* অনুবাদ: আনিয়া ফাহমিন
[ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী ডেভিড গ্রেইবার এর এই প্রবন্ধটি ২০১২ সালে the Baffler ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রবন্ধটিতে গ্রেইবার ম্যাজিক বা জাদুর ধারণা ও রাজনীতির মধ্যে একটি অন্তর্গত সম্পর্ক আবিষ্কার করছেন, যেখানে রাজনৈতিক পারফরম্যান্সের মধ্যে কীভাবে ধর্মতাত্ত্বিক ও জাদুকরী একটা চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায় সেদিকে ইঙ্গিত করছেন। অরাজের জন্য গ্রেইবারের এই প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন আনিয়া ফাহমিন। মূল ইংরেজি প্রবন্ধটি এই লিংকে ক্লিক করলে পাবেন– সম্পাদক]
১.
রাজনীতিবিদরা স্বভাবতই অসৎ, তারা সকলেই মিথ্যার আশ্রয় নেয়। তবে মার্কিন রাজনীতির অনেক পর্যবেক্ষকই স্বীকার করবেন যে, বিগত কয়েক বছরের রাজনৈতিক অসততার মাত্রায় একপ্রকার গুণগত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। পারতপক্ষে নির্দিষ্ট কিছু দলীয় এলাকায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ব্যাপারে একপ্রকার গর্হিত, উদ্ভট মিথ্যাচারকে বৈধতা দেয়ার জন্য নিয়ম পরিবর্তনের সচেতন প্রচেষ্টা লক্ষণীয়, যা অন্যান্য রাষ্ট্রে সচরাচর দেখা যায় না। সারাহ প্যালিন ও তার “ডেথ প্যানেল” এই নতুন শৈলীর প্রবর্তক হলেও দ্রুতই মিশেল বাখম্যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শরিয়া আইন আরোপের সরকারি পরিকল্পনা বা ডলার ত্যাগ ও চীনা ইউয়ান দিয়ে এটি প্রতিস্থাপনের গোপন পরিকল্পনার দাবির মাধ্যমে বিষয়টিকে দর্শনীয় উচ্চতায় নিয়ে যায়। মিট রমনিই মিথ্যাচারের মহিমা বা আড়ম্বরের দিক থেকে প্যালিন বা বাখম্যানকে অতিক্রম করতে না পারলেও, সম্পূর্ণ জালিয়াতির ভিত্তিতে তার সমগ্র প্রেসিডেন্সিয়াল কেম্পেইন পরিচালনার মাধ্যমে মাত্রায় তা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। রিপাবলিকানদের এমন নির্লজ্জ মিথ্যাচারকে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত উস্কানি ছাড়া অন্য কিছু ভাবা কষ্টকর। প্রার্থীরা যেন মিডিয়া এবং ডেমোক্র্যাটদের চ্যালেঞ্জ করছে তাদের মিথ্যাবাদী আখ্যা দেয়ার জন্য।
এর অর্থ কী দাঁড়ায়? প্রথমত, ব্যাপারটা কাকতালীয় হতে পারে না যে উপরোক্ত তিনজন রাজনীতিবিদই অত্যন্ত ধার্মিক। সারাহ প্যালিন এবং মিশেল বাখম্যান ইভেনজিলিকাল; রমনি একসময় মরমন বিশপ ছিলেন। এইসব ধর্মীয় মহলে বিশ্বাস এবং মিথ্যা হল এমন বিষয় যা একজনের অভ্যন্তরীণ অবস্থা নির্দেশ করে। ফলে যখন মিডিয়া কর্তৃক এসব রাজনীতিবিদদের মিথ্যা ফাঁস হয় তখন তাদের ধর্মীয় সমর্থকরা অবিচলিত থাকে। বরঞ্চ, কোন সাংবাদিক যদি সচেতন অসততার প্রতি ইঙ্গিত করে তবে তাদের সমর্থকদের সেই সাংবাদিকের উপর ক্ষুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ক্যারিশম্যাটিকস এবং ইভাঞ্জেলিক্যালরা খ্রিস্টধর্মের এমন রূপ অনুসরণ করে যেখানে পারতপক্ষে বিশ্বাসই একমাত্র উপাদান। বিশ্বাসীদের, যারা স্বর্গীয় আত্মার কাছে নিজেদের সঁপে দিয়েছে,তাদের নিয়তের পবিত্রতা সম্পর্কে কোন প্রশ্নই থাকতে পারে না। অথচ কিছু সেকুলার লিবারেল এলিটিস্ট মিডিয়া তাদের মিথ্যাবাদী বলছে?
ডানপন্থী রিপাবলিকানরা যা করছে তা মূলত একপ্রকার জাদুকরী কৌশলের রাজনৈতিক পারফরম্যান্সের একটি ধর্মতাত্ত্বিক সংস্করণ। তারা বিশ্বাসের দ্বারা একটা জগতকে বাস্তবে রূপ দেয়ার চেষ্টা করছে।
অবশ্যই লিবারেলদের জন্য এর অর্থ হল, রিপাবলিকানরা তাদের নিজস্ব উদ্ভাবিত এক স্বপ্নের দুনিয়ায় বসবাস করে। তারা নিজেদের “রিয়ালিটি বেসড কমিউনিটি‘ হিসেবে কল্পনা করে, যারা তথ্য–প্রমান সংগ্রহে দৃঢ়ভাবে গুরুত্ব আরোপ করে এবং জগতের প্রকৃত রুপ অনুসন্ধান করে।
কথাটার উৎপত্তির মধ্যেই এর অর্থ নিহিত। প্রাক্তন ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল প্রতিনিধি রন সাস্কিন্ডের নিউ ইয়র্ক টাইম ম্যাগাজিনে লেখা “Faith, Certainty and the presidency of George W. Bush” – শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে এটি নেয়া।
প্রবন্ধটি মূলত আমার আলোচ্য বিষয়টিই ব্যাখা করে, যে বুশ ফ্যানদের জন্য তার অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসের পবিত্রতাটাই গুরুত্বপূর্ণ। তবে যে অনুচ্ছেদটি সাস্কিন্ড কে বিখ্যাত করে তোলে তা ছিল বুশের একজন অজ্ঞাতনামা ঊর্ধ্বতন উপদেষ্টার সাথে কথোপকথন, যা তার ভাষ্যমতে বুশের প্রেসিডেন্সির একেবারে মূলে প্রবেশ করে।
সহযোগীটি বলেছিলেন যে আমার মতো মানুষেরা এমন সমাজে বাস করে ” যাকে আমরা বলি রিয়ালিটি বেসড কমিউনিটি”। এসব মানুষকে তিনি এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন যে, যারা “বিশ্বাস করেন যে সমাধানগুলি আপনাদের উপলব্ধিযোগ্য বাস্তবতার বিচারপূর্ণ অধ্যয়ন থেকে বেরিয়ে আসে।” আমি আলোকিত নীতি এবং অভিজ্ঞতাবাদ সম্পর্কে কিছু বিড়বিড় করে বললাম। সে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “বর্তমান বিশ্ব আর এভাবে কাজ করে না, আমরা এখন একটি সাম্রাজ্য, এবং যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে আমরা নিজস্ব বাস্তবতা তৈরি করি এবং যেই সময়ে আপনি সেই বাস্তবতা অধ্যয়ন করবেন, অবশ্যই বিবেচনার সঙ্গে, আমরা আবার নতুন বাস্তবতা তৈরি করব, সেগুলিও আপনি অধ্যয়ন করতে পারবেন। আমরা ইতিহাসের অভিনেতা… এবং আপনি, আপনারা সবাই, আমরা যা করি তা শুধুমাত্র অধ্যয়ন করবেন।”
লিবারেলরা যা যা বিশ্বাস করতে চাইতো তার সবই এই অনুচ্ছেদটি নিশ্চিত করে।
“Proud member of the reality based community” ঘোষণা দিয়ে বাটন, টিশার্ট তৈরি হতে থাকে। বাক্যটি একটি শিবলেথ–এ পরিণত হয়। তবে এক্ষেত্রেও যে যা দেখা যায় তার সবটা সত্যি নয়, এমনটা ভাবার কারণ আছে। পরবর্তীতে অনেক সাংবাদিকই দেখিয়েছেন যে সাস্কিন্ডের কাজ অবাস্তব সব গুণাবলী এবং এমন কিছু উক্তির সমন্বয়ে গঠিত যার সোর্সদের খুঁজে বের করার পর তারা দাবি করেন এমন কথা তারা কখনো বলেননি। তাছাড়া বুশের কোন সহযোগীকে অন্য কেউ এমন কথা বলতে শোনেননি। পুরো ঘটনাটা বানোয়াট হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
রিয়ালিটি বেসড কমিউনিটির সম্পূর্ণ ধারণাটাই কি একটি অসাধারণ ভণ্ডামি? বর্তমান আমেরিকার রাজনৈতিক বিতর্কের সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হলো, মেইনস্ট্রিম ডান এবং বামপন্থীরা তাদের নিজস্ব বাস্তবতা তৈরিতে এতটাই মগ্ন যে কোন প্রকার অর্থবহ কথোপকথন এক্ষেত্রে অসম্ভব। যেমন, কোন এক সময়ে লিবারেল এবং কনজারভেটিভরা দারিদ্র্যের মূল কারণ নিয়ে আলোচনা করত। এখন তারা আলোচনা করে দারিদ্রের আদৌও অস্তিত্ব আছে কিনা। এক সময় তারা বর্ণবাদকে পরাস্ত করার বিষয়ে তর্ক করতো, এখন কনজারভেটিভদের বলতে শোনা যায়, যারা তাদের মিথ্যাবাদী আখ্যা দেয় তারাই যেমন প্রকৃত মিথ্যাবাদী, ঠিক তেমনি তারাই প্রকৃত বর্ণবাদী যারা অন্যকে বর্ণবাদী আখ্যা দেয়। তবে অপরপক্ষও একই কাজ করে। একজন খ্রিস্টান কনজারভেটিভ যদি মার্কিন মূল ধারার সংস্কৃতিতে সেকুলার চিন্তাধারায় “লিবারেল এলিট” –দের আধিপত্য সম্পর্কে আলোচনা করতে চায়, অথবা কোনো রান্ড পল সমর্থক যদি ফেডারেল রিজার্ভ এবং ইউ.এস সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা করতে চায় তবে তারা একই ধরনের অবিশ্বাসের মুখোমুখি হবে।
মূলধারার বামপন্থাকে আলোকায়নের অভিজ্ঞতাবাদের ঐতিহ্যের সাথে চিহ্নিত করার ব্যাপারটা অদ্ভুত, কেননা বামধারার শ্রেষ্ঠ অবতাররা অবজেক্টিভ সত্যের ধারণাকে ধ্বংস করার পেছনেই গত প্রজন্ম পার করেন। লিবারেল সমাজেও চার্চের সমকক্ষ প্রতিষ্ঠান রয়েছে আর তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ধর্মতত্ত্ববিদদের মতো বুদ্ধিজীবীরা। তারা ঠিক ততটাই শ্রদ্ধার সাথে গিলস ডেলিউজ, মিশেল ফুকো এবং জ্যাক দেরিদার কাজ ব্যাখ্যা করেন যতটা শ্রদ্ধা রেডিক্যালদের রয়েছে কার্ল মার্কস এর জন্য। এইসব লেখকরা আলোকায়নের বিরোধিতা ছাড়া কিই বা করেন?
মূল ধারার ডেমোক্রেটিক বাম এবং রিপাবলিকান ডানপন্থীরা বহুদিন যাবত আমেরিকান প্রতারণা, প্রবঞ্চনার ঐতিহ্যে কাজ করে যাচ্ছে, তবে বিভিন্নভাবে তারা এটাকে ন্যায্যতা দেয়। ডানপন্থীরা যা করে অন্তর্নিহিত বিশ্বাসের যুক্তি দিয়ে; বামপন্থীরা আগে বিজ্ঞানের যুক্তিতে এবং বর্তমানে একপ্রকার উত্তর উপনিবেশবাদী অ্যান্টি সাইন্স এর উপর নির্ভর করে। তবে দুটোই মূলত একই উদ্দেশ্য পূরণ করে।
দুটো পন্থাই তাদের নিজ নিজ দলের সামাজিক ভিত্তির জন্য যথাযথ– শতকরা এক ভাগ যা তাদের অনুদান, সংস্কৃতি আর সংবেদনশীলতার যোগান দেয়। রিপাবলিকানরা ব্যবসায়িক দল হিসেবে কুখ্যাত। বিষয়টা অবাক করার মতো না যে তারা একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সি.ই.ও. এর অভ্যন্তরীণ কনফিডেন্সকে ধারন করে এবং উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যা যা বলা দরকার তার সবটাই বলতে রাজি এবং কোম্পানি চালানোর জন্য যা করা প্রয়োজন তার সবটাই করতে রাজি। বারবারা এরেনরিচের মতে ডেমোক্রেট্ররা “পেশাদার ব্যবস্থাপক শ্রেণী ” এর দল– শিক্ষক, উকিল, সমাজকর্মী ও মনোবিজ্ঞানীদের দল। কাজেই এটা আশ্চর্যজনক নয় যে, তাদের ওয়েল্টানশাউং–এর সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি হল মিশেল ফুকোর কাজ, অন্তত বিশ বছর ধরে সমসাময়িক মার্কিন একাডেমির দেবতা, এবং একজন ব্যক্তি যিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে পেশাদার ডিসকোর্সগুলো শক্তির এমন রূপ যা সেইসব বাস্তবতা তৈরি করে যা তারা পরিচালনার দাবি করে থাকে। বা নব্বইয়ের দশকে এবং কয়েক দশক ধরে যখন মার্কিন অর্থনীতি আরও স্পষ্টভাবে বুদ্বুদ অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছিল, এবং হলিউড ও বিশেষ করে ওয়াল স্ট্রিটের অর্থ ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে ব্যয় করা হয়, তখন বুদ্ধিজীবী মহলগুলোতে এ জাতীয় ধারণার গ্রহণযোগ্যতা আরও অযৌক্তিক হয়ে ওঠে।
আমি এক্ষেত্রে কোনো সহজ একক সংযোগের ইঙ্গিত দিচ্ছি না। বিষয়টা এমন নয় যে বামপন্থী আমেরিকান একাডেমিকরা সরাসরি ওয়াল স্ট্রিট ফান্ডিং দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। কিন্তু এই সিস্টেমের সৌন্দর্যই হল যে তার প্রয়োজন নেই। অন্য সবার মত তারাও বাবলের জগতে বাস করে। এবং তাদের বিদ্যমান তাত্ত্বিক বিন্যাস, এমন একটি পেশাদার বিশ্বের দৈনন্দিন সাধারণ জ্ঞান থেকে জন্ম নেয়া যেখানে পরিচয় ব্যবস্থাপনাই সবকিছু, একটি বুদ্বুদ অর্থনীতির যুক্তিকেই প্রতিফলিত করে।
২০০৮ সালে ক্র্যাশের ঠিক আগে আমার কনফারেন্স এবং সেমিনারে যোগ দেওয়ার কথা মনে আছে। যেখানে আমি সাংস্কৃতিক তত্ত্ব বা বিজ্ঞান অধ্যয়নরত ছাত্রদের বা এমনকি মৌলবাদী রাজনৈতিক বিজ্ঞানীদের জটিল জারগন ভরা উপস্থাপনা শুনেছিলাম। তারা দাবি করেছিল “প্রিএম্পশন“, “সিকিউরিটাইজেশন” এবং “আর্থিকীকরণ” এর উদ্ভূত যুক্তি কেবল সামাজিক শক্তির অভূতপূর্ব নতুন রূপের জন্মই দেয় না , বাস্তবতার প্রকৃতির একটি রূপান্তরকেও নির্দেশ করে। “আমাদের বামপন্থীদের নিউলিবারেলদের থেকে কিছু জিনিস শিখা উচিত” আমার মনে আছে কালচারাল স্টাডিজের এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের এই মন্তব্য শুনেছি (বিশ্ববিদ্যালয়ের কালচারাল স্টাডিজের ছাত্ররা প্রায়ই নিজেদের বিশ্ব বামপন্থার ধারক বাহক মনে করে, যদিও তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে না। ), “সত্যি বলতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। তারা প্রায় শূন্য থেকে মান তৈরি করতেও সক্ষম”।
সেই সময় আমি বলেছিলাম– “জানেন কি, ওয়াল স্ট্রিটের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা এই ব্যাপারটাকে ‘স্ক্যাম‘ বলে থাকে৷” তবে কেউ মনে হয় না আমার কথা শুনছিল৷ বেশিরভাগ একাডেমিক চরমপন্থিরা নিজেদের একপ্রকার তাত্ত্বিক ভাষায় বাক্সবন্দী করে রেখেছিলো, যেই ভাষায় স্ক্যাম শব্দটা ছিল প্রায় অর্থহীন। বিজ্ঞান থেকে বিজ্ঞানবিরোধী, আলোকিত অভিজ্ঞতাবাদ থেকে তার বিপরীতে অবস্থান করে, একাডেমিক বামরা শেষপর্যন্ত এই ধারণায় পৌঁছেছে যে পারফর্মেন্সই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আশির দশকের শেষের দিকে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতাগুলি নিজেরাই “পারফরম্যান্স থিওরি“- বর্জন করে, নব্বই দশকে এক্টর–নেটওয়ার্ক তত্ত্বের উত্থান হয়। এটি দাবি করে যে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের বস্তুগুলিও মূলত বিজ্ঞানী, প্রতিষ্ঠান, বস্তু, প্রাণী এবং জীবাণুর মধ্যে জোট তৈরির আলোচনা, প্ররোচনার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দ্বারা গঠিত হয়। বিষয়টির সারমর্ম হল, যে সময়ে আমেরিকান (এবং সম্প্রসারণে উত্তর আটলান্টিক) অর্থনীতির ভিত্তি ছিল ক্রমবর্ধমান আর্থিক বুদবুদের উত্পাদন, সেই সময়ের বুদ্ধিজীবীরা সিদ্ধান্ত নেয় যে একেবারে সবকিছুই কেবলমাত্র রাজনৈতিক পারফরমেন্সের পণ্য। বুদ্বুদ অর্থনীতি ছিল রাজনৈতিক জাদুর এক ধরনের অপথিওসিস।
তবে যেকোনো প্রকৃত জাদুকরই ( বা সফল রাজনীতিবিদ) বলতে পারে যে ঘটনাগুলি এতটা সরল নয়। আমরা সকলেই স্বীকার করি যে একজন রাষ্ট্রপতি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন এমন ব্যক্তি যিনি রাষ্ট্রপতির মতো আচরণ করতে জানেন। এই ভূমিকাটি সম্পাদন করতে কোনো প্রকার অক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য আমরা প্রার্থীদের অবিরাম সমালোচনা করি। কিন্তু একজন প্রার্থী যদি খোলাখুলিভাবে বলেন যে পারফর্ম করাই তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার একমাত্র যোগ্যতা, তবে তার নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। বাস্তবে , দ্বৈত চিন্তার সমস্ত কৌশল আমাদের সাথেই থাকে। আমরা যা করি তা হল এই সকল চিন্তা প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন কারণ তৈরি।
রন সাসকিন্ডের (সম্ভবত কাল্পনিক) বুশ উপদেষ্টা অন্তত এই বিষয়ে সচেতন ছিলেন যে নতুন বাস্তবতা তৈরির ক্ষেত্রে বিশ্বাস যথেষ্ট নয়: আপনার সামরিক শক্তিও দরকার। জাদুকর এবং রাজনীতিবিদের মধ্যে চূড়ান্ত পার্থক্য এটাই যে: রাজনীতিবিদ জানেন, যদি সত্যিই প্রয়োজন হয় তবে তিনি সামরিক শক্তি ব্যাবহার করতে পারেন, সেটা হোক সেনাবাহিনী বা পুলিশ।
রাজনৈতিক বাস্তবতা সবসময়ই ভয়, আকাঙ্ক্ষা এবং দ্বৈত এবং ত্রি–চিন্তার একটি অস্পষ্ট সংমিশ্রণ। আপনার জিজ্ঞাসা করতে হবে যে সাধারন জনগন স্বীকৃত রাজনৈতিক বিন্যাসকে ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করেন, নাকি তিনি বিশ্বাস করেন যে অন্য সবাই এটিকে ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করে। আপনার জিজ্ঞাসা করতে হবে সে বিশ্বাস করে কিনা যে এমন একটি বিশ্ব ছাড়াও তার সবচেয়ে প্রিয় উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলি সে উপলব্ধি করতে পারবে, যে বিশ্বকে সে স্ক্যাম মনে করে। আপনার আরও জিজ্ঞাসা করতে হবে সে বিশ্বাস করে কিনা যে জিনিসগুলি পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হলে, এমনকি পুরো জিনিসটি একটি স্ক্যাম তা প্রকাশের চেষ্টা করলে সে গুরুতর আহত হতে পারে। (যেমনটা অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট–এর সাম্প্রতিক ভাগ্যে দেখা গেছে, এমনকি মধ্যবিত্ত শ্বেতাঙ্গ লোকেরাও যখন আজকের আমেরিকায় অপ্রীতিকর সত্য কথা বলার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে আসে, তখন সহিংসতা একটি বাস্তব সম্ভাবনা।) এবং তারপর জিজ্ঞাসা করতে হবে অন্য সবাই বিশ্বাস করে কিনা যে পরিবর্তনের চেষ্টা করলে সহিংসতার সম্ভাবনা রয়েছে? নাকি সবাই মনে করে যে অন্য সবাই বিশ্বাস করে তাদের সাথে এমনটা ঘটবে। বিষয়গুলো গোলোকধাঁধায় আবদ্ধ।
২.
দৈনন্দিন সকল বিকৃতি, সুবিধাবাদী অর্ধ–সত্য, এবং কল্পিত মতাদর্শের মধ্যে যা এখন রাজনৈতিক ডিসকোর্স তৈরি করে, যে কোনও সৎ আলোচককে এই প্রশ্নের সাথে লড়াই করতে হয় যে কীভাবে আত্ম–প্রতারণা একটি স্বশাসিত বিশ্বাস ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে । প্রোপাগান্ডা শিল্পের ছাত্ররা দীর্ঘকাল ধরে লক্ষ করেছে যে এর পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানকে অনুকরণের প্রবণতা রয়েছে , কিন্তু অসত্য আবরণ নিজের পছন্দসই প্রোপাগান্ডায় স্ব–সচেতন বিশ্বাসের গভীর বিভ্রান্তির জন্য দায়ী নয়। সমস্যাটির প্রচলিত সূত্র প্রশ্ন করে যে কীভাবে কিছু লোক এমন কিছু বিশ্বাস করতে পারে যা অন্যদের কাছে অলীক মনে হয়। তবে এই বক্তব্য ধারণা করে মানুষ যা বিশ্বাস করে সে বিষয়ে সে ভুল হতে পারে না। এটা কি ভাবা সম্ভব যে আপনি যখন কিছু বিশ্বাস করেন, বাস্তবে তা করেন না, বা যখন কিছু বিশ্বাস করেন না, বাস্তবে তা করেন।
প্রকৃতপক্ষে, এটি কীভাবে সম্ভব হতে পারে তা বোঝার জন্য চিন্তার সম্পূর্ণ ধারা রয়েছে। ধারণা করা হয়, ফেটিশিজম শব্দটি পশ্চিম আফ্রিকায় কর্মরত ইউরোপীয় বণিকদের সৃষ্টি, তাদের আফ্রিকান সমকক্ষরা কীভাবে ব্যবসায়িক চুক্তি করে তা ব্যাখ্যা করার জন্য। এটি ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর ঘটনা, দাস ব্যবসা শুরুর আগে, যখন ইউরোপীয়রা স্বর্ণের সন্ধানে ছিল। তৎকালীন আফ্রিকান অনেক বন্দরনগরেই কোনো বাণিজ্যিক উপলক্ষ্যের জন্য একটি নতুন দেবতা তৈরি করা সম্ভব ছিল। আপনি কিছু পুঁতি, পালক এবং বিরল কাঠের টুকরো একত্রিত করতে পারেন, অথবা সমুদ্র সৈকতে খুঁজে পাওয়া কোনও অদ্ভুত বা উল্লেখযোগ্য–সুদর্শন বস্তু তুলে নিতে পারেন, তারপরে পারস্পরিক শপথের মাধ্যমে এটিকে পবিত্র করতে পারেন। অন্যান্য ফেটিশ, যা সমগ্র সম্প্রদায়ের সুরক্ষার জন্য পালন করা হত, তাতে আকর্ষণীয় সুন্দর ভাস্কর্য থাকতে পারে, যার মধ্যে চুক্তিকারী দলগুলি পেরেক ঠেকাতো। এইভাবে নতুন সৃষ্ট ঈশ্বরকে রাগান্বিত করা হয় যাতে সে সীমালঙ্ঘনকারীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য উপযুক্ত মেজাজে থাকে। তবে একজন বিদেশীর সাথে নিছক ব্যবসায়িক চুক্তির জন্য আকর্ষণীয় একটি কাঠের টুকরোই যথেষ্ট।
শপথ নেওয়ার মাধ্যমে বস্তুটি একটি ঐশ্বরিক শক্তিতে পরিণত হয় যা প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনকারীকে ভয়ানক শাস্তি দিতে সক্ষম। নতুন ঈশ্বরের শক্তি ছিল তাদের চুক্তির শক্তি। সমস্ত ব্যাপারটা প্রায় স্বীকার করার মত যে বস্তুটি ঈশ্বর কারণ মানুষ তাকে ঈশ্বর দাবি করেছে, কিন্তু সবাই জোর দিয়ে বলত– না, আসলে, বস্তুগুলি এখন ভয়ানক অদৃশ্য শক্তি লাভ করেছে। এবং চুক্তিকারী পক্ষগুলির মধ্যে একটির সাথে অপ্রত্যাশিত কোনো বিপর্যয় ঘটলে – যা মোটেও অস্বাভাবিক ছিল না কারণ ইউরোপীয়রা প্রায়ই ঝড়ের কবলে বা ম্যালেরিয়া জ্বরে মারা যেত, মানুষ সহজেই বলতে পারত যে মৃত ব্যক্তিরা তাদের ওয়াদা ভাঙ্গার ফলেই এই পরিণতি ভোগ করছে।
আফ্রিকান বণিকরা কি সত্যিই তাদের ফেটিশের শক্তিতে বিশ্বাস করত? অনেকে মনে করেন যে তারা করত, যদিও প্রায়ই তারা এমন আচরন করত যে ফেটিশগুলি কেবল সুবিধাজনক বাণিজ্যিক উপযোগী। কিন্তু ইন্দ্রজালের মনোমুগ্ধকর জগৎ বিভিন্ন প্যারাডক্সে পূর্ণ। এতটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে ধর্মতাত্ত্বিক পরিভাষায় চিন্তা করতে অভ্যস্ত ইউরোপিয়োরা এইধরনের আচার–অনুষ্ঠান বুঝে উঠতে পারেনি। ফলস্বরূপ তারা আফ্রিকানদের উপর তাদের নিজস্ব বিভ্রান্তির প্রতিফলন ঘটাতে থাকে। শীঘ্রই ফেটিশের অস্তিত্বকে প্রমান হিসেবে দেখানো হয় যে আফ্রিকানরা আধ্যাত্মিক বিষয়ে গভীরভাবে বিভ্রান্ত ছিল। ইউরোপীয় দার্শনিকরা যুক্তি দেখাতে শুরু করে যে ফেটিশিজম ধর্মের সর্বনিম্ন সম্ভাব্য পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে ফেটিশবাদী একেবারে যেকোন কিছুর উপাসনা করতে রাজি, যেহেতু তার কোনও নিয়মতান্ত্রিক ধর্মতত্ত্ব নেই।
অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই কার্ল মার্কস এবং সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতো ইউরোপীয় ব্যক্তিরা জিজ্ঞাসা করতে শুরু করেছিলেন যে আমরা কি আসলেই আলাদা? মার্কস যেমনটা উল্লেখ করে, পশ্চিমা ইতিহাস হল আমাদের জিনিসগুলি তৈরি করার এবং তারপরে আমাদের নিজস্ব সৃষ্টির সামনে মাথানত করা এবং তাদের দেবতার মতো পূজা করার গল্প। মধ্যযুগে আমরা ওয়েফার, চালিস এবং রিলিকোয়ারি দিয়ে এটি করেছি। এখন আমরা অর্থ এবং ভোগ্যপণ্য দিয়ে করি– অতঃপর ফেটিশিজম সম্পর্কে মার্কসের বিখ্যাত উক্তি। আমরা ক্রমাগত ব্যবহার বা সুবিধার জন্য বস্তু তৈরি করছি, এবং তারপরে তাদের সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলছি যেন তারা কিছু অদ্ভুত, অতিপ্রাকৃতিক শক্তির সাথে যুক্ত এবং তারা নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করতে সক্ষম – মূলত কারণ, তাত্ক্ষণিক ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সত্যও হতে পারে।
যখন একজন পণ্য ব্যবসায়ী ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পড়ে এবং জানতে পারে যে স্বর্ণ এটা করছে, বা তেল বা শুকরের মাংস এমনটা করছে, বা এই টাকা বাজার থেকে পালাচ্ছে এবং অন্য কোথাও যাচ্ছে, তখন সে যা পড়ে তা কি বিশ্বাস করে? অবশ্যই তিনি মনে করেন না যে তিনি করেন। ব্যবসায়ীকে একপাশে নিয়ে ব্যাখ্যা করার কোনো প্রয়োজন নেই যে সোনা বা তেল একেবারেই নির্জীব বস্তু যেগুলি কিছুই করতে পারে না। এমনটা করলে সে স্পষ্টতই বিরক্ত হবে। এটি একটি কথার কথা মাত্র। তুমি কি আমাকে বোকা মনে করো? কিন্তু বাস্তবিক অর্থে, তিনি এটি বিশ্বাস করেন, কারণ প্রতিদিন তিনি ট্রেডিং ফ্লোরে যান এবং এমন ভান করেন যে এটিই সত্য।