অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী
গেল ১৫ই জুলাই ছিল ২০১৬ সালে তুরষ্কে যে ক্যু বা সামরিক অভ্যুত্থানটি ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল তার চতুর্থ বছর। ঐ দিনটি তুরষ্কের নিওলিবারেল রাষ্ট্র এবং সমাজ গঠনের বেদিতে বলীকৃত অপরিহার্য সমাপ্তি হিসেবেই গণ্য স্মরিত হবে। তুরষ্কের এই নব্যগঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৯৮০ সালের ক্যু-এর সাথে যা ১৯৯০ সালে আরো কিছুটা ভিত্তি পায়, এবং প্রক্রিয়াটি অবশেষে বড় পরিসরে হলেও শেষ হয় ‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি)’র মাধ্যমে।
তুরষ্কের বুর্জোয়া ও অভিজাত শ্রেণি যারা রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রাথমিক ভাবে সামরিক বাহিনীর উপর কর্তৃত্ব বা প্রভাব বিস্তার করেছিল, তাদের ভেতর ১৯৮০’র দশকে একটি আমূল রূপান্তর ঘটে যা আন্তর্জাতিক পুঁজির সাথে সঙ্গতি রেখেই সাধিত হয়েছিল। এই রূপান্তর একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক পতন ঘটায় যা কিনা লাঠির গায়ে লাগানো ললিপপের মতই ২০১৬ সালের ১৫ই জুলাই পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। চার বছর আগের ঐ দিনটি সেদিন ঘটে থাকা নানা ঘটনার ঘটনা শৃঙ্খলের থেকেও বেশি কিছু, যার অনেকটাই দ্ব্যর্থবোধক থেকে যাবে।
এটা সেই সব ঘটনাবলীর একটি যা কিনা জোরালোভাবেই প্রতীকী এবং তুরষ্কের গত ৪০ বছরের অতীতকে প্রতিফলিত করে। অপরাধের দায়ে অভিযুক্তরা দাবি করছেন যে তারা ভুক্তভোগী। তারপর আছেন তাঁরাও যারা নিজেদের ঘটনাপ্রবাহের ধারায় নিজেদের জয়ী হিসেবে দেখাচ্ছেন। এই উভয়পক্ষেরই আছে সমাজে ধর্মকে উত্তরণের কাজের সাথে প্রত্যক্ষ সংযুক্তি- গত ৪০ বছরের অন্যতম প্রধান ও সুস্পষ্ট ঘটনা।
তবু জুলাই ১৫ নিছকই একটা দিন নয় যা মিল্লি গোরাস-ভিত্তিক নব্য-ইসলামী জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) এবং গুলেন আন্দোলনের ভেতরকার উত্তেজনার সমন্বিত রূপ হিসেবে দেখা দিয়েছিল। সমাজে ধর্মের বৃদ্ধি গত ৪০ বছরের অন্যতম প্রধান সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কৌশলগত প্রপঞ্চগুলোর একটি। ধর্মের এই প্রসার অনেক ধ্বংস ডেকে এনেছে এবং বিদ্যমান, অন্ধকার পরিস্থিতির পরিসর বাড়িয়েছে। তবে ধর্ম শুধুই একটি ভাবাদর্শগত খোলস নয়, বরং গত ৪০বছর ধরে তুরষ্কের যে পুঁজিবাদী প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তারই এক সতীর্থ যাত্রী হলো এই ধর্ম।
কেনান এভরেন, ১৯৮০ সালের ক্যু’য়ের নেতা, ক্যু-উত্তর সংবিধানের অনুসমর্থন লাভের আশায় সংগঠিত র্যালিগুলোয় কোরান হাতে ছুটে বেড়িয়েছেন ও জনতার কাছে ভোট চেয়েছেন। ২০১৫ সাল থেকে রাষ্ট্রপতি রিসেপ তায়িপ এরদোগান নির্বাচন এবং সাংবিধানিক গণভোট আদায়ের লক্ষ্যে কোরান হাতে বড় বড় র্যালিতে অংশ নিয়েছেন। এভরেন এবং এরদোগান তুরষ্কের অর্থনৈতিক কর্মসূচীর উত্তরণে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এটা সেই অর্থনৈতিক কর্মসূচী যা একই কাঠামোর ভেতরে একজন জান্তা সামরিক নেতা ও একজন নির্বাচিত নব্য-ইসলামী নেতার যুগলবন্দী উপস্থাপন করে। এই অর্থনৈতিক কর্মসূচীই একইসাথে নির্বাচিত, অনির্বাচিত এবং বলবৎকৃত অনুশীলনসমূহ একত্রিত করার সুযোগ দিয়েছে।
বস্তুত, ১৯৮০ সালের ক্যু-উত্তর কৌশল বা স্ট্র্যাটেজি তার নিজস্ব যাত্রাপথই অনুসরণ করেছে, মধ্যখানে ২০১৬-এর জুলাই ১৫-ও ছিল একটি আত্তীকৃত যাত্রাবিরতি মাত্র। এক নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে একটি সামরিক উত্থানকে সুকৌশলে একটি পরিপূর্ণ গণতন্ত্র-বিরোধী পাল্টা অভ্যুত্থানের চেহারা দেয়া হয়। তবু গোটা ঘটনার পরবর্তী অভিঘাতকে শুধুই নিও লিবারেল যুগের ইসলামপন্থীদের প্রবণতার মাপে মিলিায়ে নেওয়াটাও ভুল হবে।
২০১৬ সালের ১৫ই জুলাই তুরষ্কে যা ঘটেছিল তা’ সেইসব রাজনীতিবিদের ঐতিহাসিক ও ভাবাদর্শগত প্রবণতাসমূহের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ যারা এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানকে ‘ঈশ্বরের আশীর্ব্বাদ’ বলেছিলেন। যাহোক, এই সঙ্গতি বা একতা কোন একতরফা প্রবণতার বিষয় নয়। তথাকথিত ‘তুর্কী-পদ্ধতির রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা’ই এই ১৯৮০ সালের ক্যু-উত্তর শাসনামলেরও জন্ম দিয়েছিল। ইতিহাসের সেসব পর্বের রাজনৈতিক অনুঘটকদের ব্যক্তিগত চারিত্র্যও এই ঘটনাবলী বিশ্লেষণে যথেষ্ট নয়।
১৯৮০-র দশক থেকে শাসক শ্রেণি যারা এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চেয়েছে এবং তুরষ্কের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বা বহি:স্থ পুঁজিবাদের ভেতরে মাঝে মাঝে বিবাদ-বিসম্বাদ দেখা দিয়েছে। তবে এটা বিভ্রান্তিকরও বটে। ভেহবি কোচের মুখে কেনান এভরেনের প্রশংসা থেকে তুরষ্ক ইউএসএইডের আজকের নৈ:শব্দ্য একাধারে যেমন পুরণো কাঠামোর ধীর পতনের ইঙ্গিতবাহী, একইসাথে তুরষ্কের মূল ক্ষমতাকাঠামো বা প্রতিষ্ঠানগুলো একই রয়েছে।
১৯৮০-এর সামরিক অভ্যুত্থান পরবর্তী শাসনামল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে ‘সন্ত্রাস দমন’ নাম্নী ডিসকোর্সের মাধ্যমে পরিচালিত করেছে। ‘পাল্টা-অভ্যুত্থান’-এর ডিসকোর্স আজকের শাসনামলকে বৈধতার পাটাতন দিয়েছে। তবু এই শাসনামল আইন ও গণতন্ত্রের একটি সত্যিকারের শুদ্ধি অভিযান চালাতে অক্ষম যা বরং প্রকৃত ক্যু-এর পরিকল্পনাকারীদের ঈর্ষান্বিত করতে পারে।
শুধুমাত্র একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রযন্ত্র তুরষ্কের পুঁজিবাদের বর্তমান অবস্থা ও অন্তর্গত অসঙ্গতির সাথে যুঝতে পারে। তবে রাষ্ট্রযন্ত্র শুধুই বর্তমানের বদলগুলোর পেছনের মৌন অপরাধী নয়, অনেকসময় এটি সহায়কের কাজও করে। অতীতেও যেমন করেছে।
বর্তমানের মূল সমস্যা হলো যে তুরষ্কে পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত সঙ্ঘাতগুলো নানা ঘাত-প্রতিঘাতের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে এমন এক বিন্দুতে পৌঁছেছে যেখানে আমাদের ‘সীমিত/নিয়ন্ত্রিত’ বুর্জোয়া গণতন্ত্র এমনকি এই পুঁজিবাদকে পরিচালনা করারও ক্ষমতা রাখে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের উদাহরণের থেকে একদম উল্টো মুখে দাঁড়িয়ে, তুরষ্কে বরং পুঁজিবাদ ও বুর্জোয়া গণতন্ত্র পরষ্পরের সহযোগী না হয়ে বরং একে অপরের সাথে বেমানান ও বৈরী ভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। এরদোগান-বাহচেলী কোয়ালিশনকে সমর্থনের বদলে, তুরষ্কের পুঁজি কাঠামো তাই এই দুই নেতাকে তাদের বিদ্যমান মেরু দূরত্বে ঠেলে নিয়ে গেছে।
মুদ্রাস্ফীতির হার গণনার ক্ষেত্রে এরদোগান সরকারের নয়া উদ্ভাবন এবং সরকারের প্রচারিত নানা অর্থনৈতিক তথ্য-উপাত্ত এমন এক স্তরে গেছে যা এই সরকারের নিজস্ব সমর্থক গোষ্ঠির বড় অংশটিই আর বিশ্বাস করেনা। তার সাথে চাড়া দিয়ে উঠছে প্রবল বেকারত্ব ও সর্বনাশা নানা অর্থনৈতিক নীতিমালা যা তুরষ্কের সাম্প্রতিক অতীতের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক শর্তমালার অধীনে সম্ভব হতো না।
তুরষ্কের লিবারেল বুর্জোয়া রাষ্ট্র একটি শুণ্যতা রেখে যায় যা ১৯৮০ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে ভরাট হতে থাকে। একেপি এই শুণ্যতাকে ‘দাতব্য’-এর মোড়কে ভরাট করতে থাকে যা সাধারণত: ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী বিভায় আচ্ছাদিত থাকে এবং আত্ম-স্বীকৃত রাজনৈতিক বিষয়ের ক্রমাগত বেড়ে চলা ব্যক্তিগত অভয়দানের ভিত্তিতে টিঁকে থাকে। এই অনুরোধ/যোগান গতিশীলতা যা কিনা সমাজের দরিদ্রতম অংশের ভিত্তি গঠন করেছিল, বর্তমানে এর অতীত সম্ভাব্যতা এবং সক্রিয়তা থেকে বহু দূরে সরে গেছে এবং আজ এত দশক পর একেপি-র সদস্যরা নিজেরাই বুর্জোয়া হয়ে গেছে।
অর্থনৈতিক ধসের ভেতরে সামনে তুর্কী সমাজের একটি বড় অংশকে প্রভাবিত করার মত যা যা আসছে, তাতে দরিদ্রদের জন্য দাতব্য সহায়তার মাধ্যমে একেপি’র অতীত গতিশীলতা অর্জনের বিষয়টি আর কাজে আসবে না।
জনতার অধিকতর অংশকে কাজে লাগানো একেপির পক্ষে দিন দিন অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তাদের ‘ভোট কমে আসা’ বা ‘ভোট ক্ষয়ে’র বিষয়টি এই আলোকেই বিচার করতে হবে।
এই প্রেক্ষিতে, সরকার তার মূল সমর্থক গোষ্ঠির জন্য কোন পুনর্বাসন প্রকল্প হাতে নেবার মত খরুচে ও কল্পনাবিলাসী কাজে সময়ের বদলে, সম্ভাব্য সব সমালোচকের উপর খড়গ হস্তে দমন-পীড়ন শুরু করেছে। এর একটি উদাহরণ হলো দেশের আইন সমিতিগুলো বিকেন্দ্রীভূত করার একটি বিল আনা যা সম্প্রতি তুর্কী সংসদে পাশ হয়েছে। অন্য পেশাজীবী পরিষদগুলো যারা প্রস্তুত হচ্ছেন তাদের আর একটি আঘাত করার জন্য প্রস্তুতিও নেয়া হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আর একটি নিয়ন্ত্রণমূলক বিল এরডোগান সরকারের এজেন্ডায় রয়েছে। এভাবেই নিয়োজিত অছি সরকার লাগামহীন ভাবে দেশ চালাচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর আইন ও নির্বাচন সংস্কারের পরিকল্পনাও চলছে।
সামাজিক রণাঙ্গনে, সরকার কিছু নতুন উদ্যোগ নিয়ে এসেছে যার মাধ্যমে সে তার সমর্থক ভিত্তির সবচেয়ে সক্রিয় উপাদানসমূহকে নিরাপদ রাখতে পারে। এই সক্রিয় সমর্থকরা ‘রাস্তার কাজের’ ডাকে সবচেয়ে দরকারি। সরকারের ‘আয়া সোফিয়া’ পদক্ষেপ এই পরিসরের ভেতরেই মূল্যায়িত হতে পারে, একটি পদক্ষেপ যা কিনা একটি বয়সের উপরে ডানপন্থী মানসের সবার কাছে একটি ‘বিশাল অর্থ’ বহন করে এবং এই ‘আয়া সোফিয়া’ পদক্ষেপ সমাজের আরো জঙ্গি অংশের চোখ ভিজিয়ে দেবে। এবং সরকারের ‘পরিবার’ নীতিকে ‘উন্নততর’ করতে সরকার ইস্তাম্বুল চুক্তি বাতিল করার অভিপ্রায় পোষন রাখছে যার মাধ্যমে নারীকে পুরুষের একটি হাতের ক্রীড়নক ছাড়া আর কিছুই মনে হবার অবকাশ থাকবে না।
এই সরকার আরো দাবি করতে থাকবে যে এটি সব নিয়মকানুন ও শর্তাদি বাতিল করছে যেন বর্তমান যে কঠিন সময় আমরা পার করছি সেটা ঠিক মত পার হতে পারি।
মূলত, এই প্রবণতা থেকেই এই সরকার সময়ে সময়ে নিল্লর্জ্জ আচরণ করে এবং ‘আয়া সোফিয়া’র মত তাসগুলো পকেট থেকে বের করে। অন্য সময়ে, তারা মানুষকে ভয় দেখানো জুয়াড়ির মত ‘খিলাফত’ শব্দটি নিয়ে পড়ে থাকে। লিবারেল বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে সরিয়ে ফেলার ঐতিহাসিক পথ- ইতোমধ্যেই এর সঙ্কুচিত আয়তন সত্ত্বেও- মূলত প্রশস্ত করা হয়েছিল ১৫ই জুলাইয়ের পর। ১৫ই জুলাইয়ে প্রদত্ত সব বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা যা কিনা ‘গণতন্ত্র এবং জাতীয় অভিপ্রায়’কে উদযাপন করেছে- সেই যাবতীয় বক্তৃতার আড়ালে ছিল বর্তমান তুরষ্কের রাষ্ট্রচালকদের রাষ্ট্রচালনার ক্ষেত্রে ভয়াবহ সঙ্কট। আর এটি এখন এক অচলাবস্থায় পরিণত হয়েছে।
তুরষ্কের বিদ্যমান ইসলামি-জাতীয়তাবাদী জোট বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত হুট করে ঘাড়ের উপর এসে বসা কোন রাজনৈতিক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নয়। বরঞ্চ এটা গত ৪০ বছর ধরে তুরষ্কের পুঁজিবাদের একটি জৈব ফসলই বলা যায়। একটি কার্যকারণমূলক সম্বন্ধ যা থেকে এই ইসলামী-জাতীয়তাবাদী জোট অনেক সুবিধা এবং তার জনসমর্থনের বিপুল অংশটি লাভ করে, একইসাথে এর ‘একিলিসের গোড়ালি’ও বটে।