- অনুবাদ: কে এম রাকিব
তবুও এইটা ঘটে নাই। এই অবস্থায় পৌঁছাইতে এমন চাকরি সৃষ্টির দরকার ছিল যা কার্যকরতার দিকে দিয়া অর্থহীন। জনগণের বিশাল একটা অংশ, বিশেষত ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায়, সম্পূর্ণ চাকরিজীবন ব্যাহত করে এমন কাজকর্ম করে যা তারা নিজেরাই আজাইরা বলে গোপনে বিশ্বাস করে।
এই পরিস্থিতি উদ্ভুত যে নৈতিক ও আত্মিক ক্ষতিসাধন হয়, সেইটা ভয়াবহ। আমাদের সামষ্টিক প্রাণজুড়ে এ এক বিশাল ক্ষত। অথচ কার্যত এইটা নিয়া কেউ কথা বলতেছে না।
এমনকি ষাটের দশকেও কেইন্স প্রতিশ্রুত যেই ইউটোপিয়া প্রত্যাশিত ছিল সেইটা আর কখনোই বাস্তবায়িত হইলো না ক্যান?
প্রচলিত মত হইলো, ভোগবাদের ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি বুঝতে পারেন নাই। প্রদত্ত অল্প কর্মঘন্টা ও বেশি ভোগসামাগ্রীর মধ্যে সামষ্টিকভাবে আমরা দ্বিতীয়টাই বেছে নিছি।
অর্থাৎ উৎপাদনশীল চাকরি, ধারণানুযায়ী, কমে আসছে ( এমনকি আপনি বিশ্বজুড়ে শিল্পকারখানায় শ্রমিকের সংখ্যাটা, যেমন ভারত ও চীনের দুর্বিষহ অবস্থার শ্রমিকদের কথাও বিবেচনায় নেন, শ্রমিকের সংখ্যার হারটা বিশ্বের জনসংখ্যার অত বড় অংশ না যতটা হওয়ার কথা ছিল।)
কর্মঘন্টা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাইলে বিশ্বের মুক্ত জনগন তাদের নিজের কাজ, আনন্দ ও আইডিয়াগুলো ও ভিশন বাস্তবায়নের সুযোগ পাইতো।
আমরা দেখছি ‘সেবা’ খাত ও প্রশাসন খাতের ব্যাপক স্ফীতি এবং সম্পূর্ণ নতুন ইন্ডাস্ট্রি যেমন অর্থসেবা ও টেলিমার্কেটিং-এর সৃষ্টি কিংবা কর্পোরেট আইন, একাডেমিক ও হিউম্যান রিসোর্স ও পাবলিক রিলেশান্স – এর মতো সেক্টরের অভূতপূর্ব বিস্তৃতি।
এই ইন্ডাস্ট্রিগুলায় যেসমস্ত লোক প্রশাসনিক, কারিগরি কিংবা নিরাপত্তা সহায়তার মতো কাজে শ্রম দেয়, সংখ্যাটা তাদেরকেও প্রতিফলিত করে না।
আসল এইখানেই রহস্য লুকায়ে।
পুঁজিবাদে ধরাই হয় এইটা কখনো ঘটবে না (চলবে চাহিদা ও যোগানের, প্রতিযোগিতামূলক বাজারের সাপেক্ষে – অনুবাদক)।
সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলার মতো পুরনো অকার্যকরী রাষ্ট্রে, যেইখানে চাকরিরে বিবেচনা করা হইতো অধিকার ও পবিত্র কর্তব্ হিসেবে- সিস্টেম যত দরকার তত চাকরি/পদ সৃষ্টি করতো। (যেই কারণে সোভিয়েত ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলোতে একটা মাংসের প্যাকেট বেচতে তিনজন কেরানি লাগত।) অথচ, এই একই ধরনের ঝামেলাই বাজার অর্থনীতিকে মেটাতে হইতেছে।
ইকোনমিক্সের থিয়োরি অনুযায়ী, অন্তত, মুনাফা-লোভী কোনো ফার্ম সর্বশেষ যা করার কথা ভাবতে পারে তা হইলো, অপ্রয়োজনে কর্মীদের নিয়োগ করা। তবু যেভাবেই হোক, এটাই ঘটছে।
কর্পোরেশনগুলা যেখানে, যারা আসলে সবকিছু বানাইতেছে, পরিবহন, মেরামত ও দেখাশোনা করতেছে, সেই শ্রেণির লোকদেরই ছাঁটাই, কর্মবিরতিতে পাঠাইতেছে নির্বিকারভাবে।
বেতনভুক্ত নথি-ঠেলাদের সংখ্যাটা আকারে বেড়েই চলতেছে, প্রচুর সংখ্যক চাকরিজীবী, সোভিয়েতের চাকুরিজীবীদের মতো সাপ্তাহিক ৪০-৫০ ঘন্টা কাগুজে কর্ম করে নয় বরং কার্যকরভাবে কেইন্সের প্রেডিকশন মতোই সাপ্তাহিক ১৫ ঘন্টা কাজ করে যাইতেছে, যেহেতু বাকি সময়টা তারা ব্যয় করতেছেন, মোটিভেশনাল (প্রেষণামূলক) সেমিনার আয়োজন আর অংশগ্রহণ করায়, ফেবু প্রোফাইল আপডেইট করা কিংবা টিভি সিরিজ ডাউনলোড করায়।
উত্তরটা অর্থনৈতিক না, নৈতিক ও রাজনৈতিক।
শাসক শ্রেণি বুঝে গেছে যে, সুখী ও উৎপাদনশীল কোনো জনগোষ্ঠী, যাদের হাতে অবসর সময় থাকে, খুবই বিপজ্জনক জিনিস (ভাবেন, কী ঘটতে পারে? ষাটের দশকে বিটজেনারেশনের মুভমেন্টের সময় কিছুমাত্রায় এই জিনিস শুরু হইছিল*)।
অন্যদিকে, কাজ যে একটা নৈতিক ব্যাপার এই বোধ এবং নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্রে নিজেরে যে শ্রম ও নিষ্ঠার সাথে সমর্পিত করে নাই সে কোনো কিছুর যোগ্য না, এইরকম বোধ খুবই সঙ্গতিপূর্ণ।
ব্রিটিশ একাডেমিকগুলায়, প্রশাসনিক কাজের আপাত অন্তহীন বৃদ্ধি দেখে আমি দোজখের সম্ভাব্য একটা চেহারা কল্পনা করতে পারছিলাম।
দোজখ হইলো সেইসব ব্যক্তির একটা সমাবেশ যারা তাদের প্রভূত পরিমাণ সময় ব্যয় করতেছে এমন কাজে যা তারা করতেও চায় না, ভালোমতো পারেও না।
তারা বলে, তাদেরকে নিয়োগ করা হইছে কারণ আসবাবপত্র নির্মানে তারা অসাধারণ এবং অবাক হয়ে আবিষ্কার করে অধিকাংশ সময় তাদের ব্যয় হইতেছে মাছ ভাজায়।
তারুপ্রে, এই কাজটাও খুব বেশি দরকার নাই করার, অন্তত, ভাজা মাছের চাহিদাও অল্প। এছাড়া বিরক্তির সাথে তারা এমনটাও ভাবে যে, তাদের কর্মীদের কেউ কেউ আসবাবপত্র বানাইতেই বেশি সময় লাগাইতেছে অথচ তারা মাছ-ভাজার দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করছে না। কর্মশালায় তাদের সামনে রয়েছে আধা-ভাজা ভাঁজা মাছের স্তূপ।
আপনি একজন নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক, এইটার ‘দরকার’ই বা কী? (প্রকৃতপক্ষে, অগণন ট্যাবলয়েড পাঠক, আমার চাকরিকে বেহুদা সামাজিক ব্যয়ের নমুনা হিসেবেই ধরে নেবে)। এক অর্থে এইটা নিশ্চয়ই সত্যি। সামাজিক মুল্যবোধের নিরপেক্ষ (অবজেক্টিভ) কোনো মাপকাঠি নাই।
আমি তাদেরকে কিছু বলার ধৃষ্টতা দেখাবো না, যারা নিজেদের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাসী যে তারা পৃথিবীতে অর্থপূর্ণ অবদান রাখছেন, কিন্তু বাস্তবে তা নন।
এই যে আমাদের সমাজ মেধাবী কবি-সংগীতশিল্পীদের চাহিদা খুবই অল্প উৎপাদন করে, অথচ কর্পোরেট আইন বিশেষজ্ঞের আপাত অসীম চাহিদা তৈরি করে, এর অর্থ কী?
(উত্তর: যদি ১% লোক ডিসপোজাবল সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে, যারে আমরা ‘বাজার’ বলি, – নিয়ন্ত্রণ কর্তারা যারে দরকারী বা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে ‘বাজার’-এ তারই প্রতিফলন ঘটে, অন্য কারও নয়।)
তাছাড়া, এইটা আরও দেখায় যে এই চাকরিগুলোর অধিকাংশ লোক এ বিষয়ে সচেতন।
সত্যি বলতে, আমি এমন একজন কর্পোরেট আইনজীবীও দেখি নাই যে যারা তাদের চাকরিরে বুলশিট মনে করে না।
উপরের সমস্ত ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বেতনভুক পেশাদারীর এমন বিশাল শ্রেণি আছে, যাদেরকে পার্টিতে দেখা হলে যদি আপনি স্বীকার করে বসেন যে আপনি এমন কিছু করেন যাকে ইন্টারেস্টিং বলে বিবেচনা করা যায় (উদাহরণস্বরূপ, একজন নৃবিজ্ঞানী), তারা এমনকি তাদের কাজকর্মের ধরণ নিয়ে আলাপেও যেতে চাইবে না। তাদেরকে ড্রিংক ধরায়ে দেন, দেখবেন তাদের চাকরির অর্থহীনতা ও অসারতা নিয়ে লম্বা বক্তৃতা আরম্ভ করবে।
এইটা এক গভীরতর মেন্টাল ভায়োলেন্স।
ক্যামনে কোনো ব্যক্তির পক্ষে শ্রমের মর্যাদার কথা বলা সম্ভব যেইখানে গোপনে সে বিশ্বাস করে তার চাকরিটার দরকারই নাই?
ক্ষোভ ও অসন্তষ্টির বোধ না তৈরি কইরা থাকে ক্যামনে?
তবু আমাদের সমাজের এমনই অদ্ভুত প্রতিভা যে শাসকেরা একটা রাস্তা ঠিকই বের করছে, মাছ-ভাজায় দায়িত্বরত লোকগুলোর মতো, যা নিশ্চিত করে ক্রোধটা তাদের যেন প্রতি লালন করা হয়, যারা প্রকৃতপক্ষে কাজের কাজ করতেছে।
যেমন, আমাদের সমাজের সাধারণ নিয়ম হইলো, নিশ্চিতভাবে যাদের কাজকর্ম অন্য লোকজনের উপকারে আসে, তাদেরকেই সবচে কম পারিশ্রমিক দেওয়া।
আবারও, নিরপেক্ষ মানদণ্ড খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু সহজ একটা উপায় হইতে পারে এই প্রশ্ন করা যে, এই কম পারিশ্রমিক পাওয়া শ্রেণিটা উধাও হয়ে গেলে কী ঘটবে?
এইটা পুরাপুরি ক্লিয়ার না, সমস্ত লবিস্ট, প্রাইভেট ইকুয়িটি সিইও, পিআর গবেষক, এ্যাকচুয়ারিস, টেলিমার্কেটারস, কিংবা লিগাল উপদেষ্টারা উধাও হয়ে গেলে মানবতার কতটা ক্ষতি হবে।
(অনেকের সন্দেহ বরং ব্যাপক উন্নতিই হবে)। তবু, হাতে গোনা কয়েকটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে, নিয়মটা আশ্চর্যরকম নির্ভুল।
ডানপন্থী পপুলিজমের গোপন শক্তির একটা জায়গা এইটা।
ব্যাপারটা বোঝা যায় যখন ট্যাবলয়েডগুলা টিউব-ওয়ার্কারদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ছড়ায় এই বলে যে, এরা ‘চুক্তি নিয়ে গণ্ডগোলের’ সময় লন্ডনকে অচল করে দিতেছে। টিউব-ওয়ার্কাররা লন্ডনকে অচল করে দিতে পারে ঠিক এই ঘটনাই প্রমাণ করে তাদের কাজ আসলেই দরকারী, অথচ অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এই ব্যাপারটাই মানুষকে বিরক্ত করে।
যুক্তরাষ্ট্রে এইটা আরও পরিষ্কার যেইখানে, স্বাভাবিকভাবেই মোটা পারিশ্রমিক ও সুযোগ-সুবিধার ধুয়ো তুইলা, স্কুলশিক্ষক বা অটো ড্রাইভারদের দিকে এই ক্রোধকে চালনা করতে রিপাবলিকানরা লক্ষনীয়ভাবে সফল, (আর লক্ষনীয়, স্কুল প্রশাসক কিংবা অটো ইন্ডাসট্রির প্রশাসকদের বিরুদ্ধে কিন্তু নয়, যারা প্রকৃতপক্ষে সমস্যার মূল। ) এ যেন ঠারে ঠারে তাদের বলা হইতেছে, ‘কিন্তু আপনাকে তো বাচ্চাদের পড়াইতে হবে! অথবা গাড়ি নির্মান করতে হবে। চাকরি করা লাগবে আপনার! তার উপর আবার মিডলক্লাস পেনশন আর হেলথকেয়ার প্রত্যাশার করার সাহস আপনে করেন ক্যামনে?’
কাউরে কর্মবিশ্বের একটা নক্সা যদি করতে হইতো, ফাইনান্স ক্যাপিটালের ক্ষমতার সাথে যার খাপে খাপ হয়, এইটা বোঝা কঠিন, যে এর চেয়ে ভালো জব তাদের পক্ষে বানানো কীভাবে সম্ভব হইতো?
আসলে উৎপাদনশীল কর্মীদের প্রতিনিয়ত নিংড়ানো ও শোষন করা হয়।
বাকিদের দুইভাবে বিভক্ত করা হইছে: একভাগে সন্ত্রস্থ স্তরের – বিশ্বজুড়ে অভিশপ্ত – কর্মহীন আর আরেক ভাগে মূলত কিছু না করেই বেতন পায়, নির্ধারিত বিভিন্ন পদে আসীন যারা নিজেদেরকে শনাক্ত করে শাসকশ্রেণির মতাদর্শ ও কান্ডজ্ঞানের সাথে (ম্যানেজার, প্রশাসক ইত্যাদি) – ও স্পেশালি অর্থনৈতিক অবতারদের সাথে এবং একই সাথে তীব্র ক্ষোভ পোষন করে তাদের প্রতি যাদের কাজের পরিষ্কার ও অবশ্যস্বীকার্য সামাজিক মূল্য আছে।
ক্লিয়ারলি, এই ব্যবস্থার নকশা কখনোই সচেতনভাবে করা হয় নাই। প্রায় এক শতাব্দীর ট্রায়াল এন্ড এররের ভেতর দিয়া আবির্ভূত হইছে। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা সত্ত্বেও আমরা যে দৈনিক ৩-৪ ঘন্টার কাজ করতেছি না, এইটাই তার একমাত্র ব্যাখ্যা।