অরাজ
আর্টওয়ার্ক: প্যারিস কমিউন সংগ্রহ: গেটি ইমেজ
প্রচ্ছদ » মিখাইল বাকুনিন।। অরাজ : রাষ্ট্রহীন সমাজতন্ত্র

মিখাইল বাকুনিন।। অরাজ : রাষ্ট্রহীন সমাজতন্ত্র

অনুবাদ: নুরে আলম দুর্জয়

মিখাইল বাকুনিন উনিশ শতকের রুশ নৈরাজ্যবাদী। সমাজতন্ত্রকে তিনি ফরাসি বিপ্লবের বিকশিত রূপ হিসেবে দেখেছেন। বাকুনিন মনে করতেন, সমাজতন্ত্র ছাড়া স্বাধীনতা বেইনসাফি আর স্বাধীনতা ছাড়া সমাজতন্ত্র স্বেচ্ছাচার-নির্মমতা।

বর্তমান রচনাটি বাকুনিনের Stateless Socialism: Anarchism’র বঙ্গানুবাদ। রুশ নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনের অন্যতম চিন্তক গ্রেগরি ম্যাক্সিমফ সম্পাদিত The Political Philosophy of  Bakunin বইয়ে রচনাটি সংকলিত হয়। নিউইয়র্কের ফ্রি প্রেস থেকে ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় বইটি।

মূলপ্রবন্ধ

মিখাইল বাকুনিন

ফরাসি বিপ্লবে ঘোষিত মহাননীতির প্রভাব

বিপ্লব অস্পষ্ট নয় বরং যৌক্তিক। স্বর্গীয় নয় বরং পার্থিব। অতিমানবিক কেচ্ছাকাহিনী নয় বরং মানুষের গল্প, মানুষের স্বাধীকারেরই ন্যায্যতা। ফরাসি বিপ্লব যখন এই নিদারুণ সত্য নিয়ে উপস্থিত, তখন দাবি করা হলো সব মানুষই সমান, সব মানুষই স্বাধীনতা-সাম্যের হকদার। এতে করে, এতদিন ধর্মীয় শাসনের ঘোরতর আফিমে বুঁদ হয়ে ছিল যে ইউরোপ এবং বিশ্বের সব সভ্য দেশ, তাদের জনগণের ঘুম ভেঙ্গে গেল। এবার তারা নিজেরাই প্রশ্ন করতে শুরু করল, তাদেরও কি সমতা, স্বাধীনতা এবং মানবতার হক আছে?

সহজাত জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধি দ্বারা যারা চালিত হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবে, সমতার এই প্রশ্ন সামনে আসতে না আসতেই তারা বুঝতে পারল যে, অর্থনৈতিক অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবতর্নই তাদের সত্যিকারের এবং মানবিক মুক্তির প্রথম শর্ত। রোজকার রুটি-রুজির প্রশ্নই তাদের কাছে প্রথম প্রশ্ন হিসেবে দাঁড়াল। যেমনটা অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, মুক্ত চিন্তার জন্য, মুক্তি অনুভবের জন্য এমনকি খোদ মানুষ হওয়ার জন্য অবশ্যই প্রতিদিনের রুটি-রুজির প্রশ্ন থেকে মুক্ত হতে হবে।

এই জন্য বুর্জোয়ারা যারা এতদিন জনমানুষের সহজাত জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধির বাইরে অবস্থান করতো, জনতার বস্তুগত অস্তিত্বর বিরুদ্ধে গলা খেকিয়ে সবচেয়ে বেশি হাউকাউ করত, জাত গেল জাত গেল বলে ফাল পাড়ত; সেই কুলীনরাই সাম্য-স্বাধীনতার ব্যাপারটা কোন ধরনের গাইগুই ছাড়াই, বাড়তি প্যাঁচাল ছাড়াই একবাক্যে স্বীকার করে নিল। কিন্তু তারা নিজেরাই জানতো, এই স্বীকারোক্তি শুধু মুখে, বাস্তবে এর কোন উদাহরণ প্রতিষ্ঠা তাদের লক্ষ্য নয়।

এরপর, জনতার সামনে এলো দ্বিতীয় প্রশ্ন- শ্রমের পরে অবসর, যা কিনা মানবতার অপরিহার্য শর্ত। কিন্তু সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তর ছাড়া কখনোই সেই রুটি-রুজি কিম্বা অবসর অধিকার সম্ভব না। আর তাই যেসব মৌলিক নীতির উপর ভিত্তি করে বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল, তা থেকেই অনিবার্যরূপে জন্ম নেয় সমাজতন্ত্র।

সমাজতন্ত্রই ন্যায়বিচার

সমাজতন্ত্র হলো ন্যায়বিচার। যখন আমরা ন্যায়বিচারের কথা বলি তখন আমরা আসলে রোমান আইনশাস্ত্রের বিচার বুঝি না, যা মূলত প্রতিষ্ঠিত ছিল বলপ্রয়োগ এবং সহিংসতার উপর ভিত্তি করে। কালের ব্যবধানে এবং ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ঝাঁড়ফুঁকে বা কলকাঠিতে এই সহিংসতাকে পবিত্র বলে জপ করতে করতে ঢুকিয়ে দেয়া হয় মানুষের মগজে। করে তোলা হয় সর্বমান্য এবং পরিণতিতে তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় চূড়ান্ত নীতি হিসেবে।

না, আমরা সেই ন্যায়বিচারের কথা বলছি, যা মানুষের বিবেকবোধের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, সেই ন্যায়বিচার যা সব মানুষের মননে বিকশিত, সেই ন্যায়বিচার যা শিশুদের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যাবে। এটা সেই ন্যায়বিচার, এক কথায় যার নাম- সমতা।

এই ন্যায়বিচারই নতুন দুনিয়ার ভিত্তি যা এখন পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক, বিচারিক বা অর্থনৈতিক বিশ্বে দেখা যায়নি। এই ন্যায়বিচার ছাড়া স্বাধীনতা, জনতন্ত্র, সমৃদ্ধি, শান্তি কোনোটাই থাকতে পারে না বা থাকে না। কার্যকর শান্তিপ্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যেতে এই ন্যায়বিচারই আমাদের পথ দেখাবে। ভয়ঙ্করভাবে নিপীড়নের শিকার মানুষের পাশে দাঁড়াতে এবং তাদের অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবি জোরালো করতে আমাদের চালিত করে এই ন্যায়বিচার।

সমাজতন্ত্রের মূলনীতি

সুধীগণ, আমরা এখানে আকাশ থেকে পড়া কোনো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলছি না। আমরা যা চাই তা হলো, নতুনভাবে ফরাসি বিপ্লবের সেই মহান নীতির ঘোষণা: মনুষ্যত্বর বিকাশের সব ধরনের বস্তুগত ও নৈতিক পন্থা মানুষের হাতেই থাকবে।

এই মৌলিক নীতিকে আমরা প্রকাশ করতে পারি এভাবে :

জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই বিচিত্র সৃজনশীলতার বিকাশ ও প্রয়োগের সমান সুযোগ থাকবে।  এমন একটি সমাজ গঠন করতে হবে, যেখানে অসম্ভব হয়ে পড়বে অন্তহীন শ্রম-শোষণ। প্রত্যেকেই সামাজিক সম্পদ ভোগ করবে যা বাস্তবে উৎপাদিত হবে সমাজেরই যৌথ শ্রমের মাধ্যমে। কিন্তু ততক্ষণই কেবল ওই সম্পদ ভোগ করবে যতক্ষণ সে সম্পদ সৃষ্টিতে সরাসরি অবদান রাখবে।

রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র বাদ

সমাজতন্ত্রের জন্য আমাদের শতাব্দীর পর শতাব্দী লড়াই করতে হতে পারে। কিন্তু ইতিহাস এরই মধ্যে এই গুরুতর প্রশ্নকে আমাদের সামনে হাজির করেছে। আমরা তাকে উপেক্ষা করতে পারি না। যদি করি তবে তা হবে আত্মপ্রতারণা। নিজের কাছে আজীবন ঘৃণ্য হিসেবেই বিবেচিত হব।

আমরা খুব জোরালোভাবে যেকোনো ধরনের সমাজসংস্থাকে প্রত্যাখান করছি যা অস্বীকার করে ব্যক্তি এবং সংগঠনের পূর্ণ স্বাধীনতা। আমরা তীব্রভাবে প্রত্যাখান করছি যে কোন ধরনের ক্ষমতার সংস্থাপণকে যা রেজিমেন্টেড, কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণমূলক ।

স্বাধীনতাই আমাদের মূলভিত্তি। এমনকি অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সংগঠনেরও একমাত্র সৃজনশীল নীতি। তাই মুক্তির নামে নিয়ন্ত্রণমূলক রাষ্ট্রীয় সাম্যবাদ বা রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রর প্রাদুর্ভাব হলে তাকে প্রতিরোধ করা আমাদের কর্তব্য।

উত্তরাধিকার আইনের বিলোপ

উত্তরাধিকার আইন রাষ্ট্রেরই সৃষ্টি। কর্তৃত্বপরায়ণ ও ঐশি রাষ্ট্রের টিকে থাকার প্রধান শর্ত। ন্যায়ভিত্তিক মুক্ত সমাজে রূপান্তরের জন্য এই রাষ্ট্রের বিলোপ করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই বিলোপ না হচ্ছে, রাষ্ট্রের উত্তরাধিকার আইনের মাত্রা একটু একটু করে কমিয়ে আনতে হবে যাতে তার উচ্ছেদ ঘটে। আর তা সম্ভব কেবল স্বাধীনতার মাধ্যমেই।

আমরা মনে করি, সব ধরনের উত্তারাধিকার বিলোপ ঘটনো দরকার। যতক্ষণ এই অধিকার থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত বংশানুক্রমিকভাবে অর্থনৈতিক অসমতা বিরাজ করবে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এই অসমতা প্রাকৃতিক নয় বরং শ্রেণীগত এবং কৃত্রিম, মানুষের বানানো।  এতে করে পুনপৌনিকভাবে মানবীয় বিকাশ অসম হয়ে হয়ে পড়ে এবং চৈতন্য গঠনকে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে বেঁধে ফেলে।  আদতে যা কিনা অন্যান্য সব ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক অসমতার পুতঃপবিত্র উৎস হিসেবে কাজ করে।

ন্যায়বিচার কায়েমে প্রধান কাজ হল সমতা প্রতিষ্ঠা। যা কিনা আদতে নির্ভর করে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমাজ-সংগঠনের উপর।  এই সমতা এমন ধরনের, যাতে মানুষ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী জীবন শুরু করতে পারে এবং প্রত্যেকে হয়ে ওঠে তার নিজস্ব কর্মরেই প্রতিরূপ।

আমাদের মতে, সদ্য মৃতদের সম্পত্তি সামাজিক তহবিলে জমা করতে হবে। জন্মের পর থেকে সাবালক না হওয়া পর্যন্ত জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে তা ব্যয় হবে সবার শিক্ষা-দীক্ষার জন্য।

জনগণের সব সম্পত্তি শুধু তাদের অধিকারেই যাবে, যারা নিজ হাতে এর চাষ করে। আর এই মৌলিক ধারণাটি স্লাভ বা রাশিয়ান হিসেবে আমাদের জনগণের ঐতিহ্যগত সাধারণ প্রবৃত্তির উপরই প্রতিষ্ঠিত।

আমরা মনে করি, এসব মৌলিক নীতি ন্যায্য এবং সব ধরনের গুরুতর সামাজিক সংস্কারের প্রয়োজনীয় ও  অপরিহার্য শর্ত। কাজেই পশ্চিম ইউরোপ এই নীতি বুঝতে এবং গ্রহণ করতে ব্যর্থ হবে না। দেশে দেশে এই বোঝাপড়ার ভিন্নতা থাকতে পারে। যেমন, ফ্রান্সে অধিকাংশ কৃষক যে ভূমি চাষ করেন তারা সেটার মালিক। কিন্তু শিগগিরই তাদের বেশিরভাগই ভূমি থেকে উচ্ছেদ হবে এবং মালিকানা শুন্য হয়ে পড়বে। এটা ফ্রান্সে যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জারি আছে তারই অপরিহার্য ফল। তো, যায় হোক, ভূমির প্রশ্নে যে কোনো ধরনের প্রলোভন থেকে আমরা বিরত থাকব।  আমাদের উচিত নিজস্ব ঘোষণার উপর দাঁড়ানো।

সমাজতন্ত্রের ঘোষণা

যতক্ষণ আমজনতা মৌলিক অধিকার বিচ্যুত,  শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকবে এবং সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে অচ্ছুত ও দাস হতে বাধ্য হবে ততক্ষণ পর্যন্ত স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং শান্তির সুস্পষ্ট বোঝাপড়া অসম্ভব। এই দাসত্ব আইনগত নাও হতে পারে। দরিদ্রতা, রুটিরুজির প্রয়োজনে অবসর-বিশ্রাম ছাড়া বাধ্য-শ্রমের মাধ্যমেও আরোপ হতে পারে। দুনিয়া যে সম্পদের উপর গর্ব করে,  শ্রমে-ঘামে তার সবটা উৎপাদন করেও যখন রুটির এতটুকু একটা টুকরো জোটে না, পরদিনের জীবিকার নিশ্চয়তা থাকে না, তখন তা দাসত্বই।

শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ ভয়ঙ্করভাবে দমন-পীড়নের শিকার। মানুষের মুক্তির সমস্যা আদতে রুটি-রুজির সমস্যা। রুটি-রুজির সমস্যা মানে মানসিক মুক্তির সমস্যা। রুটি-রুজির সমস্যা মানে স্বাধীনতার সমস্যা। এমনকি মানবতার সমস্যাও বটে।

সমাজতন্ত্র ছাড়া স্বাধীনতা বিশেষ সুবিধা এবং অন্যায্য। আর স্বাধীনতা ছাড়া সমাজতন্ত্র দাসত্ব, হিংস্রতা।

লীগ [দ্য লিগ ফর পিস এন্ড ফ্রিডম] ঘোষণা করছে যে, পুঁজি ও সম্পত্তির গোলামি থেকে জনগণের শ্রম-মুক্তির লক্ষ্যে বৈপ্লবিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন প্রয়োজন। সত্যিকারের ন্যায়বিচারের উপর ভিত্তি করে এমন পুনর্গঠন, যা কল্যাণমুখি বিজ্ঞান ও সদা বিকাশমান স্বাধীনতার উপর প্রতিষ্ঠিত।  মোদ্দা কথায়, দরকার মানুষের ন্যায়বিচার; যা আদতে বিচারসংস্থা-ধর্মতত্ত্ব বা আধ্যাত্মবাদ ভিত্তিক কোন ন্যায়বিচার বা তার ভ্রম নয়।

রাজনৈতিক ক্ষমতার বদলে উৎপাদনভিত্তিক সংগঠন

সবধরনের রাজনৈতিক ক্ষমতার উচ্ছেদ দরকারি।  নীতিতে থাকুক কিম্বা বাস্তবে, রাজনৈতিক ক্ষমতা মাত্রই তাতে থাকবে শাসক ও শাসিত, মালিক ও দাস এবং শোষক ও শোষিত ।  একবার এই রাজনৈতিক ক্ষমতার বিলোপ ঘটলে তার স্থলে প্রতিষ্ঠা করতে হবে উৎপাদনী শক্তি ও অর্থনৈতিক সেবার সংগঠন।

আধুনিক রাষ্ট্রের ব্যাপক উন্নতি হলেও এর চূড়ান্ত এবং যৌক্তিক পরিণতি হচ্ছে অর্থহীন হয়ে পড়া। ধীরে ধীরে পরিস্কার হচ্ছে যে, যাবতীয় রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় নীতির দিনক্ষণ ফুরিয়ে আসছে।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, আম জনতা তাদের মুক্তির চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দিক-দিগন্তে দাবি তুলছে। জেগে উঠছে মানুষ ও তাদের মুক্ত সামাজিক সংগঠন। সরকারি হস্তক্ষেপের বাইরে মুক্ত অর্থনৈতিক সংগঠনের ছায়াতলে একত্রিত হচ্ছে তারা।  সাবেকী যত রাষ্ট্রীয় উচ্ছিষ্টভোগী এবং জাতিবাদী নীতিকে একপেশে করে শুধুমাত্র উৎপাদনমুখী ও মানবীয় শ্রমের ভিত্তিতে এত বৈচিত্র্যের মধ্যেও সাধারণ লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ।

জনতার আর্দশ

জনতার সামনে এক অভিনব আদর্শ হাজির।  যার লক্ষ্য হচ্ছে সব ধরনের অভাব ও দারিদ্রের সমাপ্তি।  যৌথ শ্রমের মাধ্যমে বস্তুগত সকল চাহিদার পূর্ণতুষ্টি। যা সবার জন্য সমান এবং সবার জন্যই প্রযোজ্য। এরপর যখনই আধিপত্য বিলুপ্ত হবে জনগণের চাহিদা পুরণে জনতারই মুক্ত সংগঠন কার্যকরী হয়ে উঠবে। এই সংগঠনের কাঠামো রাষ্ট্রের মতো উপর থেকে নিচে নয় বরং তার গঠন হবে গোড়া থেকে উপরের দিকে। যা সরকার-আইনসভার স্থলে কাজ করবে বিভিন্ন সমিতির মুক্ত ইউনিয়ন হিসেবে। কৃষি সমিতি, কারখানা-শ্রমিক সমিতি, সম্প্রদায়-সমিতি, আঞ্চলিক এবং জাতীয় সমিতির মেলবন্ধন এই মুক্ত ইউনিয়ন। আর এর মাধ্যমেই রাষ্ট্রের ধ্বংসাবশেষের উপর চূড়ান্তভাবে  প্রতিষ্ঠিত হবে বৈশ্বিক মানব সংহতি।

মুক্ত সমাজের কর্মসূচি

মাজিনিয়ান সিস্টেম মাত্রই রাষ্ট্ররূপে রিপাবলিক সিস্টেম। এর বাইরে কমিউন রূপে, ফেডারেশন হিসেবে একটি সমাজতান্ত্রিক ও  জনগণের সত্যিকারের রিপাবলিক হিসেবে নৈরাজ্যবাদ ছাড়া আর কোন পথ নেই। এটাই হচ্ছে সামাজিক বিপ্লবের রাজনীতি যার লক্ষ্য রাষ্ট্রের বিলোপ।  আর তার স্থলে জনতার অর্থনৈতিক মুক্ত সংগঠন প্রতিষ্ঠা। এই মুক্ত সংগঠনগুলো ফেডারেশনের মাধ্যমে নিচ থেকে উপরের দিকে পরিচালিত হবে।

… কোন রাজনৈতিক সরকারের অস্তিত্বের সম্ভাবনা থাকবে না। তার বদলে সরকার রূপান্তরিত হবে সাধারণ কর্মকাণ্ড পরিচালনার সরল কাঠামো।

মোদ্দা কথায় আমাদের কর্মসূচি হল:
– সকল নিপীড়িতের জন্য শান্তি, স্বাধীনতা এবং খুশালি
– সকল নিপীড়ক ও লুটেরার বিরুদ্ধে যুদ্ধ
– শ্রমজীবীদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। সমস্ত পুঁজি, কারখানা, যন্ত্রপাতি এবং কাঁচামাল যাবে শ্রমজীবীদের সমিতিতে। সম্মিলিতভাবে ভূমি থাকবে তাদের হাতে যারা নিজের হাতে ফসল ফলায়।
–  পৃথিবীর সকলের জন্য ন্যায়বিচার এবং মৈত্রী
– সকলের জন্য সমতা
– সবার জন্য বৈষম্যহীন সমৃদ্ধি। শিক্ষা, অগ্রগতি এবং কাজের মাধ্যমে জীবন ধারণের সমান সম্ভাবনা।
-মুক্ত ফেডারেশনের মাধ্যমে সমাজ গঠন। নিচ থেকে উপরে। কারখানা শ্রমিকের সংগঠন, কৃষকের সংগঠন, বিজ্ঞানীদের সংগঠন, সাহিত্যিকদের সংগঠন। প্রথমে একটা কমিউনে, তারপর কমিউনের ফেডারেশন; কমিউনের ফেডারেশন থেকে আঞ্চলিক, আঞ্চলিক থেকে জাতীয়; এরপর আন্তর্জাতিক সর্বজনীন সংগঠনে সংগঠিত হওয়া।

আর্টওয়ার্ক: প্যারিস কমিউন
সংগঠন: গ্রাঞ্জার

বৈপ্লবিক সময়ের সঠিক কর্মকৌশল

সামাজিক বিপ্লব সবসময়ই রাজনৈতিক বিপ্লবের পুরোপুরি বিপরীত। একক ব্যক্তি-কৃতিত্বর স্থলে আমজনতার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনই তার চালিকাশক্তি। সামাজিক বিপ্লবে ব্যক্তির ভূমিকা হল, আমজনতার সহজাত জ্ঞানকে আরও বিকশিত, আরও স্পষ্ট করার পাশাপাশি সে অনুযায়ী তৎপরতা চালানো। একই সঙ্গে জনগণে স্বাভাবিক ক্ষমতার বৈপ্লবিক সংগঠন-প্রচেষ্টায় লাগাতার অবদান রাখা। এর বাইরে আর কিছু নয়; বাকিটা জনগণ নিজেরাই ঠিক করবে। এর বাইরে রাষ্ট্রীয় পুনরুজ্জীবনের অন্য যেকোনো তরিকা হবে রাজনৈতিক স্বৈরাচার। সামাজিক আন্দোলন রূপ নেবে রাজনৈতিক স্বৈর-আন্দোলনে। রাষ্ট্রের মাধ্যমে উত্থান ঘটাবে নিপীড়ন এবং অসমতা তথা বিশেষ অধিকারের। রাষ্ট্রপন্থী তরিকার গতিমুখ গিয়ে ঠেকবে সাতরাস্তার মোহনায়,যেখানে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দাসত্বের অবধারিত পথই হয়ে উঠবে যৌক্তিক।

ফরমান দিয়ে বিপ্লব হয় না

কর্তৃত্বপরায়ণ সাম্যবাদীদের ধ্যান-ধারণা আমার মতে, একটা চূড়ান্ত প্রতারণা। তারা মনে করে, স্বৈরক্ষমতা বা প্রতিনিধিত্বশীল গণপরিষদের মাধ্যমে ফরমান দিয়ে সামাজিক বিপ্লব সংগঠিত করা যায়। অন্যদিকে প্যারি-সমাজতন্ত্রীরা মনে করতেন, একমাত্র জনতার স্বতঃস্ফূর্ত এবং বিকাশমান বিভিন্ন গোষ্ঠী ও জনসমিতির বিপুল কর্মযজ্ঞর মাধ্যমেই বিপ্লবকে চূড়ান্ত রূপ দেয়া সম্ভব।

বিপ্লব প্রশ্নে, প্যারি-সমাজতন্ত্রী বন্ধুরাই হাজারগুণ ঠিক ছিলেন। আসলে, এমন কোন চৈতন্য নেই, যা মেধা আর সর্বগুণে গুণান্বিত।  আর তাই আমরা যদি কয়েকশ অতিমানবের সম্মিলিত একনায়কত্বের কথা বলি, তাতে মেধার এমন কোন তেলেসমাতি থাকবে না, যা জনগণের সাধারণ সংকল্প তথা এর মধ্যে বিকশিত আশা, আকাঙ্ক্ষা বা সত্যিকারের স্বার্থের বিপুল ও বৈচিত্র্যময় বহুত্বকে ধারণ করতে পারে।  আসলে মেধার এমন কোন সক্ষমতাই নেই যা প্রত্যেকের এবং সকলের পুর্ণাঙ্গ তুষ্টির জন্য একটা সামাজিক সংগঠন নির্মাণ করতে পারে।

তারা শুধু পারে এমন একটা সংগঠন বানাতে যার মাধ্যমে হতভাগ্য সমাজের উপর জোরপুর্বক, সহিংস ও রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের মতলব আঁটা যায়। আর এই সেই সেকেলে সংগঠন পদ্ধতি যা বল প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। গণমানুষ ও তার বিভিন্ন গোষ্ঠী, সমবায়, সমিতি, এমনকি ব্যক্তির পুর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই উচ্ছেদ করতে হবে সব ধরনের সহিংসতার ঐতিহাসিক ভিত্তিকে; বিনাশ করতে হবে রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে। এই পতনেই ধ্বংস হবে সব ধরনের বিচারিক অধিকারের অসমতা এবং যাজকতন্ত্রের মিথ্যাচার যা এতদিন একেবারে পূত-পবিত্র, আর্দশিক ও বাস্তবিক বলে বিবেচিত ছিল। বিলোপ ঘটবে সেইসব সহিংসতার যা এতকাল রাষ্ট্র কর্তৃক উপস্থাপিত-অনুমোদিত ও রক্ষিত ছিল।

তবে এটা খুব পরিষ্কার যে, রাষ্ট্র তার অস্তিত্ব হারাতে শুরু করলে মানুষও স্বাধীনতা অর্জন করতে শুরু করবে। সংগঠিত হবে সত্যিকারের সমাজস্বার্থের ভিত্তিতে। আর এভাবে সংগঠিত ব্যক্তি- গোষ্ঠী-সমিতি খুঁজে পাবে বাস্তবিক মুক্তির পথ।

রাষ্ট্র বিলোপের পথে যাবে মুক্ত সংগঠন

রাষ্ট্র এবং ধর্মীয় সংগঠনের পতনই হবে সমাজের সত্যিকারের মুক্তির জন্য  প্রথম এবং অপরিহার্য শর্ত।  আর এরপরই সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে তার নিজস্ব সংগঠন। এই সংগঠন কখনোই ‘উপর থেকে নিচ’ কাঠামোবিশিষ্ট হবে না। এমনকি গুটিকতক মহাজ্ঞানী-মহাপণ্ডিতের তৈরি করা আর্দশও অনুসরণ করবে না। স্বৈরক্ষমতা বা সার্বজনীন ভোটে নির্বাচিত কোন গণপরিষদের ফরমান দিয়েও চলবে না এই সমাজ-সংগঠন।

তবে এর ব্যাত্যয় ঘটলে, আমি আগেই বলেছি, এমন এক ব্যবস্থা কায়েম হবে যা অবধারিতভাবে নিয়ে যাবে  সরকারি অভিজাততন্ত্রের পথে। সৃষ্টি করবে এমন একটা নতুন শ্রেণি যার সঙ্গে জনগণের কোন সমস্বার্থ থাকবে না। ফলে জনকল্যাণের অজুহাতে কিংবা রাজকীয় মুক্তির নামে নিশ্চতভাবে এই শ্রেণী শোষণ শুরু করবে এবং ফিরে আসবে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার সেই পুরনো রীতি।

সমতার হাতে হাত রেখেই হাঁটবে মুক্তি

আমি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমতার পক্ষপাতী।  আমারা জানি, সমতার বাইরে মুক্তি, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা, নৈতিকতা, ব্যক্তির কল্যাণ বা জাতির অগ্রগতি আদতে মিথ্যের ফুলঝুরি ছাড়া আর কিছুই নয়। মুক্তির পথে- মানবতার পথে প্রথম শর্ত হল সমতা প্রতিষ্ঠা। দুনিয়াব্যাপী,  শ্রম এবং সম্পত্তির যৌথ মালিকানার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা মুক্ত স্বাধীন সংগঠনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে হবে সমতা। সমতা আসবে, পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা উৎপাদকদের মুক্ত সংগঠনের সমবায় এবং তার মুক্ত ফেডারেশনের মাধ্যমে। কেন্দ্র-কর্তৃত্বের এক-অদ্বিতীয় ত্রাণকর্তা রাষ্ট্রর পথ ধরে নয়।

কর্তৃত্বপরায়ণ মুক্তিপরায়ণ বিপ্লবের পার্থক্য

বিপ্লব প্রশ্নে দুই ধারা। এর একটা হল- সমাজতন্ত্রী বা বিপ্লবী সংঘ। আর আরেকটা হল- কর্তৃত্বপরায়ণ সাম্যবাদী, যারা রাষ্ট্রের মাধ্যমে সবকিছু হাসিল করতে চায়। দুই ধারার মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। যদিও উভয়ের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এক। যৌথ শ্রম, অর্থনৈতিক সমতা এবং উৎপাদনের উপায়ের উপর সামষ্টিক মালিকানার ভিত্তিতে উভয়েই একটা নতুন সমাজ নির্মাণ করতে চায়।

সাম্যবাদীরা মনে করেন,  শ্রমজীবী শ্রেণীর বিকাশ এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে, বিশেষত শহুরে সর্বহারা শ্রেণী ও বুর্জোয়া চরমপন্থার সহযোগিতায় এই লক্ষ্য হাসিল সম্ভব। অন্যদিকে  বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীরা সবধরনের অস্পষ্ট জোটকে শত্রু মনে করে।  রাজনৈতিক ক্ষমতা নয় বরং সামাজিক সংগঠন (যা আদতে রাজনীতি-বিরোধী) এবং গ্রাম-শহরের শ্রমজীবী জনতার শক্তির মাধ্যমে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীরা এই সাধারণ লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। এমনকি যারা উচ্চকোটিতে জন্মেছে কিন্তু নিজেদের অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এবং প্রকাশ্যে সর্বহারার সঙ্গে যোগ দিয়ে এর কর্মসূচি মেনে নিয়েছে তারাও এর অর্ন্তভুক্ত হতে পারে।

সাম্যবাদী নৈরাজ্যবাদী কর্মসূচির পদ্ধতি

সাম্যবাদী এবং নৈরাজ্যবাদী দুটি ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি। সাম্যবাদীরা মনে করেন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রন নিতে শ্রমিক-শক্তিকে সংগঠিত করা জরুরি। বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রীদের লক্ষ্য খোদ রাষ্ট্রকে বিনাশ করা। একটু পরিশীলিত করে বললে, রাষ্ট্রকেই বিলোপ করে দেয়া। সাম্যবাদীরা কর্তৃত্বের নীতি ও চর্চার দলভুক্ত। অন্যদিকে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীরা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।

উভয়েই সমানভাবে বিজ্ঞানের পক্ষপাতি, যা কুসংস্কার দূর করবে এবং অন্ধবিশ্বাসকে প্রতিস্থাপন করবে। কিন্তু সাম্যবাদীরা বিজ্ঞানকে মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। আর বিপ্লবী সংঘ চেষ্টা করে জ্ঞান-বিজ্ঞানকে মানুষের মাঝে ব্যপৃত করতে যাতে মানব সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের প্রচারে সহমত হলে নিজেরা সংগঠিত হতে পারে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিতে পারে ফেডারেশনে, বাস্তব স্বার্থ এবং স্বাভাবিক প্রবণতার ভিত্তিতে। এমন কোন পরিকল্পনার ভিত্তিতে নয়, যা মুর্খ মানবগোষ্ঠীর উপর প্রয়োগের  জন্য গুটিকতক ‘উর্বর’ মস্তিস্ক প্রসূত। বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রীরা বিশ্বাস করে, আমজনতার সহজাত আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রয়োজনের মধ্যেই নিহিত থাকে কাণ্ডজ্ঞান এবং সত্যিকারের করণ-কারণ যা কিনা, সমাজের সর্বরোগের বিজ্ঞ চিকিৎসক কিংবা মনবজাতির ঘাড়ে জুড়ে বসা সবকদাতাদের চৈতন্যে নেই। মানবজাতির উদ্ধারে হতাশাব্যাঞ্জক অসংখ্য ব্যর্থ চেষ্টাই কেবল তাদের উদাহরণ এবং আজও তা একই কায়দায় চলমান। বিপরীতে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীরা মনে করে, মানবসমাজের আসল রোগটা হল, যোজন যোজন বছর ধরে শাসিত হতে থাকা, যার গোড়া আদতে দুর্ভাগ্য বা বিশেষ ধরনের কোন সরকার ব্যবস্থা নয় বরং খোদ সরকারের অস্তিত্বের মধ্যেই নিহিত।  তাতে সরকারের চরিত্র যাই হোক না কেন।

মতামতের এসব পার্থক্য এখন ঐতিহাসিকও বটে। বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদ আর প্রুঁধোবাদের মধ্যে তা বিদ্যমানও। বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদ জার্মান ঘরানা থেকে উদ্ভূত এবং আমেরিকান ও ইংরেজ সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে আংশিকভাবে গৃহীত। আর প্রুঁধোবাদের সৃষ্টি সমাজতন্ত্রীদের বিকাশমান ও সামষ্টিক সিদ্ধান্তর উপর ভিত্তি করে এবং তা বিস্তৃত ল্যাতিন দেশগুলোর শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে। বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্র প্রথমবারের মতো এর সবচেয়ে উজ্জল ও বাস্তব রূপায়ন ঘটায় প্যারি কমিউনে।

সর্বজার্মান ব্যানারে লেখা: যেকোন মূল্যে রাষ্ট্রকে রক্ষা ও তার শক্তিবৃদ্ধি। বিপরীতে আমাদের সামাজিক-বৈপ্লবিক ব্যানারে আগুন আর রক্তের আখরে লেখা: সব রাষ্ট্রের ধ্বংস; বুর্জোয়া সভ্যতার বিনাশ। নিচ থেকে উপর ভিত্তিতে স্বতস্ফূর্ত মুক্ত সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং মুক্তিকামী জনতার অবাধ-স্বাধীন শ্রম সংগঠনের মাধ্যমে মুক্ত সমতি গঠন।

অতঃপর বিশ্বজুড়ে নয়া মানবিক দুনিয়া সৃষ্টি!

তথ্যপঞ্জি

১. গ্রীক দার্শনিক। তাকে পশ্চিমা দর্শনের জনক হিসেবে অভিহিত করেন অনেকে। রাজনীতি, বিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা, নীতিবিদ্যার পুরোধা তিনি। নির্মোহ অনুসন্ধানের মাধ্যমেই জ্ঞান অর্জনকে পথ মনে করতেন। তার বিখ্যাত উক্তি: Man is by nature  a political animal . মানবীয় প্রকৃতি যুক্তিশীল এবং এটাই তাকে অন্যান্য প্রাণী থেকে পৃথক করে।

২. লুক্সেমবার্গ নিয়ে ফ্রান্স এবং প্রুশিয়ার যুদ্ধের সময় লিগ অব পিস এন্ড ফ্রিডম প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬৭ সালের সেপ্টম্বরে এর প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। মিখাইল বাকুনিন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। লিগে জনস্টুয়ার্ট মিল, ভিক্টর হুগো, লুইস ব্লাঙ্ক, গ্যারিবাল্ডির মত প্রভাবশালী চিন্তক ও রাজনীতিবিদরাও ছিলেন। কংগ্রেসে প্রায় ৬ হাজার প্রতিনিধি যোগ দেয়।

৩. ম্যাজিনি ইতালীয় রাজনীতিবিদ। ঐক্যবদ্ধ ইতালি গঠনে তাঁর ভুমিকা উল্লেখযোগ্য। ম্যাজিনি রিপাবলিকান ছিলেন। সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ সম্পর্কে তার ছিল বিরূপ মনোভাব। তিনি শ্রেণী সংগ্রামের বিরোধিতা করেন এবং শ্রেণী-সহযোগিতার মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে প্রচার করেন। রাষ্ট্র সম্পর্কে তার ধ্যান-ধারণাই ম্যাজিনয়িাম ব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত। ইউনাইটেড স্টেটস অব ইউরোপ ধারণারও প্রবক্তা তিনি।

৪. ১৮৭১ সালে প্যারিসে শ্রমজীবীরা সমাজ বিপ্লব সংগঠিত করে। এই বিপ্লব ‘প্যারি কমিউন’ নামে পরিচিত। কমিউন একটি যৌথ সমাজ ব্যবস্থা। মুক্ত শ্রম এবং এবং সামাজিক মালিকানা এবং সমতাই ছিল এর প্রধান বৈশিষ্ঠ্য। স্ব-প্রতিনিধিত্বমূলক এই ব্যবস্থায় স্থায়ী সেনা বাহিনীর বদলে জনগণকে সশস্ত্র করা হয়। এছাড়া স্থায়ী আমলাতন্ত্র-পুলিশ ও বিচারকের বদলে সর্বস্তরে চালু হয় স্ব-প্রতিনিধিত্ব।

নুরে আলম দুর্জয়