অনুবাদ: বীথি সপ্তর্ষি
প্রুধোঁর তুলনায় বাকুনিন অনেক বেশি পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্বের বিরোধী ছিলেন। তাঁর প্রবন্ধ সমন্বিত শিক্ষায়১ তিনি সন্তানের ওপর পিতার কর্তৃত্বের নিন্দা করেছিলেন। তাঁর বিপ্লবী কর্মসূচী ও ইশতেহারে তিনি ধারাবাহিকভাবে নারীর সমানাধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন। ১৮৬৬ সালে তাঁর বিপ্লবী প্রশ্নোত্তরে তিনি লিখেছিলেন: ‘নারী, পুরুষের থেকে ভিন্ন হলেও তার থেকে নিকৃষ্ট নয়। তারা বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী আর পুরুষের মতোই স্বাধীন। রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজকর্ম ও দায়িত্বের ক্ষেত্রে পুরুষের মতোই তারা নিজেদের সমঅধিকারের ঘোষণা দিয়েছে।’২ সুতরাং তিনি দাবি জানান:
প্রাকৃতিক পরিবারের বিলোপ নয় বরং আইন ও সম্পত্তির ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত বিধিসম্মত পরিবারের বিলোপ করতে হবে। ধর্মীয় ও সামাজিক বিয়ের পরিবর্তে মুক্ত বিয়ের প্রচলন করতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং নারীর অধিকার আছে তাদের পছন্দ মতো একসাথে থাকার বা আলাদা হয়ে যাওয়ার। তাদের একসাথে থাকায় বাধা দেয়া কিংবা একসাথে থাকতে বাধ্য করার কোনো অধিকার নেই সমাজের। সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিলুপ্ত করা হলে এবং সমাজ শিশুদের শিক্ষার নিশ্চয়তা দিলে, বাধ্যতামূলক সমস্ত আইনী কারণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। নারী ও পুরুষের মিলন অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে, কারণ স্বাধীন ইচ্ছা নীতিগত আন্তরিকতার অপরিহার্য শর্ত। বিয়ের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের চূড়ান্ত স্বাধীনতা উপভোগ করা উচিত। কি সহিংসতা, কি আবেগ কি অতীতে ত্যাগ করা অধিকারসমূহ কোনোটাই একের দ্বারা অন্যের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেয় না। এবং এ জাতীয় প্রতিটি হস্তক্ষেপই অপরাধ বলে গণ্য হবে।৩
প্রথম আন্তর্জাতিকের সময়ই ইউজিন ভার্লিনের মতো কর্তৃত্ববাদ বিরোধী ফেডারালিস্টরাও বাকুনিনের সাথে যোগ দিয়ে একই রকম অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, প্রুধোঁর অনুসারী ফরাসি মিচুয়ালিস্ট যার বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু শুধু প্রুধোঁর অনুসারীরাই প্রথম আন্তর্জাতিকে লিঙ্গ-সমতা সম্পর্কিত বাকুনিনের ধারণাকে উপহাস করেছিলেন তাই নয়। ১৮৬৮ সালে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক জোটের কার্যক্রমে বাকুনিনের বক্তব্য ছিল- ‘সকল লিঙ্গের প্রতিটি মানুষের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্যপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে’ মৈত্রীগঠনই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ৪ এর বিপরীতে মার্ক্স তার নোটে বাকুনিনকে নপুংসক বলে সম্বোধন করেন, এবং এই কার্যক্রমে সিগনেচার করার কারণে তার স্ত্রীকে অপদস্ত করেন। স্ত্রী অ্যান্টোনিয়ার সাথে বাকুনিনের সম্পর্ক রীতিমতো নিন্দনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, কারণ অরাজপন্থী চিন্তাধারা অনুসরণ করার কারণেই তিনি তার স্ত্রীকে অপর পুরুষের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে বাধা দেননি আবার তার সন্তানদের স্নেহময় পিতা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
অরাজপন্থী লেখা ‘রাষ্ট্রবাদ এবং অরাজ'(১৮৭৩)-এর পুনঃমুদ্রণ থেকে নেয়া নিম্নোক্ত অংশটিতে বাকুনিন পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্যের মূল প্রতিপাদ্যে ফিরে আসেন। তাঁর সময়ের অন্যান্য রাশিয়ান সমাজতান্ত্রিকদের মতো, রাশিয়ার কৃষক গোষ্ঠী- মির-এর কর্তৃত্ববাদী ও পুরুষতান্ত্রিক সামাজকাঠামোর প্রতি বাকুনিনের কোনো বিভ্রান্তি ছিল না, যাকে অন্যরা কৃষি-সমাজতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে দেখত।
রাশিয়ান জনগণের আদর্শ আরও তিনটি প্রবণতার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে, যা এই আদর্শকে অনুধাবন করতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং একে বিকৃত করে। এই প্রবণতাগুলোর সাথে আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে লড়াই করতে হবে… এই তিনটি প্রবণতা হলো: ১. পিতৃতন্ত্র ২. মির কর্তৃক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ওপর চালানো শোষণ ৩. জার এর প্রতি আস্থা… শেষের দুটি অর্থাৎ মির কর্তৃক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ওপর চালানো শোষণ এবং জার এর প্রতি ভক্তি, প্রথমটির অর্থাৎ পিতৃতন্ত্রের জনগণকে শাসন করার স্বাভাবিক ও অনিবার্য পরিণতি। এটা মস্ত বড় এক ঐতিহাসিক ক্ষতি, যা সবচাইতে খারাপ।
এই ক্ষতি তার নির্বোধ পারিবারিক মন্থরতা, ক্রমাগত মিথ্যাচার, লোভী কপটতা এবং সবশেষে বশ্যতা জীবনকে যা দুর্বিসহ করে তুলে, এসবের মাধ্যমে সমস্ত রাশিয়ান জীবনকে বিকৃত এবং অবধারিতভাবেই পঙ্গু করে তুলেছে। পরিবারের ওপর (যা ন্যায়বিচার-অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে ইতোমধ্যেই একটি নীতি-বিবর্জিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে) পিতা, স্বামী, বড় ভাইয়ের স্বৈরশাসন এবং পরিবারগৃহের কাপুরুষতা ও মানসিক বিকৃতি একে সহিংসতা ও অপরাজিত পাশবিকতার একটি শিক্ষাঙ্গনে পরিণত করেছে। চুনকাম করা কবরস্থান কথাটার মাধ্যমেই রাশিয়ান পরিবারকে সবচাইতে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।
…[গৃহপতি] একই সাথে দাস এবং একটি স্বৈরশাসক: যে স্বৈরশাসক তার সাথে একই ছাদের নিচে বাস করা ও তার ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল সমস্ত ব্যক্তির ওপর তার দৌরাত্ম চালায়। শুধু মির এবং জারকেই তিনি মনিব বলে মানেন। তিনি যদি পরিবারের কর্তা হন তবে তিনি চূড়ান্ত স্বৈরশাসকের মতো আচরণ করবেন কিন্তু তিনি মিরের চাকর ও জারের দাস হয়ে থাকবেন। গ্রামীণ সম্প্রদায় তাঁর মহাবিশ্ব; সেখানে কেবল তার পরিবার এবং এবং তারচেয়েও উচ্চ স্তরে রয়েছে গোষ্ঠী । এর থেকেই বুঝা যায়, কেন পুরুষতান্ত্রিক নীতিই মিরকে শাসন করে। যা আসলে এক ঘৃণ্য অত্যাচার, একটি কাপুরুষোচিত বশ্যতা এবং সকল ব্যক্তি ও পারিবারিক অধিকারের চূড়ান্ত অস্বীকার…
রাশিয়ার অন্যতম বড় দুর্ভাগ্য হলো প্রতিটি সম্প্রদায় ছোট ছোট গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের সাথে নূনতম স্বাভাবিক যোগাযোগ পর্যন্ত রাখার প্রয়োজন মনে করে না। তারা প্রত্যেকেই কেবল ‘দ্য লিটল ফাদার’ জার এবং তার ওপর ন্যাস্ত সর্বশক্তিমান পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার মধ্যস্থতার মাধ্যমেই যুক্ত। এটা স্পষ্ট যে অনৈক্য জনগণকে পঙ্গু করে ফেলে, এবং প্রায় সবসময়ই আঞ্চলিক বিদ্রোহগুলোকে তিরস্কারের মাধ্যমে নিশ্চিত পরাজয়ের দিকে ঠেলে দেয়, আবার একইসাথে স্বৈরশাসনের জয়ের পথকে সুগম করে…
পুরুষতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই বর্তমানে প্রায় প্রতিটি গ্রাম এবং প্রতিটি পরিবারেই ফুঁসে উঠছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীতে মির এমন এক পর্যায়ে নেমে এসেছে যেখানে তা রাষ্ট্রের একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা এবং স্বেচ্ছাচারী আমলাতান্ত্রিক ইচ্ছাকে জনগণ ঘৃণা করে এবং এই ক্ষমতা এবং স্বেচ্ছাচারী ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ একই সাথে পরিণত হয়েছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত স্বৈরশাসন ও মির এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে।
সূত্র:
১. Bakunin: Integral Education(1869), Anarchism/A Documentary History of Libertarian Ideas, Selection, 64; Ed. Robert Graham; Black Rose Books, Newyork, pp 220
২. Principle and the organization of Brotherhood, Micheal Bakunin Selected writings, Ed. Arthur Lehning, Jonathon Cape Ltd, page 83
৩. Bakunin on Anarchism, Ed. Sam Dolgoff Black Rose Books, Montreal, 1980, pp. 93-94
৪. Four Anarchist Writing, Michael Bakunin Selected writings, Ed. Arthur Lehning, Jonathon Cape Ltd, page 174