- সেলিম রেজা নিউটন
চিন্তা বলতে এখন আমরা যা বুঝি সেই অর্থে চিন্তা বলে কিছুই আর থাকবে না আসলে। গোঁড়ামি মানে চিন্তা না করা – চিন্তার প্রয়োজনই না পড়া। গোঁড়ামি হলো অচেতনতা। (জর্জ অরওয়েল, ‘উনিশ শ চুরাশি’, ১৯৪৯)
কে ছিলেন অরওয়েল?
জর্জ অরওয়েল ছিল তাঁর ছদ্ম নাম। প্রকৃত নাম এরিক ব্লেয়ার। জন্ম ১৯০৩ সালে। বৃটেনের তৎকালীন উপনিবেশ ভারতের পূর্ববঙ্গে। স্কলারশিপ পাওয়া ছাত্র হিসেবে পড়াশোনা ইংল্যান্ডের অভিজাত স্কুলগুলোতে। কিন্তু সেসব স্কুলে শিক্ষার্থীদের ওপর স্বৈরাচারী নিয়ন্ত্রণের সাথে মানিয়ে নিতে পারেন নি তিনি। নিজেকে তাঁর নির্যাতিত মনে হতো। মনে মনে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তিনি কলেজে পড়াই বাদ দিয়ে দেন। বৃটিশ রাজকীয় পুলিশবাহিনীর সদস্য হিসেবে চলে যান বার্মায়। স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার কঠোর পুলিশী নিয়ন্ত্রণের প্রতি তাঁর ঘৃণা জন্মায়। ছুটি নিয়ে ফিরে আসেন ইংল্যান্ডে। এসেই ছেড়ে দেন চাকরিটা। মন দেন লেখালেখিতে।
ড্রইংরুম-লেখক ছিলেন না তিনি। লন্ডনের বস্তিতে ছেঁড়া কাপড় পরে জীবন-যাপন করেছেন। উত্তর ইংল্যান্ডের খনিশ্রমিকদের সাথে তাঁদের অধঃপতিত জীবন-যাপনও করেছেন তিনি। এসব অভিজ্ঞতা তাঁকে পুঁজিবাদ প্রত্যাখ্যান করতে শেখায়। আস্থা জন্মায় তাঁর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রতি। আরও পরে ১৯৩৬ সালে সাংবাদিক হিসেবে স্পেনে গিয়েছিলেন সেখানকার ‘গৃহযুদ্ধ’ তথা ফ্যাসিবাদের উত্থানের বিরুদ্ধে নৈরাজ্যবাদী/সমাজতান্ত্রিক প্রতিরোধযুদ্ধ বিষয়ে রিপোর্ট করার জন্য। সেখানে ফ্যাসিবাদীদের বিভিষীকাপন্থা নিজের চোখে দেখেছেন। অংশ নিয়েছেন স্বাধীনতাশীল সমাজতন্ত্রীদের জনযুদ্ধে। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে লিখেছেন পরবর্তীকালে নোম চমস্কি কর্তৃক বহুল প্রশংসিত দালিলিক রচনা ‘ক্যাটালোনিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি’। স্পেনে ফ্রাংকোর, জার্মানিতে হিটলারের এবং রাশিয়ায় স্তালিনের উত্থান তাঁর মনে সর্বাত্মক-স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রপন্থার প্রতি সুগভীর ঘৃণা এবং মনুষ্য-স্বাধীনতার প্রতি আন্তরিক অনুরাগের জন্ম দেয়।
কর্তৃত্বের প্রতি বিরাগ, স্বাধীনতার প্রতি অনুরাগ
এক কথায়, কর্তৃত্বের প্রতি বিরাগ এবং স্বাধীনতা-সৃজনশীলতার প্রতি অনুরাগই অরওয়েলকে দিয়ে পশুখামার (১৯৪৫) এবং উনিশ শ চুরাশি (১৯৪৯) নামে কালজয়ী উপন্যাস দুটি লিখিয়ে নিয়েছিল। রাশিয়া-জার্মানি-স্পেনে কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক কর্তৃত্বের মনুষ্যত্ব-বিধ্বংসী তৎপরতার যে পরাকাষ্ঠা তিনি দেখেছিলেন সেটাই তুলে ধরেছিলেন এই দুই লেখায়। ইংরেজি সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক কর্তারা রচনা দুটিকে (বলশেভিক ধারার) সমাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারের সমস্যা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করলেও দুটো রচনাতেই আসলে তিনি সাধারণভাবে পুঁজিবাদ-পরবর্তী পাশ্চাত্য-সমাজে অর্থোডক্সির চূড়ান্ত পরিণতির চরম বিভীষিকাপূর্ণ ছবি এঁকে মানবজাতিকে সতর্ক করে দিতে চেয়েছিলেন। সারা রাশিয়ায় ‘সোভিয়েত’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আপামর শ্রমজীবী মানুষের অর্জিত মহান রুশবিপ্লবকে একটি ষড়যন্ত্রমূলক ক্যু-দেতা তথা রাজনৈতিক প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে নস্যাৎ করে দিয়ে লেনিনবাদী বলশেভিকদের প্রতিষ্ঠা-করা চরম ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের প্রচারণাভিত্তিক জয়জয়কার জর্জ অরওয়েলকে নিদারুণ ধাক্কা দিয়েছিল। এক দিকে বলশেভিকদের সর্বাত্মক-স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রপন্থাকে দুনিয়াজোড়া যোগাযোগহীনতা (আজকের তুলনায়), মানুষের জানার সুযোগের অভাব, আর স্রেফ প্রচারণার জোরে ‘সমাজতন্ত্র’ বলে চালাতে থাকা, এবং অন্য দিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইঙ্গ-মার্কিন অঞ্চলে বিপুল গতিতে প্রবর্ধমান চরম গণবিরোধী কর্পোরেট-পুঁজিবাদী রাষ্ট্রপন্থার আশঙ্কাজনক বিকাশ অরওয়েলকে বিচলিত করেছিল।
চিন্তাপরাধ, চিন্তাপুলিশ
কল্পনায় আঁটে এমন নিকৃষ্টতম মানবসমাজের একটা ধারণা পাই আমরা ‘উনিশ শ চুরাশি’তে। ১৯৪৯ সাল। পারমাণবিক যুগের ঊষাকাল। তখনও ঘরে ঘরে টেলিভিশন ঢোকে নি। অরওয়েলের দূরদৃষ্টি পরমাণু-উত্তর যুগের এমন এক ছবি আঁকল যেখানকার ঘরে-বাইরে-পথে- প্রাঙ্গণে বসানো টেলিপর্দার মাধ্যমে প্রত্যেকটা মানুষকে সার্বক্ষণিক নজরদারির আওতায় আনার ধারণাটা আতঙ্কজনকভাবে সম্ভব বলেই মনে হয়। রচনাকালের ৩৫ বছর পরের ঘটনাবলী নিয়ে বিন্যস্ত, রক্তহিম-করা, এই অসাধারণ উপন্যাসটির ঘটনাকাল ১৯৮৪ সাল। ঘটনাস্থল লন্ডন, উপন্যাসের বিকল্প বাস্তবতায় যা ওশেনিয়া মহাদেশের ‘এয়ারস্ট্রিপ ওয়ান’ হিসেবে পরিচিত। অন্ধকার, হতাশ, নৈরাশ্যজনক স্বরে লিখিত এই রচনার মূলভাব হচ্ছে সর্বাত্মক-স্বৈরতন্ত্রী রাজনৈতিক কর্তৃত্বের মনস্তাত্ত্বিক, প্রাযুক্তিক, শারিরীক এবং সামাজিক বিপদসমূহ – বিশেষত মনুষ্য-ভাষা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মনুষ্য-চিন্তার ওপর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ কায়েমের প্রচেষ্টা।
উপন্যাসের মূল চরিত্র উইনস্টন স্মিথ শাসক-পার্টি ‘ইংলিশ সোশ্যালিজম’ বা ‘ইংসক’-এর নিচু স্তরের সদস্য। যেখানেই তিনি যান, পার্টি তাঁর ওপর টেলিপর্দার মাধ্যমে নজরদারি করতে থাকে – এমনকি নিজের বাসাতেও। যেদিকেই তিনি তাকান, দেখতে পান পার্টির সর্বত্র বিরাজমান, সর্বজ্ঞ নেতাকে – বিশাল বিশাল টেলিপর্দায়, বিরাটকায় সব পোস্টারে – সবার কাছে যিনি শুধু ‘বিগ ব্রাদার’ হিসেবে পরিচিত। (এ অবস্থা শুধু উইনস্টনের নয়। ওশেনিয়ায় মোট মানুষের ১৯ শতাংশ পার্টির সদস্য। এঁদের মধ্যে ১৮ শতাংশই বহিঃপার্টির সদস্য, আর বাকি এক শতাংশ অন্তঃপার্টির সদস্য। এই অন্তঃপার্টির সদস্যরাই আসল ক্ষমতাধর। পার্টি বলতে মূলত এঁদেরকেই বোঝায়। এঁরা বহিঃপার্টির সমস্ত সদস্যকে নজরদারিতে রাখেন। আর পার্টির বাইরেকার ৮১ শতাংশ লোক হচ্ছে প্রোল – প্রলেতারিয়েত – স্রেফ দাস। প্রোলরা ওশেনিয়ায় মানুষপদবাচ্যই নন। প্রোলদের তুলনায় বহিঃপার্টির সদস্যরা রীতিমতো সুবিধাভোগী, তা বলাই বাহুল্য।) সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করে পার্টি – ইতিহাস, ভাষা এবং চিন্তাকেও। এমনকি চিন্তার মধ্যে বিদ্রোহ নিয়ে ভাবাও বেআইনী। সমস্ত অপরাধের মধ্যে সবচাইতে বড় অপরাধ হলো ‘চিন্তাপরাধ’। ‘চিন্তাপরাধ’ দমন করার জন্য ওশেনিয়ার সর্বত্র আছে ‘চিন্তাপুলিশ’।
বেআইনী ডায়েরি এবং মিনিস্ট্রি অফ ট্রুথ
উপন্যাসের শুরুতেই আমরা ওশেনিয়ায় পার্টির নিবর্তন এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণের ফলে উইনস্টনকে হতাশ অবস্থায় পাই। স্বাধীন চিন্তা, যৌনতা এবং ব্যক্তিত্ব সেখানে নিষিদ্ধ করেছে পার্টি। উইনস্টন তাই অপছন্দ করেন পার্টিকে। বেআইনীভাবে তিনি একটি ডায়েরি কেনেন। সেখানে তিনি তাঁর অপরাধমূলক ভাবনাচিন্তা লিখে রাখতে শুরু করেন। ও’ব্রায়ান নামের ক্ষমতাবান এক পার্টিসদস্যের সাথে তিনি খাতিরও পাতান। উইনস্টনের বিশ্বাস, ও’ব্রায়ান আসলে ‘ব্রাদারহুড’ নামের রহস্যময় এক গুপ্ত সংগঠনের গোপন সদস্য। এই সংগঠনের লক্ষ্য পার্টিকে উৎখাত করা। এরকম কোনো সংগঠন আসলেই আছে কিনা সেটা কেউ জানে না। লোকমুখেই শুধু শোনা যায় এর কথা।
উইনস্টন কাজ করেন ‘মিনিস্ট্রি অফ ট্রুথ’ বা ‘সত্য সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়’-এ। সেখানে তাঁর কাজ হলো, পার্টির চাহিদামতো ঐতিহাসিক দলিলপত্র বদলে ফেলা। সেখানে তিনি কৃষ্ণকেশী এক নারী-সহকর্মীর দেখা পান, যিনি বারবার তাকাতে থাকেন উইনস্টনের দিকে। রীতিমতো উদ্দেশ্যপূর্ণ সেই চাহনি। উইনস্টনের দুশ্চিন্তা হতে থাকে – এ হয়ত পার্টিরই গুপ্তচর, নিশ্চয়ই এ তাঁকে তাঁর চিন্তাপরাধের জন্য পার্টির কাছে ধরিয়ে দেবে। ইতিহাসের ওপর পার্টির নিয়ন্ত্রণ নিয়েও বিচলিত বোধ করেন উইনস্টন। পার্টির দাবি, ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওশেনিয়া সব সময় ইস্টেশিয়ার মিত্র ছিল। কিন্তু উইনস্টন এমন একটা সময়ের কথা মনে করতে পারে যখন এ কথা সত্য ছিল না। পার্টি আরো দাবি করে, ব্রাদারহুডের তথাকথিত নেতা ইম্যানুয়েল গোল্ডস্টেইন ওশেনিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক জীবিত ব্যক্তি। উইনস্টনের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। তাঁর সন্ধ্যাগুলো সাধারণত তিনি শহরতলীর দরিদ্রতম এলাকাগুলোতে হাঁটাহাটিঁ করে কাটিয়ে থাকেন, যেখানে অত্যন্ত পুঁতিগন্ধময় পরিবেশে বাস করে প্রলেতারিয়েত বা ‘প্রোল’রা। পার্টি-নজরদারির হাত থেকে তুলনামূলকভাবে এরা মুক্ত। ওশেনিয়ায় প্রোল আর পশুরাই শুধু স্বাধীন।
কৃষ্ণকেশী সেই নারী-সহকর্মীর কাছ থেকে এক দিন ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’ লেখা একটা চিরকূট পান উইনস্টন। উইনস্টনকে তিনি জানান, তাঁর নাম জুলিয়া। পার্টি-নজরদারিকে ফাঁকি দিয়ে দিয়ে তাঁদের একটা গোপন সম্পর্ক শুরু হয়। এক সময় তাঁরা প্রোল-এলাকায় পুরোনো জিনিসপত্রের এক দোকানের ওপরকার একটা ঘর ভাড়া নেন, যেখান থেকে সেই ডায়েরিটা কিনেছিলেন উইনস্টন। তীব্র প্রেমের এই সম্পর্কটা চলতে থাকে। নিশ্চিভাবেই উইনস্টন জানতেন, আজ হোক কাল হোক একদিন ঠিক তাঁরা ধরা পড়ে যাবেন এবং তাঁদের শাস্তি হবে। নিয়তিবাদী উইনস্টন জানতেন, যেদিন তিনি সেই ডায়েরিতে প্রথম লিখেছেন সেদিনই তাঁর নিয়তি নির্ধারিত হয়ে গেছে, ধ্বংস তাঁর অনিবার্য। জুলিয়া অবশ্য অধিকতর বাস্তববাদী এবং আশাবাদী। জুলিয়ার সাথে তাঁর সম্পর্ক যত এগুতে থাকে, পার্টির প্রতি তাঁর ঘৃণা ততই বাড়তে থাকে। অবশেষে তিনি সেই বার্তাটি পান যার জন্য তিনি অপেক্ষায় ছিলেন: ও’ব্রায়ান তাঁকে দেখা করতে বলেছেন।
ও’ব্রায়ানের অ্যাপার্টমেন্টে যান উইনস্টন আর জুলিয়া। উইনস্টন তো স্রেফ বহিঃপার্টির সদস্য – আর ক্ষমতাশালী অন্তঃপার্টির সদস্য হিসেবে ও’ব্রায়ান এমন বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন উইনস্টন যার কল্পনাই করতে পারেন শুধু। উইনস্টন আর জুলিয়াকে ও’ব্রায়ান আশ্বস্ত করেন যে, তাদেঁর মতো তিনিও পার্টিকে ঘৃণা করেন এবং ব্রাদারহুডের সদস্য হিসেবে আসলে তিনি পার্টির বিরুদ্ধেই কাজ করেন। উইনস্টন আর জুলিয়াকে তিনি ব্রাদারহুডের দীক্ষা দেন এবং পড়তে দেন ইম্যানুয়েল গোল্ডস্টেইনের বই – ‘ব্রাদ্রারহুডের ইশতেহার’। ভাড়া করা সেই ঘরে উইনস্টন বইটা পড়ে শোনাতে থাকেন জুলিয়াকে। বইটা বিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন ধরনের শ্রেণীভিত্তিক সামাজিক তত্ত্বের সংমিশ্রণ জাতীয় একটা জিনিস। হঠাৎ হুড়মুড় করে সৈন্যরা এসে ঢুকে পড়ে সেই ঘরে এবং তাঁদেরকে ধরে নিয়ে যায়। পুরোনো ঐ দোকানটার মালিক জনাব চ্যারিংটন আসলে চিন্তাপুলিশের সদস্য ছিলেন – আগাগোড়া।
বিগ ব্রাদারের প্রতি ভালোবাসা
জুলিয়ার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে উইনস্টনকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় যার নাম ‘ভালোবাসা সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়’। সেখানে তিনি দেখতে পান ও’ব্রায়ানও আসলে পার্টিরই গুপ্তচর। ব্রাদারহুড-সদস্য হওয়ার ভাব ধরাটা ছিল স্রেফ একটা অভিনয়। তিনি আসলে ফাঁদ পেতেছিলেন যেন পার্টির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহী তৎপরতা চালানোর দায়ে উইনস্টনকে একদম হাতেনাতে ধরা যায়। এবার তাঁকে নির্যাতন করা এবং তাঁর মগজধোলাই করার পেছনে মাসের পর মাস ব্যয় করেন ও’ব্রায়ান। আর প্রতিরোধ করার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে থাকেন উইনস্টন। ও’ব্রায়ান আগাগোড়াই চাইছিলেন উইনস্টন যেন মন থেকে জুলিয়াকে ছেড়ে দেন, কেননা প্রেম-ভালোবাসা-যৌনতা পার্টির কাছে অতিবিপজ্জনক এবং নিষিদ্ধ বস্তু। কিন্তু কিছুতেই মন থেকে জুলিয়াকে মুছে দিতে রাজি হন না উইনস্টন – স্রেফ অকল্পনীয় শারিরীক নির্যাতনেও না। অবশেষে ও’ব্রায়ান তাঁকে ভয়ঙ্কর কক্ষ নং ১০১ এ পাঠিয়ে দেন। এটাই হচ্ছে পার্টিবিরোধীদের আখেরি পরিণাম। ও’ব্রায়ান বলেন, এখানে তাঁকে তাঁর নিকৃষ্টতম ভয়কে মোকাবেলা করতে বাধ্য করা হবে। পুরো উপন্যাস জুড়ে উইনস্টন উপর্যুপরি দুঃস্বপ্ন দেখেন ইঁদুরের। ও’ব্রায়ান তাঁর মাথার সাথে ইঁদুরভর্তি একটা খাঁচা বেঁধে দেন এমনভাবে যেন ইঁদুরগুলো তাঁর মুখমণ্ডল খেয়ে ফেলতে পারে। এবার সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েন উইনস্টন। কাকুতিমিনতি করতে থাকেন – এই কাজ জুলিয়ার সাথে করা হোক, তাঁর সাথে নয়।
এখন মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়া অবস্থায় উইনস্টনকে মুক্তি দেওয়া হয়। জুলিয়ার সাথে তাঁর দেখা হয়, কিন্তু তিনি আর মেয়েটার প্রতি কোনো টান অনুভব করেন না। পার্টিকে এখন তিনি সম্পূর্ণত গ্রহণ করে নিয়েছেন এবং বিগ ব্রাদারকে ভালোবাসতে শিখেছেন। এখানেই শেষ হয় উপন্যাস।
নয়া-জবান, দ্বৈতচিন্তা, অর্থোডক্সি
এবার আসি অর্থোডক্সির প্রশ্নে, চিন্তার প্রয়োজন না পড়ার প্রশ্নে, চিন্তা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার প্রশ্নে – যা দিয়ে আমরা আলাপ শুরু করেছি। ঠিক কী বলছিলেন তিনি? উপন্যাসে এ প্রশ্নটা উঠেছিল সমস্ত মানুষের চিন্তাদাসত্ব সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ওশেনিয়ার পার্টি কর্তৃক সম্পূর্ণ নতুন এক ভাষারীতি চালু করার ব্যাপার নিয়ে। উপন্যাসের ঘটনাকাল ১৯৮৪ সাল নাগাদ পার্টি সিদ্ধান্ত নেয় তাদের নিজেদের উদ্ভাবন-করা ভাষারীতি চালু করার। ‘নয়া-জবান’ হিসেবে আখ্যায়িত নতুন এই ভাষারীতির লক্ষ্য এমন সব আগাম ব্যবস্থা করা যাতে করে সমাজে কোনো প্রকার বিদ্রোহ হতে না পারে। মানুষ যেন বিদ্রোহের চিন্তাও না করতে পারে। এই লক্ষ্যে বিদ্রোহ, স্বাধীনতা, অধিকার ইত্যাদি যাবতীয় শব্দ উৎপাটন করার মাধ্যমে শুরু হয় নয়া-জবান প্রণয়নের কাজ। পুরোনো ভাষারীতি বা আদি জবান ছিল প্রমিত ইংরেজি ভাষা। আর নয়া-জবান হচ্ছে ওশেনিয়ার সরকারী ভাষা – রাষ্ট্র অনুমোদিত একমাত্র ভাষা। নয়া-জবানই হচ্ছে ইংসক, আর ইংসক হচ্ছে নয়া-জবান।
এর প্রথম কথাই হচ্ছে ‘দ্বৈতচিন্তা’। পার্টির চাপিয়ে দেওয়া মিথ্যাকে যদি সবাই মেনে নেয়, সমস্ত দলিলপত্র যদি একই কেচ্ছা গাইতে থাকে, তাহলে সেই মিথ্যা ইতিহাসে ঢুকে পড়ে এবং সত্যে পরিণত হয়। এ সম্পর্কে পার্টির স্লোগান হলো, অতীতকে যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন, ভবিষ্যৎকে তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করেন, আর বর্তমানকে যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন, অতীতকেও তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন। ঘটনা হচ্ছে, এত দিন পর্যন্ত যা সত্য ছিল, অন্তহীনকাল থেকেই তা সত্য বলে পরিগণিত ছিল। ব্যাপারটা এরকমই সহজসরল ছিল। আর এখন যা দরকার পড়ল তা হচ্ছে মানুষের স্মৃতির ওপর দিয়ে একের পর একের এক দখলদারিত্বের অনন্ত স্রোত বইয়ে দেওয়া। একেই তাঁরা বলেন ‘বাস্তবতা-নিয়ন্ত্রণ’, নয়া-জবানে বললে এটাই ‘দ্বৈতচিন্তা’।
এ জিনিস প্রথম চালু হয় পার্টির পত্রপত্রিকা-মিডিয়ায়। অচিরেই পার্টির ভাষা-বিশেষজ্ঞরা নয়া-জবানের অতিকায় সব অভিধান রচনা করতে শুরু করেন। একের পর এক সংস্করণ ছাপা হতে থাকে সেসব অভিধানের। নয়া-জবান হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র ভাষা প্রতি বছর যার শব্দসংখ্যা কমতে থাকে, কেননা এর লক্ষ্য হচ্ছে চিন্তার পরিসরকে সংকীর্ণ করে আনতে থাকা, চিন্তাপরাধকে অসম্ভব করে তোলা। এর লক্ষ্য নিজেকে ক্রমশ এমন এক স্তরে উন্নীত করা যাতে করে চিন্তাপরাধকে প্রকাশ করার মতো শব্দই খুঁজে পাওয়া না যায়। নতুন এই ভাষারীতি যখন খাঁটি পূর্ণাঙ্গতা লাভ করবে কেবল তখনই সম্পূর্ণ হয়ে উঠবে পার্টির বিপ্লব। নয়া-জবানের দুর্দান্ত নমুনা পাওয়া যাবে খোদ পার্টির একেবারে মূল তিনটা স্লোগানে, বিশাল বিশাল হরফে যা খোদাই করা আছে সত্য সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের গায়ে। স্লোগান তিনটা হচ্ছে: যুদ্ধই শান্তি / দাসত্বই স্বাধীনতা / অজ্ঞতাই শক্তি।
এসব স্লোগানেই ফুটে ওঠে নয়া-জবানের মূল বৈশিষ্ট্য। এ রকম আরো নমুনা পাওয়া যায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নামকরণে। যে মন্ত্রণালয়ের কাজ পার্টির চাহিদা মোতাবেক ইতিহাসের সত্যকে প্রণালীবদ্ধভাবে, সুবিশাল আয়োজনসহকারে, নস্যাৎ করা, তার নাম ‘সত্য সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়’। যেমন, যে মন্ত্রণালয়ের কাজ আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার নামে সন্দেহভাজন ব্যক্তিবর্গকে অমানুষিক নিপীড়ন করা, তার নাম ‘ভালোবাসা সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়’। যে মানুষ স্বভাবতই অর্থোডক্স বা এমন গোঁড়া রকমের গতানুগতিক যে, ‘খারাপ চিন্তা’ করতেই অক্ষম, নয়া- জবানে তাকে বলে ‘শুভচিন্তাসম্পন্ন’ মানুষ।
তো, সাইম নামে উইনস্টনের পরিচিত এক লোক, যিনি নয়া-জবান বিষয়ক অভিধানের একাদশ সংস্করণের বিশেষজ্ঞ-বুদ্ধিজীবী, একদিন কথায় কথায় তাঁকে বলছিলেন, ‘তুমি কি কখনো ভেবে দেখেছ উইনস্টন, আমরা এখন যে ভাষায় [অর্থাৎ আদি জবানে] কথা বলছি আগামী এক শ বছরের মধ্যে সে ভাষা বোঝার মতো কোনো লোক আর বেঁচে থাকবে না? – শুধুমাত্র প্রোলরা ছাড়া’, এবং যেন কিছুই না এমন একটা ভঙ্গিতে যোগ করেন সাইম, ‘প্রোলরা মানুষ নয়’। তার মানে, সাইম বলতে থাকেন,
২০৫০ সালের মধ্যে, অথবা সম্ভবত তার আগেই, পুরোনো ভাষারীতির সমস্ত সত্য-জ্ঞান হারিয়ে যাবে। অতীতের সমস্ত সাহিত্য ধ্বংস করে দেওয়া হবে। চসার, শেক্সপিয়ার, মিল্টন, বায়রন – এদের অস্তিত্ব থাকবে শুধু নয়া-জবানের সংস্করণে। এদেরকে পরিবর্তিত করে যে স্রেফ আলাদা কিছুতে পরিণত করা হবে তা নয় – এমনভাবে বদলানো হবে যে তাঁরা আগে যা ছিলেন তার উল্টা জিনিসে পরিণত হবেন। এমনকি পার্টি-সাহিত্যও বদলে যাবে। বদলে যাবে এমনকি স্লোগানগুলোও। স্বাধীনতার ধারণাই যখন বিলুপ্ত হয়ে যাবে তখন তুমি এমন স্লোগান কোত্থেকে পাবে যে ‘দাসত্বই স্বাধীনতা’? চিন্তার পুরো বাতাবরণটাই আলাদা হয়ে যাবে। চিন্তা বলতে এখন আমরা যা বুঝি সেই অর্থে চিন্তা বলে কিছুই আর থাকবে না আসলে। গোঁড়ামি মানে চিন্তা না করা – চিন্তার প্রয়োজনই না পড়া। গোঁড়ামি হলো অচেতনতা।
এভাবেই তুলেছিলেন অরওয়েল অর্থোডক্সি সংক্রান্ত আমাদের আদি প্রশ্নটা, অর্থাৎ চিন্তার প্রয়োজন না পড়ার, তথা চিন্তা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার প্রশ্নটা। তো, আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশের মুক্তচিন্তা ও মুক্তপ্রকাশের অধিকার, শিক্ষায়তনিক স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়ের সাথে অরওয়েলের আলোচিত এই অর্থোডক্সি বা চিন্তাহীন গতানুগতিকতার সম্পর্ক কোথায়?
আজকের যুগে বাস্তবতা নিয়ন্ত্রণ
একটা বিষয় তো ইতোমধ্যেই পরিষ্কার, যে বাস্তবতা তথা বাস্তবতা-নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অরওয়েল চিন্তিত ছিলেন, সেই বাস্তবতা আজকের দুনিয়ারই বাস্তবতা। ফ্র্যাংকো-স্তালিন-হিটলার আজ নেই ঠিকই, বলশেভিকদের জগৎজোড়া সাম্রাজ্য হাওয়া মিলিয়ে গেছে তাও ঠিক, কিন্তু মার্কিন কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ এবং দুনিয়াব্যাপী কর্তৃত্বপরায়ণ চিন্তনের প্রাবল্য অরওয়েলের উদ্ভাবিত শব্দমালা ও উদ্ধৃতিরাজিকে আজকের সমাজের সাধারণ জ্ঞানে পরিণত করেছে। তাঁর অনেক শব্দই আজকের ইংরেজি ভাষার অভিধানের শব্দ এবং তাতে উল্লেখ থাকে যে এটি জর্জ অরওয়েলের বানানো শব্দ। যেমন, দ্বৈতচিন্তা বা ‘ডাবলথিংক’ শব্দটা। মাইক্রোসফট কর্পোরেশনের এনকার্টা রেফারেন্স লাইব্রেরির ২০০৪ সালের এনকার্টা-
অভিধানে এর অর্থ ‘পরস্পর-বিপরীত দুটো বিশ্বাসকে একই সাথে সঠিক বলে গ্রহণ করা’। আমাদের আজকের পরিচিত পৃথিবীর সর্বত্রই কি আমরা এই জিনিসের অস্তিত্ব দেখছি না?
আবার ধরা যাক নয়া-জবান বা ‘নিউস্পিক’ শব্দটা। অরওয়েলের বরাত দিয়ে ঐ একই অভিধান এর অর্থ ‘দ্ব্যর্থবোধক ভাষা’ বলে সাব্যস্ত করেছে, ‘এমন ভাষা যা দ্ব্যর্থবোধক এবং সত্য গোপন করার মতো করে বানানো, বিশেষত মাঝেমধ্যে আমলাবর্গ এবং প্রচারণাবিশারদেরা যা ব্যবহার করে থাকেন’। আজকের মার্কিন মন্ত্রীরা স্বাধীন রাষ্ট্র ইরাক দখল করার সময় যখন বলেন তাঁরা ইরাকীদের মুক্ত করার জন্য এসেছেন; কিংবা যখন তাঁদের ‘নিখুঁত’ বোমাবর্ষণে নিহত বেসামরিক ব্যক্তিদের কথা বলার সময় তাঁরা ব্যবহার করেন ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ বা ‘পারস্পরিক ক্ষতি’র মতো শব্দমালা; অথবা যখন আমাদের দেশের পুলিশ প্রভৃতি বাহিনী কর্তৃক নির্বিচারে বলপ্রয়োগ করার পর তার নাম দেওয়া হয় ‘সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা’ কিংবা নিরীহ লোকজনের ‘জানমাল রক্ষা’র চেষ্টা; কিংবা যখন আমাদের বিশেষ সরকারী বাহিনী মানুষজনকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে, ঠাণ্ডা মাথায় তুলে নিয়ে গিয়ে পূর্বনির্ধারিত স্থানে নেহাৎ একতরফাভাবে খুন করে তার নাম দেয় ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘এনকাউন্টার’ বা ‘গুলিবিনিময়’ এবং এরকম রাষ্ট্রীয় বিধি-বন্দোবস্তের নাম দেওয়া হয় ‘আইনের শাসন’; কিংবা যখন কতিপয় ব্যক্তিবর্গের গণ
-স্বার্থবিরোধী শাসনব্যবস্থাকে বলা হয় ‘গণতন্ত্র’; অথবা যখন সমাজের একেবারে ওপরতলার বড়লোকদের একচ্ছত্র শাসনক্ষমতাকে বলা হয় ‘জনগণের সরকার’; অথবা যখন অসহায় সমাজবিড়ম্বিত নারী বা শিশুকে পুলিশ বা ঐ জাতীয় কর্তৃপক্ষের অধীনস্ত অমানবিক, দুর্দশাপূর্ণ কোনো স্থানে দিনের পর দিন অনিশ্চিত অবস্থায় ফেলে রাখাকে খোদ আদালত বলেন ‘নিরাপত্তা হেফাজত’-এ রাখা; অথবা যখন রাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন বা পুলিশ কর্তৃক আইনী অনুমতি সাপেক্ষে নিদারুণ নির্যাতনকে ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ বলা হয়, তখন আমাদের অরওয়েল-কথিত নয়া-জবান আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। আসলে সর্বকালের সর্বস্থানের কর্তৃত্বতন্ত্র অরওয়েল-বর্ণিত এই নয়া-জবানেই কথা বলে এসেছে।
ঘৃণার পতাকা
হাজার হোক, আমরা তো আজকে ঘৃণাকেই সর্বদলীয়-সর্বজনীন মনুষ্যধর্মের ধ্বজায় পরিণত করেছি আমাদের রক্তের দামে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং তার সর্বপ্রকার পার্টি, মিডিয়া, রাজ-বুদ্ধিজীবীদের কল্যাণে, তাই না? এই পরিপ্রেক্ষিতে জর্জ অরওয়েল আমাদেরকে একটু কাঁদাতেও পারতে পারেন হয়ত। ‘তোমার দ্বেষ, আমার দ্বেষ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’-এ মানুষ তো আজকে কাঁদতে ভুলে গেছে। ঘেন্নাঘাটির ভ্যাপসা গরমে কান্না গেছে শুকিয়ে।
অনলাইন প্রাইম খবর, ৬ই মার্চ ২০১৩