ইস্ক্রা
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ভর্তি হই একটা চুক্তির মাধ্যমে। এই চুক্তি অনুযায়ী যে শিক্ষার্থী তারা ভর্তি করে তাকে যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করে নেয়া হয়। আর স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষের শর্ত থাকে যে তারা শিক্ষার্থীকে ‘শেখাবেন’। এমন কোনো শর্ত থাকে না যে তারা ‘কম্পিটিশন’ তৈরি করবেন, শিক্ষার্থীদের মাঝে ডিসক্রিমিনেশন তৈরি করবেন। বরং,সকল শিক্ষার্থীকে তারা সমানভাবে দেখবেন এইটাই কন্ডিশনালি এবং মরালি তাদের কর্তব্য। অথচ, স্কুল-কলেজে প্রথম দিনটি থেকেই ‘রোল কল’ এর মাধ্যমেই শুরু হয় ডিসক্রিমিনেশন। তথাকথিত এই ‘রোল কল প্রোফাইলিং’ তা সে ভর্তিক্রম অনুযায়ীই হোক বা মেধাক্রম অনুযায়ীই হোক, যে ব্যাপারটি সকলের নজর এড়িয়ে যায় তা হল, এটি শিক্ষার্থীদের মনোজগতে প্রভাব ফেলে, কম্পিটিটিভ মনোভাব তৈরি করে, একে অপরের প্রতি সুপ্ত বা প্রকাশ্য শত্রুতা সৃষ্টি করে।
রোল নম্বর প্রোফাইলিং এর ক্ষেত্রে যুক্তিটা হল— এতে শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাসে আসছে কিনা তার হিসাব রাখা যায়; বেশ সহজ-সরল, নিরীহ একটা সিস্টেম। কিন্তু, আপাত নিরীহ, কার্যকর এই সিস্টেমটির আসলে দমনমূলক এবং বৈষম্যপূর্ণ চরিত্র আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যত বড় হয়, নিয়মিত ক্লাসে আসা না আসার এই বিষয়টি শিক্ষকদের কাছে একরকম ইগোতে পরিণত হয়। রোল কলিং এর হিসাব রেখে শিক্ষার্থীকে ক্লাসমুখী করার জন্য আবার কখনো কখনো বেঁধে দেওয়া হয় বিশেষ নম্বর। অথচ, যে শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাসে আসে না সেইটার সবচেয়ে কমন কারণ হতে পারে সে ক্লাসকে বন্ধুত্বপূর্ণ, স্বস্তিদায়ক স্থান মনে করতে পারছে না,স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান মনে করতে পারছে না। অথচ, এই সমস্যাটিও সকলের নজর এড়িয়ে যায়, কারণ, কর্তৃপক্ষ সবসময়ই দণ্ডনীতির পূজারি। তাই, ক্লাস সিস্টেম সংস্কারের চেয়ে ঘাড় ধরে শিক্ষার্থীকে ক্লাসমুখি করার জন্য কর্তৃপক্ষের পীড়ণমূলক নীতিকেই প্রয়োগ করতে দেখা যায়। ক্লাসরুম থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থা,পরিবার থেকে সমাজ সর্বত্রই কর্তৃপক্ষের হুকুমদারির এই যে শাসন— তা সবসময়ই ব্যক্তি স্বাধীনতার অন্তরায়।
ক্লাসরুম ভাল লাগে না, টিচারের বকবক ভাল লাগে না, পরীক্ষা ভাল লাগে না — এইরকম অভিযোগ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে কমন। আমি এগুলোকে অভিযোগের চেয়ে একেকটি ছোট ছোট বিদ্রোহ বলব। এইসব বিদ্রোহের স্বরূপ প্রকাশ পায় আড়ালে টিচারকে গালিগালাজ করা, পরীক্ষা নিয়ে ভয়ে থাকা, রেজাল্টের জন্য বন্ধুর সঙ্গে প্রকাশ্য অথবা শীতল কম্পিটিশন ইত্যাদির মধ্যদিয়ে।
কম্পিটিশন কখনো বিদ্যাকে অর্জন করতে শেখায় না, গলধঃকরণ করতে শেখায়। এই কম্পিটিশন যুক্তি, বিজ্ঞানমনষ্কতা, দর্শন কোনোকিছুরই উন্মেষ ঘটায় না। বস্তুত, মানুষ যা কিছু শেখে এবং যতটুকু শেখে তা একদম স্বেচ্ছায়। কারও সাথে তুলনা করা শেখার উদ্দেশ্য নয়, বস্তুত, কোনোকিছু শেখার পেছনে কোনো ধরণের উদ্দেশ্যই থাকে না। শিখন প্রক্রিয়ায় যখনই উদ্দেশ্য ঢুকে পড়ে তখনই তা গলধঃকরণ প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিখন প্রক্রিয়ার গলধঃকরণ করানোর এই প্রচেষ্টা সম্পর্কে বলেছেন –
ভাণ্ডারঘর যেমন করিয়া আহার্য দ্রব্য সঞ্চয় করে আমরা তেমনি করিয়াই শিক্ষা সঞ্চয় করিতেছি, দেহ যেমন করিয়া আহার্য গ্রহণ করে তেমন করিয়া নহে। ভাণ্ডারঘর যাহা-কিছু পায় হিসাব মিলাইয়া সাবধানে তাহার প্রত্যেক কণাটিকে রাখিবার চেষ্টা করে। দেহ যাহা পায় তাহা রাখিবার জন্য নহে, তাহাকে অঙ্গীকৃত করিবার জন্য। তাহা গোরুর গাড়ির মতো ভাড়া খাটিয়া বাহিরে বহন করিবার জন্য নহে, তাহাকে অন্তরে রূপান্তরিত করিয়া রক্তে মাংসে স্বাস্থ্যে শক্তিতে পরিণত করিবার জন্য। আজ আমাদের মুশকিল হইয়াছে এই যে, এই এত বছরের নোটবুকের বস্তা-ভরা শিক্ষার মাল লইয়া আজ আমাদের গোরুর গাড়িও বাহিরে তেমন করিয় ভাড়া খাটিতেছে না, অথচ সেটাকে মনের আনন্দে দিব্য পাক করিয়া ও পরিপাক করিয়া পেট ভরাই সে ব্যবস্থাও কোথাও নাই। তাই আমাদের বাহিরের থলিটাও রহিল ফাঁকা, অন্তরের পাকযন্ত্রটাও রহিল উপবাসী।১
প্রমথ চৌধুরী ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে বলেছিলেন:
আমাদের ধারণা শিক্ষা আমাদের গায়ের জ্বালা চোখের জল দুই ই দূর কর করবে। এ আশা সম্ভবত দুরাশা। তবুও আমরা সম্মুখে কোন সদুপায় খুঁজে পাইনা।২
আবার, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের পড়াশোনায় ‘স্পেশালাইজেশন’ কেমন করে আমাদের সীমাবদ্ধ করে ফেলছে সে ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ মত দিয়েছেন। সেটি এখানে তুলে দিচ্ছি –
হুমায়ুন আজাদ: বাঙলাদেশে জ্ঞানচর্চার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনার ধারণা?
আহমদ শরীফ: বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে একটি ক্ষতিকর ব্যাপার ঘটে গেছে। ছাত্র অবস্থা থেকেই শুরু। স্পেশিয়ালাইজেশন দিয়ে জ্ঞান হয় না, পটভূমি দরকার। তাই পাঠ্যবিষয়ের বাইরের জ্ঞান দরকার। আমাদের এখানে এখন তার ব্যবস্থা নেই। ফলে জ্ঞানের ভিত্তি তৈরি হচ্ছে না, খাড়া হয়ে উঠছে। একটি ডক্টরেট করে জ্ঞানী হয়ে যাচ্ছে, আর কোনো লেখাপড়া করছে না। এমন মানুষের দ্বারা জ্ঞানের চর্চা হতে পারে না। জ্ঞানী মানুষ হওয়ার পথে আমাদের দেশে বাধা সৃষ্টি হয়েছে।৩
ড. আহমদ শরীফ তাঁর বক্তব্যের সর্বশেষ লাইনে সম্পূর্ণ বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছেন। জ্ঞানী মানুষ, স্বাধীন মানুষ হওয়ার পথে আমাদের দেশে বাধা সৃষ্টি হয়েছে, অর্থ্যাৎ, জ্ঞানার্জনে শিক্ষার্থীর আগ্রহ নিজে নিজে কমে যায়নি, বরং, আগ্রহ কমিয়ে ফেলেছে রাষ্ট্রপ্রণীত দমনমূলক, ভুলভাল শিক্ষানীতি। এই দমনমূলক, ভুলভাল নীতি কেবলমাত্র আজকের সমাজেই নয়, সুদূর এবং অদূর- সকল অতীতেই ছিল।
পাঠ্য বিষয়ের বাইরের জ্ঞান দরকার একথা রবি ঠাকুরও উপলব্ধি করেছেন বহুকাল আগেই, তিনি এও বলেছেন,বাইরের জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রের শিক্ষানীতি অর্থ্যাৎ, খোদ রাষ্ট্র। রবীন্দ্রনাথ প্রথমত শিক্ষানীতি প্রণয়নকারী কমিটির অসাড়তার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন –
কমিটি দ্বারা দেশের অনেক ভালো হইতে পারে; তেলের কল, সুরকির কল, রাজনীতি এবং বারোয়ারি পূজা কমিটির দ্বারা চালিত হইতে দেখা গিয়াছে, কিন্তু এ পর্যন্ত এ দেশে সাহিত্য সম্পর্কীয় কোনো কাজ কমিটির দ্বারা সুসম্পন্ন হইতে দেখা যায় নাই। মা সরস্বতী যখন ভাগের মা হইয়া দাঁড়ান তখন তাঁহার সদ্গতি হয় না। অতএব কমিটি-নির্বাচিত গ্রন্থগুলি যখন সর্বপ্রকার সাহিত্যরসবর্জিত হইয়া দেখা দেয় তখন কাহার দোষ দিব। আখমাড়া কলের মধ্য দিয়া যে-সকল ইক্ষুদণ্ড বাহির হইয়া আসে তাহাতে কেহ রসের প্রত্যাশা করে না; ‘সুকুমারমতি’হীনবুদ্ধি শিশুরাও নহে।
অতএব, কমিটিকে একটি অবশ্যম্ভাবী অদৃষ্টবিড়ম্বনাস্বরূপ জ্ঞান করিয়া তৎসম্বন্ধে কোনো প্রসঙ্গ উত্থাপন না করিলেও সাধারণত বিদ্যালয়ে ব্যবহার্য পুস্তকগুলিকে পাঠ্যপুস্তক-শ্রেণী হইতে বহির্ভূত করা যাইতে পারে। ব্যাকরণ, অভিধান, ভূগোলবিবরণ এবং নীতিপাঠ পৃথিবীর পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে গণ্য হইতে পারে না, তাহারা কেবলমাত্র শিক্ষাপুস্তক।৪
রবি ঠাকুর আরও বলছেন
যতটুকু অত্যাবশ্যক কেবল তাহারই মধ্যে কারারুদ্ধ হইয়া থাকা মানবজীবনের ধর্ম নহে। আমরা কিয়ৎপরিমাণে আবশ্যকশৃঙ্খলে বন্ধ হইয়া থাকি এবং কিয়ৎপরিমাণ স্বাধীন। আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সেই সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না। স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক, নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য এবং আনন্দের ব্যাঘাত হয়। শিক্ষা সম্বন্ধেও এই কথা খাটে। যতটুকু কেবলমাত্র শিক্ষা অর্থাৎ অত্যাবশ্যক তাহারই মধ্যে শিশুদিগকে একান্ত নিবদ্ধ রাখিলে কখনোই তাহাদের মন যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িতে পারে না। অত্যাবশ্যক শিক্ষার সহিত স্বাধীন পাঠ না মিশাইলে ছেলে ভালো করিয়া মানুষ হইতে পারে না—বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেও বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে সে অনেকটা পরিমাণে বালক থাকিয়াই যায়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের হাতে কিছুমাত্র সময় নাই। যত শীঘ্র পারি বিদেশীয় ভাষা শিক্ষা করিয়া পাস দিয়া কাজে প্রবিষ্ট হইতে হইবে। কাজেই শিশুকাল হইতে ঊর্ধ্বশ্বাসে দ্রুতবেগে, দক্ষিণে বামে দৃক্পাত না করিয়া পড়া মুখস্থ করিয়া যাওয়া ছাড়া আর কোনো কিছুর সময় পাওয়া যায় না। সুতরাং ছেলেদের হাতে কোনো শখের বই দেখিলেই সেটা তৎক্ষণাৎ ছিনাইয়া লইতে হয়।
শখের বই জুটিবেই বা কোথা হইতে। বাংলায় সেরূপ গ্রন্থ নাই। এক রামায়ণ মহাভারত আছে, কিন্তু ছেলেদের এমন করিয়া বাংলা শেখানো হয় না যাহাতে তাহারা আপন ইচ্ছায় ঘরে বসিয়া কোনো বাংলা কাব্যের যথার্থ স্বাদ গ্রহণ করিতে পারে। আবার দুর্ভাগারা ইংরেজিও এতটা জানে না যাহাতে ইংরেজি বাল্যগ্রন্থের মধ্যে প্রবেশ লাভ করে।৫
শিক্ষক কিংবা অভিভাবক, সকলের কাছেই বিদ্যার্জন মানেই হলো কিছু করে খাওয়ার শিক্ষা। অথচ, পথ মাত্রই অজানা। শিখন প্রক্রিয়া হলো অজানা পথকে আবিষ্কারের উপায়। অজানা পথে চলার নামই স্বাধীনতা। শিখন প্রক্রিয়ার মধ্যে উদ্দেশ্য ঢুকিয়ে ক্লাসরুম স্বাধীনতার ঠিক বিপরীত কর্মটি করে, ক্লাসরুম দেখিয়ে দেয় একটি চেনাজানা পথ, যে পথে কোনোকিছু আবিষ্কারের কিছু নাই, আছে স্বাধীনতাকে ত্যাগ করে শুধু অভ্যাসের বশ হওয়ার প্রতিযোগীতা, একে অপরকে টপকে দ্রুত গোলামি বরণের হুড়োহুড়ি – আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যারিয়ার ক্লাব, ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড লিমিটেড শিক্ষাদান, কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের সাথে হ্যাবিচুয়েটেড হওয়ার জন্য কর্মশালা, ঘরের ভিতরে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়র হবার তাড়া— এইসবই হলো ক্লাসরুমের কুফল। এক্ষেত্রেও রবি ঠাকুর স্মরণীয়:
যাহার মধ্যে জীবন নাই, আনন্দ নাই, অবকাশ নাই, নবীনতা নাই, নড়িয়া বসিবার এক তিল স্থান নাই, তাহারই অতি শুষ্ক কঠিন সংকীর্ণতার মধ্যে। ইহাতে কি সে-ছেলের কখনো মানসিক পুষ্টি, চিত্তের প্রসার, চরিত্রের বলিষ্ঠতা লাভ হইতে পারে। সে কি একপ্রকার পাণ্ডুবর্ণ রক্তহীন শীর্ণ অসম্পূর্ণ হইয়া থাকে না। সে কি বয়ঃপ্রাপ্তিকালে নিজের বুদ্ধি খাটাইয়া কিছু বাহির করিতে পারে, নিজের বল খাটাইয়া বাধা অতিক্রম করিতে পারে, নিজের স্বাভাবিক তেজে মস্তক উন্নত করিয়া রাখিতে পারে। সে কি কেবল মুখস্থ করিতে, নকল করি এবং গোলামি করিতে শেখে না।৬
বলাই বাহুল্য, স্বাধীনতা হীনতাই গোলামি। কর্তৃপক্ষ খুব ভালোমতোই ওয়াকিবহাল যে, জানার স্পৃহাটুকু তথা স্বাধীনসত্তাটুকু কেড়ে নিলেই হুকুমদারি আসান হয়ে যায়। সিস্টেম্যাটিক গলধঃকরণ ফর্মুলাটি গেলাতে পারলেই একেকটি মগজ ধোলাইকৃত কামলা-রোবট তৈরি করা যায়। এদের চোখ-কান-মুখ থাকে বন্ধ এবং মন থাকে কর্তৃত্বতন্ত্রকে আবৃত করে রাখা চাকচিক্যের প্রতি মোহাবিষ্ট। এতে কর্তৃপক্ষের মাতব্বরি আসান হয়ে যায় এবং অভিভাবকের চোখের জল দূর না হলেও গায়ের জ্বালাটুকু মেটে।
ক্লাসরুমে বুঝতে না পেরেও চক্ষুলজ্জায় বা ভয়ে তা প্রকাশ না করাও শিক্ষার্থীদের একটা অতি সাধারণ সমস্যা। এই প্রশ্ন করার হিম্মত যোগানোর ব্যর্থতার দায় ক্লাসরুমের, স্বাধীনতার এই বিপন্নতার দায়ও ক্লাসরুমেরই। এটা এমন একটা জড় স্থান যেখানে সবাই টিচার নামক কর্তৃপক্ষের হুকুম, ইচ্ছা-অনিচ্ছার অধীন ও দয়া প্রত্যাশী। পুরো বিষয়টি একদমই স্বাধীন নয়; চরমভাবে পরাধীন, অবন্ধুসুলভ এবং অস্বস্তিকর। ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবেই এই বিষয়ে বলেছেন:
বাঙালির ছেলের মতো এমন হতভাগ্য আর কেহ নাই। অন্য দেশের ছেলেরা যে-বয়সে নবোদগত দন্তে আনন্দমনে ইক্ষু চর্বণ করিতেছে, বাঙালির ছেলে তখন ইস্কুলের বেঞ্চির উপর কোঁচাসমেত দুইখানি শীর্ণ খর্ব চরণ দোদুল্যমান করিয়া শুদ্ধমাত্র বেত হজম করিতেছে, মাস্টারের কটু গালি ছাড়া তাহাতে আর কোনোরূপ মসলা মিশানো নাই।৭
আজ থেকে প্রায় শ’খানেক বছর আগের পরিস্থিতি থেকে বর্তমান পরিস্থিতি এতোটুকুও পরিবর্তন হয়নি। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কটি যুগ যুগ ধরে কর্তৃপক্ষ এমন একটা জায়গায় গিয়েছে যেখানে বন্ধুত্বের চেয়ে আবেগ বেশী, শেখানোর ইচ্ছার চেয়ে আদব-কেতা, সম্মান ও ভয় বেশী। এইসমস্ত “সম্মানীয় আবেগ” ও “মহামান্য ভয়” শিখন প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত দূরে ঠেলে দেয়। তার বদলে শিক্ষকের সম্মান, শিক্ষককে ভয় ইত্যাদি নীতিবাক্যমূলক বিষয়াদি অনেকটা শিক্ষার্থীর মনকে ব্লাকমেইল করে ফেলে। ফলে, শিক্ষক হয়ে যান অত্যন্ত দূরের মানুষ নতুবা বিদ্রোহীদের কাছে অপ্রিয় ব্যক্তি যা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার।
আবার, কর্তৃত্বতন্ত্রের ভিতরেই থাকে ছোট ছোট কর্তৃত্বতন্ত্র। যেমন, রাষ্ট্রের ভিতরে থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও হয়ে ওঠে কর্তৃপক্ষ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটা ছোট্টক্লাসরুমও শিক্ষার্থীদের উপর কর্তৃত্বপরায়ন হয়ে উঠে। সেই ছোট্ট ক্লাসরুমেরই আরও ছোট বাসিন্দা ছাত্ররাও পর্যন্ত হয়ে ওঠে ছাত্রীদের কর্তৃপক্ষ। আর, একচ্ছত্র কর্তৃপক্ষ শিক্ষক তো আছেনই ছাত্রীদের উপর “বিশেষ নির্যাতন” চালাতে, কিছুক্ষেত্রে তারা ছাত্রদের কর্তৃত্বপরায়ন, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবকে উস্কে দিতেও দ্বিধাবোধ করেন না। স্কুল-কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, কোথাও বাদ নেই এমন ঘটনা। রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল এন্ড কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক ও বর্তমানে শেরপুর সরকারি কলেজের প্রভাষক লোকমান কবীর এই বিষয়ে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা আমাকে জানিয়েছেন ফেসবুকের মাধ্যমে। সেগুলোই হুবহু তুলে দিলাম:
আজ আমার ক্লাসে একটা সারিতে চারটি মেয়ে কথা বলছিল। আমার সমস্যা হল, কেউ কথা বললে আমি বলতে পারি না। তাই ওদের জিজ্ঞেস করলাম ওরা কি কথা বলছিল, কেন বলছিল? সাথে সাথে এক ছেলে, আামার কথা শেষ হতে না হতেই বলে ফেলল, স্যার ওদের বের করে দেন। মেয়ে বলেই ছেলেটার উৎসাহ অনেক বেশি ছিল। তখন আমি ছেলেটাকে বোঝালাম যে তার এটা বলা ঠিক হয়নি। কারণ মেয়েরা যা করেছে, এটা তারাও করে, এবং এটা একটা ভুল, কিন্তু অন্যায় নয়। আমি বসে থাকলেও হয়তো করতাম। কিন্তু আমাকে সহযোগিতা করার জন্য অপ্রয়োজনীয় কথা বলা ঠিক না। এরকম কোন বিষয় নিয়ে কোন মেয়েকে যদি অপদস্ত করা যায়, তাহলে ছেলেরা সবাই একযোগে হইহই করে উঠে।
রাজউক কলেজে থাকার সময় প্রভার স্ক্যান্ডাল বের হল। আমি একদিন টেনের একটা ক্লাসে কি একটা প্রসঙ্গে আলো অর্থে বললাম ওমুক লেখকের কর্মের প্রভা…ইত্যাদি। সাথে সাথে পুরো ক্লাসে মৃদু হাসির রোল পড়লো। এটাও এক ধরনের মানসিক হয়রানি।
এমন ঘটনা ব্যক্তিগতভাবে আমিও অসংখ্যবার দেখেছি। গত পরশুদিনের একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
গত পরশু (৭.৯.২০১৩) স্যার মুসলিম ল’র সাকসেশনের একটা চার্ট বুঝাচ্ছিলেন। চার্টটা স্যার অনেক দীর্ঘ করে ফেলেছিলেন (না করলেও চলত)। চার্টটা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে দেখে আমাদেরই কয়েকজন বান্ধবী বলে উঠল, আর নিচে নামবেন না, স্যার। আর ওমনি ক্লাসের একাংশের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল।
তথ্যসূত্র:
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অসন্তোষের কারণ, শিক্ষা (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধ সংকলন), তথ্যসূত্র: উইকিসংকলন
২. প্রমথ চৌধুরী, বই পড়া
৩. আহমদ শরীফ, আহমদ শরীফ: পণ্ডিত ও বয়স্ক বিদ্রোহী, সাক্ষাৎকার: হুমায়ুন আজাদ, আহমদ শরীফ স্মারক গ্রন্থ, ২০০১, সম্পাদনা: মুস্তাফা মজিদ, আফজালুল বাসার
৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিক্ষা (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধ সংকলন)
৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিক্ষা (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধ সংকলন)
৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিক্ষা (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধ সংকলন)
৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিক্ষা (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধ সংকলন)