অনুবাদ: তৌকির হোসেন
আমরা সবসময়ই শুনে থাকি বর্তমানে আমরা এক ড্রামাটিক, ট্রমাটিক রাজনৈতিক, সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে বসবাস করছি। এক অর্থে এটা সত্য। পূর্ব ইউরোপ, রাশিয়ার কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা ধসে পড়েছে, নতুন এক ঘরানার ইউরোপিয়ান রাজনৈতিক পরিচয়ের আবির্ভাব ঘটেছে, নতুন নতুন প্রযুক্তির আগমনের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হচ্ছে। সেই সাথে জাতীয়, জাতিসত্তার পরিচয়গুলো সারা পৃথিবীজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে— যার ফলাফল যুদ্ধ, গণহত্যা। এইসবই ইঙ্গিত দেয় আমাদের সময় আসলে একটা র্যাডিকেল পরিবর্তনের সময়।
আবার অন্যদিকে, কেউ যদি বলে, আসলে তেমন কিছুরই পরিবর্তন ঘটেনি— তাকেও মাফ করে দেওয়া যায়; কারণ সে ভুল কিছু বলছে না। একই ধরনের কর্তৃত্ব, প্রতিষ্ঠানভেদে বৈষম্য, স্তরায়ন বারবার কেবল পোশাক, ছদ্মবেশ পাল্টে আসছে যাচ্ছে। কিংবা আরও চতুর ছদ্মবেশ ধারণ করছে। এমনকি যদি আমরা একটু ঘাঁটি, দেখব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ব্যাপক এবং জনপ্রিয় প্রতিরোধের পর কিংবা কিছু ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠীকে উৎখাতের পর, সবসময়ই একটা নতুন ধরনের আরও বেশি নিপীড়নমূলক শাসন জেঁকে বসে। সবসময়ই এক নতুন ক্ষমতার ডিসকোর্স পুরোনো ডিসকোর্সকে সরিয়ে নিজেকে জায়গা করে নিতে তক্কে তক্কে থাকে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী বা দক্ষিণ আফ্রিকার শহুরে কিংবা রাশিয়াতে জেল খাটছে এরকম একজন মানুষ অথবা আমেরিকাতে ধুঁকতে থাকা একজন লাতিনো ‘অবৈধ অভিবাসির’ কী আসে যায় যদি তাদের শাসনরত বর্তমান প্রভুর জায়গায় নতুন প্রভু আসে? একজন মানুষ তখনও কর্তৃত্বের জালেই আটকা পড়ে থাকবে। প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলন এবং ডিসকার্সিভ শাসনতন্ত্রের ধারাক্রম খুব সুষ্ঠুভাবে এই জাল গড়ে দিয়েছে। এইসব একজন ব্যক্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা এবং শাসনতন্ত্রের সাথে আটকায়ে রাখে এবং প্রান্তিক করে দেয়। অনিবার্যরূপে দেখা দেয় ব্যক্তির এক শোষিত পরিচয় । ক্রমবর্ধমান উন্নত প্রযুক্তি আরও কঠোর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং খুব নিখুঁতভাবে জটিল উপায়ে একজন ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করবার নানা পথ তৈরি করতে থাকে। প্রযুক্তি, নিয়ন্ত্রণ যেন হাতে হাতে রেখে চলে। একদিকে স্বাধীনতা পাওয়া গেলে অন্যদিকে কর্তৃত্ব কায়েম হবার পথ সাথে সাথেই খুলে যায়। সুতরাং, ব্যাপক বৈশ্বিক পরিবর্তনের সাথে সাথে অনিবার্যভাবে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের তীব্র, কঠোর প্রকাশও সত্য। হয়তো ফ্রিডরিখ নীটশে ইতিহাসের ব্যাপারে ঠিকই বলেছিলেন— ইতিহাস হচ্ছে ‘এক খাপছাড়া শাসনের খেলা’।
অবশ্যই এটা বলা হচ্ছে না, বৈশ্বিক মাত্রায় বিভিন্ন ধরনের কোন পরিবর্তন আসেনি। এমনকি এটাও বলা হচ্ছে না, সমস্ত ধরনের শাসনতন্ত্র, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের আদল অতীতের মতই একই মাত্রায় শোষণমূলক। যদি কেউ এইরকম অর্থ বানায়— দক্ষিণ আফ্রিকার বৈষম্যোত্তর শাসনব্যবস্থা অথবা ধসে পড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের এখনকার নতুন সরকার (অতটাও নতুন না), যাদের তারা প্রতিস্থাপন করেছে, তাদের মতই ক্ষমতাশালী কিংবা অত্যাচারী— তবে তা হবে হাস্যকর এবং অপমানজনক। আমাদের অন্তত একবার হলেও সেই বিশুদ্ধতর, সর্বজনীন বিপ্লবী তত্ত্বের বিপজ্জনক ভুলে পা ফেলা বন্ধ করতে হবে। ওই ধরনের বিপ্লবী কৌশল আসলে সেই কর্তৃত্বকেই আবার নিশ্চিত করে যাকে বিপ্লব নিশ্চিহ্ন করতে চায়। বলশেভিক বিপ্লব এটার একটা ভালো উদাহরণ। আমার বক্তব্য হচ্ছে, বিপ্লব বলতে সর্বজনীন এবং বর্তমান খতরনাক অবস্থা থেকে পরিপূর্ণ মুক্তির যে ধ্যানধারণা তা পরিহার করা আবশ্যক। আর ক্ষমতার এইরকম বারবার ফিরে আসাকে ইঙ্গিত করার মাধ্যমে আমি নিজেকে নৈরাশ্যবাদী বা অদৃষ্টবাদীও প্রমাণ করছি না। বরঞ্চ, ক্ষমতার এই রিয়েলিটি হচ্ছে এমন কিছু যাকে উপেক্ষা করা সম্ভব না।
মার্ক্সবাদ কিংবা বিভিন্ন তত্ত্ব একটা লম্বা সময় ধরে ক্ষমতাকে ‘বস্তুবাদী’ ব্যাখার মধ্যে আবদ্ধ করে রাখার একটা অভ্যাস চালু রেখেছে। এর চেয়ে ক্ষমতাকে স্রেফ ক্ষমতা হিসেবেই আমরা দেখতে পারি এবং দেখা উচিত। একে পুঁজিবাদী অর্থনীতি কিংবা শ্রেণি-সম্পর্কের উপজাত হিসেবে ট্রিট করলে বরং এর বিস্তারকেই ছোট করে দেখা হয়। ক্ষমতাকে খোদ ক্ষমতার ওয়াস্তেই বিচার করা উচিত। এবং এটিই ব্যাখার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া দরকার। এজন্যেই ক্ষমতার ফেরত আসাকে, ক্ষমতাকে বোঝার খাতিরেই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ‘ফেরত আসা’ বা রিটার্ন অফ পাওয়ার মূলত লাকাঁর ‘পুনরাবৃত্তি’ বা রিপিটিশনের অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। লাকাঁর মতে, রিয়েল বা সত্য হচ্ছে সেটাই যা সবসময়ই একই স্থানে বারবার ‘ফেরত আসে’। সাধারণ সিম্বলিক ভাষাজগতের দুনিয়াতে লাকাঁর জন্যে রিয়েল সবসময়ই মিসিং। রিয়েল হচ্ছে এমনকিছু যা বলা যায় না, কল্পনা করা যায় না। সুখের ব্যাপারটিই ধরা যাক। কেউ নিজেকে কোন কাজের মধ্যে ব্যস্ত রেখে কল্পনা করতে পারে কিংবা কথাবার্তায় ব্যক্ত করতে পারে আমি এই এইভাবে সুখি। কিন্তু তার যে সুখ তা কি সে দেখাতে পারে কিংবা আমরা কি ধরতে পারি বা পরিপূর্ণভাবে বুঝতে পারি? অর্থাৎ, সুখ হচ্ছে এমন একটি বিষয় যা বোঝানো/বলা/লেখার পরও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। তেমনি ক্ষমতাকেও নানাভাবে বোঝার চেষ্টা করলেও কেবল ক্ষমতার প্রকাশ সম্পর্কে আমরা মোটামুটি একটা ধারণা পেতে পারি। কিন্তু, ওই যে ক্ষমতা, তার রিয়েল রূপ, আমাদের কল্পনার মধ্যে বোঝা দুষ্কর ব্যাপার। না বোঝা গেলেও ক্ষমতা, সুখ, সবকিছুরই একটা রিয়েল জগত রয়েছে যা থেকেই যায়। এক অর্থে যেখানে কল্পনার শেষ সেখানেই রিয়েলের উৎপত্তি। যেকোন কিছুর রিয়েল সবসময়ই একই জায়গায় ফেরত আসার দরুণ রিয়েলকে সিম্বলিক অর্থে ডিফাইন করতে গেলে আসলে পুরো ডেফিনিশনই ক্ষতির মুখে পড়ে। তখন আমরা ওই রিয়েলকে বা কোনকিছুর সত্যরূপ আর ভালো করে বুঝতে পারি না। লাকাঁর ভাষায়, রিয়েল হচ্ছে সেইটাই যা পূর্বের স্থানে বারবার ফেরত আসে— সেই স্থান যার ব্যাপারে আমরা যতটুকু পর্যন্ত চিন্তা করতে পারি, অন্তত আমাদের চিন্তাভাবনার সামর্থ্যের ভেতর, সিম্বলিক ভাষাজগতের অভাবের ভেতর। রিয়েল এবং তার সিম্বলিক ভাষাজগতে যে অভাব রয়েছে তার মধ্যকার জটিলতা আমরা পরে আলোচনা করব। তবুও আমরা অন্তত বলতে পারি ক্ষমতা হচ্ছে লাকাঁর রিয়েলের একটা রূপ। ক্ষমতা অবশ্যই এবং অবশ্যই তার আগের স্থানেই ‘ফেরত আসে’ যদিও এই ক্ষমতাকে হটানোর জন্যে নানা প্রচেষ্টা থাকতেই পারে। তবুও এই ক্ষমতা সবসময়ই আমাদের তাড়িত করে, পীড়া দেয় কারণ এটাকে আমরা পুরোপুরি ডিফাইন করতে পারি না, কারণ রাজনৈতিক ডিসকোর্সে এর যে উপস্থিতি আছে তাকে নানাভাবে অস্বীকার করা হয়, এমনকি সেই রাজনৈতিক ডিসকোর্সগুলোতেও, যেখানে ক্ষমতাকে সরানো অন্যতম একটা লক্ষ্য হিসেবে হাজির করা হয়ে থাকে; ক্ষমতা অবশ্যম্ভাবীভাবে সেখানেও হাজির।
এই আলোচনার অর্থ এই নয় যে, আমরা ক্ষমতার নতুন একটা ডেফিনেশন দিব, এ যাবৎ যেই সহিহ ডেফিনেশন আমরা পাইনি। বরং, আমরা স্বীকার করছি, ক্ষমতা হচ্ছে বিমূর্ত বা এ্যাবস্ট্রাক্ট এবং যাকে ডিফাইন করা যায় না। এবং আমরা প্রথাগত ডেফিনেশনের বিরোধিতা করেই ক্ষমতার নতুন এক ধরনের ডেফিনেশন তৈরি করার চেষ্টা করব। ক্ষমতা কী— এই জায়গা থেকে শুরু করার চেয়ে, বিপ্লব, বিদ্রোহ, প্রতিরোধের নানা তত্ত্ব, চিন্তাভাবনা কিভাবে ক্ষমতাকে ধ্বংস করতে যেয়ে ক্ষমতাকেই প্রতিষ্ঠা করে— সেই বিশ্লেষণের দিকে নজর দেয়াই কাজের কাজ হবে। যেই যুক্তি আমাদের দেখায় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের পুনরাবির্ভাব ঘটে এবং তাকে আমি বলছি ‘ক্ষমতার স্থান’। স্থান বলতে এখানে বিমূর্ত/এ্যাবস্ট্রাক্ট অবস্থা, মিনিংফুল, অনিঃশেষ, বারবার ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ধ্বংস করবার প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা বোঝানো হচ্ছে। রিয়েল ‘সবসময়ই একই স্থানে ফিরে আসে’ এবং রিয়েলের এই ‘স্থান’ কিংবা আরও ভালো করে বললে রিয়েলের এই ‘ফেরত আসার’ যুক্তির ব্যাপারে আমি কথা বলছি। এই যুক্তি এক অর্থে অবশ্যই ক্রিপি, নিষ্ঠুর ধরণের যুক্তি। কিন্তু এই যুক্তি গুরুত্বপূর্ণ যদি আমরা রাজনীতির ব্যাপারে চিন্তা করতে যাই।
সুতরাং, এইসবের আলোকে আমরা কিভাবে সদ্য অতীতের এবং বর্তমানে ঘটে চলা রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনগুলোকে প্রত্যক্ষ করতে পারি? একদিকে আমরা বলতেই পারি, এই পরিবর্তনগুলো আসলেই ড্রামাটিক। কিন্তু এইগুলো আসলে দেখায় আমরা এখনও এসেনশিয়ালিস্ট ধারণা এবং রাজনৈতিক ধারণা যা গত দুই শতাব্দী ধরে আমাদের চিন্তাভাবনাকে প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে তার সাথে যুক্ত। যেমন, ১৬৪৮ সালের ওয়েস্টফেলিয়ার চুক্তির মাধ্যমে কিংবা আরও স্পষ্ট করে বললে ফরাসি বিপ্লবের পর থেকেই যে জাতিরাষ্ট্রের ধারণার উৎপত্তি হতে শুরু করেছে এবং যা এখন প্রতিষ্ঠিত, তা থেকে আমরা এখনও বের হতে পারি নাই। জাতিগত পরিচয়ের জন্যে ধ্বংসাত্মক, নিষ্ঠুর যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া এখনও আমাদের দেখিয়ে দেয়, আমরা কিভাবে এই জাতিরাষ্ট্রের ধারণার সাথে সংযুক্ত। আমরা এখনও মনে করি, প্রতিটির জাতির আলাদা রাষ্ট্র থাকাটাই শ্রেয়। এই অর্থে, রাষ্ট্রের ধারণাকে ক্ষমতার স্থানের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা যায়। যেই স্থানে রাষ্ট্র আসে, শূন্যস্থান পূরণ করে। স্পষ্টরূপে তাই এখনও আমরা এসেনশিয়ালিস্ট জাতিগত পরিচয়ের মধ্যে আটকা পড়ে আছি। একজনের এসেনশিয়ালি ক্রোট কিংবা সার্ব কিংবা আলবেনিয়ান কিংবা হুতু কিংবা ইউরোপিয়ান পরিচয় এবং যার মাধ্যমে একজন অন্যের বিপরীতে নিজেকে তুলে ধরে বা বুঝতে চায়— অন্যরা কম শুদ্ধ, কম শিক্ষিত, কম এনলাইটেনড, কম র্যাশনাল, কম পরিশ্রমী— এইসবের চিহ্ন এখনও স্পষ্ট চারপাশে। যে সমস্ত পরিবর্তন অন্তহীনভাবে চাউর হয়েছে, জন্মলাভ করেছে সেইসব কেবল এই এসেনিশিয়ালিস্ট জাতীয়তাবাদী পরিচয়গুলোকেই শক্তিশালী করেছে।
এসেনশিয়ালিজমের সমস্যা জাতীয়তাবাদের সমস্যা থেকে আরও বিস্তৃত। দেখা যায়, এসেনশিয়ালিস্ট ধ্যানধারণা রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের পরিচয় প্রকৃতিগত কিংবা প্রকৃতিগতভাবে সত্য এইরকম পরিচয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এসেনশিয়ালিস্ট পরিচয় তাই অবধারিতভাবে মানুষকে সীমার আওতায় নিয়ে আসে, তার বাস্তবতাকে কিছু নির্দিষ্ট নিয়মকানুনের সাপেক্ষে তৈরি করে এবং সে যে পরিবর্তিত হতে পারে কিংবা নিজের ইচ্ছায় ‘হয়ে উঠতে পারে’ সেই সম্ভাবনাগুলোকে রূদ্ধ করে দেয়। এছাড়াও বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার ধারাক্রম মানুষকে শাসন করতে থাকে বিভিন্ন মাত্রায়, বিভিন্নভাবে যাকে এসেনশিয়ালিস্ট যুক্তির মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়। এটা বুঝতে হলে সমাজ এবং পরিবারের কল্যাণকর এবং শাস্তিমূলক উপায়সমূহের দিকে নজর দিলে আর বেশি কষ্ট করা লাগে না। ‘অপরাধী’, ‘কল্যাণ—নির্ভর’, ‘অনুপযোগী অভিভাবক’— এইরকম পরিচয় তৈরি করে দেওয়ার মাধ্যমে একজন মানুষের সত্তাকে নতুনভাবে তৈরি করা হয়, তাকে আলাদা করে দেওয়া হয়। এই এসেনশিয়াল পরিচয়ের দ্বারা তখন মানুষকে বিভিন্ন র্যাশনাল এবং নৈতিক আদর্শের মাপকাঠির সাপেক্ষে বিচার করা হয়।
বিশ্বজুড়ে যেসব পরিবর্তন এসেছে তা মানুষের পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনাকে অস্বীকৃতি জানায়। এসেনশিয়ালিস্ট ধ্যানধারণা ব্যক্তিকে নৈতিক এবং আচরণের আদর্শিক মাপকাঠির ভিতরে টেঁসে ধরেই কেবল সীমাবদ্ধ করে না বরং এই মাপকাঠির আওতায় যে সমস্ত পরিচয় এবং আচার—আচরণ পড়ে না তাকে ঝেঁটিয়ে বের করে দেয়। তাদেরকে ‘অস্বাভাবিক’, ‘বিপথগামী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যেন তারা ‘অন্য’ বা বিপরীত এবং তখন তাদের বিপথগামী হওয়ার জন্য শাস্তির সম্মুখীন করা হয়। এসেনশিয়ালিজমের যুক্তি এক ধরণের বিপরীতধর্মী চিন্তা আনয়ন করে যেখান থেকে বাইনারি শ্রেণিকরণ তৈরি হয়: স্বাভাবিক/অস্বাভাবিক, পাগল/সুস্থ, বিষমকামি/সমকামি ইত্যাদি। এইরকম কর্তাগিরি কেবল ওই মানুষগুলোকেই ইঙ্গিত করে না যারা আদর্শচ্যুত হয়েছে (সমকামি, মাদকাসক্ত, অপরাধী, পাগল ইত্যাদি) এটা তাদেরকেও আক্রান্ত করে যাদের একটু হলেও আদর্শচ্যুতি ঘটেছে (যাদের পরিচয় আদর্শের ভিতরই কিন্তু যেহেতু তারা কিছু দিক দিয়ে ঠিকঠাক হতে পারেনি, তাই তাদের সাইজ করা দরকার) কারণ আইডেন্টিটি কখনোই সম্পূর্ণ না বরং এটা একটা প্রক্রিয়ার মতো চলতেই থাকে। কমবেশি আমরা সবাই এই স্বাভাবিকতার স্বৈরশাসনের ভিতর, কর্তৃত্বের ডিসকোর্সের (যা ইঙ্গিত করে আমাদের সবার এসেনশিয়াল পরিচয় আছে এবং সেটাই আমরা) মধ্যে সাফার করি। এবং যদি ভাবি এই কর্তৃত্বের পুরোটাই আমাদের উপর চাপানো তা হলে ভুল হবে। এর কিছুটা সত্যও বটে তাতে কোন সন্দেহ নাই— জেলখানা, পাগলাগারদ, সেনাবাহিনী, হাসপাতাল, কর্মক্ষেত্র— একটা এসেনশিয়াল পরিচয় প্রদান করে যা আমরা স্বেচ্ছায় মেনে নিই। ক্ষমতার এই ধরন আমাদের সম্মতি ছাড়া চলতে পারে না, আমাদের অধীন থাকার খায়েশ ছাড়া চলতে পারে না। তাই, এই আলোচনা কিভাবে এসেনশিয়ালিস্ট ডিসকোর্স এবং পরিচয়সমূহের মধ্যে কর্তৃত্ব বহমান থাকে, কিভাবে তা প্রতিষ্ঠানসমূহকে যেমন— রাষ্ট্র, জেলখানাকে শাসন করতে সাহায্য করে তা নিয়েই কেবল থাকবে না, বরং এটা এও দেখাবে কিভাবে আমরা নিজেরাই কর্তৃত্বের বিস্তারে অংশগ্রহণ করি নিজেদেরকেই দমন করতে।
এসেনশিয়ালিজমের সমস্যা আমাদের সময়ের রাজনৈতিক সমস্যা। পার্সোনাল ইজ পলিটিক্যাল— এই কথা যদিও খুব ক্লিশে শোনায়, কিন্তু এই কথা এও বোঝায় আমাদেরকে এসেনশিয়ালিস্ট ব্যক্তি হিসেবে যেভাবে যে উপায়ে গঠন করা হয়েছে তা রাজনৈতিক ইস্যু। এইখানে র্যাডিকেল কোনকিছু নাই। বরং এই প্রশ্নটিই আমাদের তোলা দরকার। এসেনশিয়ালিজম এখন সর্বজনীন এবং সর্বব্যাপী (Totalizing) রাজনীতি নিয়ে আবির্ভূত হচ্ছে, যা ক্ষমতার আধুনিক স্থানের একটা জায়গাও তৈরি করে দিয়েছে। কিংবা এসেনশিয়ালিজম এমনকিছু যাকে ঘিরে ক্ষমতার যুক্তি তৈরি হয়। আমাদের এই আলোচনার অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে কিভাবে বিপ্লবী দর্শনে (এনার্কিজম, মার্ক্সিজম) এসেনশিয়ালিস্ট ধ্যানধারণা জড়িত থাকার ফলে একই ধরনের কর্তৃত্বের পুনরাগমন ঘটায় যা ছিলো তাদের উৎপাটনের মূল লক্ষ্য। এসেনশিয়ালিস্ট ধারণার মধ্যে দিয়েই আধুনিক ক্ষমতা আবর্তিত হয়। তাই যদি প্রকৃত অর্থেই প্রতিরোধ গড়তে হয়, প্রকৃত অর্থেই পরিবর্তন আনতে হয় তাহলে এসেনশিয়ালিস্ট চিন্তাভাবনাকে এড়াতে হবে। তাই বর্তমান সময়ের পরিবর্তনগুলো যতই ড্রামাটিক হোক না, এই পরিবর্তনের ভেতর আমরা নিজেদের খুঁজে পাই এসেনশিয়ালিস্ট চিন্তাচেতনার সাথে আবদ্ধরূপে— জাতীয় পরিচয়, সার্বভৌমত্বের নানা পরিচয়, রাষ্ট্রীয় সুবিধা ইত্যাদি এখনও আমাদের ছেড়ে যায়নি। এই পরিবর্তনগুলো এই বিভাজনগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে না বরং রাজনৈতিক ডিসকোর্স, সামাজিক বাস্তবতার ভিতরে আরও গভীরভাবে যুক্ত করে।
তাছাড়া, আধুনিকতা/মডার্নিটি আর সবকিছুর মতই একটা প্যারাডক্স। হাজার রকমের ব্যাখা, হাজার রকমের ফলাফল, কন্ঠস্বর, স্বপ্ন আধুনিকতাকে ব্যাখা করে, বিশিষ্টতা দান করে। এখন যে পরিবর্তনকে আমরা এক চোখে দেখি ওই পরিবর্তনই আর কয়েক বছর পর ভিন্ন চোখে দেখতে শুরু করব। যে পরিবর্তন রাজনৈতিক স্তরায়নকে দৃঢ় করে শোষণের পথ ত্বরান্বিত করে, সেই পরিবর্তনই আবার প্রতিরোধের পথ দেখায়। যে পরিবর্তন আমাদের পরিচয়ের মাপকাঠিকে সীমায়িত করে সেটিই এক সময় সীমাহীন স্বাধীন পরিচয়ের সম্ভাবনা তৈরি করে। আমার কাছে স্বাধীনতা একটা স্বচ্ছ ধারণা যেখানে প্রায়শই কর্তৃত্বের নানা তরিকা চালু থাকে। আবার এই স্বাধীনতাকে ক্ষমতার মতই ডিফাইন করা যায় না। তাই একে নানাভাবে দেখার সুযোগ রয়েছে, আর তাই এর সম্ভাবনাও সীমাহীন।
ক্ষমতার মতই স্বাধীনতাকে রিয়েলের সাপেক্ষে দেখা যেতে পারে: যা সবসময়ই তার মাত্রা এবং একে ঘিরে প্রস্তুতকৃত ডেফিনেশন অতিক্রম করে যায়, আর একে রূদ্ধ করার যত কঠোর প্রক্রিয়াই নেওয়া হোক না কেন, স্বাধীনতার সম্ভাবনা সবসময়ই ফিরে আসে। সুতরাং এই সময় আমাদের সামনে এক নতুন দিগন্ত হাজির করে যেখানে আমরাই আমাদের বাস্তবতা তৈরির মালিক, যেখানে আমাদের রেডিমেড বাস্তবতা গ্রহণ করার দরকার পড়ে না। স্লাভো জিজেকের মতে, কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রগুলো যখন এক ধরনের মুক্ততা বা ওপেননেসের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেলো তখন সেই মুহূর্তে যাদের উৎখাত করা হয়েছে তাদের মতোই আরেক কর্তৃত্বপরায়ণ মঞ্চ গদিতে বসবে এরকম কোন কর্তৃপক্ষ ছিলো না। এটা হচ্ছে এক ‘মহিমান্বিত’ মুহূর্ত, যে মুহূর্তে শূন্যগর্ভে সম্ভাবনা বিরাজ করে; এটা একটি সত্যিকার অর্থেই বিপ্লবী মুহূর্ত— এক সিগনিফায়িং শাসনতন্ত্র এবং আরেকটির মধ্যকার ‘ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র’ মুহূর্ত যেখানে সম্ভাবনা ছাড়া কিছু নাই। সেই মুহূর্তে নতুন একটি কর্তৃত্ব স্থান নিতে পারে কিংবা নাও নিতে পারে— যদি সম্ভাবনার কথা বলি। এটিই হচ্ছে সেই মুহূর্ত যখন ক্ষমতার স্থান হয়ে পড়ে শূন্য। শাসনতন্ত্রের অনিবার্যতা বলে কিছু নাই, বরং শাসনতন্ত্রের সম্ভাবনা থাকে— সবসময়। একই বক্তব্য স্বাধীনতার জন্যেও। হয়তো আমরা এখন এই শূন্য স্থানে আটকে আছি, এক মহিমান্বিত মূ্হূর্তে— এক ক্ষমতার বিশ্বের পরবর্তী ‘কোনকিছু’র মধ্যবর্তী শূন্য অবস্থানে।
যদিও আমরা এখনও পুরোনো রাজনৈতিক শ্রেণিবিভাগে সীমায়িত হয়ে আছি, আমরা এই সমস্ত শ্রেণিবিভাগের সীমাবদ্ধতা ইতিমধ্যেই প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেছি। আমরা কিভাবে এই বিভাগগুলোর বাইরে পা রাখতে পারি তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা পরবর্তীতে কোথায় যাব? যদি আমরা চিন্তা করি, আমরা ‘ক্ষমতাবিহীন’ একটি বিশ্বে পদার্পন করতে চলেছি তাহলে আমরা যেই কুয়োয় আছি সেই ‘ক্ষমতাযুক্ত’ কুয়োতেই পড়ে আছি। পৃথিবীর রাজনৈতিক ভাষার একটি অংশই হচ্ছে ক্ষমতাহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা।
মনুষ্যত্বকে কেন্দ্র করে যেসব এসেনশিয়ালিস্ট ধ্যানধারণা রয়েছে তার মধ্যে এটাও আছে— স্বপ্ন দেখা, যা কেবল একটি স্বপ্নই থাকে না বরং বিপজ্জনকও হয়ে উঠে। ক্ষমতার উর্ধ্বে যাওয়া কখনোই সম্ভব না, যা সম্ভব ক্ষমতাকে সীমিত করে তোলা। অন্তত এটাকে এমনভাবে সাজানো যাতে কর্তৃত্বের আশঙ্কা দূর করা যায়। বিভিন্ন উপায়ের মধ্যে এরকম একটা হচ্ছে এসেনশিয়ালিস্ট এবং সর্বব্যাপী (Totalizing) যুক্তিগুলোর সমালোচনার মাধ্যমে আগানো।
আমরা ক্ষমতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারি— এইরকম ধারণা বিপরীতধর্মী ম্যানিকিয়ান যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই যুক্তি একটি এসেনশিয়াল লাইন টানে মনুষ্যত্ব এবং ক্ষমতার মধ্যে। এনার্কিজমের দর্শনের ভিত এই যুক্তির উপরই। এটি মনুষ্যত্বকে দেখে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দ্বারা শোষিত, পীড়িত হিসেবে। যদিও মনুষ্যত্ব এই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দিয়ে পুরোপুরি দূষিত না হতেও পারে। কারণ, এনার্কিজমের মতে মানুষের অবস্থান (প্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা চালিত) পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবেই আগত যা র্যাশনাল এবং নৈতিক। কিন্তু রাষ্ট্র একটা কৃত্রিম ক্ষমতার দুনিয়ার মধ্যে হাবুডুবু খায়। তাই মনুষ্যত্ব এবং রাষ্ট্র পরস্পর দুই বিপরীত অর্থ নিয়ে দুই দুনিয়াতে বসবাস করে। এনার্কিজমের তাই রাষ্ট্রের দূষণ থেকে মনুষ্যত্বের দিকে প্রস্থানের সুযোগ আছে। তার ক্ষমতা দ্বারা দূষিত না হওয়ারও সুযোগ আছে। এসেনশিয়াল অর্থ থেকে এটাও ধরে নেওয়া যায় ক্ষমতা অস্বাভাবিক, ইর্যাশনাল, অনৈতিক। আগেকার রাজনৈতিক তত্ত্বের আলোচনায় এই মনুষ্যত্বের অদূষিত প্রস্থানের সুযোগ বা সম্ভাবনা বারবার ফিরে ফিরে আসতো। ক্ষমতার সমালোচনার জায়গা হিসেবে এটি ছিলো একটি মোক্ষম হাতিয়ার। তা হোক রাষ্ট্রের ক্ষমতা, পুঁজিবাদী অর্থনীতির ক্ষমতা, ধর্মের ক্ষমতা ইত্যাদি। মানুষের অদূষিত হয়ে যদি ক্ষমতার দুনিয়া থেকে বের হওয়ার সুযোগই না থাকতো তাহলে ক্ষমতার বিরুদ্ধে যেকোন প্রতিরোধ, বিদ্রোহ সম্ভবই হতো না বলেই মনে হয়। যদি বের হওয়ার কোন জায়গা না থাকে, তা হলে প্রতিরোধ, বিদ্রোহের কি অর্থ থাকে? প্রতিরোধের যুক্তি তাহলে নিশ্চিতভাবেই র্যাশনাল, নৈতিক ধারণা থেকেই উৎপন্ন যেই প্রতিরোধকে আমরা বলতে পারি অদূষিত। প্রতিরোধ তাহলে ক্ষমতার দূষণ থেকে পবিত্র বলা যায়।
এখানেই হচ্ছে সমস্যা— যে সমস্যা আমাদের আলোচনাকে তাড়া করে ফিরবে। মনে করি, প্রাকৃতিকভাবে মানুষের যে সার, উপযোগিতা, নৈতিক, র্যাশনাল যে অবস্থান ক্ষমতার দ্বারা (যার দূষিত করার কথা ছিলো না) তা দূষিত। শুধু তাই নয়, সে নিজেই গঠিত ক্ষমতারই দ্বারা যাকে সে উৎখাত করতে চায়। আরও দেখি, এসেনশিয়াল যুক্তির কারণে, প্রতিরোধের স্থানটিও দূষিত। কেননা, আমরা ক্ষমতার দ্বারা দূষিত হলে, আমাদের প্রতিরোধের ধরন-ধারণও ক্ষমতার দ্বারা দূষিত হতে বাধ্য। এসেনশিয়ালিস্ট এবং সর্বজনীন যুক্তি-সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে বলা যায়, এক পর্যায়ে প্রতিরোধের স্থানও ক্ষমতার স্থান হয়ে পড়ে (শূন্যস্থান পূরণ করার জন্যেই)। তাই বিশুদ্ধ প্রতিরোধের জন্যে বিশুদ্ধ (ক্ষমতা দ্বারা অদূষিত) প্রতিনিধি দরকার যে ক্ষমতাকে উৎখাত করতে পারবে পুরোপুরিভাবে। কিন্তু আমরা দেখলাম, সবসময়ই আশঙ্কা থেকে যায় প্রতিনিধিই যদি দূষিত হয় তাহলে ক্ষমতার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। এনার্কিস্ট ডিসকোর্সে মনুষ্যত্ব রাষ্ট্রকে বিলোপ করবে এরকম ধরনের কথা উঠে। কিন্তু যদি এরকম হয়, মনুষ্যত্ব নিজেই ক্ষমতা দ্বারা গঠিত এবং মনুষ্যত্ব নিজেই নিজের ভেতরে কর্তৃত্বের ডিসকোর্স বয়ে নিয়ে চলে, তাহলে এনার্কিস্টদের প্রস্তাবিত বিপ্লব স্রেফ আরেকটি কর্তৃত্বতন্ত্রের দরজা খুলে দিবে যেটা বরং তারা উৎখাত করতে চেয়েছিলো। অন্য কথায়, ফিরে ফিরে আসার একই স্থানের ফাঁদে বিপ্লব ধরাশায়ী হয়ে পড়বে। এটা একধরনের তাত্ত্বিক কানাগলিতে নিয়ে যায়— যদি কোন বিশুদ্ধ প্রস্থানের পথ না থেকে থাকে যে অবস্থান থেকে, এক নিরপেক্ষ কিংবা বিশুদ্ধতার চোখ দিয়ে ক্ষমতাকে সমালোচনা কিংবা দমন করার সুযোগ না থাকে, তাহলে তো ক্ষমতার কোন এসেনশিয়াল সীমা তৈরি করা সম্ভব হবে না। তাহলে তো এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধও গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। তাহলে আর কী করা? তখন আমাদের এই বিপুল রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞ বাদ দেওয়া এবং কর্তৃত্বের অনিবার্যতায় নিজেদের সঁপে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। এটি একটা প্যারাডক্স। প্রতিরোধের অদূষিত স্থানের প্যারাডক্স।
কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সম্ভাবনার প্রশ্নটি আমাদের এই আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এনার্কিজম আর পোস্টস্ট্রাকচারালিজমের মধ্যকার আলোচনার মাধ্যমে আমরা প্রতিরোধের অদূষিত স্থানের প্যারাডক্সের আরও গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করব।
প্রতিরোধের পথ নিয়ে কথা বলা এনার্কিস্ট ডিসকোর্সের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। একজন এসেনশিয়াল ব্যক্তির অবস্থান এবং এর সাথে যুক্ত নৈতিকতা এবং র্যাশনালিটি যদি ক্ষমতার দ্বারাই গঠিত হয়ে থাকে তাহলে এইভাবে বিষয়গুলোর কোন দাম থাকে না। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার এটা এসেনশিয়ালিস্ট ধ্যানধারণা দিয়ে তৈরি। এটা নিজের কর্তৃত্ববাদের এক আলাদা ডিসকোর্স তৈরি করে যা আদতে ক্ষমতারই একটি স্থান। ক্ষমতার এই স্থান খুঁটে খুঁটে দেখতে গেলে স্টার্নার, ফুকো, দেল্যুজ, গাট্টার, দেরিদা, লাকাঁর আলোচনা জরুরি হয়ে পড়ে। তাদের আলোচনা দিয়ে দেখানো যায়, এনার্কিস্ট ডিসকোর্সের মধ্যে মানুষের যে অবস্থান তা আংশিকভাবে হলেও বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক এবং ডিসকার্সিভ শাসনতন্ত্র দিয়েই গঠিত। তাই কোন অদূষিত প্রস্থানের পথ আসলে দেখানো সম্ভবও হয় না। পোস্টস্ট্রাকচারালিজমের যে রাজনীতি তা হলো ‘সরিয়ে দেওয়ার’ রাজনীতি: যুদ্ধ, ফাঁকফোকর, বিরোধের রূপক ব্যবহার করে মানুষের অবস্থানের এসেনশিয়াল যে ঐক্য তা ভেঙেচুরে দেওয়া। দেখিয়ে দেওয়া— যা ক্ষমতার বিরোধের কথা বলে আসলে তা নিজেই ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। সরিয়ে দেওয়ার এই ধারণা আমাদের ওই তাত্ত্বিক কানাগলিতে পৌঁছায়ে দেয়— যদি ক্ষমতা থেকে প্রস্থানের তাত্ত্বিক কোন জায়গা না থাকে তাহলে ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কিভাবে যুক্তিযুক্ত হয়? এতদ সত্ত্বেও আমরা নন-এসেনশিয়ালিস্ট প্রস্থানের ভেতর দিয়ে প্রতিরোধের ডিসকোর্স তৈরি করতে পারি।
আমাদের কাজটি হবে তাই বিভিন্ন রাজনৈতিক ডিসকোর্স এবং ধ্যানধারণার মধ্যে ক্ষমতার স্থান কিভাবে থাকে তা বের করা। প্রতিরোধের এমন এক উপায় খুঁজে বের করতে হবে যা কর্তৃত্বকে পুন:প্রতিষ্ঠা করে না। এই কাজটি অরাজকে (Anti-Authoritarian) জোর দেয়। কারণ, এটি নির্দিষ্ট কোন ক্ষমতার স্থানকে গ্রাহ্য করে না। প্রতিরোধের কোন এসেনশিয়াল পয়েন্টকে অস্বীকৃতি জানায়। কেননা, প্রতিরোধের কোন এসেনশিয়াল পয়েন্ট থাকার অর্থ, তা কর্তৃত্বের ডিসকোর্সকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। সুতরাং, আমাদের আলোচনা হতে হবে এই সময়ের উপযোগী যা প্রকৃত অর্থেই অরাজ চিন্তাকে প্রাধান্য দিবে।
আমাদের আলোচনার একটি দিক— এনার্কিজম এবং পোস্টস্ট্রাকচারালিজমের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া। এটা শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে। কারণ, এনার্কিজম আর পোস্টস্ট্রাকচারালিজম দুইটির মধ্যে খুব কমই মিল আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মানবধর্ম থেকে জন্ম নেওয়া একটি বিপ্লবী দর্শন হচ্ছে এনার্কিজম। অন্যদিকে পোস্টস্ট্রাকচারালিজম (দর্শন কি বলা যায়?) এনার্কিজমের মূল ভিতগুলোকেই প্রশ্ন করে। ঠিক এই কারণেই এই দুটিকে একত্র করা হয়েছে। এদের মধ্যে মূল পার্থক্যগুলো— বিশেষত ব্যক্তির অবস্থান, নৈতিকতা, র্যাশনালাটিকে ঘিরে যে সব প্রশ্ন দুটিকে আলাদা করে দেয়, তা আসলে খোদ আধুনিকতার সমস্যাগুলোই তুলে ধরে। এই প্রশ্নগুলো আদতে আধুনিকতাকেই প্রশ্ন করে। এনার্কিজমের বিপ্লবী তত্ত্ব, যা বিভিন্ন এসেনশিয়াল শ্রেণিবিভাজনকে সরিয়ে দেয় না বরং যার উপরই ভিত্তি করে তৈরি, তা আরেকবার খুঁটিয়ে দেখা দরকার যদি আমরা এনার্কিজমের সীমা উৎরাতে চাই। মূলত, এনার্কিজম হচ্ছে ক্ষমতা বিষয়ক দর্শন। ক্ষমতার মুখোশ উন্মোচন করার দর্শন। মার্ক্সিজমের থেকে এর বিপরীত দিকটি হচ্ছে, এটি খোদ ক্ষমতাকেই বিচার-বিশ্লেষণ করে। মার্ক্সিজমের ভেতরে ক্ষমতার স্থান উন্মোচন করে দেয়। দেখিয়ে দেয়, মার্ক্সিজম রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার একটি বড় ধরণের সম্ভাবনা জারি রেখেছে। এনার্কিজম হচ্ছে এমন একটা দর্শন যা ক্ষমতার স্থানকে রাজনৈতিক ধারণা আকারে নিয়ে আসে। কিন্তু এনার্কিজম নিজেই ওই ক্ষমতার স্থানের ফাঁদে পড়ে যায়, যা আমরা পোস্টস্ট্রাকচারালিজমের সাহায্যে এসেনশিয়ালিজমের সমালোচনা করে দেখাতে পারি। পোস্টস্ট্রাকচারালিজমও ক্ষমতার মুখোশ উন্মোচন করে। ডিসকোর্স, ধারণা, চর্চার মধ্যে (যাদেরকে দেখে আপাতভাবে ক্ষমতার দূষণ থেকে পবিত্র হিসেবে ধরা হয়) কিভাবে ক্ষমতা জড়িয়ে থাকে তা উন্মোচন করে। যদিও এনার্কিজম, পোস্টস্ট্রাকচারালিজম আলাদা, কিন্তু ক্ষমতার সমালোচনা এবং মুখোশ উন্মোচন করার তাগিদেই দুইটিকে একসাথে করা যেতে পারে। তাছাড়া, যেমনটা এর আগে আমি বলেছিলাম, তাদের মধ্যকার মিলগুলো নয় বরং পার্থক্যগুলোই তাদের তুলনামূলক আলোচনাকে ইন্টারেস্টিং করে তোলে। তাই আমাদের কাজটি নেহাত এনার্কিজম আর পোস্টস্ট্রাকচারালিজমের মধ্যকার তুলনাই নয় বরং বিপরীতধর্মী ধারণাগুলোকে একত্র করা। বিপ্লবী দর্শন বর্তমানে যে সমস্ত প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে একত্রিত ধারণাগুলোর মাধ্যমে তার জবাব দেওয়া। এই তুলনা কেবল একটা অস্ত্র যার মাধ্যমে আমরা প্রশ্ন ও সমস্যাগুলো নিয়ে চিন্তা করতে পারি এবং হয়তো সমস্যাগুলোর সমাধানও বের করে নিয়ে আসতে পারি।