অরাজ

 ক্রাইমথিঙ্ক. || মার্চ ১৮, ১৮৭১: প্যারিস কমিউনের অভ্যুদয়

  • অনুবাদ: ইশাদী হুসাইন

সম্পাদকের নোট: কিভাবে, কোন পরিস্থিতিতে প্যারিসের জনসাধারণ পুরো শহরের দখল নিয়ে নিয়েছিল- তার একটি ভাষ্য উঠে এসেছে কমিউনার্ড লুইস মিশেলের সঙ্গে ঘটা ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে। লেখাটি নেওয়া হয়েছে ক্রাইমথিঙ্ক. থেকে।

লুইস মিশেল

সালটা ১৮৭১। জার্মানির সাথে যুদ্ধে সম্রাট নেপোলিয়নের পরাজয়ের পরপরই ফ্রান্সের বিপ্লব একটি গণতান্ত্রিক সরকারের গোড়াপত্তন করেছে ঠিক। কিন্তু এই নতুন প্রজাতন্ত্র কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারছে না। নতুন গঠিত ভারপ্রাপ্ত সরকারটি পুরানা মহারাজের চাকুরিজীবী আমলাদের দ্বারা সংগঠিত; বিপ্লবীদের সমাজ বদলানোর দাবিদাওয়া পূরণে তারা না কোন কাজ করেছে, না তারা করতে চায়। প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থীরা মহারাজকে পুনরায় নির্বাহী ক্ষমতা প্রদানের কিংবা তাতে ব্যর্থ হলে নতুন কোন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করছে। ফ্রান্স এবং প্রতিবিপ্লবের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে একা বিদ্রোহী প্যারিস। 

নিয়মের দাসদের কাজকর্ম ঠিকঠাক বেঁটে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে, ফরাসী জনতাকে বাধ্য করতে হবে অক্ষরে অক্ষরে জার্মানির জনবিরোধী সমর্পণ শর্ত মান্য করতে। নাগরিকদের উপর যুদ্ধবিরতি চাপানোর জন্য নতুন প্রজাতন্ত্রটি দু’টি জাতীয় সেনাবাহিনীর জোরে র‍্যাডিকাল ক্লাবগুলিকে নিষিদ্ধ করেছে এবং সংবাদপত্রগুলি বন্ধ করে দিয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে কেবল যখন সম্রাটকে উৎখাত যারা করেছে তাদের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পরেই।

র‍্যাডিকালরা জেলে কিংবা অজ্ঞাতবাসে থাকায় নির্বাচনে জেতে সংরক্ষণশীলেরা। প্রধান জয়ী হয় প্রুধোঁ’র আদি শত্রু ব্যাংকার অ্যাডল্ফ থিয়ের যে ১৮৪৮ এর বিপ্লব বেঁচতে সহযোগিতা করেছিল। তার জন্যে না হলে হয়তো সম্রাট ক্ষমতা অধিগ্রহণও করতে পারতেন না। প্রাদেশিক গ্রামাঞ্চলের ভোটে সরকারের অফিসে যেতে পেরেই থিয়েরের প্রথম কাজ হ’লো ৫০ কোটি ফ্রাংক খরচ করে জার্মানির সাথে শান্তির জন্য আপোস করা। থিয়েরের কাছে এটা রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলের সস্তা উপায় মাত্র – বিশেষ করে যেখানে পুরোটাই দিচ্ছে ফরাসি জনতা, সে নিজে না। আর যদি জনগণ তা না দিতে চায়? তাহলেও সে জার্মানি নয় বরং ফ্রান্সের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করবে।

থিয়েরের সমর্পণচুক্তির মধ্যে অন্যতম শর্ত হলো জার্মান সৈন্যদের রাজধানীর মধ্য দিয়ে বিজয় মিছিল করতে দেয়া। মাসের পর মাস ঘেরাওয়ের ফলে ক্ষুধায় ক্লীষ্ট প্যারিসবাসী এটা কোনভাবেই হতে দিতে চায় না। গুজব ছড়িয়ে পড়ছে যে জার্মানিরা শহর লুটতে আসছে। বিপ্লবের পরে গড়ে ওঠা প্রহরী সমিতি নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সাক্ষাৎ চালিয়ে যাচ্ছে।

ফেব্রুয়ারি ২৬ এর রাতে, সরকারি নির্দেশ অমান্য করে জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর দশ হাজারের বেশি বিদ্রোহী সদস্য চ্যাম্পস-ইলিসিসের মফঃস্বল শহরে জড়ো হয়। তাদের সাথে আছেন নগরপ্রান্ত মন্তমার্ত্রের স্কুলশিক্ষিকা চল্লিশ বছর বয়স্ক লুইস মিশেলের মতোন কঠোর-মূর্তি বিপ্লবীরা। একসাথে তারা সদ্য আটক হওয়া রাজবন্দীদের জেল ভেঙে মুক্ত করে। তারপর তারা প্যারিসের জন্য মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে নিকষ আঁধারে অপেক্ষা করতে থাকে জার্মানদের আগমনের।

ছবি: ক্রাইমথিঙ্ক

ভোর নাগাদ আক্রমণের কোন লক্ষণই দেখা না যাওয়ায় বিদ্রোহীরা প্যারিসে থাকা যুদ্ধের অবশিষ্ট কামানগুলি করায়ত্ত করে নেয়। বিদ্রোহীরা বিশ্বাস করে গরিবের দাতব্য চাঁদায় কেনা এই কামানগুলির যোগ্য অধিকার তাদেরই আছে যারা শহরটিকে রক্ষা করতে চায়; শহরের সাথে প্রবঞ্চনা করা রাজনীতিবিদ কিংবা যেই জার্মান বাহিনী নিরস্ত্র করে তাদের গ্লানি জর্জরিত করতে চায় তাদের কক্ষণো নয়। বিলাসী এলাকা থেকে সরিয়ে ভারী অস্ত্রগুলি তারা বস্তি আর ভাগাড়ের ফাঁকে নিজেদের এলাকায় নিয়ে মন্তমার্ত্রের টিলায় স্থাপন করেন।

অবশেষে, ১৮৭১ সালের পয়লা মার্চে, জার্মান বাহিনী প্যারিসে প্রবেশ করে। অস্থির বস্তিগুলো এড়িয়ে তারা পুরান শহরে চেপে চেপে আগায়। দোকানপাট সব বন্ধ; মিছিলের যাত্রাপথে সমস্ত ভাস্কর্য কালোবসনে আবৃত আর কালো পতাকা উড়তে থাকে দালানে দালানে। দুস্থ জনতা দূর থেকে কড়া চোখে তাকিয়ে দেখে; তাদের বুভুক্ষু নজর হৃষ্টপুষ্ট জার্মানদের মজ্জা কাঁপিয়ে দেয়। হানাদার বাহিনী লেজ গুটিয়ে শিবির স্থাপন করে শহরের বাইরে পূর্বপাশে।

এর কিছুদিন পরেই থিয়েরের সরকার ঘোষণা করে ঘেরাওয়ের সময় স্থগিত রাখা ভাড়াগুলি বাড়িওয়ালারা আদেশমাত্র দাবি করতে পারবে। চারমাসের বকেয়া সুদসমেত বাকী, এবং বন্ধক রাখা মাল বিক্রির স্থগিতাদেশও বাতিল ঘোষণা করা হয়। বিশেষ প্রয়োজন দেখাতে না পারলে, জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর বেতনও দেয়া হয় বন্ধ করে। এইসব এবং আরও অনেক কিছুই থিয়ের যেই শর্তে শান্তি লিখে দিচ্ছে সেই চুক্তিতে অবধার্য।

মার্চ ১৮ এর সকালে মন্তমার্ত্রেবাসী ঘুম ভেঙে দেখে দেয়ালে দেয়ালে এলান। পৈতৃক প্রতাপে অ্যাডল্ফ থিয়ের ব্যাখ্যা করে দিচ্ছে কীভাবে জনশৃঙ্খলা, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, অর্থনীতি, এবং তাদের নিজেদের পিঠ বাঁচানোর স্বার্থে প্যারিসের সুনাগরিকদের কামানগুলো ফেরত দিয়ে বিপথে চালিত করা অপরাধীদের ধরিয়ে দিতে হবে:

ন্যায়বিচার ও সুবুদ্ধির খাতিরে এই কর্ম সম্পাদনে সরকার আপনাদের সহায়তা কামনা করছে। জনমতের সাথে বিরোধিতা না করে সমর্থন করে সুনাগরিকেরা কুনাগরিকের সঙ্গ ত্যাগ করবে এই বিশ্বাস করে। এই প্রজ্ঞাপন জারি মাত্রই, বলপ্রয়োগে আপনাদের সম্মতি গৃহীত হবে, কেননা আর একদিনও দেরি না করে শান্তি নিশ্চিত করতে হবে। 

ছবি: ক্রাইমথিঙ্ক.

ঠিক এর আগের দিন রাতে, লুইস মিশেল মন্তমার্ত্রের চূড়ায় উঠে কামানের তত্ত্বাবধানে থাকা প্রতিরক্ষীদের একটি বার্তা পৌঁছে দেন। দেরি হয়ে যাওয়ায়, তাদের হেডকোয়ার্টারে তিনি রাতটা থেকে যান। সারারাত একের পর এক সন্দেহজনক চরিত্র টিলার উপরে উঁকি দিতে হাজির হয় মাতালের ভান করে আউলফাউল গপ্পো সাজিয়ে।

বন্দুকের গর্জনে তার ঘুম ভাঙে। তখনও আঁধার কাটে নাই। বিছানা ছেড়ে দাঁড়ানোর আগেই বাড়িটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে থিয়েরের অনুগত ফরাসি সৈন্যরা। ঘরদোর তছনছ করে ছেলেদের গ্রেফতার করেছে বটে কিন্তু তাকে খেয়াল করে কদাচিৎ – তিনি একজন মেয়েলোক ছাড়া কী। এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সৈন্যরা প্রতিরক্ষীদের একজনকে নিয়ে আসে যাকে গুলি করা হয়েছে। তার রক্তের স্রোত আর মিশেলের অশ্রু প্রবাহ এক হয়ে মিশে যায়।

মন্তমার্ত্রের উদারপন্থী মেয়র আসলেন। তার নগরবাসীরা ভাঙচুর শুরু করার আগে তাড়াতাড়ি সৈন্যদের কামানগুলি সরিয়ে নেয়ার পাশাপাশি তিনি আহত প্রতিরক্ষীর ব্যাপারেও চিন্তিত। মাথা নাড়ানো ছাড়া মিশেলের করার কিছু নেই। তাই মিশেল ক্ষত বেঁধে দিয়েছেন না জেনেও তিনি পরিষ্কার ব্যান্ডেজের খোঁজ করায় মিশেল নিজেই তা নিয়ে আসার আগ্রহ জানালেন।

“আপনি নিশ্চিত আপনি ফিরে আসবেন?” তিনি কটাক্ষে তাকালেন।

“আমি কথা দিচ্ছি,” জবাবে মিশেল, অবিচল।

দৃষ্টির সীমানা পেরোতেই, পাহাড়ের তল থেকে এক দৌড়ে, দেয়ালে সাঁটানো থিয়েরের প্রজ্ঞাপন পড়তে থাকা জটলাগুলো পেরিয়ে স্থানীয় প্রহরা সমিতির মূলভবনের সড়কে পৌঁছাতেই পুরা দমে চিৎকার করতে থাকলেন, “বেইমান! বিশ্বাসঘাতক!” তার বন্ধুরা সেখানেই ছিলো। নিজেদের বন্দুক নিয়ে সবাই ছুটলেন পাহাড়ের উপরে আবার তার সাথে। দূরে তখন শোনা যাচ্ছে রণধ্বনি প্রতিরক্ষী বাহিনীর দামামায়।

এখন রাস্তায় জমেছে ভীড়: দাঁড়িওয়ালা প্রতিরক্ষী জোয়ান বিড়বিড় করছে রাইফেল হাতে দুই বা তিনজন নারীর সাথে এখানে-ওখানে। জমতে জমতে মানব জোয়ার হয়ে উর্দ্ধগামী ছুটছে সকলে। তাদের সবার আগে, মিশেল দেখতে পায় পাহাড়টা, দিনের মৃদু আলোয় উজ্জ্বল চূড়াটা। চূড়ান্তে দাঁড়িয়ে, রণব্যুহে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত একটি সৈন্যদল। তিনি এবং তার বন্ধুরা মারা যাবেন। এই নিদারুণ সত্যের উত্তেজনাটা প্রায় শ্বাসরুদ্ধকর। হঠাৎ, মিশেলের মা এসে দাঁড়ায় সেই ভীড়ে তার পাশে। “লুইস, কত দিন ধরে তোমারে দেখি না! কই ছিলা তুমি? এই ঝামেলার মধ্যে তো পড়তে যাচ্ছো না তুমি, না?”

যখন তিনি পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছেছেন, জনতা ততক্ষণে সৈন্যদের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে ভিতরে চলে গিয়েছে। তাদেরকে ঘিরে ধরা হয়েছে। মহিলারা থিয়েরের সৈন্যদের জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে:

“এই কামানগুলি কই নিচ্ছো, গা? বার্লিনে?”

“না– ওরা এইগুলা নবাব নেপোলিয়নের কাছে ফিরায়ে নিচ্ছে গো!”

“তোমরা আমাদের উপর গুলি করতে পারো, কিন্তু জার্মানদের উপর করতে পারো না, এহ?”

ঘোড়ায় টানা কামানের ঘোড়া আর কামানের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়া এক রণচণ্ডীর সামনে লজ্জায় নতমুখে এক অফিসার অনুনয় করতে থাকে। “সরে দাঁড়ান, মা জননী, এদিকে আসেন।”

“যা সর, কুলাঙ্গার,” তিনি পালটা চিৎকার করে বলেন, “গুলি কর আমারে আমার বাচ্চাগুলার সামনে!”

“দড়িগুলা কেটে ফেলেন!” কেউ চিৎকার করে ভীড়ের পিছন থেকে। একটা ছুড়ি হাত থেকে হাতে পৌঁছে যায় কামান আটকে রাখা নারীটির হাতে। তিনি ঘোড়ার সাথে জুড়ে বাঁধা দড়িটা কেটে আলাদা করেন। জনতা গর্জে উঠে। 

ছবি: ক্রাইমথিঙ্ক.

জেনারেল লেকোন্তে স্বয়ং স্বীয় উচ্চাসনে চড়ে হাজির হোন। উপত্যকায় প্রতিধ্বনিত কর্তৃবাচ্যে তিনি হুঙ্কার করেন: “সৈন্যদল! অস্ত্র সাজো!”

থমকে যায় সব। সৈন্যরা অস্ত্র সাজায়। তাদের মুখ রক্তশূণ্য। কেউ চিল্লায় উঠে, “গুলি কোরো না!” কিন্তু জনতা পিছু হটে না।

“তাক করো!”

এক সারি রাইফেল তুলে ধরা হয়। একজন নারী কাঁপছে; আরেকজন তার হাত শক্ত করে ধরে রাখে, উর্দিধারী জোয়ানদের দিকে তাকিয়ে ভেঙচি কেটে। তাদের পিছনে, মিশেল আর তার বন্ধুরাও রাইফেল তুলে ধরে। তারা দেখতে পায় কিছু সৈন্যরাও কাঁপছে। 

“চালাও গুলি!” এক মুহুর্তের জন্য সব স্তব্ধ।

একজন অফিসার তার অস্ত্র ছুঁড়ে ফেললেন। বের হয়ে গেলেন সারি থেকে। “চুদি তোরে!”

“সবাই রাইফেল ঘুরায় নাও!” আরেকজন চিৎকার করলো। এবং এই মুহুর্তটা মিশেলের সারাজীবন মনে থাকবে।

এরপর দিন, নগর ভবনে উড়িয়ে দেয়া হয় লাল পতাকা – জনতার পতাকা, ১৮৪৮ সালেই যেটা ওড়ানো উচিৎ ছিলো। প্রহরা সমিতি এলাকার যাবতীয় প্রশাসনিক ভবনগুলিতে অবস্থান নিয়েছে। লেকোন্তেকে গুলি করা হয়েছে। সামরিক বাহিনীর অবশিষ্টাংশ সাথে নিয়ে থিয়ের আর তার শাগরেদরা উড়াল দিয়েছে নিকটবর্তী শহর ভার্সাইয়ে। তাদের পৃষ্ঠপোষকেরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে গেছে তাদের গ্রামের তালুকে। ভিক্টর হুগো পালিয়েছে বেলজিয়ামে। পূর্বদিক থেকে অপেক্ষমান জার্মান সেনারা দেখছে ফরাসি সরকার এই বিপ্লব ঠেকাতে পারে কিনা। তাদের ভয়, যা ছড়িয়ে পড়তে পারে সমগ্র ইউরোপে।

প্যারিস কেবলমাত্র সেই সাধারণের হাতে যারা পরিচিত কেবলই একে অপরের কাছে। রহস্যজনক হলো, এইদিনের মতো এতো শান্তি এই শহরে আগে কখনো ছিল না। 

ইশাদী হুসাইন

RocketplayRocketplay casinoCasibom GirişJojobet GirişCasibom Giriş GüncelCasibom Giriş AdresiCandySpinzDafabet AppJeetwinRedbet SverigeViggoslotsCrazyBuzzer casinoCasibomJettbetKmsauto DownloadKmspico ActivatorSweet BonanzaCrazy TimeCrazy Time AppPlinko AppSugar rush