× অনুবাদ: সহুল আহমদ
[অনুবাদকের মন্তব্য: বিখ্যাত মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক ও বিপ্লবী রোজা লুক্সেমবার্গের জন্ম ১৮৭১ সালের ৫ মার্চে, পোল্যান্ডের এক ইহুদি পরিবারে। কৈশোরেই রাজনীতির সাথে যুক্ত হন রোজা। ১৮৮৬ সালে পোলিশ প্রলেতারিয়েত পার্টির সদস্য হিসেবে কাজ করা শুরু করেন, কিন্তু তৎপরতার কারণে তৎকালে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে রোজা দেশ ছাড়েন ১৮৮৯ সালে। পাড়ি জমান সুইজারল্যান্ডে। ১৮৮৯ থেকে ১৮৯৭ সালে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন, ‘দি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অফ পোল্যান্ড’ শীর্ষক ডক্টোরাল থিসিস জমা দেন। কিন্তু ততদিনে তার তৎপরতা তাকে মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে পরিচিত করে তুলেছিল। ১৮৯৩ সালে জুরিখে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন।
১৯০৪ সালের দিকে, যখন বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধটি লেখেন, তখন রোজা লুক্সেমবার্গ মোটাদাগে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের জন্য পোলিশ ও রুশ বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছেন। ১৯০৩ সালে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টিতে মেনশেভিক ও বলশেভিকদের যে বিভাজন হয়েছিল সেটা বিশ্লেষণ করতে ইস্ক্রার সম্পাদকরা তাকে অনুরোধ করেন। জার্মান ভাষায় ১৯০৪ সালে তিনি Neue Zeit পত্রিকায় ‘রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেসির সাংগঠনিক প্রশ্নসমূহ’ শিরোনামে প্রবন্ধটি প্রকাশ করেন। এই প্রবন্ধ হচ্ছে সংগঠন বিষয়ে লেনিনের তত্ত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা। রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক আন্দোলনের ভেতর পার্টি সংগঠন ও গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা বিষয়ে যে তর্ক চলছিল তাতে এই প্রবন্ধ একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। রোজা এখানে বৈপ্লবিক পার্টির গঠন ও কেন্দ্রিকতা বিষয়ে লেনিনের অবস্থানের কড়া সমালোচনা হাজির করেন।
রোজা এই প্রবন্ধে সংগঠন সংক্রান্ত তার ভাবনা তুলে ধরেন। আলাপ শুরু করেন লেনিনের কেন্দ্রিকতাবাদ দিয়ে, এবং এটাকে সমালোচনা ও পর্যালোচনা করার মাধ্যমে তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি হাজির করেন। তৎকালে এক ধরনের নতুন সংগঠন, যা কিনা বিপ্লব সফল করবে, সে বিষয়ে প্রচুর আলাপ চলছিল। লেনিনের মতে, বিপ্লবী পার্টিকে আসলে শ্রমিকশ্রেণির ভ্যানগার্ড হতে হবে। তারাই নেতৃত্ব দিবে বিপ্লবে, শ্রমিকশ্রেণিকে তাদের ‘ঐতিহাসিক দায়িত্ব’ পালনে উদ্বুদ্ধ করবে। এই যে সংগঠন বা পার্টি হবে সেটাকে খুব কেন্দ্রীভূত হতে হবে, সামরিক বাহিনীর মতো এবং আমলাতান্ত্রিক। সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীয় কমিটির হাতে ন্যস্ত থাকবে। কেন্দ্রীয় কমিটিই সবকিছুর পরিকল্পনা করবে, বাদবাকি সবাই, সংগঠনের শাখা–প্রশাখা সকলেই কেবল সেই পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করবে। বিভিন্ন শাখা কমিটি গঠন, বিলুপ্তকরণ, নেতা নির্বাচন বা অপসারণ ইত্যাদি সকল কাজের দায়িত্ব থাকবে কেন্দ্রীয় কমিটির হাতে। কেন্দ্রে যা সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বাকিরা সেটাই বাস্তবায়িত করবেন, কীভাবে সেটা বাস্তবায়ন করা যায় সেই বিষয়ে আলাপ–আলোচনা করবেন। শ্রমিকশ্রেণির গণতন্ত্রের এইসব নিয়া ভাবনার সময় নেই। বরঞ্চ সংগঠনের আমলাতান্ত্রিকতা ও কেন্দ্রিকতাবাদ আদতে বৈপ্লবিক। রোজা এই প্রবন্ধে প্রধানত এই প্রস্তাবনা ও এর সাথে জড়িত মনোভঙ্গির সমালোচনা করেন। রোজা বৈপ্লবিক পার্টির জরুরতকে অস্বীকার করেন না, বরঞ্চ তিনি মানেন সেটা লাগবেই। কিন্তু লেনিন যে কেন্দ্রিকতার কথা বলেন, রোজা সেটা মানতে পারেন না। কারণ, রোজার মতে, লেনিন জনগণের সৃজনশীলতা ও স্বতঃস্ফূর্ততাকে যান্ত্রিক বানিয়ে তুলতে চান। লেনিন যে ‘সুবিধাবাদে’র ব্যাপক নিন্দামন্দ করেন, রোজার মতে, সেটা কেন্দ্রিকতার মাধ্যমে বরঞ্চ আরও ত্বরান্বিত হবে। রোজা তার দুই অধ্যায়ে এই অবস্থানকেই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। তিনি বরঞ্চ সংগঠনে ব্যাপক অংশগ্রহণ চান। তাতে ভুল হতে পারে, সুবিধাবাদও প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু সেটাকে কোনো গঠনতন্ত্র দিয়ে ঠেকানো যাবে না। ভুল ঠেকানোর জন্য যদি কঠিন কেন্দ্রীয় কমিটি গড়ে তোলা হয় তাহলে সেটা ভুল ঠেকানো দূরে থাক, উল্টো বৈপ্লবিক শ্রমিকশ্রেণির যে সজীবতা ও লড়াই করার যে স্পৃহা তাকেই গলা টিপে মেরে ফেলবে।
রোজার এমন ভাবনা মোটেই অকস্মাৎ নয়। লেনিনের সাথে তার এই দৃষ্টিভঙ্গিজনিত পার্থক্য একেবারেই মৌলিক এবং সেটা আজীবন ছিল। এই প্রবন্ধে যেমন ছিল, তেমনি ছিল শেষ দিন পর্যন্ত। রোজা বলশেভিক বিপ্লবের প্রশংসা করলেও সেখানেও তিনি এই বিষয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছিলেন। কয়েকটা বিষয়ে রোজার অগাধ বিশ্বাস ছিল, এগুলোই লেনিনের সাথে তার অবস্থানের ফারাক ঘটিয়েছে, এবং সারাজীবন সকল লেখাতেই বিষ্যগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায়। বিষয়গুলো হচ্ছে, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা, সৃজনশীলতা ও গণতন্ত্র। রাজনৈতিক আন্দোলনের বিকাশে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর রোজা জোর দিতেন। সেখানে শ্রমিকশ্রেণির বা প্রলেতারিয়েতের বা আমজনতার সৃজনশীল সত্তা এই আন্দোলনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যে লেনিনের কেন্দ্রিকতাবাদের সমালোচনা করেন সেখানেও এই দুটোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া। অর্থাৎ, কেন্দ্রিকতাবাদ জনগণের আন্দোলনের স্পৃহা, তাদের সৃজনশীলতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা সবকিছুকে দমিয়ে দিয়ে, কাগজ ও গঠনতন্ত্রের মাধ্যমে একটি কেন্দ্রীয় কমিটির খপ্পরে তুলে দেয়। ফলে রোজার চোখে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র অবিচ্ছেদ্য। তিনি অবশ্যই সমাজতন্ত্র চাইতেন কিন্তু, তার মতে, যতদূর পর্যন্ত গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকে বিস্তৃত করা যায় ততদূর ছাড়া তার সমাজতন্ত্র কায়েম হবে না। সকল ধরনের স্বাধীনতা, অর্থাৎ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা ব্যতীত সেই সমাজতন্ত্র কায়েম হবে না। তার চিন্তার এই কেন্দ্রীয় বিষয়গুলো লেনিনের সাথে তার ফারাকটা গড়ে দিয়েছিল, এবং সেটা এই প্রবন্ধ থেকে শুরু করে একেবারে শেষ দিন পর্যন্ত বহাল ছিল। তৎকালে তর্কে জিত বোধহয় লেনিনেরই হয়েছিল, (যেহেতু লেনিনের নেতৃত্বে বিপ্লব হয়ে গিয়েছিল), কিন্তু বিপ্লব পরবর্তী অভিজ্ঞতা, স্ট্যালিনবাদের আবির্ভাব, সোভিয়েতের পতন ইত্যাদিসহ আজ প্রায় ১০০ বছর পর আমাদের কাছে মনে হচ্ছে রোজাই বোধহয় সঠিক আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, বিপদ টের পেয়েছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংগঠন বিষয়ক আলাপ–আলোচনা একদম অনুপস্থিত। থাকলেও সেটা অল্প। সংগঠন বিষয়ে যে সকল ধারণা প্রবলভাবে রাজনৈতিক মানসজগতে বিরাজ করছে সেখানে লেনিনের সংগঠন বিষয়ক ভাবনার একচ্ছত্র আধিপত্য। কিন্তু এই ধরনের সাংগঠনিক মডেল আজ আর কাজ করছে না। এই মুহূর্তে সংগঠন বিষয়ে আমাদের নতুন নতুন আলাপ তোলা জরুরি। এই কথা মাথায় রেখেই রোজা লুক্সেমবার্গের প্রবন্ধটির অনুবাদ করা হয়েছে।
তৎকালে এই তর্কের আরও হদিস পাওয়া যেতে পারে লেনিনের হোয়াট ইজ টু বি ডান? এবং ওয়ান স্টেপ ফরোয়ার্ড, টু স্টেপস ব্যাক শীর্ষক রচনাতে। পাশাপাশি দেখা যেতে পারে ট্রটস্কির আওয়ার পলিটিক্যাল টাস্ক।
১৯০৪ সালে এটি প্রকাশিত হয় “Organizational Questions of the Russian Social Democracy” শিরোনামে। প্রকাশিত হয় Iskra এবং Neue Zeit–এ। পরবর্তীতে Marxism vs. Leninism নামে একটি পুস্তিকা আকারেও প্রকাশিত হয়। ১৯৩৪ সালে ইন্টেজারে প্রকাশিত হয় Revolutionary Socialist Organization শিরোনামে। ১৯৩৫ সালে Leninism or Marxism? শিরোনামে আরেকটি ফেডারেশন থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৬১ সালে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে বার্ত্রাম উলফের ভূমিকাসহ The Russian Revolution and Leninism or Marxism? শিরোনামে প্রকাশিত হয়; ১৯৭০ সালে পাথফাইন্ডার প্রেস থেকে প্রকাশিত রোজা লুক্সেমবার্গের আরেকটা সংকলনে “Organizational Questions of Social Democracy” শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
এখানে যে সংস্করণটি অনুবাদ করা হয়েছে তার মূল সূত্র হচ্ছে মার্ক্সিস্ট আর্কাইভ। তবে ২০০৪ সালে প্রকাশিত পিটার হুদিস এবং কেভিন বি এন্ডারসন সম্পাদিত দি রোজা লুক্সেমবার্গ রিডার–এর সংস্করণটিকেও অনুসরণ করা হয়েছে। কখনো কখনো ফুটনোটে বা বন্ধনীর ভেতর পার্থক্যসূচক মন্তব্যও জুড়ে দেয়া হয়েছে। তবে, এই দুটো সংস্করণকে পাশাপাশির রেখে আরও সম্পাদনার জরুরত রয়েছে।
রোজা লুক্সেমবার্গের এই লেখা প্রকাশিত হয়েছিল দুই অধ্যায়ে। রাষ্ট্রচিন্তা জার্নালের জন্য রোজার প্রথম অধ্যায়ের একটি খসড়া অনুবাদ করেছিলেন অনুবাদক মাজহার জীবন; কিন্তু তিনি আর কাজটা শেষ করেননি। এই অনুবাদে বিভিন্ন সময়ে তার খসড়া থেকে আমি সাহায্য নিয়েছি। তার প্রতি অন্তহীন কৃতজ্ঞতা। অনুবাদ করার সময় আরিফ রেজা মাহমুদ, সারোয়ার তুষার ও তানভীর আকন্দের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় সহযোগিতা নিয়েছি। তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা।]
মূল অনুবাদ
প্রথম অধ্যায়
সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ওপর এক নজিরবিহীন দায়িত্ব বর্তেছে। যে দেশে এখনো চরম ক্ষমতাধর রাজতন্ত্র প্রভাবশালী, সেখানে সর্বোত্তম সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক কৌশলগত নীতি [পলিসি] নির্ধারণ করাই হলো এর দায়িত্ব। [১৮৭৯–৯০ সালের দিকে জার্মানিতে যখন বিসমার্কের সমাজতন্ত্র বিরোধী আইন কার্যকর ছিল] জার্মানির তৎকালীন পরিস্থিতির সাথে বর্তমান রাশিয়ার পরিস্থিতিকে একই সমান্তরালে তুলনা করাটা ভুল হবে। দুই দেশেরই সাধারণ মিল হলো—পুলিশি শাসন। আর কোনো দিক থেকেই দু’দেশের তুলনা চলে না [বিশেষত রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে]।
গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার অনুপস্থিতিতে সৃষ্ট সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিবন্ধকতাগুলো গুরুত্বের দিক থেকে তুলনামূলকভাবে গৌণ। এমনকি রাশিয়ায় জনগণের আন্দোলন রাষ্ট্র কর্তৃক আরওপিত বাধাগুলো অতিক্রম করে সাফল্য লাভ করেছে। রাস্তায় বিশৃঙ্খলার মধ্যে জনগণ তাদের ‘গঠনতন্ত্র’ (কনস্টিটিউশন) খুঁজে পেয়েছে (যদিও তা অনিশ্চিত)। এই অবস্থা বজায় রেখে একদিন রাশিয়ার জনগণ একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ বিজয় অর্জন করবে।
রাশিয়াতে বুর্জোয়া আধিপত্য স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির আড়ালে কার্যকর; এই বাস্তবতাই রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক কার্যকলাপ পরিচালনার প্রধান সমস্যা। এই স্বৈরতান্ত্রিক আধিপত্য শ্রেণিসংগ্রামের সমাজতান্ত্রিক মতবাদের একটি বিমূর্ত প্রোপাগান্ডামূলক চেহারা প্রদান করে, এবং তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক অসন্তোষ বা বিক্ষোভকে একধরনের গণতান্ত্রিক–বৈপ্লবিক চেহারা প্রদান করে।
বিসমার্কের সমাজতন্ত্র বিরোধী আইনগুলো১ শ্রমিক আন্দোলনকে অতি উন্নত বুর্জোয়া সমাজে সাংবিধানিক চৌহদ্দির বাইরে নিয়ে এসেছে; যে বুর্জোয়া সমাজে শ্রেণিদ্বন্দ্ব ইতোমধ্যে সংসদীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সর্বোচ্চ বিরোধাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। [এখানেই বিসমার্কের পরিকল্পনার অর্থহীনতা নিহিত]। রাশিয়ার পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। ওখানকার সমস্যা হলো কীভাবে একটা সোস্যাল ডেমোক্রেটিক আন্দোলন গড়ে তোলা যায় যেখানে রাষ্ট্র এখনো বুর্জোয়াদের কব্জায় নেই।
এই পরিস্থিতির সাথে কেবল বিক্ষোভ এবং সমাজতান্ত্রিক মতবাদকে রুশ মাটিতে রোপনের পদ্ধতিই জড়িত নয়; বরঞ্চ এর সাথে পার্টি সংগঠনের প্রশ্নটিও বিশেষভাবে এবং সরাসরি সামনে চলে আসে।
সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক আন্দোলনে এমনকি সংগঠনকেও [সমাজতন্ত্রের পূর্বেকার ইউটোপিয়ান পরীক্ষা–নিরীক্ষা থেকে স্বতন্ত্র] প্রোপাগান্ডা/প্রচারণার একটি কৃত্রিম ফসল হিসাবে না দেখে বরঞ্চ শ্রেণিসংগ্রামের একটি ঐতিহাসিক ফসল হিসাবে দেখা হয়ে থাকে। সাধারণ পরিস্থিতিতে, যেখানে বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব [ডমিনেশন] সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের চেয়ে অগ্রগামী থাকে, সেখানে খোদ বুর্জোয়ারাই শ্রমজীবী শ্রেণির মাঝে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক সংহতির সূত্রপাত ঘটান। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর মতে, ‘এই পর্যায়ে শ্রমজীবীদের সংহতি তাদের নিজস্ব আকাঙ্ক্ষার ফসল নয়, বরঞ্চ এটা বুর্জোয়াদের কর্মকাণ্ডের ফলস্বরূপ।’ […যা কিনা নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রলিতারিয়েতদের বাধ্য করে…’]
তদপুরি, রাশিয়াতে সোশ্যাল ডেমক্রেসিকে নিজের প্রচেষ্টাতেই একটি সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক কালপর্ব মেরামত করতে হবে। রুশ প্রলেতারিয়েতদের বর্তমান যে ‘বিক্ষিপ্ত’ [atomized] অবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক জমানাকে দীর্ঘায়িত করছে সে অবস্থা থেকে তাদেরকে শ্রেণি সংগঠনে রূপান্তরিত করতে হবে। এটা তাদেরকে তাদের ঐতিহাসিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলবে এবং সেই উদ্দেশ্য হাসিল করতে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করে তুলবে।
একটি বুর্জোয়া–গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত যে ধরনের সুযোগ–সুবিধার নিশ্চিয়তা থাকে সেগুলো ছাড়াই রুশ সমাজতন্ত্রীদের এমন একটি সংগঠন নির্মাণের ভার গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অন্যান্য দেশের বুর্জোয়া সমাজ যে রাজনৈতিক রসদ যোগায় তা সেখানে থাকবে না। এভাবে বলা যায় যে, সর্বশক্তিমান ইশ্বরের মতো তাদেরকেও শূন্য থেকে এধরনের সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রস্তুতিমূলক পর্যায়ে সংগঠনগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলো সাধারণত বিচ্ছিন্ন স্থানীয় গোষ্ঠী/দল ও ক্লাব, এবং এদের প্রধান কর্মসূচি হচ্ছে প্রচারণা/প্রপাগান্ডা। প্রস্তুতি পর্যায়ের এই ধরনের সংগঠনগুলোকে কীভাবে এমন একটি বৃহৎ অখণ্ড জাতীয় কাঠামোতে রূপান্তর করা যায় যেগুলো কিনা রাশিয়া রাষ্ট্র শাসিত বিশাল অঞ্চলজুড়ে সমন্বিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য উপযুক্ত? এটাই হলো রাশিয়ার সোস্যাল ডেমোক্রোসির সুনির্দিষ্ট সমস্যা যা বেশ কিছুকাল ধরে আলোচিত হচ্ছে।
পুরনো সংগঠন সক্রান্ত ধারণার সর্বাধিক লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বায়ত্তশাসন [অটোনমি] এবং বিচ্ছিন্নতা [আইসোলেশন]। সুতরাং এটা বোধগম্য যে, যিনি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সংগঠন দেখতে চান তাঁর শ্লোগান কেন হয়ে যাচ্ছে ‘কেন্দ্রিকতাবাদ’ [সেন্ট্রালিজম’]। গত পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতির জন্য ইস্ক্রা২ যে দারুণ প্রচারাভিযান চালিয়েছে সেখানে কেন্দ্রিকতা ধারণার প্রতি সম্মতি বারংবার প্রকাশিত হয়েছে; এই ধারণা রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্রেটের পুরো তরুণ প্রজন্মকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পার্টি কংগ্রেসে৩ এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ‘কেন্দ্রিকতাবাদ’ প্রত্যয়টি রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেসির জন্য সংগঠন প্রশ্নকে পুরোপুরি আলাপে আনতে পারেনি। আমরা আবারও বুঝতে পারলাম যে, সামাজিক আন্দোলনে কোনো বাঁধাধরা নকশা [ফর্মূলা] যে কোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারে না।
ইস্ক্রা গ্রুপের অন্যতম সদস্য কমরেড লেনিন রচিত এক কদম আগে, দুই কদম পিছে৪ শীর্ষক গ্রন্থটি রাশিয়ার আন্দোলনের “অতি–কেন্দ্রীকতাবাদীদের” ধারণাগুলোর পদ্ধতিগত বর্ণনা। এই গ্রন্থে অতুলনীয় বলিষ্ঠ ও যুক্তি সহকারে নির্মম কেন্দ্রিকতাবাদের দৃষ্টিভঙ্গিকেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মূলনীতিগুলো হলো: ১) সকল সক্রিয় বিপ্লবীদের নিয়ে একটি আলাদা বাহিনী বাছাই ও গঠন করার জরুরত; এই অভিজাতদের [এলিট] চারপাশে থাকা অসংগঠিত কিন্তু বৈপ্লবিক সাধারণ জনগণ থেকে তারা আলাদা হবেন। ২) পার্টির সকল স্থানীয় কমিটিকে মনোনিত করার সুযোগ–সুবিধা কেন্দ্রীয় কমিটির হাতে থাকবে; সকল স্থানীয় কমিটির কার্যকর পদে নিয়োগ দেয়ার এখতিয়ার কেন্দ্রীয় কমিটির থাকবে; পার্টি পরিচালনার তৈয়ারি নিয়মকানুন সবার ওপর চাপিয়ে দেয়ার এখতিয়ারও কেন্দ্রীয় কমিটির হাতে থাকবে; এমনকি, স্থানীয় কমিটিগুলোর বিলুপ্তকরণ ও পুনর্গঠনের প্রশ্নে কোনো ধরনের আর্জির সুযোগ ছাড়াই কেন্দ্রীয় কমিটির কর্তৃত্ব থাকতে হবে। এভাবে কেন্দ্রীয় কমিটি তার প্রয়োজন অনুসারে পার্টির সর্বোচ্চ পর্যায়ে স্তর বিন্যাসে ভূমিকা রাখতে পারে। পার্টির মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটিই হবে একমাত্র চিন্তাশীল অংশ। বাকি সকল গ্রুপ হবে এর কার্যনিবাহী অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।
লেনিনের যুক্তি হচ্ছে যে, এমন কেন্দ্রীভূত ধরনের সংগঠনের সাথে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক গণআন্দোলনের সংমিশ্রণই বিপ্লবী মার্ক্সবাদের একটি নির্দিষ্ট নীতি। এই থিসিসের সমর্থনে তিনি একাধিক যুক্তি উপস্থাপন করেন। এই ব্যাপারটা আরও একটু গভীরভাবে দেখা যাক।
কোনো সন্দেহ নেই যে, সামগ্রিকভাবে কেন্দ্রিকতাবাদের দিকে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির একটি জোরালো ঝোঁক বা প্রবণতা রয়েছে। সোশ্যাল ডেমোক্রেসি যেহেতু তার এই ঝোঁকগুলো [কেন্দ্রিকতাবাদের ঝোঁক] সহ পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক জমিনে বেড়ে ওঠে এবং বৃহৎ কেন্দ্রীভূত বুর্জোয়া রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামোর [ফ্রেমওয়ার্ক] ওপর তার সংগ্রাম ভর করে, সেহেতু সোশ্যাল ডেমোক্রেসি অন্তর্নিহিতভাবে সকল ধরনের স্থানিকতা বা জাতীয় ফেডারেলিজমের বিরুদ্ধে অবস্থান করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতীয় রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে প্রলেতারিয়েতের শ্রেণিস্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করা এবং সকল স্থানীয় ও গোষ্ঠী স্বার্থের সাধারণ স্বার্থগুলোর বিরোধিতা করা। এটি সকল শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনকে একটি একক দলে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে, তা তাদের মধ্যে যতই জাতিগত, ধর্মগত বা পেশাগত ভিন্নতা থাকুক। অস্ট্রিয়ার মতো কিছু বিশেষ ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এই নীতির ব্যতিক্রম ঘটেছে।৫
এটা পরিষ্কার যে, রুশ সোশাল ডেমোক্রেসি নিজেকে অনেকগুলো জাতীয় গ্রুপ/দলের একত্রীভূত ফেডারেটিভ হিসাবে সংগঠিত করা উচিৎ নয়। বরঞ্চ তাকে পুরো সাম্রাজ্যের জন্য একটি একক পার্টি হয়ে উঠতে হবে। তদপুরি, এখানে বিবেচনাধীন প্রশ্ন এটি নয়। আমরা এখানে যা জিজ্ঞেস করছি তা হচ্ছে, এই বিশেষ পরিস্থিতিতে একীভূত ও একক রুশ পার্টির অভ্যন্তরে কেন্দ্রীয়করণের মাত্রা কদ্দূর পর্যন্ত জরুরি।
সোশ্যাল ডেমোক্রেসির যথাযথ কার্যক্রমের আঙ্গিক থেকে শ্রেণি সংগ্রামের একটি দল হিসাবে এর সক্ষমতাকে বিবেচনায় নিলে প্রথমেই প্রতীয়মান হয় যে, পার্টির ক্ষমতা ও শক্তি সরাসরি পার্টির কেন্দ্রীকরণের সম্ভাবনার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক পরিস্থিতিসমূহের প্রভাবের তুলনায় এগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি সমাজের ইতিহাসে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক আন্দোলনই প্রথম যা প্রত্যেক পর্যায়ে এবং সকল ক্ষেত্রে জনগণের সংগঠন এবং প্রত্যক্ষ ও স্বাধীন কার্যকলাপকে বিবেচনায় নেয়।
এই কারণেই সোশাল ডেমোক্রেসি এমন এক ধরনের সংগঠন তৈরি করে যা পূর্বতন বৈপ্লবিক আন্দোলনের সাধারণ সংগঠনের (যেমন জেকোবিন ও ব্লাঙ্কুইদের অনুসারী) চেয়ে পৃথক।
লেনিন বোধহয় এই বাস্তবতাকে অবজ্ঞা করতে চেয়েছেন যখন তিনি তার বইয়ে মন্তব্য করেন যে, বৈপ্লবিক সোশ্যাল ডেমোক্রেট ‘শ্রেণি সচেতন প্রলেতারিয়েতদের সংগঠনের সাথে যুক্ত একজন জেকোবিন’–এর চাইতে বেশি কিছু নয়। লেনিনের কাছে সোশাল ডেমোক্রেসি এবং ব্লাঙ্কুইজিমের৬ পার্থক্য এই জায়গায় নেমে এসেছে যে, মুষ্টিমেয় ষড়যন্ত্রকারীর পরিবর্তে আমরা শ্রেণি–সচেতন প্রলেতেরিয়াত পেয়েছি। তিনি ভুলে যান যে, এই পার্থক্য সংগঠন প্রশ্নে আমাদের ধারণাগুলোর সম্যক পুনঃপাঠের ইশারা দিচ্ছে; কেন্দ্রিকতাবাদ নিয়ে একেবারে নতুন ধরনের ধারণার ইশারা দিচ্ছে; এবং পার্টি ও সংগ্রামের মধ্যকার বিদ্যমান সম্পর্ক বিষয়ে একেবারে ভিন্ন ধারণার ইশারা দিচ্ছে।
ব্লাঙ্কুইজম শ্রমিক শ্রেণির প্রত্যক্ষ সংগ্রাম বা অংশগ্রহণকে আমলে নেয় না। ফলে বিপ্লবের জন্য তাকে জনগণকে সংগঠিত করতে হয় না। বিপ্লবের মূহূর্তেই কেবল জনগণ তাদের ভূমিকা পালন করবে বলে ধরে নেয়া হয়। বিপ্লবের প্রস্তুতির ভার কেবল ছোট একটি সশস্ত্র বিপ্লবী দলের, যারা ক্যু করবে। বস্তুত বৈপ্লবিক ষড়যন্ত্র সফল করার জন্য ধরে নেয়া হয়েছিল যে ষড়যন্ত্রকারীদের থেকে জনগণকে দূরে রাখাই শ্রেয়। এমন সম্পর্ক কেবল ব্লাংকুইবাদীরাই গ্রহণ করতে পারতেন, কেননা তাদের সংগঠনের ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার সাথে জনগণের নিত্যদিনের সংগ্রামের কোনো ঘনিষ্ঠ সংযোগ নেই।
ব্লাংকুইস্ট বিপ্লবীদের কৌশল ও তৎপরতার সাথে প্রাথমিক শ্রেণি সংগ্রামের সংযোগ খুব কমই ছিল। তারা মুক্তভাবে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই কাজ করতে পারতেন। ফলে তারা আগ থেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে একটি রেডিমেড পরিকল্পনার রূপ নিতে পারেন। এর ফলে, সংগঠনের সাধারণ সদস্যরা কেবল সাধারণ কার্যনিবাহী অঙ্গে পরিণত হন; তাদের কর্মকাণ্ডের পরিসরের বাইরে পূর্ব নির্ধারিত ইচ্ছা/সিদ্ধান্তের আদেশ পালন করাই হয়ে উঠে তাদের কাজ। তারা কেন্দ্রীয় কমিটির হাতিয়ারে পরিণত হন। এখানে আমরা ষড়যন্ত্রমূলক কেন্দ্রিকতাবাদের দ্বিতীয় বিশেষত্ব খুঁজে পাই: কেন্দ্রের ইচ্ছার কাছে পার্টির বিভিন্ন অংশের চরম ও অন্ধ সমর্পণ, এবং সংগঠনের সকল অংশে এই কর্তৃত্বের সম্প্রসারণ।
কিন্তু সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে [র্যাডিক্যালি] আলাদা পরিস্থিতিতে পরিচালিত হয়। ঐতিহাসিকভাবে এর উত্থান ঘটে প্রাথমিক শ্রেণি সংগ্রাম থেকে। এর বিস্তার ও বিকাশ ঘটেছে নিম্নোক্ত দ্বান্দ্বিক বিরোধের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে। অর্থাৎ, খোদ এই সংগ্রামের মধ্যেই প্রলেতারিয়েত বাহিনী নিজেকে নিযুক্ত করেছে [রিক্রুট], এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তারা সংগ্রামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছে। পার্টি গঠনের কার্যক্রম, সংগ্রামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রলেতারিয়েতদের সচেতনতা এবং খোদ সংগ্রাম, কোনোটাই কালানুক্রমিক ও যান্ত্রিকভাবে আলাদা আলাদা বিষয় নয়। এগুলো হলো একই সংগ্রামের ভিন্ন ভিন্ন দিক। সোশ্যাল ডেমোক্রেসির এমন কোনো একগুচ্ছ কৌশল নেই যা কিনা প্রশিক্ষণ শিবিরের সৈনিকদের শেখানোর মতো করে কেন্দ্রীয় কমিটি পার্টির সদস্যদের শেখাবে। বরঞ্চ, যে সংগ্রামের প্রক্রিয়া সংগঠন তৈয়ার করেছে সেটাই সোশ্যাল ডেমোক্রেসির প্রভাবের পরিসরে একটি ক্রমাগত ওঠানামার প্রয়োজনীয় শর্ত তুলে ধরে।
এই কারণে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক কেন্দ্রিকতা পার্টির কেন্দ্রের প্রতি সদস্যদের যান্ত্রিক অধীনতা ও অন্ধ আনুগত্যের ওপর ভর করে হতে পারে না। এই কারণে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক আন্দোলন ইতোমধ্যে পার্টিতে থাকা প্রলেতারিয়েতের শ্রেণি সচেতন নিউক্লিয়াস এবং প্রলেতারিয়েতের পার্টিবিহীন অংশের মধ্যে কোনো বদ্ধ দেয়াল তৈরি অনুমোদন করে না।
এখন লেনিনের কেন্দ্রিকতা যে দুটো নীতির ওপর নির্ভর করে আছে তা হলো:
১) পার্টির কেন্দ্রের কাছে পার্টির সকল অংশের অন্ধ আনুগত্য; কেবল কেন্দ্রই সকলের জন্য চিন্তা করবে, নির্দেশনা দিবে, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
২) সামাজিক–বৈপ্লবিক প্রতিবেশ থেকে বিপ্লবীদের সংগঠিত নিউক্লিয়াসের কঠোর পৃথকীকরণ।
এ ধরনের কেন্দ্রিকতাবাদ হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক শ্রেণির গণআন্দোলনের ওপর ব্লাঙ্কুইজমের সাংগঠনিক নীতিমালার একটি যান্ত্রিক প্রয়োগ।
এই মতের সাথে সামঞ্জস্য রেখে লেনিন তার ‘বৈপ্লবিক সোশ্যাল ডেমোক্রেট’কে সজ্ঞায়ন করেছেন ‘শ্রেণিস্বার্থ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠা প্রলেতারিয়েতদের সংগঠনের যুক্ত একজন জেকোবিন’ হিসাবে। প্রকৃতপক্ষে, সোশ্যাল ডেমোক্রেসি প্রলেতারিয়েতের সংগঠনে সাথে যুক্ত নয়। এটা নিজেই প্রলেতারিয়েত; এটা শ্রমিক শ্রেণির নিজেদের আন্দোলন। এই কারণেই সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক কেন্দ্রিকতাবাদ মূলত ব্লাংকুইস্ট কেন্দ্রিকতাবাদ থেকে আলাদা। এটা কেবল মাত্র শ্রমিক শ্রেণির ব্যক্তি ও গোষ্ঠী প্রতিনিধিদের পুঞ্জীভূত বা সম্মিলিত ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। বলা যেতে পারে, এটা প্রলেতারিয়েতের অগ্রসর অংশের [বা নেতৃত্বস্থানীয় স্তরের] ‘স্ব–কেন্দ্রিকতাবাদ’। এটা হলো নিজ পার্টির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন।
সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক কেন্দ্রিকতাকে বাস্তবে পরিণত করার অপরিহার্য শর্তগুলো হচ্ছে:
১) শ্রেণি সংগ্রামে শিক্ষিত এক বিরাট বা তাৎপর্যপূর্ণ অংশের শ্রমিকের উপস্থিতি
২) জনজীবন, পার্টি প্রেস, জনসমাবেশ ইত্যাদিতে প্রত্যক্ষ প্রভাবের মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক তৎপরতা বিকাশে শ্রমিকদের সম্ভাবনা।
এই শর্তগুলো রাশিয়াতে এখনো পুরোপুরি গঠিত হয়নি। প্রথমটি, অর্থাৎ শ্রেণিস্বার্থ সচেতন এবং রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনায় সক্ষম একটি প্রলেতারিয়েত ভ্যানগার্ড, এখনো রাশিয়াতে কেবলমাত্র হাজির হওয়া শুরু হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগঠনের সকল প্রচেষ্ঠা এমন ভ্যানগার্ড গঠনকে ত্বরান্বিত করা উচিৎ। দ্বিতীয় শর্তটি কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতার পরিস্থিতিতে বাস্তবে পরিণত হতে পারে।
এই সিদ্ধান্তগুলোর সাথে লেনিন চরমভাবে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি নিশ্চিত যে, একটি শক্তিশালী এবং কেন্দ্রিভূত পার্টি গঠনের সকল প্রয়োজনীয় শর্তাবলী ইতোমধ্যে রাশিয়াতে বিদ্যমান। তিনি ঘোষণা দেন যে, ‘প্রলেতারিয়েতদের নয়, বরঞ্চ সংগঠন ও শৃঙ্খলার বিষয়ে আমাদের পার্টির কিছু বুদ্ধিজীবীদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে’। তিনি কারখানার শিক্ষামূলক প্রভাবকে মহিমান্বিত করেন, যা তার ভাষায়, প্রলেতারিয়েতদেরকে ‘শৃঙ্খলা ও সংগঠনে’ অভ্যস্ত করে তুলবে। এতকিছু বলার পর লেনিন আবারও প্রমাণ করেন যে, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক সংগঠন সম্পর্কে তার ধারণা যথেষ্ট যান্ত্রিক। লেনিনের চিন্তায় যে ‘শৃঙ্খলা’ [ডিসিপ্লিন] রয়েছে তা কেবল কারখানার মাধ্যমেই শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে রোপণ করেন না, বরঞ্চ সামরিক ও বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় বা [আধুনিক] আমলাতন্ত্রের মাধ্যমেও সেটা করেন। অর্থাৎ, কেন্দ্রীভূত বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সকল কলকব্জা [মেকানিজম] দিয়ে এটা করা হয়।
আমরা শব্দের অপব্যবহার করি এবং আত্ম–প্রবঞ্চনা চর্চা করি যখন একই শব্দ—যেমন শৃঙ্খলা [ডিসিপ্লিন]—নিম্নোক্ত বিপরীতমুখী ধারণাতে প্রয়োগ করি: ১) সয়ংক্রিয়ভাবে চলমান হাজারো হাত পা যুক্ত শরীরে চিন্তা ও ইচ্ছার অনুপস্থিতি, এবং ২) একদল মানুষের সচেতন রাজনৈতিক তৎপরতার স্বতঃস্ফূর্ত সমন্বয়। একটি নিপীড়িত শ্রেণির অন্ধ আনুগত্য এবং নিজের মুক্তির জন্য সংগ্রামরত একটি শ্রেণির সংগঠিত বিদ্রোহের মধ্যে কোন সাধারণ বৈশিষ্ট্যটি পরিলক্ষিত হয়?
সোশ্যাল ডেমোক্রেসির স্ব–শৃঙ্খলা মানে বুর্জোয়া শাসকদের কর্তৃত্বকে একটি সমাজতান্ত্রিক কেন্দ্রীয় কমিটির কর্তৃত্ব দ্বারা নিছক প্রতিস্থাপন করা নয়। শ্রমিক শ্রেণি নতুন শৃঙ্খলার ধারণা অর্জন করবে, মুক্তভাবে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির স্ব–শৃঙ্খলাকে গ্রহণ করবে; পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কর্তৃক আরওপিত শৃঙ্খলার ফসল হিসেবে নয়, বরঞ্চ আনুগত্য ও দাসত্বের পুরোনো অভ্যাসের শেষ শেকড় পর্যন্ত উৎপাটন করার মাধ্যমে এটা করবে।
সমাজতান্ত্রিক [সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক–রিডার] ধারণায় কেন্দ্রিকতাবাদ শ্রমিক আন্দোলনের যে কোনো পর্যায়ে প্রয়োগযোগ্য এমন কোনো চূড়ান্ত বিষয় নয়। বরঞ্চ এটা একটা প্রবণতা, যা শ্রমজীবীদের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় অর্জিত বিকাশ ও রাজনৈতিক শিক্ষার আলোকে মূর্ত হয়ে ওঠে। সন্দেহ নেই, রুশ আন্দোলনে এই ধরনের কেন্দ্রিকতাকে সম্পূর্ণরূপে মূর্ত করে তুলতে প্রয়োজনীয় শর্তাবলীর অনুপস্থিতিই একটি দুরূহ বাধা হাজির করেছে।
এটা ভাবা ভুল হবে যে, যেখানে এখনো পার্টিতে সচেতন শ্রমিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি সেখানে সে শাসনকে একটা কেন্দ্রীয় কমিটির চূড়ান্ত ক্ষমতা দিয়ে ‘সাময়িকভাবে’ প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে এবং এভাবেই পার্টি বা সংগঠনের ওপর শ্রমজীবী জনগণের উন্মুক্ত নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে বৈপ্লবিক প্রলেতারিয়েতের ওপর কেন্দ্রীয় কমিটির নিয়ন্ত্রণ প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে।
রুশ শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস এমন ধরনের কেন্দ্রিকতার মূল্য সম্পর্কে বিবিধ সন্দেহের জন্ম দেয়। নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপের সীমাহীন অধিকারসহ সর্বক্ষমতাময় কেন্দ্র (অল–পাওয়ারফুল সেন্টার), যেমনটা লেনিন হয়তোবা চাইবেন, তা অর্থহীনতায় পর্যবসিত হবে যদি এই কর্তৃত্ব কেবল প্রযুক্তিগত বা টেকনিক্যাল প্রশ্নে প্রয়োগ করা হয়, যেমন তহবিল পরিচালনা, প্রচারকারী [প্রপাগান্ডিস্ট] ও বিক্ষোভকারীদের কাজের দায়িত্ব বণ্টন, পার্টি পুস্তিকা বহন ও প্রচার। কেবলমাত্র যদি এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সংগ্রামের কৌশল অবলম্বন এবং রাশিয়াতে একটি বিরাট বৈপ্লবিক পদক্ষেপ শুরু করা হয় তবেই এর একটি বোধগম্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত রুশ আন্দোলন যে পরিবর্তনগুলোর মধ্য দিয়ে গিয়েছে তার অভিজ্ঞতা কী? গত দশকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও ফলপ্রসূ পরিবর্তনগুলো আন্দোলনকারী কোনো নেতার ‘আবিষ্কার’ নয়, এমনকি নেতৃত্বস্থানীয় সংগঠনগুলোরও ফসল নয়, বরঞ্চ প্রতিটি ক্ষেত্রেই এটা ছিল আন্দোলনের সক্রিয়তার স্বতঃস্ফূর্ত ফসল। এটা সত্য ছিল রাশিয়ার প্রলেতারিয়েত আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের জন্য; এটা শুরু হয়েছিল ১৮৯৬ সালের সেন্ট পিটার্সবার্গে স্বতঃস্ফূর্ত সাধারণ ধর্মঘটের মাধ্যমে। এই ঘটনাটি ছিল রাশিয়ার শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক সংগ্রামের নবযুগের সূচনা। পরবর্তী সময়েও এটা কম সত্য ছিল না, ১৯০১ সালের মার্চে সেন্ট পিটার্সবার্গের শিক্ষার্থীরা যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তার আন্দোলনে নেমে আসে। ১৯০৩ সালের রোস্তভ অন ডনের সাধারণ ধর্মঘট ছিল রুশ প্রলেতারিয়েত আন্দোলনের পরবর্তী বিশাল কৌশলগত মোড়, এটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত তৎপরতা। ‘অল বাই ইটসেলফ’, মানে নিজে নিজেই ধর্মঘট পরিণত হয় রাজনৈতিক সমাবেশে, রাস্তার বিক্ষোভে, বিশাল বিশাল সভা, যা কিনা কয়েকবছর পূর্বেই সবচেয়ে আশাবাদী বিপ্লবীও কল্পনা করতে পারেননি।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘পহেলা ছিল কর্ম’; অর্থাৎ এই ঘটনাগুলো থেকে আমাদের কাজের যৌক্তিকতা আরও শক্ত ভিত্তি পেয়েছে। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগ ও সচেতন নেতৃত্ব এই বিকাশে খুবই নগণ্য ভূমিকা পালন করেছে। এটা সত্য যে এই সংগঠনগুলোকে এমন ঘটনা প্রবাহের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত ছিল না। তবু বিপ্লবীদের এই অগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে এই ফ্যাক্ট দিয়ে বিশ্লেষণ করা যাবে না। লেনিন যে সর্বক্ষমতাময় কেন্দ্রীয় পার্টির হাতিয়ারের কথা বলেছিলেন তার অনুপস্থিতি দিয়েও এটা ব্যাখ্যা করা যাবে না। এমন একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের অস্তিত্ব সম্ভবত স্থানীয় কমিটিগুলোতে বিশৃঙ্খলা বা সিদ্ধান্তহীনতা বৃদ্ধি করতো; উত্তেজিত জনগণ এবং সোশ্যাল ডেমোক্রেসির বিচক্ষণ অবস্থানের মধ্যে ফাটল ধরানোর মাধ্যমে এটা করা হতো। একই প্রপঞ্চ, মানে কৌশল নির্ধারণে কেন্দ্রীয় কমিটির সচেতন উদ্যোগের গৌণ ভূমিকা, বর্তমানে জার্মানি ও অন্যান্য দেশে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। সাধারণত, সোশ্যাল ডেমোক্রেসির কৌশলগত নীতি এমন কিছু নয় যা আসলে ‘উদ্ভাবিত’ [ইনভেন্টেড] হতে পারে। বরঞ্চ বিভিন্ন পরীক্ষামূলক, এবং প্রায়শই স্বতঃস্ফূর্ত, শ্রেণি সংগ্রামের দুর্দান্ত সব সৃজনশীল কর্মতৎপরতার ধাবাহিকতার ফসল।
এখানেও চেতনের পূর্বে আসে অচেতন। ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী মানবজাতির [বা, প্রক্রিয়ার এজেন্টদের] বিষয়ীগত যুক্তির পূর্বে আসে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার [অবজেক্টিভ বা বিষয়গত] যুক্তি। এইসমস্ত ক্ষেত্রে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক নেতৃত্বের ভূমিকা রক্ষণশীল চরিত্রের হয়ে থাকে, কারণ অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে যে, যখন তারা লড়াইয়ের জন্য নতুন জমিন জিতে নেয় তখন তারা এটার ওপর পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা–নিরীক্ষা শুরু করে, এবং আরও বেশি মাত্রার অধিকতর উদ্ভাবনের বিপরীতে এটাকে শীঘ্রই কেল্লা বা দুর্গে পরিণত করে।
জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেসির বর্তমান কৌশল তাদের অসাধারণ বৈচিত্র্য, নমনীয়তা [ফ্লেক্সিবিলিটি], এবং একইসাথে দৃঢ়তার কারণে সবার কাছ থেকে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এটি পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার [রেজিম] আওতায় প্রতিদিনের ক্ষুদ্রতম বিষয়গুলোও বিবেচনায় নিয়ে পার্টির খাপ খাওয়ানোর [এডাপটেশন] একটি চমৎকার আলামত। পার্টি তার আয়ত্বে থাকা সকল জিনিসপত্রের একটি পদ্ধতিগত অধ্যয়ন করেছে; সে জানে তার নীতিগুলো পরিবর্তন না করেও কীভাবে সেগুলোকে কাজে লাগাতে হয়।
তদপুরি, এই বিশেষ কৌশল, মানে এই এই নিখুঁত অভিযোজন, আমাদের পার্টির বিস্তীর্ণ দিগন্তকে এতই কার্যকরভাবে রুদ্ধ করে দিচ্ছে যে, পার্লামেন্টারি কৌশলকে চিরস্থায়ী করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং এটাকে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লড়াইয়ের জন্য নির্দিষ্ট কৌশল হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি জার্মানিতে সাধারণ ভোটাধিকার বিলুপ্ত হয় তখন কৌশলগত নীতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা (পারভাস৭ দ্বারা উত্থাপিত) বিবেচনা করতে লোকেরা অস্বীকার করেছিল; যদিও এমন একটি সম্ভাব্য ঘটনাকে [মানে ভোটাধিকারের বিলুপ্তি] জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেসি একেবারে অবাস্তব মনে করেনি।
মোটাদাগে এই ধরনের জড়তার কারণ হচ্ছে যে, বিমূর্ত হাইপোথিসিস সমূহের শূন্যতার মধ্যে, অস্তিত্বহীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির লাইন ও রূপগুলোকে সংজ্ঞায়ন করা খুবই ঝামেলাপূর্ণ। স্পষ্টত ভবিষ্যত কৌশলের জন্য রেডি–মেড পরিকল্পনা প্রস্তুত করা এবং আন্দাজ করাটা সোশ্যাল ডেমোক্রেসির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে: ১) প্রদত্ত পরিস্থিতির সাথে মিল রেখে সংগ্রামের রুপগুলোর সঠিক ঐতিহাসিক মূল্যায়নে উৎসাহিত করা, এবং ২) বর্তমান পর্যায়ের আপেক্ষিকতা এবং শ্রেণি সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্যের অবস্থান থেকে বৈপ্লবিক উত্তেজনার অনিবার্য বৃদ্ধি সম্পর্কে বোঝাপড়া অব্যাহত রাখা।
লেনিনের চাওয়া মতে পার্টির শীর্ষে নেতিবাচক চরিত্রের এমন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেয়া হলে আমরা এমন অঙ্গের অন্তর্নিহিত রক্ষণশীলতাকে একটা বিপজ্জনক পরিমাণে শক্তিশালী করে তুলবো। সমাজতান্ত্রিক পার্টির কৌশল যদি একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন না হয়ে উল্টো পুরো পার্টি গঠন বা আরও ভালো হবে যদি পুরো শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়, তাহলে এটা স্পষ্ট যে পার্টির বিভিন্ন অংশ [সেকশন] ও ফেডারেশনের কর্মের স্বাধীনতার জরুরত রয়েছে। এই স্বাধীনতা তাদেরকে বৈপ্লবিক উদ্যোগ গড়ে তোলার এবং পরিস্থিতি সকল উপাদানকে ব্যবহার করার অনুমতি দিবে। লেনিন কর্তৃক প্রস্তাবিত অতি–কেন্দ্রিকতা একজন প্রহরীর নিষ্ফলা চেতনায় ভরপুর। এটা কোনো ইতিবাচক এবং সৃজনশীল চেতনা নয়। পার্টির কর্মকাণ্ডকে আরও ফলপ্রসূ করার চাইতে লেনিনের তাগিদ হচ্ছে পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করা—আন্দোলনকে বিকশিত করার পরিবর্তে আরও সঙ্কুচিত করা ফেলা, সমন্বয় করার পরিবর্তে বেঁধে ফেলা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেসির জন্য এই ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা দ্বিগুণ বিপজ্জনক হবে। জারের শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের চূড়ান্ত প্রান্তে এটি দাঁড়িয়ে আছে। এখন এটি তীব্র সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের কালে প্রবেশের সময় এসেছে, অথবা ইতোমধ্যে প্রবেশ করেই ফেলেছে; যখন কিনা এটি তার প্রভাবের পরিধিকে বিস্তৃত করে তুলবে [বৈপ্লবিক সময়ে যেমন সাধারণত হয়ে থাকে] এবং জোরেশোরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামনে এগিয়ে যাবে। এই মুহূর্তে পার্টির উদ্যোগকে বেঁধে রাখার চেষ্টা, কাঁটাতার দিয়ে চতুর্দিক থেকে ঘিরে রাখার মানেই হচ্ছে এই মুহূর্তের যে অভাবনীয় দায়িত্ব বর্তেছে সেটা পালনে অক্ষম হয়ে পড়া।
সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক কেন্দ্রিকতার প্রশ্নে আমরা যে সাধারণ ধারণা হাজির করেছি সেগুলো রুশ পার্টির জন্য মানানসই গঠনতান্ত্রিক [কনস্টিটিউশনাল] পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য পর্যাপ্ত নয়। চূড়ান্ত মুহূর্তে, এই ধরণের বিধিবিধান নির্ধারণ করা যেতে পারে কেবল সেই বাস্তবতায়, যার অধীনে একটি প্রদত্ত যুগে সংগঠনের কার্যকলাপ সংঘটিত হচ্ছে। রাশিয়ায় এই মুহূর্তের প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে একটি বৃহৎ প্রলেতারিয়েত সংগঠন চালু করা যায়। কোনো গঠনতান্ত্রিক প্রকল্পই অভ্রান্ততা দাবি করতে পারে না। অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমেই নিজেকে প্রমাণ করতে হয়।
কিন্তু সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক সংগঠনের প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের সাধারণ ধারণা থেকে আমরা মনে করি, এর স্পিরিটের জন্য প্রয়োজন, বিশেষ করে গণপার্টির শুরুতেই, আন্দোলনের সমন্বয় ও একত্রীকরণ; একগুচ্ছ নিয়মকানুনের কাছে অন্ধ আনুগত্য নয়। যদি পার্টি রাজনৈতিক গতিশীলতার গুণ ধারণ করতে পারে, পাশাপাশি নীতির প্রতি অটল থাকে এবং ঐক্য নিয়ে ভাবনা থাকে তাহলে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, পার্টির গঠনতন্ত্রে যে কোনো ধরনের ত্রুটি চর্চার মাধ্যমে সংশোধিত হয়ে যাবে। আমাদের জন্য এক টুকরো দলিল নয়, বরঞ্চ সদস্যরা সংগঠনের ভেতর যে জীবন্ত চেতনা নিয়ে আসেন সেটাই সাংগঠনিক বিভিন্ন রূপের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়।
দ্বিতীয় অধ্যায়
এতক্ষণ আমরা সোশ্যাল ডেমোক্রেসির সাধারণ দৃষ্টিকোণ এবং কিছুটা হলেও রাশিয়ার অভিনব পরিস্থিতির আলোকে কেন্দ্রিকতাবাদের সমস্যাকে পর্যালোচনা করলাম। তদপুরি, লেনিন ও তার কমরেডদের বহুল প্রচারিত সামরিক অতি–কেন্দ্রিকতাবাদ মতের আকস্মিক ভিন্নতার ফসল নয়। বলা হয় যে এটা সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযানের সাথে জড়িত যা লেনিন ক্ষুদ্রতর সাংগঠনিক বিবরণের মধ্যে ধারণ করেছেন।
লেনিন বলছেন যে, ‘সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে মোটামুটি কার্যকরী অস্ত্র দাগা জরুরি’। তিনি বিশ্বাস করেন যে, সুবিধাবাদ বিশেষত বিকেন্দ্রীকরণ ও বিশৃঙ্খলার প্রতি বুদ্ধিজীবীদের ঝোঁক থেকে আসে, কঠোর শৃঙ্খলা ও ‘আমলাতন্ত্র’ এর প্রতি তাদের বিতৃষ্ণা থেকে আসে; যদিওবা এগুলো পার্টির কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজন।
লেনিন বলছেন যে, বুদ্ধিজীবীরা সোশ্যালিস্ট/সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে যোগ দেয়ার পরও ব্যক্তিবাদী রয়ে যান এবং নৈরাজ্যবাদের প্রতি ঝুঁকে থাকেন। তার মতে, কেন্দ্রীয় কমিটির নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের প্রতি প্রবল বিরোধিতা কেবল বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই দেখা যায়। তিনি বলেন, খাঁটি প্রলেতারিয়েত তার শ্রেণি–প্রবৃত্তির কারণে দৃঢ় নেতৃত্ব ও কঠোর/নির্দয় শৃঙ্খলার খপ্পরে নিজেকে সঁপে দিয়ে একধরনের ইন্দ্রিয়পরায়ণ সুখানুভূতি খুঁজে পায়। তিনি লেখেন, ‘আমলাতন্ত্রবাদ বনাম গণততন্ত্রবাদ হচ্ছে বিপ্লবী সোশ্যাল ডেমোক্রেসির সাংগঠনিক নীতি বনাম সুবিধাবাদীর সাংগঠনিক নীতি’। তিনি ঘোষণা করেন যে, যেসব দেশে সংস্কারবাদী ও বিপ্লবী সমাজতন্ত্র মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে সেখানে কেন্দ্রীয়বাদী ও স্বায়ত্তশাসনবাদী প্রবণতার মধ্যে একধরনের সংঘাত বিরাজ করছে। আইনভায় সমাজতান্ত্রিক প্রতিনিধির কতটুকু স্বাধীনতা পার্টি অনুমোদন করবে—এই প্রশ্নে জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেসিতে যে সাম্প্রতিক বিতর্ক চালু আছে সে দিকে লেনিন বিশেষভাবে ইঙ্গিত দেন।৮
লেনিন উত্থাপিত সাদৃশ্যগুলোকে পরীক্ষা করা যাক।
প্রথমত, এটা উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, সমাজতান্ত্রিক সংগঠনের ব্যাপারে প্রলেতারিয়েতের অনুমিত প্রতিভার গুণকীর্তন এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রতি সাধারণ অবিশ্বাস এগুলো ‘বিপ্লবী মার্ক্সবাদী’ মানসিকতার আবশ্যক লক্ষণ নয়। এটা খুব সহজেই দেখানো সম্ভব যে, এই ধরনের যুক্তি নিজেই আসলে সুবিধাবাদের বহিঃপ্রকাশ।
শ্রমিক আন্দোলনে খাঁটি প্রলেতারিয়েত উপাদান ও অ–প্রলেতারিয়েত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যকার বিরোধকে মতাদর্শিক বিষয় হিসাবে উত্থাপিত করা হয় নিম্নোক্ত উপায়ে: ফরাসি সিন্ডিকালিস্টদের আধা–নৈরাজ্যবাদ, যার জিগির হচ্ছে, ‘রাজনীতিবিদ থেকে সাবধান!’; ইংরেজ ট্রেডইউনিয়বাদী, ‘সমাজতান্ত্রিক স্বপ্নদ্রষ্ট্রা’দের ব্যাপারে অবিশ্বাসী; এবং আমাদের তথ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে এরপরেই রয়েছে ‘খাঁটি অর্থনীতিবাদী’, রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেসিতে রাবচায়া মিসলে৯ কিছুদিন আগে এর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, সেন্ট পিটাসবার্গ–এ প্রকাশিত হয়েছিল।
পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ সমাজতান্ত্রিক পার্টির মধ্যে সুবিধাবাদ ও ‘বুদ্ধিজীবী’দের মধ্যে নিঃসন্দেহে একটি যোগসূত্র রয়েছে, পাশাপাশি শ্রমিক আন্দোলনের সুবিধাবাদ ও বিকেন্দ্রীকরণ প্রবণতার মধ্যেও যোগসূত্র রয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিক জমিন থেকে সামাজিক প্রপঞ্চগুলোকে আলাদা করা এবং প্রপঞ্চগুলোকে বিমূর্ত নীতি হিসাবে উপস্থাপন (যেন এগুলোর একটি চূড়ান্ত ও সর্বজনীন প্রয়োগ রয়েছে) করার চাইতে মার্ক্সবাদী চিন্তার ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির বিপরীত আর কিছুই হতে পারে না।
ধরে নেয়া যাক, যে কেউ বলতে পারেন, বুর্জোয়া শ্রেণি থেকে উঠে আসা একটি সামাজিক উপাদান হিসেবে ‘বুদ্ধিজীবী’ আদতে প্রলেতারিয়েত থেকে দূরবর্তী থাকেন; তিনি তাঁর শ্রেণি–পরিচয়ের বোধের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সমাজতন্ত্রে যোগ দেন না, বরঞ্চ মতাদর্শিক পথকে গ্রহণের মাধ্যমে সেই বোধকে মাড়িয়ে তিনি যোগ দেন। এই কারণে তার শ্রেণি সচেতন প্রলেতারিয়েতের তুলনায় বেশি সুবিধাবাদী বিভ্রান্তে পড়ার প্রবণতা রয়েছে। যেহেতু শ্রেণি–সচেতন প্রলেতারিয়েতের নিজস্ব সামাজিক পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও জনতার সাথে যোগসূত্র হারিয়ে যায়নি, সেহেতু তার তাৎক্ষণিক শ্রেণি–প্রবৃত্তি তাকে বিপ্লবী মেরুদণ্ড প্রদান করে। কিন্তু সুবিধাবাদের দিকে বুদ্ধিজীবীর ঝুঁকে থাকার এই পূর্বানুমানের দৃঢ় রূপ এবং সর্বোপরি সাংগঠনিক প্রশ্নে এই প্রবণতা যেভাবে নিজেকে প্রকাশ করে তা সবসময়ই প্রদত্ত সামাজিক পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে।
জার্মান, ফরাসি ও ইতালির সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে লেনিন যে প্রপঞ্চ চিহ্নিত করেছেন সেখানে বুর্জোয়া পার্লামেন্টারিজম বা সংসদীয় রীতি হচ্ছে সেই প্রপঞ্চের নির্দিষ্ট সামাজিক ভিত্তি। পশ্চিমা সোশ্যাল ডেমোক্রেসিতে বিদ্যমান সকল সুবিধাবাদী প্রবণতার উর্বর জমিন হচ্ছে এই পার্লামেন্টারিজম।
ফ্রান্স, ইতালি ও জার্মানিতে আমরা বর্তমান সুবিধাবাদের যেসকল বিভ্রান্তির বিষয় দেখতে পাচ্ছি, যেমন: সামাজিক সংস্কার, শ্রেণি ও পার্টির সহযোগিতা, সমাজতান্ত্রিক পথে শান্তিপূর্ণ বিকাশের আশা ইত্যাদির অতি–মূল্যায়ন, পার্লামেন্টারিজম কেবল এগুলোকে সমর্থনই যোগাচ্ছে না, বরঞ্চ এটা সেই জমিন তৈরি করে দিচ্ছে যেখানে এই বিভ্রান্তিগুলোকে অনুশীলন করা যায়। কারণ, এমনকি সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ভেতরেই, পার্লামেন্টারিয়ান হিসাবে বুদ্ধিজীবীদেরকে এটি প্রলেতারিয়েত থেকে আলাদা করে ফেলে, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রলেতারিয়েতদের ওপরে স্থান দিয়ে দেয়। শ্রমিক আন্দোলন বৃদ্ধির সাথে সাথে পার্লামেন্টারিজম হয়ে উঠছে রাজনৈতিক ক্যারিয়ারবাদীদের উর্বর জমিন। এই কারণেই বুর্জোয়াদের এত বেশি উচ্চাভিলাষী ব্যর্থতা সমাজতান্ত্রিক পার্টির ব্যানারে ভিড় জমিয়েছে।
এইসকল কারণ পশ্চিম ইউরোপের সোশ্যাল ডেমোক্রেসির সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অরাজকতা ও শৃঙ্খলতার অভাবের দিকে একটি নির্দিষ্ট ঝোঁকের উত্থান ঘটিয়েছে। বর্তমান সুবিধাবাদী ঢেউয়ের দ্বিতীয় নির্দিষ্ট শর্ত হচ্ছে উচ্চ বিকশিত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এবং এর ফলে একটি প্রভাবশালী সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি সংগঠনের উপস্থিতি। বুর্জোয়া–পার্লামেন্টারি প্রবণতার বিরুদ্ধে এই পার্টি বিপ্লবী শ্রেণি সংগ্রামের দুর্গ হিসাবে কাজ করবে। যদি প্রলেতারিয়েতদের সুদৃঢ় ও সক্রিয় প্রাণভোমরাকে ভেঙে একটি নিরাকার গণ ‘ভোটারে’ পরিণত করতে হয় তাহলে এই দুর্গকে ভেঙে ফেলতে হবে এবং অকার্যকর করে তুলতে হবে। এভাবেই আধুনিক সুবিধাবাদের ‘স্বায়ত্তশানবাদী’ ও বিকেন্দ্রীয়করণের প্রবণতাগুলোর জন্ম হয়। তারা ঐতিহাসিকভাবে সু–প্রতিষ্ঠিত এবং নির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিক লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ফলে এগুলোকে ‘বুদ্ধিজীবী’র অন্তর্নিহিত অস্থিরতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না, যেমন করে লেনিন বলছেন; বরঞ্চ এগুলোকে বুর্জোয়া পার্লামেন্টারিয়ানদের প্রয়োজনীয়তা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। বুদ্ধিজীবীদের ‘মনস্তত্ত্ব’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না, বরঞ্চ সুবিধাবাদী ‘রাজনীতি’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।
তদপুরি জারের রাশিয়ার পরিস্থিতি একদম ভিন্ন। সাধারণত রাশিয়ার শ্রমিক আন্দোলনের সুবিধাবাদ কোনোভাবেই সোশ্যাল ডেমোক্রেসির শক্তিশালী বিকাশ অথবা বুর্জোয়া সমাজের বিভাজনের ফসল নয়, বরঞ্চ এটি রুশ সমাজের পশ্চাৎপদ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফসল।
এটা বোধগম্য যে, রাশিয়ার যে বিদ্বৎসমাজ থেকে সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীরা উঠে এসেছেন সেই সমাজের এখনো সুনির্দিষ্ট শ্রেণিচরিত্র গড়ে ওঠেনি, এবং পশ্চিম ইউরোপের বিদ্বৎসমাজের চাইতে কিছুদূর অব্দি এখনো শ্রেণিচ্যুত বলা যায়; অর্থাৎ, তারা সে তুলনায় এখনো কম বুর্জোয়া। এটি রাশিয়ার প্রলেতারিয়েত আন্দোলনের অপরিপক্বতার সাথে যুক্ত হয়ে তত্ত্বীয় অস্থিরতা ও সুবিধাবাদী দোদুল্যমানতার বিস্তর সুযোগ তৈরি করে দেয়; যা কখনো শ্রমিক আন্দোলনের রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে পুরোপুরি খারিজ করে দেয়, কখনো এর একদম বিপরীতে গিয়ে সন্ত্রাসকে মুক্তির একমাত্র উপায় হিসাবে বিশ্বাস করে, এবং পরিশেষে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে লিবারেলিজমের পঙ্কিলতায় অথবা দার্শনিক পরিমণ্ডলে কান্টের আদর্শবাদীতার খপ্পরে পড়ে।১০
আমাদের মতে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক বুদ্ধিজীবীদের সংগঠনহীনতার দিকে একটি নির্দিষ্ট সক্রিয় প্রবণতাকে উস্কে দেয়ার জন্য বুর্জোয়া পার্লামেন্টারিজমের ইতিবাচক অভিজ্ঞতার কেবল অভাবই নয়, বরঞ্চ এটা সংশ্লিষ্ট সামাজিক–মনস্তাত্ত্বিক পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে জড়িত। আধুনিক পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবীদের যারা এই সময়ে ‘ইগোর কাল্টে’ নিজেকে নিয়োজিত করেছেন এবং এমনকি ‘প্রভু জাতের নৈতিকতা’কে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা ও সংগ্রামের জগতে টেনে নিয়ে আসছেন, তারা সাধারণত বুর্জোয়া বিদ্বৎসমাজের আদর্শ প্রতিনিধি নন, বরঞ্চ তারা তাদের সামাজিক বিকাশের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। অন্য ভাবে বলা যায়, এটি একটি ক্ষয়িষ্ণু ও বিকৃত বুর্জোয়া সমাজের ফসল, যা কিনা ইতোমধ্যে তার নিজের শ্রেণি আধিপত্যের দুষ্টচক্রে জড়িয়ে পড়েছে। এর বিপরীতে এবং সঙ্গত কারণেই, রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিবৃত্তির ইউটোপিয়ান ও সুবিধাবাদী কল্পনাগুলো বরঞ্চ আত্ম–অস্বীকৃতি ও আত্ম–অননুমোদনের বিপ্রতীপ তাত্ত্বিক রূপের গ্রহণ করার দিকে ঝোঁকে। নিশ্চিতভাবে পুরনো নারদনিকদের ‘জনতার কাছে যাওয়া’১১ নামক আন্দোলন, মানে বুদ্ধিজীবীকে বাধ্যতামূলকভাবে কৃষকের ছদ্মবেশ ধারণ ছিল একটি হতাশাজনক আবিষ্কার। একইভাবে সাম্প্রতিক খাঁটি ‘অর্থনীতিবাদে’র শীষ্যরা শ্রমিকের ‘মসৃণ হাত’–এর সামনে আমাদেরকে মাথা নত করাতে চায়।
আমরা যদি সাংগঠনিক কাঠামোর প্রশ্নটিকে সরাসির ইউরোপ থেকে রাশিয়াতে আমদানি না করে খোদ রাশিয়ার নির্দিষ্ট পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সমাধান করতে চাই তাহলে আমরা একদম ভিন্ন ফলাফল পাবো। সংগঠনের কোনো একটি নির্দিষ্ট কাঠামো, যেমন বিকেন্দ্রীকরণ, এর প্রতি প্রবল উৎসাহের জন্য সুবিধাবাদকে দায়ী করার (যেমনটি লেনিন করেছেন) মানে হলো সুবিধাবাধের অন্তর্নিহিত নির্যাসকে ভুল বোঝা। সাংগঠনিক প্রশ্নে সুবিধাবাদের কেবল একটাই নীতি থাকে: নীতির অনুপস্থিতি। এটা সবসময়ই পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে পদ্ধতি নির্বাচন করে, যতক্ষণ পর্যন্ত তার উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে। কিন্তু যদি লেনিনের মতো করে আমরা সুবিধাবাদকে একটি প্রবণতা বা আকাঙ্ক্ষা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করি যা কিনা প্রলেতারিয়েতদের স্বাধীন বিপ্লবী শ্রেণি সংগ্রামকে অসাড় করে ফেলে এবং এটাকে উচ্চাভিলাষী বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের একটি হাতিয়ারে পরিণত করে, তাহলে আমাদের এটাও স্বীকার করতে হবে যে, শ্রমিক আন্দোলনের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে এই ফলাফল বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে নয়, বরঞ্চ দৃঢ় কেন্দ্রিকতাবাদের মাধ্যমেই কায়েম হয়ে যায়। কঠোর কেন্দ্রিকরণের মাধ্যমেই একটি নব–বিকশিত ও অপরিষ্ফুটিত প্রলেতারিয়েত আন্দোলন একটি কেন্দ্রীয় কমিটির বুদ্ধিজীবী নেতাদের হাতের মুঠোয় চলে যায়।
জার্মানিতেও আন্দোলনের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে, সচেতন প্রলেতারিয়েতদের একটি শক্তিশালী নিউক্লিয়াস এবং অভিজ্ঞতাভিত্তিক একটি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক কৌশল হাজির হওয়ার পূর্বেই বিপরীতমুখী দুই সাংগঠনিক প্রবণতাই বিবাদে মুখোমুখি হয়েছে। একদিকে রয়েছে লাসালের জেনারেল জার্মান ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন কর্তৃক প্রচারিত উগ্র কেন্দ্রিকতাবাদ, এবং অন্যদিকে রয়েছে আইজেনাখার কর্তৃক প্রচারিত ‘স্বায়ত্বশাসনবাদ’। আইজেনাুখারদের কৌশলগত নীতি কিছুটা দিশেহারা হওয়া সত্ত্বেও এটি জার্মানের জনগণের মধ্যে শ্রেণি সচেতনতা বৃদ্ধিতে লাসালিয়ানদের তুলনায় বেশি অবদান রেখেছিল। অতি শীঘ্রই শ্রমিকরা এই পার্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা শুরু করেছিল এবং আন্দোলনের দ্রুত বিস্তৃতি ঘটেছিল। একইসময়ে লাসালিয়ানরা তাদের ‘স্বৈরশাসক’দের নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা উল্টো বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত করেছিল।
সাধারণভাবে, যেখানে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে বিপ্লবী উপাদান এখনো অসংগঠিত এবং খোদ আন্দোলনই দোদুল্যমান, (সংক্ষেপে, এই পরিস্থিতির সাথে বর্তমান রাশিয়ার মিল রয়েছে) এমন পরিস্থিতিতে সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীরা একটি কঠোর স্বৈরাচারী কেন্দ্রিকতাবাদী সাংগঠনিক প্রবণতাকে সমর্থন করেন। অন্যদিকে, একটি সংসদীয় শাসনামলে এবং একটি শক্তিশালী শ্রমিক দলের মুখোমুখি হয়ে বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদী প্রবণতা তখন ‘বিকেন্দ্রীকরণে’র দিকে ঝুঁকে পড়ে।
শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনে বিদ্বৎসমাজের বিপজ্জনক প্রভাব সম্পর্কে লেনিনের যে ভয় সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায়, সংগঠন প্রশ্নে তার নিজের ধারণা রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেসির জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ হাজির করছে। প্রকৃতপক্ষে, বিকাশমান প্রলেতারিয়েত আন্দোলনকে একটি আমলাতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাবাদের পকেটে ঢুকাতে পারলে এই আন্দোলন ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী একদল বুদ্ধিজীবীদের কব্জায় খুব সহজে, এবং নিশ্চিতভাবেই চলে যায়। এই আমলাতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা সংগ্রামী শ্রমিকদের একটি ‘কমিটি’র অনুগত হাতিয়ারে পরিণত করে। অন্যদিকে, শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড, যার ফলশ্রুতিতে শ্রমিকরা রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা অর্জন করেন, তা তাদেরকে উচ্চাভিলাষী বিদ্বৎসমাজ পরিচালিত কমিটির সুবিধাবাদী ব্যবহার থেকে রক্ষা করবে।
লেনিন আজ যাকে অলীক ছায়া বা ভূত হিসাবে দেখছেন কাল তা সহজেই বাস্তবে পরিণত হতে পারে।
আমাদের ভুলে যাওয়া চলবে না যে রাশিয়ার আশু বিপ্লব একটি বুর্জোয়া বিপ্লব হতে যাচ্ছে, কোনো সর্বহারা বিপ্লব নয়। এটি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লড়াইয়ের সকল পরিস্থিতি পরিবর্তন করে ফেলবে। তখন রুশ বুদ্ধিজীবীরা দ্রুতই বুর্জোয়া মতাদর্শে ডুব দিবে। যদি বর্তমানে রুশ শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সোশ্যাল ডেমোক্রেসিই প্রধান ধারা হয়ে থাকে, তাহলে বুর্জোয়া বিপ্লবের পরপরই, সর্বোপরি এর বুদ্ধিজীবীরা জনগণকে সংসদীয় হেজেমনির জন্য স্তম্ভমূল বানাতে চাইবে। স্বতঃস্ফূর্ত কর্মকাণ্ড, স্বাধীন উদ্যোগ এবং শ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনাধারী অংশ যত কম হবে, তত বেশি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক জবরদস্তির শিকার হবে, নতুন রাশিয়ার বুর্জোয়া বক্তৃতাবাজ নেতাদের খেলা তত সহজ হবে, এবং আজকের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক শ্রমিকদের ফসল তত বেশি বুর্জোয়াদের মাচায় উঠবে।
সর্বোপরি, অতি–কেন্দ্রিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মূল অভিমুখ, অর্থাৎ সাংগঠনিক অবস্থা বা পার্টির গঠনতন্ত্রের ধারা–উপধারা দিয়ে শ্রমিক আন্দোলনকে সুবিধাবাদের হাত থেকে রক্ষা করার ধারণাটি, আসলে মিথ্যা। ফ্রান্স, ইতালি ও জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেসির সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের মাঝেও সুবিধাবাদকে শ্রমিক আন্দোলনের জন্য এলিয়েন বা বিজাতীয় উপাদান হিসাবে বিবেচনা করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে; যেন এটা কেবল বুর্জোয়া গণতন্ত্রের উপাদানের সাথে বাইরে থেকে এসেছে। যদি এটা সত্য হয়ে থাকে তাহলে সংগঠনের গঠনতন্ত্রের ধারা–উপাধারা এই অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে পারবে না। অর্থাৎ, সুবিধাবাদী উপাদানের চাপে এটা অকার্যকর হিসাবে প্রমাণিত হবে। প্রলেতারিয়েত সংগঠনে বা সোশ্যাল ডেমোক্রেসির মধ্যে নন–প্রলেতারিয়েত উপাদানের এই অন্তঃপ্রবাহ আসলে বিভিন ধরনের সামাজিক কারণের ফলাফল, যেমন পাতি–বুর্জোয়াদের অর্থনৈতিক পতন, বুর্জোয়া উদারবাদের দেউলিয়াপনা এবং বুর্জোয়া গণতন্ত্রের অবক্ষয়। সংগঠনের গঠনতন্ত্রে লিখিত ফর্মুলা দিয়ে এই প্রবাহকে আটকানোর আশা করা বোকামিই। কয়েকটি অনুচ্ছেদ, বা বিধিবিধানের ম্যানুয়াল কেবল একটি ছোট উপদল বা গোপন (প্রাইভেট) চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, ইতিহাসের প্রবাহ সবসময় এই অনুচ্ছেদকে মাড়িয়ে যায়। তাছাড়া, বুর্জোয়া সমাজের ক্রমাগত অবক্ষয়ের ফলে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেয়া উপাদানগুলোকে ঠেকানোর মানে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থকে রক্ষা করা—এও সত্য নয়। সোশ্যাল ডেমোক্রেসি সর্বদাই দাবি করে এসেছে যে, এটি কেবল প্রলেতারিয়েতদের শ্রেণি স্বার্থেরই প্রতিনিধিত্ব করে না, বরঞ্চ সমগ্র সমসাময়িক সমাজের প্রগতিশীল আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে। বুর্জোয়া আধিপত্যের জুলুমের শিকার সবার স্বার্থকে এটা তুলে ধরে। এটাকে নিছক এই অর্থে বোঝা যাবে না যে, এইসমস্ত স্বার্থ আদর্শস্বরূপ সোশ্যালিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ঐতিহাসিক বিকাশের প্রক্রিয়াতেই এই ধারণাটি বাস্তবে হাজির হবে, যেখানে কিনা রাজনৈতিক পার্টি হিসাবে সোশ্যাল ডেমোক্রেসি ধীরে ধীরে আমাদের সমাজের সকল অসন্তুষ্ট উপাদানগুলোর আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে। যার ফলে এটি গুটিকয়েক আধিপত্যকামী বুর্জোয়াদের পার্টি হওয়ার বিপরীতে জনতার পার্টি হয়ে উঠবে। এ জন্য জানতে হবে কীভাবে এই বিচিত্র সমষ্টির যন্ত্রণা, ক্রোধ ও আশাকে শ্রমিক শ্রেণির চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করা যাবে। বিদ্যমান সমাজের বিরুদ্ধে অ–প্রলেতারিয়েতের বিক্ষোভকে প্রলেতারিয়েতের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সাথে একত্রে আবদ্ধ করতে হবে। অর্থাৎ, আগত উপাদানগুলোকে একীভূত করতে হবে। এটা কেবল তখনই সম্ভব যদি সোশ্যাল ডেমোক্রেসিতে ইতোমধ্যেই রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত ও শ্রেণি সচেতন প্রলেতারিয়েত নিউক্লিয়াসের উপস্থিতি থাকে (যেমন এখন পর্যন্ত জার্মানি) যারা কিনা শ্রেণিচ্যুত ও পাতি–বুর্জোয়া উপাদানগুলোকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারবে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়করণের নীতির কঠোর প্রয়োগ এবং দলীয় বিধি অনুসারে গঠিত কঠিন শৃঙ্খলা সুবিধাবাদের বিপদের বিরুদ্ধে একটা কার্যকর সুরক্ষা হতে পারে। এভাবেই ফ্রান্সের বৈপ্লবিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন জ্যোরাসি১২ বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করেছিল। সেদিকে জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেসির গঠনতন্ত্রের সংশোধন একটি সময়োচিত পদক্ষেপ হবে। কিন্তু এমনকি এক্ষেত্রে কেবল দলীয় গঠনতন্ত্র বা বিধিকে সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার হাতিয়ার ভাবা উচিৎ নয়, বরঞ্চ এটাকে পার্টির মধ্যে বিদ্যমান বৈপ্লবিক সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রলেতারিয়েত কর্তৃত্বমূলক প্রভাব প্রয়োগের একটি বাহ্যিক বাধ্যতামূলক বা জবরদস্তিমূলক হাতিয়ার হিসাবে দেখা উচিৎ। যদি এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাব থাকে তাহলে সবচেয়ে ভয়ানক কাগুজে অনুমোদনও বিকল্প হয়ে উঠতে পারে না।
তদপুরি আমরা উল্লেখ করেছি যে, কেবল বুর্জোয়া উপাদানের অনুপ্রবেশই সোশ্যাল ডেমোক্রেসির মধ্যে সুবিধাবাদী প্রবাহের একমাত্র উৎস নয়। আরেকটি কারণ হচ্ছে খোদ সমাজতান্ত্রিক লড়াইয়ের চরিত্র ও এর মধ্যে অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য। সর্বমুক্তির দিকে প্রলেতারিয়েতদের আন্তর্জাতিক লড়াই বা বিজয়ের দিকে প্রলেতারিয়েতদের ঐতিহাসিক অগ্রগতি একটি অভূতপূর্ব প্রক্রিয়া। কারণ ইতিহাসের প্রথমবারের মতো জনগণ [পিপল] সচেতনভাবে নিজেদের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে, এবং সমস্ত শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাদের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। কিন্তু এই ইচ্ছা কেবল বিদ্যমান ব্যবস্থা বা সমাজের উর্ধ্বে উঠে বা ছাড়িয়ে গিয়ে সিদ্ধ হতে পারে। তদপুরি অন্যদিকে, এই জনতা তাদের এই ইচ্ছাকে গঠিত বা বিকশিত করতে পারে কেবল বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দৈনন্দিন সংগ্রামের মাধ্যমে, অর্থাৎ কেবল বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যেই (অর্থাৎ, পুঁজিবাদী সমাজের সীমাবদ্ধতার মধ্যে)। একদিকে রয়েছে জনতা [মাস] অন্যদিকে রয়েছে এর ঐতিহাসিক লক্ষ্য যা কিনা বিদ্যমান সমাজের বাইরে অবস্থিত। একদিকে রয়েছে দৈনন্দিন সংগ্রাম, অন্যদিকে রয়েছে সামাজিক বিপ্লব। এই দ্বান্দ্বিক বৈপরীত্যের মধ্য দিয়েই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের [সোশ্যালিস্ট ডেমোক্রেটিক আন্দোলন] বিকাশ ঘটছে বা ঘটে। এই পথচলায় দুটো বিপদকে যৌক্তিকভাবে মোকাবিলা করেই যেতে হয়, একদিকে রয়েছে গণচরিত্রের ক্ষতি, অন্যদিকে রয়েছে এর লক্ষ্যে পরিত্যাগ। একদিকে রয়েছে একটি উপদল বা সম্প্রদায়ের দশায় পুনঃপতিত হওয়ার বিপদ, অন্যদিকে রয়েছে একটি বুর্জোয়া সংস্কার আন্দোলনে পরিণত হওয়ার বিপদ।
এই কারণেই এটা চিন্তা করা অনৈতিহাসিক ভ্রান্তি যে, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক আন্দোলনের বৈপ্লবিক কৌশল পূর্ণরূপে সবার জন্য নির্ধারণ করা যাবে এবং শ্রমিক আন্দোলনকে সুবিধাবাদী ভ্রান্তি থেকে একেবারেই মুক্ত করা সম্ভব। অবশ্যই, মার্ক্সবাদী তত্ত্ব আমাদেরকে সুবিধাবাদী সাধারণ প্রবণতাগুলোকে চিহ্নিত করতে এবং এর বিরুদ্ধে লড়াই করার হাতিয়ার সরবরাহ করে। কিন্তু যেহেতু সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন একটি গণ–আন্দোলন এবং এর বিপদগুলো ব্যক্তির মনন থেকে উদ্ভূত না হয়ে বরঞ্চ সামাজিক পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত হয়, ফলে আগ থেকে সুবিধাবাদী ভ্রান্তির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া যায় না। যখন এগুলো বাস্তবে মূর্ত আকার ধারণ কবে কেবল তখনই, খোদ আন্দোলনের মাধ্যমেই এটাকে কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে; এবং অতি অবশ্যই মার্ক্সবাদ প্রদত্ত হাতিয়ার দিয়ে, মানে মার্ক্সবাদী তত্ত্বের সহায়তায়। এদিক থেকে দেখলে সুবিধাবাদকে শ্রমিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক বিকাশের অনিবার্য পর্যায় ও ফসল বলে মনে হবে। রাশিয়ার মতো অঞ্চলে যেখানে সোশ্যাল ডেমোক্রেসি এখনো অবিকশিত, এবং যেখানে শ্রমিক আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই অস্বাভাবিক, সেখানে সুবিধাবাদ মোটাদাগে এই উৎস থেকে উৎসারিত হতে পারে। অর্থাৎ, এটি সমাজতান্ত্রিক লড়াইয়ের কৌশলের ক্রমাগত পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও অনুসন্ধান থেকে উৎসারিত হতে পারে, সমাজতান্ত্রিক মৌলিক নীতিগুলোর ব্যতিক্রমী ও অতুলনীয় পরিস্থিতিতে বর্তমান সংগ্রামকে নিয়ে আসার প্রয়োজন থেকে উৎসারিত হতে পারে।
যদি এটা হয়ে থাকে, তাহলে কোনো একটা নির্দিষ্ট সাংগঠনিক গঠনতন্ত্র দিয়ে রাশিয়ার আন্দোলনে সুবিধাবাদের উত্থান এড়ানোর ধারণাটা অদ্ভুত খেয়ালিপনায় পূর্ণ। এক টুকরা কাগজ দিয়ে সুবিধাবাদকে নিবৃত্ত করার প্রয়াস প্রচণ্ড ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে, সুবিধাবাদের জন্য নয় বরঞ্চ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্যই। কারণ একটি সুস্থ জীবনের স্বাভাবিক হৃদস্পন্দন বন্ধ করার মাধ্যমে আপনি তার লড়াই করার স্পৃহাকেই দুর্বল ও দমন করে ফেলেন। যা কিনা কেবল সুবিধাবাদের বিরুদ্ধেই নয়, বরঞ্চ বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও তার লড়াইর স্পৃহাকে দুর্বল করে দেয়। উপায় উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধেই চলে যায়।
রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের একটা অংশের (বা লেনিনের) এই যে অতি–উদ্বিগ্নতা, অর্থাৎ একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও প্রাণশক্তিসম্পন্ন শ্রমিক আন্দোলনকে কোনো ধরনের ভুল–ভ্রান্তি থেকে রক্ষা করার জন্য একটি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিষ্ঠা করার উচ্চাকাঙ্ক্ষার মধ্যে আমরা সেই একই সাবজেক্টিভিজমের আলামত দেখতে পাচ্ছি, যা কিনা রাশিয়া সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার জগতে ইতোমধ্যে একের অধিক প্রতারণা করে ফেলেছে। সাম্প্রতিক রাশিয়ার ইতিহাসে শ্রদ্ধেয় মানব ‘অহং’কে যে অদ্ভুত ডিগবাজিগুলো করতে হয়েছে তা আগ্রহোদ্দীপক। রুশ স্বৈরাচার কর্তৃক একেবারে ধুলোয় মিশে গিয়ে এই ‘অহং’ নিজেকে, নিজস্ব চিন্তার পদ্ধতিতে, সিংহাসনে বসিয়ে এবং অস্তিত্বহীন ‘নারোদনায়া ভোলিয়া’র১৩ নামে ষড়যন্ত্রকারীদের একটি কমিটি হিসাবে নিজেকে সর্বশক্তিমান হিসাবে ঘোষণা করে তার প্রতিশোধ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ‘বিষয়’ [অবজেক্ট] শক্তিশালী হিসাবে প্রমাণিত হয়েছিল। এই কষাঘাত (knout/knot একেক স্থানে এককটা দেয়া আছে) বিজয়ী হয়েছিল, কারণ এটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের ‘বৈধ’ অভিব্যক্তি হিসাবে প্রমাণ করেছিল।
সময়ে সময়ে আমরা দৃশ্যপটে ইতিহাসের আরও বেশি ‘বৈধসম্মত’ সন্তানকে দেখতে পেলাম, মানে রুশ শ্রমিক আন্দোলনকে। প্রথমবারের মতো একটি খাঁটি ‘পিপলস উইল’ বা ‘জনগণের ইচ্ছা’ গঠনের ভিত্তি রাশিয়ার জমিনে স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু এখানে আবারও রুশ বিপ্লবী ‘অহং’! মাথার উপর দাঁড়িয়ে এটা আরেকবার নিজেকে ইতিহাসের সর্বশক্তিমান পরিচালক হিসাবে ঘোষণা করছে; এইবার রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির মহামান্য কেন্দ্রীয় কমিটির নামে। এই তুখোড় কসরতবাজ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, আজ যে কর্তা বা সাবজেক্ট পরিচালকের ভূমিকা পালন করার যোগ্যতা অর্জন করেছে, তা হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণির সমষ্টিগত ‘অহং’। শ্রমিক শ্রেণি তাদের ভূল করার এবং ইতিহাসের দ্বন্দ্ব শেখার অধিকার দাবি করছেন। আমরা স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারি। ঐতিহাসিকভাবে, সবচেয়ে চতুর কেন্দ্রীয় কমিটির অভ্রান্ততার চাইতে কোনো একটি সত্যিকারের বৈপ্লবিক আন্দোলনের ভুল বা ত্রুটিগুলো বহুগুণ উপকারী।
টীকা:
১. জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক আন্দোলনকে দমন করার উদ্দেশ্য নিয়ে ১৮৭৮ সালে জার্মানির রাইখস্ট্যাগে বিসমার্ক কর্তৃক উত্থাপিত সমাজতন্ত্র–বিরোধী আইনটি গৃহীত হয়। ১৮৯০ সালে এই আইন প্রত্যাহার করা হয়।
২. ইস্ক্রা হচ্ছে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি [RSDLP] কর্তৃক প্রকাশিত রুশ সংবাদপত্র। ভি আই লেনিনের তত্ত্বাবধানে এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০০ সালের ১ ডিসেম্বর। জার দ্বিতীয় নিকোলাসের দমন পীড়নের জন্য এটি রাশিয়ার বাইরে প্রকাশ করতে হতো, এবং বিদেশে প্রকাশিত হয়ে গোপনে রাশিয়াতে প্রচার করা হতো। ১৯০৩ সালে RSDLP এর বিভাজনের পর পত্রিকাটি মেনশেভিকদের দখলে যায়।
৩. এখানে ১৯০৩ সালের আগস্টে অনুষ্ঠিত RSDLP এর দ্বিতীয় কংগ্রেসের কথা বলা হচ্ছে। এই কংগ্রেসেই মেনশেভিক ও বলশেভিকরা আলাদা হয়েছিল।
৪. লেনিনের এই গ্রন্থটি ১৯০৪ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয়েছিল।
৫. এখানে অস্ট্রীয় সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অস্ট্রীয়–হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের বহুজাতিক চরিত্রের প্রতিক্রিয়ায় তারা যেভাবে একটি ফেডারেল পার্টি কাঠামো তৈরি করেছিলেন, যেখানে কিনা তাদের বিভিন্ন জাতির স্বায়ত্তশাসনের অনুমতি দেয়া হয়েছিল।
৬. লুই অগাস্ট ব্লাঙ্কুই (১৮০৫–১৮৮১) কর্তৃক প্রচারিত বিপ্লবের ধারণাকে ব্লাংকুইজম বলা যায়। এর মতে, তুলনামূলক একটি ছোট ও খুব সঙ্ঘবদ্ধ গ্রুপ এবং গোপন ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালিত হওয়া উচিত। ক্ষমতা দখলের পর বিপ্লবীরা এই রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সমাজতন্ত্র চালু করবে। এটা মনে করে যে, রাজনৈতিক বিপ্লব আসলে একধরনের ক্যু’র মাধ্যমেই হতে হবে।
৭. পারভাস আলেক্সান্ডার হেলফান্ড (১৮৬৭–১৯২৪) এর ছদ্মনাম ছিল। তিনি ছিলেন রুশ বিপ্লবী; ১৮৯১ এর SPD এর সাথে সক্রিয় ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আগ পর্যন্ত তিনি লুক্সেমবার্গের সাথে কাজ করেছেন। ১৯১৪ সালের পর তিনি যখন জার্মানির পক্ষাবলম্বন করেন তখন রোজা তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
৮. এস্পিডি এর সংস্কারপন্থীরা এসপিডির অতিরিক্ত কেন্দ্রিকতাবাদের বিরুদ্ধে স্থানিক স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে যুক্তি দিতেন, তাদের সংস্কারপন্থী নীতিকে তুলে ধরার একটা উপায় হিসাবে।
৯. রবচায়া মিসলে (শ্রমিকদের চিন্তাধার) অর্থনীতিবাদীদের সংবাদপত্র। ১৮৯৭ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। ১৬টি সংখ্যা বের হয়েছিল, ৩ থেকে ১১ সংখ্যা এবং ১৬তম সংখ্যা বের হয়েছিল বার্লিন থেকে, অন্যান্য সংখ্যা বেরিয়েছিল সেন্ট পিটাসবার্গ থেকে। – তথ্যসূত্র: ভি আই লেনিন, কী করিতে হইবে, পৃষ্ঠা. ১৮৭ [ফুটনোট]
১০. ইমানুয়েল কান্টের ক্রিটিক্যাল ফিলোসফির উল্লেখ; রোজা তাঁর লেখাপত্রে ধ্রুপদী দার্শনিকদের কথা যে অল্প কয়বার উল্লেখ করেছেন তন্মধ্যে এটা অন্যতম। এসপিডির কয়েকজন সংস্কারপন্থী নেতা কান্টবাদী ছিলেন। – সম্পাদক, রোজা লুক্সেমবার্গ রিডার
১১. ‘জনতার কাছে যাওয়া’ ছিল ১৮৭০–১৮৮০ সালের দিককার রুশ পপুলিস্ট বিদ্বৎসমাজের একটি শ্লোগান।
১২. জ্যা জ্যোরাসি (১৮৫৪–১৯১৪) একজন সংস্কারপন্থী ফরাসি সমাজতন্ত্রী নেতা, তিনি L Humanite নামক পত্রিকা ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। লুক্সেমবার্গ অনেকবার তার সাথে বিতর্ক করেন। কিন্তু তার উচ্চকিত প্রশংসা করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধের বিরোধীতা করার কারণে তিনি হত্যার শিকার হন।
১৩. নারোদনায়া ভোলিয়া ১৮৭৯ এর আগস্টে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একটি ছিল রুশ পপুলিস্ট সংগঠন, বৈপ্লবিক সন্ত্রাসবাদের চর্চা করতো। ১৮৮১ সালের মার্চে এই দলের সদস্যরা জার আলেক্সান্ডার দ্বিতীয়কে হত্যা করে। এরপরে রুশ সরকার এই গোষ্ঠীকে মারাত্মক দমন পীড়নের মাধ্যমে নিধন করেছিল।