- অনুবাদ: কাজী তাফসিন
ভূমিকা
করোনা ভাইরাস মহামারী প্রসঙ্গে প্রখ্যাত স্লোভেনীয় দার্শনিক স্লাভো জিজেকের প্রথম ইন্টারভেনশন বা অভিঘাত ছিল welt.de তে প্রকাশিত My Dream of Wuhan শিরোনামের লেখাটা। এই রচনা ২২শে জানুয়ারি, ২০২০ তে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও পরবর্তীতে আলোচ্য প্রসঙ্গে আরও বেশ কিছু লেখা ও সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার ওয়েবসাইটে। জিজেকের My Dream of Wuhan লেখাটির অনুবাদ করেছে কাজী তাফসিন। তাফসিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। লেখাটির অনুবাদ গত ২৮ মার্চ, ২০২০ তারিখ প্রকাশ করে বোধিচিত্ত। বোধিচিত্তের সৌজন্যে লেখাটি পুনপ্রকাশ করা হল।
মূল রচনা
করোনা ভাইরাসের মহামারী নিয়ে যেহেতু ইতোমধ্যেই অনেক লেখালেখি হয়ে গেছে—একজন অ-বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমার হাতে থাকা এই সীমিত তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আমি সর্বোচ্চ আর কি-ই বা যোগ করতে পারি? কিন্তু তবুও এখানে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়ঃ কোন জায়গায় এসে তথ্য-উপাত্ত তার গুরুত্ব হারায় আর কোথা থেকে শুরু হয়ে যায় মতাদর্শের খেল?
সবচেয়ে প্রথমে যে বিভ্রান্তিটা এসে হাজির হয় সেটা হচ্ছে: এর চেয়ে আরও বাজে রকমের মহামারী যেহেতু হয়ে চলছে, যেখানে হরেক পদের রোগ বালাইতে প্রতিদিন আরও হাজারও মানুষ মারা যাচ্ছে, তাহলে কেন আমরা করোনা নিয়ে এত অবসেশনে ভুগছি? এখানে স্পেনীয় ফ্লু নামে সুপরিচিত ১৯১৮-১৯ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর কথা স্মরণ করবার দরকারই নেই যেটাতে প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল বলে আন্দাজ করা হয়। বর্তমানেও, ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রায় ১৫০ লক্ষ আমেরিকানকে আক্রান্ত করে রেখেছে: যার মধ্যে এক লাখ চল্লিশ হাজার মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে এবং মারা গেছে প্রায় ৮ হাজার ২০০ মানুষ—কেবল এই ঋতুতেই।
এর মধ্যে একটা বর্ণবাদী ভাবালুতা তো অবশ্যই আছে—ধরুন নোংরা চাইনিজ বুড়িদের জ্যান্ত সাপের চামড়া ছাড়ানো আর বাদুড়ের স্যুপে শব্দকরে চুমুক দিয়ে খাওয়া নিয়ে আমাদের মধ্যে যতরকম ফ্যান্টাসি আছে সেগুলোর কথাই মনে করে দেখতে পারেন… কিন্তু এই মুহূর্তেই চায়নার একটা বড় শহর হয়তো সবচাইতে নিরাপদেই আছে।
কিন্তু এর মধ্যে আরও বড় একটা প্যারাডক্স কাজ করছে—পৃথিবীতে পরস্পরের সাথে আমাদের সংযুক্তি যত বাড়তে থাকবে, যেকোন একটা স্থানিক দূর্যোগ ঘটলে পুরো পৃথিবীতে এটার ভীতি আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকবে এবং অকস্মাৎ মহাদুর্ঘটনা ঘটাবে। ২০১০ সালের এপ্রিলে আইসল্যান্ডের একটা দ্বীপে আগ্নেয়গিরির সামান্য একটা অগ্ন্যুৎপাতের ফলে উৎপন্ন ধোঁয়ায় একটা মেঘের মত তৈরি হয়েছিল—যেটাকে বলা যায় পৃথিবীতে জীবের বেঁচে থাকার এই জটিল ব্যবস্থায় খুবই ছোট্ট একটা ঘটনা। কিন্তু এটার জন্য তখন পুরো ইউরোপের বিমান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে হয়েছিল—যেটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রকৃতিকে মানুষ এত ভয়াবহভাবে রূপান্তর করার পরেও শেষ পর্যন্ত মানুষ কিন্তু মাত্র একটা প্রজাতিই রয়ে গেছে।
প্রকৃতিতে এত ক্ষুদ্র একটা ঘটনা ঘটার ফলশ্রুতিতে এইযে সামাজিক-অর্থনৈতিক দিকে এত ব্যাপক প্রভাব পড়ছে সেটা আমাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের (পড়ুন, বিমান চলাচল) কারণেই হচ্ছে। এক শতক আগে এরকম কিছু একটা ঘটলে সেটা হয়তো আমাদের নজরেও আসতো না। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আমাদেরকে প্রকৃতি থেকে মুক্ত করে কিন্তু একইসাথে আমরা অন্যদিক দিয়ে প্রকৃতির খেয়ালখুশির উপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। এই বিষয়টাই একইভাবে করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে হয়েছে: যদি এই ভাইরাসের কাহিনীটা চীনে ডেন জিয়াও পিংয়ের আমলের আগে হত, তাহলে আমরা কেউই হয়তো এটা নিয়ে খুব বেশি কিছু একটা জানতামই না।
তাহলে আমরা কিভাবে এই ভাইরাসকে টেক্কা দিব যখন এটা কিনা প্রতিনিয়ত গুণিতকের আকারে একটা অদৃশ্য পরজীবীর মত ছড়িয়ে পড়ছে, যেন এটা একটা ‘জ্যান্তে মৃতের’ মতন ভুতুড়ে জিনিস (entity) যেটার কার্যকলাপ এখনও আমাদের অজানা। এই অজ্ঞানতাই প্যানিকের কারণ: যদি ভাইরাসটা হিসাবমত রাস্তায় পরিবর্তিত না হয় এবং বিশ্বব্যাপী এক সত্যিকার মহাদুর্ঘটনা ঘটায়, তাহলে কি হবে?
[তবে] আমার নিজের দুশ্চিন্তা হচ্ছে: যদিও এখন অব্দি এটার প্রভাব একটা সীমার মধ্যে আছে, তবুও আমাদের অথোরিটির প্যানিক করা কি এই কারণে যে এই ভাইরাসের সম্ভাব্য মিউটেশন (পরিবর্তনের গতিবিধি) নিয়ে তারা এমন কিছু একটা জানে যেটা তারা লুকাতে চাচ্ছে জনগণের বিশৃঙ্খলা আর অবরোধ/সভা সমাবেশের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে?এখানে একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পৃথকীকরণ (আইসোলেশন), নতুন নতুন দেয়াল তোলা এবং কোয়ারেন্টাইন করতে থাকা আসলে কোনো কাজেই আসবে না। এইক্ষেত্রে দরকার সম্পূর্ন শর্তহীন ঐক্য আর বিশ্বব্যাপী সমন্বিত প্রতিক্রিয়া; দরকার একটা নতুন সুরৎ যেটাকে একসময় বলা হত কমিউনিজম। যদি আমরা এই পথে না এগোই, তাহলে আমাদের পুরো পৃথিবীটা হয়তো দেখতে এখনকার উহান শহরের মতনই হবে।
ইতোমধ্যেই অনেকগুলো ডিস্টোপিয়াই আছে একই ধাঁচের একটা ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়: যেখানে আমাদের সবাইকে বাসায় বসে থাকতে হবে, কম্পিউটারে বসে বসে কাজ করবো, ভিডিও কনফারেন্সে যোগাযোগ করবো আর বাসায় বানানো অফিস রুমের কোণায় পড়ে থাকা মেশিনে ফিটনেস মাপাবো, মাঝে মাঝে স্ক্রিনে হার্ডকোর সেক্সের ভিডিও দেখে দেখে মাস্টারবেট করে নিবো আর তারপর ডেলিভারীতে খাবারের অর্ডার করবো…
কিন্তু যাইহোক আমার এই দুঃস্বপ্নের মধ্যে কিন্তু একরকম মুক্তির সম্ভাবনাও লুকিয়ে আছে। এখানে এসে আমাকে বলতেই হচ্ছে যে, বিগত কয়েকদিন যাবত আমি উহান শহরে এই অবস্থায় ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। এই অর্ধপরিত্যক্ত বড় শহরের রাস্তাঘাট—যেখানে প্রতিদিনকার ভিড়বাট্টার কেন্দ্রগুলো এখন একটা ভুঁতুড়ে জায়গায় পরিণত হয়েছে, দোকান খোলা থাকলেও নেই কোনো খরিদ্দার, আছে কেবল দু’একজন উদাসী পথচারী কিংবা আর এদিক সেদিক পড়ে থাকা গাড়িগুলো—কি নিজেই আমাদেরকে একটা ভোগবাদহীন পৃথিবীর কথা মনে করিয়ে দেয় না? সাংহাই কিংবা হংকংয়ের রাজপথের শুনশান এই বিষাদগ্রস্থ সৌন্দর্য আমাকে মনে করিয়ে দেয় On the Beach-এর মতন কিছু পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপ্টিক মুভির কথা—যেখানে কিনা অধিকাংশ মানুষ নাই হয়ে গেছে বড় কোনো ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়াই; যেন এই দুনিয়ার সবকিছু যেমন আমাদের হাতের কাছে সদাপ্রস্তুত ছিল তেমনটা আর নাই।
বরং দুনিয়াটা আমাদের অপেক্ষায় আছে, আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে আর আমাদের জন্য তাকিয়ে আছে… এমনকি রাস্তায় দাঁড়ানো সেই সাদা মাস্ক পড়া লোকগুলি তাদের এই ছদ্মবেশকে রীতিমতো বরণ করেই নিবে, যেহেতু এই মাস্ক তাঁদেরকে সামাজিক পরিচিতি পাবার জন্য প্রতিদিনকার যে চাপ ছিল সেটা থেকে রীতিমতো মুক্তি দিয়েছে।
মৃত সময়— মানে সত্তার এইযে নিজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া বা প্রত্যাহার করে নেয়া [২], যেটাকে পুরানা মরমীবাদীরা বলেছিলো Gelassenheit (গেলাসেনহাইট)[১] বা খালাস হওয়া— সেই বিষয়টাই এখন পারবে আমাদের প্রতিদিনকার এই অভিজ্ঞতাগুলোকে চাঙ্গা করতে। আর করোনাভাইরাসের আরো একটা পরিণাম হিসেবে যে কেউ আশা করতেই পারে যে, এই মৃত সময়টা হয়তো চায়নার শহুরে মানুষের দৈনন্দিনকার নন-সেন্স চিন্তাভাবনা আর ব্যস্ততা থেকে খালাস পাবার একটা অছিলা হয়ে দাঁড়াবে।
এদের এই দ্বিমুখী আচরণের(শাসকদের স্বচ্ছতা নিয়ে যা ইতোমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে) বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ থেকেই চীনের রাজনীতিতে নতুন একটা পটপরিবর্তন হবে।
[১] Gelassenheit জার্মান ভাষার শব্দ। শব্দটা পাওয়া যায় পরের দিকের হাইডেগারের অপ্রকাশিত কিছু লেখাপত্রে। এই অপ্রকাশিত লেখাগুলো Country Path Observations(২০১০) বইয়ের প্রথম লেখাটায় পাওয়া যায়। এখানে একজন বিজ্ঞানী, পণ্ডিত এবং দিকনির্দেশকের সাথে পারস্পরিক কথা চালাচালির সময় চিন্তা’র কাজ কি এবং চিন্তা’র সারসত্তা কি এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে Gelassenheit শব্দটা প্রাসঙ্গিক হয়েছিল।এই শব্দটা হাইডেগার নিয়েছে খ্রিস্টান মিথোলজিস্ট এখার্টের থেকে।