- অনুবাদ: খোইরোম রুধির
প্রবহমান রচনাটি নোম চমস্কির Understanding Power: The Indispensable Chomsky গ্রন্থ থেকে সংকলিত। ২০০২ সালে নিউপ্রেস থেকে এটি প্রকাশিত হয়। পুরো গ্রন্থটিই মূলত বিভিন্ন কথোপকথন, প্রশ্নোত্তরের একটি গ্রন্থনা। এর নির্বাচিত অংশ ক্ষমতাবোধিনী: নৈরাজ্য ও বিবিধ শিরোনামে প্রকাশিত হল।-সম্পাদক
বিজ্ঞান ও মানব প্রকৃতি
পুরুষ কণ্ঠ: নোম, মানব প্রকৃতি সম্পর্কে আপনার ব্যক্তিগত অভিমত একটু বিস্তারিত বলবেন? যেমন, আপনি কি মানুষকে গঠনমূলক সত্তার চেয়ে অধিকতর ধ্বংসাত্মক সত্তা হিসেবে দেখেন কিংবা সম্ভবত কাছাকাছি অন্যকিছু?
চমস্কি: আচ্ছা। প্রথমত, আমার অভিমত আপনাদের অভিমতের চেয়ে উত্তম কিছু নয়-এটি বিশুদ্ধ স্বজ্ঞা মাত্র। মানব প্রকৃতি সম্পর্কে প্রকৃতপক্ষে কেউই কোনকিছু বুঝতে পারে না। দেখুন, মানুষ বৃহৎ অণুগুলো সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না। আপনি যখন তারও বাইরে মানব প্রকৃতির মতো ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে কথা বলেন তখন যে কারো অনুমানই অন্য কারো অনুমানের মতোই ভালো।
পুরুষ কণ্ঠ: কিন্তু আপনি তো মানব প্রকৃতির প্রচুর সংখ্যক ফলাফল নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন।
চমস্কি: হ্যাঁ। কিন্তু আপনি যদি মানব প্রকৃতির ফলাফলগুলোর দিকে তাকান তাহলে তার মধ্যে আপনি সবকিছুই দেখতে পাবেন–আপনি প্রচুর আত্মোৎসর্গ, প্রচণ্ড সাহস, সততা, নাশকতা, যা চান তাই দেখতে পাবেন। এটা আদতে আপনাকে বেশি কিছু জানান দেয় না।
পুরুষ কণ্ঠ: যদিও আপনার বিপুল সংখ্যাক গবেষণাপত্র মানুষের ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির দলিল হাজির করেছে বলে মনে হয়।
চমস্কি: তা ঠিক। কিন্তু সেগুলোর প্রচুর সংখ্যক গবেষণাপত্র অন্য কিছুর দলিলও হাজির করে। আমার সাধারণ উপলব্ধি হচ্ছে সময়ের সাথে সাথে পরিমিত পরিমাণে অগ্রগতি হয়েছে—বিপুল পরিমাণে নয় তবে উল্লেখযোগ্য। আর কোনো কোনো সময় এই অগ্রগতি এসেছে খুব নাটকীয়ভাবে। উদাহরণস্বরূপ আমেরিকার ইতিহাসে “আদি পাপ” এর কথাই ধরুন। এখানকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে কী ঘটেছিল? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যে ১৯৬০ সাল অব্দি আমেরিকার সংস্কৃতি আদিবাসী জনজাতির সংস্কৃতিকে কোনভাবেই গ্রহণ করতে পারেনি। ১৯৬০ সাল অব্দি বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া বিদ্যায়তিক জ্ঞানচর্চায় ঢালাওভাবে ইতিহাসের মিথ্যা বয়ান হাজির করা হচ্ছিল এবং বাস্তবে যা ঘটেছে সেগুলোকে মাটি চাপা দেয়া হচ্ছিল। এমনকি যাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল তাদের সংখ্যা সম্পর্কেও ব্যাপক মিথ্যাচার করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রগণ্য কূটনৈতিক ইতিহাসের কোনো একটিতে লেখক থমাস বেইলি লিখতে পেরেছিলেন যে, আমেরিকান বিপ্লবের পর পূর্বতন উপনিবেশবাদীরা “গাছ ও ইন্ডিয়ানদের ভূপাতিত করার” কাজে মনোনিবেশ করেছিল।১ ইদানিং কেউ আর এই কথা বলতে পারবে না, এমনকি ওয়াল স্ট্রীট জার্নালের সম্পাদকীয়তেও আপনি এই কথা বলতে পারবেন না। এগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এবং এগুলো অপরাপর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির অংশও বটে। দাসত্বকে অল্প কিছুদিন আগেও চমৎকার জিনিস বলে বিবেচনা করা হতো।
পুরুষ কণ্ঠ: তার মানে আপনি মনে করেন যে মানব প্রকৃতি আলাদাভাবে এক প্রকার ধ্বংসাত্মক ঠেকলেও সামগ্রিকভাবে এটি গঠনমূলক?
চমস্কি: আমি জানি না। যেমন, উনিশ শতকে তাদের কাছে গ্যাস চ্যাম্বার ছিল না। সুতরাং আপনি সকল প্রকার বৈশিষ্ট্যই খুঁজে পাবেন। আর আপনি যদি বিজ্ঞানভিত্তিক উত্তর চান তাহলে উত্তর শূন্য, কেউ কিছু জানে না—এই সংক্রান্ত উত্তরগুলোর অধিকাংশই এসেছে ইতিহাস কিংবা স্বজ্ঞা কিংবা অন্যকিছু থেকে। মানে হচ্ছে, বিজ্ঞান শুধুমাত্র খুব সহজ-সরল প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারে। জটিল ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আপনি শুধু অনুমান করেন মাত্র।
অপর পুরুষ কণ্ঠ: ভাষাতত্ত্ব সংক্রান্ত আপনার বৈজ্ঞানিক কাজ এবং আপনার রাজনীতির মধ্যেকার যোগসূত্র সম্পর্কে যখন প্রশ্ন করা হয় তখন আপনি এমন মন্তব্য করেন যে, “হ্যাঁ, তাদের মধ্যে অতি সূক্ষ্ম কিছু যোগসূত্র রয়েছে”। আপনি কি এই বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত বলবেন? আমার নিজস্ব ভাবনা হচ্ছে- আমাদের রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর একাংশ সম্ভবত এই যে, মানব মস্তিষ্ক ‘বেশি’ ও ‘কম’ এর মতো প্রতিযোগিতামূলক শব্দবন্ধে ব্যাপারগুলোকে বিবেচনা করতে খুব দক্ষ এবং ‘পর্যাপ্ত’ ধারণাটির ক্ষেত্রে কম দক্ষ।
চমস্কি: আচ্ছা। এইটা হয়তো সত্য কিন্তু এগুলো এমন সব বিষয় যা সম্পর্কে ভাষা বিষয়ক বৈজ্ঞানিক গবেষণার কোনো কিছু বলার নেই। আমার কথার মানে হচ্ছে আপনি এই বিষয়ে ততটুকু জানেন যতটুকু জানেন আমাদের আশেপাশে অবস্থিত সবচেয়ে বিশেষজ্ঞ ভাষাবিজ্ঞানী।
পুরুষ কণ্ঠ: তাহলে কোথায় সেই অতি সূক্ষ্ম যোগসূত্রগুলো?
চমস্কি: সেখানে নয়। এই অতি সূক্ষ্ম যোগসূত্রগুলো অন্য কোথাও রয়েছে।
প্রথমত, আমাদের মনে রাখা উচিত যে বিজ্ঞান যে ধরনের বিষয়বস্তুর উপর আলোকপাত করতে পারে তা খুবই সীমিত। আপনি যখন জটিল সিস্টেমের দিকে এগুতে শুরু করবেন তখন বৈজ্ঞানিক জ্ঞান খুব শীঘ্রই সেগুলোর ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম হয়ে উঠবে। আর আপনি যখন মানুষের প্রকৃতি নিয়ে অনুসন্ধান করতে যান তখন বিজ্ঞানের আর কিছুই বলার থাকে না। কিন্তু এমন কিছু ক্ষেত্রও আছে যেখানে আপনি গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও বোধশক্তির সন্ধান পেতে পারেন এবং কিছু কারণে ভাষার কোনো কোনো পরিপ্রেক্ষিত সেই ক্ষেত্রগুলোর একটি হতে পারে। কিন্তু এই অন্তর্দৃষ্টিও মানব সংক্রান্ত প্রকৃত জিজ্ঞাসাগুলোর প্রাসঙ্গিক উত্তর হাজির করতে পারেনি, অন্ততপক্ষে মানবজীবনে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম এমন পর্যায়ের উত্তর হাজির করতে পারেনি।
এই যোগসূত্রগুলো একেবারেই ভিন্ন ও অতি সূক্ষ্ম। যোগসূত্রগুলোতে জোর দেওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের কালপর্বে এই যোগসুত্রগুলোকে বহুবার চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ক্লাসিকাল লিবারেলিজমের ঠিক কেন্দ্রস্থলেই এই যোগসূত্রগুলো নিহিত। আমার কথার মানে হচ্ছে, ক্লাসিকাল লিবারেলিজম (যা ছিল প্রাক-পুঁজিবাদী প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাদ বিরোধী) মানুষের স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার নিমিত্তে স্ব-কার্য স্ব-নিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং নিজস্ব তত্ত্বাবধানে স্বাধীন সৃজনশীল কার্য সম্পাদনের প্রয়োজনীয়তার উপর দৃষ্টিপাত করত, যা এটির সাম্প্রতিক সংস্করণের ঠিক উল্টো। সুতরাং একজন ক্লাসিকাল লিবারেলের কাছে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় শ্রম মজুরির ধারণা হয়তো আগাগোড়া অনৈতিক হিসেবে বিবেচিত হতো। কারণ এটি স্ব-কার্যের উপর স্ব-নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক জরুরতকে ব্যাহত করে এইটা প্রচার করার মাধ্যমে—তুমি কারো না কারো দাস মাত্র।
স্বাধীন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের অধিকার এবং তার উপর স্ব-নিয়ন্ত্রণের তাগিদে মানব প্রকৃতির অন্তঃসার শনাক্ত করার চেষ্টা করতে গিয়ে কতিপয় ক্লাসিকাল লিবারেল দার্শনিক মানব বুদ্ধিবৃত্তির অন্য দিকগুলোতে দৃষ্টিপাত করেছিলেন। সেগুলোর একটি দিক হচ্ছে ভাষা যা নিয়ে সতের শতক থেকে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে এবং এটির সাথে কার্টেসিয়ান চিন্তাচর্চারও[ফরাসি দার্শনিক দেকার্ত পরবর্তী] যথেষ্ট লেনাদেনা আছে। কোনো পশু কিংবা স্বয়ংচল যন্ত্রের সাথে মানুষের পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানব অনুভূতির উপর মানব মনের কর্তৃত্ব যাকে প্রায় যথাযথভাবে ভাষার মধ্যে শনাক্ত করা হয়েছিল। ভাষার স্বাভাবিক ব্যবহারে স্বাধীন সৃজনশীল পরিপ্রেক্ষিত এমনই এক নির্ণায়ক।
দেকার্তের যুক্তিতর্কের একটি কেন্দ্রিয় অংশ, এমনকি মানুষ ও জগতের অন্য সত্তাগুলোর মধ্যেকার অন্টোলজিকাল পার্থক্য হচ্ছে—আপনি যদি কোনো মানুষকে কিছু শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে নতুন কোনো বিষয়ে জানতে চান যেটি সম্পর্কে সে আগে কখনো শুনেনি তাহলেও সেই বিষয়ের সাথে প্রাসঙ্গিক নতুন কোনো উত্তর সে আপনাকে দিতে পারবে। কোনো অভ্যন্তরীণ অবস্থা কিংবা কোনো বাহ্যিক পরিস্থিতির দরুন এমনটা ঘটে না। এটি সম্ভব হয় মানব মনের সৃজনশীল ক্ষমতার জন্য। কিন্তু কোনো স্বয়ংচল যন্ত্র, পশু কিংবা অন্যকিছুর ক্ষেত্রে একই জিনিস ঘটবে না। যেমন, আপনি যদি কোনো যন্ত্রকে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিস্থিতিতে সেট করে বাটনে চাপ দেন তখন যে ফলাফল পাবেন তা পূর্বনির্ধারিত। কিংবা আপনি যদি কোনো কবুতরকে সুনির্দিষ্ট কিছু তাড়না দেন সেক্ষেত্রেও এটি যে সকল কার্যকলাপ করবে তাও পূর্বনির্ধারিত-ই হবে। কিন্তু একজন মানুষের ক্ষেত্রে আপনি যে ফলাফল পাবেন তা পূর্বনির্ধারিত নয় বরং অনির্ধারিত কিন্তু কোনো না কোনোভাবে সেই পরিস্থিতি সাপেক্ষে যুতসই।
দেকার্তের জন্য এইটা ছিল মানব মনের চরম দিক। রুশো, হামবল্ডট ও অন্যান্যরা ঠিক ক্লাসিকাল লিবারেল পর্ব থেকে চেষ্টা করে গিয়েছেন এই উপাদানগুলোকে জোড়া দেওয়ার এবং স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা ও অধিকার শনাক্ত করার। এটিকে কখনো কখনো “স্বাধীনতার সহজাত প্রবৃত্তি” নামে ডাকা হয়েছে যা মানব প্রকৃতির জ্ঞানতাত্ত্বিক অন্তঃসার—স্বাধীন সৃজনশীল চিন্তা এবং তার বহিঃপ্রকাশ।
এইটা অনেকটা রূপক। যেমনটা আমি বলেছি, আসলে কেউই মানব প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু জানে না। সুতরাং আপনি নিশ্চিতভাবে জানেন না যে স্বাধীনতা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি কি না। আমার কথার মানে হচ্ছে, কেউ যদি বলতে চায় যে মানুষের জন্মই হয়েছে দাসত্ব বরণ করার জন্য তাহলে সেইটার পক্ষেও সে সেই পরিমাণ বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্ক হাজির করতে পারবে যে পরিমাণ যুক্তিতর্ক রুশো হাজির করেছিলেন মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মায় এই মন্তব্যের জন্য। এটি নির্ভর করছে আপনার প্রত্যাশা কোথায় তার উপর, এমন নয় যে এই সংক্রান্ত কোনো বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আছে।
আজকের দিনেও ব্যাপারটা সত্য। যেমন, আপনি সোশিওবায়োলজি সম্পর্কে মর্জিমাফিক যেকোন বই পড়তে পারেন। সেগুলোর অধিকাংশই রূপকথা মাত্র। এটি সেই পর্যায় পর্যন্ত ঠিকঠাক যতক্ষণ পর্যন্ত এটি পিঁপড়েদের নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু এটি যখন স্তন্যপায়ীদের নিয়ে কথা বলে তখন এটি অনুমান নির্ভর হয়ে উঠে। আর এটি যখন মানুষ সম্পর্কে কথা বলতে যায় তখন মাথায় যা আসে তাই বলে ফেলে। তবে আপনি এক প্রকার সম্ভাব্য শক্তিশালী যোগসূত্র দেখতে পাবেন। যোগসূত্রগুলোকে আদৌ বাস্তব রূপ দেওয়া সম্ভব কি না কে জানে? এটি বৈজ্ঞানিক বোঝাপড়ার এত বাইরে যে আপনি স্বপ্নেও এটির কূল-কিনারা খুঁজে পাবেন না। আর এইটাই এইসব বিষয়ে খুব বেশি মন্তব্য না করার পেছনকার মূল কারণ। আমি শুধু ভাবি এগুলো আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার-স্যাপার এবং এইসব বিষয়ে আনমনে চিন্তা করা কিংবা সেগুলো নিয়ে কবিতা লেখা কিংবা অন্যকিছু করা হয়তো উত্তম কাজ হবে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে এগুলো স্বাভাবিকভাবেই কোনো বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের বিষয় নয়।
“এনার্কিজম” ও “লিবার্টারিয়ানিজম”
নারী কণ্ঠ: অধ্যাপক চমস্কি, একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ, আপনি সচরাচর “বিশৃঙ্খলা” নামক যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন তার থেকে “এনার্কি” শব্দটার অর্থ আলাদা।
চমস্কি: হ্যাঁ। এটি মূলত একটি অর্থহীন প্রলাপ। এটি অনেকটা সোভিয়েত ঢং এর আমলাতন্ত্রকে “সমাজতন্ত্র” নামে ডাকার মতো কিংবা মতাদর্শিক লড়াইয়ের স্বার্থে কোনো ডিসকোর্সের একটি শব্দবন্ধের দ্বিতীয় অর্থ দাঁড় করানোর মতো ব্যাপার। আমি বলতে চাচ্ছি যে এনার্কি শব্দটার একটি অর্থ “বিশৃঙ্খলা” কিন্তু সমাজ বিষয়ক চিন্তাধারায় এই অর্থের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। সামাজিক দর্শন হিসেবে এনার্কি বলতে কখনোই “বিশৃঙ্খলা” বুঝায় না। প্রকৃতপক্ষে, এনার্কিস্টরা অত্যন্ত সংঘবদ্ধ সমাজে বিশ্বাস করে। এমন একটি সমাজ যা নিচ থেকে গণতান্ত্রিকভাবে সংগঠিত।
নারী কণ্ঠ: আমার মনে হয় সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে এনার্কিজম এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হাজির করেছিল যে শব্দটিতে কালিমা লেপন করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। জনতার সমগ্র শব্দভাণ্ডার ও চিন্তা–ভাবনা থেকে শব্দটিকে গায়েব করার প্রয়োজন পড়েছিল যাতে শব্দটি শোনার সাথে সাথে তাদের চোখে মুখে ভয়ের প্রতিফলন ঘটে।
চমস্কি: হ্যাঁ, ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট লোকেরা এনার্কিজমকে সবসময়ই চরম অশুভ বলে বিবেচনা করেছে। তাই উড্রো উইলসনের লাল আতঙ্কের(যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১৯ সালে পরিচালিত “নাশকতা” বিরোধী অভিযান) সময় তারা সমাজতন্ত্রীদের ব্যাপারে কঠোর ছিল কিন্তু খুন করেছিল এনার্কিস্টদের। এটি সত্যিই দুঃসংবাদ ছিল।
দেখেন, মানুষ স্বাধীন জীবনযাপন করবে এই ধারণা ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট যেকোনো ব্যক্তির জন্য অতীব ভয়ানক ব্যাপার। এই কারণে ১৯৬০ সালের কুখ্যাতি আছে। ষাটের দশক নিয়ে বিপুল সাহিত্য রয়েছে এবং তার অধিকাংশই লিখিত হয়েছে বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা কারণ তারাই সেই বর্গের লোক যারা বইপত্র লিখেন। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই এটির দুর্নাম ছিল কারণ তারা এদের ঘৃণা করত। সেই সময়কার ফ্যাকাল্টি ক্লাবের দিকে নজর দিলে ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। শিক্ষার্থীরা কেবল অনুকরণ না করে কেন প্রশ্ন করতে শুরু করেছে সেইটা ভেবে ভেবে তারা প্রায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এমনকি অ্যালান ব্লুমের (দ্য ক্লোজিং অব দ্য অ্যামেরিকান মাইন্ড-এর লেখক) মতো লোকেরা এমনভাবে লিখেছে যেন ষাটের দশকে সভ্যতার ভিত্তিগুলো ধ্বসে পড়ছিল। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে তা ঠিক-আসলেই ধ্বসে পড়ছিল। কারণ তাদের কাছে সভ্যতার ভিত্তি হচ্ছে “আমি একজন বড় মাপের অধ্যাপক এবং আমি বলে দিব তোমরা কী বলবে, কী ভাববে আর সেইটাই তোমরা নোটবইয়ে টুকে নিবে এবং একই কাজ বারংবার করতে থাকবে”। যদি আপনি দাঁড়িয়ে বলে বসেন যে “আমার মাথায় ঢুকে না কেন আমাকে প্ল্যাতো পড়তে হবে, আমার কাছে এটি অর্থহীন বস্তু মনে হয়” তাহলে তা সভ্যতার ভিত্তিকে ধ্বংস করছে। কিন্তু এটি সম্ভবত যথেষ্ট বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রশ্ন- প্রচুর সংখ্যক দার্শনিক এই প্রশ্ন করেছেন সুতরাং কেন এটি একটি বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রশ্ন হবে না?
ষাটের দশকে সংঘটিত প্রত্যেক জনপ্রিয় আন্দোলনগুলোর সাথে সাথে বিপুল সংখ্যক পাগলাটে কিসিমের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু পাগলাটে কিসিমের ঐ ঘটনাগুলোই একমাত্র ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছে। সেই সময়কার মূল ঘটনাগুলোকে ইতিহাস থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে কারণ সেইগুলোতে লিবার্টারিয়ান বৈশিষ্ট্য ছিল এবং ক্ষমতাবান লোকদের কাছে এর চেয়ে ভীতিকর আর কিছু নেই।
পুরুষ কণ্ঠ: “লিবার্টারিয়ান” ও “এনার্কিস্ট” ব্যক্তিবর্গের মধ্যে মূল পার্থক্যটা কী?
চমস্কি: আসলে তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমি মনে করি তারা একই বস্তু। কিন্তু আপনি যুক্তরাষ্ট্রে “লিবার্টারিয়ান” শব্দটার বিশেষ অর্থ খুঁজে পাবেন। এই ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র মূল ধারার অনেক বাইরে অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রে যেটিকে “লিবার্টারিয়ানিজিম” বলা হয় তা আসলে অবাধ পুঁজিবাদ। ইউরোপীয় লিবার্টারিয়ান ধারা সর্বদাই এটির বিরোধীতা করেছে যেখানে প্রত্যেক নৈরাজ্যবাদী একজন সমাজতন্ত্রী। এই বিরোধীতার কারণ হচ্ছে অবাধ পুঁজিবাদ আপনার আয়ত্তে আসা মানে আপনি সমস্ত কর্তৃত্বের মালিক-আপনি সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ।
পুঁজির ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণ মানেই হচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য আমজনতাকে নিজেদের ভাড়ায় খাটাতে হবে। আপনি হয়তো বলতে পারেন যে, “তারা নিজেদেরকে স্বেচ্ছায় ভাড়া দেয়, এইটা একটা স্বাধীন চুক্তি”। কিন্তু এইটা আসলে তামাশা। “আমি যা বলি তাই করো নাহলে ক্ষুধায় মরবে”- এমন যদি হয় বাছাই করার শর্ত তাহলে এটি আদতে বাছাই করার অধিকার না। আঠারো-উনিশ শতকে শ্রম দাসত্ব/মজুরি দাসত্ব বলে সাধারণত যা পরিচিত ছিল এটি প্রকৃতপক্ষে সেই বস্তুই।
“লিবার্টারিয়ানিজম” এর আমেরিকান সংস্করণ মূল বিচ্যুত হওয়া সত্ত্বেও কেউ আসলে এটিকে গুরুত্বসহকারে নেয় না। আমার কথার মানে হচ্ছে আমেরিকান লিবার্টারিয়ান নীতিতে চালিত কোনো সমাজ তিন সেকেন্ডে নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবে এই বিষয়ে সকলে অবগত। লোকে এইটাকে গুরুত্বসহকারে নেয়ার ভান করে কারণ এটিকে আপনি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন। যেমন ধরুন, কেউ যখন করের পক্ষে কথা বলতে আসবে তখন আপনি বলতে পারবেন- “না, আমি একজন লিবার্টারিয়ান এবং আমি করের বিপক্ষে” কিন্তু তবুও আমি সরকারের রাস্তা নির্মাণ, স্কুল বানানো, লিবিয়ানদের হত্যা ইত্যাকার সমস্ত কার্যক্রমকে সমর্থন করি।
মুরে রোথবার্ড(আমেরিকান একাডেমিক) এর মতো কনসিসটেন্ট লিবার্টারিয়ানরাও আছেন। আপনি যদি তাদের বর্ণিত জগতের কথা পড়েন তাহলে দেখবেন সেই জগত এত ঘৃণায় পূর্ণ যে কোনো মানুষই সেখানে বাস করতে চাইবে না। এ এমন এক জগত যেখানে রাস্তা নেই কারণ আপনি যুক্তি খুঁজে পান না কোনো রাস্তা নির্মাণে কেন সহযোগিতা করবেন যে রাস্তা আপনি ব্যবহার করবেন না। আপনার যদি রাস্তার প্রয়োজন পড়ে তাহলে আপনি আরো একদল লোক যারা ঐ রাস্তা ব্যবহার করবে তাদেরকে নিয়ে রাস্তা বানাবেন। তারপর সেই রাস্তায় যাতায়াতের জন্য অন্য লোকের উপর কর ধার্য করবেন। আপনার যদি কারো মোটরগাড়ির দূষণ পছন্দ না হয় তাহলে আপনি সোজাসুজি আদালতে যান এবং তার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেন। এমন জগতে কেইবা থাকতে চাইবে? এটি ঘৃণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা এক জগত।২
পুরো ব্যাপারটি নিয়ে আলাপ করার কিছু নেই। প্রথমত এটি এক সেকেন্ডের জন্যও ঠিকঠাক কাজ করবে না। আর যদি কাজ করেও তাহলে আপনি যা কিছু করতে চাইতেন তা হচ্ছে সেখান থেকে কেটে পড়া কিংবা আত্মহত্যা করা কিংবা অন্যকিছু। কিন্তু এটি একটি বিশেষ আমেরিকান বিচ্যুতি। এটি আদৌ গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাপার নয়।
সচেতনতা ও কর্মতৎপরতা
পুরুষ কণ্ঠ: প্রচুর সংখ্যক এক্টিভিস্ট যাদের সঙ্গে আমি কাজ করি তারা সকলেই এই ধারণা নিয়ে কাজ করে যে শুধুমাত্র জনগণকে সচেতন করতে পারলেই সবকিছুর সমাধান বের হবে এবং কোনো না কোনো পরিবর্তন আসবে। পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিবাদে আমরা যখন নাগরিক অবাধ্যতার মতো কর্মসূচির প্রাক্কালে আমিও এমন ধারণাই পোষণ করতাম যে, এইসব প্রতিবাদ কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা জনগণের কাছে আমাদের বার্তা তুলে ধরতে পারব। কিন্তু মনে হচ্ছে আসলে এইটাই শেষ কথা নয়। শিক্ষার পাশাপাশি আর কী কী কর্মপন্থা দরকার বলে আপনি মনে করেন?
চমস্কি: শিক্ষা শুরুয়াদ মাত্র। তাছাড়া এমন পরিস্থিতিও আসবে যখন সবাই সচেতন হয়ে আপনার পক্ষে দাঁড়াবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা কিছুই করতে পারছে না। যেমন, হাইতির দিকে তাকান। হাইতির ৯০ শতাংশ লোক কী চায় সেইটা সম্পর্কে কেউ সন্দিহান বলে আমার মনে হয় না। তারা সেইটা সম্পর্কে অবগত। কিন্তু খুন হওয়া ছাড়া তাদের পক্ষে কোনকিছু করা সম্ভব না। সুতরাং আস্ত একটি ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে আপনাকে যেতে হবে এবং সেটার শুরু সচেতনতা দিয়ে। সচেতন না হয়ে আপনি কিছুই করবেন না। আপনার করণীয় কী সেইটা সম্পর্কে অবগত না হয়ে অবশ্যই কোনকিছু করতে যাবেন না। সংজ্ঞানুসারে এইটাই শুরুর কথা। কিন্তু প্রকৃত সচেতনতা আসে বিশ্ব সম্পর্কে চর্চা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। এমন নয় যে, আপনি প্রথম সচেতন হবেন তারপর কিছু করতে শুরু করবেন। আপনি সচেতন হয়ে উঠবেন আপনার কর্মপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
উদাহরণস্বরূপ, আপনি সংস্কারবাদী রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন সেইটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই। আমার অভিমত হচ্ছে, সকল সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা উচিত কারণ মাঝেমধ্যে জনগণের উপকারে আসে এমন কিছু হিতকর ফলাফলও পেতে পারেন। অনতিবিলম্বে আপনি সীমাবদ্ধতাগুলোকে সনাক্ত করতে পারবেন এবং বুঝতে পারবেন সীমাবদ্ধতার সূত্রগুলো। আপনি এমন সচেতনতা অর্জন করবেন যা বক্তৃতা শুনে অর্জন করতে পারবেন না। আমার কথার মানে হচ্ছে ক্ষমতা কিভাবে কাজ করে সে সংক্রান্ত সমস্ত পছন্দসই বক্তৃতা আপনি শুনতে পারেন কিন্তু আপনি তখনই খুব দ্রুত শিখতে পারবেন যখন প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার মুখোমুখি হবেন, বক্তৃতা শোনা ছাড়াই। সুতরাং সচেতনতা ও কর্মতৎপরতার মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে এবং পরিবর্তনের স্বার্থে আপনাকে সহিংস বিপ্লবী সংগ্রামের মতো পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন হতে পারে। যেমন ধরুন, হাইতির জনগণ যদি সেইখানকার মিলিটারিকে উৎখাত করার মতো শক্তিশালী কোনো অবস্থানে থাকত তাহলে তাদের তাই করা উচিত ছিল বলে আমার অভিমত। কখনো-সখনো এমন পরিণতিই ঘটে।
ব্যক্তিগত অভিমত ব্যক্ত করছি, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিবাদে নাগরিক অবাধ্যতা প্রদর্শনী বিক্ষোভগুলো সম্পর্কে আমার কতিপয় বন্ধুর সাথে আমার অনেক মতানৈক্য ছিল। প্লাউশেয়ারসে (নিরস্ত্রীকরণ ইস্যুতে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী এক দল মানুষ) যে মানুষগুলো সম্পৃক্ত ছিল তাদের মতো মানুষদেরকে আমি আসলেই শ্রদ্ধা করি। আমি মনে করি এই সবই হচ্ছে কৌশলগত দিক। যেমন কোনো মিসাইলের সম্মুখশঙ্কু থেঁতলে দিবেন কি না সেইটার সাথে কোনো মূলনীতির প্রশ্ন জড়িত বলে আমি মনে করি না। এটি আপনার ও ঈশ্বর কিংবা অন্যকিছুর মধ্যবর্তী চুক্তির মতো কোনো ব্যাপার নয়। মূল প্রশ্নটি হচ্ছে, এই কর্মসূচি কী কী প্রভাব ফেলেছে? সেই বিষয়ে আমার ভাবনা হচ্ছে প্রভাবগুলো ছিল নেতিবাচক। আমার মনে হয় তারা যে কর্মসূচি নিয়েছিল তার প্রভাবগুলো হচ্ছে- প্রথমত, রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়া কারণ তারা বিশ বছরের জন্য কারাবরণ করতে যাচ্ছিল এবং একই সাথে আদালতের পেছনে অঢেল অর্থ ও শ্রম নষ্ট করতে যাচ্ছিল যেটি সবচেয়ে জঘন্য স্থান। আমি বলতে চাচ্ছি, যেহেতু আদালতের পেছনে আপনাকে অঢেল সময়, শ্রম ও অর্থের অপচয় করতে হচ্ছে সুতরাং আদালতের বাইরে থাকতে পারলেই আপনার সৌভাগ্য। দ্বিতীয়ত, আমি মনে করি না যে তাদের বার্তা জনগণ অব্দি পৌঁছাতে পেরেছিল কারণ তারা এটির জন্য আগে থেকে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেনি। এমন কোনো শহর কল্পনা করুন যার বাসিন্দাদের মিসাইল তৈরির কারখানায় কাজ করা ব্যতীত জীবিকা নির্বাহের অন্য কোনো রাস্তা নেই এবং কেন আমাদের মিসাইলের দরকার নেই সেই বিষয়ে তারা ওয়াকিবহাল নয়। সেই শহরে যদি আপনি মিসাইলের সম্মুখশঙ্কু থেঁতলে দেয়ার মতো কর্মসূচি পালন করেন তাহলে এমন কর্মসূচি শহরের বাসিন্দাদের আদৌ কোনো বার্তা দিবে না বরং তাদেরকে ক্ষিপ্ত করে তুলবে।
সুতরাং আমার মনে হয় এই কৌশলগত দিকগুলো নিয়ে খুব সতর্কভাবে ভাবতে হবে। অধিক নিশ্চয়তার সহিত আপনি কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবেন না। তবে আপনার গৃহীত কৌশলের কী প্রভাব পড়তে পারে তা আপনাকে আন্দাজ করতে হবে। সেই প্রভাব যদি হয় সচেতনতা তৈরি তাহলে ভালো। কিন্তু সচেতনতা শুরুয়াত মাত্র কারণ সচেতন হওয়ার পরও লোকে কোনকিছু নাও করতে পারে। যেমন তারা হয়তো চাকরি হারানোর ভয়ে ভীত। এই দুশ্চিন্তার জন্য আপনি অবশ্যই তাদের সমালোচনা করতে পারেন না। তাদের বাচ্চাকাচ্চা আছে এবং তাদেরকে খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে। এই ভাবনা যথেষ্ট যুক্তিসম্মত। আপনার অধিকার অর্জনের জন্য লড়াই করা কঠিন। সেজন্য আপনাকে প্রায়শই ভুগতে হবে।
পারমাণবিক অস্ত্রবিরতি আন্দোলন
নারী কণ্ঠ: যে সংগঠনগুলো সঠিক পথে যাচ্ছে না বলে আপনি মনে করেন সেই সংগঠনগুলোর কাছ থেকে আমরা কী শিখতে পারি বলে আপনার ধারণা?
চমস্কি: আচ্ছা। আমাদের চারপাশে বিপুল সংখ্যক গোষ্ঠী আছে যাদের কাজকর্ম আমার কাছে খুব গঠনমূলক মনে হয় না। যদিও আমি সেগুলোর কোন কোনটার সদস্য এবং তাদেরকে বিভিন্ন প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করি। উদাহরণস্বরূপ পারমাণবিক অস্ত্রবিরতি সংক্রান্ত প্রচারাভিযানের কথাই ধরুন। আমার সত্যিই মনে হয়েছিল যে তারা ভুল পথে এগুতে যাচ্ছে। পারমাণবিক অস্ত্রবিরতি সংক্রান্ত প্রচারাভিযান এক অর্থে ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ও সংগঠিত জনপ্রিয় আন্দোলনগুলোর একটি। তারা এমন এক সময় পারমাণবিক অস্ত্রবিরতির পক্ষে ৭৫ শতাংশ আমেরিকান জনগণের সমর্থন আদায় করতে পেরেছিল যখন কোনো সংবাদপত্র, কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি কেউই প্রকাশ্যে এই আন্দোলনের সমর্থনে প্রচার চালায়নি।৩ সেই অর্থে এটি একটি বিস্ময়কর অর্জন ছিল। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এটি কোনো অর্জন ছিল বলে আমি মনে করি না। আমার মনে হয়েছিল যে অস্ত্রবিরতি আন্দোলন ভেঙে পড়তে যাচ্ছে এবং সত্যিই তা ভেঙে গেল। আর এই আন্দোলন ভেস্তে যাওয়ার কারণ হলো এটির অন্য কোনো ভিত্তি ছিল না শুধুমাত্র পিটিশনে স্বাক্ষর করা ছাড়া।
আমার কথার মানে হচ্ছে, আপনারা পিটিশনে স্বাক্ষর নিয়েছেন, সে ভালো কথা। কিন্তু ঐটাই আন্দোলনের সমাপ্তি ছিল। আপনারা বাড়ি ফিরে গেলেন এবং আগের মতো প্রাত্যহিক কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সেটির কোনো ধারাবাহিকতা ছিল না, কোনো প্রকার প্রকাশ্য বা লিখিত অঙ্গীকার ছিল না। এটি এমন কোনো টেকসই কর্মতৎপরতা ছিল না যা সক্রিয় কোনো কমিউনিটি গড়ে তুলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে আমি যে সকল ভয়ঙ্কর/অপ্রীতিকর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখি সেগুলো এই ধরনের।
তবে আমাদের যদি সুপ্রতিষ্ঠ জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান থাকত তাহলে আমরা কিভাবে ব্যর্থ হয়েছিলাম তা স্মরণ করতে পারতাম। অন্য কাউকে একই কাজ আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হতো না এবং একই ভুল করতে হতো না। আমাদের জানা উচিত যে এটি কোনো কিছু করার আসল তরিকা নয়। পারমাণবিক অস্ত্রবিরতি আন্দোলন মূলত জনতার মতামত গ্রহণ ও দানের সমার্থক হয়ে উঠল। তারা লক্ষ করল যে যত সংখ্যক লোক পারমাণবিক অস্ত্র খাতে সরকারের অর্থায়ন চায় তার চেয়ে তিনগুণ লোক চায় চিকিৎসা ও অন্যন্য খাতে সরকার এই টাকা ব্যয় করুক। তাতে কি? তারা এই বিষয়ে কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছিল? কিছুই না। সুতরাং পারমাণবিক অস্ত্রবিরতি আন্দোলনের সাথে যে লোকজন যুক্ত ছিল তারা শুধুমাত্র মতামত প্রদানের মাধ্যমে তাদের কাজ শেষ করল। এটিকে সংগঠিত করা বলে না।
আমার মনে হয় এমন বহু অপ্রীতিকর কর্মকাণ্ড আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত কোথাও পৌঁছাতে দেয়নি। আসলে এরূপ কর্মকাণ্ড আন্দোলনকে নিঃশেষ করেছে। আমি বলতে চাচ্ছি- আপনারা এত মানুষ পেলেন যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিল এবং তারা প্রচুর খেটেছে। তারা এত পরিমাণ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিল যে আপনারা চাইলে এটিকে দেশের প্রায় সবাই পারমাণবিক অস্ত্র বিরতি চায় বলে দেখাতে পারতেন। তারপর তারা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কনভেনশনে (১৯৮৪ সালে) গেল এবং তাদের আন্দোলনের ফলাফলগুলো তুলে ধরল। সেখানে উপস্থিত সকলেই বলল, “বিস্ময়কর! এটি আসলেই চমৎকার যে আপনারা এই কাজটি করেছেন। আমরা সব উপায়েই আপনাদেরকে সাহায্য করব।” অতঃপর ডেমোক্র্যাটরা নির্বাচন লড়তে গেল এবং আর কখনোই অস্ত্র বিরতির কথা উচ্চারণ করেনি। শুধুমাত্র যে কতিপয় শহরে এই প্রসঙ্গ তুললে সহজে কিছু ভোট আদায় করা যাবে সেখানে গিয়ে বক্তৃতাবাজি করেছে—আপনারা জানেন “আমরা এই শহরে এসেছি আবার স্মরণ করিয়ে দিতে যে আপনারা এই কথাগুলো বলতে চান…”। এই প্রকার কর্মকাণ্ড জনগণকে হতাশ করেছে এবং আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে। ক্ষমতা কিভাবে কাজ করে এবং কিভাবে আপনি পরিবর্তনকে প্রভাবিত করবেন ইত্যাদি সম্পর্কে বিভ্রম নিয়ে শুরু করার কারণেই এই মাশুল দিতে হয়েছে। আমাদের অবশ্যই এই সংক্রান্ত বিভ্রম থাকা উচিত না, যেমনটা থাকা উচিত না সংবাদমাধ্যমগুলো আমাদেরকে ঠিক তথ্য দিচ্ছে কি না সেই সম্পর্কেও। আপনি যদি ভ্রমে না থাকেন তাহলে আপনাকে ব্যর্থতার আগুনে পুড়ে খাক হতে হবে না। আমরা এই সকল ভ্রম মুক্ত হতে পারি আমাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নতিসাধনের মাধ্যমে যেখান থেকে আমরা এরূপ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে শিক্ষা নিতে পারব।
বিশাল এক সাংগঠনিক প্রয়াস যেখানে প্রত্যেকেই পিটিশনে স্বাক্ষর করেছে এবং কিছু লোক এই ইস্যুকে ১৯৮৪ সালের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্ল্যাটফর্মে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে কিন্তু তাতে আদৌ কোনো প্রভাব পড়েনি; তার ঠিক এক বছর পর মিখাইল গর্বাচেভ (সোভিয়েত নেতা) এক তরফা পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করলেন এবং তারপরও কোনো প্রভাব পড়ল না। এইসব দেখার পর আমাদের উচিত ছিল সেখান থেকে কিছু শিক্ষা নেয়া।৪ তারপর পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্রবিরতি আন্দোলনের সংগঠকরা এমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সংগঠকদের প্রতিক্রিয়া এমন ছিল না যে, “আচ্ছা, আমরা সম্ভবত ব্যাপারটা কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে ভুল বুঝেছি” বরং প্রতিক্রিয়া ছিল এমন, “আমরা ঠিক কাজটাই করেছিলাম কিন্তু আমরা আংশিকভাবে ব্যর্থ হয়েছি—আমরা জনগণকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছি কিন্তু এলিটদেরকে বুঝাতে সক্ষম হইনি। সুতরাং চলুন এবার এলিটদেরকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি”। আপনারা জানেন, “আমরা বিভ্রান্ত কৌশল বিশ্লেষকদের সাথে কথা বলব—আমরা যা বুঝি তা তারা বুঝতে পারছে না। আমরা তাদেরকে ব্যাখ্যা করে বলব কেন পারমাণবিক অস্ত্রবিরতি আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে”। প্রকৃতপক্ষে অনেকগুলো অস্ত্রবিরতি আন্দোলনের পরিণতি এমনই হয়েছিল—জনগণ আন্দোলন থেকে সটকে পড়ল এবং তারা ম্যাকআর্থার ফেলোশিপ ও ইত্যাকার শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে কৌশল বিশ্লেষকদের “বুঝাতে” চারদিকে বেরিয়ে পড়ল।৫
এটি সে উপায়গুলোর একটি যার মাধ্যমে আপনারা এখনো কিছু করছেন এমনটা বিশ্বাস করার জন্য ধাপ্পাবাজি করতে পারেন যখন নাকি আপনারা আসলে ঘুষ প্রাপ্ত। কারণ এলিটরা এইটা বলতেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে- “ওহ, আসুন, আমাকে রাজী করান”। এই ব্যাপারটাই আপনাদেরকে সংগঠিত হওয়া এবং জনগণকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখে। এটিই আন্দোলনের ভাঙ্গন ঘটাচ্ছে কারণ আপনি এখন কতিপয় এলিট ভদ্রলোকদের সাথে আলাপ পাড়ছেন এবং এই কাজ আপনি সারাজীবন করে যেতে পারবেন। পারমাণবিক অস্ত্রবিরতির পক্ষে আপনাদের দেয়া একটা যুক্তির জবাবে তারা আপনাদেরকে পাল্টা আরেকটা যুক্তি দিবে এবং এটি শুধু চলতেই থাকবে। আপনারা এমন মাননীয়দেরও নাগাল পাবেন যারা আপনাদেরকে হার্ভার্ড ফ্যাকাল্টি ক্লাবে মধ্যাহ্নভোজের জন্য দাওয়াত দিবে। প্রত্যেকেই আপনাদের কথা মন দিয়ে শুনবে এবং আপনাদেরকে সমাদর করবে। সবকিছুই চমৎকার মনে হবে। পারমাণবিক অস্ত্রবিরতি আন্দোলনটি প্রকৃতপক্ষে এই অভিমুখেই ধাবিত হয়েছিল এবং এটি ছিল একটি ভুল। ইত্যাকার ভুল-ভ্রান্তি সম্পর্কে আমাদের সজাগ থাকতে হবে এবং সেগুলো থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আপনারা এলিট সার্কেলে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছেন মানে এই সম্ভাবনা প্রবল যে আপনারা ভুল কিছু করছেন। খুব সাধারণ কারণেই। যারা তাদের ক্ষমতাকেই মাটি চাপা দিতে চাচ্ছে তাদেরকে তারা সমীহ করবে কেন? তার কোনো মানে হয় না।
প্রতিরোধ বিষয়ক শিক্ষা
নারী কণ্ঠ: সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে কাজ করে এবং তারা কিভাবে জনগণকে নিজেদের ভালো-মন্দ স্বাধীনভাবে চিন্তা-ভাবনা করা থেকে বিরত রাখে- ইত্যাকার ধারণাগুলো যাতে জনগণ বুঝে উঠতে পারে সেজন্য কোথা থেকে শুরু করা উত্তম বলে আপনি ভাবেন?
চমস্কি: আচ্ছা। সত্য হচ্ছে এগুলোর কোনটিই খুব কঠিন কিছু বলে আমার মনে হয় না। বুদ্ধিজীবীরা সহজ কথা কঠিন করে বলার ক্যারিরায় গড়ে তুলেন কারণ তাঁদেরকে যেসব কাজের জন্য মাইনে দেওয়া হয় এই কাজ তার অংশ বিশেষ। কিন্তু প্রকৃত সত্য এই যে, সামাজিক পৃথিবীর যদ্দুর আমরা বুঝতে পারি তা অল্পবিস্তর আমাদের সামনে ও পেছনে বিরাজমান। চোখের ঠুলি একটু আলগা করলেই দেখা যায়। আপনার একক প্রয়াসে এই পৃথিবীকে বুঝে উঠা বড়ো কঠিন। তবে যে ধরনের পারস্পারিক আদান-প্রদান ও সংঘবদ্ধ কর্ম তৎপরতার কথা আমরা আলাপ করছি সেগুলোর মাধ্যমে খুব সহজেই বুঝে উঠতে পারবেন।
সুতরাং জনগণের সাথে মোলাকাত কিংবা আলাপ করার সুযোগ হলে যে কাজটি আপনি করতে পারেন তা হচ্ছে- তাদের নিজেদের ভাল-মন্দ অনুসন্ধান করার তরিকা আত্মস্থ করতে সাহায্য করা। যেমন, প্রচারমাধ্যম ম্যানিপুলেশন ও নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে যে তরিকায় বিভিন্ন ইস্যুকে আকার-আকৃতি দেয় তা যাতে তারা নিজে নিজেই বুঝতে পারে সে ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন। এটি কিভাবে কাজ করে সে সংক্রান্ত কিছু তত্ত্ব আওড়ানোর মতো বিমূর্ত ধারণা দেয়ার কোনো মানে হয় না। যে কাজটি আপনার করা উচিত তা হচ্ছে সে সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করা।
সুতরাং যে ঘটনাগুলোর প্রতি জনগণের আগ্রহ আছে সে ঘটনাগুলোকে বেছে নিন এবং কিভাবে গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করবেন সে সম্পর্কে তাদেরকে শিক্ষা দিন। গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করা খুব সহজ, সেজন্য আপনাকে পিএইচডি করার দরকার নেই। পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণা করতে গেলে হয়তো প্রয়োজন পড়বে কিন্তু এই সকল বিষয়ে তার কোনো দরকার নেই। শুধুমাত্র আপনার কমনসেন্সের দরকার পড়বে। আপনার কমনসেন্স থাকতে হবে এবং আপনাকে তথ্যগুলোর দিকে সতর্ক দৃষ্টিপাত করতে হবে। সেগুলোর ভেতর থেকে সত্য উদঘাটন করতে হয়তো একটু কষ্ট করতে হবে কারণ সচরাচর আপনি পত্রিকার শিরোনাম কিংবা অন্যকিছুতে সেই প্রকৃত তথ্যগুলো খুঁজে পাবেন না। কিন্তু আপনি যদি একটু কষ্ট করেন তাহলে প্রকৃত তথ্যগুলো জানতে পারবেন। প্রতিষ্ঠানগুলো সেই সত্যগুলোকে কিভাবে বিকৃত ও পরিবর্তন করেছে তা বুঝতে পারবেন। তৎক্ষণাৎ সে সকল বিকৃতির উদ্দেশ্য আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
পুরুষ কণ্ঠ: একজন শিক্ষক কিংবা সংগঠক হিসেবে জনগণের আগ্রহ উদ্দীপিত করার জন্য কোনটি সর্বশ্রেষ্ঠ পথ তা বুঝা কঠিন। কিন্তু কিছু করা থেকে বিরত থাকার জন্য অসংখ্য পথ আছে, এমনকি আপনি যখন কিছু করার জন্য হাজির হচ্ছেন তখনও। নাগরিক অবাধ্যতা বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরে আগে আপনি প্রতিরোধ বিষয়ক বক্তৃতা দেয়া লোকদের কথা উল্লেখ করেছেন। এটি আমার কাছে কিছু না করেও কিছু করার ভান ধরার মতো ঠেকে।
চমস্কি: আচ্ছা। জনগণকে উদ্দীপিত করার জন্য এটি কোনো কাজের কাজ না সে রকমটা ভাবতে আমি আসলে রাজি নই। যেমন, আমি মনে করি যে জনগণকে প্রতিরোধ বিষয়ক শিক্ষা দেয়ার মতো অনেক ব্যাপার স্যাপারও আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে সে সকল মানুষের কাছে শুনতে চাই যারা সেই সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। তাদের মাথায় হয়তো সেই সংক্রান্ত এমন অনেক চিন্তাধারা আছে যা আমার মাথায় নেই। আপনি যদি একে “বক্তৃতাবাজি” বলতে চান তাতেও আমার আপত্তি নেই। কিন্তু এটি অবশ্যই ভুল নয় যে দুনিয়াতে বহু জিনিস আছে যা আপনি অন্য লোকের কাছ থেকে শিখতে পারেন, যারা সেই সব ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করেন এবং যাদের সেইসব ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে।
পুরুষ কণ্ঠ: তাছাড়া জনগণকে প্রতিরোধ ও এক্টিভিজম বিষয়ে শিক্ষা দিতে আমাদেরকে কোন বিষয়গুলো মাথায় রাখা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
চমস্কি: প্রথমত, আমি মনে করি আপনার উচিত নয় জনগণকে ভুল পথে পরিচালিত করা। তাদেরকে এইটা বুঝানো উচিত যে তারা যদি স্বাধীন চিন্তক হতে চায় তাহলে তাদেরকে সেজন্য সম্ভবত মাশুল দিতে হবে। মানে হচ্ছে, প্রত্যেককেই পৃথিবীটা কিভাবে চলে সেই সংক্রান্ত বোঝাপড়া দিয়েই শুরু করা উচিত- এই পৃথিবী সততা ও স্বাধীনতাকে আদৌ পুরস্কৃত করে না বরং পুরস্কৃত করে আনুগত্য ও দাসত্বকে। এই পৃথিবী কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার এবং যারা ক্ষমতাবান তারা আদৌ সেই সকল মানুষকে পুরস্কৃত করবে না যারা ঐ ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে। সুতরাং শুরুতেই কাউকে এই বিষয়ে ভুল ধারণা দেয়া উচিত না।
এই বিষয়ে বোঝাপড়া হওয়ার পর আপনি আপনার পছন্দসই পথ বাছাই করুন। আপনাকে কী ধকল পোহাতে হবে তা সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্ত্বেও আপনি যদি যে কোনো উপায়ে স্বাধীন হতে চান তাহলে আপনার সেই পথেই পা বাড়ানো উচিত এবং আপনি সেই চেষ্টাই করুন। কিন্তু আপনি যে পথ বেছে নিচ্ছেন কোনো কোনো সময় তা চরম বন্ধুর প্রতিপন্ন হতে পারে। যেমন ধরুন, একজন বয়োজ্যেষ্ঠ লোক হিসেবে তরুণ-তরুণীরা প্রায়শই আমাকে চেপে ধরেন উপদেশ দেয়ার জন্য। এমন কোনো সিদ্ধান্ত দিতে আমি সর্বদা খুব বিব্রত বোধ করি (যদিও আমি মাঝেমধ্যে এমন পরিস্থিতির শিকার হই যে আমাকে বাধ্য হয়ে উপদেশ দিতে হয়) কারণ আমি কে কী সিদ্ধান্ত নিবে সেইটা বলে দেয়ার মতো কোনো অবস্থানে নেই। কিন্তু যে কেউ যে কাজটা করতে পারে বলে আমি মনে করি তা হচ্ছে জনগণকে রূঢ় বাস্তবতাগুলো বুঝতে সাহায্য করা।
দেখুন, আপনি এক্টিভিজমের মাধ্যমে অনেক কিছুই হয়তো অর্জন করতে পারবেন যেমনটা আপনারা সবাই একটু আগে বলছিলেন। কিন্তু এমন অনেক জিনিসও আছে যা আপনি হারাতে পারেন এবং সেই সব জিনিসের কোন কোনটা আদৌ অগুরুত্বপূর্ণ নয়। যেমন ধরুন, নিরাপত্তা-এটি কোনো তুচ্ছ ব্যাপার নয়। আর কে কী করতে যাচ্ছে সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ই তার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ বিবেচনায় নিতে হবে।
নেতা ও আন্দোলন
নারী কণ্ঠ: একজন এক্টিভিস্ট হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সবাইকে এই সত্য উপলব্ধি করানো যে আমরা এইসব এক্টিভিজমে আনন্দ পাই এবং আমাদের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা ঋদ্ধ হয়ে উঠি। আমরা যদি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা মাথায় রেখে সেই ধরনের সংগঠন গড়ে তুলতে চাই যে ধরনের সংগঠনের কথা আপনি বলছেন তাহলে আমাদেরকে অধিক পরিকল্পিত হতে হবে অনেকটা সদস্য সংগ্রহের মতো। প্রায়শই “এক্টিভিস্ট” বলতে জনগণের চোখে যে প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে তা হচ্ছে সর্বদা পুড় খাওয়া কোনো মানুষ। আমাদের এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে যেটি জনগণের কাছে আকর্ষণীয় ও উদ্দীপক ঠেকবে যাতে এমনটি মনে না হয় যে আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু র্যাডিকাল স্লোগানগুলোই জপে যাচ্ছি।
চমস্কি: দেখুন, যে মানুষজন সত্যিকার অর্থে সামাজিক আন্দোলনগুলো সফল করেছিল তারাও এইসব কাজ করেছিল বলে আমার ধারণা। তাদেরকে ইতিহাস থেকে বাদ দেয়া হয়েছে- কোনো বইয়েই তাদের নামোল্লেখ করা হয়নি, সামাজিক আন্দোলনগুলোকে সত্যিকার অর্থে যারা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই দিয়েছিল তাদের নাম কেউই জানে না। কিন্তু সবসময় এমন ঘটনাই ঘটেছে বলে আমার ধারণা।
এমনকি ১৯৬০ সালের যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলনের মতো সাম্প্রতিক সময়ের আন্দোলগুলোর ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারগুলো সত্য। ইদানিংকালে এমন অসংখ্য বই বের হচ্ছে যা আপনাকে তথ্য দিবে এস. ডি. এস. (স্টুডেন্টস ফর অ্যা ডেমোক্রেটিক সোসাইটি) এর কার্যালয়ে কী ঘটেছিল কিংবা এক ভদ্রলোক অপর ভদ্রলোককে কী বলেছিল। কিন্তু ষাটের দশকে সংঘটিত যুদ্ধ বিরতি আন্দোলন কেন এত ব্যাপক গণ আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল সেইটা সম্পর্কে মাথা ঘামানোর বিন্দুমাত্র প্রয়োজন অনুভব করেনি। আমার ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি কারা সেই আন্দোলনগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এবং তাদের কথা আমার মনে আছে। আমার মনে আছে এই শিক্ষার্থীরাই বিক্ষোভ কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নে কঠোর পরিশ্রম করেছিল এবং সেই কারণেই আমি সেখানে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। তারা অন্য লোকদেরও সম্পৃক্ত করার জন্য সেখানে নিয়ে আসছিল। তারা তাদের কাজকর্ম উপভোগ করছিল এবং সেই ব্যাপারে অন্য লোকদের সাথেও কোনো না কোনোভাবে বার্তা আদান-প্রদান করছিল। এইগুলোই জনপ্রিয় আন্দোলনগুলোকে সফল করেছিল। কিন্তু এইটা নিশ্চিত যে এই সবই ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাবে-রয়ে যাবে শুধু উপরে ভেসে থাকা ফেনাগুলো।
পুরুষ কণ্ঠ: মার্টিন লুথার কিং কিংবা মহাত্মা গান্ধীর মতো বিখ্যাত পরিবর্তনকামী নেতাদের নিয়ে আপনার ভাবনা জানতে আগ্রহী। আপনার বক্তৃতায় কখনো তাঁদের নামোল্লেখ করেছেন বলে মনে হয় না, কেন?
চমস্কি: আচ্ছা। মার্টিন লুথার কিং এর কথাই ধরা যাক। দেখুন, মার্টিন লুথার কিং একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু তিনি পরিবর্তনের বড় কোনো প্রতিনিধি ছিলেন বলে আমি মনে করি না। বরং মার্টিন লুথার কিং পরিবর্তন আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পেরেছিল কারণ পরিবর্তনের প্রকৃত প্রতিনিধিরা ব্যাপক কর্মযজ্ঞে লিপ্ত ছিলেন। আর তাঁরাই ছিলেন পরিবর্তনের প্রকৃত প্রতিনিধি যারা তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করছিলেন। উদাহরণ হিসেবে এস. এন. সি. সি. (স্টুডেন্ট ননভায়োলেন্ট কোঅর্ডিনেটিং কমিটি) এর কর্মীদের কথা বলা যায়।
দেখুন, আমজনতাকে ক্ষমতাহীন করে রাখার পুরো প্রক্রিয়ার অন্তর্গত কৌশল হচ্ছে পরিবর্তনের প্রকৃত প্রতিনিধিদের ইতিহাস থেকে ছুঁড়ে ফেলা এবং তাঁদের কৃতিত্বকে কখনোই সেই সংস্কৃতিতে স্বীকৃতি না দেয়া। তাই ইতিহাস বিকৃত করার প্রয়োজন পড়ে যেন ইতিহাসের সব অর্জনকেই মহামানবদের কৃতিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। এইটা সেই দীক্ষায়ন প্রক্রিয়ার অংশ যা আমজনতাকে এই শিক্ষা দেয় যে তারা অক্ষম, তারা অসহায় এবং তাদেরকে এমন কোনো মহামানবের জন্য অপেক্ষা করতে হবে যিনি তাদের হয়ে কার্য সম্পাদন করে দিয়ে যাবে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত নাগরিক অধিকার আন্দোলনগুলোর দিকে তাকান। উদাহরণস্বরূপ রোজা পার্কসের কথাই ধরুন যিনি ১৯৫৫ সালে জাতিগত/বর্ণ বৈষম্যের প্রতিবাদে মন্টগোমারি বাস বয়কট আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল। রোজা পার্কসের গল্পটা এমন- এই নির্ভীক কালো নারী হঠাৎ একদিন সিদ্ধান্ত নিল যে, “অনেক সহ্য করেছি, আর নয়। আমি আর বাসের পেছনের সিটে বসব না।” সে ভালো কথা কিন্তু এইটা অর্ধসত্য। রোজা পার্কস এমন এক সুসংগঠিত কমিউনিটি থেকে উঠে এসেছিল যার অতীত খুঁড়লে কমিউনিস্ট পার্টি, হাইল্যান্ডার স্কুল (রাজনৈতিক সংগঠকদের শিক্ষাদান করার জন্য তৈরি একটি টিন্নিস স্কুল) ও ইত্যাকার প্রতিষ্ঠানের যোগসূত্র পাওয়া যাবে।৬ কিন্তু এটি এমন এক কমিউনিটি যার বাসিন্দারা একত্রিত হয়ে কাজ করছিল এবং এই বর্ণ-বৈষম্যমূলক সিস্টেমকে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্তে ছিল সংকল্পবদ্ধ। রোজা পার্কস সেই পরিকল্পনার কেবলমাত্র একজন প্রতিনিধি ছিল।
আর এইসব কাহিনী ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি। ইতিহাসে যা ঠাঁই পেল তা হচ্ছে এক ব্যক্তির সাহসী কীর্তিকলাপ। কিন্তু তা তাঁর একক প্রয়াসে হয়নি। কোনো মানুষই নিজের একক প্রয়াসে কিছু করে ফেলে না। রোজা পার্কস প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মানুষের এক সুসংগঠিত কমিউনিটি থেকে উঠে এসেছিল, যারা দীর্ঘদিন যাবৎ এক হয়ে কাজ করে যাচ্ছিল পরিবর্তনের স্বার্থে। আর এইভাবেই সর্বদা আন্দোলনগুলো সফল হয়েছে।
মার্টিন লুথার কিং এর বেলায়ও এই কথা সত্য- তিনি জনসম্মুখে এসে বক্তৃতা দিতে পেরেছিলেন কারণ এস. এন. সি. সি., ফ্রিডম রাইডার্স ও অপরাপর সংগঠনের কর্মীরা পূর্বেই এই ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল। সেজন্য তাদেরকে নির্মম নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল ঢের সুবিধাপ্রাপ্ত তরুণ-তরুণী। মনে রাখবেন, তারা এই পথ স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিল, বাধ্য হয়ে এই পথে আসেনি। তারাই ছিল নাগরিক অধিকার আন্দোলনের চালিকা শক্তি। মার্টিন লুথার কিং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিল কারণ উনি সেখানে উঠে দাঁড়াতে পেরেছিল এবং ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল। কিন্তু বাকি লোকেরাই ছিল নাগরিক অধিকার আন্দোলনের মূল স্রোত। আমি নিশ্চিত যে উনিও প্রসঙ্গক্রমে একই কথা বলতেন কিংবা অন্ততপক্ষে এইটুকু বলা উচিত ছিল।
গান্ধীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। তাঁর সম্পর্কে আসলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষেরাই গান্ধীর এই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠার ভিত্তি প্রস্তুত করতে কাজ করেছিল এবং এক প্রকার তাঁর ভাবনা প্রচারে সহায়তা করেছিল। আপনি যদি অপরাপর জনপ্রিয় আন্দোলনগুলোর দিকে তাকান তাহলে একই জিনিস দেখতে পাবেন বলেই আমার ধারণা।
অহিংসা
পুরুষ কণ্ঠ: চমস্কি সাহেব, আমরা কর্পোরেট পুঁজিবাদকে অহিংস পন্থায় কিন্তু খুবই দৃঢ় ও সুসংঘবদ্ধ প্রতিরোধের মাধ্যমে বিকল করে দিতে পারব এবং বিকল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার দখল নিয়ে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে পারব–এই আশা সবসময়ই লালন করেছি। আমি বিস্ময় নিয়ে জানতে চাচ্ছি, অহিংস পন্থায় এমন আশাবাদ ব্যক্ত করাকে আপনি আদৌ বাস্তবসম্মত মনে করেন কি? সহিংসতার সর্বজনীন ব্যবহার সম্পর্কে আপনার ভাবনা কী?
চমস্কি: আচ্ছা। যেমনটা আমি বলি- কেউই আসলে কৌশল/উপায় সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানে না। অন্তুতপক্ষে আমি জানি না। কিন্তু আমি মনে করি এই অহিংসা প্রশ্নে আপনাকে সবিস্তারে ভাবতে হবে। আমি বলতে চাচ্ছি যে, যদি সম্ভব হয় প্রত্যেকেই অহিংসভাবে সব কিছু সম্পাদন করার চেষ্টা করে। তাহলে সহিংসতার দরকারটাইবা কি? কিন্তু আপনি যখন ক্ষমতাকে আক্রমণ করা শুরু করবেন তখনই আপনার অধিকারগুলোকে আগলে রাখার প্রয়োজন পড়বে এবং অধিকারগুলোকে রক্ষা করার প্রয়োজনেই আপনার মাঝেমধ্যে সহিংসতার দরকার পড়বে। তারপর আপনি সেটা ব্যবহার করবেন কি করবেন না সেইটা নির্ভর করবে আপনার নৈতিক মূল্যবোধের উপর।
আমেরিকার শ্রমিক ইতিহাসের দিকে তাকান। এই শতকের প্রথমার্ধে শত শত আমেরিকান শ্রমিকদেরকে খুন করেছিল নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। শুধুমাত্র তাদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য।৭ যুক্তরাষ্ট্রের অস্বাভাবিক সহিংস শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস রয়েছে। কার্যত এতই সহিংস ছিল যে আপনি যদি ১৮৯০ সালের ডানপন্থী বৃটিশ সংবাদ মাধ্যমগুলোতে নজর দেন- যেমন লন্ডন টাইমস এর মতো ডানপন্থী বৃটিশ সংবাদপত্রগুলো কখনোই বুঝতে পারেনি আমেরিকান শ্রমিকদের সাথে কি নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছিল। শ্রমিকদেরকে যে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল তাও তারা বুঝতে চায়নি।৮ এইটা এই কারণে নয় যে শ্রমিকরা সহিংস আচরণ করতে শুরু করেছিল বরঞ্চ এই কারণে যে ক্ষমতাবান লোকেরা সহিংস পন্থায় তাদের ক্ষমতা আগলে রাখছিল। আর এই ক্ষমতাই শ্রমিক জনতাকে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিল।
আপনি যদি শান্তিবাদী কিংবা এমন কিছু হয়ে থাকেন তাহলে আপনাকে এই মুহূর্তে এসে নিজেকেই কিছু প্রশ্ন করতে হবে- জনগণকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে আক্রান্ত করা হলে জনগণ কি নিজেদের রক্ষার্থে পাল্টা বল প্রয়োগ করতে পারবে? এইটা ঠিক যে এই ক্ষেত্রে মানুষের মূল্যবোধের তফাৎ থাকতে পারে কিন্তু আপনাকে অন্ততপক্ষে এই প্রশ্নগুলো করতে হবে।
আমার নিজস্ব অভিমত হচ্ছে যে, জনপ্রিয় আন্দোলনগুলোতে প্রচুর পরিমাণে কর্মকৌশল পরীক্ষা করে দেখা উচিত। এমনকি আন্দোলনকারীদের চোখে যা অহিংস ঠেকেছে তাও সহিংস হয়ে উঠতে পারত। উদাহরণস্বরূপ, আমার কাছে যে ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে তা হলো একটি রাজনৈতিক দল গঠন, যা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারত এবং জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারত। শুধুমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থে গড়া কোনো দল নয়। আমার কথার মানে, এইটা নিশ্চয়ই বোধগম্য যে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলোর মতো একটি দল সেখানে থাকতেই পারত। কিন্তু এমন কোনো দল যদি কখনো ক্ষমতাপ্রাপ্ত হতো তাহলে সমাজের ক্ষমতাবান জনগণ সেইটার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত নিজেদেরকে প্রতিরক্ষার তাগিদে। সেই মুহূর্তে প্রত্যেককেই সিদ্ধান্ত নিতে হতো- নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য আপনি কি সহিংসতার ব্যবহার করবেন কি করবেন না? লক্ষ করুন, সহিংসতা সাধারণত ক্ষমতাবানদের দিক থেকে আসে। লোকে হয়তো বিপ্লবীদের দিক থেকে ঘটা সহিংসতার কথা বলবে, কিন্তু এইটা সাধারণত এই কারণে যে তারা আক্রান্ত হয় এবং তারপর নিজেদের রক্ষার্থে তারা পাল্টা সহিংসতায় লিপ্ত হয়।
একই প্রশ্ন অন্য একটি ব্যাপারেও উঠে যেটি নিয়ে আলাপ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। তা হচ্ছে-বিকল্প প্রচার মাধ্যম গড়ে তোলা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণকারী সংগঠনগুলোর মধ্যে নেটওয়ার্ক স্থাপন করা, যা বিভিন্ন মতবাদে দীক্ষায়ন প্রকল্পের প্রভাব মোকাবেলা করতে আমজনতাকে ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করবে। যেমন, আমরা যে বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করছি। আবার কর্পোরেট শক্তির ভিত্তি ধ্বংস করতে গিয়ে ফলাফলগুলো যে মুহূর্তে পেতে শুরু করবেন ঠিক সেই মুহূর্ত পর্যন্ত আপনি অহিংস থাকতে পারবেন। তার ঠিক পরের মুহূর্তে আপনি আবিষ্কার করবেন যে আর অহিংস থাকা সম্ভব না। কারণ ধনীরা নিজেদের সাম্রাজ্য বাঁচাতে সহিংসতাসহ বিভিন্ন প্রতিরক্ষা কৌশল খুঁজে বের করবে। সুতরাং অহিংসা নিয়ে আলাপ পাড়া হয়তো সোজা কিন্তু সত্যিকার অর্থে পরম নীতি হিসেবে আমি নিজেই অহিংসাকে গ্রহণ করতে রাজি নই।
তবে সহিংসতাকে অতিক্রম করে যাওয়ার উপায়ও অবশ্যই আছে। যেমন ধরুন, যদি পর্যাপ্ত সংখ্যক লোক একত্রিত হয়ে কোনো ফ্যাক্টরির কর্তৃত্ব নিয়ে নিত তাহলে পুলিশ তাদেরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করত। কিন্তু পুলিশ ও সৈনিকরা যেহেতু তাদের মতোই মানুষ এবং যদি পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সংহতির ক্ষেত্র যথেষ্ট বিস্তৃত হতো তাহলে শেষপর্যন্ত তারাও বাধা প্রদান করত না। সুতরাং এক অর্থে আপনার প্রশ্নের একটি উত্তর হতে পারে কেবলমাত্র সংহতির পরিসর বাড়ানো, সংহতির ক্ষেত্র বিস্তৃত করা যাতে তারা অন্য কোনো জায়গা থেকে সৈনিক এনে সংঘবদ্ধ জনতাকে গুঁড়িয়ে দিতে না পারে। কিন্তু সেই কাজ কঠিন হবে আর আমাদেরকে সম্পূর্ণভাবে এটির সম্মুখীন হতে হবে। এটি আপনাআপনি হয়ে উঠবে না। সত্য হচ্ছে আমাদের আজকের সমাজ ঘৃণার ভিত্তিতে এত স্তরে স্তরায়িত ও বিভাজিত যে আপনাকে দমন করতে আগ্রহী লোক খুঁজে পেতে এলিটদের বেশি দূর যেতে হবে না।
কিন্তু ঐ পরিস্থিতিরও পরিবর্তন হতে পারে। আসলে এটিকে পরিবর্তন করতে হবে। কারণ জনপ্রিয় ধাঁচের আন্দোলনগুলো কতদূর পর্যন্ত সহিংসতার মাধ্যমে আন্দোলন টিকিয়ে রাখতে সক্ষম তার একটি বাস্তব সীমা থাকে। আমি মনে করি, যে মুহূর্তে প্রতিরোধের জন্য বন্দুকবাজি ও যুদ্ধবিগ্রহের প্রয়োজন পড়বে সম্ভবত সেই মুহূর্তে যেকোন বিপ্লবী ক্রমবিকাশের অধঃপতন ঘটবে এবং যেকোন বাস্তব পরিবর্তনের সম্ভাবনা ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হবে। সুতরাং আমি মনে করি এই আশার বাস্তবায়ন চূড়ান্তভাবে অধিকতর আন্তর্জাতিক সংহতির মধ্যে অন্তর্নিহিত। আপনি নিজের দেশের ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষদের সাথে কী আচরণ করছেন তার রাজনৈতিক আবেদনের উপরও নির্ভর করে।
পুঁজিবাদের সীমা ছাড়িয়ে
পুরুষ কণ্ঠ: পুঁজিবাদের খপ্পর থেকে মুক্তি কিংবা পুঁজিবাদের সাথে যোগসূত্র বিচ্ছেদ সংক্রান্ত আপনার মন্তব্যের সূত্র ধরেই আমি জানতে চাচ্ছি যে, পুঁজিবাদের জায়গায় আপনি কোন কার্যকর প্রকল্প হাজির করবেন?
চমস্কি: আমি?
পুরুষ কণ্ঠ: কিংবা যারা এই প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিচালনা করার মতো অবস্থানে আছেন তাদেরকে আপনি কী পরামর্শ দিবেন?
চমস্কি: আচ্ছা। শতবর্ষ আগেও যাকে “মজুরি দাসত্ব/শ্রম দাসত্ব” বলা হতো তাকে আমি দুর্বিষহ মনে করি। আমি মনে করি না যে, বেঁচে থাকার জন্য মানুষের জোর করে নিজেদেরকে ভাড়া খাটানো আবশ্যক। আমি মনে করি যে, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালনা করা উচিত এবং অবশ্যই সেই প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গ ও তারা যেখানে বসবাস করে সেখানকার কমিউনিটিগুলোর তত্ত্বাবধানে। বিভিন্ন প্রকার স্বাধীন সংঘ ও ফেডারিলজমের সাহায্যে এমন একটি কার্যকর সমাজ কল্পনা করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। আমার কথার মানে হচ্ছে, এমন একটি সমাজ ব্যবস্থার বিস্তারিত সাজ-সজ্জা আপনি হাজির করতে পারবেন না। কেউই এত করিতকর্মা নন যে কোনো সমাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ নকশা এঁকে ফেলতে পারবে। আপনাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এগুতে হবে। কিন্তু এমন একটি সমাজ কোন যুক্তিসঙ্গত মূলনীতির উপর ভিত্তি করে নির্মিত হবে তা বেশ স্পষ্ট।
পুরুষ কণ্ঠ: পরিকল্পিত অর্থনীতিতে (Planned economies) গৃহীত অধিকাংশ প্রয়াসই এক প্রকার গণতান্ত্রিক আদর্শ ও তার প্রতিষ্ঠাতাদের বিপক্ষে গিয়েছে।
চমস্কি: এটি আসলে নির্ভর করে আপনি কোন পরিকল্পিত অর্থনীতির কথা বলছেন তার উপর। অসংখ্য পরিকল্পিত অর্থনীতির নজির আছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রও পরিকল্পিত অর্থনীতির একটি উদাহরণ। আমাদের অর্থনীতি নিয়ে কথা বলার সময় আমরা “মুক্ত বাজার” অর্থনীতির কথা বলি কিন্তু ঐটা স্রেফ ধোঁকাবাজি। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির যে অংশটি আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রতিযোগিতামূলক তা ঐ পরিকল্পিত অংশটিই। পুঁজি-নির্ভর কৃষি (মাত্রাধিক্য ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার গদি হিসেবে যার একটি রাষ্ট্র প্রতিশ্রুত বাজার আছে) কিংবা উচ্চ-প্রযুক্তিসম্পন্ন শিল্প কারখানা (যেটি পেন্টাগন সিস্টেমের উপর নির্ভরশীল) কিংবা ঔষুধ শিল্পের (যেটি ব্যাপকভাবে জন-অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণার ভর্তুকিপ্রাপ্ত) মতো রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি প্রাপ্ত অর্থনীতির এই অংশটিই ঠিকঠাক কাজ করছে।৯
আপনি পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে তাকান যাদেরকে সফল বড় অর্থনীতি দেশ হিসেবে ধরা হয়। মুক্ত-বাজার গণতন্ত্রের সফল উদাহরণ হিসেবে যাদেরকে নিয়ে সবাই আলোচনা করে, প্রকৃতপক্ষে তাদের সাথে মুক্ত-বাজার গণতন্ত্রের সামান্যতম যোগসূত্রও নেই। আনুষ্ঠানিকভাবেই বলছি, তারা হচ্ছে ফ্যাসিস্ট; তাদের অর্থনীতি রাষ্ট্র-সংগঠিত অর্থনীতি যা কর্পোরেট শক্তির ছত্রছায়ায় পুঞ্জিভূত বৃহৎ কর্পোরেশনগুলোর সাথে সন্ধি করে চলে। এটি কোনো মুক্ত বাজারের নমুনা নয়, যথাযথভাবে বলতে গেলে এটি ফ্যাসিজম।
এই ধরনের পরিকল্পিত অর্থনীতি “কার্যকর”, অন্ততপক্ষে এটি কিছু না কিছু উৎপাদন করে। অন্যদিকে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি (Command economies) কার্যকর নয় কিংবা ভিন্নভাবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, সোভিয়েত যুগে পূর্ব ইউরোপের পরিকল্পিত অর্থনীতি ছিল অতিমাত্রায় কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত ও আমলাতন্ত্র নির্ভর এবং তা ঠিকঠাক কাজ করেনি যদিও তারা জনগণের জন্য যৎসামান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রদান করেছিল। কিন্তু সেই সমস্ত সিস্টেমগুলো প্রচণ্ড গণতন্ত্র বিরোধী ছিল। যেমন, সোভিয়েত ইউনিয়নে সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কার্যত কোনো কৃষক কিংবা শ্রমিক যুক্ত ছিল না।
পুরুষ কণ্ঠ: কোনো আদর্শিক কার্যকর মডেল খুঁজে পাওয়া কঠিন।
চমস্কি: হ্যাঁ। কিন্তু আঠার শতকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির/রাজনৈতিক গণতন্ত্রের কোনো কার্যকর মডেল খুঁজে পাওয়াও কঠিন ছিল। তার মানে এটি প্রমাণিত হয় না যে তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। উনিশ শতকে এসে এটির অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল। মানব ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটেছে বলে যদি আপনি মনে না করেন তাহলে এইটা বলা খোঁড়া যুক্তি হবে না যে “এটি কাছেপিঠে নয়”। আপনি দু’শ বছর পেছনে যান। সেই সময় এটি কল্পনা করাও দুরূহ ছিল যে দাসত্বের বিলুপ্তি ঘটবে।
পাদটীকা
১. বেইলির মন্তব্যের জন্য দেখুন, Thomas A. Bailey, A Diplomatic History of the American People, New York: Appleton, 1969 (eighth edition). His exact words (p. 163):
The ending of the Napoleonic nightmare thus left the American people free to work out their own destiny with a minimum of foreign meddling. Responding to the robust new sense of nationalism engendered by the War of 1812, they turned their backs confidently on the Old World, and concentrated on the task of felling trees and Indians and of rounding out their national boundaries.
নেটিভ আমেরিকান গণহত্যা বিষয়ক বিদ্যায়তনিক জ্ঞানচর্চা সম্পর্কে জানতে দেখুন, U.P. –এর ৪র্থ অধ্যায় এবং এই অধ্যায়ের ফুটনোট ৭২ ও ৭৬।
২। রোথবার্ডের দৃষ্টিকল্পের নমুনার জন্য দেখতে পারেন Murray Rothbard, For a New Liberty, New York: Macmillan, 1973, especially chs. 10-13. An excerpt (pp. 202, 210, 214-216, 220-221, 229, 269-270):
Abolition of the public sector means, of course, that all pieces of land, all land areas, including streets and roads, would be owned privately, by individuals, corporations, cooperatives, or any other voluntary groupings of individuals and capital. . .. Any maverick road owner who insisted on a left-hand drive or green for “stop” instead of “go” would soon find himself with numerous accidents, and the disappearance of customers and users. . .. [W]hat about driving on congested urban streets? How could this be priced? There are numerous possible ways. In the first place the downtown street owners might require anyone driving on their streets to buy a license. . .. Modern technology may make feasible the requirement that all cars equip themselves with a meter. . .. Professor Vickery has also suggested . . . T.V. cameras at the intersections of the most congested streets. . ..
[I]f police services were supplied on a free, competitive market . . . consumers would pay for whatever degree of protection they wish to purchase. The consumers who just want to see a policeman once in a while would pay less than those who want continuous patrolling, and far less than those who demand twenty-four-hour bodyguard service. . .. Any police firm that suffers from gross inefficiency would soon go bankrupt and disappear. . .. Free-market police would not only be efficient, they would have a strong incentive to be courteous and to refrain from brutality against either their clients or their clients’ friends or customers. A private Central Park would be guarded efficiently in order to maximize park revenue. . .. Possibly, each individual would subscribe to a court service, paying a monthly premium. . ..
If a private firm owned Lake Erie, for example, then anyone dumping garbage in the lake would be promptly sued in the courts.
৩। যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫ শতাংশ জনগণ যে পারমাণবিক অস্ত্রবিরতির পক্ষে সমর্থন দিয়েছিল সে সম্পর্কে জানতে উদাহরণস্বরূপ দেখতে পারেন, Daniel Yankelovich and John Doble, “The Public Mood: Nuclear Weapons and the U.S.S.R.,” Foreign Affairs, Vol. 63, Fall 1984, pp. 33-46 (reporting public opinion poll findings).
৪। এক তরফা পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ সংক্রান্ত গর্বাচেভের ঘোষণা সম্পর্কে জানতে উদাহরণস্বরূপ দেখতে পারেন, Serge Schmemann, “Gorbachev Seeks To Talk To Reagan On Atom Test Ban,” New York Times, March 30, 1986, p. 1 (“Moscow announced a halt of its testing program last July, asking Washington to join in”).
৫। ১৯৮৫ সালের মার্চ মাসে ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স এন্ড ডিসআর্মমেন্ট স্টাডিস কর্তৃক পাঠানো তিন পৃষ্ঠার ফান্ডিং লেটারে অস্ত্রবিরতি আন্দোলনের প্রণিধানযোগ্য কতিপয় এক্টিভিস্টদের প্রতিক্রিয়া চিত্রায়িত হয়েছিল। ফান্ডিং লেটারটি ইনস্টিটিউটের পরিচালক র্যানডাল ফোর্সবার্গ কর্তৃক স্বাক্ষরিত ছিল। পারমাণবিক অস্ত্রবিরতি সংক্রান্ত প্রচার অভিযান সফল হওয়ার পেছনে যার কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি। সেই লেটার থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দিয়ে চমস্কি নিম্নোক্ত আলাপ করেছেন (Turning the Tide: U.S. Interventionism in Central America and the Struggle for Peace, Boston: South End, 1985, p. 188):
The Institute, which “launched the nuclear freeze movement in 1980,” accomplished what it set out to do: it educated the public to support a nuclear freeze. But this popular success did not lead to “a real electoral choice on the issue in 1984.” Why? Because of “expert opposition to the freeze,” which prevented Mondale [the Democratic candidate] from taking a supportive position. The conclusion, then, is that we must devote our efforts to “building expert support”: convincing the experts. This achieved, we will be able to move to a nuclear freeze.
৬। রোজা পার্কস ১৯৫৫ সালে হাইল্যান্ডার ফোক স্কুলে অনুষ্ঠিত বর্ণবিভেদলোপ বিষয়ক ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঐ একই বছর ডিসেম্বর মাসে মন্টমোগারি বাস বয়কট আন্দোলন শুরু হয়েছিল।
সাদা চামড়ার বিচ্ছিন্নদীদের দ্বারা আক্রান্ত হবার পর টিন্নিস কর্মকর্তারা ১৯৬২ সালে হাইল্যান্ডার স্কুল এবং “কমিউনিস্ট ট্রেনিং স্কুল” নামে অপর একটি স্কুল বন্ধ করে দিয়েছিল। তার পর পরই হাইল্যান্ডার রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন সেন্টার নামে নতুন একটি প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপিত হয়। হাইল্যান্ডার ছিল নানা প্রকার সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট সমিতির মিলনকেন্দ্র এবং এটির প্রতিষ্ঠাতারা “দক্ষিণের শিল্পশ্রমিক ও কৃষকদের সম্মিলনে সংগঠিত অদম্য ও বহুজাতিক আন্দোলনের সমর্থনে একটি র্যাডিকাল জোটের উত্থান ঘটবে বলে স্বপ্ন দেখেছিল”, যদিও “[এটির প্রতিষ্ঠাতা মাইলস] হর্টন কিংবা অন্যান্য ফ্যাকাল্টি মেম্বারদের কেউই কখনো চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি এবং কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেনি”। দেখুন- John M. Glen, Highlander: No Ordinary School, Knoxville: University of Tennessee Press, 1996, pp. 162-164, 54-55; Frank Adams, Unearthing Seeds of Fire: The Idea of Highlander, Winston-Salem, NC: John F. Blair, 1975.
হাইল্যান্ডার ও তার প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে মূল্যবান ও আগ্রহোদ্দীপক বই হিসেবে দেখতে পারেন- Myles Horton, The Long Haul: An Autobiography, New York: Teachers College Press, 1998.
৭। আমেরিকান শ্রমিক ইতিহাসে সহিংসতা প্রসঙ্গে, উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারেন, Patricia Cayo Sexton, The War on Labor and the Left: Understanding America’s Unique Conservatism, Boulder, CO: Westview, 1991, chs. 4, 6, and 7. উদ্ধৃতাংশ (pp. 55, 58, 65):
Labor everywhere has “war stories” to tell, but nowhere has the record been as violent as in the United States. . .. One review of some major U.S. strikes puts the figure at 700 dead and untold thousands seriously injured in labor disputes, but these figures, though impressive, include only strike casualties reported in newspapers between 1877 and 1968; and may therefore grossly underestimate the total casualties. (During the 1877-1968 period, state and federal troops intervened in labor disputes more than 160 times, almost invariably on behalf of employers.) In the seven years from 1890 to 1897, an estimated 92 people were killed in some major strikes, and from January 1, 1902, to September 1904, an estimated 198 people were killed and 1,966 injured. These casualties were overwhelmingly strikers killed or injured in some major strikes and lockouts. . .. After the adoption of some protective legislation, between 1947 and 1962, violence and militia intervention declined, but an estimated 29 people were killed in major strikes during the period, 20 of them in the South. By contrast, only 1 person in Britain has been killed in a strike since 1911. . ..
Over the years, labor espionage has been a large and profitable business. In April 1946, for example, some 230 agencies were in the business, the largest of them being William J. Burns’s International Detective Agency, Inc. (operating in forty-three cities) and [Allan] Pinkerton’s National Detective Agency, Inc. (operating in thirty-four cities). In just three top agencies, an estimated 135,000 men were employed at one point, operating in over 100 offices and more than 10,000 local branches, and earning some $65 million annually for the agencies. . .. [D]uring the 1930s the agencies charged employers an estimated $80 million a year. General Motors testified before the LaFollette [Congressional] committee that it paid about a million dollars to such agencies from January 1934 through July 1936. . .. The use of espionage agencies and professional strikebreakers has been almost unknown in European and other developed democracies.
John Streuben, Strike Strategy, New York: Gaer, 1950, pp. 300-309 (listing 143 deaths in the United States which were officially attributed to labor-management disputes between 1933 and 1949); David Montgomery, “Afterword,” in David Demarest, ed., “The River Ran Red”: Homestead 1892, Pittsburgh: University of Pittsburgh Press, 1992, pp. 225-228; Jeremy Brecher, Strike!, Cambridge, MA: South End, 1997 (revised and updated edition; original 1972)(a valuable U.S. labor history). আরো দেখতে পারেন Understanding Power বইয়ের ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের ফুটনোট ৩২ এবং ১০ম অধ্যায়ের ফুটনোট ৮১।
৮। বিগত উনিশ শতকের যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক ইতিহাসে শ্রমিকদের সহিংসতা প্রসঙ্গে বৃটিশ সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারেন, Patricia Cayo Sexton, The War on Labor and the Left: Understanding America’s Unique Conservatism, Boulder, CO: Westview, 1991, pp. 83, 100.
৯। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির ভূমিকা সম্পর্কে জানতে দেখুন U.P.–এর ৩য় অধ্যায় এবং এই অধ্যায়ের ফুটনোট ৩, ৪, ৭, ৮, ৯ ও ১০; U.P.-এর ৭ম অধ্যায় এবং এই অধ্যায়ের ফুটনোট ৩৮-৪৪, ৫১ ও ৫৩; এবং U.P.–এর ১০ম অধ্যায় এবং এই অধ্যায়ের ফুটনোট ২২ ও ২৩। আরো দেখুন U.P.–এর ২য় অধ্যায় এবং এই অধ্যায়ের ফুটনোট ৪ ও ৫।