জুলাইয়ের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিসরে কিছু রাজনৈতিক গুরুত্ববহ শব্দ বা বচনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। নাগরিক সমাজ অহরহ এগুলো ব্যবহার করছেন, এমনকি রাষ্ট্রের দায়িত্বরত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বক্তব্যাদি থেকেও সেসব শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এই যেমন “মব,” “মব করা,” “ডেভিল,” এবং “ডেভিল হান্ট” ইত্যাদি। এমনিতে শব্দ অর্থ প্রকাশের দিক থেকে একটা পিচ্ছিল ব্যাপার, অর্থাৎ এর ব্যবহারে নানান অনির্দিষ্টতা থাকে, কিন্তু রাষ্ট্র এবং বিশিষ্ট নাগরিক সমাজ যখন এই শব্দগুলো একই প্রেক্ষিতে ব্যবহার করেন সেগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা থিতু হয় এবং শব্দগুলো সরকারি ও নাগরিক সমাজের শব্দভাণ্ডারে নির্দিষ্ট অর্থসহ যুক্ত হয়। এইসব শব্দের মাধ্যমে রাষ্ট্র এবং সরকার নাগরিককে কিছু বার্তা দিতে চায়, নাগরিক সমাজও সরকারকে কিছু বার্তা দিতে চায়। ফলে সর্বজনের স্বার্থে এই শব্দগুলোর সরকারি ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবহারকে ব্যবচ্ছেদ করার প্রয়োজন আছে। সেই তাগিদ থেকে তৈরি করেছি আমার এই লেখাটি। শব্দগুলো ব্যবচ্ছেদের ফলে যা বেরিয়ে এসেছে এই লেখায়, তা হলো গণআন্দোলনের সঙ্গে ডিপ স্টেইট ও শ্যালো স্টেইটের সংহতি এবং সংঘাতের কিছু চিত্র। এই চিত্রগুলোর পর্যালোচনা করতে গিয়ে যথাস্থানে ডিপ স্টেইট ও শ্যালো স্টেইটের উদাহরণসহ সংজ্ঞা হাজির করব। এটা বলে নেয়া দরকার যে, শব্দগুলোর ব্যঞ্জনার উদাহরণ দেখাতে গিয়ে নাগরিক সমাজের যেসকল চিন্তকের বয়ান এখানে ব্যবহার করা হয়েছে তারা সকলেই জুলাই অভ্যুত্থানে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছেন এবং যুগিয়েছেন। অর্থাৎ শব্দগুলোর ব্যঞ্জনার যে হেরফের আমরা পাব এখানে তা বক্তাদের জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষে এবং বিপক্ষে থাকা বাবদে উদ্ভূত নয়, পার্থক্যটা তাদের রাষ্ট্রচিন্তাগত পার্থক্য থেকে আসা।
প্রথমেই আসি মধ্যে ‘মব‘ প্রসঙ্গে। মব কী, এ নিয়ে সবার মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন ধারণা আছে যা প্রথম আলো প্রস্তাবিত অর্থ “দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা“র সঙ্গে যায়। মবের আদি অর্থ মোবাইল ভারগাস, অর্থাৎ অস্থির জনতা। মোবাইল ভারগাসকে সংক্ষেপে মোবিলিটিও বলা হতো নোবিলিটির বিপরীতে, যেখানে নোবিলিটি হচ্ছে সুস্থির উচ্চবর্গ, আর মোবিলিটি হচ্ছে অস্থির নিম্নবর্গ। অস্থির নিম্নবর্গ যখন সুস্থির উচ্চবর্গের স্থাপিত স্থিতিশীলতা ভাঙে তখন তাদের তাচ্ছিল্যভরে বলা হতো মব। কালে কালে মবের বৈশিষ্ট্যের বিস্তার হয়েছে, আধুনিক ব্যবহারে অর্থ দাঁড়িয়েছে নৈরাজ্যমূলক ও ধ্বংসাত্মক কাণ্ডে লিপ্ত উত্তেজিত জনতা। তবে এই বাংলাদেশে যাদের “মব” বলা হয়েছে এবং হচ্ছে সেই মবের প্রতি নাগরিক সমাজের সবার মনোভঙ্গী এক নয়। এই প্রসঙ্গে অন্তত দুজন স্বনামখ্যাত চিন্তককে দেখেছি, মব সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলোর উপর ক্রিটিকাল দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করছেন, ভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন, যা আমদের আহ্বান জানায় মবকে ভিন্ন দৃষ্টি দিয়ে দেখতে। এরমধ্যে একজন হলেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেছেন, “জনগণের ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভকে ‘মব‘ বলা হাসিনার ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা পুনর্গঠনের ভাষা।” অর্থাৎ –এর সঙ্গে মজহার যুক্ত করে দিচ্ছেন এই যে, রাজ্যের (রাষ্ট্রের) নিপীড়নের বিরুদ্ধে এই নৈরাজ্য, রাষ্ট্র কর্তৃক নিপীড়ন করার ব্যবস্থা গড়ার প্রতিক্রিয়ায় জনতার এই ভাঙা। অর্থাৎ এই বিশৃঙ্খলা, অন্যায়ের প্রতিবাদ বাবদে ন্যায়সিদ্ধ। এটা অনেকটা মবের আদি অর্থ নোবিলিটির বিপরীতে মোবিলিটির সমার্থক। পাঠক, এখানে মজহার উল্লেখিত “ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র” প্রসঙ্গে একটা নোক্তা দিয়ে রাখি। এই লেখায় স্টেইট বা রাষ্ট্র বলতে, পরিচালনা বাবদে উদ্ভূত রাষ্ট্রের একটা সংস্করণ বা ভার্শনকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রত্যেক সরকারই রাষ্ট্র পরিচালনা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রের একটি উপস্থিত সংস্করণ তৈরি করেন। যেমন শেখ হাসিনার আমলের শেষ দশ বছর “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” এর যে ভার্শনটি উপস্থিত ছিল তা হলো একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র।

ফরহাদ মজহারের ব্যাখ্যাটি এমন সময় প্রকাশ পেলো যখন অন্তর্বর্তী সরকার এবং জুলাই অভ্যুত্থানে সমর্থন দেয়া বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশটি “তৌহিদী জনতার” নামে দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীকে মব বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং তাদের কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং এসময়ের গুরুত্বপূর্ণ তরুণ চিন্তক মাহফুজ আলম ওই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের উদ্দেশ্য করে অনুরোধ করেছেন, “অভ্যুত্থানের পক্ষে হলে মব করা বন্ধ করেন, আর যদি মব করেন, তাইলে আপনাদেরও ডেভিল হিসাবে ট্রিট করা হবে।” অনুরোধটির মধ্যে একটি সতর্কবাণী আছে যা বহু পাঠকের কাছে হুমকি বলে মনে হয়েছে। তার কারণ হলো দেশে যৌথবাহিনীর “অপারেশন ডেভিল হান্ট” চলছে। এধরনের অপারেশনের একটা ইতিহাস আছে যা জনমনে ভীতি তৈরি করে রেখেছে। ফলে মাহফুজ আলমের হুঁশিয়ারিমূলক কথাটি তৎক্ষণাৎ ওই ইতিহাসের প্রেক্ষিতে পঠিত হয়েছে। সেই প্রেক্ষিত প্রসঙ্গে কিছু বলা যাক। “অপারেশন ক্লিন হার্ট“-এ বহু লোক প্রাণ হারিয়েছে যা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে দেখেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। সংস্থাগুলোর মতে, অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ফলে সন্দেহভাজনদের প্রাণ গেছে, সন্দেহ প্রমাণের জন্য ডিউ প্রসেস অবলম্বন করা হয়নি। এমনিতে “অপারেশন ডেভিল হান্ট” এর ব্যাপারে ওই সকল সংস্থাসহ নাগরিক সমাজের অনেকে তাদের আপত্তি জানিয়েছেন। আপত্তির কারণ আছে। সংবিধানে “মানবিক মর্যাদা“কে অন্যতম মূলনীতি রেখে, নাগরিককে “ডেভিল” হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না। মানবিক মর্যাদার মূল কথাই হলো মানুষকে তার মানবজন্মের জন্য মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে হবে। মানবদেহের মর্যাদাও এর মধ্যে পড়ে। একারণে, চোখের বিনিময়ে চোখ তুলে নেয়া সুবিচার হিসেবে গ্রাহ্য হয় না। কেউ কারও “রগ কেটে” জেলে গেলে, বিচারক অপরাধীর “রগ কেটে” “উচিত বিচার” করেন না। সে বাবদে নাগরিককে আগেই “ডেভিল” নাম দেয়া হচ্ছে “গিভ দেম এ ব্যাড নেইম, অ্যান্ড হ্যাং দেম” পলিসির অংশ। এটা সম্মতি উৎপাদনের কৌশলও বটে। এই অপারেশনে প্রাণ যাদের যাবে তারা কোনো বিচার ছাড়াই “ডেভিল” হিসেবে সাব্যস্ত হবে। কেননা কোনো কাজ একজন নাগরিককে “ডেভিল” বানায় তার কোনো আইনি ব্যাখ্যা নেই। রাষ্ট্র “মানবিক মর্যাদা“কে অন্যতম মূলনীতি রেখে নাগরিককে মানবেতর “ডেভিল” সাব্যস্তই করতে পারে না, সেখানে রাষ্ট্র উল্টা “ডেভিল” ক্যাটাগরিটাকে উন্মুক্ত রেখেছে, যাতে রাষ্ট্র তার সঙ্গে বনিবনা না হলে নাগরিককে “ডেভিল” হিসেবে সাব্যস্ত করতে পারে।
মাহফুজ আলম সতর্কবাণীটা যদিও লঘু পাপে গুরুদণ্ডের মতোই শোনায় আপাত পাঠে কিন্তু অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রের দিক থেকে দেখলে বিষয়টা মোটেও লঘু নয়। তার ব্যাখ্যাও উপদেষ্টা দিয়েছেন, “বিপ্লবী জনতা আর খণ্ড খণ্ড মব আলাদা জিনিস। লক্ষ্যহীন, উদ্দেশ্যবিহীন এ মবসংস্কৃতির কারণে উপকৃত হচ্ছে আমাদের শত্রুরা। রাষ্ট্রের অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার্থে আমাদের কঠোর হতে হবে।” অর্থাৎ “মব করা” বা দলবদ্ধভাবে লক্ষ্যহীন, উদ্দেশ্যবিহীন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের ক্যাটাগরিতে পড়ছে। যা কঠোরভাবে দমন করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। শুধু ইন্টেরিম নয়, জনগণের একটি বড় অংশও মনে করে মব সংস্কৃতির কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের শত্রুরা অর্থাৎ পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার উপকৃত হচ্ছে। তাদের “টুপ করে” ঢুকে পড়ার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে, জুলাইয়ের অর্জনে যারা অবদান রেখেছেন এবং যারা এই অর্জনে সমর্থন যুগিয়েছেন তাদের কারোরই তা কাম্য নয়। সম্প্রতি আয়নাঘরের আংশিক চিত্র সবাই দেখেছেন, এটা কেবল কয়েক হাজার ভুক্তিভুগির বিরুদ্ধে অপরাধ নয়, খোদ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করছে জাতিসংঘ। সেবাদে ইন্টেরিম সরকারের ভয়টা কত সর্বগ্রাসী হতে পারে তা ভাবনার বিষয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের অস্থিতিশীলতা বাবদে পাশার দান পাল্টে গেলে তাদের কী অবস্থা হবে সেই ভয়ের মাত্রা নিয়ে বললাম কথাটা। কিন্তু ভয় থেকে রাষ্ট্র অপারেট করলে কী বিপদ হতে পারে সেদিকে এবার নজর দেয়া যাক।
এক্ষেত্রে উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের মন্তব্য প্রাসঙ্গিক, তা হলো, “পতিত ফ্যাসিস্টরা লাখ লাখ কোটি টাকা খরচ করে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।” এই প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রে দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করাটা আর লক্ষ্যহীন, উদ্দেশ্যবিহীন থাকে না, কিংবা দেশকে অস্থিতিশীল করার শত্রুপক্ষীয় উদ্দেশ্য থেকে আলাদা করা যায় না। তাই পত্রিকায় পাই, “দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টাকারী ব্যক্তি ও সন্ত্রাসীরা যাতে সহজে জামিন না পান”, সেটা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশ ও আইনজীবীদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্রের মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং আইনের আসিফ নজরুল। একই রিপোর্টে পাচ্ছি, আইন উপদেষ্টা “মবতন্ত্র” নিয়েও মন্তব্য করেছেন, বলেছেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সঠিকভাবে কাজ করলে মব–তন্ত্র কমে যাবে।” উপরোক্ত ভয়ের মাত্রাগত দিকটা উপদেষ্টাদের ‘জামিন‘ সংক্রান্ত উপদেশের মধ্যেও প্রকাশ পায়। এখন প্রশ্ন হলো, আইন উপদেষ্টা কি আইনত এই উপদেশ দিতে পারেন? না, পারেন না। সেটাই বলেছেন স্বনামখ্যাত আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, তার মতে “জামিন বিষয়ে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল যা বলেছেন তা বিচার বিভাগের উপর নগ্ন হস্তক্ষেপ এবং আদালত অবমাননার সামিল।” আসিফ নজরুল এবং জ্যোতির্ময় বড়ুয়া দুজনেই আইনের ছাত্র এবং স্বনামখ্যাত চিন্তক, অভ্যুত্থানে সরাসরি সমর্থন যুগিয়েছেন। তবু আইনের ব্যাখ্যা ছাড়াও যে ভেদটা চোখে পড়ছে তা হলো অভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশকে কে কীভাবে দেখতে চান। নাগরিক সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করে ইন্টেরিম পতিত ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীর ফিরে আসার ভয়ে অন্ধ না হয়ে যাক, কেননা তাতে নতুন ফ্যাসিবাদের জন্ম নিতে পারে।
“মব সংস্কৃতি” বা “মবতন্ত্র” দমনে “অপারেশন ডেভিল হান্ট“-এর হুঁশিয়ারি দেয়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশেষ নির্দেশ দেয়া বাবদে উপদেষ্টাদের বক্তব্যগুলো অনেকে শেখ মুজিবের “লাল ঘোড়া দাবড়ে দেয়ার” হুঁশিয়ারি সঙ্গে তুলনা করেছেন। আসলেই মিলটা কোথায়? মিলটা হচ্ছে রেজিম তার অস্তিত্ব রক্ষায় আক্রমণাত্মক হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন রেজিমের তৈরি করা স্টেইটের ভার্শনটি টিকিয়ে রাখতে পুরনো ভার্শন টিকিয়ে রাখার অস্ত্র ব্যবহার করতে চাইছে। ভালোমন্দ বিচার মুলতবি রেখে বিষয়টি এভাবে দেখা যেতে পারে, স্টেইট মাত্রই স্থিতি চায়, শব্দের ব্যুৎপত্তিতেও ব্যাপারটি খোদিত আছে, স্টেইট এবং অবস্থা একই শব্দের দুইরূপ, এখানে ‘স্থা-‘ থেকেই স্থিতি। যখন কেউ সেই স্থিতি নষ্ট করতে চায়, রাষ্ট্রকে অ–স্থিতি–শীল করতে চায়, রাষ্ট্র তা প্রতিহত করতে প্রতিক্রিয়া করে। অন্তর্বর্তী সরকারের ভার্শন অন্তর্বর্তী রাষ্ট্র সেই প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করছে। এখন অভ্যুত্থানকারী ছাত্র–জনতার সমর্থিত রেজিম আমাদের দুধ দিবে বলে তার লাত্থি খেয়ে হজম করার পক্ষে নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ দাঁড়িয়েছেন। তাদের অবস্থান হলো, “অপারেশন ডেভিল হান্ট” হান্ট করবে পতিত ফ্যাসিস্টদের। এখানে মানুষকে ডেভিল জ্ঞানে “হান্ট” করা যায় কিনা, তাতে মানবিক মর্যাদার হানি হয় কিনা সেই আলাপকে তারা ত্যানা প্যাঁচানো বলে এড়িয়ে যাবেন। কিন্তু নাগরিক সমাজের সবাই তা মেনে নিচ্ছেন না। তাদের কথা হলো সংবিধানের প্রস্তাবিত নতুন মূলনীতি মতে সরকারের হাতে যেকোনো অর্থে হান্টার থাকাটা নাগরিকের জন্য অমর্যাদাকর। প্রশ্ন উঠবে আয়নাঘর যে ফ্যাসিস্টদের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করার সাক্ষ্যবহন করছে তাদের জন্যও কি “অপারেশন ডেভিল হান্ট” পরিচালনা করা যাবে না? নাগরিক সমাজের একটি অংশের উত্তর হচ্ছে যাবে না, কেননা এধরনের অপারেশন দিয়ে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করার রাস্তা তৈরি হয়। তাছাড়া ডিউ প্রসেস ছাড়া কে ফ্যাসিস্ট আর কে মব তা বাছবিচার সমসময় সম্ভব হবে না। ডিউ প্রসেস দিয়েই ফ্যাসিস্টদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া সম্ভব।

নানাবিধ ব্যবহারিক কারণেও আমি মনে করি “মব” এবং “ডেভিল” ক্যাটাগরি দুটাই বাদ দিতে হবে আমাদের। নাগরিক সমাজের একটি অংশ ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাংচুরের ঘটনাকে মবের কাজ মনে করেন। নাগরিক সমাজের অন্য একটি অংশ মনে করেন এটা ফ্যাসিবাদ বিরোধী অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতা। ফলে তা হান্টযোগ্য মব নয়। কেননা সেটা মজহারের কথা ধার করে বলা যায় “জনগণের ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভ“-এর বহিঃপ্রকাশ। কাছাকাছি একটি ক্রিটিকাল ব্যাখ্যা দিয়েছেন আরেক স্বনামখ্যাত চিন্তক সেলিম রেজা নিউটন, বলেছেন “হাজার হাজার মানুষ যখন রাজনৈতিক কারণে জড়ো হয়, তাকে মব বলে না, তাই যদি হয় তাহলে তো ৩৬শে জুলাই বঙ্গভবনে যে জনতা ঢুকেছিল তারাও মব।” সেলিম রেজা নিউটনের কেবল চিন্তক হিসেবে এই বক্তব্যে হাজির করা তাই শুধু নয়, তিনি আন্দোলনেরও ক্ষুব্ধ অংশ: যখন আন্দোলনকারী ছাত্রদের পুলিস ধরে নিয়ে যাচ্ছিল তিনি পুলিসের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে ছাত্রদের ছিনিয়ে এনেছিলেন। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাংচুরের ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি আরও বলেন, “মব একটা পুলিশি শব্দ মাত্র।” একই প্রসঙ্গে তার ব্যাখ্যা ও অভিমত ব্যক্ত হয়েছে তার এই মন্তব্যে, “গণহত্যাকারী হাসিনা এবং তাঁকে আশ্রয়দানকারী ভারতীয় শাসকদের প্রতি প্রচণ্ড আক্রোশও আজকের ধ্বংস–তাড়নার পেছনে কাজ করেছে।…এই তাড়নাকে বিবেচনায় নিয়েই জুলাই–নেতৃত্বকে সামনে যেতে হবে।” এখানে নিউটনের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারও একমত। অন্তর্বর্তী সরকারের মতে, “ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাংচুরের ঘটনা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। পলাতক অবস্থায় ভারতে বসে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার উস্কানিমূলক বক্তব্যের কারণে জনমনে গভীর ক্রোধের সৃষ্টি হয়েছে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।”
উপরোক্ত মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে স্বনামখ্যাত চিন্তক আনু মুহাম্মদসহ ২৬ জন বিশিষ্ট নাগরিক একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। যেখানে ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাংচুরের ঘটনাটিক গণ–উত্তেজক সহিংসতা বা মব ভায়োলেন্স হিসেবে সাব্যস্ত করেন, এবং বিচারযোগ্য অপরাধ মনে করেন। এবং তারা এও মনে করেন “কোনো ধরনের গণ–উত্তেজক সহিংসতা বা মব ভায়োলেন্স কেবলমাত্র ফ্যাসিবাদের কর্মী–সমর্থক এবং তাদের আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকদের নাশকতা সৃষ্টির প্রচেষ্টাকেই উৎসাহিত করবে।” এর সঙ্গে আনু মুহাম্মদের ব্যক্তিগত মতও যোগ যাক, তিনি বলেন, “সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাড়ী, চিহ্ন, প্রতীক ভেঙে রাগ দেখানো যায়, ফ্যাসিবাদ যায় না। ফ্যাসিবাদের পুনরুৎপাদন হয়!” এই প্রসঙ্গে এটা বলা দরকার যে সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর ভাঙাকে নেতিবাচক কাজ হিসেবেই দেখেছেন, ফ্যাসিবাদের আইডলস (মূর্তি) ভাঙার চেয়ে উনি ফ্যাসিবাদের আইডিয়ালস (চিন্তা, আদর্শ) ভাঙার দিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এ নিয়ে সেলিম রেজা নিউটনের সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে ছোট্ট একটি সংলাপ হয়। নিউটনের “গণবিক্ষোভের কার্যকারণও বিবেচনায় নেয়ার প্রয়োজন আছে” মন্তব্যের জবাবে উপদেষ্টা আলম বলেন “এ সব সাপ্রেশনের (গণবিক্ষোভের কারণ) বহিঃপ্রকাশ ইতিবাচক হলেই আমরা দীর্ঘমেয়াদে জিতব।” এখানে এসে নিউটনও একমত হন। কিন্তু নৈরাষ্ট্রবাদী নিউটন বর্তমান রাষ্ট্রকে জুলাই আন্দোলনের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন বাবদে একটু ছাড় দিলেও, “মব” বিষয়ে মজহার তার একই অবস্থানে আছেন, বই মেলাতে তৌহিদী জনতার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশকে তিনি ন্যায়সঙ্গত মনে করেন।
ফরহাদ মজহার তসলিমা নাসরিনের বই নিষিদ্ধের দাবিতে তৌহিদী জনতার বিক্ষোভের কার্যকারণও বিবেচনায় নিতে চান। তিনি বলেন, তসলিমা নাসরিন স্বঘোষিত জুলাই অভ্যুত্থানের বিরোধী। তিনি শুধু লেখক নন, হিন্দুত্ববাদী দিল্লীর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পক্ষে একজন প্রপাগান্ডিস্ট। তার বিরুদ্ধে ‘তৌহিদী জনতার‘ প্রতিরোধ এবং রণধ্বনি সকল প্রকার গোলামির বিরুদ্ধে। এটা জুলাই অভ্যুত্থানের ধারাবাহিতকতা। উপদেষ্টা সরকারকে এটা বুঝতে আহ্বান করেছেন যে এই প্রতিরোধের পেছনে জনগণের গণঅভিপ্রায়ের উপাদান আছে। পাঠক খেয়াল করে দেখুন, সেলিম রেজা নিউটন ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাংচুরের ঘটনার পেছনে যে কারণটি উপদেষ্টা সরকারকে বিবেচনা করতে বলেছেন, সেই একই কারণ ফরহাদ মজহার বিবেচনা করতে বলছেন বইমেলায় বই নিষিদ্ধের দাবিতে তৌহিদী জনতার বিক্ষোভ প্রসঙ্গে। লেখকের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ নিয়ে ক্ষুব্ধ সমাজের প্রতি মজহারের পাল্টা জবাব হচ্ছে জাহানারা ইমামের গণআদালত ছিল “মবজাস্টিস” প্রকৃষ্ট উদাহরণ, তখন নাগরিক সমাজ এর সমর্থনই দিয়েছিলেন। এখানেও একটি নোক্তা প্রয়োজন। জাহানারা ইমামের গণআদালতও মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখেছেন তৎকালীন নাগরিক সমাজ, এর মধ্যে গণঅভিপ্রায় দেখেছেন, এমনকি ফরহাদ মজহার নিজেও দেখেছেন সেই গণঅভিপ্রায় যা তার “রাষ্ট্রদ্রোহী জাহানারা আসছে, হুঁশিয়ার” কবিতায় বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এর মধ্যে ব্যক্তি হিসেবে মজহারের অবস্থানের স্ববিরোধিতা আছে কি না সেটা জানা আমাদের উদ্দেশ্য না, আমাদের উদ্দেশ্য হলো, যেসব ঘটনাগুলো বিভিন্ন সময় রাষ্ট্র থেকে “মব” বলা হয়েছে তা আসলে “গণঅভিপ্রায়ের বিধ্বংসী বহিঃপ্রকাশ” কি না।
উপরের আলোচনায় দেখা যাচ্ছে “মব” এবং “অন্যায়ের প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ জনতা” কখনো এক হয়ে যাচ্ছে কখনো আলাদা হয়ে যাচ্ছে। এখানে যারা এক করছেন তারা কখনো আলাদা করছেন, আবার যারা আলাদা করছেন তারা কখনো কখনো এক করছেন। এই বিষয়টি আরও জটিল আরও একটি যুক্তিতে। জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের একদল দাবি করছেন তৌহিদী জনতাই যাত্রাবাড়ির যুদ্ধে প্রাণ দিয়ে বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনকে তরান্বিত করেছে। এই তৌহিদী জনতা শাহবাগ আন্দোলনকে ফ্যাসিবাদের সূতিকাগার মনে করে, এবং শাপলাচত্বরের পাল্টা আন্দোলনকে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের শুরুয়াত মনে করে। অর্থাৎ জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে তৌহিদী জনতার একটা সংহতি ছিল যখন ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াই প্রত্যক্ষ ছিল। আজ সেই লড়াইয়ে জিতে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া অংশ যখন সরকার গঠন করেছে তখন তৌহিদী জনতার লড়াই শেষ হয়নি। তৌহিদী জনতা তাদের মনমত রাষ্ট্র চায়, যা এখনো অর্জিত হয়নি। সেই বাবদে তৌহিদী জনতা একটি রাজনৈতিক কমিউনিটি যাদের ইমাজিনেশনে একটি আদর্শ রাষ্ট্র বর্তমান। বাস্তবে বিদ্যমান রাষ্ট্র যদি সেই রাষ্ট্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে নৈরাজ্য (নৈরাষ্ট্র) তৈরি করা তাদের জন্য দায়িত্ব হয়ে পড়ে, আইন নিজের হাতে নেয়া কর্তব্য হয়ে পড়ে। তারা তাই করছে, ফলে তারা মাইন্ডলেস মব না। তুলনার জন্য “ঘাতক–দালাল নির্মূল কমিটি“র কথা তোলা যেতে পারে, কমিটিটি কি মব ছিল? ছিল না। জাহানারা ইমাম কি রাষ্ট্রদ্রোহী ছিলেন? ছিলেন না। তাদের ইমাজিনেশনের আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে রাষ্ট্রের আদালত থাকার পরও তারা গণআদালত গঠন করেছিলেন, অভিযুক্তের বিচার করে শাস্তি দিয়েছিলেন। ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। এখানে কোনটা ইতিবাচক বহিঃপ্রকাশ আর কোনটা নেতিবাচক তার কোনো সার্বজনীন ঐক্যমত্য নাই।

এমতাবস্তায় এদেরকে “মব” বলব না, বলব শ্যালো স্টেইট। শ্যালো স্টেইটের ধারণাটি আলোচিত হয় ডিপ স্টেইটের বিপরীতে। সরকার চালায় স্টেইট, কোনো কোনো রাষ্ট্রে সরকারকে চালায় রাষ্ট্রের অরাজনৈতিক অংশের ক্ষমতাধরদের একটি অংশ। সেই অংশটি রাষ্ট্রক্ষমতাকে ভেতর থেকে প্রভাবিত করে। মূলত রাষ্ট্র বিষয়ে নিজস্ব মতামতের প্রকাশ দেখতে ইচ্ছুক আর্মি, পুলিস ও আমলারা এই অংশটি তৈরি করেন। এরা তুলনামূলকভাবে স্থায়ী, অর্থাৎ সরকার আসে সরকার যায়, ডিপ স্টেট থেকে যায়। এরা সংগঠিত, অনুচ্চ, রাষ্ট্র পরিচালনা বিষয়ে অভিজ্ঞ, বাস্তবে রাষ্ট্র কেমন হবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। যদিও ডিপ স্টেট নিয়ে অনেক ফাঁপানো গল্প আছে, যার বেশির ভাগেরই ভিত্তি পাওয়া যায় না। সেসব বাদ দিয়ে এটুকুতো আমরা দেখতে পাই কখনো কখনো শাসন সরকারের হাতে থাকলেও প্রশাসন আমলা, পুলিস এবং আর্মিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই প্রভাবকে সাধারণতো নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়, কেননা এটার সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা নাই। আবার এও দেখেছি রাষ্ট্রের ক্রান্তিকালে ডিপ স্টেইট কখনো কখনো ইতিবাচক ভূমিকাতে জেগে ওঠে। এমনটাও প্রচার হয়েছে যে আর্মির ভেতর থেকে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পক্ষে একটি অংশ ভূমিকা রেখেছে। পারিপার্শ্বিক উপাত্তের আলোকে এটা বিশ্বাস করা যায়।
এবার ডিপ স্টেইটের প্রেক্ষিতে শ্যালো স্টেইটকে দেখা যাক। শ্যালো স্টেইট ডিপ স্টেইটের ঠিক উল্টা, এরা দৃশ্যমান, উগ্র, রাষ্ট্র কিংবা সমাজের আচরণে ক্ষুব্ধ এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় অনভিজ্ঞ। কিন্তু মিলের জায়গাটি হলো তাদেরও রাষ্ট্রচিন্তা আছে, তারা লক্ষ্য উদ্দেশ্যহীন না। যেমন ঘাতক–দালাল নির্মূল কমিটির একটা রাষ্ট্রচিন্তা ছিল। তৎকালীন বিএনপি সরকারের রাষ্ট্রচিন্তার সঙ্গে তার বনিবনা হয়নি। তাই তারা যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ভার নিজদের হাতে তুলে নিয়েছিল, সেটা প্রতীকী হলেও রাষ্ট্রের জন্য একটা চাপ। আবার যেমন আওয়ামী লীগ সরকারের রাষ্ট্রকল্পনার সঙ্গে হেফাজতের বনিবনা না হওয়া। হেফাজত সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। এরা শ্যালো স্টেইট, এরা রাজনৈতিক দল নয়, কিন্তু রাজনৈতিক দাবিকে কেন্দ্র করেই সংগঠিত। আজ যাদের তৌহিদী জনতা বলছি তারাও আওয়ামী লীগ সরকারের রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল, তখন অবশ্য ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের সঙ্গে তার সংহতি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এটাতো বোধগম্য যে তৌহিদী জনতার যে রাষ্ট্রকল্প তা পুরপুরি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি বলেই তারা ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাচ্ছে। আজ ড. ইউনূসের রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তোলাটা নেতিবাচক হিসেবে দেখছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই নেতিবাচকভাবে দেখার পেছনে যে যুক্তি সেটা ইতোমধ্যে আলোচনা করেছি। যে প্রতিক্রিয়া সরকার দেখাচ্ছে সেটারও সমালোচনা হাজির করেছি। তবে এটা স্বীকার্য যে জুলাই অভ্যুত্থান যে প্রতিশ্রুতি আর সুযোগ নিয়ে এসেছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রাষ্ট্রকে, তার সংবিধানকে সংস্কার করার, তা করতে রাষ্ট্রের সুস্থিতি প্রয়োজন। তাই উপদেষ্টা পরিষদকে উপদেশ দিতে চাই, তারা যেন কোনো শ্যালো স্টেইটকে ডিপ স্টেইটের অ্যাপেরাটাস দিয়ে “ট্রিট” না করে, বরং নিজেরাই “ডিল” করে বা মোকাবেলা করে। বিগত সরকার শ্যালো স্টেইটকে ট্রিট করতেই কিন্তু তাদের জঙ্গি সাব্যস্ত করে, আয়নাঘর বানায়, অনন্ত যুদ্ধে ঢুকে পড়ে।
তৌহিদী জনতার নামে যে ক্ষোভের প্রকাশ হয় তার মধ্যে তাৎক্ষণিকতা থাকলেও একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে। যেমন মাজার ভাঙা, বাউল–ফকির–বয়াতিদের উপর আক্রমণ করা গত রেজিমেও বেশ বিদ্যমান ছিল, বর্তমান রেজিমেও বিরাজমান আছে। তৌহিদী জনতার ব্যাখ্যা হলো, এসব শিরকী কাজ কারবার। এটা কোনো নতুন কথা নয়, বাউল ধ্বংসের ফতোয়াগুলো এই ধারণা থেকেই দেয়া। শিরক হলো তৌহিদের বিপরীত, ফলে একে ধ্বংস করতে হবে। শিরকের প্রশ্নে ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে ঘাবড়ে দেয়া সহজ, কেননা একটা ক্ষমার অযোগ্য একটি অপরাধ এবং এই অপরাধ কেবল মুসলমানদের উপরই প্রযোজ্য। শিরকের পরেই তৌহিদী জনতা আরও একটি বিষয়কে ক্ষমার অযোগ্য একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য করেন, তাহলো হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-কে নিয়ে কটূক্তি করা, যাকে ইসলামী পরিভাষায় বলা যায় শাতিম করা। শাতিমের অপরাধে যেকোনো ধর্মের ব্যক্তিকে শাস্তি দেবার বিধান রয়েছে তৌহিদী জনতার কাছে। বহু কেইস আছে যেখানে শাতিম–এ–রসুল, রসুল (সাঃ)-এর অবমাননার অভিযোগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিপীড়ন করা হয়েছে, বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি কবি সোহেল হাসান গালিবকে একটি কবিতায় তৌহিদী জনতার শাতিম–এ–রসুল খোঁজার অতি উৎসাহ নিয়ে ক্রিটিক করে একটি কবিতা লিখেছেন, সেটাকেও শাতিম–এ–রাসুল হিসেবে সাব্যস্ত করে তাকে বিপদে ফেলা হয়েছে, খবরের কাগজে এসেছে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নেয়া হয়েছে। এছাড়াও, বসন্তবরণ, নববর্ষবরণ, নারীদের ফুটবল খেলা থেকে শুরু করে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে তৌহিদী জনতার বক্তব্য আছে যা নাগরিক সমাজের সবার জন্য গ্রহণযোগ্য না। ফলে তাদের ক্ষোভ হয়, সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। সামনে শিয়া, আহমদিয়াদের ব্যাপারেও তাদের অসন্তোষ নিয়ে হাজির হবে অনুমান করা যায়। এখন উপায়? আমার মতে মুসলমান সমাজকে, নাগরিক সমাজকে সঙ্গে নিয়েই উপায় বের করতে হবে সরকারকে। তার কিছু ইঙ্গিত রেখে লেখাটির উপসংহার টানছি। তবে বলে নেয়া ভালো এ কোনো নতুন উপায় না, বহুল আলোচিত এবং উপেক্ষিত উপায়।

উপায়টি এক বাক্যে বললে বলা যায়: জান–মান–মাল ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে মানুষের জবানকে স্বাধীন করে দেয়া। তো, জবান স্বাধীন করা কেন গুরুত্বপূর্ণ? কেননা, জবান সরাসরি চিন্তাভাবনার সঙ্গে জড়িত। জবানের বা প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া চিন্তাভাবনা আগাতে পারে না। চিন্তাভাবনা না আগালে কোনো ব্যক্তি, বর্গ, জাতি (নেশন) আগাতে পারে না, তা পর্যবেক্ষিত সত্য। রাষ্ট্রকে তাই পরিষ্কার ধারণা দিতে হবে রাষ্ট্র কী ধরনের জবানকে সুরক্ষা দিবে, কী ধরনের জবানকে দিবে না। যেমন সরকার এবং সরকারের তৈরি করা রাষ্ট্রের ভার্শনের সমালোচনার সুরক্ষা দিতে রাষ্ট্র বাধ্য থাকবে। আবার, যেমন জনগণের জান–মান–মালের ক্ষতিসাধনের হুমকি ও সহিংসতার প্ররোচনা যেহেতু আইনত অপরাধ তার সুরক্ষা রাষ্ট্র দিবে না। এটা পরিষ্কার হতে হবে, যেসব বাচনিক, আঙ্গিক এবং অন্যান্য মাধ্যমগত প্রকাশ আইনত অপরাধ সেই অপরাধের অভিযুক্তের বিচার করা কেবলমাত্র রাষ্ট্রের এখতিয়ার। কোনো ব্যক্তি বা বর্গ অভিযুক্তের ক্ষতিসাধন করতে গেলে তাও অপরাধ বলে বিবেচ্য হবে প্রচলিত আইনে। কোনো স্পেশাল ট্রিটমেন্ট নয়, ট্রিটমেন্টের কোনো অর্থেই নয়। এটা হলো পূর্বকথিত উপায়ের সূচনার দিকটা, তবে দীর্ঘমেয়াদি সুফলের জন্য একটি বৃহত্তর সংলাপের প্রয়োজন। সেই সংলাপের বিষয় হলো বাংলাদেশে মুসলমান প্রশ্ন। সামাজিক পরিসরে নাগরিক সমাজ মুসলমান প্রশ্নটির ধারাবাহিক আলাপ হওয়া দরকার।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, ইসলাম প্রশ্নের কথা বলছি না, বাংলাদেশে ইসলাম কোনো প্রশ্ন নয়। যা হাজির আছে, তাহলো মুসলমান প্রশ্ন। মাইনরিটিকেই সবসময় প্রশ্ন আকারে দেখা হয়ে আসছে, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, হেফাজত, তৌহিদী জনতা, প্রভৃতির শ্যালো স্টেইটের ক্ষুব্ধ উপস্থিতির প্রেক্ষিতে, ম্যাজোরিটির প্রশ্নটি ফয়সালা করা দরকার। কেননা উপরোক্ত শ্যালো স্টেইটগুলো ম্যাজোরিটির দোহাই দিয়েই চাপটা তৈরি করে। উল্টো দিকে যাদের দোহাই দিয়ে এরা তাদের ক্ষোভ দেখায়, সেই বাংলাদেশে মুসলমানদের মধ্যে তৌহিদী জনতা নামের উপবর্গ বা সাব–ক্যাটাগরিটি হীনম্মন্যতা সৃষ্টি করে। প্রশ্ন জাগে, বাকি মুসলমানরা তাহলে তৌহিদী না? অথচ বিশ্বাসী মুসলমান মানেই তৌহিদী জনতা, কারণ তারা তৌহিদ অথবা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করেন। আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস, অর্থাৎ এক আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নাই, এ কথা বিশ্বাস করেই একজন মানুষ মুসলমান হয়।
ফলে, প্রায় নব্বই শতাংশ মুসলমান অধ্যুষিত দেশে “তৌহিদী জনতা” বা “আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী জনতা” নামে একটি বিশেষ বর্গ করার কারণ নিয়ে জনপরিসরে তাদের প্রশ্ন করা দরকার। “তৌহিদী জনতা” নামে পরিচিত মুসলমানদের যদি সত্যিই কোনো রাষ্ট্রকল্প থাকে, অর্থাৎ আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা থাকে, যেমন তৌহিদী রাষ্ট্র বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী রাষ্ট্র, তবে তাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সেটা শোনা উচিত, তাদের সঙ্গে সংলাপ করা উচিত। বাংলাদেশের ম্যাজোরিটি মুসলমান যে গণতন্ত্র চায়, সেটা তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। ম্যাজোরিটি মুসলমানের রাষ্ট্রকল্পের সাক্ষী বাংলাদেশের ইতিহাস। তৎকালীন পাকিস্তান পূর্ববঙ্গসহ ইসলামিক রিপাবলিক গড়ে একনায়কতন্ত্রের দিকে গিয়েছিল, ইসলামের অপমান করে লাখো মুসলমানকে হত্যা করেছিল সেই একনায়কতন্ত্র। শেষপর্যন্ত, পূর্ববঙ্গের লক্ষ লক্ষ মুসলমান পিউপল‘স রিপাবলিক আনার জন্য সত্তরে ভোট দিয়েছিল, একাত্তরে জীবন দিয়েছিল। সেই পিউপল‘স রিপাবলিক যখন বিভিন্ন সময় একনায়কতন্ত্রে বা ফ্যাসিবাদে মোড় নেয়, গণতন্ত্রকামী মুসলমানরা তাদের পিউপল‘স রিপাবলিক ফিরিয়ে আনতে জীবন দিয়েছে। এখন “তৌহিদী জনতা” বাংলাদেশের ম্যাজোরিটি মুসলমানের আদর্শ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চায় কি না, সেটা পাবলিক পরিসরে পরিষ্কারভাবে বলুক।