- আজফার হোসেন
কার্ল মার্কস আর মিশেল ফুকোর সম্পর্ক নিয়ে দুইটি বিশেষ বই বেরিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে: একটি হচ্ছে ফরাসী দার্শনিক জাঁক বিদে-এর বই ফুকো উইথ মার্কস (২০১৫/ ইংরেজি তর্জমা: ২০১৬); অপরটি ইতালীয় মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও অ্যাকটিভিস্ট আন্তনিও নেগ্রি-এর বই মার্কস অ্যান্ড ফুকো (২০১৭)। বেশ কৌতূহল নিয়ে পড়তে গিয়ে দেখলাম বই দুইটি একদিকে যেমন মার্কস আর ফুকোর তাত্ত্বিক সংশ্লেষণ ঘটাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে আবার তারা ফুকোর নিজস্ব বই—তাঁর সাক্ষাৎকারের বই— রিমার্কস অন মার্কস কে সম্পূর্ণ এড়িয়েও গেছে। মনে হল, ফুকোর ওই বইটা আবারও পড়া দরকার।
তবে ফুকোর রিমার্কস অন মার্কস বইটা আবারও পড়ার আরেকটা কারণ আছে অবশ্য। প্রায় দেড় দশক আগে মার্কসবাদীদের এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে মার্কস, ফুকো এবং দেরিদা নিয়ে আমি নিজেই একটা পেপার পেশ করেছিলাম। সেখানে মার্কসকে নিয়ে ফুকো ও দেরিদার ভাবনার তুলনামূলক আলোচনা করেছিলাম। ফুকোর বই রিমার্কস অন মার্কস আর দেরিদার বই স্পেক্টার্স অফ মার্কস কে এক সমতলে এনে তাদের তুলনা করে রূপকার্থে এও বলেছিলাম: যেখানে দেহতাত্ত্বিক মিশেল ফুকো ব্যস্ত থাকেন মার্কসের দেহ নিয়ে, সেখানে ভূতকাব্যতাত্ত্বিক জাঁক দেরিদা ব্যস্ত থাকেন মার্কসের “ভূত” নিয়ে, যদিও সেটা আমার পেপারের একমাত্র আর্গুমেন্ট ছিল না। ওই পেপারের একটা পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত রূপ শিঘ্রি প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে। সেই জন্যও ফুকোর ওই তুলনামূলকভাবে অবহেলিত বই রিমার্কস অন মার্কস -এর কাছে ফিরতে হল।
বলা দরকার, ইতালীয় মার্কসবাদী সাংবাদিক দুচ্চো ত্রোম্বাদরি বেশ কিছু সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন মিশেল ফুকোর, সত্তরের দশকের শেষভাগে। ওই সাক্ষাৎকারগুলোকে একসঙ্গে করেই সেই ১৯৮১ সালে ইতালীয় ভাষায় প্রথম বেরোয় রিমার্কস অন মার্কস। ফুকো মারা যান ১৯৮৪ সালে। তারপর ১৯৯১ সালে বইটির ইংরেজি তর্জমা প্রকাশিত হয় আমেরিকায়। আর আমি বইটার প্রথম সন্ধান পাই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ওয়াইডনার লাইব্রেরিতে, সেই ১৯৯৫ সালে।
এবারে বইটা নিয়ে কয়েকটা কথা বলে নেই। যদিও বইটির শিরোনামে মার্কসের নাম জাহিরী ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত, সেখানে ফুকো সরাসরি মার্কস নিয়ে কথা বলেছেন খুবই কম। বরঞ্চ ফুকোর বয়ান আবর্তিত হয়েছে ফরাসি মুলুকের মার্কসবাদী ঐতিহ্যকে ঘিরে; সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ও টানাপড়েনকে ঘিরে এবং সে-সব কিছুর প্রেক্ষিতে তাঁর কাজের রাজনৈতিক ও তাত্ত্বিক তাৎপর্যকে ঘিরেও। বইটাতে ফুকো এই ইঙ্গিতটা দিতেও বাধ্য হন যে, মার্কস ও মার্কসবাদকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো পথ নাই; বরঞ্চ বিশ শতকের প্রায় সব প্রধান ও প্রভাবশালী তাত্ত্বিক বা দার্শনিক কোনো না কোনোভাবে মার্কসের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু এই বইয়ে ফুকো যে মার্কসের সঙ্গে সরাসরি বোঝাপড়ায় এসেছেন তাও বলা যাবে না, যদিও মার্কসের সঙ্গে ফুকোর কাজের সম্পর্কের একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে, যে-সম্পর্কটা কিছুটা জটিলও বটে।
শুরুর দিককার ফুকো, যে-ফুকোর কাজে কেউ কেউ “কাঠামোবাদী” বা “স্ট্রাকচারালিস্ট” পর্ব চিহ্নিত করে থাকেন (যদিও “কাঠামোবাদী” বর্গটা ফুকোর পছন্দের না), সেই ফুকো তাঁর বিখ্যাত বই দ্য অর্ডার অফ থিংস -এ মার্কসকে কোনো বিপ্লবী চিন্তাবিদ হিসাবে গণ্য করেন নাই (এই বইয়ে ফুকোর নায়ক নীৎশে, মার্কস নন।)। ওই বইয়ে তিনি মার্কসের কাজ আর মার্কসবাদকে সমার্থক করে খুব দ্রুত এই কথাগুলো বলেন,
পশ্চিমা জ্ঞানের গভীরতম স্তরে মার্কসবাদ কোনো ছেদ ঘটাতে পারে নাই; কোনো সমস্যা ছাড়াই মার্কসবাদ পশ্চিমা জ্ঞানের পরিসরে জায়গা করে নিতে পেরেছে… এমন এক জ্ঞানতাত্ত্বিক আয়োজনের ভেতর দিয়ে, যে আয়োজন মার্কসবাদকে আনন্দে আহ্বান করেছে আর মার্কসবাদ সেই আয়োজনকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে সামান্যতম আগ্রহ দেখায় নাই (পৃ. ২৬১)।
দেখা যাচ্ছে, ধ্রুপদী রাজনৈতিক অর্থনীতির অভূতপূর্ব তুমুল ক্রিটিক হাজির করার ভেতর দিয়ে মার্কস যে রাজনৈতিক অর্থনীতির পাঠে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন তা ফুকোর মনোযোগ কাড়তে পারে নাই। না পারারই কথা। মার্কস যে কেবল ইউরোপীয় আলোকায়ন প্রকল্পের সন্তান ছিলেন তা তো নয়; বরঞ্চ তিনি ওই প্রকল্পের বুর্জোয়া রাজনীতির বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিলেন সবকিছুর খোলনলচে পাল্টে দেয়ার জন্য। এই বিষয়টা শুরুর দিককার বা ‘কাঠামোবাদী’ ফুকো আমলে যে আনেন নি, তা তো আগেই লক্ষ করলাম। ফুকোর এই ফাঁক ও ফাঁকি এর মধ্যে অবশ্য ধরিয়ে দিয়েছেন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার একাধিক মার্কসবাদী তাত্ত্বিক— বিশেষভাবে বলা যাবে ভারতীয় মার্কসবাদী তাত্ত্বিক এজাজ আহমদ ও ফিলিপাইনি মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ই স্যান উয়ানের কথা। তৃতীয় বিশ্বে ফুকোসহ অনেক “উত্তরবাদী”র সমালোচনা আরেক এলাকায় আমাদের মনোযোগ দাবি করে, কিন্তু আমি এখন সেদিকে যাচ্ছি না।
তবে জোর দিয়েই বলা যাবে যে, থেকে থেকে মার্কসকে নিয়ে ফুকোর ধারণা বদলে গেছে। ফুকোর দ্য অর্ডার অফ থিংস পরবর্তী কাজগুলোতে মার্কস তুমুলভাবে না হলেও কোনো না কোনোভাবে হাজির হয়েছেন। বোঝা যায়, এড়াতে চাইলেও মার্কসকে এড়াতে পারছেন না ফুকো। তাইতো তাঁর পরবর্তী কাজ দ্য আর্কেওলজি অফ নলেজ -এ ফুকো নির্দ্বিধায় বলে উঠেন: ”রাজনৈতিক অর্থনীতির ভিত্তিতে মার্কস সম্পূর্ণ নতুন বয়ানের চর্চাকে সামনে এনেছেন” (পৃ. ১৮৮)। কিন্তু ফুকো এখানেই থামেন নাই; তাঁর বেশ পরের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী কাজ পাওয়ার / নলেজ -এ ফুকো এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন,
মার্কসের চিন্তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত ধ্যানধারণার বিভিন্ন ব্যবহার ছাড়া এবং মার্কস-নির্দেশিত চিন্তার দিগন্তে নিজেকে কোনো না কোনোভাবে স্থাপন না করে বর্তমান সময়ে ইতিহাস লেখা অসম্ভব। (পৃ. ৫৩)
এখানে ফুকো যে মার্কসের কথা বললেন তাকে ফুকোবাদীরা যে সবসময় চিনতে পেরেছেন তা বলা যাবে না, যদিও এই মার্কসকে চিনে রাখা দরকার।
(চলবে)
প্রথম প্রকাশ: The World and the Word