- সহুল আহমদ
খালেদ আবু এল ফাদল ইসলামি আইনশাস্ত্রের নামজাদা আলেম। ইসলামি আইন, শরিয়া সহ ইসলামের নানা শাখা নিয়ে অজস্র কিতাবাদি রচনা করেছেন। ২০০৩ সালে তিনি ‘ইসলাম এন্ড চ্যালেঞ্জ অফ ডেমোক্রেসি’ নামে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেন। এই প্রবন্ধকে কেন্দ্র করে বেশ বড়সড় বাহাস তৈরি হয়, যেখানে নাদের হাশমি, জেরেমি ওয়াল্ড্রন, সাবা মাহমুদ, মোহাম্মদ ফাদেল সহ প্রায় এগারজন স্কলার অংশ নেন। কেউ কেউ ফাদলের অবস্থানের প্রশংসা করেন, কেউ কেউ ক্রিটিক করেন। ফাদল পরে আবার সেগুলোর সম্মিলিত জবাব দেন। এই পুরো বাহাসই পরে কিতাব আকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
যে বাস্তবতার মধ্যে প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল ও সকলে বাহাসে লিপ্ত হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে দুটো নোক্তা দেওয়া প্রয়োজন। কেননা, পুরো বাহাসজুড়ে সেই বাস্তবতা এতো প্রবল কিন্তু উহ্য ছিল যে, তা পাঠকমাত্রই নজরে পড়বে। ২০০১ এর পর দুনিয়াজুড়ে মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রের হালচাল নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা শুরু হয়। এই কথাবার্তা একেবারে এতদূর পর্যন্ত ঠেকে যে, ইসলাম আদতে কোনোভাবেই গণতন্ত্রকে সমর্থন করে না। বরঞ্চ, ইসলামি ধর্মতত্ত্বেই লুকিয়ে আছে স্বৈরতন্ত্রের ভূত। অন্যদিকে, যে সকল রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক মুসলমান, সেখানে কায়েম ছিল স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। ফাদল যখন প্রবন্ধ লিখেন এবং তার জবাবে বাকিরা বাহাসে লিপ্ত হন, তখন সবার মধ্যে আসলে কোন না কোনোভাবে এই সঙ্কটকে মোকাবিলা করার কোশেশ ছিল।
ফাদল গণতন্ত্রের পক্ষেই ওকালিত করেন। কিন্তু ইসলামের মধ্যে (অথবা ইতিহাসে) গণতন্ত্র ছিল, বা গণতন্ত্রের আদিরূপ ইসলামে ছিল – এমন কোনো দাবি থেকে খুব সচেতনভাবে তিনি নিজেকে বিরত রাখেন। ঐতিহাসিক দুয়েকটা নজির দিয়ে গণতন্ত্রের উপস্থিতি প্রমাণের কোশেশও তিনি করেন না। গণতন্ত্র যে হালজমানার রাষ্ট্র পরিচালনার মডেল এবং এর উৎস যে ইউরোপে হয়েছে সেটাকে কবুল করে তিনি দাবি করেন, গণতন্ত্রের যে অন্তর্নিহিত বুদ্ধিবৃত্তিক দিকগুলো রয়েছে সেগুলো কেবল ইউরোপের একার সম্পত্তি নয়। বরঞ্চ ইতিহাস প্রমাণ করে যে, ওই সবের বিকাশে ইসলামি দর্শন ও মুসলমানদের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি আসলে ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের জায়গা থেকে গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের সমন্বয়ের কোশেশ করেন। যেমন, গণতন্ত্রে যে জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা বলা হয়, তার সাথে ইসলামি ধর্মতত্ত্বে ঘোষিত আল্লার সার্বভৌমত্ব কী সাংঘর্ষিক? ফাদলের উত্তর হচ্ছে, না।
তিনি কেন ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন থেকে এর ব্যাখ্যা করতে গেলেন? কেননা, তিনি মানেন, ধর্ম এখনো গভীরভাবে মানুষের ব্যবহারকে প্রভাবিত করে। অনেকেই মুসলমানদের জীবনে ধর্মের ভূমিকাকে খাটো করে দেখেন বলে সিদ্ধান্ত নেন যে, ধর্মতত্ত্বীয় বাহাসের প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ফাদলের মতে, অজস্র লোকের জীবনে, এমনকি তার কাছেও, খোদা এক নিত্যনৈমিত্তিক বাস্তবতা। ধর্ম এখনো তাদের কাছে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে অন্যতম নিয়ামক। ফলে, ধর্মের ময়দান থেকে এই বোঝাপড়াকে তিনি জরুরি বলে মান্য করেন। কোরান শরীফ কোনো নির্দিষ্ট ধরনের শাসনব্যবস্থাকে নির্ধারণ করে না দিলেও, ফাদল মনে করেন, কোরান এমন কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের কথা বলে যেগুলো শাসনব্যবস্থার জন্য একেবারে কেন্দ্রীয় বলে বিবেচিত হবে। সামাজিক সহযোগিতা ও পারষ্পরিকতার মাধ্যমে ইনসাফ অনুসন্ধান; অ-স্বৈরাচারী ও পরামর্শমূলক শাসনব্যবস্থা পত্তন; এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়াতে রহম ও দয়াকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা। এই মূল্যবোধগুলোকে প্রমোট করতে সহায়তা করবে এমন যে কোনো ধরনের শাসনব্যবস্থার পক্ষে মুসলমানদের থাকা উচিত বলে মনে করেন ফাদল। এবং, অবশ্যই তার কাছে বর্তমানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই হচ্ছে তেমন উপযোগী শাসনব্যবস্থা।
ফাদলের কাছে গণতন্ত্রের একেবারে কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, সরকারের ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ এবং মৌলিক মানবাধিকারসমূহের হেফাজত। বাদবাকি অধিকারগুলো – যেমন, সমাবেশের অধিকার, বিরোধী দলের উপস্থিতি ইত্যাদি – সব আসলে এই কেন্দ্রীয় বিষোয়গুলোর উপজাত। যখন কেন্দ্রীয় বিষয়গুলোর সাথে বোঝাপড়া হয়ে যাবে, তখন বাকিগুলোর প্রায়োগিতা সহজেই সমাধান করা যাবে। তবে, এই পুরো প্রক্রিয়াটা যে সহজকম্ম নয়, এবং অন্যের অভিজ্ঞতা হুবুহু কপি-কাট করার মামলা নয় সেটাও তিনি বলেন। তিনি বরঞ্চ তার কাজকে কেবল একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ বলেই মান্য করেন।
তাঁর ধর্মতাত্ত্বিক যুক্তিগুলো দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি মৌলিক ধারণার উপরে। এক, মানুষ হচ্ছে দুনিয়ার বুকে খোদাতা’লার খলিফা; দুই, খোদার সাথে এই সম্পর্কটাই ব্যক্তিক দায়িত্বের ভিত্তি; তিন, খলিফা হিসাবে এই দায়িত্ব পালন মানবাধিকার ও সমতার ভিত্তি প্রদান করে; চার, ইনসাফ প্রদান ও খোদার সৃষ্টিকে দেখভাল করার মৌলিক বাধ্যবাধকতা মানবজাতি, বিশেষত মুসলমানদের রয়েছে; পাঁচ, খোদাবি আইন ও মানুষের করা (ভুল হওয়ার সম্ভাবনাসহ) তাফসিরের মধ্যে মৌলিক ফারাক রয়েছে; ছয়, রাষ্ট্রকে কোনোভাবেই খোদার সার্বভৌমত্ব ও মহিমাকে মূর্ত করে তোলার করার ভান করা উচিত নয়। গণতন্ত্রের পক্ষে হাজির তাঁর সকল যুক্তি দাঁড়িয়ে আছে এই পাটাতনের ওপর।
অনেকেই রাশিদ আল ঘানুচ্চি, ইউসুফ আর কারজাভিদের মতো পণ্ডিতদের সাথে ফাদলের আলাপকে তুলনা করলে ফাদল সচেতনভাবে তাদের অবস্থানের চেয়ে নিজের অবস্থানের ফারাক পষ্ট করেন। তিনি বলেন, বাকিদের মতো তিনি মনে করেন না যে, ইসলামই গণতন্ত্র সবার আগে প্রতিষ্ঠা করেছে, এবং প্রথম যুগের কিছু অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গণতন্ত্রের একরৈখিক কোনো আখ্যানে তাঁর আস্থা নেই। গণতন্ত্র ইসলামের ট্র্যাডিশনাল বোঝাপড়ার প্রতি যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়, তাকে মোকাবিলা করার সিরিয়াস কোনো কোশেশও তাদের নেই বলে মনে করেন। বাকিরা যেখানে ইসলামি রাষ্ট্রের পক্ষে ওকালতি করেন, খোদার নামে শরিয়া আইন প্রয়োগের কথা বলেন, ফাদল উলটো মনে করেন এমন কোনো ধরনের রাষ্ট্র আদতে মূর্তিপূজার সামিল (form of idolatry)। তারা ব্যক্তির অধিকারের পক্ষে অতোটা সোচ্চারও নয়, যতটা ফাদল গুরুত্ব দেন।
আগেই বলেছি, ফাদলের প্রবন্ধের ওপর বেশ সিরিয়াস বাৎচিত ও বাহাস শুরু হয়। আমি দুজনের কথা আপাতত বলবো। তাঁর আলাপের ভূয়সী প্রশংসা করেন নাদের হাশমি। নাদের হাশমি কেন প্রশংসা করলেন, এটা তাঁর কাজ থেকেই আন্দাজ করা যায়। তিনি উদার গণতন্ত্রের সাথে ধর্মের বিশেষত ইসলামের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেছেন। ধর্মীয় রাজনীতির সাথে উদার-গণতান্ত্রিক বিকাশের জলঅচল সম্পর্ককেই প্রশ্নবিদ্ধ করার কোশেশ করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রশ্নই ছিল, মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় উদার গণতন্ত্র কীভাবে ফাংশন করবে, যে গণতন্ত্রের জন্য কিনা একরনের সেকুলারিজমের জরুরত রয়েছে। তাঁর তিনটা প্রধান যুক্তি ছিল। প্রথমত, ধর্ম যে সমাজে পরিচয়ের অন্যতম প্রধান নির্ধারক, সেখানে সেকুলারিজমের একধরনের ধর্মভিত্তিক তত্ত্ব গড়ে তোলা জরুরি। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় রাজনীতির দরজা বাদ দিয়ে উদার গণতন্ত্রের দিকে যাওয়া সম্ভব হবে না। ফলে, সরকারব্যবস্থার ধর্মের নরম্যাটিভ ভূমিকা নিয়ে দরকষাকষি ও মুলামুলি এই বিকাশের অন্তর্নিহিত অংশ। তৃতীয়ত, গণতান্ত্রীকরণ ও লিবারেলাইজেশনের জন্য ধর্মকে একেবারে খারিজ না করে ধর্মীয় ধারনাগুলোর নানাবিধ ব্যাখ্যা ও তাফসির করা জরুরি। নাদের হাশমি যে ধরনের বোঝাপড়া তৈরির কথা তাঁর কাজে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ফাদলের প্রবন্ধ যেন তারই এক নজির। ফলে তিনি এর প্রশংসা করেন।
অন্যদিকে, বেশ কড়া সমালোচনা আসে সাবা মাহমুদের কাছ থেকে। সাবা মাহমুদ প্রশ্ন করেন, লিবারেলিজমই কী ইসলামের একমাত্র দিশা/পন্থা? ইউরোপীয় মূল্যবোধের সাথে খাপ খাচ্ছে কিনা – ইসলামকেই কেন নিজেকে সেটা প্রমাণ করার বার্ডেন নিতে হবে? তিনি ইন্ডিভিজুয়ালিজমের বাইরে ইসলামের ইতিহাসে থাকা সামষ্টিক অধিকার নিয়ে কথা বলেন। পাশাপাশি, লিবারেলিজমে ভেতরে থাকা সহনশীলতারও একটি সহিংস ইতিহাস ও যাত্রার দিকে ইঙ্গিত করেন। ফাদলের প্রবন্ধ দার্শনিক চর্চা থেকে গুরুত্বপূর্ণ মান্য করেই সাবা মাহমুদ আরেকটি সমালোচনা করেন, ফাদল মুসলমান দুনিয়ার আরেকটি বাস্তবতাকে আমলে নেননি। মুসলমান দুনিয়ার যে সকল দেশে প্রবল স্বৈরাচারী শাসন ক্ষমতায় রয়েছে তারা কোনো না কোনোভাবে লিবারেল মার্কিন সরকারের মদদপ্রাপ্ত।
পশ্চিমা মূল্যবোধের সার্বজনীনতাকে ক্রিটিক করতে গিয়ে ইসলামী মূল্যবোধকে প্রান্তিক হিসাবে তুলে ধরাকে ফাদল বিপজ্জনক বলে মনে করেন। ইসলামের স্বতন্ত্রকে অতিরিক্ত জোরারোপ করতে গিয়ে খোদ ইসলামের অভিজ্ঞতার যে সার্বজনীনতা রয়েছে সেটা উপেক্ষিত হয়ে যেতে পারে। পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হিসাবে ইসলামকে দাঁড় করিয়ে দেওয়াটাকে তিনি ইতিবাচকভাবে দেখেন না। সেখানে সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদের বিপদও দেখেন। ফাদল উলটো অভিযোগ করেন, সাবা মাহমুদ ও অন্যান্যদের খেয়াল থাকে না যে, মুসলিম দুনিয়ার শাসকরা সামষ্টিক অধিকারের ধুয়ো তুলেই নাগরিকদের ক্রমাগত নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছেন। রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে ব্যক্তিকে হেফাজত করাকেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।
বইয়ের হদিস :
Khaled Abou El Fadl, Islam and the Challenge of Democracy, Princeton University Press, 2004
Nader Hashemi, Islam, Secularism, and Liberal Democracy: Toward a Democratic Theory for Muslim Societies, Oxford University Press, 2009