‘হিন্দু পরিবারে জন্ম নেওয়া কবিতা (ছদ্মনাম) ভালোবেসে বিয়ে করেন গোপাল কর্মকারকে (ছদ্মনাম)। তারা প্রথমে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বিয়ে করেন। বিয়েটি আরও শক্ত হবে ভেবে পরদিন তারা নোটারি পাবলিকের কাছে এফিডেভিট করেন। বিয়ের পর তারা নারায়নগঞ্জে ভাড়া বাসায় সংসার শুরু করেন। গোপাল বিয়ের সময় স্কুলে চাকরি করতেন। বিয়ের পর সরকারি কলেজে চাকরি নিয়ে সন্দ্বীপে চলে যান। তখন কবিতা ঐ বাসাতেই বসবাস করতে থাকেন, গোপাল আসা–যাওয়া করতেন। পরবর্তী সময়ে গোপাল ঢাকায় বদলি হয়ে আসেন এবং তারা রাজাবাজার এলাকায় বাসা ভাড়া করে বসবাস শুরু করেন। কবিতা এ সময়ে একটা স্কুলে চাকরি করা শুরু করেন। কবিতার বিবাহিত জীবনের দীর্ঘসময় পার হয়ে গেলেও সন্তান না হওয়ায় অনেক চাপাচাপির পর গোপাল ডাক্তারের কাছে যেতে সম্মত হন। ডাক্তার তাদের পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে টেস্টটিউব বেবি নেয়ার পরামর্শ দেন। এতে সম্মত হয়ে অনেক খরচের কথা বলে গোপাল কবিতার জমানো সমস্ত টাকা নিয়ে নেন। কিন্তু গোপাল টেস্টটিউব বেবি নেয়ার ব্যাপারে পরবর্তী সময়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেননি। কবিতা অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এ সময় থেকে ধীরে ধীরে কবিতার প্রতি গোপালের আচরণ বদলাতে থাকে। গোপাল প্রায়ই কবিতার সাথে খারাপ আচরণ করা শুরু করেন। ২০০৭ সালের জুলাই মাসে ভাড়া বাসায় কবিতাকে একা রেখে গোপাল চেলে যান এবং ফোন করে জানান, তিনি কবিতার সঙ্গে আর সংসার করবেন না। অথচ কবিতা গোপালের কারণেই তার বাবা–মা ভাইবোনদের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন। পরের মাসেই গোপাল দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এতে কবিতা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তিনি আইনগত সহযোগিতার জন্য আইন ও সালিশ কেন্দ্রে (আসক) আসেন। আসক থেকে উভয়কে নিয়ে সালিশে বসা হলেও কোনো সমাধানে আসা সম্ভব হয় না। কবিতা আদালতের দ্বারস্থ হন। প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা হারে কবিতাকে আজীবন ভরণপোষণ প্রদান করবেন এবং দুজনে পৃথক বসবাস করবেন এবং কারও সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করবেন না মর্মে আদালতের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয়।
গোপাল ঠিকই তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করছেন। কিন্তু কবিতা স্বামীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকার পরও বিবাহিতা হিসেবে শাঁখা–সিঁদুর পরে গোপালের স্ত্রী পরিচয়ে জীবন অতিবাহিত করছেন। (সূত্রঃ বাংলাদেশের আইনে নারী নির্যাতন প্রসঙ্গ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, পৃষ্ঠা ৬৮–৬৯)
বাংলাদেশে প্রচলিত সনাতনী হিন্দু আইনে বিয়ে কোনো চুক্তি নয়। সকল ধর্মীয় ও জাগতিক কার্যসাধনের উদ্দেশ্যে বিয়েকে স্বামী–স্ত্রীর অবিচ্ছেদ্য বন্ধন হিসেবে দেখা হয়। সেকারণে হিন্দু নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমোদন নেই। হিন্দু নারী কিংবা পুরুষ কোনো পক্ষই কোনো পরিস্থিতেই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে সক্ষম নয়। তবে একজন হিন্দু পুরুষ ইচ্ছে করলেই স্ত্রী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও যতবার ইচ্ছে বিয়ে করার অধিকার রাখেন। সেজন্য বিশেষ কারণ বা আগের স্ত্রীর/স্ত্রীদের বা কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমতি–অনুমোদনের দরকার পড়ে না। প্রচলিত সনাতন হিন্দু আইনেই বহুবিবাহ অনুমোদিত। এর অর্থ হচ্ছে, বহুবিবাহ ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিতে অবৈধ বা অগ্রহণযোগ্য নয়, সেইসাথে হিন্দু পুরুষের বহুবিবাহ রাষ্ট্রীয় আইনেও শাস্তিযোগ্য নয়। অন্যদিকে একজন বিবাহিত হিন্দু নারী আদালতের মাধ্যমে বড়জোর স্বামী থেকে পৃথক বসবাস ও ভরণপোষণের অধিকার পেতে পারেন।
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসকদের উদ্যোগে উনিশ শতকে এ অঞ্চলে বিধিবদ্ধ আইনের সূচনা হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক, দাপ্তরিক কাজের সুবিধার্থে ও আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ও কর্তৃত্বে রাখার প্রয়োজনে মূলত আইনগুলো তৈরির উপলক্ষ্য সৃষ্টি হয়। দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, দেওয়ানি কার্যবিধির মতো গুরুত্বপূর্ণ আইন তৈরি হলেও ব্রিটিশ শাসকগণ বিভিন্ন ধর্ম–জাতিগোষ্ঠী–সম্প্রদায়ের নিজ নিজ ধর্মীয় আইন তথা প্রচলিত প্রথাসিদ্ধ আইনের ব্যাপারে এবং সেগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করে। অথচ ধর্ম ও প্রথা থেকে উৎসারিত ব্যক্তিগত আইনগুলো বৈষম্যপূর্ণ, পীড়নসহায়ক ও পিতৃতান্ত্রিক চেতনাজাত। বলাবাহুল্য, এইসব আইনের প্রধান শিকার হয়েছে নারী। ব্রিটিশের নীরবতার কারণ বোধগম্য। সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়ার অনিবার্য লক্ষ্যই হলো মুনাফা সর্বোচ্চকরণ। উপনিবেশের মানুষের সুযোগ–সুবিধা বৃদ্ধি কিংবা সার্বিক মঙ্গলকরণ তাদের অভীষ্ট হতে পারে না। তাছাড়া ব্যক্তিগত আইনকে রাষ্ট্রীয় আইনের আকার দিয়ে আইনের দৃষ্টিতে সবাইকে সমানভাবে দেখা ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের সর্বজনীন মানবাধিকার নিশ্চিত করা ঝুকিপূর্ণ ছিল। সেটা করতে গেলে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের পিতৃতান্ত্রিকতার পাহারাদার পুরুষেরা ধর্মের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশের বিপক্ষেই দাঁড়িয়ে যেতেন। ব্যবসা–বাণিজ্য–মুনাফা করতে এসে অহেতুক ঝামেলা বাড়াবেন কেন তারা। সেকারণে ব্যক্তিগত আইনের (personal law) বিষয়টি সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছে ব্রিটিশ শাসকগণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে সতীদাহ প্রথা বাতিল করে আইন ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়। এই দুটি আইন ছাড়াও ১৮৭২ সালে বিশেষ বিবাহ আইন প্রণীত হয়। এসব আইন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রচলিত হিন্দু সনাতন ধর্মশাস্ত্রের বিধিবিধানের সাথে সংঘর্ষ ও সমন্বয় করে মানুষের মাঝে স্থান পায়। তবে মোটাদাগে হিন্দুদের বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, পুনর্বিবাহ, সম্পত্তি, উত্তরাধিকার, দত্তক ইত্যাদি ব্যক্তিগত অধিকার সংক্রান্ত আইন, শাস্ত্রের অনুসৃত বিধি দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানকাল ও ১৯৭১–এ স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের জন্মের পঞ্চাশ বছর হলেও হিন্দুদের পারিবারিক আইনের সংস্কার সম্ভব হয়নি। হিন্দুদের বিবাহ বিচ্ছেদের আইনও তৈরি হয়নি। অথচ, দেশভাগের পর প্রতিবেশী দেশ ভারতে সেই ১৯৫৫ সালে হিন্দু বিবাহ আইন পাশ হয়েছে। যার মাধ্যমে হিন্দুদের বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এমনকি একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র নেপালেও বিবাহ বিচ্ছেদের আইন আছে।
কিন্তু বাংলাদেশে অনুরূপ আইন তৈরির কার্যকর সরকারি উদ্যোগ অদ্যাবধি গ্রহণ করা হয়নি। ২০১২ সালে প্রণীত ‘হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন’ রাষ্ট্র কর্তৃক হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য সর্বশেষ আইনি সুরক্ষা। যদিও শুভঙ্করের ফাঁকির মতো করে আইনটিকে ‘ঐচ্ছিক’ করে রাখা হয়েছে। মানে দাঁড়াচ্ছে, আইন না মানলেও অসুবিধা নেই। আইনের ৩(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘উপধারা (১) এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোন হিন্দু বিবাহ এই আইনের অধীনে নিবন্ধিত না হইলেও উহার কারণে কোনো হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী সম্পন্ন বিবাহের বৈধতা ক্ষুণ্ন হবে না’। একইসাথে আইন মানা ও না মানার বিধান সংযুক্ত রাখা আইনের মোলিক উদ্দশ্যকেই ব্যহত ও প্রশ্নবিদ্ধ করে রাখার শামিল।
২০১২ সালে বাংলাদেশ আইন কমিশন সরকারের কাছে ‘হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কারের সুপারিশ বিষয়ক আইন কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন’ পেশ করে। আইন কমিশনের উক্ত গবেষণালব্ধ সুপারিশে হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইন পাশের জোরাল দাবি জানানো হয়। সেইসাথে বিবাহ নিবন্ধন (২০১২ সালে বিবাহ নিবন্ধন আইন পাশ হয়েছে, যদিও আইনটি ঐচ্ছিক), বিবাহ বিচ্ছেদ ও পুণর্বিবাহ, বহুবিবাহ রোধ, অসবর্ণ বিবাহ, সম্পত্তি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা, সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার, ভরণপোষণ ও সন্তানের অভিভাবকত্ব ইত্যাদি বিষয়ে আইন সংস্কারের ব্যাপারে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। আইন কমিশনের রিপোর্টে জনমত জরিপে কমিশনের প্রশ্ন ছিল, ‘হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ ও পুণর্বিবাহের সুযোগ থাকতে পারে কি? জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ৮০% হ্যাঁ, ১৫% না ও ৫% মন্তব্য প্রদানে বিরত থাকেন।
আইন কমিশন সুপারিশে উল্লেখ করেন, ‘যে সমস্ত কারণে হিন্দু নারীর পৃথক বসবাসকে আইনগত স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে তার অধিকাংশ কারণই বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য যুক্তিসংগত কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সুনির্দিষ্ট কারণে আদালতের অনুমোদন সাপেক্ষে এই বিচ্ছেদ কার্যকর করা যেতে পারে। বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হওয়ার পর উভয় পক্ষ পুণর্বিবাহ করতে পারবে’। (সূত্রঃ হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কারের সুপারিশ বিষয়ক আইন কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন, ০৭ অগাস্ট, ২০১২)
১৯৪৬ সালে পাশ হয়, ‘The Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act’ অর্থাৎ বিবাহিত হিন্দু নারীর পৃথক বাসস্থল ও ভরণপোষণ আইন। এই আইনের ২ ধারায় নিম্নলিখিত এক বা একাধিক কারণে একজন হিন্দু বিবাহিত নারী স্বামীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে বসবাস করতে পারবেন এবং সেক্ষেত্রে তিনি স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাবেন:
(১) যদি স্বামী কোন ‘ঘৃণ্য বা নিকৃষ্ট’ (loathsome) রোগে ভোগেন যা তার স্ত্রীর কাছ থেকে আসেনি;
(২) যদি সে (স্বামী) তার (নারী) প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করেন যা কি না তার সাথে থাকাকে অনিরাপদ বা অনাকাঙ্ক্ষিত করে তোলে;
(৩) যদি স্বামী, স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া বা তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে পরিত্যাগ করে;
(৪) যদি স্বামী পুনরায় বিয়ে করে;
(৫) যদি স্বামী ধর্মান্তরিত হয়;
(৬) যদি তিনি (স্বামী) বাড়ীতে উপ–পত্নী রাখেন বা অভ্যাসগতভাবে উপপত্নীর সাথে বসবাস করেন;
(৭) অন্যকোন যুক্তিসঙ্গত কারণে ।
হিন্দু নারীর পৃথক বসবাসের বিধান আপাত দৃষ্টিতে একটি ভাল সমাধান মনে হলেও এটি আসলে একজন নারীর মৌলিক চাহিদা ও অধিকারের পরিপন্থী। এই আইন আসলে শাঁখা–সিঁদুর পরে বৈধব্যপালনের সমতুল্য। নারী ও পুরুষের স্বামী–স্ত্রী হিসেবে বা সঙ্গী (partner) হিসেবে একসাথে থাকা আন্তঃসম্পর্কের মধ্যে যৌনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হিন্দু নারীর পৃথক বসবাসের এই আইন নারীর যৌনতাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছে।
আইনের ২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘শর্ত থাকে যে একজন নারী পৃথক বসবাস ও ভরণপোষণের অধিকারী হবে না যদি সে ‘অসতী’ হয় অথবা সে যদি অন্য ধর্ম গ্রহণ করে অথবা দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের ডিক্রি পাওয়ার জন্য যুক্তিসঙ্গত কারণ দর্শাতে ব্যর্থ হয়।
সেইসাথে আমরা যদি ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইনের ৪৯৪ ধারা পাঠ করি তাহলে নারীর যৌনতা ও পুনরায় নতুন জীবন শুরু করার প্রচেষ্টাকে কীভাবে দমন করা হয়েছে তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হব। ৪৯৪ ধারায় বলা হয়েছে,
‘যদি কোনো ব্যক্তি এক স্বামী বা এক স্ত্রী জীবিত থাকা সত্ত্বেও পুনরায় বিয়ে করেন, তাহলে দায়ী ব্যক্তি ৭ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন’।
বহুবিবাহরোধকল্পে ৪৯৪ ধারা তৈরি করা হলেও আইনটির কার্যকারিতা মূলত খ্রিস্টান সম্প্রদায় ও সব ধর্ম সম্প্রদায়ের নারীর জন্য কার্যকরী হয়ে আছে। কারণ, হিন্দু ও মুসলমান পুরুষের একাধিক বিয়ে যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলিম আইন অনুসারে অবৈধ নয়। কিন্তু একজন হিন্দু নারী আইনসঙ্গতভাবে আলাদা বসবাস করতে পারলেও যেহেতু বিয়েটি বাতিল হচ্ছে না এবং স্বামী জীবিত সেকারণে অন্যকারও সাথে আইনগত বৈধ সম্পর্ক স্থাপনে সে অপারগ।
হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদের পক্ষে আইন কমিশনের প্রতিবেদন ছাড়াও এনজিও সংস্থাগুলো হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন। এই দাবিতে হাইকোর্টে রিটও দায়ের করেন মানবাধিকার কর্মী এলিনা খান।
‘হিন্দু আইনে ‘তালাক’ অন্তর্ভুক্ত না করার দাবি’ শিরোনামে জাগো নিউজ ২৪ ডট কম প্রকাশিত ১৪ই ফেব্রুয়ারি ২০১৬’র প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহিলা জোট ’শাশ্বত হিন্দু বিধি বিধান ধ্বংস করে ‘হিন্দু আইনে তালাক’ অন্তর্ভুক্ত না করার দাবিতে ব্যানার সহযোগে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করছেন।
হিন্দু বিবাহ আইনে তালাক ব্যবস্থা সংযুক্ত করতে মানবাধিকার কর্মী এলিনা খানের হাইকোর্টে রিট করার প্রতিবাদে এ মানবন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, হাজার বছর ধরে অবিকৃতভাবে চলমান শান্তিপূর্ণ পরিবার ব্যবস্থায় দুটি মানুষ একত্রিত হয়। হিন্দু পুরুষের জীবনে নারী আসে অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে, তাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। এমনকি স্বামীর থেকে পৃথক থাকলেও নারীর ভরণ–পোষণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
সংগঠনটির সভাপতি ড. সেলিনা দত্তের সভাপতিত্বে মানবন্ধনে হিন্দু মহিলা জোটের নির্বাহী সভাপতি প্রীতিলতা বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট প্রতিভা বাগচী, বিথী দত্ত, হিন্দু মহাজোটের সভাপতি দেবাশীষ মন্ডল, মহাসচিব অ্যাডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
ওদিকে, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে হিন্দু ধর্মীয় নেতাদেরকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে হিন্দু আইন সংস্কারের একটি খসড়া তৈরি করতে বলা হলেও তাদের ভেতরে কোনও উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি।
এ ব্যাপারে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, “এখনকার পরিস্থিতি হলো, সংখ্যালঘুদের ওপর সামগ্রিকভাবে নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে। তারা অস্তিত্বের সংকটে আছে। ফলে এখন অস্তিত্ব রক্ষা করবে নাকি অভ্যন্তরীণ সংস্কারের বিষয়ে কাজ করবে। এসব প্রশ্নে একটা বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সেজন্য কোনো উদ্যোগ নেয়া যাচ্ছে না।”
অর্থাৎ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর ‘সামগ্রিকভাবে নির্যাতনের অভিযোগের’ কথা বলে নারীদের অধিকার প্রশ্নে উদ্যোগের বিষয় এড়িয়ে যান তিনি। তাদের বেশিরভাগে নেতাই এখনো এমন আইনের বিপক্ষে রয়েছেন।
এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিম চন্দ্র ভৌমিক বলেন, বিয়ে বা পরিবার নিয়ে ধর্মের স্বীকৃত বিধান চলে আসছে দীর্ঘ সময় ধরে। সেজন্য তাতে সংস্কারের ব্যাপারে তাদের সমাজে জড়তা আছে বলে তিনি মনে করেন। একইসাথে তিনি বলেছেন, বিবাহ বিচ্ছেদের ব্যবস্থা করা হলে তখন ঠুনকো বিষয়েই পরিবারগুলোর বন্ধন ভেঙে যেতে পারে। সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। এমন ভয়ও তাদের অনেকের মধ্যে রয়েছে। (সূত্রঃ বিবাহ–বিচ্ছেদের অধিকার চান হিন্দু নারীরা, কাদির কল্লোল, বিবিসি বাংলা, ঢাকা, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬)
এদিকে তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ মনে করেন, ‘বিবাহ বিচ্ছেদ এবং সম্পত্তির মালিকানাসহ হিন্দু নারীদের অধিকারের প্রশ্নে আইন প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগ নিলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগ তোলা হতে পারে, এমন ভয় সরকারের মধ্যে কাজ করে বলে তাঁর ধারণা’।(সূত্রঃ বিবাহ–বিচ্ছেদের অধিকার চান হিন্দু নারীরা, কাদির কল্লোল, বিবিসি বাংলা, ঢাকা, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬)
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা নীনা গোস্বামী বলেন, “হিন্দু নারীরা মূলত ঘরে নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে স্বামী থেকে আলাদা থাকার আবেদন নিয়ে আসেন।”
“তখন সালিশ–সমঝোতার মাধ্যমে ভরনপোষণের অর্থ নিয়ে তারা আলাদা হচ্ছেন। বিয়ের কিন্তু সমাপ্তি ঘটছে না। সেখান থেকে তাদের বেরুবার কোনো পথ নেই। হিন্দু নারীরা এখন বিবাহ–বিচ্ছেদরে অধিকার চাইছেন”– বলেছেন নীনা গোস্বামী। (সূত্রঃ ঐ)
এছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদের বিরুদ্ধ পক্ষের যুক্তি হচ্ছে, ‘মুসলিম সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রচলন থাকায় নারীরা নিরাপত্তাহীন জীবন বেছে নিচ্ছে। বিচ্ছেদের শিকার নারীরা পেশা হিসবে যৌনকর্ম বা অপরাধ জগতে যংযুক্ত হচ্ছে। অন্যদিকে তাঁদের শিশুরা পরিত্যাক্ত হয়ে অপরাধজগতে প্রবেশ করছে’। ( সূত্রঃ আইন কমিশনের প্রতিবেদন)
হিন্দু নেতৃবৃন্দের অনাগ্রহ ও হিন্দু সংগঠনের তৎপরতার কারণে হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইন না হওয়ার প্রধান অন্তরায়। বৈষম্যমূলক শ্রেণি ব্যবস্থার সুবিধাপ্রাপ্ত সমাজের এইসব উঁচুতলার হিন্দু এলিটদের কারণে হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের মতো একটি বাস্তবসম্মত, অতি জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ ও দরকারি আইন প্রণয়ন হতে পারছে না। হিন্দু পিতৃতন্ত্রের এইসব মোড়লেরা হিন্দু নারীদেরকে স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করে তাঁদেরকে আধুনিক দাস হিসেবে অন্তরীণ করে রেখেছেন।
সনাতন ঋষিদের সংজ্ঞায় স্ত্রী স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তিই। মনুর [৯:৩] বিধানে নারী চিরস্বাধিকারহীন অসহায় শিশু:
‘নারীকে কুমারিকালে পিতা, যৌবনে স্বামী ও বার্ধক্যে পুত্ররা রক্ষা করবে। নারী কখনোই স্বাধীন থাকার যোগ্য নয়’।
হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের অবর্তমানে বিচ্ছেদের ভূয়া, অগ্রহণযোগ্য ও আইনি মূল্যহীন কাগজের কথা শোনা যায়। এইসব কাগজ আসলে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে সম্পাদিত এফিডেভিট বা হলফনামা। নন জুডিশিয়াল স্টাম্পে নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে বা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে গিয়ে এই ধরণের হলফনামা করা হয়। হলফনামা একটি ঘোষণা ছাড়া আর কিছু নয়। এটি বিবাহ কিংবা বিবাহ বিচ্ছেদের আইনগত দলিল হিসেবেও স্বীকৃত নয়। আদালতে এই জাতীয় কাগজের মূল্য নেই।
জাতি–ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের নারীরা বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ ও সম্পত্তির ক্ষেত্রে সম অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ, সিডও সনদ এবং বাংলাদেশের সংবিধানের ২৬, ২৭, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদে নারী–পুরুষের সমানাধিকারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। বিশেষ করে ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী’। বিবাহ বিচ্ছেদ আইন হলে নারীরা নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়বে, বিচ্ছেদের শিকার নারীরা যৌনকর্মী হয়ে অধঃপাতে যাবে, ঠুনকো বিষয় নিয়ে সংসার ভেঙ্গে যাবে, অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে, ধর্ম ও জাত যাবে— এইসবই কর্তৃত্বপরায়ন হিন্দু পিতৃতন্ত্রের সুপ্রাচীন অজুহাত, যা হাজার বছর ধরে নারীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হিন্দু অধ্যুষিত রাষ্ট্র ভারতের হিন্দু জনগোষ্ঠী সেই ১৯৫৫ সাল থেকে হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের সুবিধা ভোগ করে আসছে। কই তাদের কাছ থেকে তো আমরা এসব অজুহাত শুনতে পাই না।
তাই সময় হয়েছে হিন্দু আইন সংস্কারের বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার। বিশেষ করে হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইন প্রণয়ের পক্ষে সামাজিক–নাগরিক আন্দোলন শুরু করা সময়ের দাবি।