- সেলিম রেজা নিউটন
‘পঙ্কিলতা’, ‘পাপকে’ কারাগারে বন্দী করে সমাজের পুঁজ আড়াল করা যায় না। বরং সমস্ত কারাগারই পুরো সমাজের বুকে দগদগে ক্ষত হয়ে দেখা দেয়। মনুষ্যত্ব ও স্বাধীনতাকে নির্বাসনের নামান্তর হয়ে ওঠে এই কারাগার-বন্দীশালা-কয়েদখানা। সমস্ত লিবারাল আইডিয়া বলতে থাকে: কারাগার না থাকলে টাকা আর ক্ষমতার জোরে একদল সমাজে যাচ্ছেতাই করবে। তাই সমাজে আইনি নাগরিক সমতার জন্যই কারাগার দরকারি। আদতে কি তাই? বরং উল্টো টাকা আর ক্ষমতার জোরে অন্যকে বন্দী করার ইনস্ট্রুমেন্ট হয়ে ওঠে কারাগার। তার গায়ে সংশোধনের মহতী তিলক যতই লাগানো হউক আদতে নিষ্ঠুর বন্দীত্ব আর নিষেধাজ্ঞা বৈধ হতে পারে না! ন্যায়বিচারের নামে ন্যায় হতে পারে না!!
প্রবহমান রচনাটি লেখা হয় ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে। জরুরি আইন অমান্য করে কারাবন্দী হন লেখক। কারাগারেরই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এই রচনা। প্রথম প্রকাশ: প্রবাসী বাঙালিদের অনলাইন পত্রিকা ইউকেবেঙ্গলি, লন্ডন, ১৯শে এপ্রিল ২০০৮। এরপরে প্ররকাশিত হয়শাশ্বতিকী, প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, জানুয়ারি ২০০৯। বর্তমাান সংস্করণটি লেখকের অচেনা দাগ গ্রন্থ থেকে সংকলিত। — সম্পাদক
বাধ্যতামূলক শ্রমশিবির
আপনি যদি একুশ শতকের আধুনিক প্রত্যক্ষ দাসপ্রথা না দেখে থাকেন, তাহলে কারাগারে যেতে পারেন। দাসদের গ্রাম এটা, বন্দিদের গ্রাম। আদর্শ দাসত্ব মহাগ্রাম। আস্ত একটা নির্যাতনমূলক শ্রমশিবির বটে জেলখানা, বাধ্যতামূলক শ্রমশিবির। এখানে ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানুষকে দিয়ে সর্বপ্রকার কাজ করানো হয় জুলুম করে এবং জুলুমের ভয় দেখিয়ে। কাজ নিজেও একটা জুলুম এখানে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্যতামূলক কর্মশ্রম জুলুম ছাড়া আর কী?
দাসত্ব মহাগ্রামের যাবতীয় কাজ কয়েদিরা করে। পুরোনো কালের বৃহৎ একটা গ্রামের মতো এখানে আছে আলাদা আলাদা পেশা-জীবিকার আলাদা আলাদা পাড়া। তবে, গ্রাম বা পাড়া বললে যে রকম মানবিক একটা ব্যাপার মনে হয়, এটা সে-রকম নয়। এটা খুবই অমানবিক। তবু পাড়া-পাড়া বা গ্রাম-গ্রাম মনে হয় এখানে থাকা মানুষদের পারস্পরিক সম্পর্কের জন্য: মোটের ওপর সবাই সবাইকে চেনে, এক সাথে কাজ করে, যাবতীয় দুঃখকষ্টের মধ্যেও সহজভাবে মেলামেশা করে, আড্ডা মারে, কালেভদ্রে ঝগড়াঝাঁটিও করে, আবার মিলেমিশে যায়। হঠাৎ ভুল ভাঙবে, যখন দেখবেন সকলের একই পোশাক, হাসিটা মলিন, উঁকি দিচ্ছে আড়ালের দুঃখ, আর কোথাও কোনো নারী নাই। নারীরা আছেন, আলাদা ঘেরাটোপে, দেখতে পাই নি। শ্রমের দিক দিয়ে দেখলে এটা একটা সুবিশাল কারখানার মতো, বন্দি শ্রমিকরা যেখানে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন, শুষ্ক অনিচ্ছুক প্রাণান্তকর পরিশ্রম। ছোটবেলায় সৈয়দপুরের রেলওয়ে কারাখানায় দেখেছিলাম ওয়াগনশপ, লোকোশেড, আরও সব আলাদা আলাদা শেড। আর এখানে জেলখানায় সব আলাদা আলাদা চালি।
জোঁয়াল-বন্দি কয়েদি, মলবাহী মানুষ
শীত নাই গ্রীষ্ম নাই কোন সকাল থেকে বিশাল বিশাল কম্বল আছড়ে ধুচ্ছেন ধোপা-চালির কয়েদিরা। প্রতিদিন দশ হাজার রুটি বানাচ্ছেন রুটি-চালির লোকেরা। নাপিত-চালির নাপিত-কয়েদিদের কাঁচি কচকচ-কচকচ চলছেই সকাল থেকে সন্ধ্যা। কৃষিকাজ যাঁদের ঘাড়ে পড়েছে তাঁরা নিজের কাঁধে করে জোঁয়াল টানছেন গরুর বদলে: কয়েদি থাকতে আবার গরু কেন। আগে-পিছে দুই কয়েদি বাঁশে ঝুলিয়ে ছোটবড় ড্রামের মতো বালতি টানছেন। কোনো কোনো বালতিতে জল। সারা জেলে যেখানে যেখানে জল লাগে পৌঁছে দিতে হবে। গণ-গোসলের বিরাটকায় চৌবাচ্চা ভরার জল। গণ-কাপড় কাচার জল। গণ-টয়লেটের জল। প্রথম শ্রেণীর বন্দিদের গোসলের জল। কয়েদি থাকতে কর্পোরেশনের পানির লাইনের কী দরকার। কয়েদিদের সশ্রম কারাদণ্ড উশুল করতে হবে না। আবার কোনো কোনো বালতিতে মল-মূত্র-গুয়ের পানি: মলবাহী নালা থেকে ভরে আনা, ফুলবাগানের বা মূলাক্ষেতের আদম-সার। গোটা জেল গুয়ের গন্ধে ম ম করছে। একেবারে বৃদ্ধ লোকেরা ঝাঁট দিচ্ছেন সার বেঁধে। বিস্তৃত আমতলার উঠান লেপছেন। মাথায় করে জং-ধরা পুরাতন টিনের তোরঙ্গে করে ভাত নিয়ে যাচ্ছেন আরেক দল লোক: কয়েদিদের খাদ্য। গিয়ে ঢালছেন ওয়ার্ডের বারান্দায় সিমেন্টের মেঝেতে। অবিকল ফকির লালনের মতো বা কনফুসিয়াসের মতো দেখতে অলৌকিক বৃদ্ধেরা বসে বসে মাছি মারছেন সারা সারা দিন। মেরে মেরে জমা করছেন ছোট ছোট কৌটায় ডিভিশনের স্যারদের ঘরে যেন ভনভন না করে কোনো মাছি। মুচি-চালির লোকেরা জুতা সেলাই করেই চলেছেন। ওদিকে উৎপাদন-বিভাগের (এম.ডি.) দেয়ালের ভেতরে তাঁত-চালির লোকরা মাকু টেনেই চলেছেন। মোড়া-চালির কয়েদিরা বাঁশের-দড়ির মোড়া বানিয়েই যাচ্ছেন। আরও আছে লোহার কাজ, ছাপাখানার কাজ, (ভেতরে গিয়ে রতন মিয়াকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, রতন, আরও যেন কী কী কাজ?) ‘রাইটার’ বন্দিরা অফিসের কত রকম কাজ করছেন। মুক্তার মতো তাঁদের হস্তাক্ষর। পাঠাগারের বন্দিরা সাড়ে চার হাজার বই লেনদেনের বন্দোবস্ত সামলাচ্ছেন প্রতিদিন। কারা-হাসপাতালে কয়েদিরাই ড্রেসিং করছেন কয়েদিদের, প্রেশার মাপছেন, ইঞ্জেকশন দিয়ে দিচ্ছেন, স্যালাইনের সিরিঞ্জ-ব্যাগ-স্ট্যান্ড সামাল দিচ্ছেন কলেরার-ডায়রিয়ার রোগীদের। গণটয়লেটের নালাড্রেনের মল-মূত্র পরিষ্কার করছেন ‘বাবু’-চালির কয়েদিরা।
বিনামূল্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল উৎপাদন
এই রীতিমতো নিবর্তনমূলক এই শ্রমশিবিরের বন্দিদের বাধ্যতামূলক শ্রমের বিনিময়ে রীতিমতো কারখানাভিত্তিক উৎপাদন-যজ্ঞ পরিচালিত হয় ম্যানুফ্যাকচারিং ডিপার্টমেন্ট এম.ডি.-তে। এটা কারাগারের ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা, কারাগারের কারখানা। জেলের ভেতরে একটা বড় অংশ চারপাশে উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। জেলের ভেতরে জেল। অন্য অংশের কোনো কয়েদি সেখানে ঢুকতে পারেন না। এম.ডি.-তে সবচেয়ে কঠোর পরিশ্রম। এম.ডি.-তে কাজ পাশ হওয়াটা কয়েদিদের কাছে ভয়ের। এখানে শত শত গজ উৎপন্ন হয় চাদর, কয়েদিদের পোশাক, লুঙ্গি, শাড়ি, গামছা ইত্যাদি হিসেবে। প্রচুর মোড়া, বাঁশের চেয়ার তৈরি হয়। মাত্রই বলেছি। জেলের বাইরের বিক্রয়কেন্দ্রে এসব জিনিস দেদারসে বিক্রি হয়, কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করে কুল পান না। এখানে মুদ্রণ হয় জেলের জন্য দরকারি যত রকমের খাতা, কাগজপত্র, ফরম, পার্সোনাল টিকেট, মেডিক্যাল কার্ড ইত্যাদি যাবতীয় কিছু। রাজশাহী জেলের চাহিদা মিটিয়ে সেসব যায় আরো সব অন্য অন্য জেলে।
কয়েদিদের বদ্ধমূল বিশ্বাস, এম.ডি. কারাগারের অত্যন্ত লাভজনক প্রকল্প, কিন্তু কর্তৃপক্ষ এটাতে লোকসান দেখায়, আর টাকা মেরে খায়। এটা এমন একটা উৎপাদন-কারবার যেখানে শ্রম পাওয়া যায় বিনামূল্যে। শ্রমের জন্য কয়েদিদেরকে কোনো টাকা-পয়সা দেওয়া হয় না। দশ-বিশ-তিরিশ-চল্লিশ বছর জেল খেটে মানুষ যখন কারাগার থেকে মুক্তি পায় তখন তাঁর হাতে ফুটা পয়সাও থাকে না।
আকাশে যত তারা, জেলকোডে তত ধারা
কাজ, কাজ আর কাজ: বিনা পারিশ্রমিকে তো বটেই, প্রায় না খেয়ে এবং নিপীড়ন আর লাগাতার দুর্ব্যবহারের বিনিময়ে। ওদিকে, বাবু-জমাদাররা সারাক্ষণই ছোঁক ছোঁক করছেন আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে। জেলের আইনে বিধিবিধানের তো আর শেষ নেই, আলমগীরের বয়ানে: ‘আকাশে যত তারা, জেলকোডে তত ধারা’। রিপোর্ট খাওয়ানোর ভয় দেখিয়ে কীভাবে পাঁচ টাকা দশ টাকা পকেটে ভরা যাবে, কীভাবে কয়েদির সিগারেটটা নিজে খাওয়া যাবে, কয়েদির নামে বাইরে থেকে পাঠানো শুকনা খাবারের ভাগ মারা যাবে, পাঠানো সিগারেটের প্যাকেট সরানো যাবে, ছুঁতানাতার শেষ নাই, অত্যাচারের শেষ নাই। এমনকি ঈদের দিনেও ডিভিশনের ‘কাজের লোক’ বা ‘ফালতু’র কাছ থেকে ২০ টাকা ‘পরবী’ নিয়েছেন এক জমাদার।
এতসব কাজ আর অত্যাচারের সংসারে তিন বেলা ভাত খেতে পর্যন্ত পান না এই বন্দিরা। সকালে একটা রুটি, সাথে গুড়। দুপুরে দুইটা রুটি, সাথে গুড়। রাতের জন্য শুধু ভাত-তরকারী। কিন্তু সে-ভাত তো এসে যায় বিকালের আগেই প্রায়, সন্ধ্যার আগেই দাসদেরকে খাঁচায় ঢুকতে হবে যে। সত্যিকারের রাতে খেতে বসলে দেখা যাবে নষ্ট হয়ে গেছে সে-ভাত, এমনই ভালো তার চাল। ভাত তাই সন্ধ্যার আগে-আগেই খেয়ে ফেলতে হয়। তারপর সারারাত উপাস। নইলে রেখে দিতে হবে পানি দিয়ে, এবং খেয়ে ফেলতে হবে সন্ধ্যা-রাতেই, না হলে নির্ঘাৎ পচতে শুরু করবে। খাবারের মান নিয়ে কিছু না বলাটাই সবচেয়ে ভালো। ডিভিশন পাওয়ার আগে তিন দিন সেলে ছিলাম, নিজমুখে খেয়ে দেখেছি। মানুষকে কষ্ট দেওয়ার কি সহজ উপায়। তবু এখন যা দেয় সেটাই নাকি ক’বছর আগের তুলনায় অনেক ভালো, কয়েদিরা বারবার মনে করিয়ে দেয় সে-কথা।
আত্মার গভীরে বন্দিত্বের অনুবাদ
সকাল থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত অমানুষিক পরিশ্রম, অত্যাচার, আর প্রায়-অনাহারের পরও রাতের চেয়ে দিবসই সুন্দর। দিনে আকাশ দেখা যায়, মাটিতে হাঁটা যায়, গণ্ডির ভেতরে হলেও একটু চলাফেরা হয়। রাতে আরও বেশি বন্দি। আসলে রাত তো অনেক দূর, সন্ধ্যা হওয়ার আগেই লক-আপ। নিজ নিজ ওয়ার্ডের খাঁচার মধ্যে লোহার গরাদের গেটে তালাচাবি। তখনও সন্ধ্যা হয়নি। তখনও হাঁস-মুরগি খুপরিতে ঢোকেনি। তখনও মাঠে চরছে গরু-ছাগল। কয়েদিদের মুখে তখন গোধূলি-ঘনানো বিষণ্নতা। প্রতিটা সন্ধ্যায় তাঁরা হাঁস-মুরগি-গবাদিপশুর প্রতি ঈর্ষা অনুভব করতে করতে খাঁচায় ঢোকেন। আত্মার একেবারে গভীরে আলাদা করে আরেকবার অনুবাদ করেন বন্দিত্বের অর্থ। বিছানা হয় দেড় হাত চওড়া। বিছানা বলতে ভাঁজ-করা একটা কম্বল, মাথায় ভাঁজ-করা কম্বলেরই একটা বালিশ। দুই বিছানার মাঝখানে এক আঙ্গুলও ফাঁক নাই। শীত হলে গায়ে আর-একটা কম্বল, জানলা-দরজা খোলা, আগেই বলেছি। গরম হলে ভাপ ওঠে, ও-রকম ঘেঁষাঘেঁষি করে বিশাল একটা মেঝেতে কোথাও একশো কোথাও-বা দুইশো তিনশো চারশো মানুষ, রাজশাহীর কুখ্যাত দম-ফাটানো ৪০-৪২ ডিগ্রির গরমে। কি গরমে, কি শীতে সেলগুলোর অবস্থা আরও সঙ্গীন। ঐভাবে শীতে-গ্রীষ্মে শুয়ে শুয়ে সারা রাত অপেক্ষা, কখন সকাল হবে, কখন খুলবে গরাদ। লক-আপ যখন খুলবে লোহার ঘটাং ঘটরং শব্দ শুনতে কত ভালোই না লাগবে: এই কথা ভাবতে ভাবতেই হয়ত ঘুম আসবে অথবা ঘুম আসবে না – দাঁড়িয়ে থাকবে জানালার বাইরে। এইভাবে আয়ু ক্ষয় করতে করতে যাবে একটা দিন। বন্দি জানবেন, তাঁর মুক্তির ক্ষণ আরও একদিন এগিয়ে এসেছে। এ-ও একটা বিরাট অর্জন: আরও একটা দিন তিনি পার করে দিয়েছেন জেলে, এবং তারপরও বেঁচে আছেন।
টাকাতন্ত্র আমলাতন্ত্র কারাতন্ত্র
এত যে দাসের মতো কাজ, সেই কাজেরও নিশ্চয়তা নাই। আজকে আপনার ফুলবাগানে কাজ, কাল যে আবার উৎপাদন-বিভাগের উঁচু দেওয়াল ঘেরা পৃথক জেলের ভেতর বসে বসে আপনাকে মোড়া বানাতে হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নাই। কর্তৃপক্ষের খেয়াল হলেই হলো আপনার কাজ অন্যত্র পাশ করে দিতে পারেন তাঁরা। আইন হচ্ছে, প্রতি মাসে কাজ-পাশ করাতে হয়। একই কাজই যদি বহালও থাকে, তবুও সেটা নতুন করে পাশ করাতে হবে। আর প্রতিবার পাশ করানোর জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিতে হবে জেল-কর্তাদেরকে। (আকাশে যত তারা, জেলকোডে তত ধারা; জেলকোডে যত ধারা, তত বেশি ‘মাসোহারা’।) টাকা দিতে না পারলে আপনার কাজ অন্যত্র পাশ হয়ে যাবে। তাতে হয়ত বেশি পরিশ্রম, তাতে হয়ত আপনার বর্তমান কর্ম-এলাকার বন্ধু-হয়ে-যাওয়া কয়েদিদেরকে হারাতে হবে, দেখা হবে না আর প্রতিদিন, কিংবা নতুন কাজটা হয়ত আপনার ভালো লাগে না স্রেফ। সুতরাং প্রতি মাসে টাকা তৈরী রাখতে হবে। টাকা পাবেন কোথায়? বাসার লোকেরা খেয়ে না খেয়ে দিয়ে যাবে। আপনার সে-রকম টাকা পাঠানোর লোক না থাকলে আপনি হয়ত আপনার বরাদ্দ মাছের টুকরাটা বেচে দেবেন দুই টাকা দিয়ে, টাকা জমাবেন।
ঐ যে সামান্য খাদ্য, একটু রুটি আর একটু ভাত, সেটুকু নিয়েও অনেক ব্যবসা হয়। ঠিকাদার কাঁচামাল সাপ্লাই দেবেন। ঠিকাদার নির্বাচনে টাকা লেনদেন হবে। গেট দিয়ে জিনিস ঢুকবে। গেটে নয়-ছয় হবে। রান্না-চালি গোপন ‘নিলামে’ বিক্রি হবে, যিনি ‘কিনে’ নেবেন (তিনি একজন কয়েদি) তিনি সেখান থেকে স্পেশাল হিসেবে চোরা খাবার বেচবেন। এমনকি আপনি যে দেড় হাত জায়গায় শুয়ে থাকেন ঐ জায়গাটা ঐখানেই বহাল রাখার জন্যেও আপনাকে মাসোহারা দিতে হবে। একটু আরামে থাকার জন্য, আলাদা একটু লোহার বেডের বালিশ-তোষক-মশারির বিছানায় ঘুমানোর জন্য, আর একটু ভালো খাওয়ার জন্য আপনাকে থাকতে হবে মেডিক্যালে, যার একটা ওয়ার্ড থেকে প্রায় ৭০ জন বন্দিকে সরিয়ে আমাদের তিন জনের থাকার ডিভিশন ওয়ার্ড বানানো হয়েছিল। আর সেই মেডিক্যালে থাকতে হলে ডাক্তারকে আপনি প্রতি মাসে এক দেড় দুই বা তিন হাজার টাকা দেবেন। টাকা না থাকলে সত্যিসত্যি অসুখ হলেও মেডিক্যালে আপনার এক-আধ দিনের বেশি সিট জুটবে না। আর টাকা থাকলে দিব্যি সুস্থ মানুষ আপনি মাসের পর মাস মেডিক্যালে থাকবেন।
গরিবের জেলখানা, বড়লোকের আইন-আদালত
এমন একটা কাজ জেলখানায় নাই, যার জন্য টাকা দিতে হয় না। অথচ ঐ দাসদের গ্রামে প্রায় প্রত্যেকেই গরিব মানুষ। গরিবের জেল, আর বড়লোকের আইন-আদালত। অনেকদিন জেল খাটা হয়েছে। যে মামলায় আপনি আছেন তাতে হাইকোর্টে মোটের ওপর একটা উকিল ঠিকমতো দাঁড়ালে আপনার জামিন নিশ্চিত, সেই উকিলটুকু ধরার মতো টাকা বেশিরভাগ কয়েদির নাই বলে তাঁকে পচে মরতে হবে জেলে আরও কত কাল। জামিনটুকু পাওয়ার জন্য আপনার পরিবার হয়ত সহায়-সম্বল সব বেচে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছে দালালকে, টাকাটা দালাল নিজেই খেয়ে বসে আছে, আর আপনি সেই জেলেই পচে মরছেন। কারারক্ষীরাও নিতান্ত গরিব। অতি সামান্য বেতন পান। সংসার চলে না, মাস চলে না। কিছুতেই না। ডিউটি প্রতিদিন ১৪ ঘণ্টা। বসার হুকুম নাই। জমাদার দেখলে রিপোর্ট করে দেবেন। আর সেই ভয় দেখিয়ে জমাদারও তার কাছ থেকে টাকা খাবেন। জমাদারের কাছ থেকে আবার টাকা খাবেন হয়ত সুবাদার, তারপর জেলার, তারপর সুপার। এরই মধ্যে কত রকম হাজারো মানবিক বৈশিষ্ট্য আর পরিস্থিতির জন্য জেলকর্তাদের কেউ কেউ দয়ালু, কেউ কেউ বদমাইশ। কয়েদিরা সারাক্ষণই বলছেন: এই জেলার ভালো, ঐ সুপার খারাপ, তার আগের জেলার ছিলেন চামার, আর ওমুক সুপার হারামির বাচ্চা, আর তমুক সুবাদার অত্যন্ত সদাশয় লোক। এসব পার্থক্য জেলের ভেতরে বাঁচা-মরার সাথে জরুরিভাবে সংশ্লিষ্ট বটে।
স্বাভাবিকতার স্বর্ণচিন্তা: স্বাভাবিকতার স্বর্ণশৃঙ্খল
আর আমরা? ডিভিশনের কয়েদিরা? আমরা রাষ্ট্র-কর্তাদের কমবেশি নিজেদের শ্রেণীর লোক বলে রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হয়েও প্রথম শ্রেণীর বন্দির মর্যাদা পাব, ‘রাজার হালে’ জেলে থাকব। আর সব গরিব মানুষেরা জেলের বাইরে যেমন মর্যাদাহীন, জেলের ভেতরে তেমনি অধিকতর মর্যাদাহীন বন্দি, পশুর মতো, দাসের মতো। সারাদেশ আমাদের মুক্তির জন্যে চিন্তিত থাকবে, মুক্তি দাবি করে এটা-সেটা করবে, আর এদের মুক্তির কথা কেউ কোনোদিন বলবে না।
জেলখানা থাকলে তাতে গরিব মানুষেরা আর ভিন্নমতের ভিন্নশক্তির লোকেরা তো বন্দি থাকবেই। ৬৪টা জেলা শহর থাকবে, আর ৬৪টা জেলখানা থাকবে না! সাতটা বিভাগ থাকবে, সাতটা কেন্দ্রীয় কারাগার থাকবে না? এই হচ্ছে আমাদের মাথার মধ্যকার ‘স্বাভাবিক’ ‘প্রাকৃতিক’ ধারণাগুচ্ছ। পরিবার রাষ্ট্র ইস্কুল-কলেজ সাহিত্য-শাস্ত্র, ধর্ম-শাস্ত্র, আর সাংবাদিকতা-শাস্ত্রের মাধ্যমে কতদিনের প্রশিক্ষণের ফল এইসব ‘স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক’ ধারণা তা আমাদের ভেবে দেখার সময় কোথায়!
ফলে ডিভিশনের প্রথম শ্রেণীর বন্দিদের কাছে একদিন দুপুরে মর্যাদাহীন এক বন্দি এসে লুকিয়ে লুকিয়ে একটু ভাত খেতে চাইবে বাবু-জমাদার কিম্বা ম্যাট-পাহারারা যেন দেখে না ফেলে, এটাই তো স্বাভাবিক। তারপর একদিন আমরা মুক্তি পেয়ে চলে যাব আর জেলখানা যেমন ছিল তেমনই থেকে যাবে, এটাই তো স্বাভাবিক। স্বাভাবিকতার এই স্বর্ণচিন্তার শৃঙ্খলই কারাগার নামক আদর্শ দাসত্ব-মহাগ্রামের আসল নিরাপত্তা।