সাংবাদিকতা, সাংবাদিকতার মান, ক্রমাগত কোণঠাসা হতে থাকা, টিকে থাকার উপায়–কৌশল ইত্যাদি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল অনেকদিন ধরেই। সাংবাদিক–লেখকদের তুলে নিয়ে যাওয়া, গুম, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া; এসবও চলছিল জোরতালে। অল্প কদিন আগেই তো জেলের ভেতরে মারা গেলেন লেখক মুশতাক। ১০ মাস কারাভোগের পর জামিন পেলেন কার্টুনিস্ট কিশোর। জামিন পেলেন সাংবাদিক কাজল। এসব গলা চেপে ধরা, শ্বাস না নিতে পারার মতো পরিস্থিতি চলছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। বিশেষকরে সর্বশেষ ‘নির্বাচন’–এর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই যা আরও তীব্র হয়েছে।
সম্প্রতি আবার দেশের সাংবাদিকতা জগতে তোলপাড় ফেলেছে প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে ৫ ঘণ্টা ধরে আটকে রেখে হেনস্তা এবং ঔপনিবেশিক আমলের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট–এর আওতায় মামলা দেওয়ার ঘটনায়। কেন–কীভাবে ঘটতে পারছে এসব ঘটনা? দেশে সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ কী? সত্যিই কি সাংবাদিকরা তাদের পাঠক–দর্শককে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানাতে পারবেন? নাকি শুধু প্রেস রিলিজ থেকে সংবাদ করে যেতে হবে? আর সত্যিই কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করতে গেলে হেনস্তা ও জেলে যেতে হবে রোজিনা ইসলাম, কাজলসহ আরও অনেকের মতো?
কীভাবে তৈরি হলো এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি? কেন পত্রিকাগুলোতে কার্টুন ছাপা বন্ধ হয়ে গেল? কেন সংবাদ সম্মেলনগুলোতে শুধু তেলতেলে বক্তব্য ছাড়া সত্যিকারের কোনো প্রশ্ন থাকে না? সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না কেন? সংবাদমাধ্যমগুলো কী সত্যিই আপামর জনসাধারণের জন্য কাজ করে? নাকি একটি বিশেষ শ্রেণির উদ্দেশ্য–স্বার্থ চরিতার্থের লক্ষ্যে কাজ করে? এই সাংবাদিকতা কি সত্যিই স্বাধীন সাংবাদিকতা নাকি পুঁজি–ব্যবসা ও ক্ষমতার সামনে নতজানু সাংবাদিকতা?
বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমগুলো আদতে উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের স্বর। তারা দুনিয়াকে উপস্থাপন করে এই শ্রেণীর দৃষ্টিকোণ থেকে। সেই শ্রেণীর ভালোমন্দ, নীতি–নৈতিকতা অনুসারে। কারণ তাদের ব্যবসাও এই শ্রেণীকে ঘিরেই। পত্রিকায় বা চ্যানেলে বা অনলাইন পোর্টালে যাদের উদ্দেশে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়; তারা সেই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী। ফলে এরাই নিউজরুমগুলোর টার্গেট অডিয়েন্স। বাংলাদেশে সে অর্থে বলতে গেলে সত্যিকারের কোনো গণমাধ্যম কখনো দাঁড়ায়ই নাই। যেটি সব ধরনের ক্ষমতা ও পুঁজির প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে; প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের কথা ভাববে এবং তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্যও কাজ করবে; মুক্ত তথ্য সরবরাহ বজায় রাখবে সমাজের সব শ্রেণি–পেশার মানুষের জন্য।
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের এই হেনস্তা ও জেলে যাওয়ার ঘটনায় সাংবাদিকতা কমিউনিটির প্রায় সবাই–ই অন্তত এই জায়গায় একাট্টা হয়েছেন যে, ‘না, এমনটা চলতে পারে না। আমরা যা করছি, তা অপরাধ না। এজন্য কোনোভাবেই জেল–জুলুম–হয়রানি করা যায় না।’ কিন্তু উত্তরণের পথ কী? তা যদি আমরা খুব ভালোভাবে তলিয়ে না দেখি… একদম গোড়া থেকে… তাহলে উত্তরণের কোনো পথ আগামীতে পাওয়ার আশা নেই। আবার দু–দিন পর থেকে সবাই সেই একই ধারায়, একই প্রক্রিয়ায় কাজে ফিরে যাব, এবং দু–দিন পর আবার নতুন কারও সাথে এমনটা ঘটবে। আবার আমরা রাস্তায় দাঁড়াবো। চলতে থাকবে দুষ্টচক্রের মতো! এই দুষ্টচক্র ভাঙা যায়, যদি আমরা সমস্যার একদম গোড়ায় গিয়ে চিন্তা করি।
সাংবাদিকতা কী? সমাজে সাংবাদিকতার ভূমিকা কী? কাজ কী? সাংবাদিকতার সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক কেমন হবে? কীভাবে সাংবাদিকতা সত্যিকার অর্থেই জনতার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠবে? স্বাধীন সাংবাদিকতা–ই বা কীভাবে হয়? সাংবাদিকরা কি স্বাধীন–সৃজনশীলভাবে কাজ করতে পারেন? বেতন–ভাতা ঠিকঠাক পান? বার্তাকক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের অংশগ্রহণ আছে? বার্তাবিভাগে কি সেই গণতান্ত্রিক পরিবেশ আছে? বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর কি কোনো পলিসি–নীতিমালা–গাইডলাইন আছে? সবার জন্য উন্মুক্ত অবস্থায়? শিশু বা জেন্ডার বিষয়ে তাদের পলিসি কী? তারা কী সমর্থন করে, আর কী করে না? আমি একজন পাঠক–দর্শক হিসেবে জানতে পারব তাদের এই পলিসি সম্পর্কে? বা খুবই সাধারণ একটি বিষয়: প্রতিটা সংবাদমাধ্যমের কি নিজস্ব বানান–রীতি আছে? দেখা যাবে: এগুলো নেই, পাওয়া যায় না।
পাঠক–দর্শকদের কথা বাদ দিলেও, সাংবাদিকদের নিজেদের সুরক্ষা, ভালো থাকা, ও ভালোভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালনের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য আরও অনেক ধরনের উদ্যোগ দেখা যায় আন্তর্জাতিকভাবে। সাংবাদিকরা কোথাও পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ ধরনের হয়রানির শিকার হলে তাৎক্ষণিকভাবে কী করবেন; তার প্রোটোকল থাকে। যৌন হয়রানি বা সহিংসতার শিকার হলে, ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যাহত হলে, মানসিক চাপে ভুগলে; কী করবেন, তার প্রোটোকল থাকে। সবার জানা থাকে: এমনটা ঘটলে কী করতে হবে। আমাদের এখানে এসব বিষয় তো অনেক দূরের ব্যাপার, সাধারণ একটা বানানরীতি পর্যন্ত নাই। অনেক সাংবাদিক ঠিকঠাক বেতনও পান না। ছাঁটাই, অসম্মানের শিকার হলেও কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। প্রতিবাদ জানাতে গেলেও মালিকপক্ষ ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে তাদের ঠেঙিয়ে তুলে দিতে পারে। কোথাও টুঁ শব্দ করার বা অভিযোগ জানানোর জায়গা নেই। কেন তৈরি হয়েছে এমন পরিস্থিতি? সাংবাদিকরা কি এমনটাই চান?
যারা বড় সাংবাদিক; সাংবাদিক নেতা, নিউজরুমের হর্তাকর্তা; তারা হয়তো পরিস্থিতির বদল না–ই চাইতে পারেন। কিন্তু দুই–তিন বছর ধরে কাজ করছেন— এমন সাংবাদিক? মিড ক্যারিয়ার সাংবাদিক? ভবিষ্যতে সাংবাদিক হবেন বলে ভাবছেন এমন আগ্রহীরা? আপনারাও কি এমন দমবন্ধ পরিস্থিতির মধ্যেই কাজ করতে চান? নাকি এমন পরিবেশ চান, যেখানে সত্যিকার অর্থেই জনস্বার্থে সাংবাদিকতা করা যাবে? যে সাংবাদিকতা পুঁজি ও ক্ষমতার গ্রাস থেকে মুক্ত থাকবে? নিউজরুমের প্রতিটি সাংবাদিক ও কলাকুশলীদের সর্বোচ্চ সৃজনশীল বিকাশের মতো পরিস্থিতি থাকবে। সত্যিই স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার থাকবে। নিউজরুমের সিদ্ধান্তগ্রহণে সক্রিয়ভাবে সবার অংশগ্রহণ থাকবে। অর্থনৈতিক, শারিরীক ও মানসিক সুরক্ষার নিশ্চয়তা থাকবে। সত্যিই এভাবে বদল চাইলে অনেক মূলগত প্রশ্ন এখন সামনে আনতে হবে এবং সেগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট বোঝাপড়া তৈরি করতে হবে।
শুধু যে ব্যক্তি সাংবাদিকের সুরক্ষা নিশ্চিত ও বিকাশের জন্যই এই বদলটা জরুরি, তাও নয়। এটি আসলে খোদ সাংবাদিকতা পেশা ও নিউজরুমগুলোরই ভবিষ্যতে টিকে থাকার প্রশ্ন। এগুলো যদি মোকাবিলা করতে না চাওয়া হয়, যেভাবে চলছে সেভাবেই চালিয়ে যেতে থাকা হয়; তাহলে অচিরেই প্রথাগত নিউজরুমগুলো ভয়াবহ অস্তিত্বের সংকটে পড়বে। কারণ এখন নিউজরুমগুলো থেকে যে ধারায় সাংবাদিকতা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা পাঠকপ্রিয় বা পাঠকের আস্থা অর্জন করতে পারছে খুবই কম। খুবই সীমিত একটি গণ্ডির মধ্যে নিজেদের বন্দি করে ফেলেছে বেশিরভাগ নিউজরুম। সেখানে নাই কোনো নতুনের চর্চা; নাই কোনো নতুন–সৃজনশীল উদ্যোগ। ফলে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মানুষ ক্রমেই বিমুখ হতে শুরু করছে প্রথাগত সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে। তিনশ শব্দের সেই একই একঘেঁয়ে ধরনের সংবাদ পড়ার চেয়ে এখন একটা মিম অনেক আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট জগতে। এবং এই প্রবণতাই যে ভবিষ্যতে বাড়বে, তা অনুমান করতে বেগ পেতে হয় না।
প্রয়োজনীয়তা যখন তৈরি হয়েছে, তখন আগামীতে নতুন ধারার সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠানও হয়তো দেখা যাবে। তা ছোট–বড় যে আয়তনেরই হোক। এবং তারা যদি সত্যিই জনস্বার্থমূলক বিষয় নিয়ে কাজ করে, সাংবাদিকতার মানোন্নয়নে কাজ করে; তাহলে অচিরেই মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করবে প্রথাগত সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে। এবং বেশি বেশি মনোযোগ দেবে নতুন ধারার সেসব মিডিয়ার দিকে। এগুলোও ভাবা উচিৎ নিউজরুমগুলোর হর্তাকর্তাদের।
মানুষ যখন চোখের সামনে দেখে যে, একটি পত্রিকার মালিক অন্যায় করেও পার পেয়ে যাচ্ছে এবং সেখানে সংশ্লিষ্ট ভিকটিমের নামেই পত্রিকায় কুৎসা-গীবত রটানো হচ্ছে, তখন মানুষের সেই সাংবাদিকতায় আর আস্থা থাকে না। এমন হাজারও উদাহরণ দেওয়া যাবে, যে জন্য মানুষের আস্থা থাকছে না মূলধারার সংবাদমাধ্যমের উপর, এবং সর্বোপরি সাংবাদিকদের উপর। ফলে এখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রাস্তায় ট্রাফিক সার্জেন্টও চাইলে সাংবাদিককে একটা থাপ্পড় বসিয়ে মামলা দিয়ে দিতে পারে। এতটাই সম্মানহীন ও ঠুনকো হয়ে পড়েছে এই সাংবাদিকতা পেশা। সবাই জানে: সব কিছুর মতো, সাংবাদিকতাও ক্রয়যোগ্য। এটাও শেষপর্যন্ত কেনাবেচারই হিসাব।
তো, আমরা এই পুঁজি–মুনাফা–ক্ষমতারই তোষামদ, হেফাজত করে যাব; নাকি সত্যিকার অর্থেই গণমুখী সাংবাদিকতা কীভাবে করা যায় এবং সমাজে নিজেদের সম্মান কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যায়, সেগুলো নিয়ে চিন্তা করব— তা এখন আমাদের ভাবতে হবে জোরেসোরে।