পার্থ প্রতীম দাস
এসো নিজে করি: রাস্তার পাঠশালায় ক্লাশ বড়রা অংশ নেবে কি?
স্কুল কলেজের ছেলে-মেয়েদের পাঠ্যবইয়ে এসো নিজে করি টাইপের অংশ থাকে। প্র্যাকটিক্যাল। সেটা তারা করে থাকে। না কি করে না, জানি না। এখন রাস্তায় নেমে সেই টাইপের একটা এসো নিজে করি জিনিসই স্কুলেজের শিক্ষার্থীরা করছে বলে মনে হচ্ছে।
তারা শুরু করেছে রাস্তায় লাইসেন্স চেকিং। ‘বাদ যাবে না একটি শিশু’ নীতিতে বিশ্বাসী মনে হয় তারা। কাউকেই বাদ দিচ্ছে না। মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী-আমলা-পুলিশ-র্যাব-সেনাবাহিনী-আমলা-উকিল-মোক্তার-সাংবাদিক-চিকিৎসক-শিক্ষক, এমনকি বাপমা পর্যন্ত বাদ যাচ্ছে না। সবার চলছে লাইসেন্স চেকিং। “আছে? লাইসেন্স আছে?” বলে ঢাকার রাজপথ কাঁপিয়ে তুলেছে কিশোর বিদ্রোহীরা। এই ক্লাসে তারা শিক্ষক হিসেবেও গ্রহণ করছে অনেককে। একটা ভিডিওতে দেখা গেল, এক পুলিশ কর্মকর্তা কিভাবে লাইসেন্স চেক করতে হয় শিখিয়ে দিচ্ছেন। এক জায়গায় এক পুলিশ সদস্য বলছেন কিভাবে দেশ গড়তে হবে। কথা পছন্দ হওয়াতে হ্যা, স্যার, ঠিক স্যার বলে হাততালি দিয়ে মেনে নিচ্ছে এই শিক্ষার্থীরা। এমন কত কত মানুষকে যে তারা শিক্ষক হিসেবে মেনে নিচ্ছে— হিসেব নেই।
আবার যে শিক্ষক পছন্দ হচ্ছে না, তাকে বলে দিচ্ছে রাস্তা মাপো। বিদেয় হয়ে যাও। অনেক ফেসবুক সেলিব্রেটি, তারকারা পড়েছেন এই তালিকায়— দেখা গেল।
সবুজের অভিযান: সকল ক্ষমতা শিশুদের কল্পনার হাতে
আপনার বাচ্চাটার মুখে যখন আধো আধো বোল ফোটে, তখন কী আপনি বুঝতে চেষ্টা করেন না যে, সে কী বলতে চাচ্ছে? কী ইঙ্গিত দিচ্ছে? We Want Justice বলে তারা গলা ফাটাচ্ছে। মার খাচ্ছে। মাথা ফাটাচ্ছে। কী তাদের জাস্টিস? বুঝতে চান না কেন আপনারা?রাজপথে-রাজনীতির ময়দানে তারা তো সেই আধো আধো বোল ফোটা শিশুর মতোই। আপনারা তো অনেক বয়স্ক। অনেক পরিপক্ক। আপনাদের কত কত বছরের সব গৌরব আছে। রাজপথ-রাজনীতির দাবায় চাল কী আপনারা কম দিন ধরে দিচ্ছেন! কত কত সব মহান অর্জন-অভিজ্ঞতা আপনাদের! সেই তুলনায় এরা তো একেবারেই ছোট্ট শিশু। তো, তাদের ভাষাটা বোঝার চেষ্টা করছেন না কেন? কী বলতে চাইছে তারা প্ল্যাকার্ডগুলো দিয়ে? কী চাইছে? কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে?বোঝার চেষ্টা আমরা করছি না। কারণ আমরা পরিবারে একটা শিশুর সঙ্গে যা করি, এই রাস্তাতেও ঠিক তা-ই করছি। শাসাচ্ছি। ভয় দেখাচ্ছি। জোর করছি। নানাবিধ জুজুর আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিচ্ছি তাদের মনে। মাঝেমধ্যে আদরও করছি। চকলেট দিচ্ছি। এটা-ওটা কিনে দেওয়ার, করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। ভুলাচ্ছি। ছেলেভোলানো!ব্যক্তিগত জীবনেও এই জিনিসই করি না আমরা? নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, চাওয়া-পাওয়া অনুযায়ী চালাই না বাচ্চাদের? চাই না আমরা, আমাদের ছেলে-মেয়েরা এটা করুক, ওটা করুক! এটা হোক-সেটা হোক! সেটা কতটুকু তার জন্য? আর কতটুকু আমাদের নিজেদের জন্য? আমরা চাই ওরা এটা-ওটা হোক, অনেক সাফল্য পাক যেন আমাদের নিজেদের মুখ উজ্জল হয়। সোসাইটিতে গর্ব করতে পারি। এজন্যই তো, নাকি? পাশের বাসার ছেলেটা বা মেয়েটা আমারটার চেয়ে ভালো কিছু করে ফেললে মুখ দেখাবো কী করে? ভাবি না, আমরা? আমরা কখনো ভাবি যে, আমাদের সন্তানেরা কী চায়? ওর সেটা ভালো লাগছে কিনা? ও আনন্দে আছে কিনা? ভাবি? ভাবি না। তো, সেই এক জিনিসই তো ঘটে চলেছে রাস্তায় এখন। রাজনীতির মাঠের জাঁদরেল-পাকা-ঝুনাদের কাছে নাজেহাল হচ্ছে বাচ্চারা। নোংরা-ঘিনঘিনে সব প্যাঁক কাদার মধ্যে পড়ছে তারা। মার খাচ্ছে, হেনস্তা হচ্ছে, কটু বিতর্কে জড়াচ্ছে। কেউ তাদের কথাটা কিন্তু বুঝতে চাইছে না। শুনতে চাইছে না। বাড়িতেও যা করা হয়, এখানেও তা-ই করা হচ্ছে। বাপমা বলে, আমি চাই তুমি এটা হবে। আমি চাই তুমি এটা করবে।
ইতিহাসের তেমনই কোনো সুপ্ত জীন কী এখন দেখা যাচ্ছে এই কিশোর বিদ্রোহে? এরা কী আবার সেই শিশুদের নগরী বানানোর ডাক দিচ্ছে? সেই হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর মতো? তাদের কথামতো, চাওয়া মতো সব কিছু চললে তো খারাপ কিছু হয় না। দুর্দান্ত দুর্দান্ত সব ব্যাপারই ঘটে। দেখলাম আমরা এই কয় দিনে। বুঝতে পারছি কী তাদের চাওয়াগুলো? ইশারা-ইঙ্গিতগুলো?