অনুবাদ: রাহুল বিশ্বাস, মোস্তাক আহমেদ
[২০০১ সালে প্যারিসের অদূরে অবস্থিত ভিনসেনস–এ অনুষ্ঠিত একটি কর্মশালায় জোয়েল কোভেল ও মাইকেল লোয়ি যৌথভাবে প্রাণ–প্রকৃতিবাদী সমাজতন্ত্রের ইশতেহার প্রকাশ করেন। অরাজের পাঠকদের জন্য সে ইশতেহারটির একটি অনূদিত সংস্করণ আমরা প্রকাশ করছি।
জোয়েল স্টিফেন কোভেল (আগস্ট ২৭, ১৯৩৬ – এপ্রিল ৩০, ২০১৮) একজন আমেরিকান পণ্ডিত এবং লেখক, যিনি “ইকো–সোশ্যালিজম বা প্রাণ–প্রকৃতিবাদী সমাজতন্ত্র” এর প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে পরিচিত। কোভেল একজন মনোবিজ্ঞানী ছিলেন। কোভেল ১৯৬০ সালের দিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের ফলে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন। ১৯৮০ সালের পর থেকে তিনি সরাসরি পরিবেশ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ১৯৮৫ সালের পর মনোবিজ্ঞানী পেশা পুরোপুরি ত্যাগ করেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক দলের নাম গ্রিন পার্টি অব ইউনাইটেড স্ট্যাটস। হোয়াইট রেসিজম (White Racism), দ্য এনিমি অব নেচার (The Enemy of Nature) সহ অনেকগুলো বই রচনা করেন।
মাইকেল লোয়ি (জন্ম মে ৬, ১৯৩৮) একজন ফরাসি–জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিক। তিনি কার্ল মার্ক্স, চে গুয়েভারা, লিবারেশন থিপলজি‘ প্রভৃতির ওপর বই রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য বই—ইকোসোশ্যালিজম: অ্যা–র্যাডিকেল অলটারনেটিভ টু ক্যাপিটালিস্ট ক্যাটাস্ট্রোফি (Ecosocialism: A Radical Alternative to Capitalist Catastrophe), মার্ক্সিজম ইন ল্যাটিন আমেরিকা ফ্রম ১৯০৯ টু দ্য প্রেজেন্ট: অ্যান অ্যানথলজি (Marxism in Latin America from 1909 to the Present: An Anthology) ইত্যাদি। – সম্পাদক]
ইকো–সোশ্যালিস্ট
প্রাণ–প্রকৃতিবাদী সকল সমাজতন্ত্রীদের১(Green Left’s) ক্রিয়াকলাপের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এখানেই যে এটি একটি ন্যায়নিষ্ঠ ও টেকসই বিশ্বের আকাঙ্ক্ষা করে। এবং এটি উপলব্ধি করে যে: পুঁজিবাদের অধীনে এই ধরণের বিশ্বব্যবস্থা কখনোই অর্জন করা যায় না। প্রাণ–প্রকৃতিবাদী সমাজতন্ত্রীদের লক্ষ্য আমাদের প্রতিষ্ঠাতাকালীন বিবৃতিতে প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা বিশ্বপরিসরের বৃহত্তর ‘ইকো–সোশ্যালিস্ট‘২ আন্দোলনের প্রতিও সহানুভূতিশীল। সেই বন্ধুত্বের জায়গা থেকে আমরা এখানে ইকো–সোশ্যালিস্ট ইশতেহার প্রস্তাব করছি। তবে মনে রাখবেন, এটি কোনো প্রাণ–প্রকৃতিবাদী সাম্যবাদী দলিল নয়।
প্রাক–কথন
২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে, প্যারিসের নিকটবর্তী ভিন্সেনাসে (Vincennes) অনুষ্ঠিত প্রাণ–প্রকৃতি ও সমাজতন্ত্রে‘র উপর অনুষ্ঠিত একটি কর্মশালায় এই ইকো–সোশ্যালিস্ট ইশতেহারের ধারণাটি দেন জোয়েল কোভেল ও মাইকেল লোয়ি। আমরা সবাই এখন গ্রামসি‘র পারাডক্স৩ নামের দীর্ঘস্থায়ী সংকটে ভুগছি। সংকটটি এই যে: আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যেখানে পুরোনো সমাজ–কাঠামোটি (ফলে মানব–সভ্যতাও) মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে পড়েছে, কিন্তু নতুন কিছুর জন্ম হতে পারছে না। তবে জন্মাতে না পারলেও, এটির কথা অন্তত ঘোষিত হতে পারে। আমাদের মাথার উপর যে গভীরতম আঁধার ঝুলছে, তা শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদ, পরিবেশ বিপর্যয়, বা অর্থনৈতিক মন্দা নয়। তা হলো এই নিয়তিবাদী বিধ্বংসী ভাবনা, যে: পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার সম্ভাব্য কোনো বিকল্প নেই। এবং সেই কারণে আমরা এমন এক ধরণের বক্তব্য হাজির করতে চেয়েছি যা এই উৎকণ্ঠাপূর্ণ আপস–মীমাংসা এবং নীরব স্বীকৃতি প্রদানের বর্তমান অবস্থানকে সচেতনভাবে নাকচ করে।
১৮৪৮ সালের কমিউনিস্ট ইশতেহারের যে দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠতা ছিল, তা হয়তো এখানে সেভাবে পাওয়া যাবে না। কারণ ইকো–সোশ্যালিজম বা প্রাণ–প্রকৃতিবাদী সমাজতন্ত্র এখন পর্যন্ত বিমূর্ত ধারণামাত্র, কিংবা এটি বাস্তবিক কোনো দল বা আন্দোলনের মাধ্যমেও গড়ে উঠেনি। এটি বর্তমান সংকটের পাঠ এবং এর থেকে উত্তরণে প্রয়োজনীয় শর্তবলীর ভিত্তিতে গড়ে উঠা একটি যুক্তিযুক্ত পথরেখা মাত্র। আমরা সর্বজ্ঞ– এমন দাবি কখনো করি না। আমাদের দূরবর্তী লক্ষ্য হল সংলাপ, বিতর্ক, সংশোধনীর আয়োজন করা, সর্বোপরি, এই পথটি কীভাবে আরো বেশি উপলব্ধি করা যায়– সেই চেতনা তৈরি করা। বিশৃঙ্খল পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার দৌরাত্ম্যে প্রতিবন্ধকতার অসংখ্য দিক স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্টি হয়। অনেকেই আছেন যারা সহজাতভাবেই ইকো–সোশ্যালিস্ট। কীভাবে তারা একত্রিত হতে পারে? আমরা কি একটি “প্রাণ–প্রকৃতিবাদী আন্তর্জাতিক” কল্পনা করতে পারি? এই বিমূর্ত ধারণাকে কি বাস্তবে পরিণত করা যায়?
ইশতেহার
একবিংশ শতাব্দী শুরু হয়েছে একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। নজিরবিহীন পরিবেশ বিপর্যয় এবং একটি সন্ত্রাস কবলিত বিশৃঙ্খল বিশ্বব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধ পৃথিবীর বিশাল অংশ জুড়ে, (যেমন: মধ্য আফ্রিকা, মধ্য প্রাচ্য, দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে) ছড়িয়ে পড়ে গ্যাংগ্রিনের মতো এবং তা আলোড়ন তোলে পুরো বিশ্বেই।
আমাদের মতে, পরিবেশ বিপর্যয় ও সামাজিক বিপর্যয়ের এই বিষয়গুলো পরস্পর গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং একে একই কাঠামোর নানা রূপ হিসেবে দেখা উচিত। পরিবেশগত বিপর্যয়ের জন্য দায়ী বিধিনিষেধহীন ব্যাপক শিল্পায়ন, যেটি পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়েছে এবং পরিবেশগত অস্থিরতা তৈরি করেছে। সামাজিক বিপর্যয় ঘটেছে বিশ্বায়ন নামক সাম্রাজ্যবাদেরই আরেক ধরন থেকে। এটি সমাজের উপর বিচ্ছিন্ন প্রভাব বজায় রেখে টিকে আছে। অধিকন্তু, এসব অন্তর্নিহিত আইডিয়াগুলো মূলত একই লক্ষ্যে পৌঁছার বিভিন্ন পথ এবং এগুলোকে অবশ্যই বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সম্প্রসারণের কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।
আমরা এই শাসনব্যবস্থার নৃশংসতার পক্ষে মুখরোচক অথবা প্রচারমূলক নমনীয় কথাবার্তা প্রত্যাখ্যান করি। যেমন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে পরিবেশগত ক্ষতি নানাভাবে আড়াল করা ও মানবজীবনের ক্ষয়ক্ষতিকে রহস্যে মুড়ে ফেলার চেষ্টা। অর্থনৈতিক হিসাব–নিকেশের পরিবর্তে, আমরা বরং গুরুত্ব দেই: এটি পরিবেশ ও মানবজীবনের উপর প্রকৃত অর্থে কি প্রভাব ফেলছে, সেদিকে।
এই শাসনব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত আরো মুনাফা বাড়ানোর তাগিদ নিয়ে চলতে হয়। যা প্রকৃতি ও পরিবেশগত ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। পরিবেশ দূষণ করছে। এমন সব প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস করছে– যা বহু যুগ ধরে, ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে প্রাণপ্রকৃতির সহায়ক হিসেবে। এই শাসনব্যবস্থা এসব প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস ও লুট করছে। ঠাণ্ডা মাথায় এসব প্রাকৃতিক প্রাণশক্তি বিনাশ করছে আরো পুঁজি সঞ্চয়ের তাড়নায়।
মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষ চায় স্ব–শাসন, কমিউনিটি ও একটি অর্থবহ অস্তিত্ব। কিন্তু পুঁজিবাদ, বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকে নিছক শ্রমভাণ্ডারে এবং অবশিষ্টদেরকে উটকো উপদ্রবে পরিণত করেছে। বিশ্বব্যাপী ভোগবাদ ও বিরাজনীতিকরণ সংস্কৃতির সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে এটি সামাজিক নীতি–নৈতিকতা ও ঐক্যে ফাটল ধরায়। বর্তমান সময়ে সম্পদ ও ক্ষমতার যে বিপুল বৈষম্য দেখা যায়, তা মানব ইতিহাসে কখনো দেখা যায় নি। পুঁজিবাদ একটি দুর্নীতিবাজ ও আজ্ঞাবহ গ্রাহক (ক্লায়েন্ট) রাষ্ট্র নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হয় যার স্থানীয় অংশীদারী অভিজাতরা দমন–পীড়ন চালায়। এটি পরিচালিত হচ্ছে পশ্চিমাশক্তি ও যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক তত্ত্বাবধানে, নানাবিধ বহুজাতিক সংস্থার নেটওয়ার্ক দ্বারা। যেগুলো বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করছে, ঋণের ফাঁদে ফেলছে এবং একই সময়ে পুঁজিবাদী কেন্দ্রের প্রতি সমর্থন আদায়ের জন্য বিশাল সামরিক যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থাপনা তৈরি রাখছে।
আমরা বিশ্বাস করি, বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যে সংকট সৃষ্টি করেছে, তা কাটিয়ে ওঠা দূরে থাক, সেটি নিয়ন্ত্রণ করার মতো ব্যবস্থাও এটি গড়ে তুলতে পারবে না। এটি পরিবেশগত সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। কারণ তা করতে গেলে তাকে সম্পদ আহরণের ওপর সীমা আরোপ করতে হবে। পুঁজিবাদ যেটি কখনোই করতে পারে না। কারণ এটি গড়েই উঠেছে এই নীতিতে: বৃদ্ধি অথবা মৃত্যু! এটি সন্ত্রাস এবং অন্যান্য সহিংস বিদ্রোহের ফলে সৃষ্ট সমস্যাও মিটমাট করতে পারে না, কারণ, তা করতে গেলে তাকে সাম্রাজ্যের ধারণা ত্যাগ করতে হবে। যা পুঁজিবাদী জীবনধারা ও সম্পদের লাগামহীন বৃদ্ধির উপর সীমা আরোপ করবে। যেটি হবে আত্মঘাতী। ফলে তার সামনে একটিই পথ খোলা থাকে। পাল্টা পাশবিক শক্তি প্রয়োগ। যেটি আরো বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে ও আরো সন্ত্রাসবাদের বীজ বপন করে। এভাবে আবার চলে সন্ত্রাসবাদ–বিরোধী সন্ত্রাস। এক পর্যায়ে এগুলো নতুন ও মারাত্নক ফ্যাসিবাদী রূপে বিকশিত হয়।
এক কথায়, পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা ঐতিহাসিকভাবেই দেউলিয়া। এটি এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে অক্ষম একটি সাম্রাজ্যে পরিণত হয় এবং এই অস্বাভাবিকতা এই অন্তর্নিহিত দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে। প্রাণ–প্রকৃতি বা বাস্তুতন্ত্রের ভাষায় এটি অন্তর্নিহিতভাবে টেকসই নয় এবং এটিকে ভবিষ্যতের বসবাসযোগ্য করতে এর অত্যাবশ্যকীয় মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন, বস্তুত, পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া প্রয়োজন।
এই পরিস্থিতিতে রোজা লুক্সেমবার্গের উত্থাপিত দাবিটি আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে: সমাজতন্ত্র অথবা বর্বরতা! যেখানে এই বর্বরতার চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে মধ্যবর্তী এই শতকটিতে। এবং নানাবিধ পরিবেশ বিপর্যয়, সন্ত্রাসবাদ, সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতা এবং এগুলোর ফ্যাসিবাদী রূপ; এই সবের আশঙ্কাও এখন খুব বাস্তব বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু, সমাজতন্ত্র কেন? বিংশ শতাব্দীর সমাজতান্ত্রিক প্রবক্তাদের ব্যর্থতার পরও, ইতিহাসের আস্তাকুড় থেকে কেন এটিকে আবার কুড়িয়ে আনা হলো? শুধুমাত্র এই কারণে: অনেক দমনপীড়ন ও অকার্যকারিতার পরেও, সমাজতন্ত্র এখনো টিকে আছে পু্ঁজিবাদী ব্যবস্থাকে উচ্ছেদের রাস্তা হিসেবে। যদি পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করা যায়, তখন সভ্যতার টিকে থাকার প্রয়োজনে সমাজতন্ত্র বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়বে, যেটি পুঁজিবাদ–উত্তর সমাজে একটি বড় সফলতা বলে গণ্য হবে। আমরা যদি পুঁজিবাদকে মূলত অস্থিতিশীলতা এবং বর্বরতায় নিমজ্জিত ব্যবস্থা হিসেবে আখ্যায়িত করি, তাহলে আমাদেরকে পুঁজিবাদের রেখে যাওয়া সংকট নিরসনে সক্ষম সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যদি পূর্বতন সমাজতন্ত্র তা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমাদের লড়াই করার বাধ্যবাধকতা আছে একটি সফল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য। লুক্সেমবার্গ৫ যে সময় পুঁজির বর্বরতার কথা বর্ণনা করেছিলেন, তখন থেকে এর চেহারা–ধরন অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। এটি নতুন রূপে হাজির হয়েছে। একইভাবে “সমাজতন্ত্র”কেও এই সময়ের বাস্তবতা বুঝে হাজির হতে হবে, নতুন নাম নিতে হবে।
এই কারণে, আমরা আমাদের সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বকে প্রাণ–প্রকৃতিবাদী সমাজতন্ত্র বা ইকো–সোশ্যালিজম নাম দিয়েছি এবং এটি বাস্তবায়নে নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছি।
কেন ইকো–সোশ্যালিজম?
বিংশ শতাব্দীর প্রথম যুগের সমাজতন্ত্রকে খারিজ করে নয়, বরং সেখান থেকে উপলব্ধি তৈরি করে আমরা ইকো–সোশ্যালিজমের ধারণা সামনে এনেছি। প্রাণ–প্রকৃতি বা বাস্তুতন্ত্রের সংকটের নিরিখে। সেটির মতো, ইকো সোশ্যালিজমও এই অন্তর্দৃ্ষ্টির ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে যে: পুঁজি শ্রমকে নিছকই একটি অবজেক্টে পরিণত করে। এবং উৎপাদকদের মুক্ত বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। অন্যভাবে বললে: এটি উৎপাদকদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে উৎপাদনের উপায় থেকে। আমরা বুঝতে পারি যে: প্রথম যুগের সমাজতন্ত্রে এটির লক্ষ্য পুরোপুরি অর্জন করা যায় নি। বিষয়গুলো বেশ জটিল বলে এখানে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা সম্ভব হচ্ছে না। এখানে শুধু এটুকু বলা যায় যে, বিদ্যমান পুঁজিবাদী শক্তিগুলোর শত্রু মনোভাবাপন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পেক্ষাপটে এই অক্ষমতার বিভিন্ন কারণ ছিল। এই সময়ের সমাজতন্ত্রে বেশ কিছু ক্ষতিকর উপাদান ও প্রভাব ছিল। প্রধানত: অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র অস্বীকার করা, এবং পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অনুকরণে উৎপাদন চালিয়ে যাওয়া। এগুলো শেষপর্যন্ত এই সমাজগুলির পতন ডেকে এনেছে এবং প্রাণ–প্রকৃতি ধ্বংস করেছে।
ইকো–সোশ্যালিজম প্রথম যুগের সমাজতন্ত্রের মুক্তিমুখীন লক্ষ্যগুলি ধরে রাখে, এবং এটি সামাজিক গণতন্ত্রের অধঃপতিত, সংস্কারবাদী লক্ষ্য এবং সমাজতন্ত্রের আমলাতান্ত্রিক রূপের উত্পাদনশীল কাঠামো উভয়ই প্রত্যাখ্যান করে। এটি বরঞ্চ প্রাণ–প্রকৃতিবাদী কাঠামোয় সমাজতান্ত্রিক উত্পাদনের পথ এবং লক্ষ্য উভয়ই পুনরায় সংজ্ঞায়িত করতে জোর দেয়। এটি সমাজের টেকসইতার জন্য অত্যাবশ্যকীয় ‘প্রবৃদ্ধি সীমাবদ্ধকরণের‘ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কাজ করে। কোনোভাবেই অভাব, কষ্ট এবং দমন চাপিয়ে দেওয়ার অর্থে কোনকিছু গ্রহণ করা হয় না। বরং ইকো–সোশ্যালিজমের লক্ষ্য হল প্রয়োজনের নিরিখে আমূল পরিবর্তন এবং পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে সরে গিয়ে গুনগত পরিবর্তন আনা। পণ্য উৎপাদনের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, সমাজের এই রূপান্তর বিনিময় মূল্যের (exchange-values) পরিবর্তে কার্যকরী মূল্যকে (use-values) মূল্যায়ন করে—যা প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে একটি সুদূরপ্রসারী তাত্পর্যপূর্ণ কর্ম–পরিকল্পনা।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে, প্রাণ–প্রকৃতিবান্ধব উত্পাদন, বর্তমান সংকটগুলি কাটিয়ে ওঠার জন্য ভূমি প্রস্তুত করতে পারে। অবাধ সমবায়ভিত্তিক উত্পাদকদের সমন্বয়ে গঠিত সমাজ তার অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রায়নের পথ বন্ধ করে না। ররং, এটি অবশ্যই তার ভিত্তি ও লক্ষ্য হিসেবে সকল মানুষের মুক্তির উপর জোর দেয়। যার ফলে এটি সাম্রাজ্যবাদী প্ররোচনাকে বৈষয়িক ও উদ্দেশ্যমূলকভাবেই প্রত্যাখ্যান করে। এ জাতীয় লক্ষ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে, এটি সমস্ত ধরনের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখে। বিশেষত লৈঙ্গিত ও জাতিগত আধিপত্য। এবং এটি অন্ধবিশ্বাসীদের বিকৃতি এবং তাদের সন্ত্রাসবাদী আত্মপ্রকাশের দিকে পরিচালিত শর্তাবলিকে পাশ কাটিয়ে যায়। মোটকথা, এটি এমন একটি বিশ্ব ব্যবস্থার কথা বলে যেখানে সবাই বাস করবে প্রকৃতির সাথে পরিবেশগত ঐক্যতান বজায় রেখে। এই প্রবণতার একটি বাস্তবিক ফলাফল প্রকাশ করা যেতে পারে, উদাহরণস্বরূপ, শিল্প পুঁজিবাদের অবিচ্ছেদ্য জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর নির্ভরতা সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলার মাধ্যমে। এবং যার পরিবর্তে, এটি তেল সাম্রাজ্যবাদের অধীনস্থ জমি মুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ দিশা দিতে পারে। তখন বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে, একইসাথে অন্যান্য পরিবেশগত সংকটের দুর্দশা থেকে রক্ষা করতে পারবে।
এই সুপারিশ/পরামর্শগুলো পড়ার সময় সবাই হয়তো চিন্তা করবেন: এগুলো কত কত বাস্তবিক ও তাত্ত্বিক প্রশ্ন সামনে আনছে। এবং ভগ্ন হৃদয়ে তারা আবিস্কার করবেন যে: এভাবে পৃথিবী গঠনের পথ থেকে তারা এখনো কতটা দূরে আছেন। প্রথা–প্রতিষ্ঠান এবং মানুষের সচেতনতা; দুই দিক থেকেই। আমাদের সেইসব বিষয়গুলি বিশদভাবে বলার দরকার নেই, যা সকলের কাছে তাত্ক্ষণিকভাবে স্বীকৃতি পায়। তবে আমরা জোর দিয়ে বলব যে, সেগুলো যেন তারা যথাযোগ্য প্রেক্ষিত–প্রেক্ষাপটের সাপেক্ষে বিবেচনা করেন। আমরা এই কর্ম–পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রতিটা পদক্ষেপ নির্ধারণ করে দিতে চাই না। বরং বর্তমান পরিস্থিতি বদলানোর জন্য পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় যুক্তি তৈরি করতে চাই। এবং এই লক্ষ্য অর্জনের পথে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে চাই। আমরা এই সম্ভাবনাগুলোকে আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি এবং একই সাথে, একই চিন্তা–চেতনার মানুষদের এক জায়গায় হওয়ার লক্ষ্যে কাজ শুরু করি। যদি এইসব যুক্তিগুলোর মধ্যে কোনো সদগুণ থাকে, তবে অবশ্যই একই জাতীয় চিন্তাভাবনা এবং এই চিন্তাভাবনাগুলো অনুধাবন করার মতো অনুশীলনগুলো সমন্বিতভাবে সারা বিশ্বে অগণিত দিকে অঙ্কুরিত হবে। ইকো–সোশ্যালিজম আন্তর্জাতিক এবং সর্বজনীন হবে অথবা এটি কিছুই হবে না। আমাদের সময়ের সংকটগুলোকে অবশ্যই বিপ্লবী সুযোগ হিসেবে দেখতে হবে, এর বাস্তব অস্তিত্ব আনায়ন করা আমাদের দায়িত্ব।
জোয়েল কোভেল এবং মাইকেল লোয়ি
প্যারিস, সেপ্টেম্বর ২০০১
অনুবাদকের টীকা:
১. গ্রিণ লেফট (Green Left) শব্দটাকে আমাদের অনুবাদে ‘প্রাণ–প্রকৃতিবাদী সমাজতন্ত্রী‘ করা হয়েছে। যাকে একইভাবে প্রাণ–প্রকৃতিবাদী রূপান্তরবাদী কিংবা প্রতিবেশবাদী সমাজতন্ত্রী বা প্রতিবেশবাদী রূপান্তরবাদী বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। সুফিবাদকেও এক ধরণের গ্রীণ লেফট বলা চলে।
২. ইকো–সোশ্যালিস্টদের চিন্তায় পরিবেশ ও বিশ্বকে বাঁচানোর প্রশ্নটা বড় হয়ে উঠেছে। প্রাণ–প্রকৃতিমূলক সমাজে যারা বিশ্বাসী। গ্রাম–নদী–পাহাড়–বৃক্ষ–ফসল আর বিস্তৃত জনপদের প্রান্তিক মানুষই যাদের শ্রেণি। যারা শুধু শিল্পসমাজকে বৈপ্লবিক হিসেবে দেখার ঘোর বিরোধী। পুঁজি শিল্পায়নকে যারা প্রাণ–প্রকৃতির দিক থেকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। লোকজ জ্ঞান–সংস্কৃতি যাদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
৩. গ্রামসি‘র পারাডক্স বলতে এমনটা বোঝায় যে পুরনো সমাজ পচে গেছে কিন্তু নতুন সমাজ নির্মাণের কাজ সেই তুলনায় দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে না। এই বিলম্বতার কারণ সম্পর্কে গ্রামসি‘র হেজিমনি তত্ত্বে বিশেষ ধারণা পাওয়া যায়। আলতাফ পারভেজ তাঁর ‘গ্রামসি ও তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা‘ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন।
৪. স্ব–পরিচালনা ও সামাজিক পুনর্গঠনে জনসাধারণের সক্রিয় অংশগ্রহণই শুধু পারে “শত শত বছরের বুর্জোয়া শ্রেণি–শাসনে অধঃপতিত জনগণের পূর্ণাঙ্গ আধ্যাত্মিক রূপান্তর ঘটাতে।“…তিনি আরো বলেছিলেন, “ইতিহাসের দিক থেকে বললে, সবচেয়ে চতুর কেন্দ্রীয় কমিটির অভ্রান্ততার চেয়েও সত্যিকারের বিপ্লবী একটা আন্দোলনের করা ভুলগুলো অপরিসীম মাত্রায় বেশি ফলপ্রসূ।” [সেলিম রেজা নিউটন (২০২০) চমস্কির ভবিষ্যতের সরকার। ঢাকা: পেন্ডুলাম পাবলিশার্স।]