অনুবাদ: বীথি সপ্তর্ষি
ধর্ষক হিসেবে দণ্ডপ্রাপ্ত এমন ১০০ জনের সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন ভারতের এক নারী। তাঁর অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে ২০১৭ সালে Washingtong Post-এ একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এটি সেই নিবন্ধের অনুবাদ।
মধুমিতা পাণ্ডের যখন মাত্র ২২ বছর বয়স, তখন তিনি নয়া দিল্লীর তিহার জেলে প্রথমবারের মতো ধর্ষকদের সাক্ষাতকার নিতে গিয়েছিলেন। পরবর্তী তিন বছরে তিনি এমন ১০০ জনেরও বেশি সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষকের সাক্ষাতকার নিয়েছেন তাঁর ডক্টোরাল থিসিসের জন্য।
২০১৩ সালে এই কাজটি শুরু হয়েছিল একটি পাইলট প্রকল্প হিসাবে। দিল্লিতে এক নারীর বহুল প্রচারিত ধর্ষণ ও হত্যার কয়েক মাস পরে। “নির্ভয়া” নামের সেই তরুণী, স্বপ্নবাজ মেডিকেল শিক্ষার্থী “লাইফ অফ পাই” সিনেমা দেখে বন্ধুর সাথে বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে চলন্ত বাসে তাঁকে ধর্ষণ করা হয়। এবং পরবর্তীতে তিনি মারা যান। ঘটনাটি পুরো ভারতে আলোড়ন তৈরি করে। যদিও ভারতে ধর্ষণের ঘটনা অহরহ । ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো অনুসারে ২০১৫ সালে ভারতে ৩৪,৬৫১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানা যায়।
২০১২ সালে নির্ভয়া হাজার হাজার ভারতীয়কে ধর্ষণ ও নারী উপর সহিংসতার বিস্তৃত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নামিয়ে এনেছিল। সেই বছরই, লিঙ্গ-রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা ভারতকে জি -২০ দেশগুলোর মধ্যে নারীর জন্য সবচেয়ে প্রতিকূল স্থান হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এমনকি ভারতের অবস্থা সৌদি আরবের চেয়েও প্রতিকূল, যেখানে কিনা নারীকে একজন পুরুষ অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়।
বিশ্বের আরেক প্রান্ত ইংল্যান্ডে স্নাতকোত্তর শেষ করতে থাকা অবস্থায় পাণ্ডে বলেছিলেন, “প্রত্যেকে একই কথা ভাবছিল।” ; “কেন এইসব লোকেরা এমন কাজ (ধর্ষণ) করে? আমরা তাদেরকে দানব ভাবি, আমরা মনে করি কোন মানুষ এমন কাজ করতে পারে না।
ভারতে চলমান বিক্ষোভগুলো ধর্ষণ সম্পর্কে একটি জাতীয় আলোচনা তৈরি করতে বাধ্য করেছিল। এটা এমন একটা বিষয় যা এখনও ভারতে ট্যাবু হিসেবে বিবেচিত হয়। নয়াদিল্লিতে বেড়ে ওঠা মধুমিতা পাণ্ডে, নির্ভয়ার ঘটনার পর তাঁর শহরকে নতুনভাবে আবিস্কার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “আমি ভাবতাম, এই লোকগুলো কীভাবে প্ররোচিত/উত্তেজিত হয়, কোন পরিস্থিতিতে এমন হয়ে ওঠে? পুরুষদের এমন পরিস্থিতি কীভাবে জন্মায়? আমার মনে হয়েছিল: প্রশ্নগুলো সরাসরি তাদেরই জিজ্ঞাসা করা দরকার।”
সেই থেকে তিনি কয়েক সপ্তাহ ধরে দিল্লির তিহার জেলে ধর্ষকদের সাথে কথা বলছিলেন। সেখানে তিনি যে পুরুষদের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন তাদের বেশিরভাগই ছিলেন অশিক্ষিত, কেবলমাত্র হাতে গোনা কয়েকজন উচ্চ বিদ্যালয় উত্তীর্ণ। অনেকেই তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির ড্রপআউট ছিল। “যখন আমি গবেষণা করতে গিয়েছিলাম, তখন আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, এই ব্যক্তিরা জঘন্য, দানব ধরনের কিছু হবে। কিন্তু আপনি যখন তাদের সাথে কথা বলবেন তখন বুঝতে পারবেন যে, এরা কোনও অস্বাভাবিক/অদ্ভূত পুরুষ নয়, তারা আসলে সাধারণ। তারা যা করেছে তা তাদের যেভাবে লালন-পালন করা হয়েছে তার মধ্যেই নিহিত। চিন্তা-পদ্ধতির কারণে।
পাণ্ডে বলছিলেন, ভারতীয় পরিবারগুলোয় এমনকি উচ্চ শিক্ষিত পরিবারেও নারীরা প্রায়শই গৎবাঁধা ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, অনেক নারীরা এমনকি তাদের স্বামীর প্রথম নাম ব্যবহার করেন না। “পরীক্ষা করার জন্য আমি আমার কয়েকজন বন্ধুকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করলাম: তোমার মা তোমার বাবাকে কী বলে ডাকেন? আমি যে উত্তর পেয়েছি তা হল ‘এই শুনছো’, ‘শোনো’ বা ‘রোনাকের বাবা’ (সন্তানের নাম)।
পুরুষরা পৌরুষ সম্পর্কে ভুল ধারণাগুলো শিখছে এবং নারীরাও অধঃস্তন হতে শিখছে। পাণ্ডে বলছেন, একই পরিবারে এটা ঘটছে। “প্রত্যেকে ধর্ষকের জন্মগত কিছু ভুল আছে বলে মনে করে। কিন্তু তারা আমাদের সমাজেরই অংশ। তারা অন্য পৃথিবী থেকে আসা এলিয়েন নয়।”
পাণ্ডে বলেন, ধর্ষকদের কিছু কথা তাকে তার নিজের পরিবারেও সাধারণভাবে চর্চিত কিছু ব্যাপার স্মরণ করিয়ে দেয়। “আপনি [ধর্ষকদের] সাথে কথা বলার পর ধাক্কা খাবেন— এই লোকগুলোর জন্য আপনার করুণা হবে। একজন নারী হিসাবে আপনার তা অনুভব করার কথা নয়। আমি প্রায়ই ভুলে যেতাম যে, এই পুরুষরা কোনও নারীকে ধর্ষণের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা হলো: এই পুরুষরা বুঝতেই পারেন না যে তারা যা করেছে তা ধর্ষণ। তারা ‘সম্মতি’ কী তা-ই বোঝে না।”
“তারপর নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, কেবল এই লোকগুলোই কি এমন? নাকি বেশিরভাগ পুরুষরাই এমন?” বলেছেন মধুমিতা। ভারতে সামাজিক মনোভাব অত্যন্ত রক্ষণশীল। বেশিরভাগ স্কুলের পাঠ্যক্রম থেকে যৌনশিক্ষাকে বাদ দেয়া হয়েছে। আইন-প্রণেতারা মনে করেন, এই জাতীয় বিষয় যুব সমাজকে “কলুষিত” করতে পারে এবং প্রচলিত মূল্যবোধে আঘাত হানতে পারে। পিতামাতারা লিঙ্গ, যোনি, ধর্ষণ বা যৌনতার মতো শব্দগুলো বলবেনই না। “তারা যদি এই মানসিকতা থেকে বের হতে না পারেন তাহলে কীভাবে তরুণ ছেলেদের শিক্ষিত করবেন?” প্রশ্ন রেখেছেন মধুমিতা।
সাক্ষাতকারে, অনেক পুরুষ তাদের কৃতকর্মের জন্য অজুহাত বা জাস্টিফিকেশন হাজির করেছিল। অনেকে ধর্ষণ যে ঘটেছিল বেমালুম তা অস্বীকার করে গেছে। “সেখানে কেবল তিন বা চার জন বলেছিলেন যে, আমরা অনুতপ্ত। অন্যরা তাদের কাজের পক্ষে যুক্তি হাজির করছিল, বিষয়টা হালকা করার চেষ্টা করছিল, এমনকি কেউ কেউ আক্রান্ত নারীকেই দোষারোপ করছিল।
বিশেষত ৪৯ নং অংশগ্রহণকারী, পাণ্ডেকে অপ্রত্যাশিতভাবে নাড়া দিয়েছিল। তিনি ৫ বছরের এক মেয়ে শিশুকে ধর্ষণের জন্য অনুশোচনা করছিলেন। “তিনি বলেছিলেন ‘হ্যাঁ আমার খারাপ লাগছে, আমি তার জীবন নষ্ট করে দিয়েছি। এখন সে আর কুমারী নয়, কেউই তাকে বিয়ে করবে না।’ তারপরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তাকে গ্রহণ করব, জেল থেকে বেরিয়ে এলে তাকে বিয়ে করব’।”
এই প্রতিক্রিয়া পাণ্ডেকে এতটাই হতবাক করেছিল যে তিনি ভুক্তভোগীর খোঁজ নিতে বাধ্য হন। লোকটি সাক্ষাতকারে মেয়েটির অবস্থান সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দিয়েছিল। তিনি যখন মেয়েটির মাকে খুঁজে পেয়েছিলেন, তখন তিনি জানতে পেরেছিলেন যে এমনকি তাদের মেয়ের ধর্ষক কারাগারে আছেন, সে কথাও মেয়েটির পরিবারকে বলা হয়নি।এই কাজের জন্য তাকে অনেক বৈরিতার মুখোমুখিও হতে হয়েছে। তিনি বলেছেন, “অনেকে ভাবেন, আরেক নারীবাদী এসেছে! তারা ধরেই নেন যে কোন নারী এভাবে গবেষণা করছেন মানে পুরুষের ধারণাগুলোকে ভুলভাবে উপস্থাপন করবেন। এমন কারো সাথে আপনি কোথায় থেকে আলাপ শুরু করবেন?”