অনুবাদ: অনিক সন্ধি
[কিউবার ঘটনাপ্রবহ কিছুদিন ধরেই সারাদুনিয়ায় আলোচিত৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে আ্যনার্কিস্টরা একই সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আরোপ করা অর্থনৈতিক অবরোধ, কিউবায় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের যাবতীয় কৌশলের বিরোধিতা করছে এবং কিউবার কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন প্রণালীর বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছে৷ কিউবান শ্রমজীবী জনগণ নিজেরাই তাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হোক, বিভিন্ন আ্যনার্কিস্ট গ্রুপের বক্তব্য ও কর্মসূচিতে এই অবস্থান ই সাধারণভাবে লক্ষণীয়।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ‘ব্ল্যাক রোজ মায়ামি’র আ্যানার্কিস্টদের একটি বিবৃতির অনুবাদ আমরা বাংলায় প্রকাশ করছি।
মায়ামির আ্যানার্কিস্টরা জানাচ্ছে, খোদ মায়ামিতেই যুক্তরাষ্ট্রের কিউবা অভিযানের পক্ষে ডানপন্থী ডায়াসপোরা কমিউনিটি অবস্থান নিয়েছে। এর বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার আহ্বান জানিয়েছে তারা। এছাড়াও কিউবার বর্তমান সংকটের প্রেক্ষাপট ও বিভিন্ন পক্ষের ভূমিকা নিয়ে পর্যালোচনা করেছে তারা। – সম্পাদক]
মূল বক্তব্য
গত ১০ই জুলাই রাতে সান্তিয়াগো দে কিউবার পালমা সোরাইনো শহরে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের খবর দিয়ে কিউবার বর্তমান অবস্থার শুরু ঘটে। দীর্ঘদিনের খাদ্য ঘাটতি, ব্ল্যাকআউট ও জনস্বাস্থ্য সংকটের মধ্যে দিয়েই লোকজন পাত্র–কড়াই হাতে নিয়ে রাস্তায় পদযাত্রা শুরু করে।
বছরের শুরুতে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকা অবস্থার মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপাতির অভাবে সাহায্যহীন মানুষ ঘরে ও হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করার মতো খবর ইন্টারনেটে ছড়াতে থাকে। কিউবার জনগণ একে অপরকে ও সারা বিশ্বের মানুষকে জানাতে শুরু করে তাদের ওষুধপত্রের অভাবের কথা, দিনের পর দিন নূন্যতম পরিমাণের এবং অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারিত পণ্যের জন্য দাঁড়িয়ে থাকার কথা; রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও কোভিড সংকট মোকাবিলার অক্ষমতার কথা। ১১ই জুলাইয়ের প্রথম প্রহরে বিদ্রোহের দাবানল সম্পূর্ণ দ্বীপজুড়ে ছড়িয়ে যায়। এটি নিঃসন্দেহে দ্বীপটির কয়েক দশকের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আন্দোলনগুলোর মধ্যে একটি।
কিউবান জনতা আজকে যে সংকটের মুখে পড়েছে তা শুধুমাত্র জাতি–রাষ্ট্রের আধিপত্যই নয়। সাথে আছে সাম্রাজ্যবাদী ও প্রতিদ্বন্দ্বী বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সংকটও। সম্প্রতি মার্কিন অবরোধ, রেমিটেন্সের উপর আরোপিত সীমাবদ্ধতা ও “মানবীয় হস্তক্ষেপ” এই ব্যাপারটাকে আরও পরিষ্কার করে। জনতার উপর অত্যাচার সব রাষ্ট্ররই লিগ্যাসি, কিউবা আর বিশেষ কী?
আমরা নৈরাজ্যবাদী হিসেবে চাই সব গণবিদ্রোহই শ্রেণিশোষণ ও রাষ্ট্রীয় আধিপত্য থেকে শেষ মুক্তির বিপ্লবী সংগ্রামে পরিণত হোক। যাইহোক, কিউবার রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের কর্তৃত্ববাদী শিকড় এবং মার্কিন সরকার কর্তৃক প্রায় সমস্ত রকমের বিরোধিতার পদ্ধতিগত আত্মসাৎ এর দরুণ শ্রেণিভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন কিউবায় বাস্তবিক অর্থে নেই বললেই চলে। এটি স্বায়ত্বশাসিত আন্দোলন তৈরিকরণের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর বর্তমানের সামাজিক ও মানবিক সংকটের বিকাশের ভবিষ্যদ্বাণী করার পরিপক্ক সময় এখনো আসেনি। তবুও যদি এমন হয় যে গণআন্দোলনটি একটি সাধারণ বিদ্রোহে পরিণত হতে থাকে তাহলে কিউবান রাষ্ট্র ও কমিউনিস্ট পার্টি তার শেষ ধাপে যেতে বসেছে। আমরা বিশ্বাস করি যে জনগণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে ও তারা তাদের স্বায়ত্বশাসন রক্ষা করতে সক্ষম। কিন্তু কিউবান রাষ্ট্রীয় দমন–নিপীড়ন এবং ডানপন্থীদের দ্বারা আন্দোলন হাতিয়ে নেয়ার কথা চিন্তা করেও আমরা শঙ্কিত; এর উভয়ই শুরু হয়েও গিয়েছে।
যেমন, ১৩ই জুলাইতে মায়ামির প্রধান এক মহাসড়ক কয়েক ঘণ্টা অবরোধের মাধ্যমে কিউবান–মার্কিন ডায়াস্পোরা মার্কিন সেনাবাহিনীর কিউবায় সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য দাবি করছিল। এসব আমাদের প্রশ্ন করায় যে রেজিম পরিবর্তনের দ্বারা কিউবার জনতার কী লাভ হবে। কোনো স্ব–সংগঠিত জনসংগঠনই যেখানে কিউবায় নেই সেখানে অনুমান করা যায় যে জনগণের এই সংগ্রাম পুঁজিবাদী ও ডান–পক্ষের স্বার্থের জন্য ব্যবহৃত হবে।
কিন্তু রেজিমটি পরাজিত হলে যা আশা করা যায়:
১। কিউবান জনশ্রেণি নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক শক্তিতে সক্ষম এক সামাজিক এক্টর হিসেবে আত্মস্বীকৃতি দিবে— যা ৬০ বছর ধরে কয়েক প্রজন্ম প্রত্যাশা করেনি।
২। তবে সম্ভবত বর্তমান রেজিমের বদলে এক নিও–লিবারাল ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক প্রশাসন পাব যারা শুধুমাত্র গণতন্ত্রের ছদ্মবেশ ধরবে। উল্টোভাবে এরকম পরিস্থিতে শোষিতশ্রেণি হয়তো সংগঠিত হবার জায়গা পাবে। এর মাধ্যমে তারা বহুল প্রয়োজনীয় শ্রেণিচেতনা, সত্যিকারের বিপ্লবী প্রবণতা ও চর্চার বিকাশ সুযোগ পেতে পারে। তবে আমরা এ সম্পর্কেও সচেতন যে তখন এমন এক অবস্থা বিরাজ করবে যে কিউবান বিপ্লবের দ্বারা আনিত নানা ভালো সামাজিক পরিবর্তন ধ্বংস করে বা ক্ষয়ে দেয়া হবে। এই অত্যাচারী রেজিমের বিরুদ্ধে যে বীর জনশ্রেণি লড়ছে তাদেরকেই সে ব্যবস্থার সবচেয়ে খারাপ অংশের ভার বইতে হবে।
এসব কিছু চিন্তা মাথায় নিয়েই বলতে হবে যে সামনের পথ খুবই কণ্টকময়। আমাদের ভালোবাসা ও সংহতি রইল কিউবান জনতার জন্য। আমরা আন্দোলনকালীন সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবি করছি। সকল খুন ও শারীরিক নিপীড়নের ঘটনার স্বচ্ছতা দাবি করছি। ইন্টারনেট সেবা ফিরিয়ে দেবার দাবি করছি এবং গণহত্যা সামিল অবরোধ উঠিয়ে নেবার দাবি করছি। আমাদের আশা তোমাদের উপর রইল। জনগণের সামাজিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক মুক্তির জন্য প্রত্যেক প্রচেষ্টা, প্রত্যেক বিদ্রোহ, প্রত্যেক বিপ্লব, প্রত্যেক আন্দোলনকে আমরা স্যালুট জানাই।
আরিব্বা লেস কে লুচান!
(সংগ্রামকারী জিন্দাবাদ!)