অরাজ
শিল্পী: ডেভিড আলফারো সিকেরোস
প্রচ্ছদ » জর্জি ডিমিট্রভ

ফ্যাসিবাদের শ্রেণীচরিত্র: জর্জি ডিমিট্রভ

  • অনুবাদ: দীপিকা বসু ও পত্রলেখা বন্দ্যোপাধ্যায়

[জর্জি ডিমিট্রভের এই লেখাটি অনুবাদ করেছিলেন দীপিকা বসু ও পত্রলেখা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিচয় পত্রিকার নব্বই বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে, কলকাতা থেকে ২০২১ সালে প্রকাশিত, ফ্যাসিস্টবিরোধী সংকলন এ অনূদিত লেখাটি ছাপা হয়। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছিলেন দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তরুণ সন্যাল। অরাজের পাঠকদের সুবিধার্থে গ্রন্থের সম্পাদকদ্বয়ের দেয়া ভূমিকাসহ লেখাটি  পুনঃপ্রকাশ করা হলো। বানান সমরূপতা রক্ষায় মুদ্রণ প্রমাদ সংশোধন করা হয়েছে।—সম্পাদক]

সম্পাদকীয় ভূমিকা: জার্মানির রাষ্ট্রপতি ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি হিটলারকে রাইখ চান্সেলরের পদে নিয়োগ করেন। জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি ছিল শক্তিশালী ও সংগঠিত, ১৯৩২ সালের নভেম্বরে রাইখস্টাকের নির্বাচনে কমিউনিস্টরা ৬০ লক্ষ ভোট পেয়েছিল। ফ্যাসিস্টদের প্রধান শত্রু ছিল তারাই। ফলে হিটলার-গোয়েরিং-গোয়েবলস চক্রের প্রথম কাজ হল ছলে বলে কৌশলে কমিউনিস্টদের নিশ্চিহ্ন করা। প্রথমে প্রচার করা হল যে ‘কার্ল লীব কনেথট’ ভবনে অবস্থিত কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে তল্লাশি করে “অতি ভয়ানক ধরনের অনেক কিছু” পাওয়া গেছে। কিন্তু প্রায় প্রতি সপ্তাহে পুলিশের নিয়মিত তল্লাশি সত্ত্বেও ঐ ভবনে মাটির নিচে ভাড়ার তৈরি করা, যাতায়াতের গোপন পথ নির্মাণ ও আস্ত একটি বিদ্রোহ-পরিকল্পনা লুকিয়ে রাখা সম্ভব—এই আষাঢ়ে গল্প প্রায় কেউই বিশ্বাস করেনি। তারপর ঘটল অভূতপূর্ব ঘটনা। ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রাইখস্টাকে আগুন লাগার সংবাদ দাবানলের মতোই ছড়িয়ে পড়ে। হিটলার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে সমবেত বিদেশী সাংবাদিকদের বলে “এটা ঈশ্বরের নির্দেশ— কমিউনিস্টদের ওপর আমরা আঘাত হানব।” অচিরে সরকারী ঘোষণা জারী করে স্পষ্ট বলা হয় রাইখস্টাকে এ-আগুন কমিউনিস্টরাই লাগিয়েছে ৷

বুলগেরীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা জঙ্গি ডিমিট্রভ তখন জার্মানিতে ছিলেন। ঐ রাতে ট্রেনে মিউনিখ থেকে বার্লিন যাচ্ছিলেন। ২৮ শে ফেব্রুয়ারি প্রভাতী সংবাদপত্রে তিনি রাইখস্টাকে আগুন লাগাবার সংবাদ পান। ডিমিট্রভ বোঝেন সংসদীয় নির্বাচনের আগে কমিউনিস্টদের জনপ্রিয়তা খর্ব ও জয়লাভের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করার জন্য হিটলারই রাইখস্টাকে আগুন দিয়েছে ।

গোটা জার্মানি জুড়ে হিটলার-পুলিশ ও ফ্যাসিস্ট ‘ঝঞ্ঝা বাহিনী’র ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস শুরু হয় ।

ছবি: তরুণ বয়সে জর্জি ডিমিট্রিভ

বলা যায় রাইখস্টাকে অগ্নিকাণ্ড ‘মহাভারত’-এর ‘জতুগৃহদাহ’ পর্ব। তারপর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধশেষে ১৯৪৫ সালের ৩রা মে তারিখে রাইখস্টাকে রক্তপতাকা উত্তোলনের মধ্যে কার্যত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান এবং পৃথিবীতে সমাজতান্ত্রিক যুগের অভ্যুদয়। ডিমিট্রভ দুই যুগের অমোঘ সেতু ৷

১৯৩৩ সালের ১লা মার্চ জার্মান ফ্যাসিস্টরা বুলগেরীয় কমিউনিস্ট পার্টির দুই সহকর্মী ব্লাগোই পপোভ ও ভাসিল তানেভসহ জর্জি ডিমিট্রভকে গ্রেপ্তার করে। কিছুদিন আটক রাখার পর লাইপৎসিকে শুরু হয় বিশ্ববিখ্যাত ‘রাইখস্টাক বিচার’।

‘সমাজতান্ত্রিক জার্মানি’ পত্রিকার সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৭৩ সংখ্যায় এ-প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে :

“লাইপৎসিক আদালতে জঙ্গি ডিমিট্রভ প্রথম কথা বলেছিলেন ১৯৩৩ সালের ২৩শে সেপটেম্বর তারিখে। সেটি ছিল বিচারের তৃতীয় দিন। আদালতে উপস্থিত ছিলেন ৮২ জন বিদেশী সাংবাদিক ও জার্মান পত্রপত্রিকার ৬২ জন সাংবাদিক। কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট ও বামপন্থী বুর্জোয়া পত্রপত্রিকার সাংবাদিকদের আদালতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। গোড়ার দিকে কোনো সোভিয়েত সাংবাদিক ছিলেন না। পরে, সোভিয়েত গভর্নমেন্ট যখন অনুরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করে সোভিয়েত ইউনিয়নে জার্মান সাংবাদিকদের তৎপরতার ওপরে বিধি-নিষেধ আরোপ করলেন, একমাত্র তখনই জার্মান ফ্যাসিস্ট কর্তারা সোভিয়েত সাংবাদিকদের আদালতে প্রবেশ করতে দিয়েছিল। পুরোপুরি সাজিয়ে ও পাকিয়ে তোলা উত্তেজনা-সৃষ্টির এই মামলার জয়লাভ সম্পর্কে ফ্যাসিস্টরা এতই নিশ্চিত ছিল যে গোড়ার দিকে আদালতের সওয়াল তারা বেতারে প্রচার করতে থাকে। তারপরেই ২৩শে সেপটেম্বর তারিখে ডিমিট্রভের প্রথম ভাষণের পরে বেতারে প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও এই বিচার সম্পর্কে বিশ্বজোড়া যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল তা বন্ধ হয় নি। লোকের মুখে মুখে ফিরতে থাকে জর্জি ডিমিট্রভের নাম। …লাইপৎসিক আদালতে ডিমিট্রিভ গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন কমিউনিস্ট মতাদর্শের নীতি। আদালতে ঘোষণা করেছিলেন :

একথা সত্য যে, আমি একজন বলশেভিক, একজন প্রোলেতারীয় বিপ্লবী। একথাও সত্য যে, বুলগেরীয় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কার্যনির্বাহক কমিটির সদস্য হিসেবে আমি একজন দায়িত্বশীল কর্মী ও নেতা। কিন্তু তাই বলে আমি সন্ত্রাসবাদী বা মতান্ধ ন‍ই, হঠাৎ আক্রমণে লিপ্ত চক্রী নই, নই আগুনবাজ । …

একথাও সত্য যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির আমি উৎসাহী সমর্থক ও গুণগ্রাহী, কেননা এই পার্টি ভূ-গোলকের এক-ষষ্ঠাংশ জুড়ে বিস্তৃত বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো দেশটি শাসন করছে এবং সাফল্যের সঙ্গে সমাজতন্ত্র নির্মাণ করছে।

রোমাঁ রোলাঁ তাঁর ‘শিল্পীর নবজন্ম’ গ্রন্থে ১৯৯৩ সালের ১১ই ডিসেম্বর এ-বিষয়ে লিখেছেন: “আমাদের সময়কার সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর মামলা শেষ হইয়া আসিতেছে।…কিন্তু যে উত্তেজনার সৃষ্টি করা হইয়াছে তাহার ফলে বিচারশালার আবহাওয়া বিষাক্ত হইয়া উঠিয়াছে…। যে মন্ত্রীর হাতে বিচার-বিভাগের ভার ন্যস্ত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর কথা যাহার সবচেয়ে বেশি এবং ধৃত ব্যক্তিদের নিরাপত্তার জন্য যিনি নিজে দ্বায়ী তিনিই যখন বিচারশালার মধ্যেই দাঁড়াইয়া প্রকাশে আসামীদের ভয় দেখান, রায় যদি তাহার নির্দেশানুযায়ী না হয়, তবে আসামীদের নিহত হইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে।

…এ মহাকাব্যের উপসংহার যাহাই হউক না কেন ডিমিট্রভের বীরমূর্তি ভবিষ্যতের পটভূমিকায় চিরদিন অনন্ত মহিমায় উজ্জ্বল রহিবে।” 

তারপর তথাকথিত লাইপৎসিক মামলা শেষ হল। ‘সমাজতান্ত্রিক জার্মানি’র ঐ সংখ্যায় ঠিকই বলা হয়েছে:

“আদালতের কাঠগড়াকে জর্জি ডিমিট্রভ ব্যবহার করেছিলেন সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের ধ্যানধারণা প্রচার করার জন্য। ফ্যাসিস্ট আদালতের সমস্ত রকমের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কমিউনিস্ট পার্টির ওপরে রাইখস্টাক অগ্নিকাণ্ডের দোষ চাপানো যায়নি এবং জর্জি ডিমিট্রভকে মুক্তি দিতে হয়েছিল।”

সম্প্রতি ডিমিট্রভের ওপর একটি সোভিয়েত তথ্যচিত্র দেখার সুযোগ আমাদের হয়েছে। রোলাঁ, বারব্যুস প্রমুখ বিশ্ববিশ্রুত লেখক ও কাশ্যাঁ, ইবারুরি, তোগলিয়াত্তি প্রমুখ অগ্রগণ্য রাজনৈতিক নেতার যৌথ উদ্যোগে জর্জি ডিমিট্রভের মুক্তির দাবিতে যে যুক্তফ্রন্ট গড়ে ওঠে—তা শুধু ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনের এক দিকচিহ্নই ছিল না, ছিল যুক্তফ্রন্ট তত্ত্বের ভবিষৎ প্রবক্তার জন্য বিশ্ববিবেকের আগমনী গীত, যথাযোগ্য অর্ঘ্য।

সোভিয়েত ইউনিয়ন জর্জি ডিমিট্রভকে নাগরিকত্ব দান করে এবং মুক্তির পর তাঁকে হত্যার ফ্যাসিস্ট চক্রান্ত ব্যর্থ করে সোভিয়েত বিমানে বিজয়ী বীরকে “বিশ্বশ্রমিক-প্রিয়” সোভিয়েত ভূমিতে নিয়ে আসে ।

কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের অবিসংবাদী নেতা হিসেবে ডিমিট্রভের বিপ্লবী জীবন অব্যাহত থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি হন মুক্ত সমাজতান্ত্রিক বুলগেরিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজে মগ্ন অবস্থারই ১৯৪৯ সালে এই সৃজনশীল কমিউনিস্টের জীবনদীপ নির্বাপিত হয়।

২রা ও ৩রা আগস্ট ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ঐতিহাসিক সপ্তম কংগ্রেসে আস্তর্জাতিকের সাধারণ সম্পাদক জর্জি ডিমিট্রভ যে বিশ্ববিখ্যাত রিপোর্ট পেশ করেন এবং আলোচনার যে-উত্তর দেন, ‘মনীষা গ্ৰন্থালয়’ সম্প্রতি ‘যুক্ত ফ্রন্ট/ ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংগ্রাম’ নামে সেই মহান আন্তর্জাতিক দলিলের বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেছে। সেই বইয়েরই একটি অধ্যায়—‘ফ্যাসিবাদের শ্রেণী চরিত্র’ আমরা পুনর্মুদ্রণ করলাম । অধ্যায়ের শুরুতে ছিল ”কমরেডগণ” এই সম্বোধন। রচনাটির কয়েক জায়গায় মোটা হরফ ব্যবহৃত হয়েছিল। আমরা বাদ দিয়েছি। বানান ও যতিচিহ্নে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়েছে।

 

বার্থ অফ ফ্যাসিজম (১৯৩৬)
শিল্পী: ডেভিড আলফারো সিকেরোস

মূল লেখা

কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কার্যনির্বাহী কমিটির ত্রয়োদশ প্লেনাম সঠিকভাবেই শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ফ্যাসিবাদকে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে জাতিদাম্ভিক এবং লগ্নী পুঁজির সবচেয়ে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিভূর প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একনায়ত্ব বলে বর্ণনা করেছিল।

সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ধরনের ফ্যাসিবাদ হল জার্মান ফ্যাসিবাদ। এর নিজেকে জাতীয় সমাজতন্ত্র বলে অভিহিত করায় ধৃষ্টতা রয়েছে, যদিও সমাজতন্ত্রের সঙ্গে এর কোনই মিল নেই। হিটলারের ফ্যাসিবাদ শুধুমাত্র বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ নয়, এ হল পাশবিক জাতিদম্ভ। এ হল রাজনৈতিক দস্যুতার এক শাসনব্যবস্থা, শ্রমিকশ্রেণী, কৃষক, পেটি-বুর্জোয়া ও বুদ্ধিজীবীদের বিপ্লবী অংশের বিরুদ্ধে প্ররোচনা ও নির্যাতনের ব্যবস্থা। এ হল মধ্যযুগীয় বর্বরতা ও পাশবিকতা, অন্যান্য জাতিদের সম্পর্কে বল্গাহীন আক্রমণ ।

জার্মান ফ্যাসিবাদ আন্তর্জাতিক প্রতিবিপ্লবের উদ্যত খড়গ হিসাবে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের প্রধান প্ররোচক হিসাবে এবং সমগ্র বিশ্বের মেহনতী মানুষের মহান পিতৃভূমি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জেহাদের প্রবর্তক হিসাবে কাজ করে চলেছে।

ফ্যাসিবাদ অটো বাওয়ারের মত অনুযায়ী “প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া—এই দুই শ্রেণীর ঊর্ধ্বে অবস্থিত রাষ্ট্রক্ষমতার কোনো একটা রূপ নয়।” অথবা ব্রিটিশ সোশ্যালিস্ট ব্রেলস ফোর্ডের ঘোষণামতো “রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র-দখলকারী পেটি বুর্জোয়াদের বিদ্রোহ”ও নয়। না, ফ্যাশিবাদ শ্রেণীর উর্ধ্বে কোনো সরকার নয় অথবা লগ্নী পুঁজির উপর পেটি বুর্জোয়া বা ভবঘুরে সর্বহারার কোনো সরকার নয়। ফ্যাশিবাদ হল লগ্নী পুঁজিরই শক্তি। এ হল শ্রমিকশ্রেণী, কৃষক ও বুদ্ধিজীবীদের বিপ্লবী অংশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী প্রতিহিংসার সংগঠন। পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ হল জাতিদম্ভের নগ্নতম রূপ যা অপরাপর জাতির বিরুদ্ধে পাশবিক ঘৃণার প্ররোচনা যোগায় ।

ফ্যাসিবাদের এই সঠিক চরিত্রের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ অবশ্যই করতে হবে; কারণ অনেকগুলি দেশে ফ্যাসিবাদ সমাজবাদী বুলির আড়ালে সেই অগণিত পেটিবুর্জোয়া জনগণের, যারা সংকটের আবর্তে নিজ নিজ গতিপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের এবং এমনকি সর্বহারাশ্রেণীর সবচেয়ে পশ্চাদপদ স্তরের কোনো কোনো অংশেরও সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ফ্যাসিবাদের প্রকৃত শ্রেণীচরিত্র ও এর সঠিক প্রকৃতি অনুধাবন করলে, তারা কখনই একে সমর্থন জানাত না ৷

এক-একটি নির্দিষ্ট দেশের ঐতিহাসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অনুযায়ী এবং জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও আন্তর্জাতিক অবস্থান অনুযায়ী ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী একনায়কত্বের বিকাশ বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন রূপ গ্রহণ করে। কোনো কোনো দেশে, বিশেষ করে যেখানে ফ্যাসিবাদের কোনো ব্যাপক গণভিত্তি নেই এবং যেখানে ফ্যাসিবাদী বুর্জোয়াদের নিজেদের শিবিরে নানা উপদলের সংঘর্ষ খুব তীব্র, সেখানে ফ্যাসিবাদ সরাসরিভাবে সংসদকে অবলোপ করার সাহস রাখে না আর তাই অন্যান্য বুর্জোয়া দল এবং এমনকি সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টিকেও কিছু পরিমাণ বৈধতা রাখবার অনুমতি দেয়। অন্য সকল দেশে, যেখানে শাসক বুর্জোরাশ্রেণী এক আসন্ন বিপ্লবের আবির্ভাব সম্পর্কে শঙ্কিত, সেখানে তারা হয় তৎক্ষণাৎ অথবা প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও উপদশের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও সন্ত্রাসের শাসনকে তীব্রতর করে তার সীমাহীন একচেটিয়া রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। এর দ্বারা ফ্যাসিবাদের অবস্থা যখন বিশেষভাবে সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে, তখন এর দরুন কিন্তু ফ্যাসিবাদের পক্ষে নিজের শ্রেণীচরিত্রকে পরিবর্তিত না করেও প্রকাশ সন্ত্ৰাসবাদী একনায়কত্বের সঙ্গে স্থূল ভুয়ো সংসদীয় পন্থার সংযুক্তিসাধন ও নিজের ভিত্তিপ্রসারের প্রচেষ্টায় বাধা হয় না ।

ছবি: রাইখস্টাইক অগ্নিকাণ্ডের বিচারে বক্তৃতা দিচ্ছেন ডিমিট্রিভ

ফ্যাসিবাদের ক্ষমতালাভ এক বুর্জোয়া সরকার থেকে অপর এক সরকারে মামুলি উত্তরণ নয়, এ হল বুর্জোয়াদের শ্রেণীকর্তৃত্বের একটি রাষ্ট্রীয় রূপ, বুর্জোয়া গণতন্ত্রের জায়গায় অন্য এক রাষ্ট্রীয় রূপের প্রকাশ, সন্ত্রাসমূলক একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠা। এই পার্থক্যটি উপেক্ষা করা গুরুতর ভুল হবে; এই ভুল বিপ্লবী সর্বহারাদের আদতে, ফ্যাসিবাদের ক্ষমতা দখলের বিপদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য শহর ও গ্রামের মেহনতী মানুষের ব্যাপক সমাবেশ ব্যাহত করবে এবং তাদের বুর্জোয়া শিবিরের মধ্যেকার স্ব-বিরোধিতার সুযোগ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত করবে। কিন্তু আবার ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে বুর্জোয়াশ্রেণীর দ্বারা অনুসৃত ক্রমবর্ধমান প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপ, যা মেহনতী জনগণের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতাকে দমন করে, সংসদের অধিকারকে খর্ব করে ও তা নিয়ে জোচ্চুরি করে এবং বিপ্লবী আন্দোলনের বিরুদ্ধে দমননীতিকে তীব্র করে, সেগুলির গুরুত্বকে ছোট করে দেখা কিছু কম বিপজ্জনক ও কম গুরুতর ভ্রাস্তি নয় ।

কমরেডগণ, ফ্যাসিবাদের ক্ষমতালাতকে এই রকম সরলীকৃত ও স্বচ্ছরূপে কল্পনা করা ভুল হবে যে, এ যেন লগ্নী পুঁজির কোনো একটি কমিটি কোনো এক নির্দিষ্ট তারিখে ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। বাস্তবক্ষেত্রে, ফ্যাসিবাদ সাধারণত ক্ষমতায় আসে পুরনো বুর্জোয়া পার্টিগুলির অথবা ঐ পার্টিগুলির কোনো নির্দিষ্ট অংশের মধ্যে পারস্পরিক লড়াইয়ের গতিপথে, অথবা কখনও কখনও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর লড়াইয়ের গতিপথে, এমনকি ফ্যাসিস্ট শিবিরের মধ্যেই লড়াইয়ের গতিপথে—কখনও কখনও এ লড়াই সশস্ত্র সংঘর্ষে পরিণত হয় যেমন হয়েছিল জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও অপরাপর দেশে। এই সবকিছু কিন্তু এই সত্যটিকে চাপা দেয় না যে, ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার আগে বুর্জোয়া সরকারগুলি সাধারণত কতকগুলি প্রাথমিক পর্যায় অতিক্রম করে এবং কতকগুলি প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা অবলম্বন করে যা ফ্যাসিবাদের ক্ষমতা দখলের পথকে প্রত্যক্ষভাবে সুগম করে। বুর্জোয়াদের এই প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং প্রস্তুতিপর্বে ফ্যাসিবাদের শক্তিবৃদ্ধির বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম না করে, সে ফ্যাসিবাদের বিষয়কে প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখে না, বরঞ্চ সেই বিজয়ের পথ প্রশস্ত করে ।

সোশ্যাল ডেমোক্রাট নেতারা ফ্যাসিবাদের প্রকৃত শ্রেণীচরিত্রকে চাপা দিয়ে জনতার কাছ থেকে তাকে গোপন রেখেছিল, এবং বুর্জোয়াত্বের ক্রমবর্ধমান প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থাবলীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য তাদের আহ্বান জানায় নি। তারা এক ঐতিহাসিক দ্বায়িত্ব বহন করছে এই কারণে যে, ফ্যাসিবাদী দেশে মেহনতী জনগণের এক বিশাল অংশ ফ্যাসিবাদের মধ্যে তাদের সবচেয়ে ঘৃণ্য শত্রু, রক্তলোলুপ, লুণ্ঠনকারী লগ্নী পুঁজিকে চিনতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং ঐ জনগণ তাকে প্রতিহত করতে প্রস্তুত ছিল না।

জনগণের উপর ফ্যাসিবাদের প্রভাবের উৎস কি? ফ্যাসিবাদ জনগণকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এই কারণে যে, জনগণের সবচেয়ে জরুরী প্রয়োজন ও দাবিগুলির কাছে সে মহাবাগাড়ম্বরে আবেদন করে। ফ্যাসিবাদ শুধু জনগণের মধ্যে গভীরভাবে বদ্ধমূল সংস্কারগুলিকেই উসকিয়ে দেয় না, উপরন্তু তাদের অপেক্ষাকৃত উন্নততর অনুভূতিগুলি, যথা- তাদের ন্যায় বিচারের চেতনাকে, এমনকি কখনও কখনও তাদের বিপ্লবী ঐতিহ্যকেও কাজে লাগায়৷ কেন জার্মান ফ্যাসিবাদীরা, যারা বড় বড় বুর্জোয়াদের সেবাদাস ও সমাজতন্ত্রের মারাত্মক শত্রু, ভারা জনগণের কাছে নিজেদের “সমাজতন্ত্রী” বলে পরিচয় দেয় এবং তাদের ক্ষমতাদখলকে বিপ্লব বলে বর্ণনা করে? তার কারণ জার্মানির অগণিত মেহনতী জনগণের সমাজতন্ত্রের যে আকাঙ্ক্ষা এবং বিপ্লবের প্রতি যে বিশ্বাস রয়েছে তাকেই কাজে লাগাবার চেষ্টা করে।

শিল্পী: মারিও সিরোনি

ফ্যাসিবাদ চরম সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থেই কাজ করে, কিন্তু জনগণের কাছে নিজেকে নির্ধাতিত জাতিগুলির রক্ষকের ছদ্মবেশে উপস্থিত করে এবং অপমানিত জাতীয় অনুভূতিগুলিকে নাড়া দেয়, যেমন জার্মান ফ্যাসিবাদীরা করেছিল যখন তারা “ভার্সাই চুক্তির বিরোধিতা”র স্লোগান তুলে পেটি বুর্জোয়া জনগণের সমর্থন অর্জন করেছিল।

ফ্যাসিবাদের উদ্দেশ্য হল জনগণের উপর বল্গাহীন শোষণ কায়েম করা, কিন্তু লুণ্ঠনকারী বুর্জোয়া, ব্যাঙ্ক, ট্রাস্ট ও ধনকুবেরদের বিরুদ্ধে মেহনতী জনগণের তীব্র ঘৃণা নিয়ে ফ্যাসিবাদ অতি সুকৌশলে, পুঁজিবাদবিরোধী বুলি কপচিয়ে ও রাজনৈতিকভাবে অপরিণত জনগণের কাছে এক-একটি নির্দিষ্ট সময়ে সবচেয়ে লোভনীয় স্লোগান নিয়ে হাজির হয়ে তাদের চিত্ত জয় করে। তাদের এই রকমের স্নোগান হল: জার্মানিতে “ব্যক্তিগত মঙ্গলের চেয়ে সাধারণ মহা অনেক ঊর্ধ্বে”; ইতালিতে “আমাদের রাষ্ট্র ধনতান্ত্রিক নয়, বরং এক যৌথ রাষ্ট্র”; জাপানে “শোষণহীন জাপানের জন্ম”, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে “সম্পদের ভাগ নাও” ইত্যাদি ।

ফ্যাসিবাদ জনগণকে সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ ও ঘুষখোর লোকেদের হাতে শিকার হবার জন্য তুলে দেয়, কিন্তু জনগণের সামনে হাজির হয় এক “সং ও নিষ্কলুষ সরকার”-এর ছবি নিয়ে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সরকার সম্পর্কে জনসাধারণের মোহভঙ্গের উপর বেসাতি করে ফ্যাসিবাদ দুর্নীতির কপট নিন্দা করে [উদাহরণস্বরূপ জার্মানিতে বারমাত এবং স্কলারেকের কাণ্ড, ফ্রান্সে স্ট্রাভিস্কির কাণ্ড এবং অনুরূপ অন্যান্য অসংখ্য ঘটনা ]।

পুরনো বুর্জোয়া পার্টিগুলিতে আস্থা হারিয়ে যে জনসাধারণ তাদের পরিত্যাগ করেছে সেই জনসাধারণকে ফ্যাসিবাদ বুর্জোয়াদের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের স্বার্থেই পাকড়ায়। কিন্তু বুর্জোয়া সরকারগুলির বিরুদ্ধে তার আক্রমণের কঠোরতার দ্বারা ও পুরনো বুর্জোয়া দলগুলির প্রতি তার আপসহীন ভাবভঙ্গির দ্বারাই ফ্যাসিবাদ এই জনগণকে প্রভাবিত করে। মানববিদ্বেষ ও ছলনায় বুর্জোয়া-প্রতিক্রিয়াধারাকে ছাপিয়ে ফ্যাসিবাদ তার প্রতিটি দেশের জাতীয় বৈশিষ্ট্যের এমনকি একই দেশের ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক স্তরের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। অভাব, বেকারত্ব এবং জীবনের অনিশ্চয়তার দরুন হতাশ পেটি বুর্জোয়া জনগণ, এমনকি শ্রমিকদেরও একটি অংশ ফ্যাসিবাদের এই সামাজিক ও জাতিদাম্ভিক বাগাড়ম্বরের শিকার হয় ।

সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী আন্দোলনের বিরুদ্ধে এবং বিক্ষুব্ধ জনগণের বিরুদ্ধে আক্রমণের পার্টি হিসাবেই ফ্যাসিবাদ ক্ষমতায় আসে, কিন্তু তবুও সে তার ক্ষমতালাভকে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে “সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে” এক “বিপ্লবী” আন্দোলন হিসাবে এবং সমগ্র জাতির “পরিত্রাণ”-এর প্রতীক হিসাবে প্রতিপক্ষ করে [ এখানে আমরা মুসোলিনির রোম “অভিযান”, পিলসুদস্কির ওয়ারশ “অভিযান”, জার্মানিতে হিটলারের ন্যাশনাল নোশ্যালিস্ট “বিপ্লব” এবং অনুরূপ ঘটনা স্মরণ করতে পারি ] ৷

কিন্তু ফ্যাসিবাদ যে কোনো মুখোশই ধারণ করুক, যে কোনো রূপেই নিজেকে উপস্থাপিত করুক এবং যে কোনো পথেই ক্ষমতায় আসুক, তবুও ফ্যাশিবাদ হল মেহনতী জনগণের উপর পুঁজির সবচেয়ে হিংস্র আক্রমণ;—ফ্যাসিবাদ হল বল্গাহীন জাতিদম্ভ ও আগ্রাসী যুদ্ধ,— ফ্যাসিবাদ হল প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবিপ্লব : ফ্যাসিবাদ হল শ্রমিকশ্রেণীর এবং সমস্ত মেহনতী মানুষের সবচেয়ে ঘৃণ্য শত্রু ।

জর্জি ডিমিট্রভ