অনুবাদ: তানভীর আকন্দ
বিশ্বের বৃহৎ দুটি প্রোপাগান্ডা ব্যবস্থা যখন কোনো মতবাদের ক্ষেত্রে একমত হয়, তখন সেই মতবাদের বেড়াজাল ছিন্ন করে বের হয়ে আসার জন্য কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতারও প্রয়োজন পড়ে। এরকমই একটি মতবাদ হলো— লেনিন ও ট্রটস্কি যে সমাজ নির্মাণ করেছেন, যাকে পরে আরও দূর ঢেলে সাজিয়েছেন স্তালিন ও তার উত্তরসূরিরা, তার সাথে সমাজতন্ত্রের প্রকৃত ধারণার বা বলা যায় ঐতিহাসিকভাবে সমাজতন্ত্রের যে ধারণা আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে তার একটা সম্পর্ক রয়েছে। আদতে সম্পর্ক যদি থেকে থাকেও, তবে সেটা সামঞ্জস্যের নয় বরং বৈপরিত্যের।
দুটি মুখ্য প্রোপাগান্ডা ব্যবস্থা কেন এই গালগপ্পের উপর এত জোর দেয় তা বেশ স্পষ্ট। শুরু থেকেই সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থা তার নিজের জনগোষ্ঠির কর্মশক্তিকে শোষণ করার চেষ্টা করেছে, একই সাথে চেষ্টা করেছে অন্যত্র জনগণকে নিপীড়ন করার। যাতে রাশিয়ার জনপ্রিয় বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ১৯১৭ সালে যারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে তাদের স্বার্থ হাসিল করা যায়। আর এইক্ষেত্রে একটি প্রধান মতাদর্শিক অস্ত্র হচ্ছে তাদের এই দাবি যে— রাষ্ট্রীয় প্রশাসকেরা তাদের নিজস্ব সমাজের পাশাপাশি সারা বিশ্বকেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছ। আর এটা যে অসম্ভব, তা যে কোনো সমাজতান্ত্রিক, এবং অবশ্যই যে কোনো চিন্তাশীল মার্ক্সবাদির পক্ষেও তৎক্ষণাৎ অনুধাবন করা কঠিন কিছু নয় (অনেকে তা অনুধাবন করেছিলেনও)। বলশেভিক শাসনের শুরু থেকেই ইতিহাস আমাদের এই পর্বতপ্রমাণ মিথ্যাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আসছে। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের মোহ ও তাদের উপর জনগণের কার্যত যে আস্থা তাকে ব্যবহার করে কর্তাব্যক্তিরা এসব কর্মকাণ্ডের বৈধতা ও এসবের প্রতি জনগণের সমর্থন আদায় করে নেয়ার চেষ্টা করেছে। যাতে করে নিজেদের রীতিনীতিকে তারা আড়াল করতে পারে। যদিও আসলে সমাজতন্ত্রের প্রতিটি নমুনাই তারা নিশ্চিহ্ন করে দিতে থাকে।
আর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ প্রোপাগান্ডা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে— সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তাদের অনুগতদের সাথে সমাজতন্ত্রের নাম জড়িয়ে একে একটি শক্তিশালী মতাদর্শিক অস্ত্র হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। যে অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৈধতা প্রদান করা ও [জনগণকে] এসবের অনুগত হতে বাধ্য করার কাজে। এর ফলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক ও কর্তাব্যক্তিদের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দেয়াটা যাতে আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক রীতি হিসেবে পরিগণিত হয়, তা নিশ্চিত করা গেছে। আর এটাই ছিল ‘সমাজতান্ত্রিক’ কয়েদখানার একমাত্র বিকল্প।
আর এভাবেই ছড়ি ঘুরানোর অধিকার আদায়ের জন্যই সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ নিজেদের সমাজতান্ত্রিক হিসেবে উপস্থাপন করে। একইসাথে পশ্চিমা ভাববাদিরাও আরও বেশি স্বাধীন ও নৈতিক একটা সমাজের হুমকিকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে এই একই ভণ্ডামির পথ অণুসরণ করে। এই যৌথ আক্রমণ আধুনিক সমাজে সমাজতন্ত্রকে বেশ সফলভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পেরেছে।
আরও একটা অস্ত্রের কথা উল্লেখ করা যায়, যেই অস্ত্র বিদ্যমান ক্ষমতাতন্ত্র ও সুবিধাবাদের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী ভাবদর্শিকেরা বেশ সাফল্যের সাথেই ব্যবহার করে থাকে। তথাকথিত ‘সমাজতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে প্রথাগত যেসব কুৎসা প্রচার করা হয় সেগুলো নানাভাবেই বিকৃত ও অনেকক্ষেত্রেই ডাহা মিথ্যায় পরিপূর্ণ। প্রকাশ্য শত্রুর নিন্দা ও যেকোনো অপকর্মের দায় তার উপর চাপিয়ে দেয়ার চেয়ে সহজ কাজ আর কিছুই হতে পারে না। স্রোতে গা ভাসানোই যেখানে মানুষের স্বভাব সেখানে কোনো তথ্যপ্রমাণ হাজির বা যুক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজন পড়ে না। পশ্চিমা জুলুম ও নৃশংসতার সমালোচনা যারা করেন তারা মাঝেমাঝেই এটা শুধরে দেয়ার চেষ্টা করেন। পশ্চিমা জুলুমের পক্ষে সাফাই গাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রচারিত কাহিনিগুলোর মুখোশ উন্মোচন করে দেবার পাশাপাশি অপরাধমূলক নৃশংসতা ও নিপীড়নকে স্বীকার করে নিয়েই এ কাজটি করেন তারা। বরাবরেই মতোই তাৎক্ষণিক এসকল পদক্ষেপকে ব্যাখ্যা করা হয় দুষ্টের সম্রাজ্য ও তার চামচাদের পক্ষে সাফাই গাইতে। আর এভাবেই রাষ্ট্রীয় স্বার্থে মিথ্যা বলার চরম অধিকারকে সংরক্ষণ করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় জুলম ও নৃশংসতার সমালোচনাকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।
সংঘাত ও বিপর্যয়ের মুহূর্তে লেনিনবাদী মতবাদের প্রতি আধুনিক বুদ্ধিজীবী শ্রেণির প্রবল আকর্ষণের কথাটাও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এই মতবাদ ‘গোঁড়া বুদ্ধিজীবিদের’ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার ও ‘নতুন একটা শ্রেণি’ অর্থাৎ ‘লাল আমলাতন্ত্রের’ কঠোর শাসন চাপিয়ে দেয়ার অধিকার প্রদান করে। এক শতাব্দী আগে বাকুনিন তার দূরদর্শী বিশ্লেষণে এমনটাই বলেছিলেন। ঠিক যেমনটা মার্ক্সের সমালোচনায় উঠে এসেছে— বোনাপার্টিস্ট রাষ্ট্রে তারা “রাষ্ট্রীয় পুরোহিত“ হয়ে ওঠে, এবং সিভিল সোসাইটির উপর আশ্রয় করে বেঁচে থাকা পরজীবী পতঙ্গে“ পরিণত হয়ে সমাজকে শক্তহাতে শাসন করতে থাকে।
রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে যখন খুবই স্বল্প মাত্রায় প্রতিরোধ বিরাজ করে তখন সেই সময়ে এই একই মৌলিক প্রতিশ্রুতিগুলো এই “নতুন শ্রেণিকে“ রাষ্ট্রীয় প্রশাসক ও ভাবাদর্শিক হিসেবে কাজ করতে প্রবৃত্ত করে। বাকুনিনের ভাষায় যাকে বলা যায় “জনগণকে তার নিজের লাঠি দিয়েই পিটিয়ে বেড়ানো“। বিগত অর্ধশতকে যা ট্র্যাজেডি থেকে প্রহসনে পরিণত হয়েছে সেই একই নাটকের যখন পুনরাবৃত্তি ঘটে, “বৈপ্লবিক কমিউনিজম“ থেকে সরে এসে “পশ্চিমের গুণকীর্তনে“ প্রলুব্ধ হওয়ার মাধ্যমে, তখন তাকে বুদ্ধিজীবিরা যে অতি সহজভাবেই গ্রহণ করে তা খুব একটা বিস্ময়কর কিছু নয়। সংক্ষেপে বললে, পরিবর্তন যা ঘটেছে তা কেবল ক্ষমতা কোথায় বিরাজ করবে সে সম্পর্কিত হিসাবনিকাশেই। “আর কিছু না, কেবল রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের একাধিপত্যই সমাজতন্ত্র, যা সমগ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে নির্মাণ করা হয়“ যেই জনগোষ্ঠীকে অতি অবশ্যই তার নেতাদের বদান্যতায় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে— লেনিনের এই উক্তি সমাজতন্ত্রের বিকৃতিকেই প্রকাশ করে মাত্র, আর প্রচার করে রাষ্ট্রীয় পুরোহিতদের প্রয়োজনীয়তাকে। আর তা আমাদের দুটি ভিন্ন অবস্থানের তরিৎ স্থানান্তরকে বুঝার সুযোগ করে দেয়, যে দুটি অবস্থান আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ বিপরীত মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে তারা খুবই নিকটবর্তী।
রাজনৈতিক ও সামাজিক ডিসকোর্সের পরিভাষা বেশ অস্পষ্ট এবং অনির্দিষ্ট, এবং এক বা একাধিক ঘরাণার ভাবাদর্শিকদের অবদানে প্রতিনিয়তই এগুলোর সুনির্দিষ্ট অর্থবোধকতা হ্রাস পাচ্ছে। তবুও এই পরিভাষাগুলোর অন্তত কিছু অর্থ অবশিষ্ট থাকে। শুরু থেকেই, সমাজতন্ত্র বলতে শ্রমজীবী মানুষের শোষণের হাত থেকে মুক্তিকে বুঝায়। মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক আন্তন প্যানেকক যেভাবে দেখেছেন, “বুর্জোয়া শ্রেণিকে নতুন একটি নেতৃস্থানীয় ও শাসকশ্রেণি দ্বারা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি, এবং তা হবেও না“, শুধুমাত্র “শ্রমিকদের দ্বারাই এর বাস্তবায়ন সম্ভব, যদি তারা উৎপাদনের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে পারে“। উৎপাদনের উপর উৎপাদকের নিয়ন্ত্রণই হচ্ছে সমাজতন্ত্রের সারকথা। লেনিনবাদ ও পশ্চিমা ব্যবস্থাপনাবাদের (managerialism) সাধারণ নীতির দ্বারা চালিত প্রথাগত শাসকশ্রেণি ও ‘বিপ্লবী বুদ্ধিজীবিদের’ চরম প্রতিপক্ষ যারা, তাদের বিরুদ্ধে এই লক্ষ্য অর্জনের পথ নিয়ে ভাবা হয়েছে বরাবরই। এই ভাবনাচিন্তা হয়েছে বিপ্লবী সংগ্রামের নানা পর্যায়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়েই। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অপরিহার্য উপাদানটি ঠিকই বজায় রয়েছে। আর তা হলো উৎপাদনের যন্ত্রসমূহকে স্বাধীনভাবে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকের সম্পত্তি তথা সেইসব মানুষের সামাজিক সম্পত্তিতে পরিণত করা যারা মালিকশ্রেণির শোষণের হাত থেকে নিজেদের মুক্ত করেছে। আর এটাই হলো মানব-মুক্তির এক বৃহত্তর সিমানার দিকে প্রাথমিক পদক্ষেপ।
লেনিনবাদী বুদ্ধিজীবী শ্রেণির উদ্দেশ্য ভিন্ন। মার্ক্স “ষড়যন্ত্রকারিদের“ যে বর্ণনা দিয়েছেন এদের সাথে তা পুরোপুরিভাবে মিলে যায়, যারা কিনা “বিকাশমান বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে কব্জা করে“ নিজেদের কর্তৃত্বের অধীনে নিয়ে আসে। “আর এজন্যই শ্রমিকশ্রেণি নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ সম্পর্কে আরও বেশি পরিমাণে তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করুক এ ব্যাপারে তাদের গভীর অনাগ্রহ কাজ করে।“ লাল আমলাতন্ত্রের উৎখাত এবং উৎপাদন ও সামাজিক জীবনের উপর গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাও এই স্বার্থের অন্তর্ভুক্ত। লেনিনবাদিদের মতে, জনগণকে বাধ্যতামূলকভাবে কঠোর নিয়মতান্ত্রিকতার অধীনে আনতে হবে। আর সমাতান্ত্রিকরা এর মধ্যেই সংগ্রাম করে যাবে এমন এক সমাজ ব্যবস্থা অর্জনের জন্য, যে সমাজব্যবস্থায় নিয়মতান্ত্রিকতা “হয়ে উঠবে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়“। যেহেতু স্বধীনভাবে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকেরা “গতর খাটবে তাদের নিজের গরজেই“ (মার্ক্স)। কিন্তু মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্র কেবল উৎপাদনের উপর উৎপাদকের গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্যেই তার লক্ষ্য সীমাবদ্ধ রাখে না, বরং সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই যত রকমের কর্তৃত্ববাদ ও উঁচু-নিচু ভেদ তার সবকিছুকেই ঝেটিয়ে বিদেয় করতে চায়। এ অন্তহীন এক লড়াই, যার কোনো শেষ নেই। কারণ অপেক্ষাকৃত ন্যায়নিষ্ঠ একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে জুলুম ও নিপীড়নের নানা চেহারা আমাদের সামনে উন্মোচিত হবে, নতুন নতুন অন্তর্দৃষ্টি ও উপলব্ধির মাধ্যমে। যা হয়তো এতদিন গোপন ছিল আমাদের চিরাচরিত অভ্যাস ও চেতনার গভীরে।
সমাজতন্ত্রের সবচেয়ে আবশ্যিক বৈশিষ্ট্যের সাথে লেনিনবাদের বৈরিতা একেবারে শুরু থেকেই দৃশ্যমান। বিপ্লবী রাশিয়ায়, সোভিয়েত ও কারখানা সমিতিগুলো গড়ে উঠেছিল সংগ্রাম ও স্বাধীনতার অস্ত্র হিসেবে। নানা ত্রুটি সত্ত্বেও যেগুলোর ছিল অমিত সম্ভাবনা। ক্ষমতা দখলের সাথে সাথেই পার্টির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে লেনিন ও ট্রটস্কি নিজেদের নিয়োজিত করে এই যন্ত্রসমূহের মুক্তিমুখী সম্ভাবনাকে ধ্বংস করার কাজে। বাস্তবিক অর্থে নিয়ন্ত্রণ ছিল কেন্দ্রীয় কমিটি এবং তার সর্বোচ্চ নেতাদের হাতে। ট্রটস্কি এর নিখুঁত পূর্বাভাস দিয়েছিলেন বছর কয়েক আগেই। রোজা লুক্সেমবার্গ ও অন্যান্য বামপন্থী মার্ক্সবাদিরা সে সময়ই সতর্ক করেছিলেন, আর নৈরাজ্যবাদিরাতো বরাবরই এ ব্যাপারে সচেতন ছিল। বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী থেকে রাষ্ট্রীয় পুরোহিতে পরিণত হওয়ার সাথে সাথে ট্রটস্কির ভাবনার মধ্যেও এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠে যে শুধুমাত্র জনগণ নয়, পার্টিকেও ‘উপর থেকে সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে’। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের আগে বলশেভিক নেতারা তৃণমূল পর্যায়ে বৈপ্লবিক সংগ্রামে যুক্ত মানুষদের রাজনৈতিক ভাস্য রপ্ত করেছিল, যদিও তাদের প্রকৃত অঙ্গীকার ছিল ভিন্ন। আগেও এর প্রমাণ দেখা গেছে, ১৯১৭ এর অক্টোবরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরতো তা একেবারে জলের মতোই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বলশেভিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল ঐতিহাসিক ই. এইচ. কার লিখেছেন, “বিপ্লবের মধ্য দিয়ে কারখানা কমিটিগুলোকে সংগঠিত করে কারখানা পরিচালনাকার্যে হস্তক্ষেপ করতে শ্রমিকদের স্বতস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসার জন্য উৎসাহিত করা হয়, যার ফলে শ্রমিকদের মধ্যে এই বিশ্বাসের জন্ম নেয় যে দেশের উৎপাদনযন্ত্রের মালিক তারাই এবং নিজেদের স্বার্থে ও নিজেদের বুদ্ধিবিবেচনা অনুযায়ী তারা এগুলো চালাতে পারবে।“ (ইতালিক অংশটুকু আমার যোগ করা- চমস্কি) একজন অরাজপন্থী প্রতিনিধি যেমন বলেছিলেন, শ্রমিকদের কাছে “কারখানা কমিটিগুলো ছিল ভবিষ্যতের ভিত্তিস্বরূপ…রাষ্ট্র নয় বরং তাদেরই এখন প্রশাসক হয়ে উঠা উচিত।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় পুরোহিতরা ছিলেন অতি পণ্ডিত, তারা একেবারে তৎক্ষণাৎই কারখানা কমিটিগুলো ধ্বংস করার কাজে নেমে পড়েন এবং সোভিয়েতগুলোকে তাদের শাসনের যন্ত্রে পরিণত করেন। নভেম্বরের ৩ তারিখ লেনিন “শ্রমিক নিয়ন্ত্রণের উপর খসড়া বিধি“ প্রণয়নের মাধ্যমে ঘোষণা করেন যে এইরূপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাপ্রাপ্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিগণকে “যথাযত নিয়মনিষ্ঠা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাষ্ট্রের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।“ বছর ঘুরার সাথে সাথেই লেনিন ঘোষণা করেন যে, “আমরা শ্রমিক নিয়ন্ত্রণকে পেছনে ফেলে জাতীয় অর্থনীতির সর্বোচ্চ পর্ষদ প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে এসেছি“ যা যন্ত্রপাতির উপর শ্রমিকের নিয়ন্ত্রণকে প্রতিস্থাপিত, বিলীন ও বাতিল করবে (ই. এইচ. কার)। “খোদ সমাজতন্ত্রের ধারণাটিই সঙ্কুচিত হয়ে শ্রমিক নিয়ন্ত্রণের ধারণায় পর্যবসিত হয়“ মেনশেভিক ট্রেড ইউনিয়নের একজন সদস্য আক্ষেপ করে বলেছিলেন। বলশেভিক নেতৃত্বও তাদের কাজেকর্মে একই আক্ষেপের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন সমাজতন্ত্রের প্রকৃত ধারণাকে ধূলিস্যাৎ করে দেবার মাধ্যমে।
কিছুদিনের মধ্যেই লেনিন আইন জারি করেন যে শ্রমিকদের উপর নেতাদের “স্বৈরাচারী ক্ষমতা“ প্রয়োগ করতে হবে, আর শ্রমিকদের “একক ইচ্ছার অধীন হতে হবে বিনা বাক্যব্যয়ে“, এবং সমাজতন্ত্রের স্বার্থে তাদেরকে অতি অবশ্যই “শ্রম ব্যবস্থাপনার নেতৃবৃন্দের একক ইচ্ছাকে বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে চলতে হবে“। লেনিন ও ট্রটস্কি যখন শ্রমের সামরিকীকরণের দিকে এগিয়ে চলেছেন, পুরো সামজকেই শ্রমসেনায় রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া তাদের একক ইচ্ছার অধীন হয়ে পড়ে। লেনিন শ্রমিকদের “একক কর্তৃত্বের“ অধীন হয়ে পড়াকে ব্যাখ্যা করছেন, “এমন এক ব্যবস্থা হিসেবে যা মানবসম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারকে নিশ্চিত করে অন্য যেকোনো ব্যবস্থার চেয়ে আরও ভালোভাবে।“ অথবা রবার্ট ম্যাকনামারা যেভাবে ঠিক একই ধারণাকে প্রকাশ করেছেন, “গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার…অবশ্যই ঊর্ধ্বতনদের হাতে ন্যস্ত থাকবে…গণতন্ত্রের উপর প্রকৃত হুমকি উপর থেকে নিয়ন্ত্রণের কারণে আসে না, বরং তা আসে নিচ থেকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে“। “মানুষ যদি বুদ্ধির শাসনের অধীন না হয় তাহলে তার পূর্ণ সম্ভাবনা বিকশিত হয় না“, আর ব্যবস্থাপনা এই বুদ্ধির শাসন ছাড়া আর কিছুই না, যা কিনা আমাদের স্বাধীন রাখে। এর পাশাপাশি “ফ্যাকশনালিজমকে“, যেমন সামান্য পরিমাণ স্বাধীন মত ও সংগঠন যেগুলো ছিল সেগুলোকেও “সমাজতন্ত্রের স্বার্থে“ ধ্বংস করে দেয়া হয়। লেনিন ও ট্রটস্কি তাদের নিজেদের উদ্দেশ্যে সাধনের উদ্দেশ্যে এই পরিভাষাটার [সমাজতন্ত্র] সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছিলেন। তারা এগিয়ে যান প্রাক-ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বনিয়াদ প্রতিষ্ঠার দিকে, যা স্তালিনের হাতে পড়ে আধুনিক সময়ের অন্যতম একটি বিভীষিকাতে পরিণত হয়।[১]
সমাজতন্ত্রের প্রতি লেনিনবাদী বুদ্ধিজীবী শ্রেণির (নিসন্দেহে যার ভিত্তি হচ্ছে মার্ক্স) প্রচণ্ড শত্রুতা অনুধাবন করতে না পারা, এবং একই সাথে লেনিনবাদী নকশাটি ভালোমতো বুঝে না উঠার কারণে আরও মানবিক একটি সমাজ নির্মাণ ও পশ্চিমা বিশ্বে বসবাসযোগ্য একটি দুনিয়া তৈরির পথে আমাদের সংগ্রামকে ভয়াবহভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। শুধু যে পশ্চিমা বিশ্বই এই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তাও নয়। পৃথিবীর প্রধান দুটি শক্তিকেন্দ্রে বসে থাকা সমাজতন্ত্রের শত্রুদের হাত থেকে— যারা সবসময়ই রাষ্ট্রীয় পুরোহিত আর সমাজের কর্তাব্যক্তি হয়ে উঠতে চায়, যারা স্বাধীনতার নামে মানুষের মুক্তিকে ধ্বংস করতে চায়— তাদের হাত থেকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে রক্ষা করার উপায় খুঁজে বের করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে।
পাদটীকা
[১] লেনিন ও ট্রটস্কির হাতে সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক ধ্বংসসাধন প্রসঙ্গে, আরও বিভিন্ন কাজের মধ্যে এই বইটি দেখতে পারেন Maurice Brinton, The Bolsheviks and Workers’ Control. Montréal: Black Rose Books, 1978, and Peter Rachleff, Radical America, Nov. 1974.
নোট: লেখাটি Our Generation এর ১৯৮৬ সালের ১৭তম খণ্ডের ২য় সংখ্যায় প্রকাশিত। বর্তমান সংস্করণটি চমস্কির ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট অনুসরণে করা।