অনুবাদ: ইলোরা সুলতানা ও বখতিয়ার আহমেদ
সাইমন মেইর এখন ইউনিভার্সিটি অব সারি’র সেন্টার ফর দি আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব সাসটেইনেবল প্রসপেরিটি’তে প্রতিবেশ অর্থনীতির গবেষক হিসেবে যুক্তরাজ্য সরকারের অর্থায়নে ‘উৎপাদনশীলতা’ বিষয়ক এক প্রকল্পের আওতায় জন-কল্যাণ ও অর্থনৈতিক উৎপাদনের আন্ত:সম্পর্ক নিয়ে কাজ করছেন। নিজের গবেষণায় তিনি মূলত একটা বিকল্প অর্থনীতি তৈরীর উপায় খোঁজার জন্য বিদ্যমান অর্থনীতিকে বোঝার চেষ্টা করছেন। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক চিন্তার ইতিহাস, ইউটোপিয়ান অর্থশাস্ত্র, এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক মডেল। বর্তমানে তিনি উৎপাদনের বিভিন্ন তত্ত্বে শ্রম’কে কীভাবে দেখা হয় এবং কীভাবে এখানে শক্তির ব্যবহার হচ্ছে সে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। সেই সাথে প্রবৃদ্ধিহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ‘স্টক ফ্লো কনসিস্টেন্ট মডেলিং এবং ইউটোপিয়ান কল্প-কাহিনীর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়েও আগ্রহ রয়েছে সাইমনের। পাশাপাশি তিনি স্যালফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। প্রতিবেশ অর্থনীতিতে পিএইচডি করা সাইমন পরিবেশ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়েছেন। তিনি ইউরোপের প্রতিবেশ অর্থনীতিবিদদের পেশাদার সংগঠনের একজন মূল সংগঠকও।
কেমন হবে করোনার পরে পৃথিবী?
চারটা সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ
এখন থেকে ছয় মাস, এক বছর বা দশ বছরের মধ্যে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব?
রাত জেগে শুয়ে শুয়ে ভাবি আমার কাছের মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ কি? চরম ঝুঁকিতে থাকা আমার আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুদের কী হবে? আমার চাকরির কি হবে? যদিও আমি অনেকের চেয়ে অনেক ভাগ্যবান, ভাল চিকিৎসা-ভাতা পাই, এবং বাসা থেকে কাজ করতে পারি। আমি এখন যুক্তরাজ্য থেকে লিখছি, এখানে আমার এমন সব বন্ধু আছেন যারা স্বনির্ভর উদ্যোক্তা, এখন কোনরকম রোজগার ছাড়া মাস পার করছেন। এমন বন্ধু আছেন যারা এর মধ্যেই চাকরি হারিয়েছেন। আমার বেতনের শতকরা আশি ভাগ যে চুক্তির আওতায় আসে তার মেয়াদ ডিসেম্বরে শেষ হয়ে যাবে। করোনা ভাইরাস অর্থনীতিকে খুব বড় আঘাত করছে। কেউ কি আমাকে আর চাকরি দেবে যখন আমার প্রয়োজন হবে?
সামনে বেশ কয়েকটা সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। সবকিছুই নির্ভর করছে কীভাবে সরকার এবং সমাজ করোনা ভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলা করে তার উপর। আশা করি আমরা এই ক্রান্তিকাল মোকাবেলা করে আরো ভালো, আরো মানবিক ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো। কিন্তু আরো খারাপ পরিস্থিতিতেও পড়ার সম্ভবনাও কম নয়।
আমার মনে হয়, অন্যান্য সঙ্কটের রাজনৈতিক-অর্থনীতির দিকে তাকিয়ে আমরা এই পরিস্থিতি আর আমাদের ভবিতব্য বোঝার চেষ্টা করতে পারি। আমার চলমান গবেষণা আধুনিক অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলো নিয়েই: বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা, শ্রম ও মজুরি এবং উৎপাদনশীলতা। আমি দেখার চেষ্টা করছি কীভাবে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি জলবায়ু পরিবর্তন এবং নিম্ন-আয়ের শ্রমিকদের দূর্বল মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের মত চ্যালেঞ্জের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এই গবেষণায় আমি দেখাতে চেয়েছি সামাজিকভাবে ন্যায়সঙ্গত এবং প্রতিবেশগত দিক থেকে সুষম একটি ভবিষ্যতের জন্য আমাদের খুব অন্যরকম অর্থনীতি দাঁড় করাতে হবে। কোভিড-১৯ এর আবির্ভাবের পরে এর চেয়ে অনিবার্য সত্য আর কিছু হতে পারে না।
কোভিড-১৯ প্যানডেমিক বা বিশ্ব-মারী প্রতিরোধে নেয়া পদক্ষেপগুলো আর সব সামাজিক এবং প্রতিবেশগত সঙ্কটের মূলে থাকা একটা নীতিরই সশব্দ সম্প্রসারণ: এক ধরনের অর্জনকে আরেক ধরনের অর্জনের উপরে অগ্রাধিকার দেয়া। এই নীতির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে নেয়া বৈশ্বিক পদক্ষেপ নির্ধারণে।
সুতরাং, এই ভাইরাস-রোধে নেয়া পদক্ষেপগুলোর আবর্তনে আমাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হতে চলেছে?
অর্থনীতির চোখ দিয়ে দেখলে সামনে চারটা সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ আছে: ১) বর্বরতায় পর্যবসিত হওয়া; ২) বলিষ্ঠ রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ গড়া; ৩) কট্টর রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র গড়া; এবং ৪) পারস্পরিক সহায়তাভিত্তিতে গড়া বড় সমাজে রূপান্তর।
এই চার ভবিষ্যতের সবগুলোই সত্য হওয়ার সমান সম্ভবনা রাখে, সবগুলো সমান কাঙ্ক্ষিত না হলেও।
ছোটখাট পরিবর্তনে কাজ হবে না
করোনা ভাইরাসও জলবায়ু পরিবর্তনের মত যা আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি অঙ্গীভূত সমস্যা। দুটাকেই আপাত-দৃষ্টিতে “পরিবেশগত” বা “প্রাকৃতিক” সমস্যা মনে হলেও এগুলো আসলে সামাজিক কার্য-কারণ তাড়িত সমস্যা।
হ্যাঁ, এটা সত্য যে কিছু সুনির্দিষ্ট গ্যাস তাপ শোষণ করার ফলেই জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু, এটা পুরাপুরি আবছা একটা ব্যাখ্যা। জলবায়ু পরিবর্তনকে পুরাপুরি বুঝতে হলে আমাদের এর কিছু সামাজিক কারণ বুঝতে হবে, কোন সব কারণে আমরা গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করি সেটা বুঝতে হবে। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। হ্যাঁ, সরাসরি কারণটা ভাইরাস। কিন্তু এর প্রভাব মোকাবেলার ক্ষেত্রে আমাদের মানব প্রজাতির আচরণ আর তার বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বোঝাটাও জরুরী ।
কোভিড-১৯ এবং জলবায়ু পরিবর্তন, দুই সমস্যাকেই মোকাবেলা করা অনেক সহজ যদি আপনি আপনার অপ্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক কাজ-কারবার কমিয়ে দেন। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব যদি আপনি কম জিনিস তৈরী করেন, কম শক্তি খরচ করেন এবং কম গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করেন। কোভিড-১৯ এর মহামারী খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। কিন্তু এর মুল বিষয় কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের মতই সাধারণ। মানুষ মেলামেশার মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এটা প্রতিনিয়ত ঘটছে মানুষের ঘরে, কর্মক্ষেত্রে এবং চলার পথে। এই মেলামেশা কমিয়ে এনে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির সংক্রমণ কমানো সম্ভব যার ফলে মোট আক্রান্তের সংখ্যাও কমে আসবে।
মানুষের সামাজিক মেলামেশা কমিয়ে আনার পাশাপাশি তার অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ কৌশলগুলোকেও জোরদার করা সম্ভব। ছোঁয়াচে রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের একটি সাধারণ কৌশল হলো আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা এবং ঐ ব্যক্তিকে সবার থেকে আলাদা রাখা। যখন একজন আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয় তখন তাকে আলাদা করে ফেলা যাতে রোগ আরো ছড়াতে না পারে। এটা সবচেয়ে কার্যকর যখন আপনি আক্রান্তের সংস্পর্শে আসা বেশিরভাগ মানুষকেই খুঁজে বের করতে পারেন। আক্রান্ত মানুষ যত কম লোকের সংস্পর্শে আসবেন আপনি তত বেশি হারে সংস্পর্শে আসা মানুষদের খুঁজে বের করতে পারবেন।
আমরা উহানের অভিজ্ঞতায় দেখতে পাই যে, সামাজিক দূরত্ব এবং লকডাউনের মত পদক্ষেপ ভাল কাজ করে সংক্রমণরোধে। এখন রাজনৈতিক অর্থনীতিআমাদের বুঝতে সাহায্য করবে ইউরোপ এবং আমেরিকা কেন শুরুতেই এই পথ অনুসরণ করে নাই।
একটা ভঙ্গুর অর্থনীতি
লকডাউনের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে চাপ তৈরী হচ্ছে। আমরা একটা কঠিন অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। এই চাপের ফলে কিছু বিশ্বনেতা লকডাউনের মাত্রা ও পরিধি শিথিল করার কথা বলছেন। এমনকি লকডাউনের এমন পরিস্থিতিতেও উনিশটা দেশের নেতারা একসাথে বসেছেন। উনাদের মধ্যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো সমস্ত আইন শিথিল করার আহবান জানিয়েছেন। ট্রাম্প তিন সপ্তাহের মধ্যে আমেরিকান অর্থনীতি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিয়ে আসার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন (এই সামাজিক দূরত্ব যে আরো বেশ কিছুদিন মেনে চলতে হবে সেই বিষয়টি কিন্তু এখন তিনি মেনে নিয়েছেন)। বলসোনারো বলেছেন: “আমাদের জীবন চলমান রাখতে হবে। চাকুরি বাঁচাতে হবে… আমাদের অবশ্য অবশ্যই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে হবে।”
এদিকে যুক্তরাজ্যে চারদিন আগে তিন সপ্তাহের লকডাউনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন একটু কম আশাবাদী ছিলেন। তিনি বলেছেন, এই জোয়ার তার দেশ বারো সপ্তাহের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। জনসনের ধারণা ঠিক হলেও, আমরা এমন এক অর্থনৈতিক ধারার মধ্যে রয়েছি যা এই প্যানডেমিকের পরের ধাপেই ভেঙে পড়ার হুমকিতে রয়েছে।
ধ্বসের অর্থনীতির হিসাব খুব সোজা-সাপটা। ব্যবসা টিকে থাকে লাভের উপর। যদি তারা উৎপাদন করতে না পাওে, তাহলে তারা বিক্রি করতে পারবে না। এর মানে দাঁড়ালো তারা লাভও করতে পারবে না, যার ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগও কমে আসবে। যদি হাতে ব্যবসা নাও থাকে, ব্যবসা-বাণিজ্যগুলো অল্প কিছুদিনের জন্য তাদের কর্মী বসিয়ে রাখতে পারে এই আশায় যে অর্থনীতি আবার চাঙা হয়ে উঠলে তখন তাদের কাজে লাগিয়ে বাজারে ফিরতে পারবে। কিন্তু সবকিছু আরো খারাপের দিকে গেলে তারা আর সেটা করবে না। সুতরাং আরো বেশী মানুষ কাজ হারাবে অথবা কাজ হারানোর ভয়ে থাকবে। সুতরাং তারা আরো কম কেনা-কাটা করবে। ফলে পুরো প্রক্রিয়াটি চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকবে এবং এই পাকচক্রে ঘুরপাক খেতে খেতে আমরা একটা অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে ডুবে যাব।
সাধারণ সঙ্কটের সময় খুব সহজ নিয়মে সমস্যার সমাধান করা যায়। সরকার সাধারণ মানুষের ভার বহন করবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষ আবার আয় করতে শুরু করবে এবং কেনাকাটা করতে পারবে (অর্থনীতিবিদ জন ম্যানিয়ার্ড কেইনজ তার এই তত্ত্বের জন্যই বিখ্যাত)।
কিন্তু এখন এসব সাধারণ পদক্ষেপ কাজে লাগবে না কারণ আমরা এই অর্থনীতির পুনরুদ্ধার চাইনা (নিদেন পক্ষে এখনই না)। লকডাউনের মূল লক্ষ্য হলো মানুষ যেন কাজে না যায়, ভাইরাস যেন না ছড়ায়। সম্প্রতি একটা গবেষণা জানাচ্ছে যে, উহান থেকে যদি তাড়াতাড়ি লকডাউন তুলে নেয়া হতো তাহলে চীন ২০২০ সালের পরের দিকে আরেকবার সংক্রমণের শীর্ষে চলে যেত।
অর্থনীতিবিদ জেমস মিডওয়ে লিখেছেন, কোভিড-১৯ মোকাবেলা করার জন্য ব্যাপক মাত্রায় উৎপাদন বাড়িয়ে যুদ্ধকালীন অর্থনীতি চালু করা কোন সঠিক পথ নয়। বরং দরকার হচ্ছে যুদ্ধকাল-বিরোধী অর্থনৈতিক নীতি যা ব্যাপক মাত্রায় উৎপাদন কমাবে। আমরা যদি সামনে বিশ্ব-মহামারীর বিপরীতে টিকে থাকার সামর্থ্য অর্জন করতে চাই (সাথে যদি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল থেকে পরিত্রাণ চাই), তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক উৎপাদন এমনভাবে বদলাতে হবে যাতে কারো জীবিকা হারাতে না হয়।
এজন্য আমাদের প্রয়োজন খুব অন্যরকম একটা অর্থনৈতিক দৃষ্টি। অর্থনীতিকে আমরা সাধারণত নিজেদের ভোগ্যপণ্য কেনা-বেচার ব্যাপার হিসেবেই দেখি। কিন্তু অর্থনীতি তো আসলে এটা না এবং এটা হওয়াও উচিত না। অর্থনীতির মূলে আছে যেভাবে আমরা আমাদের সহায়-সম্পদগুলোকে দেখি এবং সেগুলোকে আমাদের বেঁচে থাকবার নানা উপকরণে রূপান্তরিত করি। এভাবে দেখতে পারলে অনেক সম্ভবনাই আমাদের চোখে পড়ে যেখানে অনেক কম জিনিস উৎপাদন করেও কারো দূর্দশা না ঘটিয়েই বেঁচে থাকা যায়।
আমি এবং আরো অনেক প্রতিবেশ-অর্থনীতিবিদ দীর্ঘদিন এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি যে, কীভাবে সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করে উৎপাদনের প্রয়োজনটাই আমরা কমাতে পারি। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবেলা করার সাথেও এই উৎপাদন কমানোর সম্পর্ক রয়েছে। এটাও সহজ হিসাব- আমরা যত কম উৎপাদন করব তত কম গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসৃত হবে। তাহলে মানুষের জীবিকা ঠিক রেখে কীভাবে আমরা সবকিছু উৎপাদনের পরিমাণ কমাবো?
এর জন্য একটা আলোচিত প্রস্তাব হচ্ছে সাপ্তাহিক কার্য-দিবস কমিয়ে আনা। এছাড়াও আছে, আমার সাম্প্রতিক গবেষণা যেভাবে দেখিয়েছে: মানুষকে আরো ধীরে-সুস্থে কাজ করতে দিয়ে তাদের উপর চাপ কমিয়েও অর্থনীতি চলতে পারে। এর কোনটাই কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সরাসরি কোন কাজে আসবে না যেখানে মূল লক্ষ্য মানুষের সামাজিক সংস্পর্শ কমানো, উৎপাদন কমানো না। কিন্তু দুই প্রস্তাবনার মূল বিষয় একটাই: বাঁচতে হলে মানুষের মজুরী নির্ভরতা কমাতে হবে।
কীসের জন্য এই অর্থনীতি?
অর্থনৈতিকভাবে কোভিড-১৯ মোকাবেলাকে বোঝার মূল উপায় হচ্ছে হুমকির মুখে পড়া এই অর্থনীতি আসলে কি কাজে লাগে তা বোঝার চেষ্টা করা। চলমান বিশ্ব অর্থনীতির মূল কাজ হচ্ছে মুদ্রার বিনিময় ব্যবস্থাকে ক্রিয়াশীল রাখা, এটাকেই অর্থনীতিবিদরা বলেন “বিনিময় মূল্য” বা এক্সচেইঞ্জ ভ্যালু।
বিরাজমান এই ব্যবস্থায় আমাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবল ধারণাটি হচ্ছে ‘বিনিময় মূল্য’ আর ‘ব্যবহারিক মূল্য’ আসলে একই জিনিস। আসলে মানুষ যা চায় বা তার যা প্রয়োজন সেটার জন্যই টাকা খরচ করে এবং এই খরচ করাটাই বলে দেয় যে সে জিনিসটার ‘ব্যবহার’কে সে কতখানি ‘মূল্য’ দেয়। এজন্যই ইদানিং বাজারকেই সমাজ ব্যবস্থাপনার মূল উপায় হিসাবে দেখা হচ্ছে। বাজার আপনাকে নিজের সাথে খাপ-খাইয়ে নেয়ার সময়-সুযোগ দেবে, এবং এই ‘ব্যবহারিক মূল্য’র সাথে নিজের উৎপাদন-সামর্থ্যের সামঞ্জস্য রাখবার মতন স্থিতি-শক্তি তার যথেষ্ট আছে।
কোভিড-১৯ বাজার সম্পর্কে আমাদের ভুয়া বিশ্বাসগুলো থেকে মুক্তি দিচ্ছে। যেমন বিশ্বের সব সরকারের মধ্যে এই ভয় কাজ করছে যে জরুরী সেবাখাতগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। সরবরাহ ব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা, এবং প্রধানত স্বাস্থ্যব্যবস্থা। এর পেছনে অনেক কার্য-কারণ আছে, কিন্তু আপাতত আমরা দুইটা বেছে নিই।
প্রথমত, বেশিরভাগ জরুরী সামাজিক পরিষেবা থেকে টাকা বানানো খুব কঠিন কাজ। এটা অংশত এজন্য যে মুনাফার অন্যতম চালিকা শক্তি হচ্ছে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, মানে অল্প মানুষ দিয়ে অনেক বেশী কাজ করানো। এধরনের ব্যবসায় কর্মীরাই খরচের বড় একটা খাত, বিশেষত স্বাস্থ্যসেবার মত ব্যবসাগুলোতে যেখানে সেবার ক্ষেত্রে ব্যক্তি-পর্যায়ের মিথষ্ক্রিয়ার প্রয়োজন পড়ে। ফলে অন্য খাতের ব্যবসার তুলনায় স্বাস্থ্যসেবা খাতে শ্রমের উৎপাদনশীলতা কম হওয়ার কারণে এর সেবার দাম অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ে।
দ্বিতীয়ত অনেক জটিল এবং জরুরী সেবা-খাতেও চাকরিগুলো এমন কাজের জন্য না যেগুলোকে সমাজ কদর করে। সবচেয়ে ভাল বেতনের অনেক চাকরিই মূলত লেনদেন ব্যবস্থাপনার কাজ যার মূল লক্ষ্য হলো মুনাফা তৈরী। এই চাকরিগুলো সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে কিছুই করে না: তারা যা করে তাকে নৃবিজ্ঞানী ডেভিড গ্রেবার বলেন ‘আজাইরা কাজ’, বা “বুলশিট জবস”। তারপরেও যেহেতু তারা মুনাফা বানানোর কাজ করেন, আমাদের অনেক অনেক কনসালটেন্ট আছেন, আছে বড় বড় বিজ্ঞাপন-শিল্প, এবং আছে বিরাট বড় একটা বিনিয়োগ খাত। এদিকে আমাদের স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবায় বড় সঙ্কট হচ্ছে এখানে নিজের কাজ উপভোগ করা লোকজন চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয় কারণ এসব চাকরি তাদের জীবন-ধারণের জন্য যথেষ্ট টাকা দেয় না।
‘আজাইরাকাজ’
কোভিড-১৯ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতির যে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে তার অন্যতম কারণ হচ্ছে অনেক বেশি মানুষ এমনসব অনর্থক বা আজাইরা কাজের সাথে জড়িত। এই মহামারী অনেক কাজকেই চিহ্নিত করছে যেসব কাজের আসলে কোন গুরুত্ব নেই। যার ফল হিসেবে খারাপ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য আমাদের যথেষ্ট দক্ষ বা কাজ জানা কর্মী মানুষ নাই।
মানুষ এসব অর্থহীন কাজ করতে বাধ্য হয় এমন সমাজে যেখানে ‘বিনিময় মূল্যে’ই অর্থনীতির মূলসূত্র হিসেবে কাজ করে, জীবনের মৌলিক চাহিদার সবকিছুই বাজার থেকে আসে। এর মানে হলো আপনাকে এগুলো কিনে নিতে হবে, কিনতে হলে আপনাকে আয় করতে হবে এবং এই আয় আসবে আপনার কাজ বা চাকরি থেকে।
অন্যদিকে কোভিড-১৯ সংক্রমণরোধে আমরা এখন এমনসব অভিনব (এবং কার্যকর) প্রয়াস দেখতে পাচ্ছি যেগুলো বাজার এবং ‘বিনিময় মূল্যে’র আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করছে। বিশ্বের সবখানেই সরকারগুলোকে আমরা এমনসব পদক্ষেপ নিতে দেখছি যা তিনমাস আগেও অসম্ভব দেখাতো। যেমন, স্পেইনে সব ব্যক্তি মালিকানাধীন হাসপাতালকে রাষ্ট্রায়াত্ত করে নেয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্যে সবধরনের পরিবহন জাতীয়করণ করার সম্ভবনাও প্রবল। ফ্রান্স তার বড় বড় ব্যবসাগুলোকে জাতীয়করণ প্রস্তুতির কথা প্রকাশ্যেই বলছে।
পাশাপাশি আমরা শ্রম-বাজারে ধ্বস দেখতে পাচ্ছি। ডেনমার্ক এবং যুক্তরাজ্যের মত দেশগুলো তাদের জনগণকে আয়ের বিকল্প হিসেবে একটা টাকা দিচ্ছে যাতে তারা কাজের জন্য বাইরে না যায়। যে কোন সফল লকডাউনের জন্য এই পদক্ষেপ খুব জরুরী। এসব পদক্ষেপ খুব নির্ভুল কিছু না। তারপরও এসব পদক্ষেপের মানে হচ্ছে সেই অমোঘ অর্থনৈতিক সূত্রের পালা-বদল যে জীবিকা অর্জনের জন্য মানুষকে কাজ করতেই হবে। এসব পদক্ষেপের মানে হচ্ছে কেউ কাজ করতে না পারলেও যে তার বেঁচে থাকার সমান অধিকার আছে, এবং এসব পদক্ষেপ মানে সেই অর্থনৈতিক সূত্রের দিকে একধাপ এগিয়ে যাওয়া।
কোভিড-১৯ অর্থনীতিতে গত চল্লিশ বছরের প্রতাপশালী প্রবণতাগুলোর চাকা উল্টা ঘুরিয়ে দিয়েছে। এতদিন বাজার আর ‘বিনিময়-মূল্য’র সূত্রই ছিল অর্থনীতি চালানোর সেরা চাবিকাঠি হিসেবে স্বীকৃত। ফলে, জনসেবার উপর বাজারিকরণের চাপ ক্রমাগত বেড়েই চলছিল, এসব ব্যবসার মত করে চালানোর চেষ্টা হচ্ছিল যাদের টাকা আয় করেই চলতে হবে। একইভাবে, শ্রমিকদেরও বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে যার ফল হিসেবে কর্মঘন্টাহীন নিয়োগ-চুক্তি এবং একটা অস্থির ও চটকদার অর্থনীতি এসে দীর্ঘ-মেয়াদের স্থিতিশীল চাকরিগুলো বাজার পরিস্থিতির বিপরীতে মানুষকে যে সুরক্ষা দিত সেটা প্রায় তুলে দিয়েছে।
কোভিড-১৯ এই প্রবণতাকে উল্টে দিচ্ছে। স্বাস্থ্য-সেবা এবং শ্রম ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনা বাজারের হাত থেকে নিয়ে রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিচ্ছে। রাষ্ট্র নানা কারণেই উৎপাদন করে। তার মধ্যে কিছু কারণ ভাল এবং কিছু খারাপ। কিন্তু রাষ্ট্র বাজারের মত না, যাকে শুধুমাত্র ‘বিনিময় মূল্যে’র জন্যই উৎপাদন করতে হয়।
এই পরিবর্তনগুলো আমাকে আশার আলো দেখায়, অনেক জীবন বাঁচানোর সম্ভাবনা দেখায়। এমনকি এমনসব দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনের সম্ভাবনাও তৈরী হচ্ছে যা আমাদের সত্যিকার অর্থে সুখী করতে পারে, যা আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন সামলাতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এই পর্যন্ত আসতে আমাদের এত সময় লাগল কেন? কেন এত এত দেশের শিল্প-উৎপাদনের গতি কমানোর কোন প্রস্তুতিই ছিলনা? এর সদুত্তর পাওয়া গেছে বিশ্ব-স্বাস্থ্য সংস্থার একটা সাম্প্রতিক রিপোর্টে যা বলছে যে তাদের সঠিক মনভাব ছিল না।
আমাদের অর্থনৈতিক কল্পলোক
এসবের উপরেই গত চল্লিশ বছর ধরে আমাদের অর্থনৈতিক বোঝাপড়া দাঁড়িয়ে ছিল। ফলে এধরনের অর্থনীতিতে যে গলদ আর ফাটল আছে সেটা দেখা বা বোঝার সামর্থ্য, বা বিকল্প কিছু ভাবার সামর্থ্য আমাদের রাজনীতিক আর উনাদের উপদেষ্টাদের ছিল না। উনাদের মনভাবে দুইটা আন্ত:সম্পর্কিত বিশ্বাস খুব প্রবল:
বাজার উচ্চমান-সম্মত জীবন-যাপনের সবকিছু সরবরাহ করে, সুতরাং এটাকে রক্ষা করতে হবে।
সাময়িক সঙ্কট কাটিয়ে উঠে বাজার সবসময়ই আবার তার স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে।
অনেক পশ্চিমা দেশেই এটাই সবচে স্বাভাবিক মনভাব। যেকারণে যুক্তরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্রের মত শক্তিশালী বাজার ব্যবস্থার দেশকেও দেখা গেল কোভিড-১৯ মোকাবেলার জন্য বাজে রকমের অপ্রস্তুত।
যেমন যুক্তরাজ্যে, এক ব্যক্তিগত আলোচনার সূত্র ধরে কোভিড-১৯ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এক জ্যেষ্ঠ সহচরের দৃষ্টিভঙ্গি জানা গেল– “এই অর্থনীতিকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র ঝাঁক-প্রতিরোধশক্তি (herd immunity), এবং এটা করতে গিয়ে যদি কিছু পেনশনভোগী মারা যায়, তাহলে সেটা আফসোসের কথা।” এখন সরকার এটাকে অস্বীকার করছে, কিন্তু সত্য হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। মহামারীর শুরুর দিকে সরকারি এক অনুষ্ঠানে এক জ্যেষ্ঠকর্তা আমাকে বলেছিলেন: “অর্থনীতি অচল করে রেখে কী লাভ আছে? একটা প্রাণের আপনি অর্থমূল্য হিসাব করেন, সম্ভবত লাভ নাই”।
একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর এলিটদের মাঝে এধরনের দৃষ্টিভঙ্গীর প্রাদুর্ভাব প্রবল। যেমন টেক্সাসের একজন সরকারী কর্মকর্তার যুক্তি মোতাবেক আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দা দেখার চাইতে অনেক বুড়ো মানুষ হাসিমুখে মরতে রাজি আছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গী আদতে ঝুঁকিতে থাকা আরো অনেক মানুষদের আরো বিপদের মুখে ঠেলে দেবে (এবং ঝুঁকিতে থাকা সবমানুষই কিন্তু বয়স্ক নন), এবং, আমি বলতে চাইছি এইটা একটা এখানে বিনিয়োগের চেষ্টা করছি সেটাও আসলে একটা অসৎ চিন্তাধারা।
কোভিড-১৯ এই সঙ্কটের সময় যে কাজটি চালাতে পারে তা হলো আমাদের অর্থনৈতিক কল্পনাশক্তিকে আরো প্রসারিত করতে থাকা। সরকার এবং নাগরিকরা এখন যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তার অনেকগুলাই তিন মাস আগেও অসম্ভব মনে হতো। দুনিয়া কীভাবে চলছে সে সম্পর্কে আমাদের ধ্যান-ধারণাও দ্রুত বদলে যেতে পারে। দেখা যাক এই নতুন কল্পনাশক্তি আমাদের কোথায় নিয়ে যায়।
সামনে চার ভবিতব্য
ভবিষ্যতে ঘুরে আসার কৌশল হিসেবে আমি কিছু ভবিষ্যৎ গণনার কৌশল ব্যবহার করব। ভবিষ্যতের মূল চালিকাশক্তি হিসাবে আপনি দুইটা নির্ধারক বেছে নেন। এখন এই দুই নির্ধারক বিভিন্ন বিন্যাস বা ছকে সাজিয়ে ভাবার চেষ্টা করেন যে আমাদের ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে।
আমি যে দুইটা নির্ধারক নিতে চাই তা হচ্ছে ‘মূল্যবোধ’ এবং ‘কেন্দ্রীকরণ’। এখানে মূল্যবোধ বলতে আমাদের অর্থনীতি পরিচালনার যে মূলনীতি রয়েছে তাকেই বোঝানো হচ্ছে। আমরা আমাদের সহায়-সম্পদগুলো কী যথাসম্ভব বিনিময় এবং টাকা বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করবো নাকি যথাসম্ভব জীবন বাড়ানোর কাজে লাগাবো? কেন্দ্রীকরণ বলতে যেভাবে আমাদের সবকিছু সংগঠিত হয়ে আছে তার সমাহারকে বোঝাতে চাইছি যা অনেকগুলো ছোট ছোট এককের সমষ্টিও হতে পারে বা বড় কোন অধিপতি শক্তি হতে পারে। এই নির্ধারকগুলোকে আমরা একটা জটিল জালে সংগঠিত মানুষের সমষ্টি হিসাবেও ভাবতে পারি। এভাবে চিন্তা করলে করোনা ভাইরাস মোকাবেলার জন্য যদি আমরা ‘মূল্যবোধ’ এবং ‘কেন্দ্রীকরণ’ এর চারটা চূড়ান্তবিন্যাস যা দাঁড়ায় সেগুলো এরকম:
১) রাষ্ট্রীয় পুঁজিতন্ত্র: কেন্দ্রীভূত পদক্ষেপ, ‘বিনিময় মূল্য’কে অগ্রাধিকার দেয়া
২) বর্বরতা: বিকেন্দ্রীকৃত পদক্ষেপ, ‘বিনিময় মূল্য’কে অগ্রাধিকার দেয়া
৩) রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র: কেন্দ্রীভূত পদক্ষেপ, জীবন রক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়া
৪) সহমর্মিতা: বিকেন্দ্রীকৃত পদক্ষেপ, জীবন রক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়া
রাষ্ট্রীয় পুঁজিতন্ত্র
বর্তমানে সারা দুনিয়াকে শাসন করছে রাষ্ট্রীয় পুঁজিতন্ত্র। এর আদর্শ উদাহরণ হলো যুক্তরাজ্য, স্পেইন এবং ডেনমার্ক।
এসব রাষ্ট্রীয় পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ ‘বিনিময় মূল্যে’ অর্জনের পথকেই অর্থনীতির দিক-নির্দেশক হিসাবে দেখছে এখনো। কিন্তু এটাও তারা বুঝতে পারছে যে সঙ্কটে পড়া বাজার-ব্যবস্থার এখন রাষ্ট্রীয় সহায়তা দরকার। যেহেতু শ্রমিকরা কাজ করতে পারছে না কারণ তারা অসুস্থ, এবং তারা প্রাণের ভয় পাচ্ছে -এরকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র তার কল্যাণমূলক কাজের আওতা বাড়িয়ে এগিয়ে আসবে। সেই সাথে বিরাট অংকের কেইঞ্জিয়ান প্রণোদনা থাকবে ঋণ-সুবিধার সম্প্রসারণ এবং ব্যবসায়ীদের সরাসরি টাকা দেয়ার মতন।
এখানে মূল প্রত্যাশা হচ্ছে যে, এসব খুব স্বল্প-মেয়াদের জন্য দরকার হবে। এসব পদক্ষেপের প্রাথমিক কাজ হচ্ছে যত বেশি সম্ভব ব্যবসাকে কারবারে টিকিয়ে রাখা। যেমন যুক্তরাজ্যে এখনো খাদ্য-দ্রব্য বাজার-ব্যবস্থা দিয়েই সরবরাহ ও বন্টন হচ্ছে (যদিও সরকার প্রতিযোগিতামূলক আইনগুলো শিথিল করেছে)। যেখানে শ্রমিকদের সরাসরি নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে, সেটা দেয়া হচ্ছে শ্রম-বাজারের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপের ব্যাঘাত কমানোর জন্য। যেমন যুক্তরাজ্যের মতন দেশগুলাতে শ্রমিকদের নগদ সহায়তা নিতে হচ্ছে দরখাস্ত করে এবং সেটা মালিকের হাত হয়ে। এবং নগদ সহায়তার পরিমাণ নির্ধারণ করা হচ্ছে বাজার-ব্যবস্থায় শ্রমিকের যে ‘বিনিময় মূল্য’ ছিল সেই অনুযায়ী, তাদের কাজের উপযোগিতা দিয়ে না।
এটা কি কোন সফল বা কার্যকর পথ হতে পারে? হয়তো হতে পারতো যদি কোভিড-১৯ খুব অল্প সময়ে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা যেতো তাহলে। কিন্তু যেহেতু বাজার চালু রাখার জন্য পুরাপুরি লকডাউনকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, সেহেতু সংক্রমণও মনে হয় চলতেই থাকবে। যেমন, যুক্তরাজ্যে এখনো অনেক অ-জরুরি নির্মাণকাজ চলছে যেখানে শ্রমিকরা মিলেমিশে কাজ করছেন। কিন্তু যদি মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে তাহলে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ সীমিত রাখা কঠিন হয়ে যাবে। ক্রমবর্ধমান অসুখ এবং মৃত্যু অস্থিরতার জন্ম দেবে করোনার অর্থনৈতিক প্রভাবকে আরো গভীর করবে যা বাজার ব্যবস্থা চালু রাখার জন্য রাষ্ট্রকে আরো বেশি বেশি কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করবে।
বর্বরতা
এটা সবচেয়ে ভয়ংকর ভবিষ্যৎ। আমরা যদি বিদ্যমান মূলনীতিঅনুযায়ী ‘বিনিময় মূল্যে’র উপর নির্ভর করে চলতে থাকি এবং অসুখ বা বেকারত্বের কারণে যারা বাজার ব্যবস্থা থেকে ছিটকে যাচ্ছে তাদের সহায়তা দিতে অস্বীকার করি। এএমন এক সম্ভাব্য পরিস্থিতি যা আমরা আগে কোনদিন দেখি নাই।
ব্যবসা লাটে উঠে বা কর্মীরা অনাহারে ভোগে কারণ বাজারের রূঢ় বাস্তবতার হাত থেকে তাদের রক্ষা করবার কোন বন্দোবস্ত নাই। হাসপাতালগুলোকে অভাবনীয় কোন পদক্ষেপে কোন বিশেষ সহায়তা দেয়া হয়নি, ফলে সেসব হতভম্ব হয়ে পড়েছে। মানুষ মারা যাচ্ছে। বর্বরতা একটা নড়বড়ে পরিস্থিতি যা নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের পর্ব পার হয়ে শেষমেষ আরেক ধরনের ছকে পর্যবসিত হয়।
এটা কি সম্ভব? দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে এটা প্যানডেমিকের সময় ভুলবশত; ঘটতে পারে, অথবা প্যানডেমিকের চূড়ান্ত পর্যায়ে ইচ্ছে করে ঘটানো হতে পারে। ভুল হচ্ছে যদি কোন সরকার প্যানডেমিকের সবচে বাজে পর্যায়ে যথেষ্ট বড় মাপের পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়। ব্যবসা বা গেরস্থালি পর্যায়ে সহায়তা দেয়া যেতে পারে, কিন্তু সেটা যদি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া অসুখের মুখে বাজার-ব্যবস্থার বিপর্যয় ঠেকানোর মত যথেষ্ট বড় না হয়, তাহলে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়বে। হাসপাতালগুলাতে হয়তো অতিরিক্ত টাকা ও জনশক্তি দেয়া যায়, কিন্তু সেটা যদি পর্যাপ্ত না হয় তাহলে অনেক বেশি সংখ্যক অসুস্থ মানুষকে বিনা-চিকিৎসায় ফিরিয়ে দিতে হবে।
পরের ধাপে রয়েছে প্যানডেমিকের চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্যাপক কৃচ্ছতা-সাধন এবং সরকারগুলোর “স্বাভাবিক” অবস্থায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা। এই পথে গিয়ে জার্মানি হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এটা বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে। কৃচ্ছতা-সাধনকালে জরুরী সেবাগুলো থেকে অর্থ প্রত্যাহারের কারণে প্যানডেমিক মোকাবেলায় রাষ্ট্রগুলোর সক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে।
অর্থনীতি ও সমাজের ব্যর্থতায় এরপর রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেবে, যা ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে মোড় নেবে এবং জনকল্যাণ ব্যবস্থা পুরাপুরি ধ্বসে যাবে।
রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র
রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র কোন সাংস্কৃতিক পালা-বদলের মধ্য দিয়ে অর্থনীতির কেন্দ্রে ভিন্ন কোন ‘মূল্যবোধ’ বসিয়ে দেখা প্রথম ভবিষ্যৎটাকে আমাদের সামনে মেলে ধরে। আজকে যুক্তরাজ্য, স্পেইন বা ডেনমার্কে আমরা যে পদক্ষেপগুলো দেখতে পাচ্ছি সেটাকে প্রলম্বিত করে আমরা এই ভবিষ্যতে পৌঁছাতে পারি।
এক্ষেত্রে মূল ব্যাপার হচ্ছে হাসপাতাল জাতীয়করণ এবং শ্রমিকদের নগদ সহায়তা দেয়াটা বাজার রক্ষার উপায় হিসেবে না দেখে মানুষের জীবন রক্ষার উপায় হিসাবে দেখা। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র অর্থনীতির এমন অংশগুলো রক্ষার জন্য এগিয়ে আসে যেগুলো মানুষের জীবনের জন্য জরুরী: যেমন খাদ্য ও জ্বালানি-শক্তি উৎপাদন, এবং আশ্রয়ণ– যাতে করে তাহলে জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলো আর বাজারের চাকচিক্যের হাতে চাবিমারা থাকবে না। রাষ্ট্র হাসপাতাল জাতীয়করণ করবে এবং বিনামূল্যে বাসস্থানের ব্যবস্থা করবে। সর্বোপরি, রাষ্ট্র বিভিন্ন নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিস তার নাগরিকদের নাগালের মধ্যে রাখবার জন্য কোন একটা ব্যবস্থা করবে। সেসব জিনিস যেমন মৌলিক চাহিদা হতে পারে তেমনি কম শ্রমশক্তি নিয়োগ করে তৈরী ভোগ্যপণ্যও হতে পারে।
জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো এবং নাগরিকদের মাঝখানে নিয়োগকর্তা বা মালিকেরা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকবে না। রাষ্ট্র সবাইকে সরাসরি নগদ টাকা দেবে যার সাথে নাগরিক ‘বিনিময় মূল্য’ বা মুনাফা তৈরী করে কিনা তার কোন সম্পর্ক থাকবে না। তার বদলে, সব নাগরিকই সমানভাবে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পাবেন (যাতে আমরা খুব সাধারণ মানের জীবন-ধারণ করে বেঁচে থাকতে পারি। অথবা এই টাকার অঙ্ক ঠিক হবে তাদের কাজ কতটা সমাজের কাজে লাগে সেই মাপকাঠি দিয়ে। সুপারমার্কেটের কর্মী থেকে শুরু করে পণ্য-পরিবহন ও বিপণন কর্মী, গোডাউন কর্মী, নার্স, শিক্ষক, চিকিৎসক আর আমাদের হাল-জমানার সিইও’রা পর্যন্ত সবাই।
রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ দীর্ঘসময় প্যানডেমিক সামলানোর জন্য নেয়া পদক্ষেপের কারণেও রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র আবির্ভূত হতে পারে। যদি গভীর মন্দা দীর্ঘদিন চলে, সরবরাহ ব্যবস্থা যদি ব্যাহত থাকে, বাজারে যদি চাহিদা ফিরিয়ে আনা না যায়, কেনিজিয়ান নীতির মানদণ্ডে চলা এখন আমরা যা যা দেখতে পাচ্ছি (টাকা ছাপানো, খুব সহজেই ঋণ পাওয়ার বিধান এবং আরো অন্যান্য), তখন হয়তো রাষ্ট্র উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে।
এই রাস্তায় অনেক ঝুঁকি আছে, কর্তৃত্ববাদ নিয়ে আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু তারপরেও কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ বিস্তারের বিপরীতে এইটাই আমাদের সবচে বড় আশা দেখাতে পারে। এক্ষেত্রে একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র সহায় সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থা নিজের হাতে তুলে নেবে সমাজ ও অর্থনীতির মৌলিক কার্য-কলাপটুকু রক্ষার জন্য।
পারস্পরিক সহায়তা
পারষ্পরিক সহায়তা আমাদের দ্বিতীয় ভবিষ্যৎ, যেখানে অর্থনীতির মূলনীতি হবে মানুষের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। কিন্তু এই ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের কোন নির্ধারক ভূমিকা থাকবে না। তার বদলে নিজ নিজ পাড়া-মহল্লায় ব্যক্তি ও ছোট ছোট সার্কেল কমিউনিটিতেই নানা ধরনের সহায়তা ও সেবা সংগঠিত করবে।
এই ভবিষ্যতের ঝুঁকি হলো, এই ধরনের সামাজিক উদ্যোগগুলোর দ্রুত গতিতে স্বাস্থ্যসেবার মত খাতগুলোর
পরিসর বাড়ানোর মত সহায়-সম্পদ নাই। কিন্তু পারস্পরিক সহায়তা হয়তো আরো কার্যকরভাবে সংক্রমণ ঠেকাতে পারতো। কমিউনিটি সহায়তা নেটওয়ার্ক তৈরীর মাধ্যমে ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে রক্ষা করা এবং সামাজিক দূরত্ব বা আইসোলেশন বজায় রাখতে পারতো আরো কার্যকরভাবে। এই ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা হতে পারে একটা নতুন গণতান্ত্রিক কাঠামোর উদয় হওয়া। সম্ভাব্য গতিতেই কমিউনিটির দলগুলো জরুরী সহায়তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিসও সরবরাহ করতে পারে। আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে রোগের বিস্তার মোকাবেলা ও রোগীদের চিকিৎসার পরিকল্পনা হবে, নিজেদের নাগালে থাকা দক্ষতাকে পুঁজি করে।
আগের তিনটি সম্ভাব্য ভবিষ্যতের যে কোনটি থেকেই এই ভবিষ্যতের আবির্ভাব ঘটতে পারে। এটা বর্বরতা বা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ থেকে বেরুনোর একটা সম্ভাব্য পথ হতে পারে, অথবা রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রকে জোরদার করবার কাজেও লাগতে পারে। আমরা জানি যে পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা প্রাদুর্ভাব ও বিস্তার রোধে স্থানীয় কমিউনিটি পর্যায়ে নেয়া পদক্ষেপগুলোই ছিল সবচে কার্যকর। এবং আমরা এরমধ্যেই এই ভবিষ্যতের শেকড়গুলো দেখতে পাচ্ছি অজস্র সামাজিকভাবে সংগঠিত দল যেভাবে ত্রাণ ও কমুনিটি সহায়তায় এগিয়ে এসেছে তার মাঝে। এটাকে আমরা রাষ্ট্রের নেয়া পদক্ষেপগুলোর ব্যর্থতা হিসেবেও দেখতে পারি। অথবা, এসবকে আমরা একটা উদীয়মান সংকটের মুখে খুব বাস্তববাদী এবং সহমর্মী সহজাত সামাজিক পদক্ষেপ হিসেবেও দেখতে পারি। দেখতে পাই। অথবা একটি নতুন সঙ্কটকে আমরা প্রায়োগিক, সমাজের সহানুভূতিশীল সাড়া হিসেবে দেখতে পাই।
আশা আর আশঙ্কাগুলো
এই দৃষ্টিপাতগুলো আসলে একদম চরমতম কল্পনা, খানিকটা ক্যারিক্যাচারও বটে। এবং এগুলোর একটার সাথে একটার কাটাকাটির মধ্য দিয়েই সম্ভবত আমাদের সামনের কাল গড়াবে। আমার প্রথম ভয় হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ থেকে বর্বর সমাজে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে। আমার প্রথম আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের সাথে পারস্পরিক সহায়তার সংমিশ্রণ: একটি বলিষ্ঠ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যা শক্তিশালী স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা তৈরীতে সহায়-সম্পদ ব্যয় করবে, বাজারের হাত থেকে বিপদাপন্ন মানুষকে সুরক্ষা দেয়াটাকে অগ্রাধিকার দেবে অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে। এমন একটি রাষ্ট্র যা নাগরিকদের পারস্পরিক সহায়তা জোরদার করবার জন্য কাজ করবে, বেহুদা কাজ কমিয়ে মানুষকে এধরণের কাজ করবার সময় ও সুযোগ করে দেবে।
আশা করি এটা পরিষ্কার হয়েছে যে, এই চার ভবিষ্যতের সবগুলোতেই আশঙ্কার দিক যেমন আছে তেমনি আশাবাদের জায়গাও আছে। কোভিড-১৯ আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থাগুলার খুব ভীতিকর কিছু গলদ চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। এর বিপরীতে কার্যকর প্রতিকার চাওয়ার মানেই হচ্ছে একটা আমূল সামাজিক পরিবর্তন চাওয়া। আমার গবেষণা দেখাচ্ছে যে, এজন্য প্রথমেই মার্কেট আর মুনাফা দিয়ে অর্থনীতি গড়ার পথ থেকে একেবারে সরে আসতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথম সম্ভাবনা হচ্ছে আমরা আরো মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো যা আমাদের সামনের প্যানডেমিকগুলোর জন্য প্রস্তুত করবে, জলবায়ু পরিবর্তনের মত বাড়তে থাকা আরো সব সঙ্কট মোকাবেলায় সক্ষম করে তুলবে।
সামাজিক পরিবর্তন অনেক ধরনের পরিস্থিতি ও তার প্রভাবের মধ্য দিয়ে আসতে পারে। আমাদের সবার একটা মূল কাজ হচ্ছে এই দাবি তোলা যে, উদীয়মান সমাজ জীবন যেন এমন সব নীতিবোধ থেকে তৈরী হয় যা সেবা, মানুষের জীবন, আর গণতন্ত্রিক সমঝোতাকে মূল্য দেয়। আজকের এই দুঃসময়ে আমাদের মূল রাজনৈতিক কর্তব্য হচ্ছে বেঁচে থাকা এবং (আপাতত ভার্চুয়ালি) নিজেদের এইসব মূল্যবোধ ঘিরে সংগঠিত করা।