অনুবাদ: সারোয়ার তুষার
[প্রখ্যাত মার্কিন ইতিহাসবিদ ও গণ–বুদ্ধিজীবী হাওয়ার্ড জিনের মার্কস ইন সোহো নাটকের ভূমিকার বর্তমান অনুবাদটি করা হয়েছে Beacon Press, Boston কর্তৃক প্রকাশিত হাওয়ার্ড জিনের Three Plays: The Political Theater of Howard Zinn (2010) বই থেকে। – সম্পাদক]
মূল অনুবাদ:
আনুমানিক সতেরো বছর বয়সে আমি প্রথমবারের মতো কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো পড়েছিলাম। আমাদের শ্রমজীবী পাড়ায় তরুণ কমিউনিস্টদের অনেকে ছিলেন। খুব সম্ভবত তাদেরই কোনো একজনের কাছ থেকে আমি বইটা পেয়েছিলাম। বইটা পড়ে আমি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম। কারণ আমার নিজের জীবন, আমার বাবা–মা’র জীবন এবং ১৯৩৯ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক যে পরিস্থিতি আমি দেখেছি; ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং শক্তিশালী বিশ্লেষণের আলোকে, সেই পরিস্থিতিরই মোক্ষম ব্যাখ্যা যেন বইটাতে পাওয়া যাচ্ছে।
আমি দেখতে পাচ্ছিলাম মাত্র চতুর্থ শ্রেণি অব্দি পড়াশোনা করা আমার অস্ট্রীয় অভিবাসী বাবা প্রচণ্ড খাটাখাটনি করেও তাঁর স্ত্রী ও চার পুত্রকে খাওয়াতে–পরাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। আমি আরও দেখতে পাচ্ছিলাম আমাদের খাওয়া–পরা ও অসুখ–বিসুখ হলে সেবাযত্ন প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে আমার মা দিনরাত খেটে মরছেন। তাঁদের জীবন যেন টিকে থাকার এক নিরন্তর কুরুক্ষেত্র। ততদিনে আমাদের দেশেরই বিপুল সম্পদের মালিক লোকেদের কথা আমি জেনে গিয়েছিলাম, যারা নিশ্চিতভাবেই আমার বাবা–মার তুলনায় অনেক কম পরিশ্রম করতেন। ব্যবস্থাটা ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল না।
আকালের (depression) সেই কালে আমার চারপাশে দেখতে পাচ্ছিলাম দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত সব পরিবার। তাদের এই দারিদ্র্যের জন্য অবশ্য তারা নিজেরা দায়ী ছিল না। বাড়ি ভাড়া দিতে না পারার দরুন ভূ–স্বামী তাদের মালামাল বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। ভূ–স্বামীরা আইনের মদদপ্রাপ্ত। ততদিনে পত্রিকা পড়ার সুবাদে এও জেনে ফেলেছিলাম তামাম দেশে এই একই অবস্থা। আমি বেশ কড়া পাঠক ছিলাম। তেরো বছর বয়স থেকে শুরু করে ডিকেন্সের ম্যালা উপন্যাস সাবাড় করে ফেলেছিলাম। ডিকেন্স পাঠ আমার মধ্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সুতীব্র এক ক্রোধ উস্কে দিয়েছিল এবং মালিকশ্রেণি ও আইনি ব্যবস্থার দ্বারা লাঞ্ছিতদের প্রতি গভীর সহানুভূতির জন্ম দিয়েছিল। তারপর, ১৯৩৯ সালে এসে, জন স্টেইনবেকের The Grapes of Wrath পড়লাম এবং সেই সুতীব্র ক্রোধ আমার মনে ফিরে এলো। তবে এবারকার ক্ষোভ আমার নিজের দেশের ধনী ও ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে।
মেনিফেস্টোতে মার্কস ও এঙ্গেলস (মার্কসের বয়স ছিল তিরিশ, এঙ্গেলসের আটাশ এবং এঙ্গেলস পরবর্তীতে বলেছিলেন যে মূল রচয়িতা ছিলেন মার্কস) ঠিক সেই বর্ণনাই দিয়েছিলেন যা আমি পড়ছিলাম, আমার চারপাশে প্রত্যক্ষ করছিলাম। অর্থাৎ এটা উনিশ শতকের ইংল্যান্ড কিংবা আকালের যুগের মার্কিন মুল্লুকের বিশেষ কোনো বিপর্যয় ছিল না, এটা ছিল খোদ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তস্থিত অসারতা। এই ব্যবস্থাকে যদিও আধুনিক দুনিয়ায় ব্যাপক সুরক্ষা দিয়ে রাখা হয়, এটা কোনো শাশ্বত ব্যবস্থা নয়। ইতিহাসের সুনির্দিষ্ট পর্বে এর আবির্ভাব ঘটেছিল এবং এই ব্যবস্থাকে দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিয়ে সমাজতন্ত্রকে একদিন না একদিন পাওনা জায়গা দিতেই হবে। পুরো ভাবনাটা বেশ অনুপ্রেরণাদায়ক ছিল।
মার্কস ও এঙ্গেলস মেনিফেস্টো শুরু করেছেন এই ঘোষণার মাধ্যমে: “এখন পর্যন্ত বিদ্যমান তাবৎ সমাজের ইতিহাস আদতে শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস।” তার মানে হলো ধনী–গরিব ব্যক্তি হিসেবে না, শ্রেণি হিসেবে পরস্পরকে মোকাবেলা করে। এতে করে তাদের দ্বন্দ্ব বিরাট হয়ে ওঠল। এর ফলে এও পরিষ্কার হলো যে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আশা দুনিয়ার শ্রমিক মেহনতি মানুষদের একই পরিচয়ে আবদ্ধ করছে— তারা সকলেই শ্রমজীবী শ্রেণির অন্তর্গত।
এই শ্রেণি সংগ্রামে সরকার–রাষ্ট্রকে কী ভূমিকায় দেখা যায়? সমস্ত সরকারি ভবনের সম্মুখভাগের দেয়ালে খোদাই করা থাকে, “সকলের জন্য সমান ন্যায়বিচার।” এদিকে মেনিফেস্টোতে মার্কস ও এঙ্গেলস মহাশয় লিখে রেখেছেন, “আধুনিক রাষ্ট্রীয় পুরোহিতগণ গোটা বুর্জোয়া শ্রেণির সাধারণ স্বার্থ রক্ষার একটা কমিটি মাত্র।” তারা এখানে একটা পিলে–চমকানো ধারণা সমেত হাজির: সমস্ত ভানটান করার পরেও সরকার–রাষ্ট্র এগুলো আসলে ধনিক শ্রেণির খেদমতগারি করে মাত্র। রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো মোটেও নিরপেক্ষ ধাঁচের কিছু নয়।
সতেরো বছর বয়সে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম যে, এগুলো বেশ চমকপ্রদ ধারণা। আমার কমিউনিস্ট বন্ধুরা আমাকে টাইমস স্কয়ারের সমাবেশে নিয়ে গেল। শত শত মানুষ ব্যানার ঝুলিয়ে যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী পদযাত্রায় অংশ নিয়েছে। সাইরেনের ধ্বনি শুনতে পেলাম। অশ্বারোহী পুলিশ বিক্ষোভরত জনতার ওপর হামলে পড়লো। সাদা পোশাকধারী এক পুলিশের ডাণ্ডার আঘাতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পরে মাথা পরিস্কার হতেই কেবল একটা চিন্তাই মস্তিষ্ককে কুরে কুরে খাচ্ছিল: পুলিশ, রাষ্ট্র সব সম্পদওয়ালাদের তল্পিবাহক। আপনার কতটুকু জবানের স্বাধীনতা আর কতটুকু জমায়েতের স্বাধীনতা থাকবে তা মূলত নির্ভর করে আপনার শ্রেণি অবস্থানের ওপর।
আঠারো বছর বয়সে ব্রুকলিনের এক জাহাজ নির্মাণ কারখানায় শিক্ষানবিশ মেরামতকারী হিসাবে কাজ করতে গেলাম। আমার কাজ ছিল যুদ্ধ জাহাজের বহিরাঙ্গে ঢালাই এর মাধ্যমে ইস্পাতের প্লেট লাগানো। ততদিনে আমি বেশ “শ্রেণি–সচেতন”। জাহাজ মেরামতের কাজে গিয়ে আমার মতো আরও তিনজন তরুণ শ্রমিক জুটিয়ে ফেললাম। আমরা চারজনে মিলে এমনসব শিক্ষানবিশ শ্রমিকদের সংগঠিত করতে শুরু করলাম যাদের কিনা জাহাজ–শিল্প ইউনিয়ন থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। আমরা আরও ঠিক করলাম যে, সপ্তাহান্তে আমরা জড়ো হবো এবং মার্কস ও এঙ্গেলসের রচনাদি পড়বো।
এভাবেই মার্কসবাদী দর্শন সম্পর্কে এঙ্গেলসের ব্যাখ্যার সাথে পরিচিত হলাম তাঁর অ্যান্টি–ড্যুরিং বইয়ের মাধ্যমে। বইটা ছিল ড্যুরিং নাম্নী একজন দার্শনিকের সাথে এঙ্গেলসের যুক্তি–তর্ক। তারপর কায়ক্লেশে Das Kapital-এর প্রথম খণ্ডটুকুও পড়ে শেষ করলাম। চরম উত্তেজনাসহ খেয়াল করলাম ব্যবস্থাটা যেন আমার সামনে নাঙ্গা হয়ে গেছে। সমস্ত ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জটিলতার আড়ালে গোড়ার সত্যটা হলো: সমস্ত মূল্যের উৎস মূলত শ্রম। অল্প মজুরির তুলনায় শ্রম অনেক বেশি মূল্য উৎপাদন করে এবং ধনিক শ্রেণি সেই উদ্বৃত্ত মূল্যটাই পকেটস্থ/আত্মসাৎ করে। পুঁজিবাদের বেকারত্ব দরকার যেন সবসময় মজুরি কমিয়ে রাখা যায়; শ্রমিকদের রিজার্ভ আর্মি। এই ব্যবস্থা পণ্য–সামগ্রীর, বিশেষত টাকার (“পণ্য–পূজা”), যতটা খায়খাতির করে মানুষের ততটা করে না। সুতরাং বিনিময় মূল্য দিয়ে জীবনে কি ভালো আর কি মন্দ তার পরিমাপ চলে।
মার্কসবাদী তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে যে শোষণ ও শ্রেণি–সংগ্রাম দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল কোনো ঘটনা নয়। তবে পুঁজিবাদ একে তীব্রতম বিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছে এবং একটা বৈশ্বিক মাত্রায়। মানব বিকাশের একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত ইতিহাসে পুঁজিবাদ একটা প্রগতিশীল শক্তি হিসাবেই অস্তিত্বশীল ছিল। মেনিফেস্টোর ভাষ্য অনুযায়ী: “ঐতিহাসিকভাবে বুর্জোয়ারা বেশ বিপ্লবী ভূমিকাই পালন করেছে।” এরা ব্যাপক মাত্রার প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি সাধন করেছে এবং অঢেল সম্পদ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু সেই সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়েছে অতি গুটিকয়েকের হাতে। ক্রমবর্ধমান গতিতে সংগঠিত উৎপাদিকা শক্তি এবং বিশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থাপনার মধ্যে একটা মৌলিক দ্বন্দ্ব ছিল। এক পর্যায়ে এসে শোষিত সর্বহারা শ্রেণি সংগঠিত হয়ে বিদ্রোহ করবে এবং ক্ষমতা দখল করবে। এর ফলে পুঁজিবাদী শ্রেণির রমরমার বদলে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর নিমিত্তে অগ্রসর প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে।
মার্কসের সাথে এই ছিল আমার শুরুর দিককার মোলাকাত। কয়েক বছর বাদে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অষ্টম বিমান বাহিনীতে বোমা–নিক্ষেপকারীর কাজ করলাম। জি. আই. বিলের সহায়তায় স্কুল–কলেজের পর্ব ডিঙিয়ে গ্র্যাজুয়েট হলাম। তারপর আমার স্ত্রী ও দুই সন্তানের সহায়তায় প্রথমে দক্ষিণের স্পেলম্যান কলেজে ইতিহাস ও রাজনীতি শাস্ত্র পড়াতে শুরু করলাম। স্পেলম্যানে সাত বছর কাটানোর পর বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি গ্রহণ করার মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলে থিতু হলাম। আমার পড়ানো রাজনৈতিক তত্ত্ব কোর্সে আমি মার্কস ও এঙ্গেলসের রচনাদিতে গভীরভাবে মনোনিবেশ করলাম।
১৯৬০-এর শেষের দিকে বেশ কিছু কারণে আমি নৈরাজ্যবাদের দিকে ঝুঁকতে শুরু করলাম। তন্মধ্যে একটা কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্রমবর্ধমান স্ট্যালিনবাদী বিভীষিকার নজির। এর ফলে ধ্রুপদী মার্কসবাদের ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটির পুনর্মূল্যায়নের জরুরত দেখা দিলো। আরেকটা কারণ ছিল দক্ষিণাঞ্চলের বর্ণবাদ–বিরোধী লড়াই–এ আমার অভিজ্ঞতা। এই লড়াইয়ে সামনে ছিল অহিংস ধারার শিক্ষার্থীদের কো–অর্ডিনেশন কমিটি (এসএনসিসি ওরফে “স্নিক” নামে যেটি পরিচিত ছিল)। কোনো প্রকারের সচেতন তত্ত্বায়ন ছাড়াই এই আন্দোলন নৈরাজ্যবাদী নীতিতে ক্রিয়াশীল ছিল: কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ ছিল না, তৃণমূলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি। ১৯৬০-এর দিককার নব্য–বামপন্থীরা এর নাম দিয়েছিল “অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র”।
নৈরাজ্যবাদ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে দিলাম। শুরুতেই মার্কিন নৈরাজ্যবাদী–নারীবাদী এমা গোল্ডম্যান ও তাঁর বন্ধু আলেক্সান্ডার বার্কম্যান পড়তে থাকলাম। পিওতর ক্রপোৎকিন ও মিখাইল বাকুনিনও পড়লাম। বিপ্লবের তরিকা প্রশ্নে বাকুনিন ছিলেন কট্টর মার্কস–বিরোধী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরোধিতা করার কারণে ১৯১৯ সালে এমা গোল্ডম্যান আমেরিকা থেকে বিতাড়িত হয়ে রাশিয়ায় পাড়ি জমান। সেখানে তিনি লক্ষ্য করলেন যে সদ্যজাত সোভিয়েত রাষ্ট্র কেবল বুর্জোয়া বিরোধিদেরকেই নয়; বরং ভিন্নমতাবলম্বী বিপ্লবীদেরও কারাবন্দি করছে। সমাজতান্ত্রিক স্বপ্নের সঙ্গে এই চরম গাদ্দারি ঘটতে দেখে এমা ক্ষমতাসীন বলশেভিক দল ও নেতৃবৃন্দের কড়া সমালোচনা করলেন। নৈরাজ্যবাদী চিন্তা–ভাবনার দিকে আমার এই নিমজ্জন আমাকে বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে “মার্কসবাদ ও নৈরাজ্যবাদ” বিষয়ে সেনিমার আয়োজনে উদ্বুদ্ধ করলো।
১৯৬৫ থেকে (এই বছর ভিয়েতনামে যুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করেছিল) ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত (এ বছর সাইগন সরকার আত্মসমর্পণ করেছিল) সময়টাতে আমি যুদ্ধ–বিরোধী আন্দোলনে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম এবং ওই সময়ে আমার যাবতীয় লেখাজোখাও ছিল যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। যুদ্ধ থামার পরেই কেবল আমি অন্যান্য বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারছিলাম। এমা গোল্ডম্যানকে নিয়ে এমা নামে একটা নাটক লিখে ফেললাম এবং নাটকটা প্রথমে বস্টন, নিউইয়র্ক, কয়েক বছর বাদে লন্ডন ও টোকিওতে মঞ্চস্থ হয়েছিল। নাটকের একটা দৃশ্য ছিল এমন: নিউইয়র্কের তরুণ বিপ্লবীরা একটা ক্যাফেতে বসে মার্কস বনাম বাকুনিন তুমুল তর্কে মেতে ওঠেছে।
এই চিন্তকদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমি খুবই আগ্রহী ছিলাম। এমা গোল্ডম্যানের আত্মজীবনী Living My Life বইটি তাঁর ঝটিকাসঙ্কুল বিদ্রোহী রাজনৈতিক ও যৌনজীবনের অকপট বিবরণীতে ঠাসা। মার্কস কখনোই কোনো আত্মজীবনী লেখেননি। তবে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ধারণা পেতে বেশ কিছু জীবনীগ্রন্থ আমাকে পড়তে হয়েছে। মার্কস তনয়া এলিয়েনরকে নিয়ে চমৎকার একটি বই লিখেছেন ইংরেজ লেখক ইভান কাপ। এই বইয়ে লন্ডন নিবাসী মার্কস পরিবারের বিস্তারিত বিবরণ আছে।
ইউরোপের একের পর এক দেশ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে মার্কস ও জেনি লন্ডনে আশ্রয় নেন। ঘিঞ্জি সোহো অঞ্চলে তাঁদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছিল। তামাম ইউরোপের বিপ্লবীরা লন্ডনে এসেই মার্কস–জেনির ডেরায় ঢুঁ মারতো। ঘরোয়া পরিস্থিতিতে জেনি ও এলিয়েনরের সঙ্গে মার্কসের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের কল্পিত দৃশ্য আমাকে অভিভূত করতো। এমা নাটকটা নিয়ে আমার সুখকর অভিজ্ঞতা আমাকে থিয়েটারের দুনিয়ায় ঢুকতে প্রলুব্ধ করেছিল এবং আমি কার্ল মার্কসকে নিয়ে একটা নাটক লিখতে শুরু করলাম। লোকে চেনে না এমন এক মার্কসকে আমি তুলে ধরতে চাইলাম। একজন গৃহী মানুষ যিনি বউ–সংসার–সন্তানাদির ভরণপোষণ করতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন; যার তিনটা বাচ্চা অকালে মারা গেছে। তিন কন্যা বেঁচে আছে।
আমি দর্শকদের দেখাতে চাইছিলাম যে, মার্কস তাঁর চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে হওয়া সাঁড়াশি আক্রমণ মোকাবেলা করছেন। আমি জানতাম তাঁর স্ত্রী জেনি নিজে একজন সমীহ–জাগানিয়া চিন্তক ছিলেন এবং কল্পনা করতে চাইলাম যে তিনি আকসার/হরদম মার্কসকে মোকাবেলা করছেন। আমি আরও জানতাম এলিয়েনর একটা অকালপক্ব অসম্ভব প্রতিভাবান বাচ্চা ছিল, যে কিনা প্রায়ই মার্কসের নিগূঢ় তত্ত্বসমূহ চ্যালেঞ্জ করে বসতো। আমি চাইছিলাম মার্কসের প্রধান ধারণাগুলো নৈরাজ্যবাদী পর্যালোচনার অধীনে আসুক এবং এজন্যই মার্কসের বাড়িতে বাকুনিনের আগমনের ঘটনা সাজানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। (আদতে বাস্তবে বাকুনিনের মার্কসের বাড়িতে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনার নজির নেই; তবে বাকুনিন ও মার্কস পরস্পরের বেশ ভালো জানাশোনা ছিলেন। শ্রমজীবিদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ফার্স্ট ইন্টারন্যাশনালে তাঁরা একে অপরের চরম বিরোধী ছিলেন।)
মার্কস বিষয়ক সাধারণ মূল্যায়নে আমি বরাবরই একটা দিকের অভাববোধ করতাম। সবসময় চিন্তক ও তাত্ত্বিক মার্কসকে ঘিরেই বেশি আলোচনা হতো। কিন্তু আমি জানতাম একজন বিপ্লবী হিসেবে মার্কসের সক্রিয়তা ছিল তাক লাগানোর মতো; প্রথমে জার্মানিতে ছিলেন প্রতিবাদী সাংবাদিক, তারপর প্যারিসে শ্রমিক সংঘে ও ব্রাসেলসের কমিউনিস্ট লীগে। ১৮৪৮ সালের ইউরোপীয় বিপ্লবের যুগে তিনি রাইনল্যান্ডে সক্রিয় ছিলেন, যার ফলে তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। আদালতে এক নাটকীয় বক্তৃতা দিয়ে সে যাত্রায় তিনি পার পেয়েছিলেন। লন্ডনে হিজরত করার পর তিনি আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সংঘের সাথে জড়িত হলেন আইরিশ মুক্তি আন্দোলনের সমর্থনে। ১৮৭১ সালে মার্কস প্যারি কমিউনের সমর্থনেও সক্রিয় ছিলেন।
সেই সময়ে মার্কস কেবল Das Kapital-এর মতো রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ক তাত্ত্বিক রচনাই লেখেননি। পাশাপাশি ১৮৪৮ এর বিপ্লব, প্যারি কমিউন, মহাদেশজুড়ে শ্রমিক সংগ্রামের মতো রাজনৈতিক ঘটনাবলির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, সংগঠিত করেছেন। সুতরাং আমি মঞ্চে মার্কসের এই অন্য দিকটা তুলে ধরতে চাইলাম— একজন ত্যাগী ও সংলিপ্ত বিপ্লবী। আমার লেখা নাটকের কুশীলব হিসাবে ছিল মার্কস নিজে, তাঁর স্ত্রী জেনি, মেয়ে এলিয়েনর, বন্ধু এঙ্গেলস ও তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বাকুনিন। বস্টনে নাটকটা সাদরে গৃহীত হয়েছিল, কিন্তু আমার মধ্যে একটা খচখচানি থেকেই গেল। এরপর আমি নাটকটাকে একক চরিত্র নির্ভর নাটক বানিয়ে ফেললাম।
আমার স্ত্রী রোজলিন বরাবরই আমার লেখাপত্রের একজন আন্তরিক সমালোচক। সে আমাকে ক্রমাগত খোঁচাতে থাকল আমি যেন নাটকটাকে উনিশ শতকের ইউরোপ ও মার্কসের গণ্ডিতে আবদ্ধ না করে একে আমাদের বর্তমান সময়ের সাপেক্ষে আরও প্রাসঙ্গিক ও সমসাময়িক করে তুলি। আমার মনে হলো রোজলিন মোক্ষম বুদ্ধিটাই দিয়েছে। অগত্যা আদি পাণ্ডুলিপিটার সাথে বেশ কসরত করে শেষতক এই ফন্দি আঁটলাম যে মার্কস যেখানেই থাকুন না কেন, বর্তমান সময়ে প্রত্যাবর্তন করবেন। শুধু তাই নয়, তিনি ফিরবেন মার্কিন মুল্লুকে। ফলে তিনি উনিশ শতকের ইউরোপে তাঁর জীবন নিয়ে স্মৃতিচারণের পাশাপাশি ঘটনাবহুল বর্তমান প্রসঙ্গেও কথা বলবেন। সিদ্ধান্ত নিলাম নাটকে কোনো এক কর্তৃপক্ষের প্রসঙ্গ রাখবো যাদের আমলাতান্ত্রিক গলদের কারণে লন্ডনস্থ সোহোর বদলে তারা মার্কসকে পাঠিয়ে দেবেন নিউইয়র্কস্থ সোহোতে।
একক চরিত্র নির্ভর নাটক হলেও, স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে মার্কস তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোকেও জীবিত করে তুলবেন; বিশেষত তাঁর স্ত্রী জেনি, তনয়া এলিয়েনর। নৈরাজ্যবাদী বাকুনিনকেও মার্কস ফিরিয়ে আনবেন। তাঁরা প্রত্যেকেই নানাভাবে মার্কসের চিন্তাগুলোকে নির্মম সমালোচনার মুখোমুখি করবে। খোদ মার্কসই তাঁর যুক্তি–তর্কগুলোতে পুনরায় আলোকপাত করবেন এবং পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে দ্বান্দ্বিকতা সৃষ্টি হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কালে আমি নাটকটা লিখেছিলাম। তখন মূল ধারার সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক নেতাদের উচ্ছ্বাস যেন উপচে পড়ছিল: শুধু ‘শত্রু’ই বিদায় নেয়নি, মার্কসবাদের আবেদনও যেন ফুরালো। পুঁজিবাদ ও ‘মুক্ত বাজার’ জয়লাভ করেছে। মার্কসবাদ ব্যর্থ। মার্কস যেন সত্যি সত্যিই মৃত। ফলে আমি ভাবলাম কয়েকটা জিনিস পরিষ্কার করা দরকার: সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা নিজেদের ‘মার্কসবাদী’ হিসাবে পরিচয় দেয়া অপরাপর রাষ্ট্র যেগুলো কিনা নিজ নিজ দেশে পুলিশি রাষ্ট্র কায়েম করেছে, তারা কেউই মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক ধারণার প্রতিনিধিত্ব করে না। আমি দেখাতে চেয়েছিলাম যে মার্কস তাঁর তত্ত্বের ভয়াবহ বিকৃতি দেখে যারপরনাই ক্ষুব্ধ। সেই বিকৃতি এতটাই যে স্ট্যালিনবাদী বর্বরতাকেও মার্কসবাদের নামে চালানো হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নজিরবিহীন জুলুমতন্ত্র কায়েম করা ভুয়া–সমাজতন্ত্রীদের খপ্পর থেকে তো বটেই; এমনকি পশ্চিমা যে সকল লেখক ও রাজনীতিবিদ পুঁজিবাদের ‘বিজয়ে’ বেশ গদগদ, এদের হাত থেকেও মার্কসকে হেফাজত করার প্রয়োজন অনুভব করলাম। আমি দেখাতে চেয়েছিলাম যে, মার্কসের পুঁজিবাদ বিষয়ক সমালোচনা আজতক মৌলিকভাবে সঠিক। দৈনিক পত্রিকার শিরোনামসমূহ দৈনিক তাঁর বিশ্লেষণের যথার্থতার পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। মার্কস তাঁর সময়ের প্রাযুক্তিক ও সামাজিক পরিবর্তনের যে বিশৃঙ্খলা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তা বর্তমান সময়ে যেন আরও প্রকট বাস্তব। মেনিফেস্টোতে মার্কস ও এঙ্গেলস বলছেন:
উৎপাদনের বিরামহীন বিপ্লবীকরণ, সমস্ত রকমের সামাজিক অবস্থার নির্বিঘ্ন গোলমাল, চিরস্থায়ী অনিশ্চয়তা ও নিরন্তর ক্ষোভ বুর্জোয়া যুগকে পূর্বের যে–কোনো যুগ থেকে আলাদা করে। জগদ্দল পাথরের ন্যায় জমাট–বাঁধা সম্পর্কপ্রণালী ও তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সনাতনি কুসংস্কার, মতামতকে স্রেফ ধুয়েমুছে সাফ–সুতরো করা হয়। নবগঠিত কোনো কিছু পোক্ত হবার আগেই সেকেলে হয়ে ওঠে। যা কিছু কঠিন, মিলিয়ে যায় বাতাসে।
আমরা আজ যাকে ‘গ্লোবায়ন’ (globalization) বলি, মার্কস তার পরিষ্কার ইশারা দিয়েছিলেন। আরও একবার মেনিফেস্টোর উদ্ধৃতি:
নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের জন্য সদা–প্রসারিত বাজারের খোঁজে বুর্জোয়াদের বিশ্বের প্রত্যেক প্রান্ত চষে বেড়াতে হয়। সবখানে তাদের বাসা বাঁধতে হয়, থিতু গাড়তে হয় এবং সবখানে সম্পর্ক পাতাতে হয়।… পূর্বের স্থানীয় ও জাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার স্থলে বিশ্বের জাতিসমূহের অবাধ লেনদেন ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার এ এক সর্বজনীন বন্দোবস্ত।
মার্কিন সরকারের চাওয়া “মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি” মূলত বিশ্বময় পুঁজির নিরবিচ্ছিন্ন বিচরণের ক্ষেত্রে শেষ বাধাটুকু অপসারণ করার খায়েশ ছাড়া আর কিছু নয়। এর ফলে পুঁজিবাদীরা বিশ্বের সর্বত্র জনসাধারণকে চুষে ছিবড়ে বানানোর ‘বৈধ’ অধিকার পাবে।
নাটকের চরিত্র মার্কস হালের পত্রিকার শিরোনাম পড়ে একেবারেই বিচলিত হন না। অতিকায় কোম্পানিগুলো মার্কসের সময়েও একীভূত হচ্ছিল, হাল আমলে তা আরও বিরাট আকারে হচ্ছে এই যা। তিনি বড়লোক আর গরিবের মধ্যকার ব্যবধান দেখেছিলেন, সেই ব্যবধান বর্তমানে শুধু দেশের অভ্যন্তরে হয় না, তা আজ আরও হতবুদ্ধিকরভাবে ধনী ও গরীব দেশের জনগণের মাঝে বেড়ে চলেছে।
নাটকে মার্কস সমাজতন্ত্রের পুঁজিবাদী রূপ ধারণ করার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। ভুয়া–সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রেজিম–বিরোধীদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো দেখে তিনি ১৮৫৩ সালে নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন–এ অপরাধ ও শাস্তি ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর লেখার স্মরণ করছেন:
অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝোলানো জল্লাদের বন্দনায় মেতে উঠার চেয়ে বরং যে ব্যবস্থা অপরাধ ও অপরাধীর বারংবার জন্ম দেয়, সেই ব্যবস্থাকে পাল্টানোর চেষ্টা করার জরুরতটাই কি বেশি না?
এমন এক সমাজে আমাদের বসবাস যাকে মার্কসের ‘পণ্য পূজা’ কথাটার মাধ্যমে যুতসইভাবে ধরা যায়। মার্কসের সমসাময়িক রালফ ওয়ালডো এমার্সন মার্কিন শিল্প ব্যবস্থার শুরু দেখে বলেছিলেন, “পণ্য–সামগ্রীই যেন মানুষ নামক ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়েছে।” মানুষের জানের সুরক্ষার চেয়ে কর্পোরেট সম্পত্তির সুরক্ষা প্রদানই অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতিয়মান হয়। উনিশ শতকের শেষ ভাগে সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে কর্পোরেশন হচ্ছে “একজন ব্যক্তি” এবং চতুর্দশ সংশোধনী মোতাবেক সুরক্ষার দাবিদার। এই সুরক্ষা কালো মানুষদের চেয়ে বেশি সুরক্ষা, যদিও সংশোধনীটির উদ্দেশ্য ছিল কালোদের রক্ষা করা।
২৫ বছর বয়সে স্ত্রী জেনিসহ প্যারিস নিবাসী মার্কস দুর্দান্ত এক ডকুমেন্ট লেখেন, যেটা তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পরে ছাপা হয়েছিল। দ্যা ইকনমিক এন্ড ফিলসফিকাল ম্যানুস্ক্রিপ্ট। এই লেখায় মার্কস আধুনিক জমানার মানুষের বিচ্ছিন্নতা নিয়ে লিখেছেন, পুঁজিবাদ যাকে চূড়ান্ত বিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছে। মানুষ তার শ্রম, প্রকৃতি, একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন এবং নিজের প্রকৃত সত্তার বিযুক্ত থেকে যায়। আমাদের সময়ে আমাদের চারপাশে আমরা এই তো ঘটতে দেখি এবং এর ফলে মনস্তাত্ত্বিক ও বস্তুগত দুর্দশা কায়েম হতে দেখি।
মার্কস তার লেখালেখির বড় অংশটাই বরাদ্দ করেছেন পুঁজিবাদের মোক্ষম সমালোচনা খাড়া করার পেছনে। ফলে সমাজতান্ত্রিক সমাজের চেহারা কেমন হতে পারে তিনি তা খুব সামান্যই বলতে পেরেছেন। তবে পুঁজিবাদ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য থেকে আমরা আমাদের মতো করে শোষণহীন সমাজ কল্পনা করতে পারি। যেখানে মানুষ প্রকৃতি, নিজের কাজ ও অন্য মানুষের সাথে একইভাবে অঙ্গীভূত থাকতে পারবে। ১৮৭১ সালে ক্ষণস্থায়ী প্যারি কমিউনে সৃষ্ট সমাজের উজ্জ্বল বর্ণনা দিতে গিয়ে মার্কস যা বলেছেন, তাতে সেই ভবিষ্যতের ইশারা পাওয়া যায়। এই নাটকে আমি সেই রূপকল্পকেই মূর্ত করার চেষ্টা করেছি।
মার্কস ইন সোহোর পাঠকেরা ভাবতে পারেন এই নাটকটা ঐতিহাসিকভাবে কতটা নির্ভুল? মার্কসের জীবনের মূল ঘটনাসমূহ এবং তাঁর সময়ের যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে তা মৌলিকভাবে সত্য: মার্কস ও জেনির বিয়ে, লন্ডনে হিজরত, তিন সন্তানের মৃত্যু। আরও সত্য সেই সময়ের রাজনৈতিক সংঘাতের চিত্র: আইরিশদের ইংল্যান্ড–বিরোধী সংগ্রাম, ইউরোপে ১৮৪৮-এর বিপ্লব, কমিউনিস্ট আন্দোলন, প্যারি কমিউন। মার্কস যে সকল চরিত্রের কথা বলেছেন, তারাও সত্য: তাঁর পরিবারের সদস্যরা, তাঁর বন্ধু এঙ্গেলস, চিরবৈরী বাকুনিন। সংলাপগুলো অবশ্য আমি বানিয়েছি; তবে আমি চরিত্রদের ব্যক্তিত্ব ও চিন্তার মূলানুগ থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। তবে এটা স্বীকার করতে হবে যে জেনি ও এলিয়েনরের সাথে মার্কসের মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব কল্পনা করার ক্ষেত্রে কিছুটা রচয়িতার স্বাধীনতা গ্রহণ করেছি। তৃতীয় নেপোলিয়নের বর্ণনার ক্ষেত্রে আমি হুবুহু মার্কসের কথাই ব্যবহার করেছি।
আমি প্রত্যাশা করি মার্কস ইন সোহো কেবল মার্কসের সময়ে মার্কসের ভূমিকার দিকেই আলো ফেলবে না; বরং, আমাদের সময়ে আমাদের ভূমিকা বিচারেও কাজে আসবে।