নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদ হিশেবে খ্যাত দীপেশ চক্রবর্তী আমাদের কাছে খুবই পরিচিত এক নাম। বিশেষত তার প্রভিন্সিয়ালাইজিং ইউরোপ দুনিয়াজুড়ে বহুল পঠিত ও আলোচিত গ্রন্থ। বর্তমান সময়ে তিনি কাজ করছেন জলবায়ু সংকট ও মহামারির কার্যকারণ উন্মোচনে ইতিহাসের ভূমিকা বিষয়ে। বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক ও পরিবর্তনকামী ক্রিটিকাল রাজনৈতিক পরিসরে দীপেশ চক্রবর্তীর নানাবিধ তত্ত্ব ও আইডিয়া সংক্রান্ত আলাপ–পর্যালোচনা ক্রমবর্ধমান।
দীপেশ চক্রবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে লরেন্স এ কিম্পটন ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর। প্ল্যানেটারি তথা গ্রহীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জলবায়ু সংকট ও মহামারি ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ সংক্রান্ত তার লেখালেখিকে সমগ্র বিশ্বেই বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার The Climate of History in a Planetary Age গ্রন্থ। মানুষী ও না–মানুষী (non-human) ইতিহাসকে একই মোহনায় সংমিশ্রণের ক্ষেত্রে দীপেশ চক্রবর্তীর মুনশিয়ানা সর্বমহলে স্বীকৃত। পুঁজির ইতিহাসের সঙ্গে পৃথিবী আর প্রাণের ইতিহাস মিলিয়ে পাঠ করার পদ্ধতি বিদ্যায়তনিক ও ক্রিটিক্যাল জ্ঞান–চর্চার জগতে প্রতিষ্ঠিত অনুশাসনে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া বর্তমানে দৃশ্যমান।
অরাজের আমন্ত্রণে দীপেশ চক্রবর্তী নিম্নোক্ত সাক্ষাৎকারটি দেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সারোয়ার তুষার।
জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে মনুষ্য সভ্যতার সম্পর্ক ভাবাই নতুন ইতিহাস চর্চার কাজ–দীপেশ চক্রবর্তী
প্রশ্ন: আপনি আপনার বিভিন্ন লেখাপত্র ও সাক্ষাৎকারে ‘ইতিহাসের ইতিহাস’, ‘ইতিহাসের বিবর্তন’ ইত্যাদি বিষয়ে নানা পর্যবেক্ষণ হাজির করেছেন। আপনার মতে, বর্তমান যুগে ইতিহাসের সংকট ও সম্ভাবনার দিক কোনগুলো?
দীপেশ চক্রবর্তী: ইতিহাসবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো চালু আছে। সেখানে বিচার হয় সাক্ষ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে, ঘটনা ও মানুষকে তার নিজস্ব সময়ের প্রসঙ্গে দেখে। কিন্তু জনজীবনে ঐতিহাসিক সাক্ষ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে সামাজিক দ্বন্দ্বের নিরসন করা বা সেই প্রমাণকে মূল্য দেবার প্রবণতা সর্বত্রই হ্রাসমান। সেই জায়গায় মানুষের “অভিজ্ঞতা”, “স্মৃতি”, গোষ্ঠীগত পরিচিতি, তাৎক্ষণিক অনুভূতির ভূমিকা ক্রমবর্ধমান। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অতি আধুনিক প্রযুক্তি যা এক অতি–তাৎক্ষনিক “বর্তমান”–এর সৃষ্টি করে স্থান–কাল–পাত্র নির্ভর বিচারের বুদ্ধিটাই দেয় গুলিয়ে। নানাদিক থেকে ইতিহাস–ভিত্তিক বিচারের বোধ আজ গভীর সংকটে।
প্রশ্ন: একদিকে উৎকট পশ্চিম–কেন্দ্রিকতা, অন্যদিকে উৎকট পশ্চিম–বিরোধিতা; এই দুইয়ের বাইরে গিয়ে আপনি প্রভিন্সিয়ালাইজিং ইউরোপ বইয়ে লিখেছেন, ইউনিভার্সাল নর্মস ‘indispensable and inadequate’; ‘অপরিহার্য এবং অপর্যাপ্ত’। আমাদের এই সাক্ষাতকারের পাঠকদের জন্য এ বিষয়টা ব্যাখ্যা করবেন কি? অর্থাৎ উত্তর–ঔপনিবেশিক সমাজগুলোতে ইউনিভার্সাল নর্মস ও লোকাল কন্টেক্সট একইসাথে কেন জরুরি? একচেটিয়াভাবে ইউনিভার্সাল কিংবা একচেটিয়াভাবে লোকাল হওয়ার সংকট কী?
দীপেশ চক্রবর্তী: এই প্রশ্নের বিশদ উত্তর দিতে গেলে একটা বই লেখা লাগবে। আমার Provincializing Europe দেখে নেবেন। কিন্তু খুব সংক্ষেপে বললে এই: মানুষের ক্ষেত্রে যা সত্যই সর্বজনীন— যেমন আমরা Homo sapiens প্রজাতি— তা আমাদের শরীরে–মনে নিজের অজান্তেই বহমানা এক ইতিহাস। এই সর্বজনীনতা থেকে কোনো রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের উদ্ভব হয় না। কারণ Homo sapiens হিসাবেই— অর্থাৎ আমাদের প্রজাতিগত চরিত্রের প্রভাবেই আমরা মানুষে–মানুষে নানান কোন্দলে লিপ্ত হই। আপনিও মানুষ, আমিও মানুষ, এই জ্ঞান সর্বজনীন হলেও এই জ্ঞান আমাদেরকে অত্যাচার বা নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তি দেয় না। বরং বলতে পারেন মানুষ মানুষকেই যে অত্যাচার করে, তা সে পশু–পাখিকেও সচরাচর করে না। ফলে রাজনীতির ক্ষেত্রে সর্ব মানুষের প্রতি প্রযোজ্য এমন কতগুলো ধারণা নিয়ে কাজ করতে গেলে— যেমন সাম্যের বা নাগরিক অধিকারের ধারণা— বুঝতে হয় যে এইগুলি সত্যকার সর্বজনীন কথা না। যুক্তির দরবারে এই সব ধারণার আপীল থাকলেও বাস্তবে ধারণাগুলিকে মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক প্রভেদের কথা মনে রেখে তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। যুক্তির কাছে যা indispensable লাগে, প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাকেই একটু বদলে নিতে হয়, তাই তা inadequateও বটে।
প্রশ্ন: ইউরোপিয়ান ক্যাটাগরিগুলো বাদ দিয়ে কি পোস্ট–কলোনিয়াল চিন্তার বুনিয়াদ গড়ে তোলা সম্ভব? ইউরোপিয়ান ক্যাটাগরির ঋণ স্বীকার করেও কি করে ইউরোসেন্ট্রিক হওয়া এড়ানো যায়?
দীপেশ চক্রবর্তী: প্রথম প্রশ্নটার সহজ উত্তর, না। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ কিন্তু উত্তরটা জটিল। উনিশ শতক বা বিশ শতকে ইউরোপীয় চিন্তার প্রাধান্য এড়ানো শক্ত ছিল। অনেক সময় ইউরোপীয় চিন্তাকে অস্বীকার করার মধ্যেও সেই চিন্তাকে পূর্বপক্ষ ধরে নিয়ে কথা হতো। বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে উনিশ শতকের শেষে একটা কথা খুব চালু হয়েছিল যে, ইউরোপীয় বিজ্ঞানের সব তথ্যই নাকি “ব্যাদেও আছে”। এখন এইটা একটা ইউরোপীয় দাবির উত্তর, অর্থাৎ সেই অর্থে কথাটা একটি “অনু–বাদ”, যে কথা আরেকটি কথা ওঠার পরে বলা হয়। একটা অন্য উদাহরণ দিলে কথাটা সহজ হবে। বঙ্কিম–রবীন্দ্রনাথ–শরৎচন্দ্রের কাছে বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিক অবশ্যই ঋণী, কিন্তু তাই বলে কি হিন্দু–কেন্দ্রিক সাহিত্য থেকে সরে যাওয়া অসম্ভব হয়েছে? তা তো না।
প্রশ্ন: ‘History and the Politics of recognition’ প্রবন্ধে চার্লস টেইলরের বরাত দিয়ে আপনি historical wound তথা ঐতিহাসিক ক্ষত ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন। ঐতিহাসিক ক্ষত সত্তা বা পরিচয়ের রাজনীতিতে খুবই কেন্দ্রীয় অবস্থানে থাকে। বিশেষত অতীত অপমান বা নির্যাতনের স্মৃতি বর্তমান সময়ে জাগরুক রাখার ক্ষেত্রে। আবার ‘ঐতিহাসিক ক্ষত’–তে সত্যের বীজ থাকলেও, এই ক্ষত কেবল ইতিহাসকে নির্ভর করে নিজেকে জিইয়ে রাখে না; ‘ইতিহাস–নির্ভর–মিথ’ জাতীয় বয়ানে পরিণত হয় যা স্রেফ ঐতিহাসিক তথ্য দিয়ে বিচার করা যায় না। আপনি এও লিখেছেন যে, এই ক্ষত কিংবা ক্ষতের নামে কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপের কথা বলতে পারার মানে হচ্ছে ইতোমধ্যেই সেই ক্ষত নিরাময় প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি ‘ঐতিহাসিক ক্ষত’ পরিচয়বাদী রাজনীতির পুঁজি হয়ে উঠছে না? বস্তুনিষ্ঠ কিংবা ঐতিহাসিক সত্যের উপর বিকশিত সমাজ গঠনে ‘ঐতিহাসিক ক্ষত’ অন্তরায় হতে পারে কিনা?
দীপেশ চক্রবর্তী: হ্যাঁ, এই শেষ প্রশ্ন দুটির মধ্যে “ঐতিহাসিক ক্ষত” সম্বন্ধে যে রাজনৈতিক সমালোচনা প্রচ্ছন্নভাবে বর্তমান, তার সঙ্গে আমি একমত।
প্রশ্ন: ‘আমাদের যা ইচ্ছা সমাজ সেদিকেই যেতে চায়’— অর্থে ইতিহাসের ধারণায় আপনি বিশ্বাস করেন না। ইতিহাসে এমন কোনো সাক্ষ্য নেই যে সমাজ ভালোর দিকে যাবেই। কিন্ত ভালো কিংবা উন্নত সমাজ নির্মাণের বাসনাও মানুষের আছে। এই বাসনা ইতিহাসের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। তাই বলে আধুনিক মানুষ এই বাসনা ত্যাগও করতে পারে না। অর্থাৎ ‘আধুনিক’ হওয়ার অর্থ এক অর্থে anti-historical হওয়া।
আবার, প্রযুক্তির বিপুল প্রসারের এই যুগে [contextual judgement অর্থে] ইতিহাস চর্চা এক রকম মারও খাচ্ছে। এমতাবস্থায়, একটা factual সমাজ গঠন ও anti-historical হওয়া কি একইসাথে সম্ভব? এমন সমাজ কি ভাবা সম্ভব যেখানে ঐতিহাসিক সত্যের কদর আছে, কিন্ত ইতিহাসবাদিতার অত্যাচার নেই? যুক্তির ক্রম অবনতি এবং প্রযুক্তির অত্যাচারের আজকের জমানায় ইতিহাস চর্চার উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত?
দীপেশ চক্রবর্তী: আপনার পর্যবেক্ষণগুলি আমারও ঠিক মনে হয়। গণতন্ত্রের ভোটের দিকটা সবাই চায়, কিন্তু গণতান্ত্রিক চেতনার যেইখানে প্রাণভোমরা বাস করে— সেই deliberative দিক, অর্থাৎ বিরোধী ও বিরোধী–চিন্তাকে শুধু স্থান দেয়া নয়, তাকে গণতন্ত্রের স্বার্থেই সম্মান করা ও মূল্য দেয়া— সেই জায়গাটার আলো–বাতাস আজ প্রায় সব দেশেই বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ইতিহাস চর্চার মূল উদ্দেশ্য এখন প্রধানত একটাই: মানুষ পৃথিবী জুড়ে গণতন্ত্রের নাম করে এমন একটা গণতন্ত্র–বিরোধী অবস্থায় পৌঁছাল কী করে, তার হদিশ দেয়া।
প্রশ্ন: আধুনিকতার সমালোচনা মাত্রই anti-modern সাব্যস্ত করার চল আছে আমাদের সমাজে। আবার এটাও সত্য যে, অনেকে প্রাক–আধুনিক অবস্থান থেকে আধুনিকতাকে খারিজ করতে চান। কিন্ত আপনি কিংবা ব্রুনো লাতুর, এমনকি হেবারমাস প্রমুখ দার্শনিকেরা তো আধুনিক যুক্তির প্রয়োজনীয়তাকে কখনো reject করেন না। হেবারমাস যেমন আধুনিক হওয়া অর্থেই আধুনিকতার পর্যালোচনা করতে আগ্রহী। কিন্ত আধুনিকতাকে সমালোচনার উর্ধ্বে sacred মনে করেন অনেকে। এর কারণ কি এই যে, মডার্নিটির দার্শনিক মোকাবেলার প্রতি অনীহা অথচ মডার্নিটিকে একটা রাজনৈতিক এজেণ্ডা বিবেচনা করা?
দীপেশ চক্রবর্তী: ইন্ডিয়াতেও এইটা এক সময় চালু ছিল। আশিস নন্দীকে আধুনিকতা–বিরোধী ভাবা হতো। আমরা আধুনিকতার যেই সমালোচনার কথা বলি, তা আধুনিক মানুষ হিসাবেই বলি। অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়ে বিশ্বাস করে, যুক্তিতে বিশ্বাস করে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, বিশেষত আধুনিকীকরণ করতে গিয়ে যে নিপীড়ন হয়— শুধু মানুষের উপরই না, প্রাণীজগতের ও প্রাকৃতিকজগতের উপরও— তারও বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে।
প্রশ্ন: এবারে আপনার সাম্প্রতিক কাজ প্রসঙ্গে আসি। এই মার্চেই আপনার নতুন একটা বই বেরিয়েছে। The Climate of History in a Planetary age জলবায়ু সংকট ও অতিমারি সংক্রান্ত আপনার সমস্ত লেখাতেই planetary ক্যাটাগরিটি অবধারিতভাবে হাজির হয়; এই ক্যাটাগরিকে আপনি global [মনুষ্য–নির্মিত পরিকাঠামোর দুনিয়া অর্থে] ক্যাটাগরি থেকে আলাদা হিশেবেই হাজির করছেন। planetary ক্যাটাগরিতে মানুষ কেন্দ্রচ্যুত হয়ে যায় এবং এই গ্রহের সার্বিক স–জীব ও অ–জীব সত্তার প্রসঙ্গ মুখ্য হয়ে ওঠে। আমাদের পাঠকদের জন্য planetary ক্যাটাগরিটি ব্যাখ্যা করার অনুরোধ জানাচ্ছি। কেন কেবল global ক্যাটাগরি দিয়ে আর জলবায়ু সংকট কিংবা অতিমারিকে বোঝা যথেষ্ট নয়? কোন অর্থে জলবায়ু ও অতিমারির সংকট পুঁজির যুক্তিকে ছাপিয়ে যায়?
দীপেশ চক্রবর্তী: এই প্রশ্নের একটা খুব ছোট্ট জবাব দিই— বাকিটার জন্য আমার বইটা পড়া দরকার (আগে যেমন সিনেমার বিজ্ঞাপনে বলা হতো “বাকিটা রূপালি পর্দায় দেখুন”!) জলবায়ু বা অতিমারির সংকট সার্বিকভাবে বুঝতে গেলে ভূতত্ত্ব, জীবনের ইতিহাস, প্রাণের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশুনা করতে হয়। অর্থাৎ পুঁজির ইতিহাসের সঙ্গে এখন পৃথিবীর আর প্রাণের ইতিহাস মিলে মিশে গেছে, এই অর্থেই প্রথাগত পুঁজিবাদের বিশ্লেষণে যে সকল বিদ্যা কাজে দিত (যেমন ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, সাহিত্য ইত্যাদি), এখন তার বেশি বিদ্যা অধিগত করতে হয়। এই অর্থে। বিশদ ব্যাখ্যার জন্য আমার বইটা দেখেন।
প্রশ্ন: জলবায়ু সংকটকে সাধারণত পলিসিগত কিংবা/এবং বৈজ্ঞানিক সংকট মনে করা হয়; যার সমাধানও পলিসিগত এবং বৈজ্ঞানিক হবে বলে ধরে নেয়া হয়। জলবায়ু পরিবর্তন ও অতিমারি প্রশ্নে ইতিহাসের অভিঘাত কেন জরুরি? সেই ‘ইতিহাস’–এ মানুষের অবস্থান কোথায় হবে?
দীপেশ চক্রবর্তী: কিন্তু পলিসিগত বা বৈজ্ঞানিক সমধানও তো মানুষের জন্যই। কাজেই সংকটের চরিত্র ও সমাধান দুটো নিয়েই মানুষকে ভাবতে হবে। বিশেষ করে ভাবতে হবে প্রাণের ইতিহাসের ও প্রাণের আয়োজনের সঙ্গে— অর্থাৎ জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে— মানুষের সভ্যতার সম্পর্ক কী। সেইটাই নতুন ইতিহাসচর্চার কাজ।
প্রশ্ন: যে ইতিহাসের নায়ক মানুষ; সেই ধরনের ইতিহাস–চর্চার সহসাই অবসান ঘটবে এমন কোন সম্ভাবনা আছে কি? আবার মানুষ তার সচেতন সিদ্ধান্তে যেভাবে এক অবিসংবাদিত ভূ–তাত্ত্বিক ক্ষমতা (geological agent) হয়ে উঠেছে এবং এর ফলে এই গ্রহের যে নাভিশ্বাস উঠেছে, সেই দিক বিবেচনায় multi-species ইতিহাস–চেতনাও অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এই দুই ধরনের ইতিহাসের সংশ্লেষে নতুন কোনো ইতিহাস–চেতনার সম্ভাবনা দেখেন কি?
দীপেশ চক্রবর্তী: এই প্রশ্নের উত্তর আমার আগের প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে নিহিত আছে। আবার বলি, অনুগ্রহ করে বইটা পড়ে দেখেন।
প্রশ্ন: অতিমারির সাথে মানুষের সম্পর্ক বেশ পুরোনো; অন্তত কৃষির উদ্ভবের কাল থেকে। তাহলে ‘অতিমারির যুগ’ কথাটার তাৎপর্য কী?
দীপেশ চক্রবর্তী: “অতিমারির যুগ” বলতে বিশেষজ্ঞরা এমন একটা সময় বোঝান যেখানে অতিমারির আক্রমণ পূর্বের চেয়ে অনেক ঘন–ঘন হয়ে ওঠে। গত পনেরো বৎসরে অনেকগুলি অতিমারি হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, একটি তো হলোই। মানুষের দশ হাজার সভ্যতার ইতিহাসে এত ঘন ঘন অতিমারির সম্ভাবনা দেখা দেয়নি আগে। কিন্তু এখন সেই অবস্থা হয়েছে। সেই কারণেই অনেক বিশেষজ্ঞ বর্তমানকে একটি “অতিমারির যুগ” বলে চিহ্নিত করেন।
প্রশ্ন: আপনি আপনার এক সাক্ষাৎকারে (The Planet does not return our gaze) বলেছেন, অতিমারি আমাদের পুনরায় মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, অণুজীব তথা বিভিন্ন ধরনের জীবাণুই এই গ্রহের ‘dominant form of life’; মানুষই বরং সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী চৈতন্যে আচ্ছন্ন মাইনরিটি ফর্ম অব লাইফ। অন্যান্য অনেক দার্শনিক (যেমন হানা আরেন্ট) মাইনরিটি ফর্ম অব থিংকিং প্রসঙ্গে আলাপও তুলেছেন, যদিও সেটা মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকেই। আপনি সম্ভবত প্ল্যানেটারি স্কেলে minority form of thinkingকে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে চাইছেন। আমাদের পাঠকদের জন্য ব্যাখ্যা করবেন কি জলবায়ু সংকট ও অতিমারির বাস্তবতায় মানুষী যজ্ঞ সংকোচনের স্বার্থে সংখ্যালঘুত্বের চৈতন্য কীভাবে কাজে আসতে পারে?
দীপেশ চক্রবর্তী: ঠিকই বলেছেন। এই কথা আমি বলেছি। কিন্তু এইটা নিয়ে আমার ভাবনাচিন্তা এখনো সম্পূর্ণ দানা বাঁধেনি। তাই এই আলোচনাটি ভবিষ্যতের কোনো সুযোগের জন্য মুলতুবি রাখলাম। শুধু এইটুকু বলি, আধুনিক মানুষকে নিজের প্রয়োজনেই এমনভাবে বাঁচতে শিখতে হবে যাতে পৃথিবীর সঙ্গে তার সম্পর্কটা domination-এর না হয়। এই ভাবনার প্রসঙ্গেই এই সব কথা তোলা।
আপনাদের প্রশ্ন ও আমার কাজে আপনাদের আগ্রহের জন্য অনেক ধন্যবাদ।