- শ্রীমানী চাকমা
এই লেখাটি সিএইটি নিউজ ব্লগে প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালের ১২ জানুয়ারি। কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনায় গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। বিচারপতি আবদুল জলিল নেতৃত্বাধীন কমিটির প্রতিবেদনের অসঙ্গতি তুলে ধরা হয়েছে লেখাটিতে। কল্পনা চাকমা অপহরণের দুই যুগ পূর্তিতে অরাজ এটি পুনপ্রকাশ করছে।
সম্প্রতি সিআইডি কল্পনা চাকমার অপহরণ বিষয়ে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করলে পাহাড়ি সংগঠনসমূহ তা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বিভিন্ন সভা সমাবেশের মাধ্যমে পুনঃতদন্তসহ চিহ্নিত অপহরণকারী লেঃ ফেরদৌস ও তার সহযোগীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি জানাচ্ছে। এর ফলে কল্পনা চাকমার অপহরণ ইস্যুটি আবার সামনে চলে এসেছে।
কল্পনা চাকমা অপহৃত হন আজ থেকে সাড়ে ষোল বছর আগে ১৯৯৬ সালের ১১ জুন রাতে রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি থানার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে। কল্পনা চাকমার ভাই লাল বিহারী চাকমা অপহরণকারীদের তিন জন লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস, নুরুল হক ও সালেহ আহমেদকে চিনতে পেরেছিলেন। এই ঘটনা দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় তোলে এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবদুল জলিলকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক ড. অনুপম সেন ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন। এই কমিটি তদন্ত শেষে ১৯৯৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী রিপোর্ট পেশ করে বলে জানা গেলেও সরকার তা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি। তবে রাঙামাটির আদালত থেকে তদন্ত রিপোর্টটি পাওয়া যাচ্ছে এবং পুলিশ ও সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তারাও এই রিপোর্টের সাহায্য নিয়েছেন। এই নিবন্ধে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবদুল জলিলের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিশন রিপোর্ট (এর পর তদন্ত কমিশন বলে উল্লেখিত হবে) ও সিআইডির চূড়ান্ত রিপোর্ট (এরপর কেবল চূড়ান্ত রিপোর্ট বলে উল্লেখিত হবে) সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
তদন্ত রিপোর্ট
বাংলাদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং স্বঃ মঃ (রাজ -২) পার্বত্য ৩/৯৫(অংশ) / ৯৬৫ তারিখ ৭/৯/৯৬ ইং মোতাবেক দি কমিশন অফ ইনকোয়ারী এক্ট, ১৯৫৬ (১৯৫৬ সালে ৬ নং আইন) এর ৩ নং পারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবদুল জলিলকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠন করে। কমিশনের কার্যপরিধি ও দায়িত্ব হলো (১) উন্মুক্ত তদন্তের মাধ্যমে কল্পনা চাকমা অপহরণ সংশ্লিষ্ট ঘটনাক্রম (? এই দুটো শব্দ অস্পষ্ট, লেখক) পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে প্রয়োজনবোধে এর জন্য দায়ী কর্মকর্তা / কর্মচারী ও ব্যক্তিগণকে সনাক্ত করণ। (২) উপরোক্ত সনাক্তকৃত কর্মকর্তা / কর্মচারী ও ব্যক্তিগণের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ করণ। এবং (৩) ভবিষ্যতে এ এলাকায় এ ধরনের অপহরণের প্রতিরোধ করণ ও এই লক্ষ্যে স্থানীয় পর্যায়ে অনুসরণীয় পদ্ধতি/কার্যক্রম সনাক্ত ও সুপারিশ করণ। (৪) এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়।
যে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই তদন্ত কমিশন গঠন করা হয় সেখানে ৭ নং প্যারায় বলা হয়েছে: ‘এই প্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি গঠন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন (স্মারক নং: স্বঃ মঃ (রাজ-২) পার্বত্য-৩/৯৫ (অংশ) /৬৬৭ তারিখ: ১৪-৮-৯৬ ইং) বাতিল করা হইল।’ অর্থাৎ আবদুল জলিলকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিশনের আগে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে একই বিষয়ে অন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু কি কারণে সেই কমিটি বাতিল করা হয়েছে, কারা সেই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল ও টার্মস অফ রেফারেন্স কি ছিল তা পরবর্তী প্রজ্ঞাপনে বলা হয়নি।
৪০-পৃষ্ঠার এই তদন্ত রিপোর্টে বলা হয় কমিশন ২৬ অক্টোবর ১৯৯৬ থেকে ৩১ অক্টোবর ১৯৯৬ পর্যন্ত রাঙামাটি সার্কিট হাউজে ৮৬ জন এবং ২৬ ও ২৭ নভেম্বর ১৯৯৬ ঢাকায় সেন্ট্রাল সার্কিট হাউজের স্থায়ী কার্যালয়ে আরও ৮ জন সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণে করে।
কিন্তু কমিশন তাদের তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের সনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। রিপোর্টের শেষে সিদ্ধান্ত টেনে কমিশন লিখেছে: “উপরোক্ত কারণাদিতে অপহরণ সংশ্লিষ্ট ঘটনাক্রম ও স্যা প্রমাণ পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে কল্পনা চাকমা ইচ্ছায় হউক বা অনিচ্ছায় হউক অপহৃত হয়েছে কিন্তু কার দ্বারা অপহৃত হয়েছে তা উপযুক্ত সাক্ষ্য ও প্রমাণের অভাবে নির্ণয় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সুতরাং কারো বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করবার কোন কারণ নেই।”
কমিশন কেন অপহরণকারীদের সনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে তার কারণ তদন্ত কমিশনের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার মধ্যেই পাওয়া যাবে। নিচে এ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
১। পদ্ধতিগত দুর্বলতা:
তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট পড়লেই বোঝা যায় তদন্তের ব্যাপারে এর সদস্যের মধ্যে কোন seriousness বা আন্তরিকতা ছিল না। তারা ঢাকা ও রাঙামাটি শহরে বসেই তাদের পুরো তদন্ত কার্যক্রম চালান। আর এই তদন্ত কার্যক্রম ব্যক্তি বিশেষের সাক্ষাতকার গ্রহণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কমিশনের সদস্যরা কেউ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেননি এবং অন্যান্য আলামতও পরীক্ষা করে দেখেননি। অথচ যে কোন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ট তদন্তের জন্য, সংঘটিত অপরাধটির একটি সামগ্রিক চিত্র সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও আলামতের পরীক্ষা একান্ত অপরিহার্য।
২। সাক্ষ্য গ্রহণে দুর্বলতা
কমিশন ৯৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করলেও তদন্তের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তির সাক্ষাতকার নেয়নি। এদের মধ্যে একজন হলেন বাঘাইছড়ি থানার তৎকালীন টিএনও হাসান জাহাঙ্গীর আলম, যিনি ঘটনার পরদিন কল্পনা চাকমার ভাই কালিন্দ কুমার চাকমার জবানবন্দী লিখেছিলেন। যখন কালিন্দ কুমার তার ঐ জবানবন্দীতে লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস ও অন্যান্যদের নাম বলেছেন নাকি বলেননি এ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তখন এ বিষয়ে হাসান জাহাঙ্গীর আলম সাহেবের জবানবন্দী গ্রহণ সুষ্ঠু তদন্তের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু তদন্ত কমিশন তার বক্তব্য নেয়ার কোন প্রয়োজন মনে করেনি। ফলে কমিশন কালিন্দ কুমার চাকমার বক্তব্যের সত্যাসত্যতা অন্যান্য সাক্ষীদের জবানবন্দীর আলোকে যাচাই করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
কমিশন এছাড়া আরো গুরুত্বপূর্ণ দু’জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাতকার নেয়নি। এরা হলেন কল্পনা চাকমার মা বাধুনী চাকমা ও কালিন্দ কুমার চাকমার স্ত্রী চারুবালা চাকমা। কমিশন বলেছে ‘বাধুনী চাকমার পক্ষে তার পুত্র ১ নং সাক্ষী কালিন্দ কুমার চাকমা সময় প্রার্থনা করে এ কমিশনের বরাবর এক আবেদন করে এবং সে প্রেক্ষিতে তাদেরকে ৩১/১০/৯৬ ইং তারিখ পর্যন্ত সময় দেয়া হয় কিন্তু ঐদিনও তিনি উপস্থিত হননি।’ এ প্রসঙ্গে কালিন্দ কুমার চাকমা এই নিবন্ধকারকে জানান তদন্ত কমিশন থেকে কেবল তাদের দুই ভাইকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য লিখিতভাবে আহ্বান করা হয়েছিল। বাধুনী চাকমা বার্ধক্যজনিত রোগে ১৯৯৯ সালের ১৮ অক্টোবর মারা যান। (স্বাধিকার, বুলেটিন নং ১৫, ১৮ জুন ২০০০) অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তির পক্ষে এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সাক্ষ্য দেয়া সম্ভব হওয়ার কথা নয়। তবে যেই হোক, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বাধুনী চাকমা ও কালিন্দ কুমারের স্ত্রী চারুবালা চাকমাকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য কমিশনের আমন্ত্রণ জানানো উচিত ছিল। এটা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর কমিশন যদি বাঘাইছড়ির ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতেন এবং সেখানেই একদিন সাক্ষাতকারের ব্যবস্থা করতেন তাহলে উক্ত দুই প্রত্যক্ষদর্শী ও তাদের প্রতিবেশীসহ অনেকে তাদের জবানবন্দী দেয়ার সুযোগ পেতেন। এতে বর্তমান তদন্ত রিপোর্টের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা বহুলাংশে কাটানো সম্ভব হতো। তাই প্রশ্ন জাগে, তদন্ত কমিশন কি ইচ্ছাকৃতভাবে ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘটনাস্থলে যায়নি, যাতে অনেকে তাদের জবানবন্দী দেয়া থেকে বঞ্চিত হয়?
৩। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যকে গুরুত্ব না দেয়া
সাধারণত সবার সাক্ষ্য সমান গুরুত্ব পায় না। যে কোন অপরাধের ঘটনা তদন্তে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যই সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে। অথচ তদন্ত কমিটি আশ্চর্যজনকভাবে প্রত্যক্ষদর্শী কালিন্দ কুমার ও লাল বিহারী চাকমার সাক্ষ্যকে কোন গুরুত্ব দেয়নি, বরং নানা কূট যুক্তি দিয়ে খারিজ করে দেয়। অপরদিকে, সেনাবাহিনী কল্পনা চাকমার অপহরণকে ঘিরে যে মিথ্যা প্রচারণা চালায় তাকেই তারা প্রামাণিক সত্য হিসেবে গ্রহণ করে।
লাল বিহারী চাকমা (তদন্ত রিপোর্টে ২ নং সাক্ষী) অপহরণকারীদের তিন জনকে চিনতে সক্ষম হন। এরা হলেন কজইছড়ি আর্মি ক্যাম্পের অফিসার লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস, ভিডিপি সদস্য নুরুল হক ও সালেহ আহমেদ। ঘটনার পরদিন সকালে লাল বিহারী কল্পনা চাকমার খোঁজে অনিল বিহারী কার্বারী ও পূণ্য রঞ্জন মেম্বারকে নিয়ে ওই আর্মি ক্যাম্পে যান এবং ফেরদৌসের সাথে দেখা করেন। অপরদিকে কালিন্দ কুমার চাকমা সম্রাটসুর চাকমাকে নিয়ে টিএনওর কাছে যান। তিনি টিএনওর কাছে ঘটনা বর্ণনা করার সময় চিহ্নিত অপহরণকারী তিন জনের নাম উল্লেখ করেন। কিন্তু পুলিশের এফআইআর-এ এদের নাম না লিখে অজ্ঞাতনামা লেখা হয়। এখানে তদন্ত কমিশনের জন্য প্রমাণের বিষয় হলো কালিন্দ কুমার চাকমা টিএনও’র কাছে অপহরণকারীদের নাম বলেছেন কিনা। এক্ষেত্রে তিনি সত্যতা যাচাইয়ের জন্য (corroboration) যার উপর ও যে সব evidence এর উপর নির্ভর করতে পারতেন তা হলো তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত টিএনও হাসান জাহাঙ্গীর আলম ও সে সময় প্রকাশিত পত্রপত্রিকার রিপোর্ট ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন। কিন্তু তদন্ত কমিশন সেটা করেনি। কমিশন প্রকাশিত অপ্রকাশিত অনেক গুজবকে গুরুত্ব দিয়ে তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, কিন্তু টিএনও কর্তৃক লেখা কালিন্দ কুমার চাকমার জবানবন্দী বিষয়ে অনুসন্ধানের ভিত্তিতে পত্র পত্রিকায় ও মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে যা লেখা হয় তা আদৌ আমলে নেয়নি। এখানে এ বিষয়ে কিছু উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে:
ক. বাঘাইছড়ি ঘুরে এসে প্রিসিলা রাজ “কল্পনা চাকমা গেলো কোথায়?” শিরোনামে দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকার ১৭ জুলাই ১৯৯৬ সংখ্যায় লেখেন: “কল্পনা অপহরণ মামলার এফআইআর (ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট) নিয়েও ঘনিয়ে উঠেছে রহস্য। মামলার বাদি কালিন্দী কুমার জানিয়েছেন, এফআইআর তাকে পড়ে শোনানো হয়নি। তিনি জানান টিএনওর কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন এফআইআর-এ তার পুরোপুরি উল্লেখ নেই। এফআইআর কে লিখেছেন তা নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। রাঙ্গামাটি ডিসি, এসপি ও বাঘাইছড়ি থানার ওসি এলাকা সফরকারী সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীসহ অন্যান্যদের জানিয়েছেন, বাঘাইছড়ি থানার টিএনও তা লিখেছিলেন। কিন্তু টিএনও হাসান জাহাঙ্গীর আলম বিষয়টি অস্বীকার করে বলেছেন তিনি কালিন্দী কুমারের অভিযোগ রেকর্ড করে তাকে থানায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সাংবাদিকসহ অন্যান্যদেরকে টিএনও জবানবন্দির কপিটি দেখিয়েছেন। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই জবানবন্দিতে আততায়ীদের ‘হাতে বন্দুক ও টর্চের’ উল্লেখ থাকলেও এফআইআরএ তা নেই। এছাড়া কালিন্দী কুমার চাকমা’র জবানবন্দি নেওয়ার পর এফআইআর পড়ে শোনানো হয়নি বলে যে অভিযোগ আছে সে বিষয়ে ওসি শহীদুল্লাহ বলেন, টিএনও কালিন্দী কুমারের জবানবন্দি নিয়েছেন, এবং তাকে পড়ে শুনিয়েছেন।
“কিন্তু টিএনও হাসান জাহাঙ্গীর আলম তা অস্বীকার করে বলেছেন, কালিন্দী কুমার তার কাছে এসেই প্রথম জবানবন্দি দিয়েছিলেন। কিন্তু তা এফআইআর হিসেবে রেকর্ড হয়নি। কালিন্দী কুমারের জবানবন্দী লেখার পর তিনি তাকে তা পড়ে শোনাননি স্বীকার করেছেন টিএনও জাহাঙ্গীর আলম।”
খ. ডেইলী স্টারের সাংবাদিক মোর্শেদ আলী খানও ঘটনার পর রাঙামাটি ও বাঘাইছড়ি সফর করেন। তিনি লেখেন: ÒThe OC of Baghaichari Shahidullah, also the Investigative Officer (IO) of the case confirmed taking Khudiram statement as identifying the abductors, but said that despite his best efforts to rescue Kalpana, his investigation was hampered due to various reasons. …. During the investigation it was found out that the First Information Report (FIR), written by the OC from Khudiram’s description, did not match the one recorded by the TNO of Baghaichari. The statement given to the TNO by Kalicharan was recorded with clear facts and figures while the FIR written by the OC lacked clarity. No one read out the FIR to Kalicharan before accepting it, it was alleged.” [Focus: A Month After Abduction, Kalpana Chakma Yet to be Rescued: Dhaka Saturday, 13 July 1996]
৩. আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিনিধিও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং বিভিন্ন মহলের সাথে কথা বলেন। ৬ জুলাই ১৯৯৬ Draft Field Report এ সংগঠনটি লিখেছে: “TNO said he did not write the FIR. Rather, he said that he handwrote a statement on blank white paper for his own records. He then told Kalpana’s older brother to go to the police. The TNO’s notes are with him. He would not agree to let us copy it, but we did read it. It was far more thorough and specifc (eg how many men came, what time, name of Lt. Ferdous) than the FIR. We advised him to keep it in a safe place. He said he would produce it if ordered by the court.” [হিল উইমেন্স ফেডারেশন সম্পাদিত ‘কল্পনা চাকমার ডায়েরী’তে সংকলিত, প্রথম প্রকাশ ১২ জুন ২০০১: পৃ: ১৮৩]
তদন্ত কমিশনের উচিত ছিল তৎকালীন টিএনও হাসান জাহাঙ্গীর আলমের জবানবন্দী নেয়া ও তিনি কালিন্দী কুমার চাকমার যে জবানবন্দী রেকর্ড করেছিলেন তা উপস্থাপন করতে বলা। কিন্তু কমিশন কেন সেটা করেনি তা রহস্যজনক।
উপরোক্ত তিনটি উদ্ধৃতি থেকে যা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয় তা হলো: ক. কালিন্দী কুমার চাকমা লেফটেন্যান্ট ফেরদৌসসহ তিন জন অপহরণকারীর নাম টিএনও ও পরে থানায় ওসির কাছে বলেছিলেন। খ. টিএনও সেটা হুবহু রেডর্ক করলেও ওসি তা করেননি। গ. টিএনওর লেখা জবানবন্দীটি এফআইআর হিসেবে রেকর্ডভুক্ত করা হয়নি। ঘ. টিএনও এবং ওসি কেউ লেখার পর জবানবন্দীটি এফআইআর হিসেবে রেকর্ড করার আগে কালিন্দী কুমারকে পড়ে শোনাননি।
এত সাক্ষ্য প্রমাণ থাকা সত্বেও তদন্ত কমিশন এ প্রসঙ্গে তার রিপোর্টে লিখেছে: “অথচ তিনি (কালিন্দ কুমার চাকমা) এ কমিশনে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন উহাতে বলেননি যে তাকে পড়ে শোনানো হয়নি। তিনি বলেছেন ‘আমি ঘটনার কথা টি,এন,ও সাহেবকে বললে তিনি লেখেন এবং আমি উহাতে দস্তখত দেই’। কাজেই তাকে পড়ে শুনানো হয়নি ইহা ঠিক নয়।” তদন্ত কমিশনের এ কথার প্রেক্ষিতে প্রথমে যা বলা দরকার তা হলো, কালিন্দ কুমার চাকমা তাকে তার জবানবন্দী পড়ে শোনানো হয়নি বলে শুরু থেকেই সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীসহ সবার কাছে বলে আসছেন, অথচ তিনি তা তদন্ত কমিশনকে বলবেন না তা বিশ্বাস করা যায় না। দ্বিতীয়ত, তদন্ত কমিশনের কথা যদি আমরা সত্য বলে ধরেও নিই এবং বিশ্বাস করি যে, ঘটনার কথা বললে টিএনও সাহেব লেখেন এবং উহাতে কালিন্দ দস্তখত দেন, তাহলেও কমিশনের কথা থেকে এটা কোন মতেই প্রমাণ হয় না যে, কালিন্দ কুমারকে এফআইআর পড়ে শোনানো হয়েছে।
৪। বিশেষ গোষ্ঠীর অপপ্রচারণায় প্রভাবিত হওয়া
কমিশন সদস্যরা যে সেনাবাহিনীর অপপ্রচারণায় প্রভাবিত হয়েছেন অথবা বলা যায় ফরমায়েশ মোতাবেক একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে প্রমাণ করতে শুরু থেকেই তৎপর ছিলেন, তা তাদের রিপোর্টে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ঘটনার পর সেনাবাহিনী ও তাদের ভাড়াটে এজেন্টরা যে সব অপপ্রচারণা ও গুজব ছড়িয়েছিলেন সেগুলোর প্রতি কমিশন অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে, এমনকি রিপোর্টে সেগুলো থেকে বেছে বেছে দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেয়। যেমন একটা গুজব হলো এ রকম: কল্পনা চাকমা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে আছেন। কমিশন তাদের রিপোর্টের ৩৫ ও ৩৬ পৃষ্ঠায় ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ দৈনিক সংবাদে “কল্পনা চাকমাকে নিয়ে ত্রিপুরাতেও নানা বিভ্রান্তি” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেয়। এই উদ্ধৃতির কয়েক লাইন এ রকম: “কল্পনা চাকমা ত্রিপুরাতে আছেন কেউ কেউ এ রকম মতও প্রকাশ করেন এবং সে সূত্রের দেয়া তথ্যের অনুযায়ী কল্পনা এখন দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার আন্দারছড়া গ্রামে তার মাসীর বাড়ীতে আছেন। প্রথমে তাকে রাখা হয় দক্ষিণ ত্রিপুরার বারমাভেলি [সংবাদের মূল রিপোর্টে রাইমা ভেলি] সাবডিভিশনে শুক্রাই গ্রামে।”
প্রথমত, ত্রিপুরার আগরতলা থেকে ঘুরে এসে সংবাদের উক্ত প্রতিবেদন লেখা হয়েছে বলে তদন্ত রিপোর্টে দাবি করা হলেও প্রতিবেদকের নাম নেই। সাধারণত পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের শুরুতে প্রতিবেদকের নাম দেয়া না হলে “নিজস্ব প্রতিবেদক” অথবা “নিজস্ব বার্তা পরিবেশক” লেখা হয়। সংবাদের উক্ত প্রতিবেদনে এই কথাও লেখা নেই। দ্বিতীয়ত, সংবাদের উক্ত রিপোর্টটি সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং এতে কোথাও লেখা নেই যে প্রতিবেদক নিজে ত্রিপুরা সফর করেছেন। এমনকি তার পরিবেশিত তথ্যের সূত্র এবং প্রতিবেদন তৈরির জন্য কার কার সাথে কথা বলেছেন তার বিন্দু বিসর্গও উল্লেখ নেই।
তৃতীয়ত, কল্পনা চাকমা ত্রিপুরাতে আছেন এমন গুজব প্রচারিত হলে সে সময় বিবিসির উত্তর-পূর্ব ভারতের সংবাদদাতা সুবীর ভৌমিক জানান যে, তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে তিনি জেনেছেন কল্পনা চাকমা ত্রিপুরায় আছেন এমন গুজব ভিত্তিহীন। তার ওই রিপোর্ট বিবিসিতে প্রচারিত হয়েছিল।
চতুর্থত, সংবাদের ওই কাল্পনিক ও উদ্দেশ্যমূলক রিপোটের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তদন্ত কমিশনের উচিত ছিল বস্তুনিষ্ঠতার স্বার্থে ওই সংবাদদাতাকে তলব করা। এমনকি কমিশন বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে ভারত সরকারকে অনুরোধ করতে পারতো যাতে ভারত সরকার সংবাদে উল্লেখিত স্থানে কল্পনা চাকমার সন্ধান কাজে সহায়তা দেয়। কিন্তু কমিশন সে সব কিছুই করেনি, লিখেছে: “অনেকে অনেক কথা বললেও তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি।”
তদন্ত কমিশন তাদের পূর্ব নির্দিষ্ট বিষয় প্রমাণের জন্য যে কেবল তাদের পছন্দের মানবাধিকার সংগঠনের রিপোর্টকে গুরুত্ব দিয়েছে ও পত্রিকা থেকে বেছে বেছে উদ্ধৃতি দিয়েছে তা আরো স্পষ্ট হয়েছে কল্পনা চাকমার মা বাধুনী চাকমার বক্তব্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে। কমিশন ৩৯ পৃষ্ঠায় লিখেছে:
“মানবাধিকার কমিশন কর্তৃক একটি তদন্ত করা হয় এবং অন্যান্যরা সহ কল্পনার মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এবং তা ভিডিও করা হয়। উহার এক কপি সেনাবাহিনীর একজন সাক্ষী কর্তৃক আমাদের নিকট উপস্থিত করা হয়। উহাতে কল্পনা চাকমার মা বাধনী চাকমা বলেছেন যে তিনি তার মেয়ের খোঁজ খবর পান এবং সে ভালো আছে। আমরা ঐ ভিডিও রেকর্ড শুনেছি ও দেখেছি। কল্পনা চাকমার মা এর বিভিন্ন কাগজে যে ছবি ছাপা হয়েছে উক্ত ছবির সহিত ভিডিওতে ধারণকৃত ছবির হুবহু মিল রয়েছে।”
তদন্ত কমিশন তথাকথিত বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের (সরকার কর্তৃক গঠিত বর্তমানের বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন নয়) তদন্ত ও ভিডিওর কথা সোৎসাহে উল্লেখ করলেও, কল্পনা চাকমার মা বাধুনী চাকমার বক্তব্য তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। বাধুনী চাকমা উক্ত তথাকথিত মানবাধিকার কমিশনের বক্তব্য সত্য নয় বলে প্রত্যাখ্যান করে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। ১৯ আগষ্ট ১৯৯৬ “কল্পনার মা বলেন মানবাধিকার কমিশন মিথ্যাচার করেছে, আমি মেয়েকে ফেরত চাই” শিরোনামে দৈনিক সংবাদ ওই সংবাদ সম্মেলনের খবর প্রকাশ করে। সংবাদ জানায়:
“সাংবাদিক সম্মেলনে কল্পনার মা বাঁধুনী চাকমা বলেন, গত ৪ঠা আগষ্ট বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের একটি দল হেলিকপ্টারে করে প্রথমে সেনাবাহিনীর জোনে যায়। সেখান থেকে বিকেলে তারা কয়েকজন বিডিআর সদস্য ও স্থানীয় বাঙালিদের নিয়ে তাদের (কল্পনার) বাড়িতে যায়। মানবাধিকার কমিশনের দলটি তার (কল্পনার মায়ের) কাছে শুধুমাত্র অপহরণের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চায়। তিনি অপহরণের ঘটনা বর্ণনা করেন। বাঁধুনী আরো জানান যে, তিনি মানবাধিকার কমিশনের দলের কাছে এমন কোন কথা বলেননি যে কল্পনা অপহরণের পরেও দুবার তার সঙ্গে দেখা করেছে। এটি ডাহা মিথ্যা, মানবাধিকার কমিশন উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাকে বিকৃতভাবে উদ্ধৃত করেছে।
“বাঁধুনী চাকমা এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে তথ্য বিকৃত করে পরিবেশনের দায়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান।”
বাঁধুনী চাকমার উক্ত সংবাদ সম্মেলনের খবর দেশের অন্যান্য জাতীয় দৈনিকেও প্রকাশিত হয়। অথচ তদন্ত কমিশন সে সম্পর্কে তাদের রিপোর্টে বিন্দুমাত্র উল্লেখ করেনি। কমিশন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রর রিপোর্ট এবং অনেক নিরপেক্ষ রিপোর্টার ও ব্যক্তি বিশেষ কর্তৃক ঘটনাস্থল ঘুরে এসে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করা প্রতিবেদন ও মন্তব্যগুলোকে কোন গুরুত্ব দেয়নি, তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ পর্যন্ত করেনি।
মন্তব্য
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবদুল জলিলের নেতৃত্ত্বাধীন তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট একপেশে, পক্ষপাতদুষ্ট ও অসঙ্গতিপূর্ণ। অপহরণকারী লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস ও তার সহযোগীদের রক্ষার জন্যই উক্ত রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। কেবল সেনাবাহিনীর দেয়া অসংলগ্ন বক্তব্যকেই সত্য বলে গ্রহণ করা হয়েছে। অপরদিকে যারা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তাদের বক্তব্যকে কথার মারপ্যাচে খারিজ করে দেয়া হয়েছে। কমিশন লিখেছে: “২ নং সাক্ষী (কল্পনার ভাই লাল বিহারী চাকমা) কোন সময় থানায় গিয়েছে উহার স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই। অতএব, ১ ও ২ নং সাক্ষী অত্র কমিশন সমীপে যে জবানবন্দী দিয়েছে তা অসত্য এবং ভিত্তিহীন। উপরোক্ত কারণাদিতে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে কল্পনা চাকমার কথিত অপহরণের ব্যাপারে লেঃ ফেরদৌস ও ২ জন ভিডিপি সদস্য বা সেনাবাহিনী বা ভিডিপি জড়িত নয়।”
জোর যার মুল্লুক তার। অপহরণকারীদের চিহ্নিত করতে না পারলেও, কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন প্রমাণ করেছে যে, কখনো কখনো গায়ের জোরে সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করা যায়। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় উপনের মতো এভাবে আক্ষেপ করা ছাড়া কালিন্দ কুমার ও লাল বিহারী চাকমার আর কী আছে: “তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে”।
সিআইডির চূড়ান্ত রিপোর্ট
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবদুল জলিলের নেতৃত্ত্বাধীন তদন্ত কমিশন অপহরণকারীদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হলেও, “দায়েরকৃত এফ,আই,আর এর ভিত্তিতে (বাঘাইছড়ি থানার মামলা নং ২ তাং ১২/৬/৯৬) তদন্ত চালিয়ে অপহৃত মিস কল্পনা চাকমাকে উদ্ধার করত ও অপরাধীদের চিহ্নিত করত যথারীতি ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেয়া যেতে পারে” বলে সুপারিশ করেছিলেন। তাদের সেই সুপারিশের ভিত্তিতে বাঘাইছড়ি থানার এস আই ফারুক আহম্মদ তদন্ত চালান এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের দেয়া সাক্ষ্যে উল্লেখিত অপহরণকারীদের নাম বাদ দিয়ে ২০১০ সালের ২১ মে চূড়ান্ত রিপোর্ট দেন। বাদী কালিন্দ কুমার চাকমা উক্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজী আবেদন জানালে আদালত সিআইডির মাধ্যমে তদন্ত করানোর নির্দেশ দেন। এরপর সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ সিআইডি চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেন।
উক্ত দুই চূড়ান্ত রিপোর্টের মূল সুর ও লক্ষ্য একই — অপহরণকারীদের রক্ষা করা। সিআইডির চূড়ান্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে,
“বাদীর ভাই লাল বিহারী চাকমা @ ক্ষুদিরাম চাকমাই একমাত্র সাক্ষী যিনি লেঃ ফেরদৌস সাহেব, ভিডিপি নুরুল হক ও সালেহ আহমেদকে চিনিতে পারিয়াছেন বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। বাদী তাহার পরিবারের লোকজন ও এলাকার গণ্যমান্য লোকদের সাথে আলোচনা করিয়া এজাহার দেন। কিন্তু তিনি তাহার লিখিত এজাহারে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি উল্লেখ করেন নাই। তাই লাল বিহারী চাকমা @ ক্ষুদিরাম চাকমার প্রদত্ত বক্তব্যটি রহস্যপূর্ণ। তবুও তাহার দেওয়া তথ্য তদন্তকালে যাচাই করা হয়। কিন্তু সমর্থনে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় নাই।”
এজাহারে কেন অপহরণকারীদের নাম নেই সে ব্যাপারে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং এখানে পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। মূলতঃ শুরু থেকেই অপরাধীদের বাঁচানোর জন্য সরকার ও সেনাবাহিনীর মরিয়া প্রচেষ্টা ল্যণীয়। ঘটনার পর এফআইআর-এ লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস ও দুই ভিডিপি সদস্যের নাম না লিখে অজ্ঞাতনামা লেখা, বাদী কালিন্দ কুমার চাকমাকে এফআইআর পড়ে না শোনানো, তদন্ত কমিটির সদস্যদের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে না যাওয়া, গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের জবানবন্দী না নেয়া, দায় এড়ানোর জন্য তদন্তের নামে eyewash — ইত্যাদি সবই একই ল্য বাস্তবায়নের জন্য করা হয়েছে। আর এখন সিআইডি ঘটনার আলামত নষ্ট করার জন্য আদালতের কাছে প্রার্থনা জানিয়েছে। সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা মোঃ শহীদুল্লাহ তার চূড়ান্ত রিপোর্টে একদিকে বলেছেন ‘ভবিষ্যতে কল্পনা চাকমা সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া গেলে বা উদ্ধার করা সম্ভব হইলে যথানিয়মে মামলাটির পুনরায় তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে’, অন্যদিকে ১ নং ও ২ নং আলামত (‘একটি রশি যাহার দ্বারা ঘরের দরজা বাধা ছিল এবং ঐ রাতে আগত অজ্ঞাত লোকেরা কাটিয়াছে বলিয়া কথিত’ এবং ‘একটি খয়েরী রং এর পলিষ্টার কাপড়ের তৈরী গুলি রাখার তোজধানী’) ধ্বংস করার আদেশ প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো আলামত নষ্ট করে ফেলা হলে ভবিষ্যতে কিভাবে তদন্ত করা সম্ভব হবে? এ বিষয়ে চূড়ান্ত রিপোর্টে তার বক্তব্য পুরোপুরি স্ববিরোধী। আসলে ভবিষ্যতে অপহরণের সাথে লেঃ ফেরদৌস এবং সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতা যাতে কোনভাবেই প্রমাণ করা সম্ভব না হয় তার জন্যই সকল আলামত নষ্ট করার এই ষড়যন্ত্র।
মোট কথা, পুলিশ ও সিআইডির তদন্ত অত্যন্ত দায়সারাভাবে করা হয়েছে। তদন্তের নামে এ ছিল এক মহা কেলেংকারী। তদন্ত কর্মকর্তারা কেউ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেননি এবং সংশ্লিষ্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির যেমন বাঘাইছড়ির তৎকালীন টিএনওর সাক্ষাতকার নেননি। কালিন্দ কুমার চাকমা নিবন্ধকারকে জানান, “আমার ভাই লাল বিহারী চাকমা ঘটনার সাথে জড়িতদের মধ্যে যাদের চিনতে পেরেছেন তাদের নাম বলেন, আমিও বলি। কিন্তু তারপরও তিনি লেঃ ফেরদৌস, নুরুল হক ও সালেহ আহমেদকে আসামী করেননি।” তার বক্তব্য থেকে আরো জানা যায়, এসআই ফারুক তদন্তে গিয়ে তাকে বলেন সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্যই কল্পনা চাকমা অপহরণ সাজানো হয়েছে। তার এই কথায় কালিন্দ কুমার দৃঢ় প্রতিবাদ জানান। এইআই ফারুকের উক্ত মন্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, তিনি নিরপেক্ষভাবে তদন্ত কাজ সম্পাদন করেননি, শুরু থেকেই বাদী সম্পর্কে বিরূপ ধারণা গঠন করে তদন্তে অগ্রসর হয়েছিলেন।
উপসংহার:
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবদুল জলিলের তদন্ত রিপোর্ট এবং পুলিশ ও সিআইডির চূড়ান্ত রিপোর্ট চিহ্নিত অপহরণকারীদের রক্ষার জন্য বিধায় তা কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), জনসংহতি সমিতির উভয় গ্রুপ ও বিভিন্ন সংগঠন উক্ত তদন্ত প্রতিবেদন ও পুলিশ-সিআইডির রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে। ন্যায় বিচারের স্বার্থে সরকারের উচিত হবে অপহরণকারী লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস, ভিডিপি সদস্য নুরুল হক ও সালেহ আহমেদকে গ্রেফতার পূর্বক পুনঃতদন্তের মাধ্যমে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা।