অনুবাদ: পার্থ প্রতীম দাস
লেখাটি ১৯৭০ সালে প্রকাশিত দানিয়েল গ্যারাঁর (Daniel Guérin ) L’Anarchisme : de la doctrine à l’action বইয়ের ইংরেজি সংস্করণ Anarchism: From Theory to Practice-এর ভূমিকা হিসেবে লিখেছিলেন চমস্কি। পরবর্তীতে লেখাটি Chomsky On Anarchism গ্রন্থে সংকলিত হয়। লেখাটিতে গ্যারাঁর মুক্তিপরায়ণ সামজতন্ত্রের ধারণা ও নৈরাজ্যবাদ সম্পর্কিত চমস্কির নিজস্ব ধারণা ফুটে উঠেছে। – সম্পাদক
১৮৯০–এর দশকে, নৈরাজ্যবাদের প্রতি সংবেদনশীল এক ফরাসি লেখক লিখেছিলেন, ‘নৈরাজ্যবাদের কাঁধটা বেশ লম্বা–চওড়া, টিস্যু পেপারের মতো এটা সবকিছু শুষে নিতে পারে’। এমনকি তাদের কর্মকাণ্ডও, যারা নৈরাজ্যবাদের চিরশত্রুদের চেয়ে কিছু কম করেননি। চিন্তা–তৎপরতার অনেক অনেক ধরন আছে, যেগুলোকে “নৈরাজ্যবাদী” বলে ডাকা যায়। একে–অপরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এসব ঝোঁক–প্রবণতাকে একটা সাধারণ তত্ত্ব বা মতাদর্শের মধ্যে আঁটানোর চেষ্টা করতে গেলে হতাশই হতে হয়। যদি আমরা জীবন্ত এবং ক্রমাগত বিবর্তিত হতে থাকা এই মুক্তিমুখীন চিন্তাধারার ইতিহাস থেকে কিছু অংশও তুলে আনতে যাই, যেমনটা দানিয়েল গ্যারাঁর অ্যানার্কিজম বইতে করেছেন, তখনো এর মতাদর্শগুলোকে সমাজ ও সামাজিক বদলের জন্য একটা নির্দিষ্ট–চূড়ান্ত তত্ত্ব আকারে হাজির করা কঠিন হবে। নৈরাজ্যবাদী ইতিহাসবিদ রুডলফ রকার (যিনি তুলে ধরেছেন, কীভাবে নৈরাজ্যবাদী চিন্তাধারা এগিয়েছে অ্যানার্কো–সিন্ডিক্যালিজমের দিকে) বিষয়টা চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি লিখেছেন—
“নৈরাজ্যবাদ অনড়, বদ্ধ কোনো সামাজিক ব্যবস্থা না। এটা বরং মানুষের ঐতিহাসিক বিকাশের একটা সুস্পষ্ট ধারাকে ইঙ্গিত করে। বুদ্ধিজীবীদের মদদপুষ্ট সব ধরনের আমলাতান্ত্রিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপরীতে এটা লড়াই করে সমাজের প্রতিটা শক্তি, প্রতিটা ব্যক্তির মুক্ত–অবাধ বিকাশের জন্য। এমনকি স্বাধীনতাও একটা আপেক্ষিক ব্যাপার মাত্র। এটাও কোনো চূড়ান্ত ধারণা না। স্বাধীনতার ধারণাও ক্রমাগত আরও বৃহৎ পরিসরে চিন্তা করা হচ্ছে, বহুমুখী পথে। নৈরাজ্যবাদীদের জন্য, স্বাধীনতা কোনো বিমূর্ত দার্শনিক ধারণা নয়। বরং প্রকৃতি প্রতিটা মানুষকে যে পরিমাণ ক্ষমতা–মেধা–মনন দিয়ে গড়ে তুলেছে তার পূর্ণ বিকাশ ও সেগুলোকে সামাজিক সম্পত্তিতে পরিণত করতে পারার সুনির্দিষ্ট সম্ভাবনার নামই স্বাধীনতা। মানুষের এই স্বাভাবিক বিকাশ ধর্মতন্ত্র বা রাজনৈতিক তত্ত্বাবধানের প্রভাব থেকে যত দূরে থাকতে পারবে, ততই সে আরও সুদক্ষ ও সুগঠিত হয়ে উঠবে। যে সমাজে সে বেড়ে উঠেছে, হয়ে উঠবে সেই সমাজের চিন্তাশীল সংস্কৃতির অগ্রগতির পরিচায়ক।”
অনেকের মনেই হয়তো এই প্রশ্ন আসতে পারে যে, ‘মানব বিকাশের ঐতিহাসিক ধারা’ পর্যালোচনা করে কী হবে, যদি সেটা সমাজ বদলের জন্য একটা নির্দিষ্ট ও বিস্তারিত তত্ত্ব হাজির করতে না পারে? শেষপর্যন্ত অনেকেই নৈরাজ্যবাদের ধারণাকে খারিজ করে দেন ইউটোপীয়, বায়বীয়, আদিম অথবা বর্তমান সময়ের জটিল সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খায় না— এই বিবেচনায়। কেউ হয়তো আবার কিছুটা ভিন্নভাবে যুক্তি দিতে পারেন যে, ইতিহাসের প্রতিটা পর্যায়েই আমাদের প্রধান বিবেচ্য থাকে কর্তৃত্ব আর নিপীড়নের কাঠামোগুলোকে উচ্ছেদ করা, যেগুলোর বৈধতা টিকে ছিল অন্য আরেকটা পর্যায়ের সামাজিক নিরাপত্তা, জীবনধারণ বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর ভিত্তি করে। কিন্তু এখন সেগুলো বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য লাঘব করার চেয়ে বরং সেটা বাড়িয়ে তুলতেই অবদান রাখছে। ঘটনা যদি এরকমই হয়, তাহলে তো বর্তমান বা ভবিষ্যতের সামাজিক পরিবর্তনের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো তন্ত্রশাস্ত্র নেই। সামাজিক পরিবর্তনের ধারা কেমন হবে সেটা স্থির করে দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট এবং অপরিবর্তনীয় কিছু থাকার দরকারও নেই। নিশ্চিতভাবেই, মানুষের স্বভাব–প্রকৃতি বা সম্ভাব্য সামাজিক কাঠামো নিয়ে আমাদের বোঝাপড়া খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। অনেক সুদূর–বিস্তৃত মতবাদকে তাই সন্দেহ–সংশয়ের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া দরকার। যেমন, যখন আমরা শুনি যে, ‘মনুষ্য প্রকৃতি’ বা ‘দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা’ বা ‘আধুনিক জীবনের জটিলতা’র জন্য এই ধরনের বা ঐ ধরনের নিপীড়ন কাঠামো আর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন দরকার, তখন খুবই সংশয়ের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার এই ধরনের চিন্তাধারাকে।
আমাদের চিন্তার দৌড় যতদূর আছে তাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ে এরকম উপলব্ধিতে পৌঁছানোই যেতে পারে যে, একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারিত যথোচিত কাজ করার ঝোঁকই মানুষের অগ্রগতির ইতিহাসে দেখা যায়। রকারের জন্য ‘আমাদের সময়ের জন্য যে সমস্যাটা নির্ধারিত হয়েছে তা হলো: মনুষ্য প্রজাতিকে অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক–সামাজিক দাসত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা।’ আর সেটা করার জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল বা সংসদীয় পন্থা অবলম্বন করাটা কোনো পদ্ধতি হতে পারে না। বরং ‘একেবারে নিচের সারির মানুষদের থেকে পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটাই সাম্যবাদের চেতনায় গড়তে হবে।’
কিন্তু সমাজের উৎপাদকরাই (কৃষক–শ্রমিক) কাজটি করার জন্য সবচেয়ে উপযোগী। কারণ তারাই সমাজের একমাত্র মূল্য–উৎপাদনকারী (Value-creating) উপাদান, যার মধ্য দিয়ে নতুন ভবিষ্যৎ গড়ে উঠতে পারে। অর্থনৈতিক শোষণের জন্য তৈরি করা শ্রম–শৃঙ্খল ভাঙার কাজটা তাদেরই করতে হবে। সমাজকে সবধরনের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রথা–প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্ত করা ও নতুন একটা সমাজের পথ খুলে দেওয়ার কাজটা তাদেরই করতে হবে। যে নতুন সমাজ গড়ে উঠবে মুক্ত নারী–পুরুষের গড়া মুক্ত গোষ্ঠীগুলোর ঐক্যবদ্ধতায়। যে সমাজের ভিত্তি হবে সহযোগিতামূলক শ্রম ও পুরো গোষ্ঠীর কল্যাণ বিবেচনা করার জন্য একটা সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা। এই মহান রূপকল্প সামনে রেখে শহর ও গ্রামের কঠোর পরিশ্রমী মানুষগুলোকে প্রস্তুত করা ও তাদেরকে আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ করে তোলাই আধুনিক অ্যানার্কো–সিন্ডিক্যালিজমের লক্ষ্য। এটুকুতেই পুরো উদ্দেশ্যটা বলা হয়েছে।
একজন সাম্যবাদী হিসেবে, রকার এটাই নিশ্চিত বলে ধরে নিচ্ছেন যে, ‘শ্রমিকদের সত্যিকারের, চূড়ান্ত, পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা একটাই মাত্র শর্তের ভিত্তিতে সম্ভব হতে পারে। আর সেটা হলো পুঁজির আত্মীকরণ। সবধরনের কাঁচামাল, ভূমি থেকে শুরু করে সব ধরনের উৎপাদনের উপায় শ্রমিকদের দখলে থাকতে হবে।’ একজন অ্যানার্কো–সিন্ডিক্যালিস্ট হিসেবে, তিনি আরও যোগ করেছেন, বিপ্লব পূর্ববর্তী পর্যায়ে শ্রমিকদের সংগঠনগুলো শুধু ধারণাই তৈরি করবে না, ভবিষ্যতের রূপকল্প অনুযায়ী গড়েও উঠবে। ভবিষ্যতের সমাজ কাঠামো কেমন হবে সেই ভাবনার প্রতিমূর্তি তারা নিজেদের মধ্যেই নির্মাণ করবে— তিনি এমন একটা সামাজিক বিপ্লবের আশা করছেন যেটা রাষ্ট্রের সকল কলকব্জা ভেঙে ফেলবে। সেই সঙ্গে দখলচ্যুত করবে দখলদারদের। তিনি বলছেন, ‘আমরা সরকারের জায়গায় বসাবো শিল্পকারখানার সংগঠন।’
অ্যানার্কো–সিন্ডিক্যালিস্টরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, একটা সাম্যবাদী অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা কখনোই সরকারি ডিক্রি বা সংসদীয় আইন–বিধি দিয়ে তৈরি করা যাবে না। এটা করার একমাত্র পথ: উৎপাদনের প্রতিটা পর্যায়ে নিয়োজিত শ্রমিকদের সর্বাত্মক সংহতি ও সহযোগিতা। যেটার জন্য কারখানার সকল ব্যবস্থাপনার উপরে শ্রমিকদের সরাসরি দখল থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট শিল্পের ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ, শাখাগুলো একটা সাধারণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অংশ নেবে স্বাধীন সদস্য হিসেবে। এবং পুরো সমাজের স্বার্থ বিবেচনা করে উৎপাদন ও বিতরণ করবে সুশৃঙ্খলভাবে। যার ভিত্তি হবে মুক্তভাবে করা পারস্পরিক চুক্তি।
[Chomsky.info version] রকার এটা এমন একটা সময়ে বসে লিখছিলেন যখন এই ধারণাগুলো নাটকীয়ভাবে অনুশীলন করে দেখা হচ্ছিল স্প্যানিশ বিপ্লবে। [১৯৩৬ সালে] স্পেনের এই বিপ্লবের আগ দিয়েই অ্যানার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট অর্থনীতিবিদ দিয়েগো আবাদ দে সান্তিয়ান লিখেছেন—
সামাজিক রূপান্তরের সমস্যার মুখোমুখি হয়ে, বিপ্লব কখনোই রাষ্ট্রকে একটা মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করতে পারে না। তাকে বরং উৎপাদকদের সংগঠনের উপরেই নির্ভর করতে হবে। আমরা এই নিয়মটাই অনুসরণ করেছি। আর দেখেছি যে নতুন একটা শৃঙ্খলা গড়ে তোলার জন্য সংগঠিত শ্রমশক্তির উপর আলাদা করে কোনো ক্ষমতার দরকার নেই। ব্যক্তি মালিকানা বিলুপ্ত ও সব ধরনের বিশেষ সুযোগ–সুবিধা প্রাপ্তির পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অর্থনৈতিক একটা সংগঠনে রাষ্ট্রের কী প্রয়োজন থাকতে পারে, সেটা কেউ আমাদের দেখিয়ে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব। রাষ্ট্রকে নিরুদ্ধ করার কাজটা কখনোই ধীরগতির একটা প্রক্রিয়া হতে পারে না। বিপ্লবের প্রধান কাজই হবে রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা। একদিকে হয় বিপ্লবের মাধ্যমে সামাজিক সব সম্পত্তি উৎপাদকদের হাতে দিতে হবে এবং তখন তারা নিজেদের সংগঠিত করে পুরো সমাজের জন্য উৎপাদন করবে আর সেখানে রাষ্ট্রের কিছুই করার থাকবে না; নয়তো অন্যদিকে বিপ্লব উৎপাদকদের সামজিক সম্পত্তি দেবে না। সেক্ষেত্রে বিপ্লবটা মিথ্যা হয়ে যাবে আর রাষ্ট্র বলবৎ থাকবে।
আমাদের অর্থনৈতিক ফেডারেল কাউন্সিল কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়। বরং এটা একটা অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। যেটা সে অর্জন করে একেবারে নিচ থেকে। আর পরিচালিত হয় আঞ্চলিক ও জাতীয় সম্মেলনে গ্রহণ করা নীতিমালার মাধ্যমে। এটা একটা সংযোগ সংস্থা মাত্র। আর কিছুই না। [Chomsky.info version]
এই রকম ধারণার সঙ্গে একমত না হতে পেরে ১৮৮৩ সালে একটা চিঠিতে অ্যাঙ্গেলস লিখেছিলেন:
নৈরাজ্যবাদীরা ব্যাপারটা তুলে ধরে উল্টাভাবে। তারা ঘোষণা দিয়েছে যে, সর্বহারার বিপ্লব অবশ্যই শুরু হতে হবে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে বিদায় করে দিয়ে। …কিন্তু এইরকম একটা মুহূর্তে রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেওয়া মানে বিজয়ী সর্বহারাদের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থাটা ধ্বংস করে দেওয়া যেটার মাধ্যমে তারা নিজেদের সদ্য প্রাপ্ত ক্ষমতাটা প্রয়োগ করতে পারে। পুঁজিবাদী প্রতিদ্বন্দ্বীদের আটকে রাখতে পারে, এবং সমাজের অর্থনৈতিক বিপ্লবটা সম্পন্ন করতে পারে, যেটা ছাড়া এই পুরো বিজয়টা পরিণত হবে নতুন পরাজয়ে আর যার শেষটা হবে শ্রমিকদের গণহত্যার মধ্য দিয়ে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল প্যারি কমিউনের পর।
এর বিপরীতে, নৈরাজ্যবাদীরা— বিশেষ করে বাকুনিন— ক্রমাগত সবাইকে সাবধান করছিলেন ‘লাল আমলাতন্ত্রের’ হুমকির ব্যাপারে, যেটা তাঁর ভাষায় প্রমাণিত হতে পারে “আমাদের শতকে সৃষ্ট সবচেয়ে গর্হিত আর ভয়াবহ মিথ্যা হিসেবে।” অ্যানার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট ফার্নান্দ প্যালাতিয়ারের জিজ্ঞাসা ছিল: “অন্তবর্তীকালীন রাষ্ট্রটাকেও কি একটা কালেকটিভিস্ট কারাগারই হতে হবে? এটা কি মুক্ত সংগঠনগুলো নিয়ে গঠিত হতে পারে না? যার কাজকর্ম নির্দিষ্টভাবে উৎপাদন আর বন্টনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? উবে যাবে রাষ্ট্র–রাজনীতির সব প্রতিষ্ঠানগুলো?”
আমি এই প্রশ্নের উত্তর জানি, এমন ভান করব না। কিন্তু এটা মনে হয় পরিষ্কার যে, কোনো না কোনোভাবে এর একটা ইতিবাচক উত্তর পাওয়া না গেলে, বামপন্থীদের মানবতাবাদী আদর্শগুলো ধারণ করতে পারবে, এমন সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আশা খুব বেশি নাই। মার্টিন বুবার খুব অল্প কথায় সমস্যাটা খুব দারুণভাবে শনাক্ত করেন, যখন তিনি লেখেন যে, “One cannot in the nature of things expect a little tree that has been turned into a club to put forth leaves.” রাষ্ট্রক্ষমতা দখল নাকি ধ্বংস— এই প্রশ্নেই মার্ক্সের সঙ্গে তাঁর মৌলিক বিভাজন তৈরি হয়েছিল বলে মনে করতেন বাকুনিন। কোনো না কোনোভাবে, এই প্রশ্নটা তখন থেকেই বারবার উঠেছিল। ‘মুক্তিমুখীন’ সমাজতন্ত্রীদের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল ‘কর্তৃত্বপরায়ন’ সমাজতন্ত্রীদের।
[Chomsky.info version] লাল আমলাতন্ত্র সম্পর্কে বাকুনিনের সাবধানবাণী এবং স্টালিনের একনায়কতন্ত্রের অধীনে সেটার চূড়ান্ত পরিণতি দেখার পরও, এক শতাব্দী আগের সেই বিতর্কগুলোকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে একটা বিশাল গলদ নিশ্চিতভাবেই থেকে যাবে যদি আমরা সাম্প্রতিক সময়ের সামাজিক আন্দোলনগুলোকেও তাদের সেই ঐতিহাসিক উদ্ভবের সময়ের ধারণার সঙ্গেই মেলাতে যাই। বিশেষত, বলশেভিকবাদকে ‘মার্ক্সবাদের অনুশীলন’ হিসেবে বিবেচনা করাটাও এক ধরনের বিকৃতি। বরং বলশেভিকবাদের বামপন্থী সমালোচনা, যেটা রাশিয়ান বিপ্লবকে ঘিরে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ বিচারের মাধ্যমে করা হয়, সেটা অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট।
বলশেভিক বিরোধী বামপন্থী শ্রম আন্দোলনগুলো লেনিনপন্থীদের বিরোধিতা করেছিল কারণ তারা রাশিয়ার মানুষের এই অভ্যুত্থানটাকে শুধুমাত্র সর্বহারাদের স্বার্থেই কাজে লাগানোর পথে বেশিদূর যায়নি। তারা বন্দী হয়ে পড়েছিল তাদের নিজেরই গড়া পরিবেশে। আর আন্তর্জাতিক একটা প্রগতিশীল আন্দোলনকে ব্যবহার করেছিল শুধুই রাশিয়ার স্বার্থে। খুব দ্রুতই সেটা বলভেশিক পার্টি–রাষ্ট্রের স্বার্থের সমার্থকে পরিণত হয়। রাশিয়ান বিপ্লবের ‘বুর্জোয়া’ চরিত্রগুলো খুঁজে পাওয়া যেতে থাকল বলভেশিকবাদের মধ্যেই। লেনিনবাদকে ধরা যেতে পারে আন্তর্জাতিক সোশ্যাল–ডেমোক্রেসির অংশ হিসেবে। দুইটার মধ্যে পার্থক্য শুধু ছিল কৌশলগত ইস্যুতে। [Chomsky.info version]
কেউ যদি নৈরাজ্যবাদী ঐতিহ্যের মধ্যে একটা প্রধান ধারণা সম্পর্কে জানতে চান, তাহলে আমার মতে সেটা হতে পারে বাকুনিনের এই লেখা থেকে। প্যারি কমিউন নিয়ে লেখার সময় তিনি নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন এভাবে:
আমি স্বাধীনতার এক অন্ধ সমর্থক। এটাকেই আমি বিবেচনা করি একমাত্র শর্ত হিসেবে যার অধীনে মানুষের বুদ্ধিমত্তা, মর্যাদা, আনন্দ বিকশিত ও বৃদ্ধি পেতে পারে। সেটা রাষ্ট্রের নির্ধারণ করা ও মেপে দেওয়া আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা না। সেই স্বাধীনতা মিথ্যা। বাস্তবে সেটা কিছু মানুষের সুযোগ–সুবিধা বৃদ্ধি ও সমাজের বাকি মানুষের দাসত্বের বেশি কিছুই না। আমি যে স্বাধীনতার কথা বলছি সেটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক, অহংবাদী, জরাজীর্ণ, কল্পিত স্বাধীনতাও নয়, যেটার উচ্চ প্রশংসা করেছেন জঁ জ্যাক রুশো ও অন্যান্য বুর্জোয়া উদারনীতিবাদের সমর্থকেরা। এটাও সব মানুষের সম্ভাব্য অধিকারগুলো প্রদানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরই প্রতিনিধিত্ব করে। রাষ্ট্র সবার অধিকার নির্দিষ্ট করে দেয়। এই ধারণাটাও অনিবার্যভাবে অধিকার হরণের দিকে নিয়ে যায়। শেষপর্যন্ত সেটা শূন্যের কোটায় এসে ঠেকে। না, আমি সেই স্বাধীনতার কথা বলছি যেটা সত্যিই তার নামের সঙ্গে মানায়। যেটার মাধ্যমে প্রতিটা মানুষ তার ভেতরে সুপ্ত বস্তুগত, বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক ক্ষমতার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে। সেই স্বাধীনতার কথা বলছি যেটা মানুষের প্রকৃতি–নির্ধারিত বিধিনিষেধ ছাড়া অন্য কোনো নিষেধাজ্ঞার স্বীকৃতি দেয় না। এগুলোকে ঠিক বিধিনিষেধ হিসেবেও বিবেচনা করা যায় না কারণ এই নিয়মনীতিগুলো কারও উপরে বাইরে থেকে আইন জারি করে চাপিয়ে দেওয়া হয় না। এগুলো মানুষের স্বভাবজাত, জন্মগত। এগুলোই আমাদের বস্তুজগত, বুদ্ধিবৃত্তি ও নৈতিকতার মূল ভিত্তি। এগুলো আমাদের সীমাবদ্ধ করে না। বরং এগুলোই স্বাধীনতার সত্যিকারের ও তাৎক্ষণিক পূর্বশর্ত।
এই ধ্যানধারণাগুলো গড়ে উঠেছে ইউরোপিয়ান আলোকায়নের যুগ থেকে। এগুলোর মূল খুঁজে পাওয়া যাবে রুশোর ডিসকোর্স অন ইনইকুয়ালিটি, হ্যামবোল্টের লিমিটস অব স্টেট অ্যাকশন, কান্টের নির্বন্ধে, ফরাসী বিপ্লবের পক্ষে তাঁর লেখাপত্রে। তাঁরা বলছিলেন যে, স্বাধীনতার পরিপক্কতা অর্জনের একমাত্র পূর্বশর্ত হতে হবে স্বাধীনতা। পরিপক্কতা অর্জন করার পরে সেটা উপহার দেওয়া হবে— বিষয়টা এমন না। শিল্প পুঁজিবাদ বিকাশের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠছিল একটা নতুন ধরণের অন্যায্য ব্যবস্থা, যেমনটা আগে কখনোই দেখা যায়নি। সেই সময়ে মুক্তিমুখিন সমাজতন্ত্রীরাই আলোকায়নের প্রগতিশীল মানবতাবাদী চিন্তাগুলো সংরক্ষণ এবং বিস্তৃত করেছিল। অন্যদিকে ধ্রুপদী উদারনৈতিক আদর্শগুলোকে বিকৃত করে একটা মতাদর্শ দাঁড় করানো হয়েছিল উদীয়মান পুঁজিবাদী সামাজিক ব্যবস্থার বৈধতা দেওয়ার জন্য।
কিন্তু আদতে, যে অনুমানগুলোর উপর ভিত্তি করে ধ্রুপদী উদারনীতিবাদ সামাজিক জীবনে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছিল, সেই একই অনুমান থেকে পুঁজিবাদী সামাজিক সম্পর্কও অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়েছিল। [Guerin Book Version] যেমন হ্যামবোল্ট রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করেছিলেন কারণ রাষ্ট্র “মানুষকে যন্ত্রে পরিণত করতে চায়, যে যুক্তিহীনভাবে রাষ্ট্রের মর্জিমাফিক চলবে। উপেক্ষা করা হয় ব্যক্তির লক্ষ্য–উদ্দেশ্যকে।” তিনি আরও যুক্তি দেন, “যে জিনিসটা ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা থেকে আসছে না… যেটা তার অস্তিত্বের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে না, বরং নিজের স্বভাব–চরিত্রের সঙ্গে অচেনা হয়ে থাকছে; সেই জিনিসটা সে কখনো ভালোভাবে করতে পারবে না, সত্যিকারের মনুষ্য–শক্তি সেখানে প্রযুক্ত হবে না। সর্বোচ্চ সেখানে কিছু কারিগরী নির্ভুলতা পাওয়া যেতে পারে।” স্বাধীনতা বজায় থাকলে, “সব কৃষক ও কারিগরই শিল্পী হয়ে উঠতে পারেন; মানে যে মানুষ নিজের জন্যই নিজের কাজটাকে ভালোবাসে, তারা ক্রমাগত সেটার বিকাশ ঘটায়, নিজেদের বুদ্ধিমত্তা ও উদ্ভাবনী দক্ষতা দিয়ে। এভাবেই তারা নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করে, মর্যাদা অর্জন করে এবং আনন্দময় জীবন যাপন করে।” মানুষ যখন শুধু বাহ্যিক চাহিদা আর কর্তৃত্বের সামনে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তখন “আমরা হয়তো তার কাজটাকে প্রশংসার চোখে দেখতে পারি কিন্তু কিন্তু মনে মনে তাকে অপছন্দই করি।” হ্যামবোল্ট আবার কোনো প্রাচীনপন্থী ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদীও নন। তিনি তার প্রধান চিন্তাধারাকে সারসংক্ষেপ করেছেন এভাবে: “মানুষ যখন সমাজের সব শৃঙ্খল ভেঙে ফেলবে, তখন তারা যত বেশি সম্ভব নতুন সামাজিক বন্ধন তৈরিরও উদ্যোগ নেবে। বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যক্তি নিজেকে বিকশিত করতে পারে না, ঠিক যেমনটা পারে না শৃঙ্খলিত কোনো মানুষ।” [Guerin Book Version] উদারনৈতিক ধ্যানধারণার এই ধ্রুপদী লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৯২ সালে এবং এটি সম্ভবত মিলকে অনুপ্রাণিত করেছিল। এটির মূল নির্যাস গভীরভাবে পুঁজিবাদবিরোধী ছিল। যদিও তা ছিল অপরিপক্ক। পরে এই ধ্যানধারণাগুলোকে নিশ্চিতভাবেই অনেক কেটেছেঁটে, চেনা যায় না এমন দশা বানিয়ে পরিণত করা হয়েছিল শিল্প পুঁজিবাদের মতাদর্শ হিসেবে।
সামাজিক নিপীড়নের শেকলগুলো প্রতিস্থাপিত হবে মুক্ত সামাজিক বন্ধন আর মুক্তশ্রমের চুক্তি দিয়ে, এমন একটা সমাজের রূপকল্প আমাদের নিয়ে যায় তরুণ মার্ক্সের কাছে, যিনি এইরকম ধারণার প্রতিচ্ছবি দেখিয়েছেন ‘শ্রমের বিচ্ছিন্নতা’ সংক্রান্ত আলোচনায়। যেখানে তিনি বলছেন যে, যখন মানুষের উপর কোনো কাজ বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়, এবং সেটা যদি অনিচ্ছা নিয়ে করতে হয়… তাহলে সে তার কাজের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণতা পায় না, নিজেই নিজেকে প্রত্যাখ্যান করে… আর একসময় হয়ে পড়ে শারিরীকভাবে বিপর্যস্ত আর মানসিকভাবে টালমাটাল। বিচ্ছিন্ন শ্রম কিছু শ্রমিককে বর্বরোচিত পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করে এবং অন্যদের যন্ত্রে পরিণত করে। এইভাবে প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে মানুষ যে ‘মুক্ত সচেতন কর্মকাণ্ড’ আর ‘সৃষ্টিশীল জীবন’–এর আকাঙ্ক্ষা পেয়েছে, সেটা থেকে বঞ্চিত হয়। একইভাবে, মার্ক্স নতুন এক ধরনের মানুষ কল্পনা করেছেন যারা সতীর্থ মানুষদের সহযোগিতা কামনা করে… [শ্রমিকদের অ্যাসোসিয়েশনগুলো হয়ে গেছে] “ভবিষ্যতের মনুষ্য সম্পর্কগুলো কেমন হবে সেটা সামাজিক পটভূমিতে তুলে ধরার একটা সত্যিকারের গঠনমূলক প্রচেষ্টা”। এটা সত্যি যে ধ্রুপদী মুক্তিমুখীন চিন্তাধারা সামাজিক জীবনে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছে। এটা তারা করেছে কারণ স্বাধীনতা, বৈচিত্র্য, মুক্ত সংগঠন; মানুষের এই স্বভাবজাত আকাক্সক্ষাগুলোর বিষয়েও তাদের একটা গাঢ় অনুমান ছিল। এই একই অনুমান অনুসারে, উৎপাদনের জন্য পুঁজিবাদী সম্পর্ক, মজুরিভিত্তিক শ্রম, প্রতিযোগিতা, ‘আধিপত্যশীল ব্যক্তিসাতন্ত্রবাদের’ মতাদর্শ— সবকিছুই মৌলিকভাবে মানুষ–বিরোধী বলে বিবেচনা করতে হবে। মুক্তিমুখীন সমাজতন্ত্রই যথাযথভাবে আলোকায়নের উদারবাদী আদর্শগুলোর উত্তরাধিকার বহন করে এনেছে।
রুডল্ফ রকার আধুনিক নৈরাজ্যবাদকে বর্ণনা করেছেন “দুইটা মহান চিন্তা–তৎপরতার মিলনস্থল হিসেবে যেটা ফরাসী বিপ্লবের সময় ও তারপর থেকে ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে একটা বৈশিষ্ট্যগত প্রকাশ খুঁজে পেয়েছে: সাম্যবাদ আর উদারনীতিবাদ।” ধ্রুপদী উদারনৈতিক আদর্শগুলো, তাঁর মতে, ধ্বংসের মুখে পড়েছিল পুঁজিবাদী অর্ধনৈতিক কাঠামোর কঠিন বাস্তবতার কারণে। নৈরাজ্যবাদ খুব জরুরিভাবেই পুঁজিবাদবিরোধী। এটা একজনের দ্বারা আরেকজন মানুষ শোষিত হওয়ার বিরোধিতা করে। সেই সঙ্গে নৈরাজ্যবাদ একজনের ওপর আরেকজনের কর্তৃত্বেরও বিরোধিতা করে। এটা যুক্তি দেয় যে, “সাম্যবাদ হতে হবে মুক্ত অথবা এটা কখনোই সাম্যবাদ হবে না।” এই দৃষ্টিকোণ থেকে, নৈরাজ্যবাদকে বিবেচনা করা যেতে পারে সাম্যবাদের মুক্তিমুখীন ধারা হিসেবে। এই ধরনের চেতনা থেকেই দানিয়েল গ্যারাঁ নৈরাজ্যবাদের পাঠ শুরু করেছেন। এই বইয়ে, অন্যান্য আরও অনেক লেখায়।
গ্যারাঁ এখানে অ্যাডল্ফ ফিশারকে উদ্ধৃত করেছেন। ফিশার বলেছেন, “প্রতিটা নৈরাজ্যবাদীই একজন সাম্যবাদী। কিন্তু সব সাম্যবাদীই হয়তো নৈরাজ্যবাদী নন।” একইভাবে বাকুনিন, তাঁর ১৮৬৫ সালের নৈরাজ্যবাদের ইশতেহার-এ, আন্তর্জাতিক বিপ্লবী ভ্রাতৃসঙ্ঘের রূপকল্প উপস্থাপনের সময় একটা নীতি ঠিক করেছিলেন যে, প্রতিটা সদস্যকে অবশ্যই শুরু করতে হবে সাম্যবাদী হয়ে।
একজন নৈরাজ্যবাদী অবশ্যই উৎপাদনের উপায়সমূহের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা ও মজুরি দাসত্বের বিরোধিতা করবে। ব্যক্তিগত মালিকানা আর মজুরি দাসত্ব— দুই–ই একই সমাজব্যবস্থার উপাদান। এবং এগুলো মুক্ত শ্রম ও সেই শ্রমের উপরে শ্রমিকদেরই অধিকার থাকবে— এমন নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না। মার্ক্স যেমনটা তুলে ধরেছেন যে, সাম্যবাদীরা এমন একটা সমাজের দিকে তাকাবে যেখানে শ্রমটা “শুধু জীবনধারণের উপায়ই না, জীবনের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা হয়ে উঠবে”। কিন্তু সেটা অসম্ভব যখন কোনো কর্মীকে স্বপ্রণোদনা ছাড়া শুধুই বাইরে থেকে কর্তৃত্বের মাধ্যমে চালানো হয়: “একে অপরের থেকে কিছুটা কম শোষণমূলক হলেও, এমন কোনো মজুরি–শ্রমের কাঠামো নেই, যেটা মজুরি দাসত্বের মর্মযন্ত্রণা দূর করতে পারে।” একজন নৈরাজ্যবাদীকে শুধু বিচ্ছিন্ন শ্রমেরই না, বিরোধিতা করতে হবে শ্রমের হতচেতন(alienated) বিশেষায়িতকরণেরও, যেটা তৈরি হয়, যখন উৎপাদনের উপায়সমূহ শ্রমিকদেরকে পুরো মানুষের একটা খণ্ডমাত্রে পরিণত করে। তার মর্যাদাহানি করে বানিয়ে দেয় পুরো ব্যবস্থাটার একটা ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ। কাজ করার পরিবেশটা এমন যন্ত্রণাদায়ক হয়ে যায় যে সেটা করার মৌলিক অর্থটাই হারিয়ে যায়; শ্রমপদ্ধতির সঙ্গে জড়িত বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গাগুলো থেকেও তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। বিজ্ঞানও এখানে মিলেমিশে গেছে স্বাধীন ক্ষমতা হিসেবে…।
[Chomsky.info version] মার্ক্স এটাকে শিল্পায়নের অনিবার্য অনুসঙ্গ হিসেবে দেখেননি। বরং বিবেচনা করেছিলেন উৎপাদনের পুঁজিবাদী সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য হিসেবে। ভবিষ্যতের সমাজকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে ‘এখনকার সময়ের শ্রমিকদের, যাদেরকে পুরো একটা মানুষের একটা খণ্ডমাত্রে পরিণত করা হয়েছে, এবং তাদের প্রতিস্থাপন করতে হবে পুরোপুরি বিকশিত একজন ব্যক্তিমানুষ দিয়ে। যে বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে পারবে, সমাজে ভিন্ন ভিন্নভাবে ভূমিকা রাখবে। এই সব কিছুরই সুযোগ থাকবে নিজের প্রকৃতিপ্রদত্ত ক্ষমতাগুলো বিকশিত করতে পারার জন্য। আর এটার পূর্বশর্ত হচ্ছে পুঁজি ও মজুরি শ্রমের বিলুপ্তি। (‘শ্রম রাষ্ট্রের’ সেনাবাহিনীর কথা তো না বললেও চলে। পুঁজিবাদের শুরুর পর থেকে চলে আসা সব ধরনের আধুনিক সর্বাত্মকবাদী কাঠামোও ধ্বংস করতে হবে।) মানুষকে শুধুই একটা যন্ত্রের নাটবল্টুতে পর্যবসিত করা, উৎপাদনের একটা বিশেষায়িত হাতিয়ারে পরিণত হওয়ার এই প্রক্রিয়া আরও বাড়ানোর চেয়ে দমন করে ফেলা যেতে পারে, নীতিগতভাবে। কিন্তু সেটা হতে হবে যথাযথ উন্নয়ন ও প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে। উৎপাদন প্রক্রিয়ার উপরে কোনো স্বৈরতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রকের চাপিয়ে দেওয়া শর্তাবলীর অধীনে নয়। এগুলোর মাধ্যমেই একটা মানুষ (হ্যামবোল্টের ভাষায়) শুধুই একটা যন্ত্রে পরিণত হয়ে শেষদিন পর্যন্ত খেটে যায়। নিজের ব্যক্তিগত লক্ষ্য–উদ্দেশ্যগুলো আড়ালেই পড়ে থাকে।
অ্যানার্কোসিন্ডিক্যালিস্টরা চেয়েছে, এমনকি পুঁজিবাদের অধীনেও, মুক্ত উৎপাদকদের মুক্ত সমবায় গড়ে তুলতে, যেগুলো যুদ্ধংদেহী আন্দোলনে যুক্ত হবে আর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে উৎপাদনের সংগঠনগুলো দখল করার প্রস্তুতি নেবে। এই সমবায়গুলো কাজ করবে নৈরাজ্যবাদের অনুশীলন স্কুল হিসেবে। [Chomsky.info version]
উৎপাদনের উপায়সমূহের ওপর ব্যক্তিমালিকানা, প্রুধোঁর বহুল ব্যবহৃত উক্তি অনুসারে, এক ধরনের “চুরিই”। এটাতে “শক্তিশালীর দ্বারা দুর্বলের শোষণই” হয়। — [Chomsky.info version] উৎপাদনের উপরে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণটাও, যত মহৎ কারণেই তা থাকুক না কেন, সেই পরিবেশ তৈরি করতে পারে না যেখানে শারিরীক বা মানসিক শ্রম জীবনের সর্বোচ্চ চাওয়া হতে পারে। ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র— দুটোই এজন্য বিলুপ্ত করতে হবে। [Chomsky.info version]
উৎপাদনের উপায়সমূহের ব্যক্তিগত মালিকানার বিরোধিতা করে এই নৈরাজ্যবাদীরা তাদের কাতারে দাঁড়ান যারা ‘ইতিহাসের তৃতীয় ও শেষ মুক্তিদায়ী পর্যায়ে’ যাওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে। প্রথম পর্যায়ে মানুষ দাস থেকে ভূমিদাসে পরিণত হয়েছে, দ্বিতীয়বার এই ভূমিদাসরা প্রতিস্থাপিত হয়েছে মজুরি শ্রমিকদের দিয়ে। আর এই তৃতীয়বারে, শ্রমিকদের মুক্তির সর্বশেষ পর্যায়ে উৎপাদকদের মুক্ত–স্বেচ্ছাসেবী সমবায়গুলো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেবে। ১৮৪৮ সালে ‘সভ্যতার’ জন্য সবচেয়ে আসন্ন হুমকির কথা বলতে গিয়ে দে তোকভিল বলেছিলেন—
ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারটাই অন্যান্য আরও অনেক অধিকারের উৎসভূমি ও ভিত্তি হয়ে থাকার কারণে এটাকে খুব সহজেই রক্ষা করা গেছে— বা বলা যায়, আক্রমণই করা হয়নি। এটাই তারপর হয়ে উঠেছে সমাজের নগরদুর্গ/আশ্রয়স্থল। সেসময় এটার অনুসঙ্গ হিসেবে গড়ে উঠেছে অন্যান্য অধিকারগুলো। এটাকে কখনো আক্রমণের ধকল সইতে হয়নি। গুরুতর কোনো আক্রমণের মুখে পড়তে হয়নি। কিন্তু এখন, ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকারকে বিবেচনা করা হচ্ছে প্রাচীন রাজতান্ত্রিক দুনিয়ার একমাত্র ধ্বংস না হওয়া অবশেষ হিসেবে। বিবেচিত হচ্ছে বৈষম্যের সমাজে সুবিধাপ্রাপ্তির একমাত্র উপাদান হিসেবে। ফলে এখন পরিস্থিতিটা ভিন্ন। শ্রমজীবী শ্রেণির বুকের মধ্যে কী হয়ে যাচ্ছে, তা একবার কল্পনা করে দেখুন, যদিও আমাকে স্বীকার করতে হচ্ছে যে, তারা এখনো চুপচাপই আছে। এটা সত্যি যে আগের তুলনায় তারা তীব্র রাজনৈতিক অনুরাগ থেকে কম উদ্দীপ্ত হচ্ছে। কিন্তু আপনারা কি দেখতে পাচ্ছেন না, তাদের অনুরাগটা এখন রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে ক্রমাগত সামাজিক হয়ে উঠছে? আপনারা কি দেখতে পাচ্ছেন না যে, আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে এমন ধ্যান–ধারণা ছড়িয়ে যাচ্ছে যার লক্ষ্য শুধু এই আইন, তমুক মন্ত্রণালয় বা এইরকমের একটা সরকার গঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না, বরং তারা এই সমাজটার খোদ ভিত্তিভূমিই পাল্টে দিতে চাচ্ছে?
১৮৭১ সালে প্যারিসের শ্রমিকরা এই নীরবতা ভেঙেছিল আর উদ্যোগ নিয়েছিল সব সভ্যতার ভিত্তি, ব্যক্তিগত মালিকানা বিলোপ করার! হ্যাঁ, মশাইরা, প্যারি কমিউনের উদ্দেশ্য ছিল সব ধরনের শ্রেণি সম্পত্তির বিলোপ ঘটানো, যা অনেকের শ্রমকে পরিণত করে কিছু মানুষের সম্পদে। প্যারি কমিউন দখলদারদেরই দখলচ্যুত করতে চেয়েছিল। যে উৎপাদনের উপায়গুলো (ভূমি, পুঁজি) এখন প্রধানত শ্রম দাসত্ব ও শোষণের উপায়, সেগুলোকে মুক্ত ও সমবায় শ্রমের একটা যন্ত্রমাত্রে পরিণত করে প্যারি কমিউন ব্যক্তি সম্পদকে একটা সত্যে পরিণত করতে চেয়েছিল।
কমিউন, অবশ্যই ভেসে গিয়েছিল রক্তবন্যায়। প্যারিসের শ্রমিকরা যে “সমাজের খোদ ভিত্তিভূমিতে” আঘাত করে বিজয়ী হবে ভেবেছিল, সেই “সভ্যতা” আরও একবার তার আসল চেহারা দেখিয়েছিল নগ্নভাবে। ভার্সাই সরকার সেনারা যখন আবার প্যারিসের দখল নিয়ে ফেলে, তখন কী পরিস্থিতি হয়েছিল তা খুব নির্মম কিন্তু সঠিকভাবে লিখেছিলেন মার্ক্স:
দাস ও মজুররা তাদের মালিকদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেই এই সভ্যতা ও বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থার ন্যায়বিচার এসে হাজির হয় তার ভয়ঙ্কর আলো নিয়ে। এরপর সভ্যতা ও ন্যায়বিচার সামনে এগিয়ে আসে চরম বর্বরতা ও বাছবিচারহীন প্রতিশোধস্পৃহার ছদ্মবেশ নিয়ে… সেনাবাহিনীর নারকীয় কর্মকাণ্ডগুলো প্রতিফলিত করে সেই সভ্যতার আজন্ম রূপটি, যেখানে তারা কাজ করে ভাড়াটে ন্যায়প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে… পুরো দুনিয়ার বুর্জোয়ারা সেই যুদ্ধের পর নির্বিচার গণহত্যা দেখে তৃপ্তির সম্মতি দিয়েছিল। তারা ভয়ে কেঁপে উঠেছিল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হতে দেখে।
প্যারি কমিউনের তীব্র ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি সত্ত্বেও, বাকুনিন লিখেছিলেন যে, প্যারিস একটা নতুন যুগের দ্বার খুলে দিয়েছে। “যে যুগটা সাধারণ জনগণের চূড়ান্ত ও সম্পূর্ণ মুক্তির সূচনা করবে। তাদের সত্যিকারের ভবিষ্যৎ সংহতি ফুটিয়ে তুলবে। রাষ্ট্র নির্ধারিত সীমানা সত্ত্বেও মানুষের পরবর্তী বিপ্লবটা হবে, আর্ন্তজাতিক সংহতিতে। সেটাই হবে প্যারিসের পুনরুত্থান।”— পুরো বিশ্ব এখনো যে বিপ্লবটার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
একজন যথার্থ নৈরাজ্যবাদীকে এজন্য সাম্যবাদী হতে হবে, বিশেষ ধরনের সাম্যবাদী। একজন নৈরাজ্যবাদী শুধু বিচ্ছিন্ন আর বিশেষায়িত শ্রমের বিরোধিতা এবং সকল শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুঁজির দখল নিয়ে নেওয়ার কথাই চিন্তা করবে না। বরং সে এটাও দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করবে যে, এই দখল নিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা হতে হবে সরাসরি। সর্বহারার নাম দিয়ে কোনো বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে সেটা করা হবে না। ছোট কথায়, সে বিরোধিতা করবে সরকার নিয়ন্ত্রিত উৎপাদন সংগঠনের। এর মানে রাষ্ট্রীয়–সাম্যবাদ। এই ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপরে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের কর্তৃত্ব, ম্যানেজার–বিজ্ঞানীদের কর্তৃত্ব, দোকানে দোকান–কর্মকর্তার কর্তৃত্ব বজায় থাকে…শ্রমিক শ্রেণির লক্ষ্য হচ্ছে সব রকমের শোষণ–নিপীড়ন থেকে মুক্তি। কিন্তু নতুন এক ধরনের পরিচালক আর কর্তৃত্বকারী শ্রেণিকে দিয়ে সেই লক্ষ্যে কখনোই পৌঁছানো যায়নি আর কখনো যাবেও না। লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে শুধুমাত্র তখনই, যখন শ্রমিকরা নিজেই তাদের উৎপাদনের উপর দখল রাখতে পারবে।
এই মন্তব্যটা নেওয়া হয়েছে বাম–ধারার মার্ক্সবাদী আন্তন প্যানেককের শ্রেণি সংগ্রামের উপর পাঁচটি থিসিস থেকে। তিনি ছিলেন কাউন্সিল কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রধান বামপন্থী তাত্ত্বিক। আসলে প্রগতিশীল মার্ক্সবাদ, নৈরাজ্যবাদী ধারার সঙ্গে মিশে যায়।
আরও বিস্তারিত চিত্রের জন্য বিবেচনা করা যেতে পারে ‘বিপ্লবী সাম্যবাদের’ এই নিম্নোক্ত রূপায়নকে:
রাষ্ট্রীয় মালিকানা একটা আমলাতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে বলে মনে করে না বিপ্লবী সাম্যবাদীরা। আমরা দেখেছি যে কেন রাষ্ট্র গণতান্ত্রিকভাবে শিল্পকারখানা চালাতে পারে না। কারখানা তখনই কেবল গণতান্ত্রিকভাবে চালানো সম্ভব যখন সব শ্রমিক সরাসরি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি নির্বাচন করে প্রশাসনিক কমিটি বানাতে পারবে। সাম্যবাদ হবে মৌলিকভাবে একটা শিল্পকারখানাভিত্তিক ব্যবস্থা; এটার প্রতিনিধি ব্যবস্থাও হবে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বৈশিষ্ট্যের। এইভাবে যারা বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম ও শিল্পকারখানাগুলো পরিচালনা করছে, তারা সরাসরি সামাজিক প্রশাসনের আঞ্চলিক বা কেন্দ্রিয় কাউন্সিলে প্রতিনিধিত্ব করবে। এই পদ্ধতিতে এরকম প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতাটা প্রবাহিত হবে তাদের কাছ থেকে যারা প্রত্যক্ষভাবে কাজগুলো করছে এবং পুরো কমিউনিটির চাহিদা সম্পর্কে অবগত আছে। যখন কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমিটি বৈঠকে বসবে তখন প্রতিনিধিরা সামাজিক কাজগুলোর প্রতিটা ধাপের বর্ণনা দেবে। এইভাবে পুঁজিবাদী রাজনৈতিক বা ভৌগলিক রাষ্ট্র প্রতিস্থাপিত হবে সাম্যবাদের শিল্প প্রশাসন কমিটি দিয়ে। এক সামাজিক ব্যবস্থা থেকে আরেকটাতে রুপান্তরিত হওয়াই তো সামাজিক বিপ্লব। পুরো ইতিহাসজুড়ে রাষ্ট্র–রাজনীতি বলতে বুঝিয়েছে শাসক শ্রেণির সরকারকে। আর সাম্যবাদী রিপাবলিক হবে শিল্পকারাখানার সরকার। পরিচালিত হবে পুরো কমিউনিটির পক্ষে। আগের ধারণাটা অনেক মানুষকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পরাধীন করে রাখত। পরের ধারণাটার অর্থ হবে সব মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি— এটাই, সেজন্য, সত্যিকারের গণতন্ত্র।
এই পরিকল্পিত বিবৃতিটা এসেছিল উইলিয়াম পলের রাষ্ট্রের উদ্ভব ও কার্যাবলী নামক বইয়ে। এটা লেখা হয়েছিল ১৯১৭ সালের শুরুর দিকে— লেনিনের রাষ্ট্র ও বিপ্লব বইটির ঠিক আগ দিয়ে। রাষ্ট্র ও বিপ্লবই সম্ভবত লেনিনের সবচেয়ে মুক্তিমুখীন চিন্তাকর্ম। পল মার্ক্সিস্ট–ডি লিওনিস্ট সোশ্যালিস্ট লেবার পার্টির সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে তাঁকে দেখা গেছে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র নিয়ে তাঁর সমালোচনার জায়গাটা নৈরাজ্যবাদীদের মুক্তিমুখীন মতবাদের সঙ্গে নীতিগতভাবে মিলে যায়। আর তা হলো: রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা বজায় থাকলে সেটা যেহেতু আমলাতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের দিকেই মোড় নেবে, সেহেতু সামাজিক বিপ্লবকে অবশ্যই এটার জায়গায় প্রতিস্থাপন করতে হবে সমাজের শিল্পকারখানার সংগঠনগুলোকে। যেগুলোর উপরে থাকবে শ্রমিকদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ। এরকম অনেক বিবৃতিই উদ্ধৃত করা যায়।
এর চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: এই ধারণাগুলো বাস্তবে চর্চা করে দেখা হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। যেমন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি ও ইতালিতে, ১৯৩৬ সালে স্পেনে (শুধু কৃষিভিত্তিক জায়গাগুলোতেই নয়, বার্সেলোনার মতো শিল্পায়িত শহরেও।) এমন যুক্তি দেওয়াই যায় যে, কাউন্সিল কমিউনিজমের মতো কোনো কাঠামোই একটা শিল্পায়িত সমাজে বিপ্লবী সাম্যবাদের প্রাকৃতিক কাঠামো। এর মধ্য দিয়ে গভীর বোঝাপড়ার পরিচয় পাওয়া যায় যে, যখন শিল্প ব্যবস্থার উপর কোনো না কোনো ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণ থাকে, তখন গণতন্ত্র খুবই খণ্ডবিচ্ছিন্ন ও সীমিত হয়ে পড়ে। সেটা মালিক, ম্যানেজার, নীতিনির্ধারক, ‘ভ্যানগার্ড’ পার্টি বা রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র; যাই হোক না কেন। কর্তৃত্বপরায়ন এই আধিপত্যের মধ্যে ধ্রুপদী মুক্তিমুখীন আদর্শগুলো ভালোমতো উপলব্ধিও করা যাবে না, যেগুলো পরবর্তীতে মার্ক্স, বাকুনিন ও অন্যান্য সত্যিকারের বিপ্লবীরা আরও বিকশিত করেছিলেন। মানুষ কখনোই নিজের সুপ্ত সম্ভাবনাগুলোকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে পারার মতো স্বাধীন হতে পারবে না। আর উৎপাদকরাও থেকে যাবে ‘মনুষ্য সত্তার একটা ক্ষুদ্র খণ্ডাংশ হয়ে’। মর্যাদাহীনভাবে। উপর থেকে পরিচালিত একটা উৎপাদন ব্যবস্থার যন্ত্র হয়ে।
[Chomsky.info version] ‘স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লবী কর্মকাণ্ড’ কথাটা বিভ্রান্তিকর হতে পারে। অ্যানার্কো-সিন্ডিক্যালিস্টরা, বাকুনিনের এই কথাটা খুব গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছিল যে, প্রাক বিপ্লব পর্যায়ে শ্রমিক সংগঠনকে “শুধু ধারণা–আদর্শ তৈরিই না, ভবিষ্যত সমাজের প্রতিচ্ছবিটাও নিজেদের মধ্যে তুলে ধরতে হবে”। স্প্যানিশ বিপ্লবের যে অর্জন, তার ভিত্তি ছিল দীর্ঘদিনের অঙ্গীকার ও লড়াইয়ের ঐতিহ্য ধরে রেখে ধৈর্য্যশীলভাবে সংগঠনমূলক কাজ ও শিক্ষামূলক প্রচার–প্রচারণা। ১৯৩১ সালের জুনে মাদ্রিদ কংগ্রেস ও ১৯৩৬ সালের মে মাসে সারাগোজা কংগ্রেসের গৃহীত প্রস্তাবে আসন্ন বিপ্লবের অনেক পূর্বাভাস দেখা গিয়েছিল। ঠিক যেমনটা দেখা গিয়েছিল সান্তিয়ানের ক্ষেত্রে। বিপ্লবের মাধ্যমে যে ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠবে, তার সুনির্দিষ্ট অনেক বর্ণনা আগেই দিয়েছিলেন সান্তিয়ান। গ্যারাঁ লিখেছেন, “মুক্তিমুখীন চিন্তকদের চিন্তাভাবনায় স্প্যানিশ বিপ্লবের ধারণাটা তুলনামূলকভাবে অনেক পরিপক্ক ছিল। একই সঙ্গে বিপ্লব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল সাধারণ মানুষের চেতনাতেও।” শ্রমিকদের সংগঠনগুলোও সমাজকাঠামোর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। সেই অভিজ্ঞতা, সেই বোঝাপড়াই তাদেরকে নিয়ে গিয়েছিল সামাজিক পুনর্গঠনের দিকে। ১৯৩৬ সালের শুরুর দিকের গোলযোগটাই, ফ্রাঙ্কোর অভুত্থানের সময় ফেটে পড়েছিল সামাজিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে। স্পেনে কালেক্টিভাইজেশন দলিলপত্র সংগ্রহের সূচনা হিসেবে নৈরাজ্যবাদী অগাস্টিন সোউচে লিখেছেন:
অনেক বছর ধরে, স্পেনের নৈরাজ্যবাদী আর সিন্ডিক্যালিস্টরা সমাজের সামাজিক রুপান্তরকেই তাদের প্রধান কাজ বলে বিবেচনা করে এসেছে। তাদের সিন্ডিকেট আর গ্রুপগুলোর সমাবেশে, তাদের পত্রপত্রিকা, পুস্তিকা, বইপত্রে, সব জায়গায় সুশৃঙ্খল কায়দায় বিরতিহীনভাবে আলোচনা হতো সামাজিক বিপ্লবের সমস্যাবলী নিয়ে।
স্বতঃস্ফূর্ত অর্জনগুলোর পেছনে এই সবই অবদান রেখেছে। স্প্যানিশ বিপ্লবের এই গঠনমূলক কাজগুলো। [Chomsky.info version]
মুক্তিমুখীন সমাজতন্ত্রের এই ধারণাগুলোর সত্যিকার অর্থ গত শতকের অর্ধেকটাজুড়ে চাপা পড়ে ছিল শিল্পায়িত সমাজে। আধিপত্যশীল মতবাদ ছিল হয় রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র নয়তো রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ (কেন সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমাগত সামরিক চরিত্র ধারণ করেছে, তার উত্তরটাও অস্পষ্ট কিছু না) কিন্তু বিগত বছরগুলোতে নৈরাজ্যবাদী ধারার চিন্তাভাবনায় আগ্রহের বাতি জ্বলেছে। উপরে আন্তন প্যানেককের যে থিসিস থেকে আমি উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছি সেটা পুনরায় ছাপা হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে প্রগতিশীল ফরাসি শ্রমিকদের একটি গ্রুপের পুস্তিকায়। বিপ্লবী সাম্যবাদ নিয়ে উইলিয়াম পলের যে লেখাটির কথা উল্লেখ করেছি, সেই লেখাটির উদ্ধৃতি সাম্প্রতিক কালে ব্যবহার করেছেন ওয়াল্টার ক্যানডাল। ১৯৬৯ সালে ইংল্যান্ডের শেরফিল্ডে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জাতীয় কনফারেন্সে বক্তৃতার সময় তিনি উদ্ধৃত করেছেন উইলিয়াম পলকে। যুক্তরাজ্যে গত কয়েক বছরে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে হাজির হচ্ছে। তারা প্রায়ই কনফারেন্স আয়োজন করে, অনেক পুস্তিকা প্রকাশ করে। গুরুত্বপূর্ণ ট্রেড ইউনিয়নগুলোতে তাদের অনুসারী অনেক সক্রিয় প্রতিনিধি আছে, যাদের হিসাবে রাখতে হয়। যেমন, The Amalgamated Engineering and Foundryworkers’ Union, তাদের আনুষ্ঠানিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে ‘সব পর্যায়ে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণাধীন অবস্থায়’ প্রধান প্রধান শিল্পকারখানার জাতীয়করণ পরিকল্পনাকে। এই মহাদেশে, একই রকম অগ্রগতি আরও দেখা গেছে। ১৯৬৮ সালের মে–তে অবশ্যই কাউন্সিল কমিউনিজমের উপর আগ্রহ ক্রমাগতভাবে বাড়ছিল ফ্রান্স, জার্মানিতে। ইংল্যান্ডেও।
মতাদর্শিকভাবে খুব আঁটোসাটো এই সমাজের রক্ষণশীল চরিত্র মাথায় রাখলে, এটা ভেবে খুব অবাক লাগে না যে, কেন যুক্তরাষ্ট্রে এসব ঘটনার প্রভাব প্রায় পড়েইনি। কিন্তু সেটাও বদলে যেতে পারে। ঠান্ডা যুদ্ধের জুজুটা উবে যাওয়ার পর এখন অন্তত বৃহত্তর পরিসরে অনেক প্রশ্ন তোলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখনকার দমনমূলক পরিবেশটা যদি হটিয়ে দেওয়া যায়, বামপন্থীরা যদি তাদের আত্মঘাতী প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে, বিগত দশকের অর্জনগুলোর ওপর দাঁড়াতে পারেন, সংগঠিত হতে পারেন, তাহলে আগামী দিনের শিল্প সমাজ কীভাবে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বোধে পরিচালিত হবে, কিভাবে কর্মক্ষেত্রে ও কমিউনিটিতে গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে— এগুলো হয়ে উঠবে প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার ইস্যু। যারা সমাজের সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবে, তারা এগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করবে। আর যখন মুক্তিমুখীন সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে উঠবে, তখন এই ভাবনাগুলো চর্চায় রূপ নেবে।
১৮৬৫ সালের ইশতেহারে, বাকুনিন অনুমান করেছিলেন যে, সামাজিক বিপ্লবের বড় একটা অংশ হবে “মেধাবী ও সত্যিকারের উদারমনা তরুণরা, যারা জন্মগতভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীতেই অবস্থান করে কিন্তু সহৃদয় আর প্রবল আকাক্সক্ষার জায়গা থেকে সাধারণ মানুষের দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়।” ১৯৬০–এর দশকে বিশ্বব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে হয়তো কেউ এই ভবিষ্যদ্বাণীর স্বার্থকতা খুঁজে পেতে পারেন।
দানিয়েল গ্যারাঁ সেই কাজটা করতে নিয়েছেন, যা তার ভাষায়, নৈরাজ্যবাদী চিন্তাভাবনার ‘পুনর্বাসন প্রক্রিয়া’। তিনি দাবি করেন, এবং আমি একমত যে, ‘নৈরাজ্যবাদের গঠনমূলক আদর্শগুলো নিজেদের প্রাণশক্তি টিকিয়ে রেখেছে। তাই তাদেরকে নতুনভাবে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখা, ওলটপালট করে দেখা প্রচলিত সাম্যবাদী চিন্তাভাবনাকেও নতুন দিশা দিতে পারে…এবং মার্ক্সবাদকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে। কেউ হয়তো নতুন কোনো পরিবর্তনের কথাও ভাবতে পারেন। আর এটা এইভাবে মার্ক্সবাদকেও সমৃদ্ধ করতে অবদান রাখতে পারে। নৈরাজ্যবাদের ‘লম্বাচওড়া কাঁধ’ থেকে তিনি সেই চিন্তাধারা ও কর্মতৎপরতাগুলোকে বেশি করে পরখ করেছেন, যাকে ডাকা যেতে পারে মুক্তিমুখীন সমাজতন্ত্র নামে। এটাই স্বাভাবিক ও যথার্থ। এই বইয়ে তিনি হাজির করেছেন নৈরাজ্যবাদের প্রধান কিছু মানুষের বক্তব্য এবং নৈরাজ্যবাদী চেতনা ও আদর্শ থেকে উৎসারিত হওয়া জনগণের বিপ্লবী তৎপরতা। গ্যারাঁ শুধু নৈরাজ্যবাদী ভাবনাগুলোকেই বিবেচনায় নেননি, সেই সঙ্গে তিনি খুঁজে দেখেছেন জনগণের বিপ্লবী সংগ্রামের স্বতঃস্ফূর্ত কর্মকাণ্ডগুলোও। সমাজের পাশাপাশি মনোযোগ দিয়েছেন বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীলতার দিকেও। যারা শুধু দুনিয়াটা বুঝতে না, সেটাকে পাল্টাতেও চায়, তাদের জন্য নৈরাজ্যবাদের ইতিহাস এভাবেই পাঠ করা উচিৎ।
১৯ শতকের নৈরাজ্যবাদকে গ্যারাঁ বর্ণনা করেছেন মতবাদভিত্তিক অবস্থায়। বিশ শতকটা ছিল নৈরাজ্যবাদীদের জন্য ‘বিপ্লবী অনুশীলনের’ সময়। বইয়ে একথারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। নৈরাজ্যবাদ নিয়ে তাঁর বোঝাপড়া সচেতনভাবে আঙুল তোলে ভবিষ্যতের দিকে। আর্থার রোসনবার্গ একবার উল্লেখ করেছিলেন যে, জনপ্রিয় বিপ্লবগুলোতে চারিত্রিকভাবে একটা বৈশিষ্ট্য দেখা যায়: তারা ‘সামন্ততান্ত্রিক বা কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বকে বল প্রয়োগ করে প্রতিস্থাপন’ করতে চায়, কোনো ধরনের কমিউনাল ব্যবস্থা দিয়ে। যেটা ‘তখন কাজ করবে পুরোনো রাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলো ভেঙ্গে উধাও করে দেওয়ার জন্য’। এরকম একটা ব্যবস্থা হবে হয় সাম্যবাদী বা ‘গণতন্ত্রের চূড়ান্ত পর্যায়… যা সাম্যবাদে যাওয়ার পূর্বশর্ত। কেননা সাম্যবাদকে আসলে এমন একটা জগতে উপলব্ধি করা সম্ভব, যেখানে ব্যক্তি সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাত্রার স্বাধীনতা ভোগ করবেন। তিনি লিখেছেন, এই আদর্শটা, মার্ক্সবাদী ও নৈরাজ্যাবাদী, দুই পক্ষই ধারণ করত। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রবণতার বিরোধিতা করে স্বাভাবিক এই মুক্তি সংগ্রাম। এক শতক আগে মার্ক্স লিখেছিলেন যে, প্যারিসের শ্রমিকরা “অনুভব করেছিল, তাদের সামনে শুধু একটাই বিকল্প আছে। কমিউন অথবা সাম্রাজ্য— সেটা যে নাম নিয়েই আবার হাজির হোক না কেন।”
সাম্রাজ্য শ্রমিকদের ধ্বংস করে দিয়েছে অর্থনৈতিকভাবে। এটা করা হয়েছে জনগণের সম্পদ ধ্বংস করে, অর্থ আত্মসাৎ করে, পুঁজির কেন্দ্রীভবন কৃত্রিমভাবে তরান্বিত করার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়ে, আর সবসময়ের দখলদারি ফলিয়ে। তাদেরকে দাবিয়ে রাখা হয়েছিল রাজনৈতিকভাবেও। উদ্ভট কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শ্রমিকদের নাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল নৈতিকভাবেও। সাম্রাজ্য Voltairianism কে অপমান করেছিল, শিক্ষার জন্য সন্তানদের frères Ignorantins এ পাঠাতে বাধ্য করে। একজন ফরাসি হিসেবে তারা জাতীয় চেতনার জায়গা থেকেই বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল যখন হঠাৎ করে তাদেরকে একটা যুদ্ধে নিক্ষেপ করা হয়। সেই যুদ্ধ যা ধ্বংস এনেছিল, তার একমাত্র সমকক্ষ হতে পারে— পুরো সাম্রাজ্যই নাই হয়ে যাওয়া।
বিভীষিকাময় দ্বিতীয় সাম্রাজ্যই ‘সেই সময়ের সম্ভাব্য একমাত্র সরকারি কাঠামো হতে পারত, যখন বুর্জোয়ারা ইতিমধ্যেই হেরে গেছে আর শ্রমিকশ্রেণিও পুরো দেশকে শাসন করার মতো সামর্থ্য অর্জন করেনি।’
এই ভাবনাগুলো, ১৯৭০–এর সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার উপযুক্ত করে পুনরায় বলা খুব কঠিন কিছু না। “মানুষকে অর্থনৈতিক শোষণ আর রাজনৈতিক–সামাজিক দাসত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার সমস্যা”টি আমাদের সময়েও সমস্যা হিসেবেই থেকে গেছে। আর যতদিন এমনটা থাকবে, ততদিন মুক্তিমুখীন সমাজতন্ত্র, মতবাদ ও বিপ্লবী অনুশীলনের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা ও পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে।