রেহনুমা আহমেদের ‘অসুখী বিয়ে’: বাম ধারা ও নারীবাদ প্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে, পাবলিক নৃবিজ্ঞান সিরিজের অংশ হিসেবে। ‘উপল’–এর আয়োজনে ‘লিঙ্গ, কর্তৃত্ব ও মুক্তি’ সিরিজের অংশ হিসেবে অরাজের পাঠকদের জন্য লেখাটি অরাজের সাইটে হুবহু তুলে দেয়া হলো। – সম্পাদক
ভূমিকা
এই পুস্তিকা–প্রবন্ধ তিনটি ভিন্ন–ভিন্ন অংশের সমন্বয়ে গঠিত, বলতে পারেন এটা একটা জোড়াতালি লেখা। বাম ধারা ও নারীবাদের সম্পর্ক অনুসন্ধানের প্রয়াস, আবার একইসঙ্গে এই প্রয়াসের পদ্ধতি কী হতে পারে, এ বিষয়গুলোকে ঘিরে এই প্রবন্ধ। পদ্ধতি–সংক্রান্ত আলোচনা প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ১।
প্রবন্ধের একেক অংশ একেক সময় লেখা বা অনুবাদ করা, শেষের অংশটি সর্বপ্রথম লিখেছিলাম (২০০৭), দ্বিতীয় অংশটি তার পরের বছর (২০০৮), আর প্রথম অংশটি, যেটি কিনা অনুবাদ, সেটি ২০১৩–তে।
প্রথম অংশ হচ্ছে “নিউ লেফ্ট ধারার নারী ও পুরুষ: মধুচন্দ্রিমার অবসান”। এটি লিডিয়া সার্জেন্ট সম্পাদিত উইমেন এন্ড রেভোলিউশন (১৯৮১) সংকলনের ভূমিকার অনুবাদ: “New Left Women and Men: The Honeymoon is Over”।২ এই সংকলনের প্রধান প্রবন্ধ লিখেছেন হাইডি হার্টমেন যার শিরোনাম হচ্ছে, “The Unhappy Marriage of Marxism and Feminism: Towards a More Progressive Union”। শিরোনামে উল্লেখিত Unhappy Marriage-এর সূত্র ধরেই উইমেন এন্ড রেভোলিউশন–এর সম্পাদক লিডিয়া সার্জেন্ট তাঁর ভূমিকার উপ–শিরোনামে ঘোষণা করেন: মার্ক্সবাদ ও নারীবাদের মধুচন্দ্রিমার অবসান ঘটেছে (The Honeymoon is Over)। হার্টমেনের শিরোনাম ধার করে এই পুস্তিকা–প্রবন্ধের শিরোনাম দিয়েছি:- ‘অসুখী বিয়ে’। বাম ধারা ও নারীবাদ।
দ্বিতীয় অংশটিও অনুবাদ— “পুরুষের লেখা স্ক্রিপ্টে নারীমুক্তি: মোশরেফা মিশুর সঙ্গে আলাপচারিতা”। এদেশের বাম নেতৃত্ব প্রসঙ্গে গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ইউনিটি ফোরামের সভাপতি ও বিপ্লবী ঐক্য ফ্রন্টের আহ্বায়ক মোশরেফা মিশুর সঙ্গে আলাপচারিতার ভিত্তিতে নিউ এইজ–এর জন্য লেখা আমার একটি কলামের অনুবাদ। মিশুর সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডা দিয়েছিলাম আগস্ট ২০০৮–এ; সেটি কলাম–আকারে কিছু দিন পরই ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছিল।৩
তৃতীয় অংশটি— “‘পেট’ বনাম ‘যোনি’ তত্ত্ব: একটি ক্রিটিক”— কয়েক বছর আগে হাতে নেওয়া একটি দীর্ঘমেয়াদী গবেষণাকর্মের অংশবিশেষ। আমার এই গবেষণাটি চলমান, তবে তার অর্থ এই নয় যে আমি এই মুহূর্তে এ নিয়ে কাজ করছি। থেকে–থেকে যখনই সময় পাব তখন আবার ধরব, এই হচ্ছে পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি। গবেষণাটি হাতে নেওয়ার ক্ষেত্রে উছিলা হিসেবে কাজ করেছিল বুদ্ধিজীবী–বিষয়ে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে এমন একটি সংকলন। কিন্তু সংকলনের সম্পাদক পরে আর যোগাযোগ না করাতে প্রবন্ধটি অপ্রকাশিত থেকে যায়।৪ এদেশের বাম/প্রগতিশীল পুরুষ বুদ্ধিজীবীদের ডিসকোর্সে লিঙ্গীয় ভিন্নতা প্রসঙ্গে গবেষণা করতে গিয়ে প্রথমেই হাত দিয়েছিলাম খ্যাতমান মার্ক্সবাদী বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহারের লেখায়।৫ তাঁর দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারের ক্রিটিক করেছি আমি। মজহারের সাক্ষাৎকারটি দৈনিক আজকের কাগজ–এ প্রকাশিত হয়েছিল ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ সালে, পুনঃপ্রকাশিত হয় “পার্টি ব্যক্তি লেখকের স্বাধীনতা” নামে সামনা সামনি। ফরহাদ মজহারের সঙ্গে কথাবার্তা (২০০৪) বইয়ে।৬ মজহারের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লিখিত ছোট্ট এই প্রবন্ধ, “‘পেট’ বনাম ‘যোনি’ তত্ত্ব: একটি ক্রিটিক”— এই পুস্তিকা–প্রবন্ধের শেষ অংশ। এটি লিখেছিলাম ২০০৭ সালে।
এই তিনটি ভিন্ন–ভিন্ন অংশ একইসূত্রে গাঁথা, যথা, মার্ক্সবাদ এবং নারীবাদ। তবে শুরুতেই একটি টীকা যোগ করছি সম্ভাব্য ভুল বোঝাবুঝি এড়ানোর তাগিদ থেকে। উইমেন এন্ড রেভোলিউশন বইয়ের লেখকদের আত্মপরিচিতি “নারীবাদী” (এবং মার্ক্সবাদী/বাম–ও)। বইটি লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ১৯৬০–১৯৭০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ লেফ্ট/নব্য বাম৭ ধারার ভিতরে নারী–পুরুষের সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। এই টানাপোড়েনের নিয়মানুবর্তিতা ও ধারাবাহিকতা নারীবাদীদের ভাবিয়ে তোলে; তা প্রশ্ন–আকারে প্রকাশ পায় এভাবে:-
এক. বাম/প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী পুরুষদের দৃষ্টিতে নারীবাদী সহযোদ্ধারা কি তাদের সমান? দুই. মার্ক্সবাদী দর্শন ও অনুশীলনের ভিত্তিতে সমাজ গঠিত হলে নারীরা কি সমতা অর্জন করতে পারবে?
সংকট দেখা দেয় কারণ মার্ক্সবাদ ও নারীবাদকে একীভূত করার প্রচেষ্টার “অপর নাম [হয়ে ওঠে] মার্ক্সবাদ”; হাইডি হার্টমেন একে ব্যাখ্যা করেন এভাবে, নব্য বাম ধারার আন্দোলনে নারীবাদীদের আন্দোলন পুঁজির বিরুদ্ধে বৃহত্তর সংগ্রামের অধীনস্ত হয়ে পড়ে। এতে নারীবাদীরা শঙ্কিত হন; তাদের প্রশ্ন হচ্ছে, যদি নব্য বামদের মধ্যেও— সনাতনী মার্ক্সবাদীদের মতোই— লিঙ্গীয় ভিন্নতা ও পুরুষ আধিপত্য তাত্ত্বিক ও বাস্তবিক–অর্থে গুরুত্ব না পায় তাহলে সমস্যাটা কোথায়, এবং নারীবাদীদের কী করা উচিৎ? সমস্যা কি মার্ক্সবাদী তত্ত্বের নাকি আন্দোলনকারী [মার্ক্সবাদী] পুরুষদের? নাকি দুটোই? একই আন্দোলনে নারী ও পুরুষের অভিজ্ঞতা ভিন্ন হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নারী আন্দোলনকারীরা নারীবাদী পরিচয় ও প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রশ্ন উত্থাপন করেন (তার উত্তরও অনুসন্ধান করেন) কিন্তু— এবং এতক্ষণে আমি ‘সম্ভাব্য ভুল বোঝাবুঝি’র জায়গাতে পৌঁছাচ্ছি— এই প্রবন্ধ–পুস্তিকার দ্বিতীয় অংশে স্পষ্ট যে, মিশু কিংবা নেপালের মাওবাদী কমরেড পার্বতী৮ নিজেদের একইসঙ্গে “বাম/কম্যুনিস্ট” ও “নারীবাদী” মনে করেন না। তাহলে কি তাঁদেরকে এই পুস্তিকা–প্রবন্ধ, যার উপ–শিরোনাম হচ্ছে “বাম ধারা ও নারীবাদ,” এতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ? কাজটা কি ঠিক করছি?
বিষয়টা জটিল, এটি ধরা পড়ে মিশুর কথা থেকে যখন তিনি বলেন, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে— পরিবারে, ব্যক্তিজীবনে, বিয়েতে— সমাজতান্ত্রিক আদর্শ চর্চিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা যখন আমি বলি তখন আমাকে “নব্য–মার্ক্সবাদী ডাকা হয়, নারীবাদী ডাকা হয়”। “নব্য–মার্ক্সবাদী”? তার অর্থ কি এই যে, এদেশের বাম পুরুষরা (পশ্চিমের) নিউ লেফ্ট ধারার পুরুষদের চিন্তাভাবনা ও আচার–আচরণের প্রতি তাদের সহযোদ্ধা নারীদের ক্রিটিকের কোনো খোঁজখবর রাখেন না? তা যদি সত্য হয়ে থাকে, এর থেকে কী বুঝব? এর থেকে আমরা নারীরা— ‘আমরা’ বলতে বোঝাচ্ছি যারা আনুষ্ঠানিকভাবে বাম আন্দোলনে আছেন (যেমন মিশু) এবং আমি/আমার মতো আরো–অনেকে যারা বাম–ঘেঁষা— আমাদের বাম পুরুষ কমরেডদের পড়াশোনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাব?
অপর দিকে কমরেড পার্বতী৯ বলেন, মার্ক্সবাদ কেবল নারী অধস্তনতার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও গভীর বিশ্লেষণ–ই হাজির করে না, একইসঙ্গে তার সমাধানও প্রস্তাব করে, একারণে আমরা আশা করতে পারি যে কম্যুনিস্ট আন্দোলনে থাকবে শত–শত নারী নেতা। কিন্তু “অব্জেক্টিভ কন্ডিশন” এর১০ উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও বাস্তব অবস্থায় দেখা যায় তার বিপরীত চিত্র। সেটি কেন ঘটে, তা বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত জরুরি। তাঁর মনে হয় এর কারণ হচ্ছে নারীবাদী আন্দোলন যেহেতু বুর্জোয়া বিপ্লবের ফলাফল তাই কম্যুনিস্ট দলগুলো নারীমুক্তির ব্যাপারে একমত হলেও তারা পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের শিকার। এটি নানাভাবে প্রকাশ পায়:- কম্যুনিস্ট আন্দোলনে নারীদের সম–অংশীদারত্ব স্বীকার না করে পার্টি তাদেরকে শুধু “সমর্থক” ভাবে। এর ফলে কম্যুনিস্ট দলগুলো শ্রেণী সংগ্রামের উপর অধিক গুরুত্বারোপ করে, তারা ভুলে যায় যে শ্রেণী সংগ্রাম ও নারী নিপীড়নের মধ্যকার সম্পর্ক হচ্ছে দ্বান্দ্বিক।১১ নারী কমরেডকে পুরুষ কমরেডের সমান না ভাববার কারণেই দেখা যায় যে পার্টি নারী–পুরুষের মধ্যে বিরাজমান সনাতনী শ্রমবিভাজনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় না। দেখা যায় যে, পার্টির পুরুষরা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করেন আর নারীদের ভাগে পড়ে কায়িক শ্রম। কমরেড পার্বতী বলেন, এটি আরও স্পষ্ট হয় যখন দেখি যে নারীর বিশেষ অবস্থার প্রতি (সন্তান ধারণ), তার বিশেষ চাহিদার প্রতি (মাসিক), পার্টি উদাসীন। “নারীর বেলায় নিপীড়ন দ্বৈত হওয়ার কারণে নারীর সংগ্রাম আরো দীর্ঘ।”১২
আমার কথা হচ্ছে, মোশরেফা মিশু বা কমরেড পার্বতী নিজেকে “নারীবাদী” বলুন আর নাই বলুন, তাঁরা নারীর অভিজ্ঞতার যেই বিশ্লেষণ ও যুক্তি/কাউন্টার–যুক্তি হাজির করেন, তা যে কোনো বিচারে নারীবাদী। আর সে কারণেই এই পুস্তিকা–প্রবন্ধে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও চিন্তাভাবনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সম্ভাব্য ভুল বোঝাবুঝির পাট চুকিয়ে এখন আগের কথায় ফিরে আসি। নিউ লেফ্ট আন্দোলনের নারীবাদীদের শঙ্কায় ফিরে আসি। তাঁদের মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে: নারী অধস্তনতা বোঝার জন্য অর্থনৈতিক বর্গ (অর্থাৎ, শ্রেণী)- ই কি পর্যাপ্ত? নিউ লেফ্ট আন্দোলনের অভিজ্ঞতা তাঁদের বলে, না। তাঁদের দৃষ্টিতে, লিঙ্গীয় শ্রমবিভাজন ও যৌনতা— নারী–পুরুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। কেন এবং কীভাবে তার বিস্তারিত বর্ণনা নিচে পাবেন (লিডিয়া সার্জেন্ট–এর লেখার অনুবাদ, “নিউ লেফ্ট ধারার নারী ও পুরুষ: মধুচন্দ্রিমার অবসান”)। সমস্যা মূলত (১) আন্দোলনরত নারী ও পুরুষের মধ্যকার কাজের ভাগাভাগি নিয়ে— আপিস কে পরিষ্কার করবে, কে মিটিংএর মিনিটস টাইপ করবে, কে কাগজপত্র ফাইল করে গুছিয়ে রাখবে, কে টেলিফোন করে মিটিং ও কর্মসূচীর বার্তা জানান দেবে, কে বিপ্লবীদের খাওয়াবে, সেবা–যত্ন করবে ও ভালোবাসবে, কে তাদের সমর্থন যোগাবে; আর কে বা কারা বিপ্লবী তত্ত্ব নির্মাণ করবে, কর্মসূচী নির্ধারণ করবে, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবে ইত্যাদি, ইত্যাদি। এবং (২) যৌনতাকে ঘিরে। এ প্রসঙ্গে মাথায় রাখা জরুরি যে ১৯৬০–৭০ দশকে পশ্চিমা (খ্রিস্টান–প্রধান) সমাজে সনাতনী যৌন আচরণের ক্ষেত্রে যে ডবল স্ট্যান্ডার্ড বিরাজ করত— অর্থাৎ, বউয়ের কুমারী হতে হবে— নারীবাদীরা এই অধিপতি ধারণা ও প্র্যাক্টিসকে চ্যালেঞ্জ করেন যার ফলে, অন্তত প্রগতিশীল মহলে, কিছুটা হলেও বদল ঘটা শুরু হয়।
ডবল স্ট্যান্ডার্ডের কথা মোশরেফা মিশুও বলেন। পুরুষ নেতাদের বান্ধবী থাকলেও এতে তাদের রাজনৈতিক ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। নারী নেতাদের সতী ইমেজ অপরিহার্য; কোনো কোনো বাম দলের ক্ষেত্রে নারী নেতারা পোষাক–পরিচ্ছেদের মাধ্যমে সতী ইমেজকে reinforce করেন। অন্যভাবে বললে, বিপ্লবী দলের মধ্যেও নারী নেতা/কর্মীর “চরিত্র” উৎকণ্ঠার বিষয় (বৃহত্তর সমাজের মতোই); বিপ্লবী নারীরও “সতী” হতে হবে (বৃহত্তর সমাজের অ–বিপ্লবী নারীদের মতোই)। মিশুর মতে বিয়ে, আর কমরেড পার্বতীর দৃষ্টিতে বিয়ে–পরবর্তী সন্তান–ধারণ, নারী কমরেডদের রাজনৈতিক অস্তিত্বে বড়সড় বদল ঘটায়:- তারা “গৃহের অন্তরালে হারিয়ে যান” (মিশু); “গৃহী দাসত্বের শৃঙ্খল আরো বেড়ে যায়, আরো প্রকট হয়” (পার্বতী)।১৩ এক্ষেত্রে পার্বতী এও উল্লেখ করেন যে, নিজের পছন্দের কমরেডকে বিয়ে করলেও এটি ঘটতে পারে। সন্তান লালনপালনের দায়ভার “একপেশে বোঝা” হয়ে দাঁড়ায় বিশেষ করে নেপালের সেই অঞ্চলগুলোতে যেখানে স্থানিক এলিটরা সনাতনী বা “traditional”।১৪ যৌনতার প্রসঙ্গ বাংলাদেশের বাম মহলে “ট্যাবু”; অবিবাহিত নারী নেতাদের ক্ষেত্রে “স্যাক্রিফাইস” আশা করা হয় (মিশু); নেপালের মাওবাদী কম্যুনিস্ট পার্টিতে নারী–পুরুষ, উভয় কর্মীর ক্ষেত্রেই বিয়ে না করাটা “সন্দেহের চোখে” দেখা হয়;১৫ যৌন নিয়মের লঙ্ঘন রাজনৈতিক নিয়ম লঙ্ঘনের চাইতে আরো বড় অপরাধ বলে বিবেচিত হয় (পার্বতী)।১৬ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে: বাম আন্দোলনে ‘বাম সত্তা’ বা ‘বিপ্লবী সত্তা’ বলতে কি অনায়াসেই পুরুষকে বোঝায় (যার মাসিক হয় না, পেটে বাচ্চা আসে না, যিনি ধর্ষণের শিকার হন না, আর ধর্ষণের শিকার হলে তা হয় নারীর–ই দোষে…? অন্য কথায়, ‘বিপ্লবী সত্তা’ বলতে অনায়াসেই নারীকে বোঝায় না— কারণ তার সত্তার সঙ্গে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িত গৃহীপনার মতাদর্শ, নীতি–নৈতিকতা ও শৃঙ্খলার প্রতি অবনত থাকার শর্ত?) পুরুষ চরিত্রই কি মানদণ্ড? ফরহাদ মজহারের সাক্ষাৎকার পড়ে (যার সমালোচনা এই পুস্তিকা–প্রবন্ধের শেষভাগে পাবেন, ‘পেট’ ও ‘যোনি’ তত্ত্ব), আমার মনে হয়েছে তিনিও বিষয়গুলোকে একই (পিতৃতান্ত্রিক) ফ্রেমওয়ার্কে দেখেন।
সংক্ষেপে বললে, পিতৃতন্ত্র সর্বব্যাপী ও শক্তিশালী; বাংলাদেশ/দক্ষিণ এশিয়ার বাম মহলে সাচ্চা বা জেনুইন আত্ম–সমালোচনার অভাব, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করার ফলে প্রাপ্ত সুযোগ–সুবিধাকে ‘স্বাভাবিক’ বলে ধরে নেওয়ার ঐতিহ্য— আর পাঠক’মাত্রই জানেন যে ‘স্বাভাবিক’ বলে ধরে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে রাজনৈতিক বিষয়ের বিরাজনীতিকরণ (de-politicisation )— শ্রেণী শোষণ বাদে অপরাপর অধিপতি ব্যবস্থাকে (লিঙ্গ, জাতি, বর্ণ, নরবর্ণ ইত্যাদি) তাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্য দিয়ে বুঝতে না চাওয়া, মোকাবেলা না করা— বর্তমানের বৈষম্য–ব্যবস্থাকে উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে। তাকে জোরদার করে ও জারি রাখে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নব্য বাম/প্রগতিশীল আন্দোলনে যারা সংগ্রামরত তাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা কীভাবে নারী ও পুরুষদের ভিন্ন কাতারে দাঁড় করায়, মুখোমুখি কাতারে দাঁড় করায় তারই বর্ণনা পাবেন এই পুস্তিকা–প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে ( ১ নং অংশ, নিচের থেকে পৃ. ১১ পর্যন্ত)।
১. লিডিয়া সার্জেন্ট, “নিউ লেফ্ট ধারার নারী ও পুরুষ: মধুচন্দ্রিমার অবসান”
১.ক অসুখী বিয়ে
হাইডি হার্টমেন ‘মার্ক্সবাদ ও নারীবাদের অসুখী বিয়ে’ নামক প্রবন্ধের প্রথম প্যারাতে লিখেছেন:
মার্ক্সবাদ ও নারীবাদের বিয়ে ইংলিশ কমন ল’তে স্বামী–স্ত্রীর সম্পর্কের মতোই: মার্ক্সবাদ ও নারীবাদ এক ও অভিন্ন, যার অর্থ, এই ঐক্যের অপর নাম মার্ক্সবাদ। মার্ক্সবাদ ও নারীবাদকে একীভূত করার সাম্প্রতিক প্রচেষ্টা নারীবাদী হিসেবে আমাদের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে কারণ নারীবাদী আন্দোলন অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে পুঁজির বিরুদ্ধে “বৃহত্তর” সংগ্রামের অধীনে। উদাহরণটা যদি আরো এগিয়ে নিতে চাই তাহলে বলতে হয়, এই বিয়েকে হয় স্বাস্থ্যকর করে তুলতে হবে নতুবা তালাকের বন্দোবস্ত করতে হবে (হার্টম্যান, পৃ. ২)।
…বাম/প্রগতিশীল আন্দোলনে, যার প্রধান মতাদর্শ মার্ক্সবাদ,১৭ আমরা যারা র্যাডিকাল,১৮ সমাজতান্ত্রিক,১৯ মার্ক্সিস্ট,২০ লেসবিয়ান,২১ এ্যানারকিস্ট,২২ কৃষ্ণাঙ্গ২৩— ভিন্ন–ভিন্ন ধারার নারীবাদী— তারা কি সমতা অর্জন করতে পারব? মার্ক্সবাদী তত্ত্ব ও চর্চাকে ঘিরে ভবিষ্যতে যে সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে সেখানে কি আমরা সমতা অর্জন করতে পারব?…
১.খ অসুখী বিয়ের কারণ
মার্ক্সবাদ ও নারীবাদের অসুখী বিয়ে নিয়ে আলোচনা জরুরি হয়ে পড়ে ১৯৬০ ও ’৭০ দশকের কৃষ্ণাঙ্গ–অধিকার আদায়ের আন্দোলন, নিউ লেফ্ট ও নারীবাদী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। নিউ লেফ্ট ঘরানার মধ্যে তর্ক–বিতর্ক, প্রতিবাদ সমাবেশ ও সাংগঠনিক কার্যকলাপ চলতে থাকে। তার–ই পরিসমাপ্তিতে মার্কিন পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিশ্লেষণ করা হয়, যা স্পষ্ট করে যে নিউ লেফ্ট এ্যাক্টিভিস্টরা মার্ক্সবাদী, লেনিনবাদী চিন্তা ও বৈপ্লবিক অনুশীলনের সঙ্গে যুক্ত বোধ করেন। নিউ লেফ্ট ধারা ওল্ড লেফ্ট এবং কম্যুনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক পার্টিগুলোর সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার ঐতিহ্যকে প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি লক্ষণীয় যে বিশ্বের কোনো না কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে, এবং যে দেশগুলো নয়া–ঔপনিবেশিক শক্তি থেকে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে যেমন কিউবা, ভিয়েতনাম, জিম্বাবওয়ে, চিলি… নিউ লেফ্ট একাত্ব বোধ করে। মার্ক্সবাদী ধারার মধ্যে অবস্থিত নিউ লেফ্ট নিঃসন্দেহে একটি নয়া ধরনের মার্ক্সবাদের সূচনা করে যেহেতু এটি স্টুডেন্ট ও তরুণ সংস্কৃতির ধারণাকে— যথা, পুঁজিবাদী/সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শ জীবনের প্রতিটি পরিসরে ছড়িয়ে পড়েছে, কি স্কুল, কি কর্মক্ষেত্র, সঙ্গীত, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, কমিউনিটি, পরিবেশ, এবং বিশেষ করে যৌন/সামাজিক সম্পর্কে— তার বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু রাজনীতিকে “ব্যাপৃত” করার যে উদ্যোগ নিউ লেফ্ট গ্রহণ করে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারীদের জন্য সীমিত ছিল কারণ এর মূল প্রতিপাদ্য ছিল: “পুরুষেরা বিপ্লব করবে আর ছেরিগুলোর সঙ্গে শোবে” [“men will make the revolution and make their chicks”]। নিউ লেফ্ট ও কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আদায়ের জন্য লড়াকু সংগঠনগুলোতে যে নারীরা সক্রিয় ছিলেন, তারা প্রধানত দুই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন: (১) দৈনন্দিন কাজকে ঘিরে উদ্ভূত সমস্যা (আপিস কে পরিষ্কার করবে/কে সেটাকে নোংরা করে, কে লিফলেট লিখবে/কে সেটা টাইপ করবে, কে সভায় কথা বলবে/কে তার মিনিটস লিখবে, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে কার মর্যাদা বাড়ে/কারটা কমে) এবং; (২) তত্ত্বের সমস্যা (কে বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে, কারা বিপ্লবী, বিপ্লব কাকে মুুক্ত করে, বিপ্লবচলাকালীন কে সংসার সামলে রাখবে)।
তত্ত্ব ও দৈনন্দিন কাজকে ঘিরে যে সমস্যা তৈরি হয় তার উত্তর খুঁজে পেতে নিউ লেফ্ট আন্দোলনে অংশীদার নারীদের খুব বেশি কসরত করতে হয়নি। প্রথম প্রশ্নের উত্তর মার্ক্সবাদ–ই বাতলে দেয়, আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর মেলে যৌনবাদী পুরুষদের [sexist men] সাহায্যে। অর্থাৎ, যারা উৎপাদনের কেন্দ্রে (শ্বেতাঙ্গ, শ্রমিক–শ্রেণীর পুরুষেরা) তারা, বিপ্লবী রাজনৈতিক ক্যাডারের সাহায্যে (তার মানে, শ্বেতাঙ্গ–মধ্যবিত্ত–পুরুষ যারা মার্ক্সবাদী তত্ত্বে নিমজ্জিত) বিপ্লব করবেন। নারী (প্রধানত শ্বেতাঙ্গ) বিপ্লব–চলাকালে সংসার সামলে রাখবেন, তাদের কাজ হচ্ছে বিপ্লবকে লালন করা, সেক্রেটারির ভূমিকা পালন করা: টাইপ করা, কাগজপত্র ফাইল করে রাখা, টেলিফোন করা, বিপ্লবীদের খাওয়ানো, তাদের সেবা–যত্ন করা, সমর্থন যোগানো, ভালোবাসতে থাকা, এবং হয়তবা, কখনো–সখনো, আধা–বিপ্লবী উৎসাহদাতা হিসেবে বিপ্লবের সম্মুখসারীতে থাকা।
এই কল্পিত দৃশ্যের কারণে (যা আমাদের কাছে দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়) নারীদের জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠে নিজেদের নিপীড়িত দশার ধরন, এবং তা যে কত বিস্তৃত, তাকে চিহ্নিত করা, তার সংজ্ঞা প্রদান করা। কারণ তা নাহলে বিপ্লবী “ভাইদের” কাছে নারীরা যৌন বস্তু ছাড়া ভিন্ন কিছু হতে পারবে না।
১.গ আপিস কে পরিষ্কার করে’র সমস্যা: আমাদের নিপীড়নের সমস্যাকে সংজ্ঞায়িত করা
বেটি ফ্রিইডান তাঁর দ্যা ফেমিনিন মিস্টিক বইয়ে ‘নামহীন সমস্যা’ [“the problem with no name ”] প্রসঙ্গে লেখেন:
আমেরিকান নারীদের মনের গভীরে একটি সমস্যা লুকিয়ে ছিল। এ নিয়ে কেউ কোনো কথা বলতেন না। আচমকা জেগে ওঠা অসন্তোষের একটি তীব্র বোধ, একইসঙ্গে একটি আকাক্সক্ষাও, মিলে–মিশে একাকার হয়ে বিংশ শতকের আমেরিকান নারীদের ভোগায়। শহরের কোলাহল থেকে দূরে সুসজ্জিত এলাকাগুলোতে (suburbia) প্রত্যেক গৃহিণী এই সমস্যায় ভোগেন। সকালবেলা বিছানাপত্তর গুছানোর সময়, বাজার–সদাই করার সময় কিংবা বাচ্চাদের সঙ্গে পিনাট–বাটার স্যান্ডউইচ খাওয়ার সময়, বা হয়ত যখন তাদের কাব স্কাউট বা ব্রাউনি মিটিংয়ে নামিয়ে দিচ্ছেন, হয়তবা রাতে স্বামীর পাশে যখন শুয়ে, তখন বারে–বারে এই ভাবনাটি মাথায় আসে, একটি প্রশ্ন যা উচ্চারণ করতেও ভয় লাগে: ব্যাস, এটাই কি সব? এর জন্যই কি এতকিছু?২৪
ঠিক যেসময়টাতে সাবারবিয়ার নারীরা ফ্রিইডানের ‘নামহীন সমস্যা’ পড়ছিলেন, তার সঙ্গে একাত্ব বোধ করছিলেন, সেসময়ে নিউ লেফ্ট নারীরা আন্দোলনের আপিস পরিষ্কার করছিলেন, সেটাকে গুছিয়ে রাখছিলেন, আন্দোলেনের কর্মীদের জন্য রান্নাবান্না করছিলেন, বাচ্চাদের দিনের বেলা দেখে–শুনে রাখছিলেন, গাড়ি ড্রাইভ করে প্রতিবাদ সমাবেশে এ্যাক্টিভিস্টদের পৌঁছে দিচ্ছিলেন, চিঠি ও লিফলেট টাইপ করছিলেন, ফোন ধরছিলেন, আর রাতেরবেলা আন্দোলনের প্রেমিক কিংবা স্বামীর পাশে শুয়ে জিজ্ঞেস করতে ভয় পাচ্ছিলেন, এই কি সব?
যদিও সিমোন দ’ ব্যুভোয়ার নারীর বিচ্ছিন্নতাবোধ, সমাজে জারি থাকা নারীর প্রতি অবমূল্যায়ন বোধের কোনো নামকরণ করেননি, কিন্তু দ্য সেকেন্ড সেক্স বইয়ে ১৯৪৯ সালে তিনি এটাকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছিলেন:
সুতরাং, মানবতা [humanity] হচ্ছে পুরুষ, আর পুরুষ নারীকে নারী হিসেবে সংজ্ঞায়িত না করে তাকে পুরুষের সাপেক্ষে করে; নারীর কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নেই… পুরুষ নারীকে যা ভাবে নারী তাই; সুতরাং, নারী হচ্ছে ‘লিঙ্গ’, যার অর্থ, পুরুষের দৃষ্টিতে একমাত্র নারীর–ই আছে যৌন পরিচয়। পুরুষের কাছে নারী হচ্ছে যৌনতা, নিরেট যৌনতা, আর–কিছু নয়। নারীকে পুরুষের সাপেক্ষে সংজ্ঞায়িত করা হয়, পুরুষের তুলনায় পৃথক ভাবা হয়, পুরুষকে নারীর সাপেক্ষে নয়। নারী হচ্ছে আনুষঙ্গিক এবং অকস্মাৎ। পুরুষ হচ্ছে অপরিহার্য। পুরুষ বিষয় (সাবজেক্ট), পুরুষ সর্বসর্বা। নারী তার ‘অপর’।
নিউ লেফ্ট রাজনৈতিক ধারায়, পুরুষ কর্তৃক নারীর “অপর” হওয়ার আছর দৈনন্দিন কাজের সবদিকেই ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মূল কেন্দ্র হচ্ছে, যা ব্যুভোয়ার বহু আগেই তাঁর বিশ্লেষণে ইঙ্গিত করেছিলেন, যৌনতা। পারসোনাল পলিটিক্স বইয়ে সারা ইভান্স বিবৃত করেন,
চোদার২৫ মধ্য দিয়ে নারী কর্মীর অস্তিত্বকে স্বীকার করা বহুস্থানেই সাধারণ চর্চা হিসেবে ধরে নেওয়া হলেও এটা ছিল [নারী কমরেডের প্রতি পুরুষ কমরেডের যৌনবাদী আচরণের] চরম বহিঃপ্রকাশ। একজন পুরুষ নারীর সাথে সঙ্গম করে তাকে সংগঠনের সদস্য করতে পারতেন, আবার তার সঙ্গে শোওয়াশুয়ির সম্পর্ক বন্ধ করে তাকে সংগঠন থেকে বাদ দিতে পারতেন। [সংগঠন থেকে] নারীর বহিষ্কার [নানা কারণে] ঘটতে পারত, পুরুষটির তাকে আর ভাল্ লাগছে না বলে, কিংবা সে অন্তঃসত্তা হয়ে পড়েছে বলে, বা অন্য কারো প্রতি তার [পুরুষ কমরেডের] আগ্রহ তৈরি হয়েছে বলে। আন্দোলন থেকে নারীকে বহিষ্কার করাটা অবিচলিতভাবে মেনে নেওয়া হতো।
আর তাই আন্দোলনে–সক্রিয় নারীরা একটি কষ্টকর ও হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির শিকার হন। এক দিকে তারা বুঝতে পারেন যে আন্দোলনের ভিতরে থাকা আর বাইরে থাকার মধ্যে গুণগত পার্থক্য আছে। ভিতরে থাকার কারেণ তারা গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান কাজ করতে পারছেন: যুদ্ধের বিরোধিতা করা, কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শামিল হওয়া। তারা ঝুঁকি নিচ্ছেন। শিখছেন। নিজেদের বিকশিত করার সুযোগ পাচ্ছেন। ১৯৫০–এর দশকে নারীর ভূমিকা যেই কঠোরতা ও কর্তৃত্বের সঙ্গে সংজ্ঞায়িত হয়েছিল, তারা সেটাকে প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু অপরদিকে নারীদের কাছে এটাও স্পষ্ট ছিল যে আন্দোলনে–সক্রিয় পুরুষদের কাছে (কোনো কোনো নারীর কাছেও) নারীর কার্যকলাপ ও আন্দোলনে থাকার বৈধতার ভিত্তি হচ্ছে প্রথাগত “নারীসুলভ” [feminine] ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অংশগ্রহণ করা, যথা, স্ত্রী, মা, বোন, রক্ষিতা, সেক্রেটারি, পরিচারিকা, পরিবেশিকা, নার্স ও যৌন বস্তু।
যৌনবাদ [sexism] মোকাবেলা করার প্রথমদিকের প্রচেষ্টার প্রত্যুত্তরে নারীদের যৌন–ইঙ্গিতময় গালাগালি শুনতে হয়েছিল [পুরুষ কমরেডদের কাছে থেকে], “কুত্তি, লেসবিয়ান, পুরুষত্ব–হানি করার চক্রান্তকারী” [bitch, lesbian, castrator]। সভা–সমাবেশে নারীরা সেক্সিজম নিয়ে প্রশ্ন তুললে পুরুষরা হৈচৈ করে হাঙ্গামা বাধাতেন আর চিল্লাচিল্লি শুরু করতেন যাতে তারা [নারীরা] মঞ্চ ছেড়ে দেন, [পুরুষ কমরেডরা] শিষ দিয়ে তাদের “ভালো একটা চোদা” নেওয়ার পরামর্শ দিতেন। নিজেদের আত্মপরিচয় গোপন করে নারীরা যখন যৌনবাদী আচরণ নিয়ে লেখেন তখন পুরুষরা তাদের উপেক্ষা করেন। পরে, যখন পুরুষদের পক্ষে উগ্র যৌনবাদী আচরণ করে পার পাওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে কারণ নারীরা বারে–বারে যৌনবাদ প্রসঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য চাপ দিতে থাকেন, এমনকি অসমতাকে ঘিরে কাঠামোগত সমাধানের প্রস্তাব হাজির করেন, তখন পুরুষরা আরো সূক্ষ্ম ধরনের যৌনবাদী আচরণে অবতীর্ণ হ’ন। তার ফলে, যৌনবাদ কী, এবং কী উপায়ে তা প্রতিরোধ করা যায়, এর পিছনে নারীদের অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে হয়। আবার একইসঙ্গে, যৌনবাদী আচরণ যে ঘটছে তা প্রমাণ করার পিছনেও তাদের অনেক সময় খরচ করতে হয়। নিচে, নারীরা কীভাবে যৌনবাদী আচরণকে চিহ্ণিত করেন, তার নামকরণ করেন ও তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন, তার বর্ণনা দেওয়া হলো।
১.গ.১ নারী সম্মেলনের আয়োজন
যৌনবাদ, যৌনবাদী রাজনীতি এবং এ ধরনের বিষয়ে নিজেদের অনুভুতি প্রকাশ করার জন্য নারীরা সাধারণত কৌশল হিসেবে কনফারেন্স ও বড় সভা চলাকালীন ‘নারী সম্মেলন’–এর আয়োজন করেন কারণ এ ধরনের ফোরাম ছিল পুরুষের ক্ষমতাগিরি থেকে মুক্ত। নারীদের দৃষ্টিতে তাদের এ ধরনের উদ্যোগ স্বার্থক; পুরুষদের বিবেচনায় তা আলাদা–কিছু, তারা নিজেরা যা করছেন তার সঙ্গে তুলনীয় নয়, গুরুত্বের বিচারে লঘু। পুরুষরা যেহেতু যৌন নিপীড়ক হিসেবে নিজেদের ভূমিকা আলোচনা করতেন না বরং মনোযোগী হতেন “গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়” এর প্রতি, নারীদের দোটানায় ভুগতে হতো: তারা কি একইসময়ে অনুষ্ঠিত–হওয়া নারী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন নাকি রাজনৈতিক বৈঠক কিংবা সভায় যাবেন।
১.গ.২ সভাপতি হিসেবে নারী
বড় দলের সামনে নারীরা যাতে কথা বলার সুযোগ পান, তার সুবিধার্থে পরিকল্পিত হলেও নারী–সভাপত্বিতে আয়োজিত মিটিং বাস্তবে পুরুষকে সভার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করার সুযোগ তৈরি করে দিত। ক্ষমতাশালী পুরুষরা বিশেষ কোনো নারীকে বাছাই করতেন সভা পরিচালনা করার জন্য (প্রায়শই এমন কেউ যার সঙ্গে সঙ্গমে আগ্রহী কিংবা ইতোমধ্যেই সঙ্গমের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে), মিটিং এ তার পাশে বসতেন। মিটিং চলাকালীন পুরুষরা কি কি করতেন: এজেন্ডার বিষয় তার কানে ফিসফিস করে বলা, কাকে এর পরে ডাকতে হবে তা বলে দেওয়া, সিদ্ধান্ত তার [পুরুষটির] মন মতো পালিত না হলে তাকে [নারীকে] তিরষ্কার করা, মিটিং ঠিক মতো পরিচালিত হচ্ছে না বলে মত প্রকাশ করা। অনেকসময় উপস্থিত অন্য পুরুষরা নানাধরনের আচরণের মধ্য দিয়ে নারী সভাপতি যে সভা পরিচালনায় অক্ষম সেই বোধ তৈরিতে সাহায্য করতেন: সভা চলাকালীন কথা বলা, হাসি–ঠাট্টা করা, কথা বলার সিরিয়াল ভঙ্গ করা, সভাপতিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা যাতে এটি স্পষ্ট হয় যে “সত্যিকার অর্থে গুরুত্বপূর্ণ সভা”র জন্য পুরুষ সভাপতি (অর্থাৎ, “শক্তিশালী” সভাপতি) ছাড়া উপায়ন্তর নেই।
১.গ.৩ অনুষ্ঠান পরিচালক হিসেবে নারী
বড় ধরনের স্থানিক কিংবা জাতীয় প্রতিবাদ সমাবেশে মঞ্চে থাকার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য অনুষ্ঠান পরিচালনা করার দায়িত্ব নারীদের দেওয়া হতো। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে নারীর দায়িত্ব পর্যবসিত হয় পুরুষ–বক্তাদের লম্বা তালিকা ঘোষণা করায়। তার মানে, নারীরা পরিণত হয় আন্দোলনের আপ্যায়নকারীর [hostess] ভূমিকায়। তিরিশ বা তার অধিক পুরুষ বক্তাকে মহিমান্বিত ভাষায় পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে অনুষ্ঠান–পরিচালনাকারী নারী যাতে তারা একে–একে যুদ্ধ, দারিদ্র, বৈষম্য, বর্ণবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগ দেওয়ার বাধ্য–বাধ্যকতা [draft policy ]-র বিরুদ্ধে, সরকার, প্রতিবেশ ইত্যাদির বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেন। এক্ষেত্রে দেখা যায় যে নারীকণ্ঠ শুধু তখনই শোনা যাচ্ছে যখন পরবর্তী বক্তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পালা।
১.গ.৪ বক্তা হিসেবে নারী
নারী বক্তার ব্যাপারে পুরুষদের আপত্তি ছিল না যতক্ষণ পর্যন্ত বক্তার বক্তব্য সেই বিশেষ অনুষ্ঠান কিংবা নারী–বিষয়ে সীমিত থাকত। তার অর্থ হচ্ছে যে কোনো বড় সভা কিংবা প্রতিবাদ সমাবেশে ঘোষক হিসেবে নারী উপরোল্লিখিত ভূমিকা পালন করতেন আর (হয়তবা) ২২তম পুরুষ বক্তার পর নারী ইস্যু নিয়ে কথা বলতেন। ততক্ষণে দেখা যেত যে দর্শকদের বেশির ভাগ হয় চলে গেছেন কিংবা দর্শক–পুরুষরা ঘুমিয়ে পড়েছেন বা নিজেদের মধ্যে কথা বলা শুরু করেছেন।
১.গ.৫ কৌশলপ্রণেতা হিসেবে নারী
এই কৌশল নানাভাবে ব্যবহৃত হতো। কোনো কোনো পুরুষ, নারী–কর্মী বা স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যকে এই উদ্দেশ্যে বাছাই করতেন যাতে মিছিল কিংবা প্রতিবাদ সমাবেশের পলিসি বা কৌশল বিষয়ে তার নিজের সিদ্ধান্ত কার্যকরি করা যায়। সাধারণত তারা বাছাই করতেন নতুন সদস্য কিংবা যারা অনভিজ্ঞ, তাদের। বন্ধুত্ব বা অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করার নামে (কখনো–কখনো আন্তরিক), পুরুষরা নারীদের সঙ্গে কৌশল নিয়ে আলোচনা করতেন। তারপর তারা যাতে এই কৌশলের পক্ষে মিটিংয়ে কথা বলেন, এ ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। যার কারণে নারীরা পরিণত হতেন পুরুষের সিদ্ধান্তের ‘বাহক’–এ। কখনো–কখনো দেখা গেছে যে সেই বিশেষ মিটিংএ পুরুষটি হয়ত জড়িতও নয়। তার অর্থ, নারীর ভূমিকা হচ্ছে তার প্রক্সি হওয়া। আবার এও দেখা গেছে যে পুরুষটি উপস্থিত, ‘বাহক’ সম্পর্কের কারণে পুরুষটিই ভোট পাচ্ছেন কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে ডমিনেটিং না মনে হওয়ার কারণে তিনি নারীদের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন না। কখনো–কখনো বাহক সম্পর্ক যৌনসম্পর্ক স্থাপনের সূত্রপাত হিসেবেও কাজ করত।
১.গ.৬ কর্মীবৃন্দের নেতা হিসেবে নারী
বহু আন্দোলনকারী–সংগঠন গঠিত হয় (ক) কর্মীবৃন্দ [staff] দ্বারা, যারা দৈনন্দিন কাজ সম্পাদন করেন এবং (খ) স্টিয়ারিং কমিটি দ্বারা, যাদের দায়িত্ব হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। বহু ক্ষেত্রে দৈনন্দিন কাজ সম্পাদনকারী স্টাফ–এর বেশির ভাগই ছিল নারী আর স্টিয়ারিং কমিটিতে ছিল পুরুষরা। যার ফলে স্টাফ সদস্য হিসেবে নারীরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ দৈনন্দিন কাজ সম্পাদন করলেও পুরুষ–প্রধান স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যরাই ঠিক করতেন আন্দোলেনর দিকনির্দেশনা ও পলিসি। কিছু–কিছু ক্ষেত্রে এটি অপ্রাসঙ্গিক ছিল কারণ দেখা যেত যে যারা দৈনন্দিন কাজ করছেন তারা স্টিয়ারিং কমিটির তুলনায় বেশি পলিসি নির্ধারণ করছেন। কিন্তু অনক সময় কাজের গতিপ্রকৃতি বা ডাইন্যামিক সাধারণ আপিসের মতোই ছিল: অর্থাৎ, পুরুষ হচ্ছে বস্, আর নারী হচ্ছে তার সেক্রেটারি।
১.গ.৭ ভাগাভাগি করে আপিস পরিষ্কার করা
মিশ্র সংগঠনে সম্ভবত এটাই ছিল সংঘাতের প্রধান কারণ। পুরুষরা যাতে আপিস পরিষ্কার করা, রান্না–বান্না করা, আন্দোলনের আপিস— যা একইসঙ্গে যূথবদ্ধ রাজনৈতিক সংসার [ঢ়political collective household ]— গুছিয়ে রাখার কাজে অংশগ্রহণ করেন, সে কারণে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত রোটেশান সিস্টেম চালু করা হয়। এই ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত স¦ার্থক হয়নি। প্রথমত, পুরুষরা ভাব দেখাতেন যে তারা জানেন না পরিষ্কার করার অর্থ কী। নারীরা পরিষ্কার করার নিয়মনীতি টাইপ করে দিলে’পর, এক সপ্তাহ অনুশীলন করার পর সেটি উপেক্ষিত হতো। পুরুষরা আরেকটা পন্থা অবলম্বন করতেন, “যখন তোমাদের (নারীদের) পরিষ্কার করার পালা, তখন তোমরা (নারীরা) পরিষ্কার করবে; আর যখন আমাদের (পুরুষদের) পরিষ্কার করার পালা আমরা ৫ মিনিটের মধ্যে পরিষ্কার করে ফেলব।” তাদের আরো একটা পন্থাও ছিল, “যখন তোমাদের পরিষ্কার করার পালা, তোমরা পরিষ্কার কোরো, যখন আমাদের পরিষ্কার করার পালা, আমরা করব না।” এরপর পুরুষরা এ নিয়েও অভিযোগ করেন যে পরিষ্কার–করা নিয়ে নারীরা ঘ্যানর–ঘ্যানর করলে তাদের নিজেদের মা’র ঘ্যান–ঘ্যানানির কথা মনে পড়ে যেটা তারা কোনোভাবেই মনে করতে চান না। অর্থাৎ, নারীর কারণে–ই পরুষরা পরিষ্কার করেন না। নারীরা–ই দোষী। তারই আরেক রূপ প্রকাশ পায় যখন দলীয় পরিষ্কার অভিযানে দেখা যায় যে নারীরা আপিসঘর পরিষ্কার করছেন আর পুরুষরা হঠাৎ করে ফোন ধরায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। পুরুষদের চ্যালেঞ্জ করা হলে তারা বলেন, দলীয় কাজে তাদের যেটুকুন অংশগ্রহণ করার কথা ছিল তা তারা ইতিমধ্যেই সেরে ফেলেছেন। আরো ঘটনাও ঘটত। যেমন, কোনো–এক–মাহেন্দ্রক্ষণে–বড়সড়–পরিষ্কার–অভিযানে–নেমে নারীদের খুশি করার কৌশল। এ সময় দেখা যেত যে পুরুষরা আসলেও পরিষ্কার করার বড় কোনো একটা কাজ হাতে নিয়েছে যেমন ধরেন জানালা পরিষ্কার করা, ঘর রঙ করা (এতে করে কাজ–শেষে ঘরদোর আরো অগুছালো হতো) কিন্তু তারা ময়লা বিনে [bin] ফেলছেন না। চারপাশে খাবারের বাক্স পড়ে থাকা বা সদর দরজার সামনে লিফলেটের বাক্স পড়ে থাকা, এসব তাদের চোখে পড়ছে না। কিন্তু তাতে কি? মাহেন্দ্রক্ষণের অভিযানের পর পুরুষদের মনে হতো তারা নারীদের দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা নারীদের মতোই, বা তাদের চাইতে আরো ভালোভাবে ঘরদোর পরিষ্কার করতে পারে।
১.গ.৮ সভায় নারীদের কথা বলা
সভায় নারীরা যাতে পুরুষদের মতো সমানভাবে কথা বলতে পারে তার জন্য নানান পথ বেছে নেওয়া হয়েছিল: সভা পরিচালনার দায়িত্বে যিনি তিনি যে নারীরা কোনো বিষয়ে কথা বলেননি তাদের কথা বলার জন্য উৎসাহ দিতেন; স্লিপ ব্যবস্থা; সময় বেধে দেওয়া, পুরুষদের আগে নারীদের কথা বলার জন্য আহ্বান করা ইত্যাদি। এই পন্থাগুলোর ক্ষেত্রে পুরুষদের প্রতিক্রিয়াকে সবচাইতে ভালোভাবে এই বলে বর্ণনা করা যায়: “যেই বিরতি চাঙা করে তোলে” [“the pause that refreshes”]। অথবা, “মেয়েরা কথা বলতে পারে কিন্তু আমাদের যে শুনতেই হবে এমন তো নয়”। এর বাস্তব অর্থ ছিল যে নারীরা যখন সভায় কথা বলতেন তখন পুরুষরা হয় কাশতেন বা বিড়বিড় করতেন বা বই পড়তেন কিংবা নারীর কথার প্রতি মনোযোগী না হয়ে আগের পুরুষ বক্তার বক্তব্যকে কিভাবে খণ্ডন করা যায়, তা নিয়ে ভাবতেন। সভায় নারীদের কথা বলা ছিল পুরুষদের নিজেদেরকে চাঙা করে তোলার বিরতির সময়।
১.গ.৯ সবটুকু কানে না–তোলা
উপরে যা উল্লেখ করেছি তার–ই আরেক রূপ: পুরুষরা তখন–ই নারীদের কথা শুনতেন যখন তাদের মন চাইত। অর্থাৎ, কোনো নারী ধরেন নকশা নিয়ে কথা বলছেন তখন পুরুষরা শুনছেন কিন্তু তিনি যখন রাজনীতি প্রসঙ্গে কথা বলছেন তখন পুরুষরা আর–শুনছেন না। কিংবা দেখা যায় যে পুরুষরা “মনোযোগ দিয়ে শুনছেন” তখনই যখন তারা সেই বিশেষ নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে ইচ্ছুক। সেক্ষেত্রে পুরুষদের হাঁ–সূচক ঢঙে মাথা নাড়তেও দেখা যেত। অথবা, নারীটি যদি দেখতে আকর্ষণীয় হয়, তাহলে দেখা যায় যে নারীটি যখন অফিস কিভাবে সাজিয়ে রাখলে ভালো এ নিয়ে কথা বলছেন তখন পুরুষরা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন কিন্তু যখন একই নারী সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গে কথা বলছেন তখন পুরুষদের মনোযোগের ঘাটতি ঘটছে। আত্মপ্রত্যয়ী নারীদের লেসবিয়ান বলে সম্পূর্ণভাবে খারিজ করে দেওয়া হতো। আর লেসবিয়ান নারীদের কথা কোনোভাবেই কানে তোলা হতো না।
আন্দোলনকারী–সংগঠনে নারীরা যখন সমতার জন্য লড়াই করতে থাকেন তখন পুরুষরা দমনের অন্তিম পথ বেছে নেন: “মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রতিরোধ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক লড়াই; পুঁজিবাদী শ্রেণীকে উৎখাত করার লক্ষ্যে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রাম হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম।” সুতরাং, স্বাভাবিকভাবেই তত্ত্বের সমস্যা দেখা দেয়। তার কারণ, দৈনন্দিন কাজের পরিসরে এতোসব উদ্যমের পরও যদি নারীদের মার্ক্স, লেনিন ও মাও–এর অধ্যায় বা উদ্ধৃতি পড়ে শোনানো হয়, যদি ভাই/বাবা–রা তাদের বলেন, যাও তোমাদের কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো, এইটিন্থ ব্রুমেয়ার, অন কন্ট্রাডিকশান, পুঁজি–র তিন ভলিউম, বা তোমাদের ইমপিরিয়ালিজম: দ্য হাইয়েস্ট স্টেজ অফ ক্যাপটিালিজম এর কপি নামিয়ে পড়ো, যদি বলা হয় পরবর্তীকালের মার্ক্সবাদীদের কাজ, হাবারমাস, মারকিউস, ওয়েবার, আলথুসার, সুইজি, ম্যাগডফ, ব্রেভারমেন–বাহিনীর কাজ পড়ো, তাইলে আপিস কে পরিষ্কার করবে’র প্রশ্নটি তত্ত্ব এবং বাস্তব— উভয় পর্যায়েই নারীর লড়াইয়ের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে।
১.ঘ তত্ত্বের সমস্যা
নিউ লেফ্ট আন্দোলনের নারীরা যখন যৌনবাদকে একটি বৈধ তাত্ত্বিক ইস্যু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেন তখন তাদের শুনতে হয় “নারীর জন্য সবচাইতে ভালো পজিশন হচ্ছে সমান্তরাল পজিশন [যৌনসঙ্গী/নিষ্ক্রিয় হিসেবে]” [“the best position for women is horizontal”]। নিউ লেফ্ট পুরুষদের যৌনবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে নারীদের সামনে তিনটি পথ খোলা ছিল: (ক) আন্দোলনের ভিতরে থেকেই লড়াই করতে থাকা (খ) আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র নারী সংগঠনে লড়তে থাকা, কিংবা (গ) দুটোই করা: থেকে যাওয়া, চলে যাওয়া। থেকে যাওয়ার অর্থ যেমনটি শিলা রোবথ্যাম উইমেন, রেসিস্ট্যান্স এ্যান্ড রেভোলিউশান–এ বলেন, “যা একান্তভাবে নারী চৈতন্য [feminist consciousness তাকে বর্জন করে বরং ভান করা যে নারীরা সুনির্দিষ্টভাবে [অর্থাৎ, নারী হিসেবে] নিপীড়িত নন”। আর চলে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে নারী চৈতন্যকে মুক্তির অপরাপর আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। একইসঙ্গে দুটো করার অর্থ হচ্ছে দ্বিখণ্ডিত ব্যক্তিসত্তা (পার্সোন্যালিটি), দ্বিখণ্ডিত আনুগত্য, সময়কে দুই ভাগে ভাগ করা, রাজনৈতিক বিশ্লেষণকে দুই ভাগে ভাগ করা। নারীরা যেই পথ–ই বেছে নেন না কেন, এক পর্যায়ে দেখা যায় যে বেশির ভাগ নারী–ই পুরুষ–প্রধান নিউ লেফ্ট আন্দোলন থেকে বেরিয়ে এসেছেন, তারা নিজেদের রাজনীতি, তত্ত্ব ও সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করা শুরু করেছেন। ১৯৬০–এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৭০–এর দশকের শুরুর দিকে এই নয়া স্বতন্ত্র নারী আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছিল তার কর্মপদ্ধতি যার বৈশিষ্ট্য ছিল: ছোট, স্তরবিহীন, সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য দল গঠন [consciousness raising group]; “দ্য পার্সোনাল ইজ পলিটিক্যাল” (যা ব্যক্তিক তাহা রাজনৈতিক)-এর রাজনীতি; পিতৃতন্ত্রের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। শারলট বাঞ্চ পার্সেনাল পলিটিক্স–এ বলেন, “মানুষের জীবনে এমন কোনো পরিসর নেই যা রাজনৈতিক নয়, এমন কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নেই যা ব্যক্তিগত নয়। পুরোনো প্রাচীরগুলো ভেঙে গেছে।” নারীদের তাত্ত্বিক কার্যক্রমকে এ্যান পপ্কিন এভাবে বর্ণনা করেন,
পুরুষ শ্রেষ্ঠত্ব বলতে আমরা বুঝি প্রাতিষ্ঠানিক, সর্বব্যাপী ক্ষমতা যা পুরুষের আছে নারীর ওপর। [আমরা বুঝি] নারীর সামাজিক ক্ষমতাহীনতা হচ্ছে ব্যবস্থাজনিত কারণে [ব্যক্তিক কারণে নয়; নারীকে নারী বলেই ক্ষমতা কাঠামো থেকে বর্জন করা হয়]। [আমরা বুঝি] নারীর সমাজ–নির্দিষ্ট ভূমিকা ও বৈশিষ্ট্য যা অবমূল্যায়িত হয় ব্যবস্থাজনিত কারণে। ধীরে–ধীরে আমরা এও বুঝি যে পুরুষ শ্রেষ্ঠত্বকে আমাদের মোকাবেলা ও আক্রমণ করতে হবে একটি সর্বাঙ্গীন ব্যবস্থা হিসেবে।
নারীবাদী আন্দোলনের বিকাশ ও নারীর রাজনীতি কী সেটিকে সংজ্ঞায়িত করার এই পর্বে নারীদের তৎপরতা বিশাল ও বিস্তৃত ছিল। ক্যাম্পাস, কমিউনিটি ও কর্মপরিসরে সচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে হাজারো দল গঠিত হয়। নারী কেন্দ্র স্থাপনের দাবি ওঠে, তার জন্য লড়াই শুরু হয়। কিছু ক্ষেত্রে ক্যাম্পাস দখল করাই ছিল নারীদের জন্য কাজ করার ও পড়াশোনার আলাদা জায়গা আদায়ের একমাত্র উপায়। শিশুদের জন্য ডে–কেয়ার সেন্টার, নারীদের জন্য সেল্ফ–হেল্প ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপন করা ছিল প্রধান দাবি। এ্যাবরশনের পক্ষে ক্যামপেইন শুরু হয় যার লক্ষ্য ছিল নারী যাতে তার নিজের পুনরুৎপাদনমূলক ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। চিকিৎসা পেশা যৌনবাদী হওয়ার কারণে চিকিৎসক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে নারী দেহের নিয়ন্ত্রণ নারীর নিজের কাছে ফিরিয়ে আনার গুরুত্ব বারবারা এহ্রেনরাইক ও ডেইড্রে ইংলিশ এভাবে ব্যাখ্যা করেন:
আমাদের সংস্কৃতিতে যৌনবাদী মতাদর্শের সবচাইতে শক্তিশালী সূত্রের একটি হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞান। যৌন পরিচিতির ভিত্তিতে প্রভেদ করা হয় শিক্ষা, চাকুরি ও পাবলিক পরিসরে। অন্তিম অর্থে এটি নির্ভর করে নারীদের পুরুষ থেকে ভিন্ন করে তোলার উপর: শারীরিক ভিন্নতার উপর। চূড়ান্ত অর্থে, পুরুষ উৎকৃষ্টতার সব তত্ত্ব নির্ভর করে জৈবিকতার উপর।
নারীর প্র্যাক্টিস এবং পুঁজির বিরুদ্ধে “বৃহত্তর” সংগ্রামে যৌনবাদকে বৈধ ইস্যু হিসেবে বোঝার জন্য তাত্ত্বিক ভিত্তির প্রয়োজন পড়ে, নারীরা এক্ষেত্রেও সাংঘাতিকভাবে কাজ করেন। নারীদের তাত্ত্বিক কাজকে এই প্রশ্নগুলোর সাহায্যে সংজ্ঞায়িত করা হয়:- নারীর নির্দিষ্ট নিপীড়নকে কীভাবে বুঝলে নিউ লেফ্ট পুরুষের মার্ক্সবাদী পদাবলির [Marxist terminology] সংকীর্ণ বোঝাপড়ার মুখোমুখি হওয়া যাবে যেহেতু তারা শুধু শ্রম ও অর্থনৈতিক সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেন; কীভাবে নতুন তত্ত্ব তৈরি করা যাবে যা সমকালীন বিশ্লেষণ ও আগামী দিনের কল্পদৃশ্যে পুনরুৎপাদন, পরিবার ও যৌনতাকে তত্ত্বের কেন্দ্রে গুরুত্বসহকারে স্থাপন করতে পারবে?
এখন আসি এই বইয়ের প্রসঙ্গে, উইমেন এন্ড রেভোলিউশান। মার্ক্সবাদ ও নারীবাদের অসুখী বিয়ের আলোচনা। এই বইতে শুরুর দিকের সেই তাত্ত্বিক প্রশ্নগুলোকে বর্ণনা ও সম্প্রসারিত করা হয়েছে। তার কারণ নারীবাদী তত্ত্ব বিকশিত হয় প্রধানত তিনটি ধারায়: (১) র্যাডিকাল (২) সমাজতান্ত্রিক (৩) মার্ক্সবাদী নারীবাদ। প্রতিটি ধারায় বিবিধতা ছিল, উপধারা ছিল। লেসবিয়ানবাদ উৎসারিত হয় র্যাডিকাল নারীবাদী বিশ্লেষণের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে, র্যাডিকাল নারীবাদী প্র্যাক্টিস থেকেই লেসবিয়ান ধারার নারীবাদ আলাদা ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এ্যানারকিজম প্রক্রিয়া ও কাঠামো, উভয়কেই প্রভাবান্বিত করে। বর্ণবাদ যদিও নারীবাদী আলাপ–আলোচনার অংশ ছিল কিন্তু নারীবাদী তত্ত্ব ও প্র্যাক্টিস কখনোই বর্ণবাদ (এবং শ্রেণীবাদ)-কে স্বার্থকভাবে তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি। এর ফলে কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদীরা শ্বেতাঙ্গ নারীবাদী আন্দোলন— তত্ত্ব ও প্র্যাক্টিসের— কড়া সমালোচনা করেন। শেষমেষ তারা নারীবাদী তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বর্ণবাদ ও যৌনবাদকে একত্রিত করে বিশ্লেষণ করার গুরুত্বের ওপর জোরারোপ করে নিজেদের পজিশন আলাদাভাবে ব্যক্ত করেন।
এই তিন ধারার নারীবাদী তত্ত্বায়নের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে কখনো–কখনো টানাপোড়েন ছিল, ক্ষেত্রবিশেষে তারা বিরুদ্ধভাবাপন্নও ছিল। বাদবাকি সময় তারা একে অপরকে প্রভাবান্বিত করে, চিন্তার রসদ যোগায়। পরস্পরের ভিতরে মিলও ছিল। মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের প্রভাব প্রতিটি ধারায় সুস্পষ্ট ছিল। পুনরুৎপাদন ও যৌনতার ভিত্তিতে শ্রমবিভাজন, এ বিষয়ে আগ্রহ ও মনোযোগ প্রতিটি ধারার ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। তা সত্ত্বেও অনেকাংশেই মনে হয়েছে ধারাগুলোর মধ্যে তত্ত্ব ও কৌশল নিয়ে যে বিরোধ তা অতিক্রম হওয়ার মতো নয়।
র্যাডিকাল নারীবাদীদের চিন্তামতে, পিতৃতান্ত্রিক যৌনভিত্তিক নিপীড়ন–ই [patriarchal sex oppression প্রধান। তাদের দৃষ্টিতে যৌনতার ভিত্তিতে শ্রমবিভাজন শ্রেণীগত ও বর্ণভিত্তিক নিপীড়নের জন্ম দেয়। আর এই কারণে, কৌশলগতভাবে যৌনভিত্তিক নিপীড়নের অবসান ঘটালে অপরাপর নিপীড়নের অবসান ঘটবে। তারা মনে করেন, নারীরাই হচ্ছে প্রধান বিপ্লবী দল; অনেকের কাছে তার অর্থ হচ্ছে পুরুষ নিপীড়কদের থেকে আলাদাভাবে সংগঠিত হয়ে লড়াই করা।
মার্ক্সবাদী নারীবাদীরা বিশ্বাস করেন যে পুঁজির বিরুদ্ধে সংগ্রামে নারীর গুরুত্ব “শ্রমিক” হিসেবে, “নারী” হিসেবে নয়। পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রে (গৃহী শ্রম/domestic labour) মার্ক্সবাদী নারীবাদীরা নারীর ভূমিকাকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করেন যাতে মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণে নারী গুরুত্বলাভ করে, যাতে তার মাধ্যমে মার্ক্সবাদী বর্গের [categories] সম্প্রসারণ ঘটে। কৌশলের দিক থেকে মার্ক্সবাদী নারীবাদীরা মিশ্র সংগঠনে কাজ করতে থাকেন, অনেকে আবার অন্য নারীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র ইস্যুর লড়াইয়েও যোগ দেন।
সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা র্যাডিকাল নারীবাদীদের সঙ্গে এ বিষয়ে একমত যে পিতৃতন্ত্র নামে নিপীড়নের একটি ব্যবস্থা বিদ্যমান; মার্ক্সবাদী নারীবাদীদের সঙ্গে তারা এ বিষয়ে একমত যে শ্রেণীভিত্তিক নিপীড়ন সব শ্রমিকদের অবস্থা নির্ধারণ করে। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা তাদের সমাজ–বিশ্লেষণে এ দুটো পন্থাকে একীভূত করার চেষ্টা করেন। আর কৌশলের দিক থেকে অধিকাংশ সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা পুরুষ–প্রধান নিউ লেফ্ট এবং স্বতন্ত্র নারী সংগঠনে কাজ করতে থাকেন।
নারীবাদী তর্ক–বিতর্কের অবয়বকে নির্ধারণ করে এই তিনটি প্রধান ধারা। র্যাডিকাল ও সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীদের ব্যাপারে মার্ক্সবাদী নারীবাদীদের সমালোচনা হচ্ছে তারা যথেষ্ট বস্তুবাদী নন, আর এ কারণে শ্রেণী নিপীড়ন ও নারীবাদী আন্দোলনের শ্রেণী চরিত্রের ব্যাপারে তারা অবহিত নন। অন্যদিকে মার্ক্সবাদী ও সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীদের নিয়ে র্যাডিকাল নারীবাদীদের সমালোচনা হচ্ছে, তারা মানুষের চৈতন্য–গঠনে পিতৃতন্ত্রের গুরুত্বকে উপেক্ষা করেন, যৌনবাদী আচরণ বজায় রাখার মানসিক চাহিদাকে অবজ্ঞা করেন। অপরদিকে, সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা মার্ক্সবাদী ও র্যাডিকাল নারীবাদীদের এই বলে সমালোচনা করেন যে, প্রথম ঘরানা প্রয়োজনাতিরিক্ত অর্থনীতিবাদী [economistic], দ্বিতীয় ঘরানা খুব–বেশি সাব্জেক্টিভ (ব্যাক্তি–বিষয়ী) আর সে কারণে, অনৈতিহাসিক। কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদীরা তিনটি ঘরানাকেই বর্ণবাদী বলে সমালোচনা করেন, তারা এমন তত্ত্ব প্রস্তাব করেন যা নারীবাদী বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত করবে নরবর্ণের [race] প্রসঙ্গকে । র্যাডিকাল, সমাজতান্ত্রিক ও মার্ক্সবাদী নারীবাদ— তিনটি ঘরানায় লেসবিয়ান নারীবাদীরা ছিলেন, তারা স্ব–স্ব ঘরানায় কনশাসনেস–রেইজিং–এর মাধ্যমে বিষমকামীতাকে [heterosexuality] একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বোঝা ও বিশ্লেষণ করার গুরুত্বের ওপর জোর দেন; অবার একইসঙ্গে সামগ্রিকভাবে নারীবাদী বিশ্লেষণ ও কৌশলের অংশ হিসেবে লেসবিয়ানবাদের গুরুত্বের ওপর জোরারোপ করেন।
অধ্যয়ন, পড়াশোনা, আলাপচারিতা, মিছিল–সমাবেশ এবং সংগঠিত হওয়ার মাধ্যমে নিজেদের সংস্কৃতি ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন নারীরা, এর সাহায্যে নারীবাদী তত্ত্বের আলোচনার অবয়ব তাদের কাছে আরো স্পষ্ট হয়। কোন্ কোন্ প্রশ্নের তাত্ত্বিক উত্তর খুঁজতে হবে তা ধীরে–ধীরে আরও স্পষ্ট হয়: নারীরাই কি আসল বিপ্লবী শ্রেণী যাদের মুক্তি আর–সকল নিপীড়নের অবসান ঘটাবে? মার্ক্সবাদী ও নারীবাদী বিশ্লেষণ কি একইসঙ্গে করা যায়, এমনভাবে যাতে দুটোর গুরুত্বই সমান ওজনের হয়? নারী নিপীড়ন বোঝার জন্য অর্থনেতিক বর্গ–ই কি পর্যাপ্ত না–কি সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া এমনই মজ্জাগত যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক পালটে গেলেও যৌনবাদী ধ্যান–ধারণার নড়চড় ঘটে না? চৈতন্য গঠনে যৌন/লিঙ্গ বা জ্ঞাতিসম্পর্কের গুরুত্ব কী? প্রায়–পুরো ইতিহাস জুড়ে নারীরা কেনই বা প্রায়–একই ভূমিকা পালন করেছেন তা বোঝার জন্য কোন্ কোন্ বিষয় অধ্যয়ন করা উচিৎ?
রাজনৈতিক এবং কৌশলগত ভিন্নতা সত্ত্বেও নারীবাদী আন্দোলনের বিবিধ ধারা একটি মিশাল [shared] সূত্রে গাঁথা। নারী চৈতন্য গড়ে ওঠে নারীদের অংশীদারী সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে ঘিরে। আগের জমানায় যে নারীরা মিছিল–সমাবেশ করেছিলেন, লিখেছিলেন, সংগঠিত হয়েছিলেন, তাদের কাছ থেকে এই জমানার নারীবাদীরা উদ্দীপনা, চিন্তাভাবনা ও কৌশল ধার করেন। এই জমানার আন্দোলনের বিকাশের ক্ষেত্রে, নারীদের সর্বজন [common] ভাষা, অংশীদারী অতীত এবং অংশীদারী বর্তমান— সবই ছিল সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভিন্ন কাল, ভিন্ন সামাজিক ব্যবস্থার কথা, অন্য নারীদের ব্যক্তিগত জীবনের কথা পড়ে নারীরা উপলব্ধি করেন যে বর্তমানে যা ঘটছে তা আগেও ঘটেছিল, বহুবার ঘটেছিল। এলেক্সান্দ্রা কোলনতাই, রুশ কমিউনিস্ট পার্টির অগ্রণী নেতা, ১৯২৬ সালে লিখেছিলেন:
আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধেও কিছু বলতে চাই। কাজ, পার্টি এসাইনমেন্টের মধ্যেও কতরকম উত্তেজনার মুহূর্ত, এতসবের মধ্যেও যে ঘনিষ্ঠ কিছু অভিজ্ঞতা, ভালোবাসার টানাপোড়েনের সময় মেলে! দুর্ভাগ্যবশত, হ্যাঁ! দুর্ভাগ্যবশত এ কারণে বলছি যে এ ধরনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সাধারণত অনেক বেশি মনোযোগ, কষ্ট, নিরাশা জড়িয়ে থাকে, অনেক বেশি এনার্জি অর্থহীনভাবে ব্যয় হয়। কিন্তু কোনো–এক পুরুষ আমার মনের গভীর পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবে, আমাকে বুঝবে, পরিশ্রমী মানুষ হিসেবে চিনবে, এসবের কারণেই এই সিদ্ধান্ত আপনাআপনি হয়ে যায়। আর প্রতিবার এ কারণেই দ্রুত হতাশ হই কারণ বন্ধুটি আমার মধ্যে দেখে শুধু নারী সত্তা যেটিকে সে নিজ অহম [বমড়] প্রচার করার শ্রবণযন্ত্রে পরিণত করতে চায়। সুতরাং, বারে–বারে সেই অনিবার্য মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে যখন একাত্ববোধের শৃঙ্খল ঝেড়ে ফেলে, হৃদয়বেদনা সত্ত্বেও স্বতন্ত্র, অ– প্রভাবিত সত্তা নিয়ে আমি সরে দাঁড়াই। কিন্তু তখন আমি একা।
কিন্তু আমরা কোলনতাইয়ের মতো একা নই। আমাদের আন্দোলন আছে। তত্ত্ব ও প্র্যাক্টিস শুরু হয়েছে। আর–কখনোই “নারী প্রশ্ন”কে “নামহীন সমস্যা” বলে বর্ণনা করা হবে না। আমাদের নাম আছে।
(অনুবাদ শেষ)
পরের অংশে আছে এদেশের বাম নেতা মোশরেফা মিশুর সঙ্গে নারীমুক্তি ও বামদলগুলো কিভাবে পুরুষ আধিপত্যকে জারি রাখে সে প্রসঙ্গে আলাপচারিতা; ভাঁজে–ভাঁজে আছে কম্যুনিস্ট পার্টিগুলো কিভাবে ‘পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের শিকার’ সে প্রসঙ্গে নেপালের মাওবাদী কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড পার্বতীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ।
২. পুরুষের লেখা স্ক্রিপ্টে নারীমুক্তি: মোশরেফা মিশুর সঙ্গে আলাপচারিতা
[নারীমুক্তি ও শ্রেণী সংগ্রামের সম্পর্ক] খুবই ঘনিষ্ঠ। সবচাইতে আগে নিপীড়নের শিকার হয়েছে নারী। [কিন্তু] শ্রেণী শোষণ শেষ হওয়ার পর তাদের–ই মুক্তি সবচাইতে শেষে ঘটবে। আর এ কারণে শ্রেণী নিপীড়ন জারি আছে কি–না তা পরীক্ষা করার পথ হচ্ছে নারী নিপীড়ন টিকে আছে কি–না তা পরখ করে দেখা।২৬
– কমরেড পার্বতী, সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য ও নেপালের মাওবাদী কম্যুনিস্ট দলের নারী বিভাগের প্রধান
কম্যুনিস্ট পুরুষদের বোঝা উচিৎ যে বিপ্লব ও বিপ্লবের অর্জনগুলোকে তখনই টিকিয়ে রাখা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব যখন বিপ্লবে আরো এবং আরো নারী যোগ দেবে।২৭
– কমরেড পার্বতী
“নারী নেতৃত্ব গড়ে তোলার প্রচেষ্টার দিকে যদি তুমি তাকাও, নারী ও পুরুষের মধ্যে যাতে সমতা গড়ে ওঠে, তাহলে তুমি দেখবে যে পার্টি নেতৃত্বের দৃষ্টিতে এটা হচ্ছে সময়ের অপচয়। তাঁরা মনে করেন যে নারীর কন্ট্রিবিউশান পুরুষের তুলনায় কম। আমি জানি না তাঁরা কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান। আর আমদেরকে দেখা হয়, আমরা ২–১ জন যারা নেতৃত্বের উঁচুতে পৌঁছেছি, আমাদরকে মনে করা হয় এক্সেপশনাল। কখনো–কখনো আমাদের প্রসংশা করা হয়, আবার অনেক সময়ই আমরা হয়ে উঠি নিন্দার পাত্র।”
কথা হচ্ছিল মোশরেফা মিশুর সঙ্গে, মিশু গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ইউনিটি ফোরামের সভাপতি, বিপ্লবী ঐক্য ফ্রন্টের আহ্বায়ক। প্রায় পঁচিশ বছর ধরে ওঁকে চিনি, খুব বেশি দেখা হয় না কিন্তু হলেই আমরা পরস্পরকে জাপটে ধরে অনর্গল কথা বলতে থাকি। দুনিয়া–জাহানের জিনিস নিয়ে আমাদের কথা হয়— গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি, কত নির্মমভাবে তাঁরা শোষণের শিকার, মিশুর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, ওঁর ব্যক্তিগত সংগ্রাম, সরকারের হয়রানি, ওঁর বিরুদ্ধে প্রায় ৪০ খানেক মামলা— আরো কতকিছু। মিশু সবসময়ই আমার কাজের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন, আমি কী লিখছি, কী পড়ছি, সবসময় আমাকে বলেন আমাদের একত্রে বসে চিন্তাভাবনা শেয়ার করা উচিৎ।
“বাম দলগুলোতে তুমি অনেক নারীকেই পাবে যাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজকর্ম করছেন, যাঁরা জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত পার্টিকে উৎসর্গ করেছেন, কিন্তু তাঁরা এখনও সেন্ট্রাল কমিটির সদস্যও হতে পারেননি। কেন সিপিবিকে দেখো না, হেনা দাস সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য হলেন ৮০ বছর বয়সে। বা কৃষ্ণা দি’কেই দেখো না, এই ক’দিন আগে উনি সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য হলেন, তাঁর বয়স ৬০–এর বেশি। পুরুষরা? ওহ, তাঁরা তো আরো অনেক অল্প বয়সে, হয়তো আমারই বয়সে— আমার বয়স এখন ৪৫— বা আরো অল্প, ধরো তিরিশ পেরিয়ে চল্লিশে পা দেবার আগেই…।” আচ্ছা, নারীরা কী এ নিয়ে প্রশ্ন করেন? “কিছুটা, কখনো–সখনো,” মিশু বলেন। “কয়েক মাস আগে, আমার মনে পড়ে শিরিন আপা [শিরিন আক্তার, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সহ–সাধারণ সম্পাদক] জামান ভাইকে [বাসদের কমরেড খালেকুজ্জামান] এ নিয়ে অনেক কিছু বলেছিলেন। কারণ রুশো আপা, জলি আপা, তাঁরা এখনও পর্যন্ত সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য হননি। যদিও তাঁরা সাংঘাতিক নিষ্ঠাবান, যদিও নেতা হিসেবে তাঁদের দুর্দান্ত সামর্থ্য, যদিও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বিস্তর অভিজ্ঞতা আছে। এমনকি তাঁরা তো সেন্ট্রাল কমিটির বিকল্প সদস্য পর্যন্ত হতে পারেননি। এখনও পর্যন্ত কোনো নারী বাসদের সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য হতে পারেনি— ভাবো অবস্থা!”২৮
“আমি কিসের জোরে কথা বলি? আমি যেহেতু গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ইউনিটি ফোরামের সভাপতি, আমি যেহেতু মাঠ পর্যায়ে কাজ করি— এ কারণে তাঁরা আমাকে গ্রহণ করেন [করতে বাধ্য?]। আমার মনে হয় তুমি যদি অন্য বাম দলের নারী কমরেডদের জিজ্ঞেস করো ওরা তোমাকে ২–৪টা কথা নিশ্চয়ই বলবেন কিন্তু তা হবে আড়ালে। তুমি তাদের উদ্ধৃত করতে পারবে না।” আচ্ছা, এটা কী পার্টির প্রতি আনুগত্যের কারণে?— মিশুর কথার মধ্যে আমি ঢুকে পড়ি। “না, তা হবে কেন? আমিও তো পার্টির প্রতি অনুগত। আমি কথা বলি কারণ আমার মনে হয় এ নিয়ে কথা বলা জরুরি। আর তাঁরা বলেন না, কারণ তাহলে তাঁদেরকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হবে। হাজার হোক, কার ঘাঁড়ে কটাই বা মাথা আছে?”
মিশুর সাক্ষাৎকার লিপিবদ্ধ করার এক ফাঁকে ব্রেক নেই, টেবিলে রাখা কমরেড পার্বতীর এই কথাগুলো চোখে পড়ে:- “দেখা গেছে যে বিপ্লবী কম্যুনিস্ট আন্দোলন সবসময়ই নারী দ্রোহের লাগামকে মুক্ত করতে পেরেছে, কিন্তু কখনোই এই শক্তিকে নারী কম্যুনিস্ট নেতা তৈরির কাজে লাগাতে পারেনি। কম্যুনিস্ট পার্টিতে নারী নেতার সংখ্যা এত অল্প কেন এ নিয়ে বারে–বারে প্রশ্ন তোলা হয়েছে কারণ মার্ক্সবাদ নারী নিপীড়নের সাংঘাতিক গভীর বিশ্লেষণ উপস্থিত করতে সক্ষম। আর তার সমাধানও।”২৯
মিশুরও বলতে গেলে একই প্রশ্ন:- বাংলাদেশের বাম আন্দোলনে নারী নেতার সংখ্যা এত কম কেন? কম্যুনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক দলগুলো নারী নেতা তৈরি করার ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রেখেছে?
এর উত্তর কোথায়–ই বা খুঁজব, আমি ভাবি।
মিশুর কথা শুনতে শুনতে মনে হয় তার মানে কি বাম আন্দোলন ধরে নেয় যে সামাজিক–অর্থে পুরুষদের কোনো লৈঙ্গিক পরিচয় নেই? যে, যেহেতু তারা পুরুষ, তারা লৈঙ্গিক পরিচয় (gender identity)-এর উর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন? নারীদের বিপরীতে, যারা কিনা পদে–পদে তাদের লৈঙ্গিক পরিচয় দ্বারা বিপর্যস্ত? হতে না চাইলেও, তার উর্ধ্বে উঠতে চাইলেও, অন্তিম বিশ্লেষণে তারা এই পরিচয় দ্বারাই বিপর্যস্ত? বাম আন্দোলন কি ধরে নেয় যে পুরুষরা যখন আন্দোলন–সংগ্রাম করেন তারা সকলের হয়ে করেন কিন্তু যখন নারীরা করেন তখন তারা শুধু নারীজাতির–ই প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন? উপরন্ত, এই আন্দোলন কি ধরে নেয় যে, যৌন সত্তা নারী একা–ই বহন করে? পারিবারিক সত্তার বেলায়ও তাই?
“তোমাকে আরেকটা ঘটনার কথা বলি,” বললেন মিশু। “অনেক আগের ঘটনা, তখন আমার বয়স অনেক কম। আমি তখন ছাত্র ঐক্য ফোরামের সভাপতি, প্রায় চল্লিশখানেক ছাত্র সংগঠনের মধ্যে আমি একমাত্র নারী সভাপতি। আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, আমার বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগ আনা হয়, ব্যাংক ডাকাতি চেষ্টা করার অভিযোগ। আসলে হয়েছিল কি, সর্বহারা পার্টির একটি দল গাজীপুরের একটি পেট্রোল পাম্পে ডাকাতি করার সময় ধরা পড়ে, আমি যেহেতু সর্বহারার সমালোচনা করেছিলাম তাই তারা ধরা পড়ার সময় আমার নাম ঢুকিয়ে আমাকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ওরা পুলিশকে বলে, ডাকাতিতে আমি নেতৃত্ব দিয়েছিলাম, ধরা পড়ার ঠিক আগ– মুহূর্তে অন্য গাড়িতে পালিয়ে গেছি। আমার ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা, আর আমার দুই বোন যারা তখন পার্টিতে নতুন যোগ দিয়েছে, আমার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে একটি বিবৃতি নিয়ে বিভিন্ন বাম দলের নেতাদের কাছে যায়। তাঁদের স্বাক্ষর করতে অনুরোধ জানায়। তাঁরা অস্বীকৃতি জানান। তাঁরা বলেন, বিষয়টি রাজনৈতিক নয়। পরে জেনেছি নির্মল সেন নাকি তখন ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, বাংলাদেশে আর কিছু না থাকুক অন্তত একজন নারী ডাকাত তো আছে! আমার প্রশ্ন হলো: আমাকে গ্রেপ্তার করা, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া— এগুলো কিভাবে রাজনৈতিক না হতে পারে? যারা মামলায় আমার নাম ঢুকিয়েছিল তারা তো এ কারণেই করেছিল কারণ আমি রাজনীতি করি? ধরো আমি যদি গৃহবধু হতাম তাহলে তো আর আমার নাম দিত না, তাই না? কোনো কোনো বাম নেতা নাকি এও উচ্চারণ করেছিলেন— আমি এটা নিশ্চিতভাবে জানি কারণ তাঁদেরই একজন নারী নেতা পরে আমাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন— তোমার কি সর্বহারা পার্টির কারো সঙ্গে এফেয়ার ছিল? সেই কারণেই কি প্রতিহিংসা হিসেবে তোমার নাম মামলায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল?”
মিশুর কথা শুনতে শুনতে মনে পড়ে পাহাড়ি নেতা কল্পনা চাকমার কথা। ১২ বছর আগে,৩০ কল্পনাকে তাঁর মারিষ্যার (খাগড়াছড়ি) বাসা থেকে আর্মি তুলে নিয়েছিল বলে পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ। একই কিসিমের কেচ্ছা ফেঁদেছিল তারা যারা ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন। এটা প্রেম–ঘটিত ব্যাপার, কল্পনা নাকি আর্মির লেফেটনেন্ট ফেরদৌসের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। একইধরনের ভাবনা যে বাম মহলের মধ্যেও বিরাজ করে, যাঁরা নিজেদের অপর প্রান্তের বলে দাবি করেন— এই বিষয়টা আমাকে বরাবরই হতবিহ্বল করে।
২.ক বিয়ের সম্পর্কে কমরেড
কমরেড পার্বতী বলেন, যে নারীদের বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার সামর্থ্য আছে তাঁরা নেতা হতে পারেন না বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের কারণে। নেপালের গণযুদ্ধের কারণে কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে ঠিকই কিন্তু গণযুদ্ধের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে যে নারী নেতৃত্ব গড়ে ওঠার জন্য নারীদের যেভাবে আন্দোলনে ধারাবাহিকভাবে উপস্থিত থাকা প্রয়োজন, বিয়ে ও সন্তানধারনের কারণে তাঁদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণে বিঘ্ন ঘটে। বাচ্চা নেওয়াটা একটি “একপেশে বোঝা,” প্রতিটি নতুন শিশু জন্মানোর অর্থই হচ্ছে [নারী কমরেডের] গৃহী দাসত্বের শৃঙ্খল আরো বেড়ে যাওয়া, আরো প্রকট হওয়া। কম্যুনিস্ট নারীদের অভিযোগ হচ্ছে “বাচ্চা হওয়াটা [পার্টির] শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অধীনে থাকা”র মতোই কারণ দীর্ঘ সময় ধরে পার্টির কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকতে হয় তাদের। সম্ভানাময়ী ও উচ্চাকাক্সক্ষী নারী ক্যাডাররা হারিয়ে যান, নিজেদের পছন্দের কমরেডদের বিয়ে করা সত্ত্বেও। নারীর পুনরুৎপাদকালীন ও সন্তান লালনপালনের বছরগুলোতে সে বাস্তবিক–অর্থে খুব কমই সাহায্য পায়। নারী ক্যাডারদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিয়ে করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। যার এখনো বিয়ে হয় নাই, তাকে— কি পুরুষ কি নারী কমরেড, উভয়কেই “সন্দেহের চোখে” দেখা হয়। যৌন নিয়মের লঙ্ঘনকে রাজনৈতিক নিয়মের লঙ্ঘনের চাইতে আরো বেশি বড় অপরাধ মনে করা হয়।৩১
আমি মিশুকে জিজ্ঞেস করি, এদেশে প্রচলিত বিয়ে ও যৌনতার সামাজিক সম্পর্ক এখানকার বাম ধারার নারীদের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে? আর তুমি, তুমি তো সিঙ্গেল। আচ্ছা, বলো তো, বাম ধারার নারীরা বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তন আনার জন্য নারীমুক্তির আকাক্সক্ষাকে কর্মসূচীর মধ্যে কীভাবে আকার–আকৃতি দিয়েছে?
“বাম ছাত্র সংগঠন করার সময় থেকে এ পর্যন্ত আমি যা দেখেছি— বাম দলগুলোর কথা বলছি— যেই নারী বুদ্ধিমান আর দেখতে ভালো— বাম পুরুষদের ভাষায়, “সুন্দরী এ্যান্ড শার্প”— তাকে বিয়ের জন্য বাছাই করা হয়। বলা হয়ে থাকে বিয়ে করলে এই নারী কমরেড নিশ্চিতভাবে বাম রাজনীতিতে থাকবে। কিন্তু তা যে অনিবার্যভাবে ঘটে তা–না। অনেকেই গৃহের অন্তরালে হারিয়ে যান। বুদ্ধিমান বাম পুরুষদেরও আমি বলতে শুনেছি— যেসব ক্ষেত্রে দুজন কমরেড–ই সমানভাবে যোগ্য, দুজনা একইভাবে সম্ভাবনাময়ী— যেহেতু দুজনকে একইসঙ্গে গড়ে তোলা যাবে না, একজনের স্যাক্রিফাইস করতে হবে। একজনকে ক্রুশে চড়তে হবে। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে পুরুষদের কখনোই ক্রুশে চড়তে দেখি নাই! বাম মহলে সবসময় জেনি মার্ক্সের৩২ অবদানের কথা, ক্রুপস্কায়ার৩৩ কথা স্মরণ করা হয়। লিও জোগিশের৩৪ কথাও বলা হয়। আমি নিজে আমার পুরুষ কমরেডদের গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি, তাঁরা কোনো অংশে কম স্যাক্রিফাইস করেননি, তাঁরা বহু বাধাবিপত্তি পার করেছেন, তাঁদের মধ্যে কোনো ঘাটতির কথা বলছি না। আমি শুধু বলছি তাঁদের আউটলুকের কথা। তাঁরা ভয়াবহ রকমের chauvinistic (উগ্র পুরুষবাদী)। আর নরবর্ণবাদীও (racist)। তুমি ভাবতে পারবে না “ফর্সা” বউ আর “কালো” বউ নিয়ে কত ধরনের কত কথা যে আমার কানে আসে।
“এখানকার প্রগতিশীল পুরুষ, কম্যুনিস্ট পুরুষ— আর কথাগুলো আমি একদম সিরিয়াসলি বলছি রেহনুমা, confidently বলছি— তাঁরা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে সমতা চর্চা করেন না। নিজের স্ত্রীর প্রতি না, কন্যাদের প্রতি না, বোনদের প্রতিও না। তাঁরা হচ্ছেন কর্তা। আমি নামধাম উল্লেখ করতে চাই না কিন্তু এমন বাম নেতাদের আমি চিনি যাঁদের মেয়েদের “ভালো” পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়েছে। আর “ভালো” পাত্রের মানে হচ্ছে যার বিদেশী ডিগ্রি আছে। এ নিয়ে আমি অন্য নারী কমরেডদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁরাও একই কথা বলেছেন।” আর পার্টির যেই নারীরা পুরুষ কমরেডদের বিয়ে করেন, পার্টি নেতাদের বিয়ে করেন, তাঁদের অবস্থা কেমন?— আমি জিজ্ঞেস করি। “অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় যে তাঁরা পার্টিতে নতুন। মার্ক্সবাদী দর্শনে নতুন। এমন পরিস্থিতিতে, অমূকের কাছ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাওয়াটা বড় ব্যাপার, যেহেতু তার স্ট্যাটাস আরো বেশি, তার প্রেস্টিজ আরো বেশি। তাঁরা নিজেরা একটি এলিট শ্রেণীর মতো।”
আচ্ছা, আর যৌনতার প্রসঙ্গে আলাপ করতে চাচ্ছি। তুমি তো সিঙ্গেল, বরাবর অবিবাহিতই থেকেছ— এই বলে আগের কথাসূত্রে ফিরে যাই। মিশু বলেন, “এই শব্দটি কখনো উচ্চারণ করা হয় না। এটা ট্যাবু। আমি পুরুষ কমরেডদের বসে আড্ডা দিতে দেখেছি, তাঁরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করেন, দেখেই বোঝা যায় তাঁরা এসব বিষয়ে কথা বলছেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে আমার যদি ২–৪টা পুরুষ বন্ধু থাকত, রাজনীতিতে আমি ঠাঁই পেতাম না। কোনো জায়গাই থাকত না। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আশেপাশে ২–৪ জনকে ‘স্যাক্রিফাইস’ শব্দটা উচ্চারণ করতে শুনেছিলাম। আমি জানি, আমি যদি ভিন্নধরনের জীবন যাপন করতাম তাহলে আমার জন্য বাম রাজনীতিতে কোনো জায়গাই থাকত না। কিন্তু আমার যদি পুরুষ বন্ধু থাকত তাহলে আমার তো ভালোই লাগত।” পুরুষ কমরেডদের কী অবস্থা?— আমি জিজ্ঞেস করি। তাঁদেরও কি একই অবস্থা, নাকি ভিন্ন? “তাতো অবশ্যই। বহু সিঙ্গেল পুরুষ কমরেড ছিলেন কিন্তু মনে হয় তাঁদের নারী বন্ধু ছিল। কিন্তু এ নিয়ে কেউ খোশগল্প করে না।” তার মানে এর কারণে তাঁদের রাজনৈতিক ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না? তাই কি?— আমি জানতে চাই। “ঠিক তাই,” মিশুর উত্তর। তার মানে তোমার বেলায় যদি এটা ঘটত তাহলে তোমাকে “চরিত্রহীন” বলা হতো? “তাতো বটোই। আমাকে ‘প্রস্টিটিউট’ ডাকলেও আশ্চর্য হবার কিছু ছিল না।” মিশুর কথা শুনে আমিও আশ্চর্য হইনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে, জাহাঙ্গীরনগরের ১৯৯৮ সালের ধর্ষণ–বিরোধী আন্দোলনের সময়, একজন প্রভাবশালী শিক্ষক যিনি আন্দোলনে আমার ভূমিকায় ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলেন আরেকজন শিক্ষককে বলেছিলেন আমি একজন “বেশ্যা”। যাঁকে তিনি এ কথা বলেছিলেন তিনি শব্দটি উচ্চারণ করতে দ্বিধা বোধ করছিলেন দেখে আমি–ই মুখ ফুটে শব্দটি উচ্চারণ করেছিলাম। নারীদের নির্ঘাৎ একটি “বউ–বেশ্যা” বৈপরীত্যে আটকে ফেলা হয়। পিতৃতন্ত্রের বিরোধিতা করলে এই চাবুক দিয়েই তাদের বেত্রাঘাত করা হয়। প্রগতিশীল পুরুষরা এই শব্দকে উড়িয়ে দেন, তাঁদের মতে এটি “রুচির অভাব”কে প্রতিনিধিত্ব করে, এটি “নিম্ন শ্রেণী”র ভাষা। কিন্তু যাঁরা বাম মহলের, তাঁরাও যদি একইধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তাহলে কী বাম আন্দোলনের পোষায়?— আমি ভাবি। এই ডাইকোটোমি শ্রেণীগত ও লৈঙ্গিক, উভয়ই। এটি, এবং মধ্যবিত্তের প্রতিক্রিয়া— দুটোই, বুদ্ধিবৃত্তিক–অর্থে, অ–নিরিক্ষীত থেকে গেছে।
মিশু বলতে থাকেন, “এদেশের বাম রাজনৈতিক ধারা খুবই পুরুষালি। বাম ঐতিহ্যে নারীরা যে তাত্ত্বিক ও নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে অবদান রাখতে পারে, তা কিন্তু সিরিয়াসলি মনে করা হয় না। সাদামাটাভাবে ধরে নেয়া হয় যে নারীরা পুরুষ বিপ্লবীদের “অনুপ্রাণিত” করতে পারবে। কিন্তু বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে পারবে না। নারী নেতৃত্ব যে বিরাজমান ক্ষমতাসম্পর্কের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধন করতে পারে— এ বিষয়টাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয় না। ধরে নেয়া হয় যে পুরুষরা তাত্ত্বিকভাবে উৎকৃষ্ট। নারী তার সহযোগী’মাত্র। নারীর অংশগ্রহণ ও নারী নেতৃত্ব পুরুষালি ক্ষমতা কাঠামোতে পরিবর্তন সাধন করতে পারে, এ বিষয়ে বাম পুরুষদের কোনো সিরিয়াস চিন্তাভাবনা নাই।
“আমরা যদি কমরেড হিসেবে একত্রে কাজ করার পরিসর তৈরি করতে না পারি, নারীর জন্য সমাজতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা যদি ‘ও হ্যাঁ, নারীদের জন্যও আমাদের কিছু করতে হবে’ এতে সীমাবদ্ধ থাকে, যদি সমাজতান্ত্রিক আদর্শ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে চর্চিত না হয়, পরিবারে, ব্যক্তি জীবনে, বিয়েতে— তাহলে তো সমতা আপনাআপনি ঘটবে না। আমি যদি এই প্রসঙ্গগুলো তুলি তাহলে আমাকে নব্য–মার্ক্সবাদী ডাকা হয়, নারীবাদী ডাকা হয় কিন্তু আমার মার্ক্সবাদী কমরেডরা বুঝতে ব্যর্থ হন যে মার্ক্সবাদের সৃষ্টিশীল বিকাশের জন্য এসব বিষয়ে আলাপ–আলোচনা গড়ে তোলা, আত্মসমালোচনার প্র্যাক্টিস গড়ে তোলা একান্তভাবে জরুরি।” মিশু হঠাৎ হেসে উঠে আর বলে, “আমাকে অন্তত এখন আর শুনতে হয় না, সাধারণ মানুষ আপনাকে গ্রহণ করবে না। আমি মাঠ পর্যায়ে কাজ করি, অনেকেই তা করে না। আমাকে গ্রহণ করতে ম্যাস পিপেলের কোনো সমস্যা হয় না। ও হ্যাঁ, তোমাকে কি বলেছি যে নারী সদস্যদের সাধারণত সাদা শাড়ি পরার কথা…।” মানে…? বিধবাদের সাজ? কি কাণ্ড! কেন? দুজনেই হো হো করে হেসে উঠি।
মনে পড়ে, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনালের এ্যানারকিস্ট এমা গোল্ডমেন বলেছিলেন, আমি যদি নাচতেই না পারি তাহলে তোমার বিপ্লবে থাকতে চাই না।
২.খ নারীমুক্তি: পুরুষের স্ক্রিপ্ট
“বাম পুরুষরা একটি পরিকাঠামো তৈরি করেছে। সেই ফ্রেমওয়ার্কের ভিতর থেকে নারী মুক্তিকে ভাবতে হবে। সেই ফ্রেমওয়ার্ক অনুসারে জীবন যাপন করতে হবে। যদি সেটা করো তাহলে তুমি আগামী সভায় সভাপতিত্ব করতে পারবে। আর যদি তা না করো, তোমার যতই নেতৃত্বের গুণাবলী থাকুক না কেন, পারবা না। আমি আবারও বলছি, আমি আমার পুরুষ কমরেডদের খুব শ্রদ্ধা করি, তাঁদের সম্বন্ধে আমার অনেক উঁচু ধারণা, তাঁরা কিন্তু oppressive নন। আমার সমস্যা তাঁদের চিন্তা–কাঠামো নিয়ে। অন্য দলের নেতারা আমার কাজের প্রশংসা করেন, কিন্তু তাঁরা এটাও আশা করেন যে আমি তাঁদের কাছে পরামর্শ চাইব। যদিও এটা পার্টি ডিসিপ্লিনের পরিপন্থী। কিন্তু আমি যদি তাঁদের কাছ থেকে পরামর্শ চাই তাহলে আমি একজন ভালো মেয়ে, তার মানে আমি আদর্শ নারী নেতা। একজন আদর্শ নারী নেতা তিনি–ই যিনি অধিপতি সামাজিক মূল্যবোধ, নিয়ম–নীতি মেনে চলেন। আমাদের এখনো বিশ্বাস করার কথা যে একবার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে নারী মুক্তি ঘটবে। আপনা–আপনিই নারী মুক্তি ঘটে যাবে। এটা অতি সরলীকরণ। এ অবস্থায় বিপ্লব ঘটলে আমরা নারীরা শুধু এক ধাপ এগিয়ে যাব। কিছু অধিকার অর্জন করব। কিন্তু যেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে সেটা পুরুষালি সমাজতন্ত্র ছাড়া আর কিছু–ই হবে না।”
আর নারী পার্টি সদস্যদের অবস্থা কী? “আমার মনে হয় না খুব–বেশি ভিন্ন। যাঁরা নতুন সদস্য তাঁদের মধ্যে কেউ–কেউ বিয়ের প্রস্তাব পান। এ ধরনের পরিস্থিতি খুব অস্বস্তি তৈরি করতে পারে। তাঁর পছন্দ নাও হতে পারে। তিনি পার্টি ছেড়ে চলে যেতে পারেন। পার্টির তরফ থেকে বলা হতে পারে, এরকম পরিস্থিতি সামাল দিতে পারার কথা, দিতে শিখতে হবে কিন্তু এ ধরনের কথা তো পার্টির দায়িত্বকে এড়িয়ে যায়। পার্টির দায়িত্ব হচ্ছে নারী সদস্যদের জন্য একটি সৃষ্টিশীল কর্মপরিসর তৈরি করা। যারা [পুরুষালি] পার্টির ‘অপর’, তাদেরকে বাস্তবিক–অর্থে অন্তর্ভুক্ত করা। পার্টি ও ‘অপর’র বিভাজনকে ভেঙে ফেলা।”
আমাদের দীর্ঘ আলাপ শেষ হয়। রুশ বিপ্লবী এলেক্সান্ড্রা কোলোন্তাইয়ের কথা মনে পড়ে । নারী মুক্তির জন্য শুধু পুঁজিবাদের অবসান নয়, মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের বদল ঘটানো জরুরি।৩৫
যৌনতা, ভালবাসা ও কমরেডশিপের সম্পর্কের বদল ঘটানো জরুরি।
পরের অংশে প্রথমত আমি প্রস্তাব করছি যে এদেশের বাম/প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের ডিসকোর্স হচ্ছে পুরুষদের ডিসকোর্স; এই ডিসকোর্সে পুরুষ হচ্ছে মানদণ্ড, যার কারণে পুরুষের লৈঙ্গিক সত্তা— নারীর সঙ্গে লৈঙ্গিক ভিন্নতা–অর্থে বা পুরুষ হিসেবে পিতৃতন্ত্রের ধারক–বাহক অর্থে, অন্য কথায়, ক্রিটিকাল–অর্থে— বুদ্ধিবৃত্তিক বিচার–বিবেচনা বা নিরীক্ষণের বস্তু অর্থে, অনুপস্থিত। বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্ত আলোচনা–শেষে আমি এদেশের একজন প্রথিতযশা মার্ক্সবাদী বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহারের একটি সাক্ষাৎকারের একাংশ বিশ্লেষণ করে পুরুষালি ডিসকোর্স প্রসঙ্গে আমার এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা তুলে ধরছি।
৩. বাম/প্রগতিশীল ডিসকোর্সে লিঙ্গীয় ভিন্নতা’র প্রসঙ্গ
বাম/প্রগতিশীল ডিসকোর্স বলতে আমি পুরুষ বুদ্ধিজীবীদের ডিসকোর্স বোঝাচ্ছি। এদেশের নারী বুদ্ধিজীবীদের স্বতন্ত্র কোনো ডিসকোর্স আছে কি–না, সে প্রসঙ্গে আপাতত ঢুকছি না। ডিসকার্সিভ–অর্থে, এদেশের অন্যান্য জাতিসত্তার বুদ্ধিজীবীদের তুলনায় বাঙালি পুরুষ বুদ্ধিজীবীর ভূমিকাই প্রধান।
বাঙালি পুরুষ বুদ্ধিজীবীদের ডিসকোর্সে লিঙ্গীয় ভিন্নতা কোনো প্রসঙ্গ নয়। প্রসঙ্গ হচ্ছে নারী। ‘পুরুষ’ সত্তাকে প্রসঙ্গ হিসেবে দেখা হয় না। সম্ভবত এ কারণে যে এটি–ই মানদণ্ড (norm)। অর্থাৎ, ধরে নেওয়া হয় যে লিঙ্গীয় পরিচিতি নারী একা–ই বহন করে। পুরুষের লিঙ্গীয় পরিচিতি কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। সামাজিক ক্রিটিক অর্থে নয়। আত্ম–ক্রিটিক অর্থে– ও নয়। এটি হচ্ছে এদেশের পুরুষ বুদ্ধিজীবী ডিসকোর্সের৩৬ কেন্দ্রীয় পূর্বানুমান। এই পূর্বানুমান— পুরুষ সত্তা বুদ্ধিজীবীতার মানদণ্ড— প্রশ্নাতীত। অন্তত আমার তাই মনে হয়।
এ অঞ্চলের বাম/প্রগতিশীল ডিসকোর্স সুবিস্তৃত। সময় ও কাল, উভয় অর্থেই। এর ভিত্তিভূমি ও সীমানা অনেকটা তরল। অনেকটা প্রবাহমান। কোনো কোনো বিষেশ মুহূর্তে ‘বাম’ বা ‘প্রগতিশীল’— হয়ত এই নামপঞ্জি বদলে যায়। হয়ত সংজ্ঞা পালটানো হয়। বদল সত্ত্বেও, তরলতা সত্ত্বেও, কিছু ডিসকুন্টনুইটি সত্ত্বেও বাম/প্রগতিশীল ডিসকোর্স বলে কিছু–একটা চিহ্নিত করা যায়। এমন কিছু আছে বলে আমরা ধারণা। তবে এ নিয়ে খুব একটা গবেষণা হয়নি। হাল–আমলের নারীবাদী প্রত্যয়গত যন্ত্রপাতির (conceptual tools) সাহায্যে একদম হয়নি বললেই চলে। পুরুষ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বাম/প্রগতিশীল বাদে আরো ধারা রয়েছে। যেমন, উদারনৈতিক/প্রগতিশীল (লিবারেল) ধারা। ইস্যুর ক্ষেত্রে, বা বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে, ধারার মধ্যকার ভিন্নতা ধরা পড়ে। সবসময় নয়।
বাম/প্রগতিশীল ডিসকোর্সে লিঙ্গীয় ভিন্নতা প্রসঙ্গে আলোচনা গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমি এদেশের পুরুষ বুদ্ধিজীবীদের কাজ টেক্সট হিসেবে বাছাই করেছি। এই প্রবন্ধটি ফরহাদ মজহারের একটি সাক্ষাৎকারকে ঘিরে। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে, সেই সাক্ষাৎকারে তাঁকে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল, তার উত্তরে তিনি যা বলেছিলেন, এই প্রবন্ধ সেটিকে ঘিরে। আমার বিবেচনায় ফরহাদ মজহার এদেশের, একালের একজন মহাপুরুষ। মজহার প্রায় ৪০ বছর ধরে লেখালেখি করছেন। এ যাবৎকাল পর্যন্ত তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন, সে কথা ভাবলে এ কথাটি কোনো ধরনের অত্যুক্তি বলে আমি মনে করি না। তাঁর আত্মপরিচিতি হচ্ছে তিনি মার্ক্সবাদী৩৭। তিনি বিপ্লবী। প্রশ্ন উঠতে পারে, শুধুমাত্র একটি টেক্সট বাছাই করে তার ভিত্তিতে আলোচনা দাঁড় করিয়ে আমি তাঁর চিন্তাভাবনার প্রতি— সেটির ব্যাপ্তি, গভীরতার প্রতি সুবিচার করছি কি–না। আমার মনে হয়, মজহার লেখকের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে যা বলেছিলেন (১৯৯৭), তা আলোচ্য বিষয় প্রসঙ্গে— লিঙ্গীয় ভিন্নতা— খুব ইঙ্গিতবহ।
আমার মনে হয় বাম/প্রগতিশীল ডিসকোর্সে পুরুষ বুদ্ধিজীবীদের৩৮ আলাপচারিতা, আর তার ক্রিটিক, এখান থেকেই শুরু হতে পারে।
৩.ক ফরহাদ মজহারের শ্রেণীগত বিভাজন, নর–নারীর বিভাজন
ফরহাদ মজহারের সাক্ষাৎকার প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল আজকের কাগজ–এর৩৯। মজহারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল: “লেখালিখি করতে গিয়ে তো আপনাকে কারাবাসও করতে হয়েছে৪০। সেই আলোকে একজন লেখক, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীর স্বাধীনতা সম্পর্কে আপনার অভিমত জানাবেন কি?”।৪১
উত্তরে মজহার বলেন, গরিব আনসারদের হত্যা করা হয়েছে। তিনি এর প্রতিবাদ করেছেন, তাই তাঁকে জেল খাটতে হয়েছে। আনসাররা শুধু খেয়ে–পরে বাঁচার মতো বেতন চেয়েছে, অন্য কিছু নয়। তিনি আরো বলেন, তাঁর কারাবাসকে লেখকের স্বাধীনতার সঙ্গে তুলনা করলে তাঁকে এমন কিছু লেখকরে কাতারে ফেলা হবে “যাদের কাজ হচ্ছে নোংরামি, বেলেল্লাগিরি এবং নিজেদের চরম বদমায়েশি”৪২–কে লেখকের স্বাধীনতা হিসেবে উপস্থাপন করা। তিনি বলেন, পেট এবং লিঙ্গের মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। শরীরে তাদের স্থানও ভিন্ন, “পেট ওপরে, লিঙ্গ নিচে”।৪৩ দুটোর জ্বালা একরকম নয়। সঙ্গম না করে বাঁচা যায়, যেমন করেন ব্রহ্মচারীরা, কিন্তু না খেয়ে বাঁচা সম্ভব নয়। পেটের ব্যবহার ছাড়া মানুষের চলে না। আর এ কারণে লিঙ্গ এবং পেটকে একই কাতারে ফেলা ঠিক নয়। “পেটের ক্ষুধা আর নুনু বা যোনির সুড়সুড়ানি এক জিনিস নয়”।৪৪
তিনি বলেন, পেট ও লিঙ্গের পার্থক্য করা শিখতে হবে। তার কারণ “সকল ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার এক রকম নয়, সকল অঙ্গের ভূমিকাও এক নয়”।৪৫ লেখকের ভূমিকার কথা তুললে, তাঁর দৃষ্টিতে, মূল প্রশ্ন হচ্ছে, “সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব জনগণ, শ্রমিক, মজুর, উন্মূল উদ্বাস্তু মানুষগুলোর জন্য”৪৬ লেখক লড়তে, প্রয়োজনে মরতে প্রস্তুত কি–না। সংগ্রামকে দেহের প্রতীক দিয়ে বোঝার প্রস্তাব করে তিনি প্রশ্ন করেন, “পেটের দাবি আগে, নাকি লিঙ্গের দাবি আগে?”৪৭ তিনি যোগ করেন, প্রথমটার কথা বলে দ্বিতীয়টার কথা তিনি অস্বীকার করতে চান না, যেহেতু “শ্রমিক ও কৃষকেরও যৌনজীবন আছে, নারীপুরুষের প্রেম ভালবাসা রতিমিলন আছে”।৪৮ কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, “এইসব খেটে খাওয়া মানুষ শরীর বললেই সবসময়ই পেট এবং সেবাশান্তি করা, পেটে মেহনত করার ক্ষমতা বোঝে”।৪৯ অপর পক্ষে, বুর্জোয়া শ্রেণী দেহ বলতে বোঝে নারীর শরীর উলঙ্গ করা। তাদের দৃষ্টিতে দেহ ও লিঙ্গ সমার্থক। মজহার বলেন, উভয় শ্রেণীর কাছে ঘাম দেহের প্রতীক, দুটোই দেহ থেকে নিসৃত, কিন্তু শ্রমিক, কৃষক শ্রেণীর ঘামের মানে যেখানে “মেহনতের ঘাম,”৫০ অন্য শ্রেণীর কাছে ঘাম মানে “সঙ্গমের স্বেদ”।৫১
মজহারের কথার দুটো অর্থ হতে পারে। দুটোই গোলমেলে। যদি ধরে নেই যে শ্রমিক বলতে মজহার শুধু পুরুষদেরই বোঝেন (“পেট ওপরে, লিঙ্গ৫২ নিচে”), তাহলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, কেন? কোন যুক্তিতে? শ্রমের কোন্ সংজ্ঞার ভিত্তিতে কেবল পুরুষ শ্রমিক–ই সাচ্চা শ্রমিক? তাহলে কিষাণী, খেটে–খাওয়া নারীর অবস্থান কোথায়? সাধারণ নারীর অবস্থান কোথায়? তাদের শ্রম— তা ঘরের কাজ হতে পারে, যেমন কুটা–কাটা, মশলা বাটা, রান্না, কাপড় ধোয়া, ঘর লেপা, ঝাড় দেয়া, নিড়ানির কাজ, ধান সিদ্ধ, ধান শুকানো, সন্তান লালন–পালন, বয়ষ্কদের দেখাশোনা, পরিবারের রুগ্ন সদস্যদের সেবা–যত্ন, হাঁস–মুর্গি–গরু–ছাগল পালা— কী? নারীর শ্রম শ্রম না কারণ তারা এর বিনিময়ে মজুরি পান না, এই যদি হয় মজহারের সংজ্ঞা, তাহলে এটি সেকেলে।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, প্রথাগত মার্ক্সবাদী ধারণা অনুসারে এ দেশের যে নারীরা পুরোদস্তুর শ্রমিক— অর্থাৎ, মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন (গার্মেন্টস শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক)— মজহারের দৃষ্টিতে, তারাও শ্রমিক নন। কারণ মজহারের
প্রস্তাবনায় খেটে খাওয়া মানুষরা (“সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব জনগণ, শ্রমিক, মজুর, উন্মূল উদ্বাস্তু মানুষগুলো..”) শরীর বললে সবসময়ই পেট বোঝেন, আর পেটের অর্থ একটাই: আঁতের জ্বালা মেটানো, ক্ষুধা মেটানো, খেয়ে পরে বাঁচা।
কিন্তু নারী শ্রমিকের জন্য পেটের অর্থ কী শুধু তাই? এতোই কী একরৈখিক? শুধু নারী শ্রমিক কেন, সকল শ্রেণীর নারীর কাছে পেটের বিশেষ অর্থ রয়েছে: নারী তার পেটে সন্তান ধারণ করে, সন্তান মায়ের পেটের থেকে পুষ্টি পায়, পেটের মধ্যেই বড় হয়, দশ (কি নয়) মাস পর পেটের থেকে বেরোয়। আর এ কারণেই, কার সন্তান, কোন্ মায়ের সন্তান বোঝাতে চাইলে আমরা বলি, অমূকের পেটের সন্তান (পুরুষদের ক্ষেত্রে তা বলি না, বরং বলি, ‘ওর জন্মের সন্তান’)। আরো অনেক–কিছু বলি যা নারীর পেটকে, নারীর জন্মদানের ক্ষমতাকে, তার এই সামর্থ্যকে ঘিরে। যেমন নাড়ির টান, নাড়িছেঁড়া ধন ইত্যাদি, ইত্যাদি।
শ্রমিক শ্রেণী নিয়ে মজহারের কথাবার্তায় নারী–পুরুষের সম্পর্কের কোনো উল্লেখ নেই, তা না। আছে, তা অতি–সামান্য, “শ্রমিক ও কৃষকেরও যৌন জীবন আছে, নারীপুরুষের প্রেম ভালবাসা রতিমিলন আছে”। যৌন জীবন আছে, রতিমিলন আছে, কিন্তু মজহারের কথা শুনে মনে হয়, যৌন সম্পর্কের কোনো জৈবিক কনসিকোয়েনসেস নেই। কেন? রতিমিলনের খেসারত নারীর পেটেই প্রকাশ পায় বলে? পুরুষের পেট— তা শ্রমিক পুরুষের পেট হোক, কী বুর্জোয়া পুরুষের পেট— যৌনসংগমের কোনো চিহ্ন ধীরে–ধীরে বহন করা শুরু করে না বলে?
মজহার যদি নারী (বুদ্ধিজীবী) হতেন, তাঁর কাছে কী পেটের এমনই একপেশে অর্থ হতো?
এখন আসি যোনির কথায়।
মজহারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল লেখক, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীর স্বাধীনতা সম্পর্কে। তিনি এই বলে আপত্তি জানিয়েছিলেন যে, “আমার কারাবাসকে লেখকের স্বাধীনতার প্রশ্ন আকারে তুললে আপনি আমাকে এমন কিছু লেখকের কাতারে ফেলে দেবেন যাদের কাজ হচ্ছে নোংরামি, বেল্লোগিরি এবং নিজেদের চরম বদমায়েশিগুলোকে লেখকের স্বাধীনতা আকারে হাজির করা।”৫৩ এর ব্যাখ্যা হিসেবে মজহার বলেন, সঙ্গমের স্বাধীনতা আর লেখকের স্বাধীনতা এক জিনিস নয়। মানুষের শরীর যে সমাজে পুঁজির অধীন, যে সমাজে মানুষের শ্রম হচ্ছে পুঁজির স্ফীতি, অপরের জন্য খেটে মরা, সে সমাজে লেখকরা পেটের মুক্তি, মেহনতের মুক্তি দাবি না করে লিঙ্গের স্বাধীনতা চাইছেন। তারা বলে বেড়াচ্ছেন, “আমাদের আছে স্বাধীন ও সার্বভৌম লিঙ্গ।”৫৪ এটাকেই তারা লেখকের স্বাধীনতা হিসেবে প্রচার করছেন।
মজহার বলেন, লেখক হিসেবে সঙ্গমের স্বাধীনতা প্রচার করা আর পেটের দাবি প্রচার করা এক জিনিস নয়। তিনি বলেন, কোনো লেখকের হয়ত হস্তমৈথুন ভালো লাগে, সেটা তিনি বাথরুমে গিয়ে করলেই পারেন। এ কারণে যদি কেউ লেখককে গালমন্দ করে, তিনি তার পক্ষে দাঁড়াবেন। কিন্তু সেই লেখক যদি তার ভালো লাগাটা প্রচার করে, অন্যরা যদি রুচির কারণে তাতে বাধা দেয়, তখন যদি লেখক বলে বসেন যে তার স্বাধীনতায় বাধা দেয়া হচ্ছে, সেটা “মহা মুশকিলের ব্যাপার।”৫৫ এ প্রসঙ্গেই মজহার বলেন, “কোন মেয়ে যদি বলে ছেলেরা চারটা বৌ রাখতে পারে, অতএব আমিও চাই চারটা পুরুষ,”৫৬ যদি পরুষতন্ত্রের এই যুগে মেয়েটি “চারটে পুরুষকে এক সঙ্গে”৫৭ বাগিয়ে নিতে পারে, তিনি তাকে “একখানা বাপের বেটি বটে”৫৮ বলবেন। মেয়েটির তারিফ করবেন, তার উদার পুরুষ সঙ্গীদেরও তারিফ করবেন। কিন্তু এই চারটি পুরুষ রাখাই নারী মুক্তি, এটিই লেখকের স্বাধীনতা, যদি লেখক এটা দাবি করে বসেন, সেটা খুবই সমস্যাজনক। এ সকল কারণে মজহার তাঁর নিজ কারাবাসকে “বিমূর্ত কায়দায় লেখকের স্বাধীনতার প্রশ্ন আকারে”৫৯ দেখতে রাজি নন।
এখন, আমার কথা হচ্ছে, লেখকের স্বাধীনতার অর্থ কী, এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মজহার আবারও লিঙ্গীয় ভিন্নতা সৃষ্টি করেন; আর আবারও, তার খেসারত নারীকেই দিতে হয়। তিনি আবারও নারী–সাপেক্ষে পুরুষের ক্ষমতাকে অদৃশ্য করেন। বুর্জোয়া নারী–লেখকের তুলনায় বুর্জোয়া পুরুষ–লেখক যে সাধারণত বেশি ক্ষমতার অধিকারী, তা হাওয়া হয়ে যায়। পুরুষ ক্ষমতার যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আছে— রাষ্ট্রব্যবস্থায়, আইনে, সমাজ–সংস্কৃতিতে, অর্থনীতিতে— তা হাওয়া হয়ে যায়। এর পরিবর্তে আমরা পাই বাস্তবিক সামাজিক সম্পর্কে অ–প্রোথিত নারী (ও পুরুষ) লেখক, যারা স্বেচ্ছাচারী যৌন তাড়না দ্বারা, অঙ্গ–প্রত্যঙ্গের অনিয়ন্ত্রিত গতি দ্বারা, চালিত (“নুনু বা যোনির সুড়সুড়ানি”)। সমাজ চিন্তক হিসেবে মজহার থেকে আমরা আশা করি যে তিনি দেহের ব্যক্তিবাদী বয়ানকে হিস্টোরিসাইজ করবেন। স্বাধীন–স্বতন্ত্র–সার্বভৌম/autonomous শরীরের ধারণাকে ডিকনস্ট্রাক্ট করবেন। তার লিঙ্গীয় ও বর্ণবাদী রূপ উন্মোচন করবেন। কিন্তু এ ধরনের কোনো কিছু না করে, লেখকের স্বাধীনতার বুর্জোয়া ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে মজহার নিজেই ব্যক্তিবাদী বয়ান উৎপাদন করেন। স্বাধীন–স্বতন্ত্র দেহের বুর্জোয়া আদর্শকে ডিমোনাইজ (দানবীয়) করার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেই সেটিকে পুনরুৎপাদন করেন। মজহারের উল্লিখিত নুনু, যোনি ইতিহাস–বিবর্জিত, সমাজ–বিচ্ছিন্ন। তাঁর সাক্ষাৎকারের এই অংশগুলো পড়লে উনবিংশ–বিংশ শতকে ‘ফ্রি সেক্স’ নিয়ে ভিক্টোরীয় উৎকণ্ঠার কথা মনে পড়ে যায়।
মজহারের ‘শ্রমিক’–এর ধারণা যেমন পুরুষ শ্রমিকের ছাঁচে গড়ে তোলা, মজহারের ‘লেখক’ও তাই। মনে হয়, পুরুষ লেখক ও নারী লেখক একই ক্ষমতা ও সামর্থ্যরে অধিকারী, বুর্জোয়া পুরুষ যা পারেন বুর্জোয়া নারীও তাই পারেন। করেনও। এখানেও যৌন মিলনের কোনো লিঙ্গীয় কনসিকোয়েনসেস নেই: পেটে বাচ্চা আসার দুর্ভাবনা, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার, এ্যাবরশন, এনেসথিশিয়া নিলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, এ্যাবরশনের পরে হঠাৎ ভ্রুণের জন্য মায়া, কুৎসা রটনার ভয়, জারজ বনাম বৈধ সন্তান জন্মদানের সুবিধা–অসুবিধা ইত্যাদি, ইত্যাদি। এমন কনসিকোয়েনসেস যার চাপ ও মুক্ত পরিসর, দুটোই— বুর্জোয়া নারীর বেলায়ও– বাস্তবিক ক্ষমতা কাঠামো দ্বারা গঠিত। আমার জানামতে রাইট–টু–ওয়ান্স–বডি’র পশ্চিমা বুর্জোয়া নারীবাদী ধারার প্রবক্তারা মজহারের মত এতো তাচ্ছিল্যের স্বরে কথা বলেন না। জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির ক্ষতিকারক দিক নিয়ে, নারী দেহের মেডিকালাইজেশন৬০ নিয়ে, এমনকি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কীভাবে তৃতীয় বিশ্বের নারীকে গিনিপিগে পরিণত করেছে, নানান সময়ে তারা এসব বিষয়ে দুশ্চিন্তা ব্যক্ত করেছেন।
সচেতন কথাবার্তায় পুরুষের ক্ষমতাকে অদৃশ্য করলেও, বাস্তব চিত্র যে ভিন্ন, অবচেতন–মনে মজহার তা জানেন, বোঝেন। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। বুর্জোয়া পুরুষ ও নারীর ক্ষমতা যে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, সমান্তরাল নয়, তা তাঁর মুখ–ফসকে–বেরিয়ে–যাওয়া কথা থেকে বোঝা যায়। “কোন মেয়ে যদি বলে ছেলেরা চারটা বৌ রাখতে পারে, অতএব আমিও চাই চারটা পুরুষ”— তাঁর এই কথা থেকে বেরিয়ে আসে। মুসলমান পুরুষের একসঙ্গে চারজন স্ত্রী থাকতে পারে, এটি এদেশে আইন–সমর্থিত। কিন্তু মুসলমান নারীর স্বামী সংখ্যা এক–এ সীমিত। লক্ষণীয় যে মজহার চারজন “বর” (বউ–এর জোড় শব্দ)-এর কথা বলেন না। চারজন স্বামীর কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। স্বামী শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ একে তো ঈশ্বর, প্রভু, রাজা, সম্রাট, মালিক ইত্যাদি, ইত্যাদি, আবার বর্তমান বাংলাদেশে, পশ্চিমা রূপান্তরণের পরিপ্রেক্ষিতে স্বামী/বর/হাসবেন্ড৬১— পুরুষের এই ভূমিকা সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইনি, মতাদর্শিক ও নৈতিক ক্ষমতার অধিকারী। চারজন কর্তার মাধ্যমে নারীমুক্তি সাধিত হতে পারে, এটা বললে তাঁর ব্যঙ্গ ধোপে টিকবে না, কথার পিঠে কথার মধ্যেও মজহার মনে হয় তা টের পেয়েছিলেন। দ্রৌপদির পুরাণ পুরাণই।
মজহারের লেখকের স্বাধীনতার বয়ান বীরোচিত। এতে নারী ‘অপর’। শুধু তাই নয়, অপরকরণের মধ্য দিয়েই বিপ্লবী, পুরুষ–লেখকের heroism রচিত। লেখকের স্বাধীনতার বয়ান ‘অনৈতিক বুর্জোয়া’ আর ‘পিউরিটান সর্বহারা,’ শ্রেণীগত বৈপরীত্য বা বাইনারি অপোজিশনের এই ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে নির্মিত। রুশ বিপ্লবের আগে ও পরে, সে দেশের নারীবাদী বিপ্লবীরা একই–ধরনের অপোজিশনের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তর্ক–বিতর্কের মাধ্যমে, ঘাত–প্রতিঘাতের মাধ্যমে তারা আবিষ্কার করেন যে এই বৈপরীত্য নারী–স্বার্থ বিরোধী। তারা আবিষ্কার করেন যে প্রেম, ভালোবাসা, যৌনতা প্রসঙ্গে ভিন্ন অভিজ্ঞতা, ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন আকাক্সক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরলে পুরুষ কমরেডরা সর্বহারা শ্রেণীর বাস্তবে যাপিত জীবনের জটিলতার মধ্যে ঢোকেন না। সর্বহারার পিউরিটান চিত্রায়ন অক্ষত রেখে তারা সহজ পথটি বেছে নেন। তারা তাদের নারী কমরেডদের ‘বুর্জোয়া’ ডেকে গালি দেন।
সামনাসামনি–তে প্রকাশিত “পার্টি ব্যক্তি লেখকের স্বাধীনতা”–র সাক্ষাৎকারের পরের সাক্ষাৎকার “বাংলা, বাংলাদেশ ও পরিচয়ের রাজনীতি” (১৯৯৪)।৬২ সেখানে মজহার বাঙালি সংস্কৃতি, এদেশের ঐতিহ্য নিয়ে কথা প্রসঙ্গে বলেন, “[আমাদের বর্তমান লড়াইয়ে] শ্রেণীর ব্যাপার আছে, নারীপুরুষ ভেদ আছে।”৬৩ পরের পৃষ্ঠাতেই পাই একটি ভাওয়াইয়া গানের চমৎকার বিশ্লেষণ।৬৪ মজহার বলেন, গানের মর্মকথা হচ্ছে গাহর্স্থ্য শৃঙ্খল থেকে মার মুক্তির অর্থ হচ্ছে কন্যার বন্দীত্ব। মজহারের বক্তব্য হচ্ছে, মায়ের প্রতি মেয়ের সলিডারিটি প্রকাশ পায় গানটিতে, আবার একইসঙ্গে এটি মেয়ে(মানুষের) গাহর্স্থ্য নিয়তির গৌরবগাথা। বিশ্লেষণ চমৎকার, তা সত্ত্বেও, কিংবা সে কারণেই, দ্বিধান্বিত বোধ করি। কীভাবে বুঝব? তার মানে কি টেক্সচুয়াল রেপ্রিজেন্টেশনে মজহার নারী–পুরুষের মধ্যকার ভেদাভেদ বোঝেন, যাপিত জীবনেরটা, with all its complexities of `self’ and ‘other’— বুঝতে পারেন না, ধরতে পারেন না?
পরিশেষে যেই চিন্তাটি প্রসঙ্গ ও প্রশ্ন–আকারে পাঠকদের মধ্যে দানা বাঁধুক, তা উপস্থাপন করছি: বাম ধারা ও নারীবাদের বিয়ে কি শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই অসুখী?
—————————————————————————–
৩’য় অংশের কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সুদৃঢ় ভগিনি বন্ধনে লালিত না হলে বাম/প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী পুরুষ ডিসকোর্স, ও তার ক্রিটিক দাঁড় করানোর কাজ হাতে নেয়া সম্ভব হতো না। ভগিনি তালিকায় সবার আগে একসাথে বেড়ে ওঠা বন্ধু শামীম আক্তার–এর নাম। দিলারা বেগম জলি (চট্টগ্রাম), শিপ্রা বোস (কাবুল), উদিসা ইসলাম (রাজশাহী) ভৌগোলিক দূরত্ব অতিক্রম করে উষ্ণ সংহতিবোধের মাধ্যমে, আমাকে, আর ক্রিটিকের জরুরিত্বকে জিইয়ে রেখেছে। প্রাণসই সায়দিয়া গুলরুখ বরাবরের মতো আমাকে প্রেরণা যুগিয়েছে। তাদের সকলকে ধন্যবাদ, তবে ক্রিটিকের অপূর্ণতা, ভুলত্রুটির দায়ভার তাদের নয়। আমারই।
পূর্ণাঙ্গ লেখার কৃতজ্ঞতা স্বীকার: পাবলিক নৃবিজ্ঞান এর সাথীদের ধন্যবাদ জানাই, এই প্রবন্ধের নানান সংস্করণে তারা সহোৎসাহে পরামর্শ দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করেছেন। সময়–অসময় যদি দিকনির্দেশনা দিয়ে তারা পথ না দেখাতেন, এগোনো কঠিন হতো। বিশেষ ধন্যবাদ সাঈদ ফেরদৌস আর মির্জা তাসলিমা সুলতানার প্রাপ্য, ২০১৫–র পরিবর্তিত বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে কী ধরনের টীকা সংযোজন করে প্রবন্ধ প্রকাশযোগ্য করে তোলা সম্ভব সেই পরামর্শ দেয়ার জন্য। সাঈদকে বাড়তি ধন্যবাদ মূল্যবান কপি–এডিটিংয়ের জন্য।
পাদটীকা
১এই পুস্তিকা–প্রবন্ধের প্রথম অংশ, যেটি লিডিয়া সার্জেন্টের লেখার অনুবাদ, এই লেখাতেই নারী–পুরুষের মধ্যকার লিঙ্গীয় অসমতার দৈনন্দিন চর্চা কীভাবে ডক্যুমেন্ট করা সম্ভব, তার একটি পদ্ধতিগত নমুনা (methodological exercise ) পাওয়া যায়।
২Lydia Sargent (ed.), Women and Revolution. A Discussion of the Unhappy Marriage of Marxism and Feminism (Boston: South End Press, 1981)। এই সংকলন ‘রাজনৈতিক বিতর্ক’ নামক সিরিজের অংশ। উল্লেখ্য যে লিডিয়া সার্জেন্টের পুরো ভূমিকাটি (“New Left Women and Men: The Honeymoon is Over”) অনুবাদ করিনি। মোট ২০ পৃষ্ঠার এই প্রবন্ধের (পৃ. xii-xxxii ) ১১ পৃষ্ঠা (xii-xxii)) অনুবাদ করেছি। বাকি ৯ পৃষ্ঠায় রয়েছে উইমেন এন্ড রেভোলিউশন সংকলনের বিভিন্ন প্রবন্ধ সম্বন্ধে সম্পাদক হিসেবে লিডিয়া সার্জেন্টের পরিচিতিমূলক আলোচনা। এই পুস্তিকাপ্রবন্ধের জন্য পরবর্তী এই অংশটি প্রাসঙ্গিক না হওয়ার কারণে তা বাদ দিয়েছি।
উইমেন এন্ড রেভোলিউশন সংকলনে ১৩জন নারীবাদীর লেখা রয়েছে, তাঁরা হলেন: Iris Young, Christine Riddiough, Gloria Joseph, Sandra Harding, Azizah al-Hibri, Carol Ehrlich, Lise Vogel, Emily Hicks, Carol Brown, Katie Stewart, Ann Ferguson & Nancy Folbre, Zillah Eisenstein।
৩Rahnuma Ahmed, ÒCONVERSATIONS: BEING A WOMAN. Left Leadership in Bangladesh,Ó New Age, Tuesday, August 5, 2008|
৪সৈকত হাবিব সম্পাদিত সংকলনটি ২০০৭ সালের বইমেলা’তে বেরুনোর কথা ছিল। সংকলনটি বইমেলা ধরতে পারেনি লেখা দিতে দেরি হওয়ার কারণে, আমার জানামতে পরে সংকলনটি আর বেরোয়নি।
৫মানুষের রাজনীতি–দর্শন–আদর্শ বদলায়, ২০০৪ এর ফরহাদ মজহার যেভাবে নিজেকে পরিচিত করিয়েছিলেন একজন ‘মার্ক্সবাদী’ হিসেবে, সেই একই ফরহাদ মজহার ২০১৫ সালে নিজেকে একইভাবে পরিচিত করাবেন কি–না, আর করলেও, তিনি সেভাবেই recognised হবেন কি–না, তা তর্কসাপেক্ষ।
৬সামনা সামনি। ফরহাদ মজহারের সঙ্গে কথাবার্তা (সম্পাদকবৃন্দ), সাদ্দাম হোসেন, ইলিয়াস মিলন, মোহাম্মদ আজম, মোহাম্মেদ রোমেল ও এবাদুর রহমান (ঢাকা: সূচীপত্র, ২০০৪)।
৭ নিউ লেফ্ট নামটি প্রধানত যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত, এটি ১৯৬০–৭০ দশকের শিক্ষক, এ্যাক্টিভিস্ট, প্রতিবাদকারীদের ইঙ্গিত করে যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী ওল্ড লেফ্টের রাজনীতির প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক বাম সংহতিতে ভাঙন ধরার একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরির বিপ্লব যেটি সোভিয়েত সেনাবাহিনী দমন করে। পশ্চিমা কম্যুনিস্ট পার্টি ও বয়োজেষ্ঠ নেতৃত্ব সোভিয়েত হস্তক্ষেপকে মেনে নিয়েছিল যার কারণে নতুন প্রজন্মের বহু পশ্চিমা মার্ক্সবাদী কম্যুনিস্ট/বাম দলকে ত্যাগ করেন। তাঁরা পুঁজিবাদের বিরোধিতা’সহ বাম–স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেন। আর এ কারণেই এই ধারার নাম নিউ লেফ্ট। ব্রিটেনের নিউ লেফ্ট প্রাধান্য দেয় মানবতাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক মার্ক্সবাদের উপর; রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির মিশ্রণের উপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ লেফ্ট প্রভাবিত হয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ (ও তার বিরোধিতা) এবং কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন দ্বারা। আমেরিকা ও ব্রিটেন, উভয় দেশের নিউ লেফ্টই সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে সমালোচনামনষ্ক ছিলেন (ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, দমন–পীড়ন নীতি), কিন্তু ব্রিটেনের নিউ লেফ্ট যেখানে ট্রটস্কিবাদ বা সামাজিক গণতন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ে, মার্কিন নিউ লেফ্ট নতুন বিপ্লবী নেতৃত্বের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে, যেমন, মাও সে তুঙ (চীন), হো চি মিন (ভিয়েতনাম), ফিদেল ক্যাস্ট্রো (কিউবা)।
৮এদেশের বাম দলের ঐতিহ্য প্রসঙ্গে মিশু যেই সমালোচনা করেন তা যে একান্তভাবে বাংলাদেশের বামদের সমস্যা নয়, সেটি তুলে ধরার জন্য আমি নেপালের মাওবাদী কম্যুনিস্ট দলের সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য এবং নারী বিভাগের প্রধান, কমরেড পার্বতীর লেখালেখি ও সাক্ষাৎকারের সাহায্য গ্রহণ করেছি।
৯দেখুন, Comrade Parvati, “Women’s Leadership and the Revolution in Nepal,” Monthly Review, February 21, 2003 http://monthlyreview.org/commentary/womens-leadership-and-the-revolution-in-nepal
http://sketchythoughts.blogspot.com/2008/03/interview-with-comrade-parvati-of cpnm.html; “People’s Power in Nepal,” Monthly Review, Volume 57, Issue 06, November 2005 http://monthlyreview.org/2005/11/01/peoples-power-in-nepal; Interview with Comrade Parvati (Hisila Yami) of the Communist Party of Nepal (Maoist), conducted by Jorun Gulbrandsen and Johan Petter Andresen, Blog Sketchy Thoughts, Friday, March 21, 2008|
১০বৈজ্ঞানিক মার্ক্সবাদ সমাজ কাঠামোর উপর গুরুত্বারোপ করে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচারে প্রথাগত চিন্তা যেখানে মানুষের ইচ্ছার (will) ওপর জোর দেয়, মার্ক্সের সমাজ কাঠামোর ধারণা’মতে ব্যক্তিগত ইচ্ছা–অনিচ্ছা যাই থাকুক না কেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একজন পুঁজিপতি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে নিরন্তর উৎপাদন বৃদ্ধি করার কাজে নিয়োজিত থাকেন, নিরন্তর শ্রম–শোষণে নিজেকে লগ্নি করেন; সমাজ কাঠামোতে ভিন্ন–ভিন্ন অবস্থানে অবস্থিত হওয়ার কারণে, মার্ক্সের কাঠামোগত দৃষ্টিভঙ্গি মোতাবেক, বুর্জোয়া ও শ্রমিক নিজস্ব সামাজিক অবস্থান মোতাবেক তাদের যা যা করা উচিৎ— ব্যক্তিগত চিন্তা মন–মানসের ভিত্তিতে নয় বরং বস্তুনিষ্ঠ শর্তের (সামাজিক অবস্থান; উৎপাদন সম্পর্কে তার অবস্থান) পরিপ্রেক্ষিতে— তারা তাই করেন (কাজকর্মে, আচরণে)। মার্ক্সের কাঠামোবাদী বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই পয়েন্টগুলো উল্লেখযোগ্য:- (ক) ব্যক্তিগত ইচ্ছার পরিবর্তে মার্ক্স বস্তুগত শর্তের ধারণার ওপর জোর দেন (খ) দ্বিতীয়টির ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করেন (গ) কাঠামোর ওপর গুরুত্বারোপ করার অর্থ হচ্ছে তিনি “ভালো” বা “মন্দ” ইচ্ছার বিষয়টিকে দূরে সরিয়ে রাখেন (ঘ) মার্ক্সের যুক্তি হচ্ছে, ব্যক্তিগত ইচ্ছার ধারণা (ও প্রয়োগ) সমাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকারী শর্তকে (উৎপাদনের সম্পর্ক: পুঁজিপতি–সর্বহারা; উৎপাদনের মাধ্যম: উৎপাদন করার জন্য যা যা লাগে যেমন কল–কারখানা, জমি, কাঁচা মাল) আড়াল করে (৫) তার অত্যাবশ্যকীয়তাকে উপেক্ষা করে (৬) প্রথাগত চিন্তাা পক্ষান্তরে, মার্ক্সবাদীদের মতে, বৈজ্ঞানিক মার্ক্সবাদের সাহায্যে বিষয়গুলোকে বোঝা ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব।
অব্জেক্টিভ কন্ডিশনের আলোচনা প্রসঙ্গে লেনিন বিপ্লবের যে ৪টি শর্তের কথা বলেছিলেন তা সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা যায়:- (ক) বিপ্লব–অনুকূল পরিস্থিতি তখনই সৃষ্ট হয় যখন শাসক শ্রেণী আগের মতো শাসন করতে অক্ষম হয়ে পড়ে; শাসক শ্রেণীর মধ্যে একাধিক দল, উপদল দেখা দেয়, তার কারণে বিভক্তি ঘটে, প্রতিটি দল ভিন্ন–ভিন্ন সমাধান প্রস্তাব করে (খ) মধ্য(বিত্ত) শ্রেণীর মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয় (গ) শ্রমিক শ্রেণী সমস্যার সমাধান খোঁজে কিন্তু পূর্বতন সমাজব্যবস্থার অধীনে নয়; বদলের জন্য শ্রমিক শ্রেণী যুদ্ধে নামতে প্রস্তুত (ঘ) আর সর্বোপরি, শ্রমিকদের সাধারণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় সুস্পষ্ট মার্ক্সবাদী ভাবধারার ভিত্তিতে পরিচালিত একটি বিপ্লবী দল যার কৌশল, লক্ষ্য হাসিলের পন্থা ও সংগঠন— সবই প্রস্তুত।
১১দ্বান্দ্বিক চিন্তার মূলে রয়েছে আপাত দৃষ্টিতে যা মনে হবে সম্পর্ক–বিহীন, তার মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক অর্থাৎ, দৈবাৎ কোনো ঘটনা নয় বরং ব্যবস্থাজনিত কারণে (systematic interconnections) তা অনুসন্ধান করতে পারা, তার মাধ্যমে পূর্বতন অনগ্রসর ধাপ অতিক্রম করে আরো অগ্রসর ধাপে উন্নীত হওয়া। অর্থাৎ, শ্রেণী বৈষম্যের সঙ্গে লিঙ্গীয় বৈষম্যের আন্তঃসম্পর্ক অনুসন্ধান করে উপলব্ধি করতে পারা কেন বিপ্লব সাধন করতে হলে, তাকে টিকিয়ে রাখতে হলে নারীমুক্তি অপরিহার্য।
১২“Women have to wage a longer struggle because of their double oppression.” দেখুন, Comrade Parvati, “Women’s Leadership and the Revolution in Nepal,” পূর্বোক্ত|
১৩“Added to this is the unilateral burden a woman has to carry when she becomes a mother. With the birth of every child she sinks deeper into domestic slavery,” উপরোক্ত। ৩১ নং টীকা–ও দেখুন।
১৪“…in white dominated areas [areas still dominated by the local traditional elite-ed.]…women seldom get support system from the mass as well as from the Party to sustain themselves in their reproductive years,” উপরোক্ত।
১৫ উপরোক্ত। ৩১ নং টীকা–ও দেখুন।
১৬এক্ষেত্রে কমরেড পার্বতীর অভিজ্ঞতা উল্লেখ্য, “But there is also a tendency to treat women differently than men, something I have experienced personally. When my husband Baburam Bhattarai was taken action against in 2005, this was given a political motivation, but when I was taken action against, the reasons given were my negative influence on him,” Interview with Comrade Parvati (Hisila Yami), Blog Sketchy Thoughts, উপরোক্ত। ৩১ নং টীকা–ও দেখুন।
১৭পাঠকদের মধ্যে যাঁরা মার্ক্সবাদ–এর সঙ্গে স্বল্প–পরিচিত, তাঁদের সাহায্যার্থে এই টীকা যোগ করছি। অন্যান্য দর্শনের সঙ্গে মার্ক্সবাদের ভিন্নতা কার্ল মার্ক্সের (১৮১৮–১৮৮৩) এই বিখ্যাত উক্তিতে ধরা পড়ে: এ যাবৎকাল পর্যন্ত দার্শনিকরা বিশ্ব–সংসারের নানা ধরনের ব্যাখ্যাই দিয়েছেন শুধু, কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে এই ব্যবস্থার বদল ঘটানো (“The philosophers have only interpreted the world, in various ways; the point is to change it”)। আর একারণেই মার্ক্সবাদ একটি বিপ্লবী দর্শন, যাঁরা মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী তাঁরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বদল ঘটাতে বদ্ধপরিকর, তাঁরা সাম্যবাদী সমাজ বাস্তবে প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেন; মার্ক্সবাদী দর্শনের ভিত্তিতে বিপ্লব সংগঠিত করেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অর্থনীতি ব্যক্তির মালিকানাধীন; মালিকরা সমাজের সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, সম্পদ তাদেরই নিয়ন্ত্রণে যাতে তারা নিরন্তর মুনাফালাভ করে আরো বিত্তবান, আরো শক্তিশালী হতে পারেন। এই উৎপাদন ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাধারণীকৃত পণ্য উৎপাদন (generalised commodity production), অর্থাৎ, ব্যবস্থাটি এমনভাবে গঠিত যাতে সমাজ–জীবনের নানাবিধ দিক প্রতিনিয়ত এবং অবিরামভাবে বেচা–কেনা বা বাজারের চক্রে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। পুঁজিবাদ একটি সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী ব্যবস্থা, এতোটাই যে, পারিবারিক সম্পর্ক পর্যন্ত এই ব্যবস্থায় টাকার সম্পর্কে পরিণত হয়। শিল্পায়নের উত্থান সাধারণ মানুষকে সামন্তবাদী প্রভুর প্রজা থেকে মুক্ত করেছে ঠিকই কিন্তু এই স্বাধীনতা শুধু শ্রম–বিক্রির স্বাধীনতা যাতে শিল্প–শ্রমিক পুঁজিপতি দ্বারা শোষিত হতে পারে; যাতে শিল্পপতি/পুঁজিপতিরা মুনাফা অর্জন করতে পারে। পুঁজিবাদের এই অসম ও অন্যায় ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করতে হলে বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা ভাঙতে হবে, সর্বহারা শ্রেণীর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে হবে যাতে সমাজতান্ত্রিক ধারায় সমাজের রূপান্তর ঘটানো সম্ভব হয়।
১৮সনাতনী মার্ক্সবাদীদের দৃষ্টিতে পুরুষাধিপত্যের মূল কারণ হচ্ছে শ্রেণী বৈষম্য, এর বিপরীতে র্যাডিকাল নারীবাদীরা মনে করেন, মানুষের মধ্যে বিরাজমান সবধরনের বৈষম্য ও আধিপত্যের (এমনকি শ্রেণী ও নরবর্ণভিত্তিক আধিপত্যের–ও) মূল কারণ হচ্ছ লিঙ্গীয় বৈষম্য বা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা। দেখুন, Ann Ferguson and Nancy Folbre, ÒThe Unhappy Marriage of Patriarchy and Capitalism,Ó Women and Revolution, পৃ. ৩১৪। বিষয়গুলো এই অংশের ‘২খ. তত্ত্বের সমস্যা’–য় আরো বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে।
১৯সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা র্যাডিকাল নারীবাদীদের সঙ্গে পিতৃতন্ত্রের অস্তিত্বের ব্যাপারে একমত, কিন্তু তারা মনে করেন না যে সমাজে বিরাজমান সকল বৈষম্য একইসূত্রে গাঁথা। তারা নারীবাদকে অপরাপর বৈষম্য–বিরোধী লড়াইয়ের সঙ্গে— শ্রেণী শোষণ, নরবর্ণভিত্তিক আধিপত্য ইত্যাদি— সম্পৃক্ত করার কথা বলেন।
২০মার্ক্সবাদী নারীবাদীরা মনে করেন, পুঁজিবাদের অবসান ঘটলে পিতৃতন্ত্রেরও বিলুপ্তি ঘটবে যেহেতু নারী নিপীড়নের প্রধান কারণ হচ্ছে সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানা। শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব ও কর্মসূচীতে নারী–শ্রমিকের অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করে মার্ক্সবাদী নারীবাদীরা মার্ক্সবাদকে তাত্ত্বিকভাবে সমৃদ্ধ করেছেন।
২১সাধারণ ধারণা হচ্ছে লেসবিয়ান মানে সমকামী নারী— নারীদের মধ্যে প্রেম–ভালোবাসা–যৌন সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ও বিশ্বাসী। এ ধরনের প্রস্তাবনায় বাদ পড়ে যায় বিষমকামীতা কিভাবে পিতৃতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখে, তার তাত্ত্বিক সমালোচনা।
২২এ্যানার্কো–ফেমিনিস্টদের দৃষ্টিতে পিতৃতন্ত্র ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই রাষ্ট্রের বিলুপ্তির লড়াইয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত। রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে এ্যনার্কিজম যেহেতু সবধরনের ক্ষমতা–সম্পর্কের বিরোধী, তাই স্বাভাবিকভাবে অনেক নারীবাদী এ্যানার্কিজমের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।
২৩মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬০এর দশকে কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী আন্দোলন শুরু হয় ব্ল্যাক লিবারেশন মুভমেন্ট ও উইমেন্স মুভমেন্টের পরিপ্রেক্ষিতে। কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদীরা প্রথমটি থেকে বেরিয়ে আসেন কারণ কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের দৃষ্টিতে নরবর্ণবাদী অত্যাচার ও নিপীড়ন সর্বসর্বা, বৈষম্য–ব্যবস্থা হিসেবে পিতৃতন্ত্র সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ না; দ্বিতীয়টি ছাড়ার কারণ শ্বেতাঙ্গ নারীদের কাছে নরবর্ণভিত্তিক বিভাজন, শত শত বছরের বর্ণবাদী ইতিহাস অবজ্ঞার পাত্র, আর এভাবেই কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা আলাদা ও স্বতন্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী তাত্ত্বিক প্যাট্রিশিয়া হিল কলিন্স’মতে, কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী হচ্ছেন তিনি যিনি সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গ নারীর অভিজ্ঞতা ও চিন্তার তত্ত্বায়ন ঘটান যা ব্যক্তিসত্তা, সম্প্রদায় ও সমাজের অবস্থাকে বিষেøষণ করতে সাহায্য করে।
২৪Betty Friedan, The Feminine Mystique (New York: Dell publishing Co., 1963), পৃ. 11|
২৫মূল টেক্সটের প্রতি সততার তাগিদ থেকে “fuck”-এর বঙ্গানুবাদে “চোদা” শব্দ ব্যবহার করেছি; ভদ্রসমাজের রীতি–নীতি অনুসারে, বিশেষ করে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত নারীর ওপর ভদ্রতা রক্ষার যেই দায়ভার বর্তায়, এটি হয়তবা একটি অমার্জনীয় অপরাধ।
২৬“[class struggle and women’s liberation] are very close. Women were the first to be oppressed, and will be the last to be liberated when class oppression ceases. So the test of whether class oppression still exists is if women’s oppression still exists or not,” Interview with Comrade Parvati (Hisila Yami), Blog Sketchy Thoughts, পূর্বোক্ত।
২৭“…communist men should know that the revolution and the gains of revolution can only be preserved and furthered when more and more women join and lead the revolution.” Comrade Parvati, “Women’s Leadership and the Revolution in Nepal,” পূর্বোক্ত|
২৯“…communist men should know that the revolution and the gains of revolution can only be preserved and furthered when more and more women join and lead the revolution.” Comrade Parvati, “Women’s Leadership and the Revolution in Nepal,” পূর্বোক্ত।
৩০নিউ এইজ–এর লেখাটি লিখেছিলাম সাড়ে ছয় বছর আগে; কল্পনাকে ১৯৯৬ সালে অপহরণ করা হয়, অর্থাৎ ১৮ বছর আগে।
৩১একদম হুবহু অনুবাদ নয়, যে অংশের ভিত্তিতে লেখা তা তুলে ধরছি, “One of the most apparent reasons is the institution of marriage, which has robbed us of promising women leaders. People’s War seems to be changing that pattern, however, even within PW the question of continuity of women’s leadership keeps coming up, especially when they get married and decide to have children.. Added to this is the unilateral burden a woman has to carry when she becomes a mother. With the birth of every child she sinks deeper into domestic slavery. In fact many women who have been active in People’s War in Nepal are found to complain that having babies is like being under disciplinary action, because they are cut off from the Party activities for a long period. In this way many bright aspiring communist women are at risk of being lost in oblivion, even after getting married to the comrades of their choice… [W]omen seldom get support system from the mass as well as from the Party to sustain themselves in their reproductive years…. There is also the tendency to create pressure on women cadres to get married covertly or overtly as unmarried women draw lots of suspicion from men as well as women for their unmarried status. This results in marriages against their wishes or before they are ready to get married. Also there is a tendency to take sexual offenses more seriously than political offenses.” উপরোক্ত।
৩২জেনি মার্ক্স (১৮১৪–১৮৮১) ছিলেন অত্যন্ত সুশিক্ষিত একজন নারী ও কার্ল মার্ক্সের স্ত্রী; ১৮৪৮ সালে ব্রাসেল্স পুলিশ জেনিকে আটক করে দেশত্যাগের নির্দেশ দেয়।
৩৩নাদেজদা ক্রুপস্কায়া (১৮৬৯–১৯৩৯), রুশ বিপ্লবী ও রাজনীতিবিদ লেনিনের স্ত্রী।
৩৪ লিও জোগিশ (১৮৬৭–১৯১৯), মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক, রোজা লুক্সেমবার্গের কমরেড ও প্রেমিক।
৩৫Teresa L. Ebert, “Alexandra Kollontai and Red Love,” July-August 1999, www.solidarity-us.org|
৩৬পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে আমি পুরুষ বুদ্ধিজীবী ডিসকোর্স বলছি, পুরুষালি বুদ্ধিজীবী ডিসকোর্স বলছি না। আমার দৃষ্টিতে সেটি প্রমাণসাপেক্ষ, গবেষণাসাপেক্ষ।
৩৭“বলা বাহুল্য আমি মার্ক্সের অনুসারী…,” সামনা সামনি। ফরহাদ মজহারের সঙ্গে কথাবার্তা। সাদ্দাম হোসেন, ইলিয়াস মিলন, মোহাম্মদ আজম, মোহাম্মদ রোমেল, এবাদুর রহমান (সম্পাদনা), ঢাকা: সূচীপত্র, ২০০৪, পৃ. ৬৮।
৩৮এটি একটি চলমান কাজ। বদরুদ্দীন উমর (সম্পাদিত) “নারী পশ্ন প্রসঙ্গে” (ঢাকা : শ্রাবণ প্রকাশনী, ২০০৩) উমরের প্রবন্ধ (বইয়ের নামেই, “নারী পশ্ন প্রসঙ্গে”) নিয়ে কাজ শেষ হয়নি, তাই সৈকত হাবিব–এর সংকলনে এই প্রবন্ধে অন্তর্ভুক্ত করতে পারিনি।
৩৯“পার্টি ব্যক্তি লেখকের স্বাধীনতা,” আজকের কাগজ, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭। সাক্ষাৎকারগ্রহণকারির নাম অনুল্লিখিত । পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে, সামনা সামনি। ফরহাদ মজহারের সঙ্গে কথাবার্তা। উপরোক্ত।
৪০‘আনসার বিদ্রোহ’ লেখার জন্য ফরহাদ মজহার ১৯৯৫ সালে, বিশেষ ক্ষমতা অধ্যাদেশ বলে, গ্রেপ্তার ও কারাবন্দী হন। বিদ্রোহটি দমন করেছিল সেনাবাহিনী। কারাবন্দী আনসারদের যাতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে মুক্ত করা হয়, মজহার এটি লিখেছিলেন। হাই কোর্ট তাঁর বন্দীত্ব বেআইনী ঘোষণা করে। ২৮ দিন পরে তিনি মুক্তি পান।
৪১“পার্টি ব্যক্তি লেখকের স্বাধীনতা,” উপরোক্ত, পৃ. ৮০।
৪২ পৃ. ৮১।
৪৩ পৃ. ৮১।
৪৪ পৃ. ৮১।
৪৫ পৃ. ৮১।
৪৬ পৃ. ৮১।
৪৭ পৃ. ৮২।
৪৮ পৃ. ৮২।
৪৯ পৃ. ৮২।
৫০ পৃ. ৮২।
৫১ পৃ. ৮২।
৫২এখানে “লিঙ্গ” শব্দের ব্যবহার খুবই phallocentric। “লিঙ্গ” বলতে মজহার এখানে পুরুষ লিঙ্গ–ই বোঝাচ্ছেন।
৫৩ পৃ. ৮১।
৫৪ পৃ. ৮২।
৫৫ পৃ. ৮১।
৫৬ পৃ. ৮১।
৫৭ পৃ. ৮১।
৫৮ c„. 81|
৫৯ c„. 81|
৬০Medicalisation: কোনো দশা বা আচরণকে চিহ্নিত করা, একটি বর্গ তৈরি করে তার মধ্যে সেটিকে ঢুকিয়ে দিয়ে বলা যে এটিকে স্বাভাবিক করতে হলে তার চিকিৎসা, চিকিৎসাবিজ্ঞানের হস্তক্ষেপ বা ঔষধপত্র প্রয়োজন।
৬১ এর জোড় শব্দ হচ্ছে “মিসেস,” এ দেশের নারীর আধুনিক বশ্যতার প্রতীক, ‘একজন’ স্বামীর প্রতি আনুুগত্যের সামাজিক চিহ্ন।
৬২ সাজ্জাদ শরিফ–এর গ্রহণ করা এই সাক্ষাৎকারটি দৈনিক বাংলা বাজার–এ প্রকাশিত হয়েছিল।
৬৩পৃ. ৮৭।
৬৪ “আজি বিহানে উঠিয়া বাসি কাম সারিয়া/গোবর ফালায় মোর ময়নামতী মাইয়া…”। দেখুন সামনা সামনি, পৃ. ৮৮–৮৯।