অরাজ
আর্টওয়ার্ক: ফেব্রিকেটেড অ্যানথ্রোপলজি শিল্পী: আদজানি অকুপু সূত্র: বুয়েল গ্যালারি
প্রচ্ছদ » নোয়াহ হারারির ভবিষ্যত পৃথিবীর রূপরেখা

নোয়াহ হারারির ভবিষ্যত পৃথিবীর রূপরেখা

  • রাকিবুল রাকিব

আমরা আজ প্লেগের কবলে নেই, কলেরা আর স্কার্ভিতে কাবু হই না কিন্তু ভাইরাস মানব শরীরকে এ পর্যন্ত মুক্তি দেয়নি। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইতিমধ্যে সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, এ সংখ্যাটা দিন দিন বাড়তে থাকবে। একশো দিন ধরে বিশ্ব থমকে আছে, ঘরবন্দী বিলিয়ন মানুষ। এ সময় অপ্রত্যাশিত মেদ আর অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণের হার দুই-ই বাড়বে, গৃহে নারী নির্যাতনের পরিমাণ থেমে থাকবে না। এরই মধ্যে বাংলাদেশে এক কোটি মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে, আমরিকায় সেই সংখ্যাটা দেড় কোটি, চীনে আট কোটি, ভারতে বার কোটি। যেখানে বত্রিশ জন ধনীর হাতে পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদ, দৈনিক একশো কোটি মানুষ এক ডলারের কম আয় করে আর দেড়শ কোটি মানুষের আয় এক থেকে দুই ডলারের মধ্যে সীমিত- ভাবুন তো আজ থেকে দুশো বছর পর পৃথিবীটা কেমন হবে? হিন্দু ধর্ম মতে, আমরা কলিযুগে আছি, হুজুররা হয়তো বলবে কেয়ামত খুব সন্নিকটে, পরিবেশবাদীরা অনুমান করবে পৃথিবীর জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে, বিজ্ঞানীরা যুক্তি সহকারে দেখাবে মানবজাতি পৃথিবীর বাইরে বসতি গড়তে সক্ষম হবে, ইতিহাসবিদরা আরও কয়েকটা প্রক্সি যুদ্ধের আলামত হাজির করবে- সেসব ভাবনা থেকে ইউভাল নোয়া হারারির ভাবনা গভীর আর বিচক্ষণ। তার তৈরি করা ভবিষ্যত পৃথিবীর রূপরেখা আমাদের বিস্মিত করে, নতুন চিন্তার খোরাক জোগায়। এর মানে আমরা ধরে নিব না তার ভাবনা পয়গম্বরের ভাবনার মতো শুদ্ধ আর সমালোচনাহীন।

ইউভাল নোয়াহ হারারি

হারারি ভবিষ্যত পৃথিবীর রূপরেখায় প্রযুক্তিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। মানুষের জৈববিবর্তন তার আলোচনার প্রধান কেন্দ্র, মানুষকে নিছক প্রাণী হিসেবে দেখার প্রবণতা তার লেখায় ঢের আছে। এখানে আমরা হোমো ডিউস: অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টুমোরো (২০১৬) ও টুয়েন্টি ওয়ান লেসনস ফর দ্যা টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি (২০১৮) বই দুটির সাহায্য নিয়ে হারারির ভবিষ্যত পৃথিবীর রূপরেখা তুলে ধরবো।

ভবিষ্যত মানুষ

The fox economy cannot grow, because fox don’t know how to produce rabbits. (Homo Deus, 2016)

মনুষ্যজাতির আছে অর্থ আর পুঁজি, যন্ত্রপাতি, উৎপাদন ব্যবস্থা, সমাজতন্ত্র  নামক কতগুলো ধারণা, যা অন্য কোনো প্রাণীর নেই। অন্যপ্রাণীরা সারাজীবনের সঞ্চয় কোনোভাবেই একদিনে করতে পারে না কিন্তু মানুষ পারে। অন্য প্রাণীর জিডিপি নামক কোনো ধারণা নেই, মানুষের আছে। মানুষ তার চিন্তা কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার টন চাল আর গম উৎপন্ন করতে পারে। আধুনিক পুঁজি গতিশীল, এ পুঁজি স্থির  হলে পুঁজিজগতে ধাক্কা লেগে যায়। ফলে পুঁজি তার টিকে থাকার শর্তে নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার করে আর বিনিয়োগে মনোযোগী হয়। পুঁজি নিজ স্বার্থে এগিয়ে চলে, নিত্য উৎপাদন করে গতিশীলতা রক্ষা করে। আঠারো শতকের শিল্প বিপ্লব সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। গ্রামের কৃষক শহরের দিকে ধাবিত হয়, নতুন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। হারারির ভাবনায়, আগামী দিনেও মানবজাতি প্রযুক্তির কল্যাণে অন্যরকম এক বাস্তবতার মুখোমুখি হবে। যে বাস্তবতায় মানুষ সুপার হিউম্যানে রূপান্তরিত হবে, বিশেষ সুবিধা ভোগ করবে। সামনের দিনগুলোতে প্রযুক্তির কল্যাণে তিন ধরনের মানুষ দেখা যাবে:

এক. বায়োলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং: মানুষ আদিদশা থেকে অ্যামিবা, রেপটাইল ধাপ পেরিয়ে হোমো স্যাপিয়েন্সে রূপান্তরিত হয়েছে। মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্সেও আর আটকে থাকবে না। বায়োলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং মানুষের দীর্ঘ বিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করবে না বরং বিশেষ সুবিধা ভোগ করার স্বার্থে ব্রেন সার্কিট, জেনেটিক কোড, বায়োলজিক্যাল ভারসাম্য রক্ষা করে নতুন স্যাপিয়েন্স তৈরি করবে। যা এখনকার স্যাপিয়েন্সের মতো হবে না, যার আয়ু আরও দীর্ঘ হবে, কাজ করার সক্ষমতা বাড়বে।

দুই. সাইবর্গ ইঞ্জিনিয়ারিং: মানুষ তার শরীরে নন অর্গানিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করবে। আর্টিফিশিয়াল চোখ, বায়োনিক হাত আর পা লাগাতে শুরু করবে। এসব যন্ত্র স্থাপনের কারনে মানুষ পূর্বের চেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করবে আর ভারী কাজ সম্পাদন করতে পারবে। সাইবর্গ শুধু যে ফিল্মেই দেখা যায়, তা নয়। বাস্তবে প্যারালাইসিস বা হার্টের সমস্যায় একে কাজে লাগানো হয়, সেই সক্ষমতা ভবিষ্যতে আরও বহুগুণে বাড়বে।

তিন. ইঞ্জিনিয়ারিং নন-অর্গানিক বিং:  উপরের দুই প্রজেক্টের সাথে এটা সম্পর্কিত। এটা মানুষকে একবারে নন-অর্গানিক করে তুলবে। যদিও এর ফলাফল সম্পর্কে মানবজাতি এখনো পুরোপুরি অবগত নয়। বলা যায় এটা যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিবহণ ব্যবস্থা আর জীবন ব্যবস্থার নানান ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন আনবে। এমনও হবে এটা মানুষের যেকোনো আকাঙ্ক্ষাকে মুহুর্তে সাধন করবে। তবে মানুষের চৈতন্যে তেমন পরিবর্তন আসবে না। যেমন ধরা যাক, সফোক্লিস বা ইউরিপিদিসের নাটকের মমার্থ মানুষ ঠিকই বুঝবে কিন্তু প্রদর্শনের সময় এদের সাজগোজে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। হয়তো দেখা যাবে রাজা ঈদিপাসের পরনে জিন্স প্যান্ট, যোগাযোগের জন্য ফেসবুক থাকবে কিন্তু নিষিদ্ধ ব্যাপারটির মর্মার্থ ঠিকই মানুষ অনুধাবন করতে পারবে। রোমিও-জুলিয়েটের প্রেমের বেলায়ও একই কথা খাটে।

মানুষের গড় আয়ু এতদিন চল্লিশের আশেপাশে ছিল, বর্তমানে সত্তর। যদি ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের পর্যাপ্ত ওষুধ আবিষ্কার হয় আর মানুষ তার বেপারোয়া জীবনযাপনে নিয়ন্ত্রণ আনে; মানুষের গড় আয়ু নব্বই হবে। সামনের দিনগুলোতে প্রযুক্তির কল্যাণে গড় আয়ু একশো বিশ থেকে একশো পঞ্চাশ করা সম্ভব। বিজ্ঞানীরা উদঘাটন করেছে, শরীরে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে, ফুসফুস কাজ না করলে বা নানান সংক্রামক জীবাণুর আক্রমনে মানুষের মৃত্যু হয়। মানুষ একটা সময় কোয়ান্টাম বিদ্যা কাজে লাগিয়ে নিজ জীবনকে স্বাভাবিক মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে।

পৃথিবীর পুরো ইতিহাস জুড়ে অভিজাতরা বিশেষ সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করেছে। কিন্ত কোনো সময়ই তাদের সাথে নিচু শ্রেনীর মানুষের জৈবিক অমিল ছিল না। মধ্যযুগের অভিজাতরা বলতো তাদের শরীরে অভিজাত রক্তের ধারা বইছে, ব্রাহ্মণরা বলতো তারা দেখতে উজ্জ্বল, নাইটরা বলতো তারা বীর যোদ্ধা- আদতে সেগুলো ছিল ফিকশন। হারারির ভাবনায়, ভবিষ্যতে আমরা ধনী আর গরীবের মধ্যে সত্যিকারের জৈবিক পার্থক্য দেখতে পাবো। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এই কাজ সম্পূর্ণ করবে, কিছু মানুষ সুপার হিউম্যানে পরিণত হয়ে মানবজাতিকে বিভক্ত করবে।

ভবিষ্যত ধর্মীয় বিশ্বাস

Google won’t have to be perfect. It won’t have to be correct all the time. It will just have to be better on average than me. (Homo Deus, 2016)

হারারি প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসকে ইতিহাস দিয়ে বুঝতে চেয়েছেন, বিভিন্ন ঘটনা আর পরম্পরা বিশ্লেষণ করে তিনি ভবিষ্যতের মনুষ্য ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনেক আগে কিছু মানুষ বিশ্বাস করতো পৃথিবীর সব জায়গায় প্রাণ আছে। এরা ভাবতো গাছ, পাথর, নদী, পাহাড়, পর্বত, বিভিন্ন প্রাণী তাদের পূর্ব পুরুষ। তাই এগুলোর পূজা করতো। এই ধারণাকে বলা হয় অ্যানিমিজম। দীর্ঘদিন এই ধারণা প্রচলিত ছিল, এখনও কয়েক লক্ষ মানুষ এই ধারণার অনুসারী। দুনিয়াব্যাপি কৃষি বিপ্লবের সময়ে কিছু মানুষ বহু দেব-দেবীতে বিশ্বাস করতে শুরু করে, মানুষ আর মানুষের সংস্কৃতি সৃষ্টির পেছনে এসবের হাত আছে বলে এরা মনে করে- এই ধারণাকে বলে পলিথেইজম। তৃতীয় আরেকটি ঘরানার ধর্ম আমরা দেখতে পাই, যারা বিশ্বাস করে পৃথিবী সৃষ্টির নৈপথ্যে একজন ঈশ্বর আছে। যিনি সব ভালো-মন্দের দেখভাল করে। হারারি বলছেন, এই তিন ধর্মের বাইরে মানবতাবাদ নামক আরেক প্রকার ধর্ম আছে। শিল্প বিপ্লবের সমসাময়িক সময়ে এ ধর্মের উদ্ভব। এ ধর্মে ঈশ্বর নেই, মানুষ-ই প্রধান। কিন্তু ভবিষ্যতে ধর্মের রূপ এমন থাকবে না। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমরা সর্বদা অ্যালগরিদমের সাফল্যের কথা শুনি- যত দিন গত হবে, ধীরে ধীরে জৈবিক অ্যালগরিদম ধারণাটি বিকশিত হবে। জৈবিক অ্যালগরিদম কাজে লাগিয়ে মানুষ তার শরীরের ওপর সবরকমের নিয়ন্ত্রণ আনতে পারবে। মানুষ একসময় ঈশ্বর ধারণাকে ধ্বংস করবে আর হোমো স্যাপিয়েন্স পরিবর্তিত হয়ে হোমো ডিউসে রূপান্তরিত হবে।

আর্টওয়ার্ক: বিগ ডাটা
শিল্পী: জাজা গানবল্ট
সূত্র: সাৎসি আর্ট

মানুষ সচরাচর তাদের প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের পরিবর্তন সম্পর্কে ভয় পায়। কিন্তু মানুষ না চাইলেও তাদের বিশ্বাসগুলোর পরিবর্তন ঘটবে, নতুন বিশ্বাসের জন্ম হবে। মিশরে তিন হাজার বছর ধরে ফারাও দেবতার পূজা করা হত, সে সেময় তারা ভাবতো ফারাও না থাকলে কে তাদের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করবে আর কে তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে? অথচ আজকে ফারাও দেবতা নেই, কিন্তু মানুষ সুন্দরভাবে বেঁচে আছে, পূর্বের চেয়ে মানুষ বেশি ন্যায়বিচার পায়, বেশি খেতে পারে আর শৃঙ্খল সহযোগে বাস করে। তিনশো বছর ধরে মানবতাবাদ পৃথিবীতে জায়গা করে নিয়েছে, মানবতাবাদ কিছু সময় আলোড়ন তুললেও বর্তমানে এটি সমালোচনার কাঠগোড়ায়। হারারির মতে, হয়তো মানবতাবাদও একসময় থাকবে না, নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটবে। ইতিমধ্যে তিনি ভবিষ্যত ধর্মকে দেখতে পাচ্ছেন। সেটি বিগ ডেটা, যাকে হারারি রিলিজিয়ন ডেটা হিসেবেও ডাকতে চান। ডেটার ধর্ম প্রবাহিত হওয়া, এক হাত থেকে বহুহাতে ছড়িয়ে পড়া। এমন না যে পুঁজিবাদ সমাজতন্ত্রের চেয়ে বেশি নৈতিক ছিল, কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধে পুঁজিবাদ জিতে যায় কেননা পুঁজিবাদীরা ডেটার প্রবাহ বৃদ্ধি করে জনগণকে প্রভাবিত করতে পেরেছিল।

ডেটার সাহায্য নিয়ে অ্যালগরিদম মানুষের ইচ্ছা আর বাসনার প্রবণতা ধরে দিতে পারে, মানুষের বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সেকেন্ডে মানুষের অবস্থান শনাক্ত করতে পারে, মানুষকে জানাতে পারে কোন পথে গন্তব্যে পৌঁছানো সহজ আর নিরাপদ। কোন হাসপাতালে বিশেষ সুবিধা আছে, কোন শহরে আর কোন দেশে বিনোদন ব্যবস্থা বিলাসী, কোন বই কাজের, কোন বিদ্যালয়ে শিক্ষা ভালো দেয়া হয় তা মুহুর্তে জানায়। নতুন কোন পণ্য বাজারে ভালো চলছে, কোন পণ্যের ব্র্যান্ড ভ্যালু সবচেয়ে বেশি, ঘর কীভাবে সাজাতে হয়, বিয়েতে বর পক্ষ কোন জিনিসটা বেশি পছন্দ করে- তাও জানাতে বাকি থাকে না। হারারির ভাবনায়, সামনের দিনে হেরা গুহা বা সিন পর্বত থেকে ধর্ম আসবে না, ধর্ম আসবে ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালির মতো জায়গা থেকেও। যেখানে গুগলের অফিস, যেখানে পুরো পৃথিবীর তথ্য জমা হচ্ছে। মানুষের সুখ-দুঃখের ধরন, কান্না আর বেদনা, বিপ্লব আর আন্দোলনের তথ্য সেখানে নিত্য আপডেট হচ্ছে। পৃথিবীর কেন্দ্র হবে ফেসবুক, অ্যাপেল আর অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। আমেরিকা আর রাশিয়া নয়, পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ থাকবে এদেরই হাতে।

সামনের দিনে বিগ ডেটা নৈতিকতার সবক দিবে, কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ তা মুহুর্তে জানাবে। ধর্মের মিথের মতো এরাও মিথ ছড়িয়ে দিবে। মানুষ সে মিথ অনুসারে সিদ্ধান্ত নিবে, সে মিথ অনুসারে সঞ্চিত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করবে। বিগ ডেটা মানুষের ভাগ্য ঈশ্বরের মতো নির্ধারণ করে দিবে। হয়তো বিগ ডেটা কাজে লাগিয়ে অ্যালগরিদম পুরোপুরি নির্ভুল কাজ করতে পারবে না, কিন্তু মানুষের চেয়ে বেশি শুদ্ধ কাজ করবে। মানুষের চেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখবে, দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়েও কম দুর্ঘটনা ঘটাবে। আবার ধর্মের মতোই বিগ ডেটার অপব্যবহার হবে। রাজনীতিবিদ আর পুঁজিপতিরা একে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ারে পরিণত করবে। যেমন বাজারে চালু আছে, ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় বিগ ডেটার ব্যবহার করেছিলেন, যা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে তাকে প্রচুর সাহায্য করেছিল। এমনকি ব্রেক্সিটেও একই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিলো। হারারি বলছেন, এই অপব্যবহার থেকে মানুষকে মুক্তি পেতে হলে অবশ্যই নতুন আদর্শের প্রয়োজন হবে।

ভবিষ্যত চাকুরীর বাজার 

Some believe that within a mere decade or two billions of people will become economically redundant. (21 lessons for the 21st Century, 2018)

পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের দুই ধরনের কাজের সক্ষমতা দেখা গেছে। মানুষ হয় কায়িক শ্রম করে, না হয় মানসিক শ্রম দেয়। পৃথিবীর ইতিহাস জুড়ে মানুষ কায়িক শ্রম বেশি দিয়েছে, মানসিক শ্রম দেয়নি তা বলা উদ্দেশ্য নয়। সভ্যতার যা কিছু, তা ওই দুইয়ের-ই যোগসাজস। মানুষ খাদ্য সংগ্রহ, কৃষিকাজ আর দাসত্ব করে বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছে। সম্ভবত গত দুশো বছর ধরে মানসিক শ্রমের মূল্য মানুষ গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছে। পূর্বে বেঁচে থাকার স্বার্র্থে কায়িক শ্রম ব্যতিত মানুষের আর কোনো উপায় ছিলনা, ভবিষ্যতে মানসিক শ্রম ব্যতিত মানুষ টিকে থাকতে পারবে না।

খাদ্য যোগানের জন্য মিশরে দীর্ঘসময় দাস ব্যবসার কারবার ছিল, ভারতীয় সভ্যতায় ছিল কৃষিকাজ, রোমানদের ছিল দেশ দখল- এসবের মূল কারন মানুষের অবিরাম টিকে থাকার সংগ্রাম। মানুষ হয় দাস হবে, না হয় দাসে পরিণত হবে। সামন্তসমাজে যে কৃষক ফার্মে কাজ করতো শিল্প বিপ্লবের ফলে সে হয়ে যায় শ্রমিক আর স্নায়ু যুদ্ধের শেষদিকে বেশিরভাগ শ্রমিক সুপার শপে চাকরি করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ভারতে তখনও কৃষিব্যবস্থাই জীবিকার উৎস, দখলবাজ রোমান আর মিশরের দাশ কারবার ইতিহাসে অতীত হয়ে গেছে। পৃথিবীতে আগমন ঘটেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার; হারারি ধারণা করেছেন, এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই আগামী দিনে দুশো কোটির বেশি মানুষকে অপ্রয়োজনীয় বানিয়ে ফেলবে। বেশিরভাগ কাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একাই সম্পাদন করবে। তখন মানুষের পারিশ্রমিক কমে যাবে, কায়িক শ্রম অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়তে থাকবে।

গাড়ি চালকের পদগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দখল করবে, হাসপাতালের নার্স আর ডাক্তার, আইনজীবী, বিমানের পাইলট, সেনাবাহিনীর পদগুলোতে এদের দেখা যাবে। এরা অ্যালগরিদম ব্যবহার করে নিখুঁতভাবে কাজ করবে, এমনকি মানুষের চেয়েও এদের কাজ বেশি নিখুঁত হবে। পৃথিবীতে প্রতিবছর পনের লাখ মানুষ সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যায়; যার নব্বই ভাগ দূর্ঘটনা অসাবধানতাবশত ঘটে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই জায়গায় একটা বড় পরিবর্তন আনতে পারবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বড় বড় হাসপাতাল বা ক্লিনিকে এরা নিখুঁত কাজ করবে। নিমিষেই পৃথিবীর প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অবদান রাখতে পারবে। এরা মানুষের জীবনকে সহজ করবে, মানুষের ভোগের পরিমাণ বৃদ্ধি করবে। চিকিৎসা সেবায় একটুও কার্পণ্য করবে না, মহামারির সময় এরাই মানুষকে উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর এরা যখন ব্যাপকভাবে সফলতা লাভ করবে, তখন বেশিরভাগ চাকরিতে মানুষ অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে, মানুষ সমাজের জন্য বোঝা হয়ে থাকবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেহেতু নতুন চিন্তা করতে পারে না, শুধুমাত্র চিন্তা ধরতে পারে। তাই মানসিক শ্রমে দক্ষ মানুষেরাই ভবিষ্যতে বাজিমাত করবে। সমাজের বেশিরভাগ মানুষকে সে ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে মানসিক শ্রমের দিকে ঝুঁকতে হবে।

দীর্ঘ আঠারো বছর নেলসন ম্যান্ডেলা রবেন দ্বীপে বন্দী ছিল। সেখানে তাকে দৈনিক তের ঘন্টা শ্রম দিতে হত; রেল লাইন তৈরি করতে, পাথর ভাঙ্গতে, জঙ্গল পরিষ্কার করতে তার দিন কেটে যেত। নোবেল বিজয়ী লেখক সলঝেনিৎসেনকে স্টালিনের গুলাগে অমানুষিক শ্রম দিতে হয়েছে। ভবিষ্যতে আর কোনো মানুষের সেই হাড় ভাঙ্গা খাঁটুনির সম্ভাবনা থাকবে না, অ্যালগরিদম কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেসব কাজ নিজেই সম্পাদন করে দিবে। বিপরীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে মানুষের নতুন কায়দা-কানুন শিখতে হবে আর প্রযুক্তি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হবে।

ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে বৈষম্য ব্যাপক হাড়ে বেড়ে যাবে। এর জবাবে হারারি হয়তো বলবেন, স্যাপিয়েন্স তার আদি অবস্থা থেকেই বৈষম্যে বিশ্বাসী প্রাণী।

ভবিষ্যত উদারনীতিবাদ

Science fiction tends to confuse intelligence with consciousness, and assume that in order to match or surpass human intelligence, computers will have to develop consciousness. (21 lessons for the 21st Century, 2018)

পুরো পৃথিবী চলছে একে অপরের দোষ খুঁজে। জাতিসংঘের চুয়াত্তর তম সাধারন অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অভিযোগ করেছিলন, নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তান বিদ্বেষী প্রচারণা চালিয়ে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছে, কিন্তু তিনিও সুযোগ পেলে পাকিস্তানের সংসদ আর জনতার মঞ্চে ভারত বিরোধী বক্তব্যের পসরা সাজিয়ে বসেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তুলে দেবার অঙ্গীকার করে, চীনাদের চাকরি থেকে ছাঁটাইয়ের প্রচারণা চালান আর সবসময় তার বক্তব্যের মূল কেন্দ্র ছিল হিলারির ইমেইল ফাঁসের ঘটনা। ট্রাম্প আমেরিকানদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আমেরিকাকে আবার  শ্বেতাঙ্গময় করে তুলবেন, কিন্তু বাস্তবিক অর্থে পৃথিবীর অর্থনীতি একে অপরের সাথে এমনভাবে লেপ্টে আছে যার নতুন সংস্কার ছাড়া আমেরিকাকে শ্বেতাঙ্গময় করা সম্ভব নয়। কাছাকাছি ব্যাপার আমরা রাশিয়া, আর তুরস্কের শাসকদের বেলায়ও দেখি, চীনারাও এ বিষয়ে কম পিছিয়ে নেই। অথচ সামনের দিনগুলোতে মানবজাতি নতুন সংকটের মুখোমুখি হবে। তথ্য প্রযুক্তি ও জৈব প্রযুক্তি বর্তমানে শিশু অবস্থায় আছে, ভবিষ্যতে এ দুই বস্তু বিধ্বংসী হয়ে উঠবে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে আছে, ভবিষ্যতে এর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়বে।

প্রত্যেক শাসকের কাজ নিজ দেশের কল্যাণে পরিকল্পনা গ্রহণ করা, দিন দিন অসমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তা নিরসন করা। বেশিরভাগ দেশে গুটি কয়েক মানুষের শাসন দেখা যাচ্ছে, তা বন্ধ করা। দিন দিন বেকার মানুষের হার বেড়ে যাচ্ছে, নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির ফলে নদী ও সাগরের বাস্তুসংস্থানে বিপর্যয় ঘটছে আর বন ধ্বংস থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করা। অথচ আজকের সময়ে নিজ প্রতিদ্বন্দ্বীকে কাবু করাই যেকোনো গাজোয়ারি নেতার মূল কাজ। হারারি হয়তো এগুলোকে মানুষের নির্বুদ্ধিতা আর মূর্খতা বলবেন। চীনারা আমেরিকান বাজার দখল করছে তাতে ট্রাম্পের ঘুম হারাম, কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষকে কর্মহীনকে করে ফেলছে তা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই।

উদারনীতিবাদ গত একশো বছর ধরে স্বপ্ন দেখিয়েছিলো একটি বৈচিত্র্যময় পৃথিবীর। যেখানে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে, ব্যক্তি মানুষের ইচ্ছাকে সম্মান জানানো হবে। গণতন্ত্র সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত থাকবে; এখানে ব্যক্তির যৌক্তিকতা নয়, বরং ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেয়া হবে। হারারি বলেছেন, বিশ শতকে কিছু সময় মানুষ উদারনীতিবাদের চর্চা করতে পেরেছে। এসময় ভোক্তা তার পছন্দমত পণ্য ক্রয় করেছে, ভোটার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে, কিন্তু আধুনিক সময়ে অ্যালগরিদম ব্যক্তির উদারনীতিকে প্রভাবিত করছে। অ্যালগরিদম বিগ ডেটা কাজে লাগিয়ে ব্যক্তির প্রবণতাকে ভিন্ন আবহে রূপান্তরিত করছে। তবে মানুষের ইচ্ছা আর বাসনাকে ধরতে পারেনি, মানুষের চৈতন্যকে বুঝতে পারেনি। অ্যালগরিদম কাজ করে যান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসারে, মানুষের চৈতন্যকে হয়তো এটা পুরোপুরি বুঝতে পারবে না। যদি কখনো মানুষের ইচ্ছা আর বাসনা বুঝতে পারে, তবে সিনেমার কাহিনী সত্যিই বাস্তব হয়ে যাবে, অ্যালগরিদম মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে মানুষের সংঘর্ষ বাঁধবে। চীন, আমেরিকা, জাপান আর রাশিয়ার মতো দেশগুলোর কাছে মানুষ খেলনা পুতুল হয়ে যাবে, গুগল আর ফেসবুক পৃথিবীর প্রধান কেন্দ্র হবে। ধনীরা হবে দৈত্য আর সুপার হিউম্যান, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অসমতা দেখা দিবে।

হারারির মতে, উদারনীতিবাদ গত শতকে হিটলার, স্ট্যালিন আর কমিউনিজমকে মোকাবেলা করেছে।  স্নায়ু যুদ্ধের সময় উদারনীতিবাদ শক্ত অবস্থান থাকলেও সোভিয়েতের পতনের পর ধীরে ধীরে নিজ অঙ্গীকার থেকে সরে এসেছে। আজকের দিনে উদারনীতিবাদ বলতে নিছক সমকামী অধিকারের মতো ব্যাপারগুলো বুঝায়। ব্রেক্সিট আন্দোলনের নেতা মাইকেল গভ প্রথমদিকে বরিস জনসনকে প্রধানমন্ত্রী পদে সমর্থন করেছিলেন, পরে সমর্থন সরিয়ে নিয়েছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, তার যৌক্তিক মন চেয়েছিলো ব্রেক্সিট সমর্থন করতে, তিনি তা করেছিলেন; তার যৌক্তিক মন চেয়েছে বরিসের দিক থেকে সমর্থন উঠিয়ে নিতে, আর তাই তিনি সেটা করেছেন। ডেভিড ক্যামেরুন ব্রেক্সিট বিষয়ে রাণীর কাছ থেকে অনুমোদন নেয়নি। বরং নিজে পরিকল্পনা করেছেন আর সেটা জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন- এটাই হয়তো উদারনীতিবাদের প্রকৃত চেহারা। ধনীদের এরকম দুয়েকটা উদাহরণ ছাড়া উদারনীতিবাদ তেমন সুরক্ষিত হচ্ছে না বরং ধর্ম আর জাতীয়তাবাদ উদারনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলছে। কিন্তু ক্রমেই অ্যালগরিদম পৃথিবীকে সম্পূর্র্ণভাবে পরিচালিত করবে আর মানুষও সেই ফাঁদে আটকে পড়বে। হয়তো আর কখনোই মানবজাতি এ ফাঁদ থেকে বের হতে পারবে না। পৃথিবীর ভাঁজে ভাঁজে যে ধর্মীয়, সম্প্রদায়, বর্ণগত, জাতিগত বিভাজন তা মানুষকে প্রকৃত সমস্যা বুঝতে সাহায্য করবে না। আর ততদিনে উদারনীতিবাদ হয়তো ধ্বংস হয়ে যাবে।

ফেসিয়াল রিকগনিশন

ভবিষ্যত সমাজ

Our sense of justice might be out of date.
(21 lessons for the 21st Century, 2018)

একহাজার পঞ্চাশ সালের সমাজের সাথে এক হাজার একশোয় পঞ্চাশ সালের সমাজের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। খুব সহজেই অনুমান করা যেত, পরবর্তী একশো বছরে কি কি ঘটবে। ভবিষ্যত বাণীতেও তেমন হেরফের হত না। রোমান সভ্যতার সাথে ভারতীয় সভ্যতার জীবনযাপনে তেমন পার্থক্য ছিল না। পৃথিবীর সবগুলো সভ্যতাই মোটামুটি হয় দাস ব্যবসা, না হয় কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও কাছাকাছি ছিল। বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে প্রধান পার্থক্যগুলো চোখে পড়ে শিল্প বিপ্লব চলাকালীন সময়ে। পাশ্চাত্যের শাসকেরা একদিকে উপনিবেশ স্থাপন করে, অন্যদিকে জ্ঞান বিজ্ঞানে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। বিভিন্ন রয়েল সোসাইটি গড়ে তোলে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার হিড়িক লাগে। দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য চর্চার জোয়ার শুরু হয়। হারারি বলেছেন, আগামীতে শিক্ষাক্ষেত্রে এসব বিষয় কম গুরুত্বপূর্ণ হবে। বরং আগামীতে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে মানুষকে বেশি বেশি তথ্য মুখস্থ রাখতে হবে। যোগাযোগ দক্ষতা বাড়াতে হবে, পৃথিবী সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা থাকতে হবে। দেখা যাবে, সে সময় মানুষকে মানসিক কাজের দিকেই বেশি নজর দিতে হবে।

আজকের সময়ে সমাজ দ্রুত বিকশিত হচ্ছে; এই বিকাশে ইতি আর নেতি দুই-ই আছে। প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ এখন একে অপরের খুব কাছাকাছি, মুহুর্তে যেকোনো প্রান্তে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে।  স্নায়ু যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জন এফ কেনেডি ঘোষণা দিয়েছিল মানুষ চাঁদে যাবে, এরপর মানুষ শুধু চাঁদেই নয় মঙ্গল গ্রহেও গিয়েছে। পৃথিবীর বাইরে বসবাসের জন্য ইদানিং তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে। এরপরেও পৃথিবীতে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ জেঁকে বসে আছে। সিলেটের চা বাগানে কাজ করা লোকটি দিনে একশো টাকার কম মজুরি পায়, এখনও আসামের চা বাগানে কাজ করা লোকটি অমানবিক জীবনযাপন করে। গাজীপুরে কাজ করা গার্মেন্টস শ্রমিক দৈনিক তের ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য হয়, বেঙ্গালুরুতে হয়তো কাছাকাছি অবস্থা; শ্রমিকদের বিনোদনের সামান্য সময় নেই। এরপরেও পৃথিবী থেমে নেই; দুবাইয়ে বিশাল টাওয়ারের পাশে সামান্য বেতনের শ্রমিক বসবাস করলে বা সৌদি আরবের শহরগুলোতে সস্তায় শ্রম পাওয়া গেলে পৃথিবীর ধনীদের তাতে কিছু আসে যায় না। বরং পৃথিবীতে ধনীর পরিমাণ নিত্য বেড়েই চলছে; গুগল, ফেসবুক, আলিবাবা, অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠান বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মুনাফা করছে। এমনকি ফোর্বসের প্রতিবেদনে করোনা কালেও তাদের মুনাফা করা থেমে নেই। হারারি বলেছেন, এ শতাব্দীর শেষদিকে হয়তো অসমতা আরও বেড়ে যাবে, তবে বেশিরভাগ মানুষ পূর্বের চেয়ে ভালো চিকিৎসা সেবা পাবে। এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামে থাকা মানুষটিও মুহুর্তে চিকিৎসা সেবা পাবে আর ক্যান্সারের মতো রোগগুলোর চিকিৎসা ব্যয় অনেক কমে যাবে।

বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর পনের হাজার নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, ভারতে হয় দেড় কোটি, আমেরিকায় সেটা আড়াই কোটির ওপরে। স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা করতে অ্যাঞ্জেলিনা জোলির তিনহাজার ডলার খরচ হয়েছিল যা সিলেটের চা বাগানে কাজ করা শ্রমিকের আয়ের অনেকগুন কম। হয়তো সারাজীবন কাজ করেও সে শ্রমিক নিজের স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা সঠিকভাবে করাতে পারবে না। পৃথিবীর এক বিলিয়ন মানুষের আয় যেখানে এক ডলারের কম, সেখানে এরকম ব্যয়বহুল চিকিৎসা না পাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর জৈবিক প্রযুক্তির বদৌলতে এই শতাব্দীর শেষদিকে এসব মানুষ আরও উন্নতধরনের চিকিৎসা সেবা পাবে। পৃথিবীতে মহামারী নামক ব্যাপারটিকে হয়তো ভালোভাবেই সামাল দেওয়া যাবে। হয়তো যুদ্ধ ক্ষেত্রেও ব্যাপক একটা পরিবর্তন আসবে। ঊনিশশো আটষট্টি সালে ভিয়েতনামে এক লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিলো, পল পটের কম্বোডিয়ায় সে সংখ্যাটা প্রায় বিশ লক্ষ, স্টালিনের গ্রেট বার্জের সময়, ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকালে বা ইরাক আর আফগানিস্তান যুদ্ধেও প্রচুর সৈন্য এবং সাধারণ মানুষ মারা পড়েছিল। ভবিষ্যতে সেই যুদ্ধটা স্থানান্তরিত হবে হ্যাকিংয়ে, সার্ভারে সার্ভারে তথা অনলাইনে। ইতিমধ্যে সে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, হয়তো কোনো একসময় রোবোটে রোবোটে যুদ্ধ হবে।

হারারি বলেছেন, ভবিষ্যত মানবাধিকার নামক ব্যাপারটি থাকবে না, একে আমরা মিথ আকারে পাবো। ন্যায়বিচার ব্যাপক আকারে লঙ্ঘিত হবে; বলা যায় সিলিকন ভ্যালি থেকে এর আগমন ঘটবে। সত্য ব্যাপারটি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। অ্যালগরিদম আমাদের সত্যের ভিত গড়ে দিবে, তথ্য প্রযুক্তি আর জৈবিক প্রযুক্তি মিলে সত্যের নানান মাপকাঠি নির্ধারণ করে দিবে। হয়তো আরও বাড়িয়ে বলা যাবে যে, এসবের কল্যাণে বিশ শতকের মতো দূর্দান্ত প্রতাপশালী দার্শনিক তত্ত্ব আর সমাজ বিপ্লবের চেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।  পুঁজিপতিরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড নস্যাৎ করবে- এজন্যই হয়তো এখনকার রাষ্ট্রগুলো মানুষের বায়োমেট্রিক্স নিয়ে খুবই সচেতন, সমস্তরকম জৈবিক পরিচয় টুকে রাখে আর সিসি টিভিতে নজরদারি বৃদ্ধি করে। হারারি এজন্যই বলেছেন, মানুষ একসময় কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী না থাকা সত্ত্বেও নিজের বুদ্ধি খাঁটিয়ে এ গ্রহ দখল করেছিলো, এরপর একজন কাল্পনিক ঈশ্বরের হাতে সে দখল বজায় ছিল; অদূর ভবিষ্যতে মানুষ নিজে ঈশ্বর হয়ে উঠবে আর ঠিক তখনই পৃথিবীর ধ্বংস অনিবার্য হবে।

যদি মনুষ্যজাতির কারণেই পৃথিবীর ধ্বংস অনিবার্য হয়, এ জাতির দায়িত্ব হবে পৃথিবী নামক গ্রহটিকে রক্ষা করা। একসময় সামন্তবাদ ছিল, মানুষ সে জায়গায় পুঁজিবাদ বসিয়েছে। একসময় ষোড়স লুই আর দ্বিতীয় নিকোলাসের জবরদস্ত শাসন ছিল, মানুষ নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। গ্রীকরা বারবার নিজেদের সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করত, আজ তারা বিলীন। বৃটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য্য দিগন্তে মিলিয়ে যেত না, এখন ঢেড় যায়। একদিন পুঁজিবাদও শূন্যে মিলিয়ে যাবে, হয়তো সাথে এ গ্রহটিকেও ধ্বংস করবে- আটল্যান্টিকের বরফ গলতে থাকা আর প্রযুক্তির অবক্ষয় সে বার্তাই দেয়। যদি পুঁজিবাদেই পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার বৈশিষ্ট্য থাকে, মনুষ্যজাতির উচিত স্বয়ং পুঁজিবাদকেই শিকড়সহ উৎপাটন করার তত্ত্ব সন্ধান করা।

রাকিবুল রাকিব

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে গবেষণা করছেন। গল্প লেখেন। পাঠচক্র সংগঠন সংবিৎ-এর সঙ্গে যুক্ত।