অরাজ
প্রচ্ছদ » জাতীয়তাবাদ, আইকনপ্রতিষ্ঠা এবং র‍্যাডিক্যালাইজেশনের রাজনীতি : অধ্যাপক ইউনূসের নোবেলপ্রাপ্তির  প্রেক্ষাপটে

জাতীয়তাবাদ, আইকনপ্রতিষ্ঠা এবং র‍্যাডিক্যালাইজেশনের রাজনীতি : অধ্যাপক ইউনূসের নোবেলপ্রাপ্তির  প্রেক্ষাপটে

  • মানস চৌধুরী

 পূর্বকথা ও প্রেক্ষাপট

১৯৯৪ এবং ১৯৯৮ – পশ্চিমবাংলার জন্য এই দুই তাৎপর্যপূর্ণ কালের বা সালের সমকালেই আমার কোলকাতা যাওয়া হয়েছিল। আমার সফর দুটো একেবারেই কাকতালীয়। অন্তত তাৎপর্যসমূহের সঙ্গে মিলিয়ে ছিল না। আবার, কোনোকিছু উপলব্ধি করতে সশরীর হাজির থাকতে হয়, সামাজিক বিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে তা আমি মনেও করি না। তথাপি, এই সফর দুটো আমাকে এমন কিছু বিষয়ে ওয়াহিবহাল করেছিল যা অন্যসূত্রে জ্ঞাত হওয়া আয়াসসাধ্য হতে পারত। ১৯৯৪-এ সুস্মিতা সেন মিস ইউনিভার্স নির্বাচিত হন। এই নবলব্ধ মর্যাদাসমেত তাঁর সফর করতে হয়েছিল কোলকাতা, এমন এক শহর যার সঙ্গে সুস্মিতা সেনের নিজ-সম্পর্ক-নির্ধারণ প্রায় প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয় হয়ে পড়েছিল যদি না খোদ পশ্চিমবাংলার কাণ্ডারীরাই তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ডেকে বসতেন। এই ডাক তামাম কোলকাতা নগরীতে হাঁকডাকে রূপান্তরিত হয়েছিল। কথিত যে, কোলকাতার শোভাযাত্রায় শকটের উপর দাঁড়িয়ে সুস্মিতা সেনকে হাত নাড়তে নাড়তে সম্ভাব্য সকল রাস্তায় ঘুরতে হয়েছে। তা তিনি উপভোগ করে থাকুন আর নাই থাকুন। তুলনায়, ১৯৯৮ সালে অমর্ত্য সেনের নোবেলপ্রাপ্তিতে উদ্যাপন, বা তাঁকে অধিগ্রহণ, তাঁর জন্য অনেক অনায়াস অনুষ্ঠানসূচিতে সীমিত ছিল। তা তিনি সমরূপ একটা কর্মসূচির জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে থাকুন আর নাই থাকুন। আমি নিঃসংশয়ী নই এই উচ্ছ্বাসকে জাতীয়তাবাদের অনুষঙ্গ হিসেবে পাঠ করা সঙ্গত, নাকি রাষ্ট্রবাদের। এ ব্যাপারেও আমি অনিশ্চিত যে উত্তর-ঔপনিবেশিক স্থাপিত-রাষ্ট্রকাঠামোতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ, এবং অন্বেষ, আদতেই রাষ্ট্রবাদী হওয়া ব্যতিরেকে সম্ভব কিনা। যাহোক, উভয়ক্ষেত্রেই অর্জনের ঘটনাকে ঘিরে যে উচ্ছ্বাস তার প্রধান অধিকর্তা আমলাতান্ত্রিক কাঠামো হওয়াতে ‘জানগণিক’ উৎসবমুখরতার সঙ্গে এর সম্পর্ক অনায়াস ও সাবলীল ছিল।

অধ্যাপক ইউনূসের নোবেলপ্রাপ্তি বাংলাদেশে সমরূপ উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করেছে, আপাতঃভাবে তা বলা যায়। কিন্তু পশ্চিমবাংলার উদাহরণের প্রেক্ষিতেই, একটা সূক্ষ্ম গুণগত পার্থক্য ঘটনাটিকে আরও স্বাতন্ত্র্য প্রদান করেছে। এই বৈশ্বিক অর্জনের পর চটজলদি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক কাঠামো খুব অনায়াসেই একটা উৎসবমুখরতার পরিকাঠামো প্রস্তাব করতে পারেনি। নিবিষ্টপাঠে এর নানাবিধ প্রকরণ ও কারণ হাজির করা সম্ভব। সংক্ষেপে, রাষ্ট্রক্ষমতার সংসদীয় লড়াইয়ে সামিল দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যকার সম্পর্ক নির্বাচনের সময়কালে চরম ও স্থূল আকার ধারণ করেছে এবং অধ্যাপক ইউনূসের নোবেলপ্রাপ্তির কাল এই সময়ের সঙ্গে মিলে যাওয়াতে একটা ভিন্নতা তৈরি হয়েছে। সেটা, পরিশেষে, ঘটনাচক্রীয়।

এই উচ্ছ্বাসটি এর গঠনপ্রক্রিয়া বিচারেই প্যারাডক্সিক্যাল বা বিষমসঙ্গতিময়, বিশেষত আলাপপ্রসঙ্গটি যদি হয় খোদ এই উচ্ছ্বাসের প্রকরণগত কারিগরি নিয়েই। ভেঙে বললে, বর্তমান নাতিদীর্ঘ লেখাটি তদন্ত করতে চাইছে এই উচ্ছ্বাসের, উৎসবমুখরতার বুনিয়াদ নিয়ে। এবং অন্যদিকে, এই উচ্ছ্বাস ও আবেগপ্রবণতা এরকম যেকোনো উদ্যোগকে ঝুঁকির মুখোমুখি করে; এরকম একটি রচনাপ্রচেষ্টা গৃহীত হতে পারে ‘জানগণিক’ অনুভূতিকে ও অর্জনকে খাট করবার প্রয়াস হিসেবে। সেসব সমেতই, এই রচনায় বক্তব্য মূলত তিনটি: এক, আইকনপ্রতিষ্ঠা হালের জাতীয়তাবাদী প্রবণতায় কেন্দ্রীয়; দুই, নোবেলপ্রাপ্ত অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশ পরিমণ্ডলে পূর্বাপেক্ষা অধিকতর সমর্থ আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন; তিন, এই প্রক্রিয়ার একটি অন্যতম দিক হলো তাঁর কর্মকাণ্ডকে, বিশেষভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির কথাই হচ্ছে, র‌্যাডিক্যাল হিসেবে ইঙ্গিত  করা হচ্ছে এবং সেই প্রবণতাটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পঠনপাঠনকে আরও কঠিন করে তুলছে।

 

বাংলাদেশে আইকন

এটা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা দরকার যে বাংলাদেশে আইকন-প্রতিষ্ঠা, বিশেষত রাজনৈতিক অঙ্গণের বাইরে এবং ‘অ-রাজনৈতিক’ আকিকায়, স্পষ্টভাবে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। এটা বলবার সময়ে অন্তত কয়েকটা বিষয়ে আমি সতর্ক আছি: এক, রাজনৈতিক অঙ্গণের আইকন ও সেগুলোর নির্মাণপ্রক্রিয়া সমরূপ নয়; দুই, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বিস্তর ফারাক আছে এবং সেটা আইকন সূত্রমালার ক্ষেত্রেও যথার্থ; তিন, সাধারণভাবে পাশ্চাত্যীয় বা অধিকতর ভোগসংস্কৃতির সমাজের সঙ্গে ফারাকটা আরও সুস্পষ্ট এবং অর্থবহ।

আইকন-সৃষ্টিতে মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে আলাদা করে বিবরণী খাড়া করবার এখানে আবশ্যকতা নেই। এটা নেহায়েৎ সাধারণ জ্ঞানের পর্যায়ে পড়ে এখন যে মিডিয়ার ভূমিকা দৃশ্য-শ্রুতিগত পুঁজিবাদী জমানায় নিরঙ্কুশ। আইকনের সৃষ্টি, ভোগসম্পাদন, পুনর্সৃজন, রূপান্তর এবং বিনাশ (তাত্ত্বিক অনুকল্পীয়ভাবে) সম্ভব কেবলমাত্র মিডিয়ার একচেটে কর্তৃত্বের মধ্যেই। পাশ্চাত্যীয় সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাপনায়, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ভারতের মতো শক্তিমান মিডিয়ারাজ্যে, যাকে সেলেব্রিটি বলা হয়ে থাকে সেটার সঙ্গে আইকনের সম্পর্ক কী তা নিয়ে সঙ্গত কারণেই চিন্তা করতে হয়েছে এই প্রসঙ্গে আলাপ তুলতে গিয়ে। চিত্তাকর্ষক যে, এই ভাবনার অনুবর্তী হিসেবে একটা প্রস্তাবনা দাঁড় করাতে আমি উৎসাহ বোধ করছি। সেটি হচ্ছে: সেলেব্রিটি উৎপাদন প্রক্রিয়ার পাটাতন আইকন সৃষ্টিতে গুরুতর ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে; এবং একই সঙ্গে এই উৎপাদন প্রক্রিয়ার ঘনত্ব আইকন-বিনাশের কারণ হতে পারে- তা সে আনমনেই হোক আর কৃৎকৌশলে সাধিত হোক। এসব কথার গুরুত্ব এখানেই যে বাংলাদেশের মিডিয়া উৎপাদন প্রণালী, এখন অবধি, সেলেব্রিটি তৈরি করতে পারঙ্গম হয় নাই। পাশ্চাত্যের তুলনায় তো বটেই, কিন্তু অন্তত ভারতের তুলনায়ও।

ভারতের বিষয়টাকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করবার আছে। মুম্বই চলচ্চিত্র কারখানা এবং ভারতীয় ক্রিকেট যুগপৎ মিথোজীবিতার মধ্য দিয়ে সেলেব্রিটি উৎপাদনের মুখ্য চালিকাশক্তি থেকে গেছে কম করেও ৫০ বছর। স্পষ্ট করে বললে, হালের ক্রিকেট বিপণনের উত্তুঙ্গ গ্লোব্যাল প্রচেষ্টার ঢের ঢের আগে থেকেই ক্রিকেট ছিল অন্যতম সেলেব্রিটি পরিক্ষেত্র। অন্যদিকে, লক্ষ্ণৌ , এলাহাবাদ, হায়দরাবাদ, চেন্নাই (তৎকালীন মাদ্রাজ), মুম্বই (তৎকালীন বোম্বে) এবং কোলকাতার নানামাত্রার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক প্রতিমা রচনার দীর্ঘস্থায়ী কাঠামো সরবরাহ করেছে মুম্বই ওরফে বলিউড চলচ্চিত্র কারখানা। ক্রিকেট ও চলচ্চিত্রের এই মিথোজীবিতা ভারতের সাংস্কৃতিকতায় এক অনন্য রাষ্ট্রোর্ধ্ব মাত্রা দান করেছে যার ভরসায় রাজনৈতিক বৈরিতার আপাত উৎকণ্ঠার মধ্যেও ভারতের মিডিয়া-প্রক্রিয়ার পক্ষে সম্ভব হয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের ব্যক্তিত্ব অধিগ্রহণ। পরিমাণে যত কমই হোক, নগণ্য নয় যে, ৫০-এর দশকে নূরজাহান বা সুরাইয়া, ৮০-এর দশকে ইমরান খান, নাহিদ আখতার, মজিদ খান বা রুনা লায়লা এবং ৯০-এর দশকে বা তার পরে নুসরাত ফতে আলি খান কিংবা আদনান সামীর মতো ‘অন্য’ প্রতিমা অন্তর্ভুক্তিকরণ। এর মাঝে ভারতের অজস্র প্রতিমা তো রয়েছেই সেলেব্রিটি হিসেবে। এসব উদাহরণের মধ্য দিয়ে আমি আসলে বড়জোর ভারতের মিডিয়াপ্রক্রিয়ায় সেলেব্রিটি সৃজনের একটা বৈশিষ্ট্যের দিকেই আলোকপাত করছি মাত্র, বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্যকে স্পষ্ট করবার স্বার্থেই। এবং একথাও আমি বিস্মৃত নই যে বিনোদন জগতের প্রতিমামণ্ডলী (সেলেব্রিটি বা আইকন) আর উন্নয়ন বা পরিষেবা (বা যাকে ফিল্যানথ্রপি বলা হয়ে থাকে) জগতের প্রতিমামণ্ডলী সমার্থক নয়।

কিন্তু, কোনোমতেই বাংলাদেশে কাছাকাছি ধরনেরও সেলেব্রিটি সৃজন প্রক্রিয়া নেই। প্রাথমিকভাবে বিনোদন জগতে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রাখলে, কাছাকাছি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা চলে এমন একটাও প্রতিমা আমাদের মনশ্চক্ষে হাজির হয় না। নিবিড় মনোযোগ দিয়ে ভাবলে, বাংলাদেশের মিডিয়াভোগপ্রণালীর নিকট বা দূর অতীতে সবচেয়ে সন্নিকট যে নামগুলো সম্ভাব্য হিসেবে হাজির হয় তার মধ্যে থাকতে পারে চম্পার নাম (হ্যাঁ, রাজ্জাক বা ববিতা নন), হুমায়ূন আহমেদ-এর নাম, মরহুম সালমান শাহ্-এর নাম, সুবর্ণা মুস্তাফা বা অপি করিম-এর নাম, আফজাল হোসেন বা হুমায়ূন ফরিদীর নাম, এমনকি হয়তো মাহমুদুজ্জামান বাবুর নাম এবং অতি অবশ্যই রুনা লায়লার নাম। নিজ জমানায় এঁদের সকলেই বাংলাদেশের সেলেব্রিটি, তথাপি চূড়ান্তবিচারে, এই নামগুলোর কোনোটাকেই দীর্ঘকালীন কিংবদন্তী রচনাকার হিসেবে দেখা কঠিন; একমাত্র ব্যতিক্রম হয়তো হুমায়ূন আহমেদ। আইসিসি শিরোপা এবং উত্তরকালে টেস্ট-স্ট্যাটাস অর্জনের পর নানাবিধ প্রোমোটারের একনাগাড় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের উছিলায় কোনো ধুন্দুমার সেলেব্রিটি জন্মলাভ করেননি। এখানে হয়তো আমাদের মুদ্রণ-মিডিয়া, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র এবং বিনোদন-সাংবাদিকতার পরিপূরক ভূমিকার ধারাবাহিকতার অভাবকে লক্ষ্য করতে হবে যদি বিষয়গুলো আমরা, তুলনামূলকভাবে, বুঝতে চেষ্টা করি। বিনোদন জগতের বাইরে, পরিষেবা বা ফিল্যানথ্রপিক জগতেও খুব ভিন্ন কোনো চিত্র নয়। মাদার তেরেসা কিংবা অরবিন্দ-এর মতো শক্তিশালী প্রতিমা বাংলাদেশে সৃজিত হয়নি। এই উদাহরণ-তালিকা দীর্ঘ করা সম্ভব।

চিত্তাকর্ষক যে, উন্নয়ন পরিমণ্ডল নিয়ে ভাবলে বাংলাদেশের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। উন্নয়নকে একটা ডিসকোর্স হিসেবে বিবেচনা করলে এই অঙ্গণে প্রতিমা সৃজন বাংলাদেশে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং আশপাশের রাষ্ট্রসমূহে যা আপাত অসম্ভব তা বাংলাদেশে সম্ভব হয়েছে। উন্নয়ন-সেলেব্রিটির তালিকায় আসবেন এনজিও উদ্যোক্তা ফজলে হাসান আবেদ, ফ র মাহমুদ হাসান, এমনকি পর্বতপ্রতিম সম্পাদক মতিউর রহমান কিংবা অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং অবশ্যই অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তালিকাটা দীর্ঘ নয় এবং, দৈবাৎ নয় যে, নারী-বিবর্জিত। তথাপি এই তালিকার প্রতিমামণ্ডলীর শক্তিমত্তা নেহায়েৎই গুরুত্বপূর্ণ। এটা অবশ্যই জরুরি জিজ্ঞাসা যে কী প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে উন্নয়ন পরিমণ্ডলে সেলেব্রিটি, এবং আখেরে আইকন, সৃষ্টি সয়ম্ভূ প্রক্রিয়া হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটা অনুধাবন করবার জন্য আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে খোদ উন্নয়ন ডিসকোর্স বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যেরকম জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্বমুক্ত থাকবার, ও কার্যত শেষোক্তের উপর কর্তৃত্ব করতে পারার, ঐতিহাসিক বুনিয়াদ লাভ করেছে সেটার দিকে। উন্নয়ন, একটা ডিসকার্সিভ বা বাক্সময় পরিক্ষেত্র হিসেবেই, জগতের আর কোথাও জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানাদির সঙ্গে সংমিশ্রণ ব্যতীত ক্রিয়াশীল নয় বলে অনুধাবন করা সম্ভব। এর মানে মোটেই এই নয় যে বাংলাদেশের উন্নয়ন ডিসকোর্স রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক কাঠামোকে লড়াই করে। বরং একেবারেই উল্টো। কিন্তু একটা দরকষাকষির আলাপচারিতা হিসেবে দেখলে বাংলাদেশের উন্নয়ন-স্থাপনাসমূহ তর্কাতীতভাবে স্বাধীন- সেটুকুই আমার বক্তব্য।

অধ্যাপক ইউনূস নোবেল পাবার ঢের ঢের আগে থেকেই সেলেব্রিটি। এমনকি তাঁর ম্যগসেসে পুরস্কার লাভেরও আগে থেকে। অধ্যাপক ইউনূস হচ্ছেন উন্নয়ন-উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিরল একজন যিনি নতুন ধরনের কর্পোরেট সাংবাদিকতার বিকাশলাভকে সম্ভবত মনোযোগ দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং এই ধারার সাংবাদিকতা-চর্চার মধ্যে নিরন্তর আত্ম-অবয়ব মুদ্রিত আকারে দেখবার সুযোগ, বা প্রেষণা, লাভ করেছেন। ফলে, নোবেল পুরস্কার অধ্যাপক ইউনূসের দীর্ঘ অভিযাত্রার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাইলফলক হতে পারত কেবল। কমবেশি কয়েকবছর যাবৎ তাঁর নাম মিডিয়াভোক্তাকুলে সম্ভাব্য নোবেলবিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে আসছিল। কার্যত যাকে আমজনতা বলা হয় সেই মিডিয়াভোক্তাকুল আকুল অপেক্ষা করছিলেন এই অর্জনের জন্য। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের আইসিসি শিরোপা কিংবা টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জনের পর এটাই সর্বোচ্চ মিডিয়া-ইভেন্ট,  এবং এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় হচ্ছেন একজন ব্যক্তি, অধিকন্তু উন্নয়ন-বলয়ের। আইকন হিসেবে অনুশীলন করবার এর থেকে বড় কোনো ঘটনা কল্পনাতীত, সমকালীন বাংলাদেশে।

 

ডিসকোর্স, পাবলিক জবান এবং অপ্রতিরোধ্য অবয়ব

উন্নয়নের বৈশ্বিক ডিসকোর্সমালাতে ‘মুক্তি’, ‘সংগ্রাম/লড়াই’ কিংবা ‘বিপ্লব’ গত দুই তিন দশক ধরে আত্তীকৃত সব পদ। ‘দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই/সংগ্রাম’; (প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা ‘স্বৈরাচার’) থেকে ‘মানুষের মুক্তি’; কিংবা ‘সাধারণ মানুষের জন্য প্রযুক্তির বিপ্লব’ ইত্যাদি। বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অবনয়ন এবং বৈশ্বিক প্রোপাগান্ডা হিসেবে এই পদগুলো নবায়িত অর্থ আলাপ প্রসঙ্গ হিসেবে নতুন নয়। ফলে এখানে এগুলো নিয়ে বিস্তর কোনো ব্যাখ্যা আমার লক্ষ্য নয়। যে বিশেষ কারণে এখানে এগুলোর উল্লেখ প্রাসঙ্গিক তা হচ্ছে ডিসকোর্স হিসেবে এগুলোর পরিসর এবং সামর্থ্য রাষ্ট্রসীমাভেদী; এবং বাংলাদেশে পাবলিক জবান সৃষ্টিতে এগুলো কেন্দ্রীয়। পাবলিক জবানের পুনঃপৌণিকতা অটুট থাকে এসবের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়া করে। কিন্তু পাবলিক জবানের বিশেষ দেশজ চেহারা আছে। সেই চেহারা গ্লোব্যাল ডিসকোর্সের সঙ্গে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতারত নয়, বরং সম্প্রসারণ ও মিথোজীবিতা। যেমন: ‘মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো’, ‘বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নেয়া’, ‘আমরাও পিছিয়ে নেই’। লক্ষ্যণীয় যে, জাতীয়তাবাদী স্পৃহার এই পাবলিক জবানগুলোর ডিসকার্সিভ পরিসর রয়েছে যে পরিসর উন্নয়ন-বিশ্বায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত; এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ যে অধ্যাপক ইউনূসের বেলায় এই জবানগুলো কারকপক্ষে শরীকী। তাঁর নোবেলপ্রাপ্তির বহু আগে থেকেই এটা চলমান।

অধ্যাপক ইউনূস-এর মডেল কিংবা গ্রামীণ ব্যাংক-এর কার্যপদ্ধতি নিয়ে উন্নয়ন-আলাপমালায় সমালোচনা কিংবা প্রতিরোধ হয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণের বিষয়ে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো (যথা বিশ্বব্যাংক) একটা সংশয়ী পর্যবেক্ষক হিসেবে যতদিন ছিল, কিংবা একটা সংস্থাপনযোগ্য প্রকল্প হিসেবে যতদিন এসব প্রতিষ্ঠান রায় দেয়নি তখনকার কথা বাদ দিলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও সমালোচনা এবং প্রতিরোধ হয়েছে। হয়েছে পলিসি অধ্যয়নের দৃষ্টিকোণ থেকে কিংবা উন্নয়ন সমীক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে। আমিনুর রহমানের অপেক্ষাকৃত আলোচিত কাজটিই বেশি মনোযোগ পেয়েছে। কিন্তু একেবারে সাম্প্রতিককালেও, তাঁর নোবেলপ্রাপ্তির আগে কিংবা পরে, আর্থসামাজিক শাস্ত্রীয় বিচারে তাঁর পদ্ধতিকে প্রতিরোধ করবার উদ্যোগ হয়েছে। যে বিষয়টা এখানে উল্লেখযোগ্য, কিংবা যে পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রসঙ্গ এখানে আসছে তা হলো তেমন কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই অধ্যাপক ইউনূস কিংবা গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল নিয়ে কোনো সমালোচনা কমবেশি চাপা পড়ে গেছে – দেশে কিংবা বিদেশে। আমিনুর রহমানের কাজ মোটের উপর উন্নয়ন সমীক্ষার অর্থনৈতিক মডেলগুলোর ব্যাপারে নির্দ্বিধ থেকে এগিয়েছে। বা অন্যভাবে বলা যায়, তাঁর প্রচেষ্টার তাত্ত্বিক পাটাতন উন্নয়নবাদী। অনুবর্তীতে, তিনি জোর দিয়েছেন যেসব গাণিতিক কৃৎকৌশলে গ্রামীণ ব্যাংক মুনাফা নিশ্চিত করে থাকে সেগুলোর তদন্ত করতে এবং এটা করতে গিয়ে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রচারণা ও মাঠপর্যায়ের বাস্তবতার মধ্যকার প্রভেদকে সামনে নিয়ে আসেন। আমার তরফে এটা স্পষ্ট করা জরুরি যে আমার শাস্ত্রীয় প্রস্তুতি এ ধরনের কিছু হাজির করার মতো নয়। সেটার জন্য যাকে প্রাথমিক উপাত্ত বলা হয়ে থাকে তার উপর কর্তৃত্ব থাকা প্রয়োজন। সর্বোপরি, বর্তমান রচনার মুখ্য তাগিদের জন্য এটা জরুরিও নয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এসব সমালোচনার প্রত্যুত্তর কী উপায়ে দেয়া হয়েছে। তেমন কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই, শাস্ত্রীয় ও পদ্ধতিগত প্রত্যুত্তরের বদলে, মিডিয়া-কাভারেজ বরাবর অধ্যাপক ইউনূসের প্রধান জবাবদিহিতা থেকে গেছে। বিষয়টা কেবল জনে জনে তিনি প্রত্যুত্তর দিতে পারেন কিনা এমন সরল আব্দারের নয়। বরং, তাঁর সচেতন ভূমিকা কাঠামোগতভাবে গ্লোবেল ডিসকোর্সের পরিসর ব্যবহার করেছে ধারাবাহিকভাবে- বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে তিনি কী কী  দিতে পারেন, কিংবা ‘জাতির জন্য তিনি কী কী  করতে সমর্থ ইত্যাদি। পাবলিক জবানে এই অবস্থান প্রতিবর্তিত হয়েছে শুধু।

তুলনায়, অন্য কিছু সমালোচনা খোদ রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের পাটাতন থেকেই হয়েছে। সেসব সমালোচনা সাধারণভাবে বাংলাদেশে এনজিও তৎপরতার বিষয়ে সপ্রশ্ন।১০ গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম সেই পরিকাঠামো থেকেই পঠিত হয়েছে। সেই হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রমের গোড়া থেকেই প্রতিরোধী চিন্তাভাবনা সক্রিয় ছিল। ২০০৫-এর ২৯শে মে দুর্নীতি দমন কমিশনের সেমিনারে অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করবার যে ঘোষণা দিয়ে যে প্রবন্ধ পড়েন সেটা সম্ভবত দারিদ্র্য দূরীকরণের থেকেও নগরমানসে (বা মিডিয়াভোক্তাকুলে) বেশি আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। বলাইবাহুল্য, এরও পাটাতন হয়ে ছিল পূর্ববর্তী বছরগুলোতে বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর দুর্নীতি বিষয়ক আলাপমালা একনাগাড় গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে। অধ্যাপক তাজ হাশমী, বাংলাদেশে উন্নয়ন সংস্থাসমূহের কর্মকাণ্ডের একজন নিষ্ঠাবান ও ধারাবাহিক সমালোচক, অধ্যাপক ইউনূসকে ডিজিটাল মাধ্যমে একটা দীর্ঘ পত্র লেখেন।১১ তাঁর চিঠির মূল বক্তব্য ছিল এনজিওগুলোর মধ্যকার দুর্নীতির নানারকম আলামত যেখানে পাওয়া যায় এবং পাবলিককৃত হয় না তখন সেই জগতের মধ্য থেকে সেসংক্রান্ত কোনো উদ্যোগ না নিয়ে এরকম খোয়াব দেখানো অতিক্রিয়া।

এসবের সঙ্গে বাহাসের একটা পদ্ধতিগত উদ্যোগ অধ্যাপক ইউনূস কিংবা গ্রামীণ ব্যাংক নিয়েছেন কখনো তেমন অনেক নজির নেই। আমার বক্তব্য কিন্তু এই নয় যে সম্ভাব্য বাহাস আরও ‘গ্রহণযোগ্য’ করে তুলতে পারত তাঁর/গ্রামীণের অবয়ব। আমার বরং একেবারেই ভিন্ন বক্তব্য। অবয়ব বরং এক্ষেত্রে এমন স্বাভাবিকীকৃত, এমনই গ্রহণযোগ্য যে সেই অবয়ব বা প্রতিমার পুনরুৎপাদন ছাড়া আর কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়নি। কূটচাল বা দুরভিসন্ধি হিসেবে একে পাঠ করতে যাওয়া নিরর্থক; পাঠ করা জরুরি বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় লোকাল আইকন সৃষ্টির কৃৎকৌশলের আলোকে, পরিবেশনমূলক/রিপ্রেজেন্টেশনাল সূত্রমালার আলোকে, হালের জাতীয়তাবাদ কীভাবে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক কল্পমানচিত্রে ডায়াসপোরিক জমিন খোঁজে তার আলোকে, এবং কীভাবে একজন সৃষ্টিরত আইকন তাতে নিরন্তর অংশ নিতে থাকেন তার আলোকে।


স্বপ্রতিমার র‌্যাডিক্যালাইজেশন

খুব স্পষ্টভাবেই আমি দুইটা আপাত  বিরোধী ধারণা যুগপৎ প্রয়োগ করেছি বাংলাদেশে উদ্যাপনমুখরতার সাম্প্রতিক সবচেয়ে বড় ঘটনাটিকে বুঝতে- জাতীয়তাবাদ ও র‌্যাডিক্যাল। এটার একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যূৎপত্তিগত দিক আছে। জাতীয়তাবাদ যতটাই অনুধাবনকৃত একটা প্রপঞ্চ, তুলনায়, র‌্যাডিক্যাল ততটাই অস্পষ্ট এবং তরল একটা প্রপঞ্চ । পাশ্চাত্যীয় রাজনৈতিক ডিসকোর্সে র‌্যাডিক্যাল হামেশা নানাবিধ অর্থে প্রয়োগকৃত হয় – প্রায়শই তা নৈরাজ্যের সঙ্গে একাকার করে দেখা হয় এবং পরিশেষে উভয়কেই নেতিবাচক তৎপরতা হিসেবে পরিবেশন করা হয়; অন্যথায় র‌্যাডিক্যাল চিহ্নিত হয় লিবেরেলের অসহিষ্ণু বেয়াড়া প্রতিপক্ষ হিসেবে। এখানে র‌্যাডিক্যালাইজেশন প্রত্যয়টা প্রয়োগ করবার সময়ে পাশ্চাত্যীয় ডিসকোর্সের এই সীমানাগুলো সম্বন্ধে আমি সজাগ আছি। লক্ষ্য করবার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের মতো প্রান্তিক পুঁজিবাদী বিশ্বে, এর নিজস্ব রাজনৈতিক ইতিহাসের আলোকেই, লিবেরেলবাদ স্বাভাবিকীকৃত হয়নি – অন্তত যতটা পর্যন্ত হলে যাবতীয় লড়াই-প্রচেষ্টা আদর্শমানের (নর্ম) লঙ্ঘন হিসেবে পাবলিক মননে গৃহীত হবে। উল্টো বরং, লড়াই-ই এখানে নর্ম। একটা রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার ফসিলপ্রায় ভাষা-লক্ষণা; রিপ্রেজেন্টেশন। এটা এমন এক বিষমসঙ্গতিপূর্ণ অবস্থা যেখানে কোনো সংঘসত্তা বা তৎপরতা প্রশংসিত হয় এর ‘অরাজনৈতিক’ অবয়বের কারণে, এবং একই সঙ্গে তা লড়াই জারি রাখবার প্রত্যাশিত রাজনৈতিক কর্তব্যচাপে থাকে- প্রাসঙ্গিক, অবশ্যই যদি লড়াইকে আমরা ‘রাজনৈতিক’ হিসেবে অনুধাবন করি। বলাইবাহুল্য, কাঙ্ক্ষিত এই লড়াইয়ের সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ/সমূহ ক্ষেত্রবিশেষে এক প্রহেলিকায় পর্যবসিত হয়। পাশ্চাত্যে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে ‘সংগ্রাম’ চলে, অধ্যাপক ইউনূসও একে জাদুঘরে পাঠাবার ঘোষণা দিয়ে স্বস্তি পেতে পারেন; কিন্তু বাঙ্গালা-মননে এমন বিমূর্ত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ‘লড়াই’ বিশেষ তাৎপর্য বহন করে না। কোন ‘সংগ্রাম’ বা ‘লড়াইটি অধিকতর খাঁটি বা কার্যকরী সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিজ্ঞাসা এবং পরিশেষে নিরর্থক জিজ্ঞাসা।

১০ই ডিসেম্বর অসলো সিটি হলে নোবেল প্রদান অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ইউনূস বাংলায় ও ইংরেজিতে যে বক্তৃতা দেন, প্রত্যাশিতভাবেই, তার একটা মুখ্য লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির গুরুত্ব তুলে ধরা এবং যাঁকে তিনি এবং তাঁর বৈশ্বিক মিত্ররা নারীমুক্তি১২ বলে আসছেন সেটা অর্জনে এর ইতিবাচক প্রভাব বয়ান করা। বহুল চর্চিত একটা পরিসংখ্যান তিনি উল্লেখ করেন১৩: ‘পৃথিবীর সম্পদের মোট শতকরা ৯৪ ভাগ রয়েছে ৪০ ভাগ লোকের হাতে এবং বাকি শতকরা ৬ ভাগ আছে বাকি জনসংখ্যা তথা ৬০ ভাগ লোকের হাতে।’ এ ধরনের পরিসংখ্যানগুলো খুবই মুস্কিলের। এক তো হলো, এর গুণমান সমর্থন বা মোকাবিলার জন্য আমশ্রোতাদের হাতে বিশেষ কিছু থাকে না। রাজ্যের জিজ্ঞাসা নিষ্পত্তিহীনতায় ভোগে- এই ৪০ ভাগের মধ্যেকার বণ্টনচিত্রটা কেমন; কিংবা এদের নিবাস কোথায় এবং কোন ঐতিহাসিক ও বৈশ্বিক বন্ধনে তাঁরা এককাট্টা; কিংবা আদতেই আপাত শিথিল এই ৪০ ভাগের মধ্যে অধ্যাপক ইউনূস কিংবা তাঁর মিত্রদের কেউ কেউ পড়বেন কিনা; যদি পড়েন, সেক্ষেত্রে মৈত্রী, পারস্পরিক আস্থা ও বন্ধুত্বের কৃৎকৌশল কী; কিংবা ‘সাংস্কৃতিক পুঁজি’১৪ বলে এমনকি এনজিও সেক্টরেও যে পদটি পরিচিত আছে সেটার বৈশ্বিক গুরুত্ব কীভাবে অনুধাবন করা যাবে; এবংবিধ। কিন্তু মূল সমস্যাটা অন্যত্র। এই পরিসংখ্যানগুলো, আমি মনে করি, ভীষণভাবে শ্রোতার অনুভূতিপ্রবণতায় আবেদন করে- এমন এক অনুভূতিপ্রবণতা একটু আগেই বাংলাদেশের পাবলিক মননের ঐতিহাসিক গঠনের সূত্রে যার উল্লেখ করেছি। বৈশ্বিক বৈষম্যের অর্থনির্দেশে এখানে যা ব্যক্ত হয়, এবং মুখ্যত অব্যক্তভাবে দ্যোতিত হয়, তা পরিবেশনমূলক; এবং আইকনপ্রক্রিয়ার নির্দিষ্ট অর্থসমূহের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টাতেই কেবল সজ্ঞান নিয়োজিত।

এক্ষেত্রে আরও চিত্তাকর্ষক প্রসঙ্গ সম্ভবত নরওয়ের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব মোবাইল ফোন কোম্পানি টেলেনর-এর সঙ্গে একেবারে সাম্প্রতিক কালে অধ্যাপক ইউনূস তথা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকাশ্য মতবিরোধ।১৫ মতবিরোধটা প্রকাশ করবার সময়কালটা নোবেলপ্রাপ্তির কালের সঙ্গে মিলে যাওয়াটা অবশ্যই দৈবাৎ হতে পারে, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখানে আরও বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করবার আছে কী ভাষামণ্ডলী দিয়ে অধ্যাপক ইউনূস একে চিত্রিত, সুতরাং মিডিয়াকৃত, করছেন। তিনি খুব স্পষ্ট করে যা যা বলেছেন তার মধ্যে নিন্মরেখা দিয়ে পাঠ করা যেতে পারে যেগুলোতে তিনি টেলেনরকে এমন একটা কোম্পানি বলছেন যেটা “রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত” এবং যারা “বাংলাদেশের গরিবদের কাছ থেকে মুনাফা চুষে নিচ্ছে”। পরন্তু, তিনি একটা তুলনা হাজির করেন, অবশ্যই গ্রামীণ টেলেকমের নৈতিক উৎকর্ষ নিশ্চিত করবার জন্য, যে টেলেনরের ঝোঁক “মুনাফা সর্বোচ্চকরণের দিকে আর গ্রামীণ টেলেকমের “সামাজিক লক্ষ্যের দিকে।১৬ তাঁর দাবির যাথার্থ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ। এবং এই বিচারসমেত কেন ও কীভাবে এই অংশীদারিত্ব এ যাবৎ ক্রিয়াশীল আছে সেটা আরও ভিন্ন জিজ্ঞাসা। বাণিজ্যে পাশ্চাত্যীয় পক্ষ যে নানাভাবে অপাশ্চাত্যীয় অংশীদারদের কোণঠাসা করে থাকে সেটাও একটা অত্যন্ত জরুরি রাজনৈতিক প্রসঙ্গ। কিন্তু এখানে মুখ্য বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে তাঁর প্রতিমার গ্রাহকদের মধ্যে কী কী অনুভূতিতে অধ্যাপক ইউনূস যোগাযোগ স্থাপন করতে চাইছেন। এই পরিবেশনরীতি একটা সজাগ সংস্থাপন হবার সম্ভাবনাই বেশি।

এই দুটো উদাহরণ কেবল নিছক দৈবচয়ন নয়। যে প্রস্তাবনার সঙ্গে এগুলো সম্পর্কিত সেখানে এই বাছাইগুলোর সুস্পষ্ট প্রেক্ষিত রয়েছে। আমার বক্তব্য হচ্ছে, বর্তমান বাংলাদেশে অধ্যাপক ইউনূসের আইকন নির্মাণের ক্ষেত্রে মিডিয়াভোক্তাকুল এবং অধ্যাপক ইউনূস স্বয়ং একটা অখণ্ড প্রক্রিয়ার সম্পূরক ভূমিকা নিয়ে চলেছেন। অধিকন্তু, বৈষম্যের প্রসঙ্গে পরিবেশনধর্মী/রিপ্রেজেন্টেশনাল ভঙ্গি খোদ আলোচিত উৎসবমুখরতার সঙ্গেও সম্পূরক। র‌্যাডিক্যালাইজেশন এখানে একটা জাদুকরী সামর্থ্যকে কল্পনা করে তাকে নিরন্তর নির্মাণ করে চলা – এমন এক ঐন্দ্রজালিক সামর্থ্য যা ভোজবাজির মতো ‘অরাজনৈতিক’ তকমাপ্রাপ্ত কিছু লিবেরেল অকাঙ্ক্ষাকে উসকে দিতে থাকবে, এমন এক জাদুকরী সামর্থ্য যা ক্ষমতার ব্যবস্থাতন্ত্রকে উন্মোচন করবার কোনো কারণ দেখবে না। যদি সিভিল অকাঙ্ক্ষার একজন ম্যাজিক্যাল আইকনকে ধন্বন্তরী হিসেবে পাওয়া হয় পলায়নপরতা, তাহলে একটা কল্পরাজ্যে ‘নিজ’কে প্রক্ষেপন করে সেই পলায়নপরতাকে আশ্রয়প্রদান অধ্যাপক ইউনূসের ‘নার্সিসিজম১৭, যা আইকনপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে কাঠামোগতভাবে সম্পর্কিত। ‘দুর্নীতি দমন’ বিষয়ে কিছু কাল আগে তাঁর মিডিয়া তৎপরতাকে আবারও স্মরণে আনা যায়; কিংবা নোবেলপ্রাপ্তির পর বাংলাদেশের ‘উচ্চতা’বিষয়ক তাঁর জবানী।

বিদ্যমান আইকন-প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে উন্নয়ন ও দারিদ্র্য নিয়ে ক্রিটিক্যাল আলাপ-আলোচনা গড়ে তোলা আগামীতে আরও দুরূহই হবে।


তথ্যপঞ্জি

১।  Ranajit Guha, Dominance without Hegemony: History and Power in Colonial India, Harvard University Press, 1998.

২। এখানে আমি সতর্ক থাকার পক্ষে যে ভারতের মতো জটিল ও বহুজাতিক-ভাষিক রাষ্ট্রকাঠামোতে বাঙ্গালি জাতির মতো ঔপনিবেশিককাল থেকে অত্যন্ত সুবিধাভোগী জাতি এবং মিজো বা অহমীয়ার মতো প্রতিরুদ্ধ সত্তার ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গকে সমভাবে দেখার সুযোগ নেই। আরও সতর্কভাবে বললে, আমি আসলে নিপীড়িত জাতিবর্গের লড়াই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংমিশ্রিত মতবাদকেও ‘এক ধরনের জাতীয়তাবাদ’ হিসেবে দেখার ক্ষেত্রে অন্য যেকোনো সময়ের থেকে অনিচ্ছুক আছি। বরং, লড়াইপ্রক্রিয়ার পঠনপাঠন নিদারুণভাবে কাঠামোগত কতগুলো নির্দিষ্ট ধাঁচে বন্দি হয়ে আছে Ñ সেই বন্দিদশা যে কেবল পঠনকে পরিসীমিত করে কেবল তাই নয়, বরং লড়িয়েদের আকাক্সক্ষাকে রূপ দেবার ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা ডিসকার্সিভ। আমার এই উপলব্ধি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকাঠামোতে পার্বত্য জাতিসত্তাসমূহের লড়াইয়ের প্রসঙ্গ বিশেষভাবে ইঙ্গিত দিয়ে এসেছে।

৩। এটা ঘনীভূত হয়েছে সম্ভবতঃ বিএনপি’র ভীষণ আত্মবিশ্বাসী, এবং প্রায়শঃই বেফাঁস কথা বলতে পারঙ্গম, একজন অর্থমন্ত্রী রয়েছিল বলে। পেশায় অধ্যাপক ইউনূস অর্থনীতিবিদ হওয়াতেই হয়তো জনাব সাইফুর রহমান ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কটাক্ষ করে বসেন (সূত্র: ডেইলি স্টার, ২০শে ও ২৩শে অক্টোবর, ২০০৬)। তবে উত্তরসপ্তাহগুলোতে, বিএনপি ও অধ্যপক ইউনূস উভয় তরফেই উৎসবমুখরতা ম্লান হতে না-দেবার প্রচেষ্টা ছিল বলে অনুভব করা যায়।

৪। অর্জুন আপ্পাদুরাই মিডিয়ার আধিপত্য নিয়ে স্পষ্টভাবে জানান তাঁর মিডিয়াস্কেপ ধারণার আওতায়: “আধুনিক কালসমূহ…অংশত এর মিডিয়াস্কেপ দ্বারা গঠিত, যেহেতু মিডিয়া কেবল তথ্য সরবরাহ করে না অধিকন্তু সত্তার প্রকৃতির জন্যে এর রয়েছে সুগভীর প্রভাব।” আপ্পাদুরাইয়ের চিন্তা-উস্কানিমূলক ভাবনা নিমন্ত্রণ করে তাঁরই প্রয়োগকৃত অপর ধারণা ‘এ্যানথ্রোস্কেপ’-এর সঙ্গে এর সম্পর্ক খতিয়ে দেখতে। হালের দুনিয়ায় পরিসর বিন্যাসে মিডিয়াস্কেপ ও এ্যানথ্রোস্কেপ কীভাবে পরস্পরপ্রবিষ্ট সেই জিজ্ঞাসা নিয়ে আরও উৎসুক কাজ জরুরি। আপ্পাদুরাই (১৯৯০) উদ্ধৃত হয়েছেন, Hugh Mackey Ges Tim O’Sullivan (eds.), The Media Reader: Continuity and Transformation, SAGE Publications and The Open University, London, 1999.

আপ্পাদুরাই দেখা যেতে পারে: Arjuna Appadurai, “Disjuncture and Difference in the Global Cultural Economy,” In Featherstone, M. (ed.) Global Culture: Nationalism, Globalization and Modernity, Sage, London, 1990.

৫। ভারতের সঙ্গে তুলনাটা গায়ে-পড়ে নয়। মিডিয়াকে বুঝতে গেলে, সংজ্ঞাকৃত দক্ষিণ এশিয়ায় বসে, ভারতের অস্তিত্ব এড়িয়ে সেটা সম্ভব নয়। এখানে আরও একটি প্রস্তাবনা আমি সবিনয়ে দিয়ে রাখতে চাইছি: উপনিবেশকালের ভারতের সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া, ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গঠন এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক ডায়াসপোরা অন্যান্য বিষয়ের মতো সেলেব্রিটি নির্মাণ প্রক্রিয়ায়ও মুখ্য অনুঘটক।

৬।  Arturo Escobar, Encountering Development: The Making and Unmaking of the Third World, Princeton, Princeton University Press, New Jersey, 1995.

৭। কর্পোরেট সাংবাদিকতা বলতে, সংক্ষেপে, আমি বোঝাচ্ছি সাংবাদিকতার সেই অনুশীলনকে যেখানে প্রেস বা পত্রিকাকে আর সম্পাদকীয় পরিক্ষেত্র হিসেবে দেখার সুযোগ থাকছে না, বরং কর্পোরেট-সংঘীয় হিসেবে দেখতে হচ্ছে; যেখানে পত্রিকাসমূহ সমরূপ কণ্ঠস্বরকে আত্মস্থ ও আত্মসাৎ করে এবং, ‘মৌলবাদ’ বনাম সেক্যুলারবাদ ব্যতীত, সকল বিতর্কে সমধর্মী অবস্থান গ্রহণ করে থাকে; যেখানে মাঠপর্যায়ের সাংবাদিকেরা ন্যূনতম কোনো পেশা-নিরাপত্তামূলক বেষ্টনীর মধ্যে থাকেন না এবং নিরন্তর উৎখাত ও মৃত্যুভয়ে থাকতে পারেন। এসংক্রান্ত আমার সামান্য ভাবনা আমি ইঙ্গিত করেছিলাম অন্য একটি রচনায়।

মানস চৌধুরী, “২১-শে আগস্টের বোমা হামলা: প্রেসকর্তব্যের শেষকৃত্য,” যোগাযোগ, সংখ্যা ৭, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ২০০৫।

৮। আমার তরফে ক্রিকেটকে এখানে উদ্ধৃত করা কোনোরকম অতিকথন নয়। প্রথম আলো’র ভূমিকাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে দেখলে আমার এই প্রতিতুলনা অর্থবহ হবে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পাকিস্তানকে পরাজিত করার পর এই পত্রিকার বিশেষ বড় হরফে শিরোনাম ছিল ‘বাঘের গর্জন শুনেছে বিশ্ব’। এই সংখ্যাটির গুরুত্ব নিশ্চয় মালিক তরফেও সম্যধিক। ফলে, পত্রিকাটির বিজ্ঞাপনী কার্যক্রমে এই সংখ্যাটাকে ব্যবহার করা হয়েছে ধারাবাহিকভাবে। এই শিরোনামের ঔজ্জ্বল্য এবং পরিমাপ কেবল ইরাক যুদ্ধের সময়কালের কিছু শিরোনাম এবং উত্তরকালে অধ্যাপক ইউনূসের নোবেলপ্রাপ্তির সময়কালের পরপর কয়েকদিনের শিরোনামের সঙ্গেই তুলনীয়।

৯।  Aminur Rahman, Women and Microcredit in Rural Bangladesh: An Anthropological Study of Grameen Bank Lending, Westview Press, 2001.

১০। অন্যান্যদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ খুব নিয়মিত একজন ক্রিটিক। তবে এখানে সাম্প্রতিক অন্য একটা লেখা উল্লেখযোগ্য যেখানে লেখক প্রবল ভঙ্গির বিপরীতে বিশেষভাবে অধ্যাপক ইউনূসের কর্মকাণ্ডকে পাঠ করবার একটা স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ দিতে সচেষ্ট –

Tarek Chowdhury, “Nobel-Man’s Un-Noble Corporate Nexus”, Meghbarta, 15 December 2006.

http://www.meghbarta.org/nws/nw_main_p01b.php?issueId=6&sectionId=30&articleId=255

১১। আরও ব্লগ ও পোর্টালে এটা সঞ্চালিত হয়ে থাকতে পারে, তবে আমি নাগাল পেয়েছিলাম এটাতে –
http://groups.yahoo.com/group/mukto-mona/message/24781
অধ্যাপক হাশমী এই চিঠির সূত্রে অন্যদের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে তাঁর একটা বইয়ের কথা বলেন। যেটা দেখা আমার কর্তব্যের মধ্যে ছিল, কিন্তু হয়ে ওঠেনি বলে মার্জনা চাই –
Taj Ul-Islam Hashmi, Women and Islam in Bangladesh: Beyond Subjection and Tyranny, Macmillan-Palgrave and St.Martin’s Press, New York, 2000.

১২। নারীমুক্তি এবং নারীর ক্ষমতায়নের মধ্যে তাত্ত্বিক পার্থক্য উন্নয়নসংস্থার কার্যক্রমে ও বুলিচর্চায় ভেদহীন মনে হয় এবং আপাততঃ সেটার সম্ভাব্য কী অর্থ তা বুঝতে গেলে আমাদের জন্য আলামত বলতে থাকে কেবল শ্রমবাজারের পরিবর্ধিত সদস্য হিসেবে মুদ্রাবাজারের ছোটখাট শরীক (স্টেকহোল্ডার!) হওয়া। আরও নিবিষ্টপাঠে, খরিদকার বা কনস্যুমার সত্তার উন্মেষ ঘটানোর সামর্থ্য ছাড়া নারী ক্ষমতায়নের অপর কোনো অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব নয়।

১৩। অসলো সিটি হল থেকে সরাসরি টেলিভিশন প্রচার, এনটিভি ইন্টারনেট সম্প্রচার, ১৩ই ডিসেম্বর ২০০৬।

১৪। সসংশয়ে এই পর্যবেক্ষণটি আমার হাজির করে রাখি যে, বাংলাদেশের উন্নয়ন সাহিত্যে নয়া-ওয়েবারীয় ধাঁচে যেভাবে রকমারি ‘পুঁজি’র বিবরণী দেয়া হয়ে থাকে তা ভীতিকরভাবে সরলীকৃত। তা যে কেবল বোর্দ্যু’র তাত্ত্বিক প্রস্তাবনার ব্যাপকতাকে পরিসীমিত করে তাই-ই নয়, বরং প্রায়শঃই প্রান্তিক শ্রেণী/গোষ্ঠীসমূহের সাফল্য ও প্রতিরোধের কাহিনী ফাঁদতে গিয়ে মূল তাত্ত্বিক প্রস্তাবনার যা কিনা বনিয়াদ সেই শ্রেণীনিষ্ঠাকেই ফিকে করে দেয়।

১৫। www.bdnews24.com, Dhaka, Dec 6, 2006

১৬। বর্তমান রচনাটি মূলগতভাবে পরিবেশনরীতি বিষয়ক। ফলে এই উদাহরণটা এখানে প্রাসঙ্গিক হবার দাবিদার। অধ্যাপক ইউনূস দাবিকৃত ‘সামাজিক লক্ষ্য’টি নিশ্চিতভাবে যাকে দারিদ্র্য দূরীকরণ বলা হয়ে থাকে সেটাই। গ্রামীণ টেলেকম বাণিজ্য শুরু করবার প্রাথমিক কালে এর প্রমোশনাল কর্মকাণ্ডতে এমনসব মুখাবয়ব হাজির করা হয়েছে, মহানগরের পথের ধারে ধারে, যেগুলো কোনো রকম বাড়তি ব্যাখ্যা ছাড়াই ‘দরিদ্র’ মানুষজনের বলে পঠিত হতে সমর্থ ছিল। হাতে তাঁদের মোবাইল ফোন। এই সামাজিক শ্রেণীর মডেলদের অপসারণ করে নিরঙ্কুশ নাগরিক এবং/অথবা মধ্যবিত্ত মুখাবয়ব দিয়ে প্রমোশনাল বানানো হয় কমবেশি পাঁচ-ছয় বছরের মাথায়। ততদিনে নির্দিষ্ট কনস্যুমারবর্গ হিসেবে উচ্চমধ্যবিত্ত ‘ইয়্যুথ’ ‘টার্গেটকৃত’ হয় ডি-জুইস সিরিজের আওতায়। এখানে প্রসঙ্গ এরকম অভিমান প্রকাশের নয় যে গ্রামীণ কাদের কাছে মোবাইল ফোন বিক্রি করতে চায়। বরং এখানে স্মরণ রাখার দরকার আছে গ্রামীণ টেলেকমের আবির্ভাব-কাল থেকে এর উন্নয়ননিষ্ঠা বোঝাতে “‘দরিদ্র শ্রেণী’র প্রযুক্তিতে অধিকার” একটা শক্তিশালী দাবি ছিল; এবং এই দাবিটা একই সঙ্গে গ্রামীণের তরফে টেলেকম্যুনিকেশন বাণিজ্যে অংশগ্রহণের লজিকও বটে। ফলে বিজ্ঞাপনে ‘দরিদ্র’ মুখাবয়বের উপস্থিতি এবং তার প্রতিস্থাপন দুই-ই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।


নোট: রচনাকাল: নভেম্বর ২০০৬। প্রকাশ: সমাজ নিরীক্ষণ ৯৮, ২০০৬। পুস্তকে সংযোজন ২০২১, জনসংস্কৃতি ও মধ্যবিত্ত, আদর্শ প্রকাশনী। পুস্তকের নোটে ছিল “বাংলাদেশে এই মুহূর্তের রাষ্ট্র কর্ণধারদের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের সম্পর্ক বিবেচনা করলে রচনাটির পুনর্প্রকাশ অস্বস্তিকর, এমনকি আমার জন্যও। তবে আমি পাঠককে পরিপ্রেক্ষিতে রেখে পাঠ করতে সুপারিশ করব।” আমাদের (রাজনৈতিক) জীবন মধুর সহ পরিহাসে ভরা। অন্যথা ওই নোটটির আবার এই অরাজ প্রকাশে দরকার হতো না। – লেখক

মানস চৌধুরী

মানস চৌধুরী নৃবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বিদ্যাগত-তর্কাতর্কিমূলক রচনা ছাড়াও যাকে 'সৃজনশীল' বলা হয়। সবই লেখেন। যখন যা কিছুতে ইচ্ছা। তাঁর সাম্প্রতিক বইগুলো হচ্ছে : গুমের কিংবা ঘুমের রাজ্যে (গল্প, ২০২৩), রাষ্ট্রমেশিনের কোলে পাতা, তুলতুলে লিবেরেল মাথা (তর্ক/প্রবন্ধ, ২০২৩), সংগঠন প্রসঙ্গে (তর্কালোচনা, ২০২৩), শান্তিবুড়ির ধবলগাই মধ্যরাতে শহর সফরে এসে থাকতে পারে (উপন্যাস, ২০২৩)। এছাড়া তার প্রকাশিত অন্যান্য বইগুলো হল: জনসংস্কৃতি ও মধ্যবিত্ত (২০২১); দৃশ্যগত নৃবিজ্ঞান (২০২০); নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ (রেহনুমা আহমেদ-এর সঙ্গে যৌথ বিরচিত) ২০০৩; কর্তার সংসার (সায়দিয়া গুলরুখ-এর সঙ্গে যৌথ সম্পাদিত) ২০০০; জলপরী আর জলাতঙ্ক (২০২০); কাকগৃহ (২০০৮) ইত্যাদি।