- অনুবাদ: অরিত্র আহমেদ
[ডেভিড গ্রেইবার(১৯৬১–২০২০) একজন আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী ও নৈরাজ্যবাদী। ‘We are the 99%’ স্লোগান সামনে রেখে ২০১১ সালে শুরু হওয়া অকুপাই মুভমেন্টে সক্রিয় রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে গ্রেইবার বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে The Debt: The First 5000 Years (2011), The Democracy Project (2013), The Utopia of Rules (2015), Pirate Enlightenment (2018), Bullshit Jobs (2018), প্রভৃতি। বর্তমান সাক্ষাৎকারটি প্রথম ছাপা হয়েছিল নিউ ইন্টারনেশনাল পত্রিকায়। পরবর্তীতে The Anarchist Library আর্কাইভে লেখাটি সংযুক্ত করা হয়। ২০১৪ সালের পহেলা জানুয়ারি জো লাটিও সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন। অকুপাই মুভমেন্টের সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা, নৈরাজ্যবাদী হওয়া ও না হওয়া, প্রভৃতি বিষয়ে ডেভিড গ্রেইবার সংক্ষিপ্ত, তবে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন এই সাক্ষাৎকারে। – অনুবাদক]
আপনার রাজনৈতিক সচেতনতার প্রথম স্মৃতি সম্পর্কে কিছু বলুন।
গ্রেইবার: সেন্ট্রাল পার্কে ষাটের দশকের এক শান্তি মিছিলের কথা মনে পড়ে আমার। অন্যান্য জায়গার মধ্যে ফায়ার আইল্যান্ডের সৈকতে আরেকটা শান্তি মিছিলের কথাও মনে পড়ছে। আমি সেইখানে একটা পতাকা নিয়ে ঘুরছিলাম, যাতে লেখা ছিলো ‘আমরা শান্তি চাই‘। আমার মতো মাত্র সাত বছর বয়সী একটা ছেলের হাতে এই পতাকা লক্ষ্য করে কিছু বয়স্ক লোক জিজ্ঞেস করলেন আমি আদৌ এ কথার অর্থ বুঝি কিনা। যতোদূর মনে পড়ে, আমি জবাবে তাদেরকে বলেছিলাম, অর্থ তো একদম সুস্পষ্ট, পড়লেই বোঝা যায়।
আপনার সর্বশেষ বই ‘দ্য ডেমোক্রেসি প্রজেক্ট‘-এ আপনি বলার চেষ্টা করেছেন যে অকুপাই মুভমেন্ট একটা বড়ো সাফল্য ছিলো; অথচ নিরানব্বই ভাগ মানুষের মধ্যে অধিকাংশের জীবনেরই তেমন কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়নি– টানাটানির মধ্যেই কোনোরকমে দিন কাটছে তাদের। সেক্ষেত্রে আপনি এতো ইতিবাচক হতে পারছেন কিভাবে?
গ্রেইবার: দেখুন, ব্যাপারটা এমন নয় যে, একটা সামাজিক আন্দোলন কোনো দেশের সরকারি নীতির উপর তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলবে– এরকমটা কখনোই হয় না আসলে। বিশ্বব্যাপী বৈপ্লবিক উন্মাদনার মুহূর্তগুলো, ১৯৬৮ কিংবা ২০১১ সালে আমরা যেমন দেখেছি, তাৎক্ষণিকভাবে ডামাডোল বা এমনকি পশ্চাদগমনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে; কিন্তু এমন কিছু বীজ ওই মুহূর্তগুলো বপন করে দিয়ে যায়, যা ধীরে ধীরে সবকিছুকেই বদলে দিতে থাকে।
অকুপাই মুভমেন্ট তো নন–হায়ারার্কিক্যাল গণতন্ত্রের আবহাওয়ায় একটা সামাজিক নিরীক্ষা হিসেবে বিকাশ লাভ করেছিলো। কিন্তু এর কিছু গুরুতর সমস্যাও ছিলো। আজ ওই আন্দোলনের দিকে যখন ফিরে তাকান, তখন এমন কিছু কি চোখে পড়ে যেটা একটু অন্যভাবে করাও সম্ভব ছিলো?
গ্রেইবার: এই আন্দোলনের গোড়া থেকেই এমন অনেক কিছু ছিলো, যেগুলো অন্যভাবে ঘটলেই আমি খুশি হতাম। অনেক জ্ঞানগত সাহায্য থেকে এ আন্দোলন বঞ্চিত হয়েছিলো, কারণ প্রবীণ পৃষ্ঠপোষক এবং গ্লোবাল জাস্টিস মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অন্যান্য ব্যক্তিদের মধ্যে আশ্চর্যজনকভাবে খুব কম লোকই আসলে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ফলে প্রতিটা জিনিসই আন্দোলনকারীদের একদম নতুন করে আবিষ্কার করে নিতে হয়েছে, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা এ কাজ করেছে খুবই স্থুল ও বেখাপ্পাভাবে। অনুপ্রবেশকারী এবং আন্দোলনে ব্যাঘাত সৃষ্টিকারীদের সামলানোর ক্ষেত্রেও তারা প্রায়শই আনাড়িপনার পরিচয় দিয়েছে। তার উপর, এক নির্বোধ ও অন্ধ আইনমুখীনতা ছিলো তাদের মধ্যে, তারা ভেবেছিলো ঐক্যমত্য (consensus) হলো আইন–কানুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো বিশেষ প্রক্রিয়া মাত্র। ঐক্যমত্য যে এক গুচ্ছ মূলনীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়– মানুষের কথা শোনা (listening) ও অ–বাধ্যবাধকতার (non-compulsion) ভিত্তিতেই প্রধানত– এবং এটা যে প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বিচিত্র হাজারো রূপ ধারণ করতে পারে– এই ব্যাপারটি তারা বুঝতে পারেনি।
আপনার ‘ডেব্ট: দ্য ফার্স্ট 5000 ইয়ার্স‘ বইয়ের শিরোনাম ইঙ্গিত করে যে আপনি আরো পাঁচ হাজার বছর একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি দেখার আশঙ্কা করছেন। ধারদেনা–ভিত্তিক অর্থনীতির কোনো সম্ভাব্য বিকল্প আছে কি?
গ্রেইবার: আরে, ওই শিরোনামের উদ্দেশ্য ছিলো একটা খোঁচা দেওয়া: আমরা কি আসলেই আরো পাঁচ হাজার বছর ধরে এই একই জিনিস দেখে যেতে চাই? আমার মনে হয় না বর্তমান ব্যবস্থার মতো কোনো কিছুই আমাদের জন্য অবধারিত; আমার তো বরং মনে হয়, আজ আমরা যেভাবে আমাদের অর্থনীতিকে সংগঠিত করছি, তাতে দু’এক প্রজন্ম পরেই এটা আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন হয়ে যাবে যে আমরা এমন কিছু কখনো করেছিলাম।
আপনি বলে থাকেন যে, ‘নৈরাজ্যবাদ হলো এমন কিছু, যেটা আপনি করেন‘, নৈরাজ্যবাদ খালি বিশ্বাস করার ব্যাপার না। একটু বুঝিয়ে বলবেন আপনি কী বলতে চান?
গ্রেইবার: আমি সবসময়ই খেয়াল করে এসেছি যে মার্ক্সবাদ হলো মূলত: বৈপ্লবিক কর্মকৌশলের একটা তাত্ত্বিক ডিসকোর্স, আর নৈরাজ্যবাদ হলো মূলত: বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের একটা নৈতিক ডিসকোর্স। মানুষজন নিজেদেরকে কিভাবে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছে, সেটা একটু খেয়াল করুন। মার্ক্সবাদীদের মধ্যে আপনি লেনিনবাদী, মাওবাদী, ট্রটস্কিবাদীদের দেখতে পাবেন– এই দলগুলোর নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক গুরুর নামানুসারে, যাঁরা বিপ্লবের কর্মকৌশল–বিশ্লেষণের একেকটা ভাণ্ডার রেখে গেছেন। অন্য দিকে নৈরাজ্যবাদীদের মধ্যে আপনি পাবেন সিন্ডিক্যালিস্ট, কমিউনিস্ট, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী, অভ্যুত্থানপন্থী (insurrectionist), প্রভৃতি দল; এ ক্ষেত্রে বিভাজন ঘটেছে সংগঠনের ধরণ–ধারণ ও কার্যপদ্ধতির বিভিন্নতার ভিত্তিতে। আমি বলছি না যে, আপনার কর্মকাণ্ডে নৈরাজ্যবাদের কোনো না কোনো প্রতিফলন দেখা না গেলে নিজেকে নৈরাজ্যবাদী দাবি করা আপনার পক্ষে সম্পূর্ণই অর্থহীন; আপনি চাইলে বিমূর্তভাবে রাষ্ট্রহীন ও পুঁজিবাদহীন এক পৃথিবীর কথা ভাবতে পারেন, সেই পৃথিবীকে উৎকৃষ্টতর ও সম্ভবপর বলে বিশ্বাস করতে পারেন, এবং কিছুই না করে বসে থাকতে পারেন। কিন্তু এতে আসলে খুব কমই যায় আসে। অন্য দিকে, আপনি চাইলে একজন নৈরাজ্যবাদীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন– এমন সব রীতি মেনে কার্য নির্বাহ করতে পারেন, যাদেরকে বলপ্রয়োগের আমলাতান্ত্রিক কাঠামো ব্যবহার করে মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়ার দরকার পড়ে না– মানে আপনি নিজেকে নৈরাজ্যবাদী বা অন্য কিছু হিসেবে চিহ্নিত না করেও একজন নৈরাজ্যবাদী হিসেবে কাজ করে যেতে পারেন। এবং বাস্তবে আমরা প্রায় সবাই অনেক সময়ই একজন নৈরাজ্যবাদীর মতো, এমনকি একজন কমিউনিস্টের মতোই আচরণ করি। আমার কাছে নৈরাজ্যবাদী হওয়ার অর্থ হলো আত্ম–সচেতন থেকে সেই কাজটা করে যাওয়া; পূর্বোক্ত মূলনীতিগুলোর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত যে পৃথিবীর কথা আমরা আজ কল্পনা করছি, তাকে ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত করার একটা উপায়ই হলো নৈরাজ্যবাদ।
আটলান্টিকের দুই পারেই বসবাস করার অভিজ্ঞতা তো আপনার হলো। গণতন্ত্র ও সামাজিক পরিবর্তনের আশা কোথায় বেশি দেখেন– ব্রিটেনে না আমেরিকায়? কী মনে হয় আপনার এবং কেনো?
গ্রেইবার: এটা বলা খুবই কঠিন আসলে। ব্রিটেনে এক বিশেষ ধরনের স্টয়িক মর্ষকাম দেখা যায়, যেটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকে না। দেখে মনে হয় শ্রমিক জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশের ভেতর থেকে সকল ধরনের প্রাণশক্তি নেহাত ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। আবার এ–ও হতে পারে যে সবচেয়ে খারাপ যা কিছু হতে পারতো, ব্রিটেন তা সহ্য করেছে, এবং এখন সে ভালোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। বিষয়টা নিয়ে আমি এখনো ভাবছি– কারণ আমি তো অপেক্ষাকৃত নবাগত এখানে। তবে আমেরিকা হলো একটা টলায়মান সাম্রাজ্য। এখানে শিক্ষা ব্যবস্থার মতো বুনিয়াদি প্রতিষ্ঠানগুলোর পায়ের তলার মাটি সরে গেছে, এবং গণতন্ত্রের অবশিষ্ট চিহ্নগুলোকেও একে একে বিলীন করে দেওয়া হচ্ছে। আমেরিকায় মানুষের রাগ বাড়ছে, কিন্তু আমার মনে হয়, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খোলাখুলি নির্যাতন ও নিপীড়ন।