- অনুবাদ: তানভীর আকন্দ
ইউরোপে ১৮৪৮ সালের তুমুল মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতায় নেমে এসছিল এক অমানিশা। একিদিকে বুর্জোয়া বিশ্বাসঘাতকতা অন্যদিকে আতঙ্ক আর হতাশায় নিমজ্জিত শ্রমজীবী মানুষ! বিপ্লবী শ্রমজীবীদের উজ্জীবনে তরুণ বাকুনিনের কালজয়ী ভাষণ স্লাভদের প্রতি আহ্বান । এতে বাকুনিন পরিস্কার করেন যে, বুর্জোয়ারা নিজেরাই নিজেদের বিপ্লব-বিরোধী শক্তি হিসেবে উন্মোচিত করেছে এবং বিপ্লবের ভবিষ্যত শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গেই আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। দ্বিতীয়ত, বিপ্লবের জন্য অস্ট্রীয় সাম্রাজ্যর ভাঙ্গন এবং মধ্য ও পুর্ব ইউরোপে মুক্ত স্লাভ রিপাবলিক মহাসংঘ (Federation of free Slav republics) প্রতিষ্ঠা একটি অনিবার্য শর্ত। তৃতীয়ত: অত্যাসন্ন বিপ্লবে কৃষক বিশেষত রুশ কৃষকরা কার্যকর ভূমিকা নিতে পারবে এবং বিপ্লবকে পুর্ণাঙ্গ রূপ দিতে সক্ষমত হবে।
ইউরোপের ইতিহাসে বাকুনিনের এই সম্ভাষণকে মাইলফলক হিসেবে অভিহিত করেছেন ই এইচ কার। ১৮৪৮ সালের অস্ট্রীয় মার্চ বিদ্রোহে অংশগ্রহণের জন্য বাকুনিনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরে রাশিয়ায় রাজবন্দী হিসেবে হস্তান্তর করা হয়। তরুণ বাকুনিনের মধ্যে বিদ্রোহের পাশাপাশি ব্লাঙ্কিবাদী ঝোঁক ছিল। স্লাভদের প্রতি আহ্বান -এ তা বেশ পষ্ট। তাঁর এই ঝোঁক কাটতে সময় লেগেছিল আরও দেড় দশক।
১৯৭১ সালে স্যাম ডলগফ স্লাভদের প্রতি আহ্বান অনুবাদ করেন। Bakunin on Anarchy গ্রন্থে এটি প্রকাশিত হয়। বর্তমান বাংলা অনুবাদ সংস্করণটি সেখান থেকেই অনুসৃত।-সম্পাদক
মূল রচনা
ভাইয়েরা, সিদ্ধান্ত নেয়ার এটাই সময়। সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাদেরই, পুরনো পৃথিবীর এই ধ্বসংস্তূপকে ঠিকা দিয়ে আরও কিছুকাল চালিয়ে নিবেন আপনারা নাকি নতুন এক পৃথিবী— যার প্রতিভাস আপনাদের স্পর্শ করেছে, যেই পৃথিবী ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ও অনাগত শতাব্দীর জন্য— তার পক্ষে দাঁড়াবেন। ভবিষ্যতের নিয়ন্ত্রণ আপনাদের হাতে রাখতে চান নাকি আবারও নিমজ্জিত হতে চান অক্ষমতায়, আশাহীন অন্ধকারে, দাসত্বের নরকে— সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভারও আপনাদেরই হাতে। মুক্তিকামী অপরাপর মানুষদের ভাগ্য ঝুলে আছে আপনাদের সিদ্ধান্তের ওপরই। আপনাদের সিদ্ধান্তই তাদেরকে লক্ষ্যের দিকে দ্রুতপায়ে, কোনো বিচ্যুতি ছাড়াই এগিয়ে যেতে প্রেরণা জোগাবে, নয়তো এই লক্ষ্য, যা কখনোই হারিয়ে যেতে পারে না, অপসৃত হবে কোনো দূর অন্ধকরাচ্ছন্নতায়।
এক রুদ্ধশ্বাস উদ্বেগ নিয়ে সকলেই চেয়ে আছে আপনাদের দিকে। আপনাদের সিদ্ধান্তই ঠিক করে দিবে এই পৃথিবীর আশা ও ভাগ্যের প্রতীতি কী হবে— তার ত্বরিৎ আগমন ঘটবে নাকি তা সরে যাবে সুদূর ও অনিশ্চিত কোনো ভবিষ্যতের দিকে। তা হবে আপনারই কল্যাণ অথবা লোকসান। জনতার আশীর্বাদ থাকবে আপনার ওপর নাকি তার ভর্ৎসনা, আপনিই বেছে নেন।
সারা বিশ্ব ভাগ হয়ে গেছে দুটি শিবিরে; এক অংশে বিপ্লব আর অন্য অংশে প্রতিবিপ্লব। এবং স্পষ্ট বিকল্প আপনাদের সামনে। আমাদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ শিবির বেছে নিতে হবে, এটা আপনাদের ক্ষেত্রে যেমন আমাদের নিজেদের ক্ষেত্রেও সত্য। মধ্যপন্থা বলে কিছু নেই। যারা মধ্যপন্থার দিকে ইঙ্গিত করে, হয় তারা নিজেরা ধাঁধায় পড়ে আছে অথবা আপনাকে ধাঁধায় ফেলতে চাচ্ছে।
আমরা যদি এই সংগ্রামে উভয় প্রতিপক্ষকেই জায়গা করে দিই, যাতে করে দুজনকেই খুশি রাখা যায় এবং অনিবার্য এবং আবশ্যক সংঘর্ষের বিস্ফোরণ এড়ানো যায়, তাহলে সুনিশ্চিতভাবেই আমরা লক্ষ্যের দিকে অনায়াসে এগিয়ে যেতে পারব— এই মিথ্যায় যারা বিশ্বাস রাখে তারা আত্মপ্রবঞ্চণার শিকার।
তারা প্রতারক যদি তারা আপনাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, কূটনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে আপনাকে একটা সময় পর্যন্ত নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে হবে, এবং অবশেষে ক্ষমতাশালী অংশটাকেই বেছে নিতে হবে, এবং নিজের ব্যক্তিগত সুযোগসুবিধা আদায় করে নিতে হবে যাদের আপনি সাহায্য করেছেন তাদের হাত ধরে।
ভাইয়েরা, কূটনৈতিক কৌশলে আপনারা বিশ্বাস স্থাপন করবেন না। পোল্যান্ডের ধ্বংস ডেকে এনেছে এটা। এবং একই পরিণতি আপনাদেরও হবে। এইসব কূটনৈতিক চাতুরি আপনাদের কী বলে? আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে পারবেন শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য। কিন্তু আপনারা কি দেখতে পাচ্ছেন না, এটাকে ব্যবহার করতে পারার বদলে বরং আপনিই এইসব কূটনীতিকদের হাতের অস্ত্রে পরিণত হচ্ছেন? যেই অস্ত্র ব্যবহার করে তারা নিজেদের শত্রুকে পরাস্ত করে। আর তাদের পরাস্ত করবার পর এরা আপনার দিকে ঝুঁকবে সেই সময়ে আপনি যখন একা ও দুর্বল হয়ে পড়েছেন, আর তখন আপনি নিজেই আপনার মাথা নুইয়ে নিবেন জোয়ালের তলে। আপনারা কি দেখতে পাচ্ছেন না, এই লজ্জাজনক কৌশল, এই ফন্দিফিকিরকে কাজে লাগাচ্ছে প্রতিবিপ্লবীরা? আপনারা কি জানেন না নিপীড়কদের সেই পুরাতন প্রবাদবাক্য: বিভক্তি ঘটাও আর শাসন করো।
কূটনীতির কাছ থেকে কীইবা আশা করা যায়? নিজের উৎসকে অস্বীকার করতে পারবে এটা? যেই কিনা স্বৈরতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না? এর উৎপত্তির জন্য যাদের কাছে সে ঋণী তাদের ছাড়া অন্যদের স্বার্থে কি সে লড়তে পারে? এটা কি কাজ করতে পারে নতুন এক বিশ্ব গড়ার জন্য? যেই বিশ্বে একে নিন্দা জানানো হবে এবং এর মৃত্যু ঘটবে সেখানে? কখনোই না। এর চেহারার দিকে সোজা তাকিয়ে দেখেন, এর মুখের ওপরই সেঁটে দেয়া আছে শয়তানের আদিরূপ, ছলনা ও বিশ্বাসঘাতকতা, যা আপনাদের মধ্যে তীব্র ঘৃণার উদ্রেগ করবে।
একে খারিজ করে দেবেন আপনারা, কেননা মিথ্যা থেকে কখনই সত্যের জন্ম হতে পারে না। অধমের দ্বারা সত্যিকার অর্থে কখনই মহৎ কিছু সংঘটিত হতে পারে না, এবং স্বাধীনতা কেবলমাত্র স্বাধীনতার দ্বারাই জয় করা সম্ভব।
প্রাচীন জার্মান রাজনীতিকে গালাগালি করার যথেষ্ট কারণ আছে আপনাদের, আপনাদের ন্যায়সঙ্গত ঘৃণা এর প্রাপ্য, কেননা এটা আপনাদের ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই চায় না। আপনাদের বন্দি করে রেখেছে কয়েক শতাব্দী ধরে, এমনকি ফ্রাঙ্কফুটের আগেও আপনাদের ন্যায্য আশা এবং আহ্বানকে কটাক্ষ করে এসেছে… এবং প্রাগ কনগ্রেস ভেঙে যাওয়াতে ভিয়েনাতে তারা উল্লাস করেছে। কিন্তু বিভ্রান্ত হবেন না এবং মনোযোগ দিয়ে শুনুন। এই পুরাতন রাজনীতি, যাকে আমরা আপনাদেরই মতো তিরস্কার করি, গালাগালি করি, যার বিরুদ্ধে শোধ নেওয়ার জন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, এই রাজনীতি ভবিষ্যৎ জার্মানির মানুষের কাছে স্থান করে নিতে পারবে না কখনোই। জার্মান বিপ্লব এটি নয়, এটি জার্মান গণতন্ত্রেরও অংশ নয়। নিছক প্রাচীন রাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্র, রাজতন্ত্রের অধিকার, অভিজাত ও অগ্রসর সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষদের রাজনীতি এটি। এটা রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা ও সেনানায়কদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি, যেনবা তারা কোনো যুদ্ধযন্ত্র। এটা সেই রাজনীতি যার পতনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা— আমরা সকলেই যারা তারুণ্য ও ভবিষ্যতের উদ্যম নিয়ে এগিয়ে চলেছি, যারা সকল দেশের সব গণতন্ত্রকামী মানুষের হাতে হাত রাখবে আনন্দের সাথে, যাতে করে আমরা একসাথে, একতাবদ্ধ হয়ে, লড়াই করতে পারি সকলের মঙ্গলের জন্য, সব মানুষের ভবিষ্যতের জন্য।
সকল প্রতিশ্রিয়াশীল কর্ম একত্র হয়েছে মদ মতলব নিয়ে। আমাদেরও কি তাই করা উচিত নয়, আমাদের সুমতলবের বাস্তাবায়নের জন্য? প্রতিক্রিয়াশীলতা যখন সমগ্র ইউরোপজুড়ে চক্রান্ত করে বেড়াচ্ছে, কোনো মাত্রা ছাড়াই কাজ করে চলেছে, ধীরে ধীরে সতর্কতার সাথে প্রস্তুত করা সংগঠনের সাহায্য নিয়ে, সবখানেই যা বিস্তৃত হচ্ছে, বিপ্লবেরও এর সাথে লড়াই করার মতো শক্তি দাঁড় করানো উচিত।
বিপ্লবের সৈনিক ও দেশ–দেশান্তরের সাম্যবাদীদের পবিত্র দায়িত্ব এটা, আমাদের শক্তিকে একত্র করা, একটা সমঝোতায় আসা ও সংগঠিত হওয়া।
আপনারাতো জানেনই যে, বিপ্লবের প্রাণের অস্তিত্বে নীপিড়কদের প্রাচীন রাজনীতির বিরুদ্ধে ঘৃণার সুদীর্ঘ এক বিস্ফোরণ রয়েছে, আছে দীর্ঘ সহানুভূতিশীল কান্না এবং সকল নীপিড়িত জাতিসমূহের প্রতি ভালোবাসা।
দীর্ঘকাল ধরে যেই জনগণকে কূটনীতির শেকলে বেঁধে চালানো হয়েছে, অবশেষে তারা তাদের এই লজ্জাজনক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছে। তারা বুঝতে পেরেছে যে জাতিসমূহের মঙ্গল নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত ইউরোপের কোনো স্থানে একজন মাত্র ব্যক্তিও দাসত্বের তলে মাথানত করে আছে, বুঝতে পেরেছে যে কোনোখানে মানুষের স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে সে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে সর্বত্রই। এবং প্রথমবারের মতো মানুষ সমস্বরে দাবি জানিয়েছে স্বাধীনতার, যেই স্বাধীনতা সত্য এবং পূর্ণাঙ্গ, যেখানে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই, কোনো বিকল্প নেই, কোনো সীমাবদ্ধতা নেই।
অত্যাচারীরা বিদায় হোক! এটাই ছিল বিশ্বজনীন আর্তনাদ। নিপীড়িতদের জন্য স্বাধীনতা, পোলিশদের জন্য, ইতালীয়দের জন্য, সকলের জন্য! আর কোনো দখলদারিত্বের যুদ্ধ নয়। শুধুমাত্র এই সর্বশেষ মহান লড়াই, সকল মানুষের মুক্তির জন্য এই বিপ্লবের লড়াই। দূর হোক শাসকরাজাদের তথাকথিত ঐতিহাসিক, ভৌগলিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কৌশলের প্রয়োজনীয়তার নামে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া সংকীর্ণ এই সীমান্ত। আর কোনো সীমান্ত থাকাই উচিত নয়, শুধুমাত্র গণতন্ত্রের উদ্দীপনা অনুসারে প্রকৃতি ও ন্যায়বিচারের প্রতি স্বতস্ফূর্ত সাড়াপ্রদান করে যেই সীমান্ত প্রতিষ্ঠিত হয় তা ছাড়া, যেই সীমান্ত জনগণ তালাশ করবে তার নিজস্ব জাতীয়তাবোধের ওপর ভিত্তি করে সার্বভৌম ইচ্ছার মাঝে। এটাই ছিল সমস্ত মানুষের সমস্বরে আর্তনাদ।
ভাইয়েরা, আপনারা কি শুনতে পাননি এই মহান আর্তনাদ?
এই ভিয়েনাতেই, মানে আছে আপনাদের? আপনারা শুনতে পেয়েছিলেন এবং উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এটা সেইদিন, যখন আপনারা লড়ে যাচ্ছিলেন অন্যদের সাথে সকলের মঙ্গলের জন্য, আপনারা জেগে উঠেছিলেন জার্মান প্রতিরোধের বিরুদ্ধে, সেই মহান স্লাভ প্রতিরোধ যার ওপর আপনাদের জাতীয় পতাকা উড়েছিল, এই স্লোগানসহ: আমাদের ভবিষ্যৎ স্বাধীনতার প্রতি!
কী মহান, কী চমৎকার ছিল এই আন্দোলন, সমগ্র ইউরোপজুড়েই যা ছড়িয়ে পড়েছিল এবং কাঁপিয়ে দিয়েছিল গোটা ইউরোপ। বিপ্লবী প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে, ইতালীয়, পোলিশ, স্লাভ, জার্মান, ম্যাগিয়ার, অস্ট্রিয়া ও তুর্কির ওয়ালেকিয়ানরা— যারাই বিদেশি শক্তির অধীনে নিপীড়িত হয়েছে, তারাও জেগে উঠেছিল, আশা ও আনন্দে শিহরিত হয়েছিল। সবচাইতে দুঃসাহসী স্বপ্নগুলোরই বাস্তবায়ন ঘটতে চলেছিল। জনগণ দেখতে পেলো বহু শতাব্দী ধরে যেই পাথর তাদের স্বাধীনতাকে চাপা দিয়ে রেখেছে তা দূরে সরে যাচ্ছে, যেন অদৃশ্য কোনো হাত তাকে ঠেলে নিয়ে গেছে। মন্ত্রপুত তালা গিয়েছিল ভেঙে, আর এতগুলো জ্যান্ত-মরা মানুষের বিমর্ষ অসাড়তাকে পাহাড়া দিয়ে রেখেছিল যেই ড্রাগন, আহত হয়ে পড়ে ছিল সে, আর মরণযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। রাজ-রাজরাদের পুরনো রাজনীতি বিদায় নিলো আর এক নতুন জনতার রাজনীতি জীবন লাভ করল।
বিপ্লব তার সার্বজনীনতা নিয়ে বিলুপ্তি ঘোষণা করেছে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের; বিলুপ্তি ঘোষণা করেছে পোল্যান্ডের একটা অংশ পরিত্যাগ করে যাওয়া প্রুশীয় সম্রাজ্যের; নানা কৌশলে নানা অপরাধের বাঁধনে বেঁধে নানা জাতির সমন্বয়ে যেই দানবের প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল সেই অস্ট্রিয়ান সম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘোষণা করেছে: তুর্কী সম্রাজ্যের পতন ঘটেছে, যেই সম্রাজ্যে বারো মিলিয়ন স্লাভ, ওয়ালাচিয়ান ও গ্রিক জনগোষ্ঠীকে পদদলিত করতে একত্র হয়েছিল সাত মিলিয়ন ওসমানলিস। এবং অবশেষে স্বৈরতন্ত্রের সর্বশেষ দুর্গের পতন সম্পন্ন হলো, মেকাইভেলিবাদ ও কূটনীতির সর্বশেষ যে নিজস্ব অঞ্চল অবশিষ্ট রয়েছে তার একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত রাশিয়ান সম্রাজ্যে আঘাত করা হলো, যাতে করে বৃহত্তর রাশিয়া, ক্ষুদ্র রাশিয়া এবং পোল্যান্ডের সীমান্তের ভেতর এতকাল ধরে দাসত্বের বন্ধনে আটকে থাকা তিন তিনটি মহান জাতি অবশেষে নিজেদের মুক্ত করে নিতে পারে, এবং নিজেদের সংগঠিত করতে পারে, স্লাভ জাতির সকল ভাইদের প্রতি তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে।
আর এরই পরিণতি সমগ্র উত্তর ও পূর্ব ইউরোপজুড়েই বিলুপ্তি, উৎখাত ও পুনরোজ্জীবন ও স্বাধীন ইতালি। এবং এর চূড়ান্ত ফলফল হচ্ছে ইউরোপীয় প্রজাতন্ত্রসমূহের সার্বজনীন ফেডারেশান।
তারপর আমাদের মোলাকাত হলো প্রাগে, যারা দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর আবারও ভ্রাতৃরূপে একত্র হয়েছে একে অপরকে এটাই জানাতে যে তাদের পথ আর কখনোই বিভক্ত হবে না। ইতিহাস ও রক্তের অভিন্ন বন্ধনে প্রবলভাবে উজ্জীবিত হয়ে আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি যে আমরা আর কখনোই নিয়তিকে আমাদের বিভক্ত করে ফেলতে দেবো না। স্বৈরাচারের রাজনীতিকে আমরা পরিত্যাগ করেছি, দীর্ঘকাল ধরে যেই স্বৈরাচারের শিকারে পরিণত হয়ে ছিলাম আমরা। এবং আমরা নিজেদের চূড়ান্ত স্বাধীনতার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা নিজেদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি যে সকল স্লাভ জনগণই এই স্বাধীনতার অংশীদার হবে। বোহেমিয়াও মোরাভিয়াকে আমরা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছি। ফ্রাঙ্কফুট (সংসদ) এর অযৌক্তিক দাবিকে আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি, ইউরোপজুড়ে যা আজ এক হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছে। তারা আমাদের সবাইকে জার্মান বানিয়ে ফেলতে চেয়েছিল, যেখানে আমরা আমাদের ভ্রাতৃত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি জার্মান জনগণের দিকে, গণতান্ত্রিক জার্মানির দিকে। হাঙ্গেরিতে বসবাসরত স্লাভদের অছিলায় আমরা ম্যাগিয়ারদের প্রতি আমাদের ভ্রাতৃপ্রতীম মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। যার কিনা আমাদের জাতির অগ্নিতুল্য শত্রু। সবেমাত্র ৪০ লক্ষ মানুষ নিয়ে যারা ৮০ লক্ষ স্লাভদের দাসে পরিণত করতে চেয়েছিল। স্বাধীনতার জন্য আমাদের যে চুক্তি তাতে আমরা ভুলে যাইনি তুর্কী আধিপত্যের অধীনে কেঁদে মরা আমাদের ভাইদের কথাও।
পোল্যান্ডকে তিন তিনবার দ্বিধাবিভক্ত করে দেয়া অপরাধমূলক রাজনীতি যা এখন আবারও অবশিষ্ট যাকিছু আছে তাকেও টুকরো টুকরো করে দেয়ার তালে আছে, আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই। আমাদের আকুল আকাঙ্ক্ষা এই যে, সেই মহান ও পবিত্র শহীদ জনগোষ্ঠীকে আমরা আমাদের সকলের মুক্তির নিশানা হয়ে পুনরুজ্জীবিত হতে দেখব খুব শ্রীঘ্রই। অবশেষে, মহান রাশিয়ান জনগণের প্রতি আমরা দৃঢ় আহ্বান জানিয়েছি। সকল স্লাভদের মধ্যে একমাত্র তারাই জাতিগত অস্তিত্ব জিইয়ে অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হয়েছে। রাশিয়ানদের কাছে আমাদের আবেদন ছিল যে তারা যা খুব ভালোভাবে জানে সে ব্যাপারে গভীরভাবে ভেবে দেখতে। আর তা হচ্ছে যতক্ষণ না তারা নিজেরাই স্বাধীন হতে পারছে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের ক্ষমতাকে দুর্দশাগ্রস্থ পোল্যান্ডের উপর চাবুক চালানোর কাজে ব্যবহারের অনুমতি দিচ্ছে, যতক্ষণ পর্যন্ত তা ইউরোপীয় সভ্যতার জন্য চিরস্থায়ী হুমকি হয়ে রয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের জাতীয়তা এবং মাহাত্মের কোনো অর্থই থাকছে না আর।
সকল দেশের গণতান্ত্রিকদের সাথে মিলে আমরা যা করেছি, আমাদের দাবি জানিয়েছি যে: জাতিসমূহের স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব। আর যার মধ্য দিয়ে স্লাভ জনগোষ্ঠী খুব দ্রুতই হয়তো একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হবে, যেখানে তারা এই জাতিরাষ্ট্রসমূহের মতোই স্বাধীন এবং সকলের সাথে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কে আবদ্ধ, কিন্তু নিজেদের মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠ মৈত্রীর বন্ধনে একতাবদ্ধ থাকবে।
বসন্তের একেবারে শুরুর দিন থেকেই দুটি বড় প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে, যেনবা স্বতস্ফূর্তভাবেই উঠে আসছে প্রশ্ন দুটি। এক দিকে সামাজিক প্রশ্ন আবার অপরদিকে সকল জাতিসমূহের স্বাধীনতা, জনগণের বন্ধনমুক্তির প্রশ্ন। আর এদুটি প্রশ্নই ভিতরে ও বাহিরের বন্ধনমুক্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে। না স্রেফ কতিপয় ব্যক্তি বা কোনো দল নয়, বরং জনগণের অপূর্ব সেই প্রবৃত্তিই এ দুটি প্রশ্নকে সামনে তুলে ধরেছে, এবর এর ত্বরিৎ সমাধানের দাবিও জানিয়েছে। প্রত্যেকেই এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছে যে যেখানে জনগণের সিংহভাগকেই এক দুর্বিষহ অস্তিত্বে পরিণত করা হয়েছে, যেখানে শিক্ষা, অবসর এবং খাবার বঞ্চিত হয়ে এই জনগণের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাবান ও ধনীদের ভারবাহী হয়ে থাকা, সেখানে স্বাধীনতা নিছক একটি মিথ্যাচার মাত্র। ফলে রাজনৈতিক বিপ্লবের স্বাভাবিক, জরুরি অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে সামাজিক বিপ্লব। অনুরূপভাবে এটাও উপলব্ধি হয়েছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত ইউরোপে একটি মাত্র নিগৃহীত জাতিও বিরাজ করছে ততক্ষণ পর্যন্ত কোথাওই গণতন্ত্রের চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গ বিজয় সম্ভব নয়। একের উপর নিপীড়ন মানে সকলের উপরই নিপীড়ন। সকলের স্বাধীনতা লঙ্ঘন না করে একের স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হতে পারে না। বিপদের দ্বারা কণ্টকাকীর্ণ ও ঝড়ের পূর্বলক্ষণে দুর্বহ এক জটিল প্রশ্ন হচ্ছে এই সামাজিক প্রশ্ন। এবং পূর্বানুমিত তত্ত্ব বা বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যবস্থার দ্বারা এর সমাধান সম্ভব নয়। এর সমাধান দাবি করে সদিচ্ছা ও সর্বসম্মত সহযোগিতার। সকলের সমান স্বাধীনতার অধিকারে সমস্ত জনগণের বিশ্বাস স্থাপনের দাবি করে এটি। বর্তমানকালে আমাদের অস্তিত্বের বস্তুগত ও নৈতিক যে অবস্থাগুলো রয়েছে সেগুলোকে রূপান্তরিত করতে হবে যদি আমরা উপর থেকে নিচে আমূল পাল্টে দিতে চাই জরাজীর্ণ এই সামাজিক বিশ্বকে। যেই বিশ্ব হয়ে উঠেছে নির্বীর্য ও নিষ্ফলা। এই বিশাল জনতার স্বাধীনতাকে ধারণ করতে বা সমর্থন করতেও যা হয়ে পড়েছে অক্ষম। আমাদের প্রথমে অবশ্যই পারিপাশ্বিক আবহকে দূষণমুক্ত করতে হবে, পুরোদস্তুর রূপান্তরিত করতে হবে আমাদের পরিবেশকে, কেননা এটি আমাদের হৃদয় ও মনকে সঙ্কীর্ণ করে দিয়ে আমাদের প্রবৃত্তি ও ইচ্ছাশক্তিকে কলুসিত করে। আর এভাবেই সামাজিক প্রশ্নটি সর্বাগ্রে সমাজকে আমূল পাল্টে দেয়ার প্রশ্ন হিসেবে হাজির হয়।