অরাজ
প্রচ্ছদ » নোম চমস্কি ।। মানুষের স্বাধীনতা ও মানুষের মন

নোম চমস্কি ।। মানুষের স্বাধীনতা ও মানুষের মন

  • অনুবাদ: আব্দুল্লাহ হেল বুবুন

[নোম চমস্কি ভাষাবিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়েছেন এই তত্ত্বের মাধ্যমে যে, মানুষের ভাষা ব্যবহারের সক্ষমতা প্রকৃতিগত বা জৈবিক (innate) এবং ভাষা ব্যবহার ও অর্জন শুধুমাত্র পরিবেশগত উদ্দীপনার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, বরং তা মানুষের মস্তিষ্কে নির্দিষ্ট কগ্নিটিভ কাঠামোর অস্তিত্বকে প্রমাণ করে।

স্বভাবতই তার কাজ ওইসব অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বগুলিকে প্রত্যাখ্যান করে, যা মানুষের মনকে ট্যাবুলা রাসা বা ফাঁকা স্লেট বলে মনে করে ( চমস্কি এই দৃষ্টিভঙ্গিগুলিকে উগ্র পরিবেশবাদবলে উল্লেখ করেছেন)। রাজনৈতিকভাবে নিজেদেরকে র‍্যাডিকেল মনে করা বিভিন্ন তাত্ত্বিক (যাদের মধ্যে মার্ক্সবাদী এবং পোস্টস্ট্রাকচারালিস্টরাও ছিলেন, যেমনঃ মিশেল ফুকো) চমস্কির ভাষা তত্ত্বকে প্রতিক্রিয়াশীল বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন; তারা একটি স্থির অপরিবর্তনীয় মানব প্রকৃতির ধারণাকে অস্বীকার করেন। এই সংক্ষিপ্ত লেখনীতে চমস্কি উলটো যুক্তি দেন যে, “স্থির অপরিবর্তনীয় মানব প্রকৃতি“-কে অস্বীকার করা তত্ত্বগুলি কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্যকে বৈধতা প্রদান করে কিংবা করতে সক্ষম; অন্যদিকে মানব মনের জৈবিক/সহজাত কাঠামো যে মানব সৃষ্টিশীলতার ভিত্তি প্রদান করেএই তত্ত্ব মানব মুক্তি জন্য আরও শক্তশালী যুক্তি হতে পারে পারে।

লেখাটি রবার্ট গ্রাহাম সম্পাদিত অ্যানার্কিজম: অ্যা ডকুমেন্টারি হিস্ট্রি অব লিবার্টারিয়ান আইডিয়াসএর তৃতীয় ভলিউম থেকে নেয়া হয়েছে। মূল লেখা চমস্কির রিফ্লেকশান অন ল্যাংগুয়েজএ প্রথম প্রকাশিত হয়। – অনুবাদক]

যেসব মতবাদে বলা হয়, মানুষের মনের জৈবিকভাবে কোন স্থির ও অপরিবর্তনীয় কাঠামো নেই এবং মানুষের মন ও তার সক্ষমতা পরিবেশ ও সমাজের বিবর্তনের সাথে পরিবর্তনশীল, সেই মতবাদগুলো বেশীরভাগ সময় প্রগতিশীল, এমনকি বিপ্লবী সামাজিক চিন্তার অংশ বলে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে, পরিবর্তনীয় মানব প্রবৃত্তি নিয়ে তৈরি বিভিন্ন তত্ত্ব ও ধ্যানধারণাকে প্রায়শই রক্ষণশীল এবং হতাশাবাদী বলা হয়ে থাকে। কেন সংস্কারক এবং বিপ্লবীরা উগ্র পরিবেশবাদী হন, তা সহজেই অনুধাবনযোগ্য এবং এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, স্থিরঅপরিবর্তনীয় মানব প্রকৃতির ধারণাগুলি সামাজিক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বাধা তৈরি করতে এবং প্রতিষ্ঠিত বিশেষাধিকার তথা স্ট্যাটাস কুয়ো রক্ষায় ব্যবহৃত হয়েছে এবং হচ্ছে।

কিন্তু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যাবে যে, “ফাঁকা স্লেটেরধারণাটি (অর্থ্যাৎ কোন অপরিবর্তনযোগ্য ট্রান্সহিস্ট্রিকাল মানব প্রকৃতি নেই) শুধুমাত্র মিথ্যা নয়, এটি স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক মতবাদকে সমর্থন করতে পারে। যদি মানব প্রকৃতি আসলেই প্লাস্টিকের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হয় অর্থ্যাৎ নির্দিষ্ট সামাজিকঅর্থনৈতিক পরিবেশে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে পরিবর্তন করা যায়, তাহলে যারা কর্তৃত্বের দাবী জানায়, “বিশেষ জ্ঞানসম্পন্নহয়, এবং কম প্রজ্ঞাবানদের জন্য কোনটা ভালো, তা জানে, তাদের দ্বারাই তো অন্যান্যদের নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত?

অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব খুব সহজেই এমন একটি মতাদর্শে রূপান্তরিত হতে পারে যা ভ্যানগার্ড পার্টির জন্য উপযোগী, যারা মনে করে, তারা জনগণের জন্য কোনটা ভালো তা জানে এবং জনগণকে একটা বেটারসমাজে নেতৃত্ব দেয়ার অথোরিটি তাদের রয়েছে। এই বেটারসমাজ হবে লাল আমলাতন্ত্র‘ (রেড ব্যুরোক্রেসি) দ্বারা শাসিত এক সমাজ; এই ব্যবস্থা সম্পর্কে বাকুনিন পূর্বেই আমাদেরকে সতর্ক করে গেছেন। এবং একইভাবে মানব প্রকৃতির প্লাস্টিসিটির এই মতবাদ উদারবাদী টেকনোক্রাট বা কর্পোরেট ব্যবস্থাপকদের জন্যও উপযোগী হতে পারে, যারা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে “গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ” একচেটিয়া করে; যাকে বাকুনিনের ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় বলেছিলেন জনগণের লাঠি দিয়ে জনগণকেই আঘাত করা। উভয়েরই যুক্তি হবে এমনঃ যেহেতু আমরা জানি মানুষের জন্য কোনটা ভালো এবং আমরা এটাও জানি, মানুষের কোন অপরিবর্তনীয় ন্যাচার বা প্রকৃতি নেই, তাই মানুষকে আমরা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে পরিচালিত করতে পারি।

মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যসমূহকে নিয়ে মানব প্রকৃতি যদি ইতিহাস এবং বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্কের ফলাফল ছাড়া আর কিছুই নাই হয়, তবে এই মতাদর্শ তথা ধারণা ক্ষমতাসীনদের জন্য সকল প্রকারের জবরদস্তি তথা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং নিয়ন্ত্রণের পথ খুলে দেয়। আমার মনে হয়, এ কারণেই এই ধারণাটি বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্টিজানদের কাছে এতোটা আকর্ষণীয়। আমি অন্যত্র কর্তৃত্ববাদী সমাজতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের সমর্থকদের মধ্যে বিকাশিত মতবাদগুলোতে বিস্ময়কর সাদৃশ্য আলোচনা করেছি, যারা “স্পিরিচুয়াল ও রাজনৈতক উভয় ক্ষেত্রেই একটি সেকুলার পুরোহিতশ্রেণী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, যাদের মানুষ এবং পৃথিবীর সকল বস্তুর প্রকৃতি সম্পর্কে অনন্য বৈজ্ঞানিক জ্ঞান রয়েছে” (ইসাইয়া বার্লিন, “দ্য বেন্ট টুইগ”)। বাকুনিনের কাছে এই টেকনোক্র‍্যাট বুদ্ধিজীবীরা ছিল একটা নতুন শ্রেণি“, যারা এমন একটি “বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যা সমস্ত শাসনব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে অ্যারিস্টোক্রেটিক, স্বৈরাচারী, উদ্ধত এবং এলিটিস্ট”। তাদের কাছে “ট্যাবুলা রাসা” মতবাদ যে আবেদন তৈরী করবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

মাইন্ড কন্ট্রোল;
শিল্পী: ব্রায়ান টেয়লর;
সূত্র: ফাইন আর্ট আমেরিকা

সৃজনশীলতা কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম এবং রীতির একটি সিস্টেমের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, যা আংশিকভাবে মানুষের জৈবিক তথা সহজাত (inherent) সক্ষমতা দ্বারা নির্ধারিত হয়। সিস্টেমের এমন সীমাবদ্ধতা তথা constraint ছাড়া শুধুমাত্র র‍্যান্ডম ও এলোমেলো কার্যক্রমই সম্ভব, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড নয়। কমন সেন্স এবং বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান উভয় বৈশিষ্ট্যই মানব মনের কাঠামোর সাথে যুক্ত নীতিগুলো থেকে উদ্ভূত হয়। সুতরাং, কেবল প্রতিবন্ধকতার অভাবকেই মানব স্বাধীনতা ভাবা একটি ভুল হবে। বাকুনিন একবার বলেছিলেন যে “মানব প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যই (laws of our nature)… আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি গঠন করে” এবং এই মানব প্রকৃতিই “আমাদের স্বাধীনতার প্রকৃত শর্ত এবং কার্যকর কারণ”। একটি মুক্তিকামী সামাজিক তত্ত্ব মানব প্রকৃতি কি, তা নির্ধারণ করার চেষ্টা করবে এবং এর উপর ভিত্তি করে সামাজিক পরিবর্তনের ধারণা এবং এর তাৎক্ষণিক এবং দূরবর্তী লক্ষ্য তৈরি করবে। যদি সত্যিই মানব প্রকৃতি বাকুনিনের “বিদ্রোহের প্রবৃত্তি” বা মার্কসের স্পিসিজ ক্যারেক্টার” (species character— যার উপর ভিত্তি করে মার্ক্স তারা বিচ্ছিন্ন শ্রম বা Alienated Labour এর ধারণা তৈরি করেছে) ধারণ করে, তবে অবশ্যই এমন কর্তৃত্ববাদী সামাজিক ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম চলতে থাকবে যা “আমাদের নিজস্ব প্রকৃতি” র বাইরে গিয়ে মানবাচরণের উপর অতিরিক্ত সীমাবদ্ধতা তথা বিধিনিষেধ আরোপ করে। প্রকৃত বিপ্লবী চিন্তক এবং অ্যাক্টিভিস্টরা দীর্ঘদিন ধরে এধরণের কর্তৃত্ববাদী ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে কাজ করে আসছেন।

মনের অন্তর্নিহিত জৈবিক কাঠামো যেমন কগ্নিটিভ ডেভেলপমেন্ট এর ভিত্তি তৈরী করে, একইভাবে স্পিসিজ ক্যারেক্টারবা প্রজাতির চরিত্রনৈতিক চেতনা, সংস্কৃতির নির্মাণ ও বিকাশ, এবং এমনকি একটি মুক্ত ও ন্যায্য সমাজে অংশগ্রহণের ফ্রেমওয়ার্ক প্রদান করে—এটা অনুমান করা যৌক্তিক। অবশ্যই, কগ্নিটিভ বিকাশের ভিত্তি সম্পর্কিত পর্যবেক্ষণ থেকে মানব প্রকৃতির রূপ এবং সেগুলির পূর্ণতার শর্তসমূহ সম্পর্কিত নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো পর্যন্ত একটি বিশাল বুদ্ধিবৃত্তিক লাফ (ইন্টেলেকচুয়াল লিপ); অর্থ্যাৎ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যে, মানবিক চাহিদা ও সক্ষমতাগুলো তাদের পূর্ণ প্রকাশ পাবে এমন একটি সমাজে, যেখানে স্বাধীন ও সৃজনশীল উৎপাদকরা ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন ব্যবস্থায় কাজ করবে, যেখানে সামাজিক বন্ধনমানব সমাজের সকল শৃঙ্খলকে প্রতিস্থাপন করবে” [উইলহেম ভন হাম্বোল্ট]। এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে, এমন দাবী উত্থাপনে সক্ষম একটি শক্তিশালী ইন্টেলেকচুয়াল ট্রেডিশন রয়েছে। যদিও এই ট্রেডিশন প্রগতি এবং আলোকায়নের প্রতি অভিজ্ঞতাবাদী প্রতিশ্রুতি থেকে উদ্ভূত, আমি মনে করি এর গভীরতর শিকড় মানব স্বাধীনতার একটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার যুক্তিবাদী প্রচেষ্টার মধ্যে। এই বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যে বিকশিত ধারণাগুলিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অনুসন্ধান করা, শক্তিশালী করা এবং সম্ভব হলে প্রমাণিত করা মুক্তিপরায়ণ সামাজিক তত্ত্বের জন্য একটি মৌলিক কাজ। ভবিষ্যতে আরও অনুসন্ধান সমস্যাগুলি সমাধান করার উপায় বের করবে না হাজির হবে এমন সব রহস্য নিয়ে যা আমাদেরকে বিভ্রান্ত করবে, তা শুধু সময়ই বলে দিবে।

যদি এই প্রচেষ্টা সফল হয়, তাহলে তা বার্ট্রান্ড রাসেলের এই নিরাশাবাদী ধারণাকে খণ্ডন করবে যে, মানুষের “আবেগ ও প্রবৃত্তি” তাকে যুক্তি দ্বারা সৃষ্ট “বৈজ্ঞানিক সভ্যতা”র সুযোগসুবিধা উপভোগ করতে অক্ষম করে তোলে (রাসেলের ইকারাস, অথবা ভবিষ্যতের বিজ্ঞান“)। এটা সম্ভব যদি আমরা “আবেগ ও প্রবৃত্তি”র মাঝে সেই “প্রবৃত্তিগুলো”কে অন্তর্ভুক্ত করে নেই (যেমন রাসেল কখনও কখনও করেছিলেন) যা সৃজনশীল বুদ্ধির সাফল্যের ভিত্তি তৈরী করে, এবং সেই সাথে অন্তর্ভুক্ত করে নেই আরোপিত কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে “বিদ্রোহের প্রবৃত্তি”—যা কিছুটা হলেও, একটি সাধারণ মানবীয় বৈশিষ্ট্য। মানব প্রকৃতি ব্যাখ্যায় এই বৈশিষ্ট্যগুলোর অন্তর্ভুক্তি একারণেই জরুরী যে, এই আবেগ এবং প্রবৃত্তিগুলো মার্কস যাকে “মানব সমাজের প্রাকইতিহাস” বলেছেন, তার সমাপ্তি টানতে সক্ষম। প্রতিযোগিতামূলক এবং কর্তৃত্ববাদী সামাজিক কাঠামো দ্বারা আর দমিত এবং শোষিত না হয়ে এই আবেগ এবং প্রবৃত্তিগুলো হয়তো এমন এক নতুন বৈজ্ঞানিক সভ্যতার মঞ্চ প্রস্তুত করবে, যেখানে “প্রাণীর স্বভাব” তথা অ্যানিমল ন্যাচার অতিক্রমিত হবে এবং মানব প্রকৃতি সত্যিকারের বিকাশ লাভ অর্জন করবে।

আবদুল্লাহ হেল বুবুন

আবদুল্লাহ হেল বুবুন পড়াশুনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে। আগ্রহের বিষয় মার্ক্সবাদ, সোশ্যাল থিওরি, বিজ্ঞানের দর্শন, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ইতিহাস।