অরাজ
আর্টওয়ার্ক: স্প্যানিশ রেভুলিউশন সূত্র: ইউজিটি অ্যান্ড সিএনটি
প্রচ্ছদ » নোম চমস্কি।। অরাজপন্থা, মার্কসবাদ ও ভবিষ্যতের আশাবাদ প্রসঙ্গে

নোম চমস্কি।। অরাজপন্থা, মার্কসবাদ ও ভবিষ্যতের আশাবাদ প্রসঙ্গে

  • অনুবাদ: মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার

প্রবহমান সাক্ষাতকারটি রেড অ্যান্ড ব্ল্যাক রেভলিউশন পত্রিকার ১৯৯৫ সালের দ্বিতীয় সংখ্যায় ছাপা হয়। নোম চমস্কি অরাজপন্থা ও মার্কসবাদ নিয়ে তাঁর মতামত তুলে ধরেন এবং বর্তমান  পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেন। কেভিন ডয়েল সাক্ষাৎকার টি ১৯৯৫ সালের মে মাসে গ্রহণ করেছিলেন। মূল প্রবন্ধটি ইংরেজি ভাষায় এখানে পাওয়া যাবে।-সম্পাদক

নোম চমস্কি

অনুবাদকের ভূমিকা: ইংরেজি Anarchist এবং Anarchism শব্দ দুটির প্রথাগত বাংলা অর্থ সকল অর্থেই নেতিবাচক। এমন কি ইংরেজি ভাষাভাষী অঞ্চলেও এই শব্দ দুটির বোঝাপড়া এতোটাই বিপরীত যে কখনও কখনও পুরপুরি উল্টো অর্থটাই চাপিয়ে দেয়া হয় এই শব্দগুলোর উপরে। নোম চমস্কি এই আলোচনার গোড়াতেও অর্থগত বোঝাপড়ার এই সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলায় আমরা Anarchist শব্দটার অর্থ করেছি ‘নৈরাজ্যবাদী’ এবং Anarchism  শব্দটির অর্থ করেছি ‘নৈরাজ্যবাদ’। হয়তো শব্দগত অর্থে এই বোঝাপড়া গুলো ভুল নয়, কিন্তু বোধের জায়গাটিতে এই শব্দগুলোর উপরে এক ধরনের নেতিবাচক বোধ চাপিয়ে  দেয়া হয়েছে, অনেকটা শব্দকে ক্রিমিনালাইজ বা অপরাধী সাব্যস্ত করার মতো। এটা দুঃখজনক। মূলত এই প্রতিষ্ঠিত বোধের জায়গাটিকে এক রকমের চ্যালেঞ্জ করার জন্যেই এই শব্দদুটির প্রথাগত বাংলা অনুবাদ আমি ব্যবহার করিনি এই অনুবাদ কর্মে। বরং আমি এই অনুবাদে Anarchism শব্দটির বাংলা অনুবাদ করেছি ‘অরাজপন্থা’ এবং Anarchist  শব্দটির বাংলা করেছি ‘অরাজপন্থি’। এই শব্দগুলো আমার সৃষ্টি নয়, বাংলা ভাষায় বেশ কিছু লেখালেখিতে আমি এই শব্দগুলো  পেয়েছি। হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘অরাজবাদ’ নাকি ‘অরাজপন্থা’? একই ভাবে ‘অরাজবাদী’ নাকি ‘অরাজপন্থী? আমি উভয় ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় পছন্দটিকেই যথাযথ মনে করেছি। এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, তবে সেটা অনুবাদের আওতার বাইরে। যদি ভবিষ্যতে দরকার হয়, এ নিয়ে পৃথক ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে, তবে আপাতত এই অনুবাদকর্মটি পাঠ করার সময় Anarchism কে  ‘অরাজপন্থা’ এবং Anarchist শব্দটিকে  ‘অরাজপন্থী’ হিসাবে পাঠ করার অনুরোধ রইলো।

সাক্ষাৎকার

প্রশ্ন: নোম, প্রথমত আপনি বেশ অনেকদিন ধরে অরাজপন্থি চিন্তার একজন সমর্থক। দানিয়েল গেঁর‌্যার ১৯৭০ সালে রচিত বইটিতে  আপনার লেখা ভূমিকাটির সাথে অনেক পাঠকই পরিচিত, কিন্তু খুব সাম্প্রতিক কালে, ডকুমেন্টারি ছবি ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট-এ আপনি আবারো অরাজপন্থি চিন্তার সম্ভাবনার কথা ব্যাখ্যা করেছেন। ঠিক কি কারণে অরাজপন্থি চিন্তা আপনাকে আকর্ষিত করলো?

চমস্কি: আসলে অরাজপন্থি চিন্তার প্রতি আমার আগ্রহ সেই কিশোর বয়স থেকেই। আমি যখন থেকে খুব সংকীর্ণ একটা গণ্ডির বাইরে পৃথিবীকে নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করলাম ঠিক তখন থেকেই। আর আজও সেই আগ্রহের খুব বেশি পরিবর্তন বা সংশোধনের দরকার পড়েনি।

আমি মনে করি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কর্তৃত্ব, হায়ারার্কি বা পুরোহিততন্ত্র  এবং আধিপত্যের কাঠামো সন্ধান করা, চিহ্নিত করা এবং তাকে প্রশ্ন করাটাই একমাত্র অর্থবহ কিছু হতে পারে। যতক্ষণ না এই সবের ন্যায্যতা  প্রতিপাদন করার মতো কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে, ততক্ষণ এর সবই অবৈধ এবং এদেরকে ভেঙ্গে ফেলতে হবে। মানুষের স্বাধীনতার দিগন্তকে প্রসারিত করার জন্যেই এসবকে চূর্ণ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক শক্তি, মালিকানা ও পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা কাঠামো এবং  নারী ও পুরুষ, পিতা-মাতা ও শিশুদের মধ্যে সম্পর্ক, ভবিষ্যত প্রজন্মের ভাগ্যের উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ (আমার মতে এটাই পরিবেশবাদী আন্দোলনের পেছনে প্রাথমিক নীতিগত উদ্দেশ্য) এবং আরও অনেক কিছু। স্বাভাবিক ভাবেই এটা জবরদস্তি ও নিয়ন্ত্রবাদী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ : রাষ্ট্র, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণকারী জবাবদিহিহীন ক্ষমতাধর মালিক এবং এই রকমের আরও অনেকের কাছেই। কিন্তু শুধু এসবই নয়। অরাজপন্থার মর্মশাঁস বলতে আমি সবসময়ই বুঝেছি যে, নিজেদের ন্যায্যতা প্রমাণের দায়টা সবসময়ই কর্তৃপক্ষ বা কর্তৃত্ববাদী সংগঠনের উপরেই বর্তায়, যদি এরা তাদের কর্তৃত্বের ন্যায্যতা প্রমাণ  করতে না পারে, তাহলে তা ভেঙ্গে ফেলাই উচিৎ। কখনও কখনও এই ন্যায্যতা প্রমাণ করা যেতে পারে। ধরুন, আমি আমার নাতি-নাতনিদের কাউকে নিয়ে বাইরে হাঁটতে বেরিয়েছি, হঠাৎ করে যদি তাদের কেউ ব্যস্ত সড়কে দৌড়ে চলে যেতে চায় তাহলে আমি শুধু আমার কর্তৃত্বই ব্যবহার করবো না, হয়তো শারীরিক শক্তিও ব্যবহার করবো ওদেরকে থামানোর জন্য। আমার এই সিদ্ধান্তকে, কাজকে হয়তো চ্যালেঞ্জ করা যাবে কিন্তু সাথে সাথেই এর যথার্থতা হাজির করা যাবে। এবং আরও অন্যান্য বিষয়-আশয় আছে,জীবনটা তো একটা জটিল ব্যাপার, মানুষ এবং সমাজ সম্পর্কে তো আসলে খুব কমই বুঝতে পারি আমরা, বিশেষত অভিজাত বয়ানগুলো প্রাপ্তির খাতায় যত না যুক্ত করে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করে। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং আমার মনে হয় সেটাই আমাদেরকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে।

এই সব সাধারণ বিষয়ের বাইরে আমরা বিশেষ ঘটনাগুলো দেখতে শুরু করি যেখানে মানুষের আগ্রহ ও উদ্বেগের প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হয়।

প্রশ্ন: এটা তো সত্য যে, আপনার চিন্তা ও বিভিন্ন পর্যালোচনাগুলো এখন আগের যেকোনো সময়ের  চেয়ে অনেক বেশি পরিচিত। আর এটাও বলা উচিৎ যে, আপনার মতামতগুলো ব্যাপক ভাবে সম্মানিতও হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে  অরাজপন্থা নিয়ে আপনার সমর্থন কিভাবে গৃহীত হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? বিশেষত আমি জানতে আগ্রহী সেইসব মানুষের প্রতিক্রিয়া যারা হয়তো প্রথম বারের মতো রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠছে এবং হয়তো কোনো ভাবে আপনার মতামতের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ ঘটেছে। এই ধরনের মানুষেরা কি অরাজপন্থার প্রতি আপনার সমর্থনে বিস্মিত হয়? তাঁরা কি আগ্রহী হয়ে ওঠে?

চমস্কি: আপনি তো জানেন, সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতিতে ‘অ্যানার্কিজম’ বা অরাজপন্থাকে যুক্ত করা হয় বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা, বোমাবাজি, কোনো কিছুতে ব্যাঘাত ঘটানো এবং আরও এই ধরনের বিষয়ের সাথে। ফলে মানুষ  প্রায়শই অবাক হয়ে যায় যখন আমি অরাজপন্থা নিয়ে সদর্থক কিছু বলি কিম্বা আমি নিজেকে যখন অরাজপন্থার মূলধারার সাথে যুক্ত বলে পরিচিত করি। কিন্তু আমার ধারণা, বোঝাপড়ার দিক থেকে কিছু অপরিচ্ছন্নতার মেঘ সরিয়ে দিলে সাধারণ জনগণের মাঝে এর মূল চিন্তাগুলো খুবই যৌক্তিক ভাবেই ধরা দেয়। অবশ্যই খুব সুনির্দিষ্ট বিষয়ের আলোচনার বেলায়, যেমন ধরুন, পরিবারের ধরন কিংবা একটা সমাজে গোটা অর্থনীতি কিভাবে আরও মুক্ত ও ন্যায্য ভাবে চলতে পারে, এ ধরনের প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে তখন মতভেদ বা বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু সেটাই তো হওয়া উচিৎ। পদার্থবিজ্ঞান আসলেই ব্যাখ্যা করতে পারে না, আপনার পানির কল থেকে কিভাবে পানি গড়িয়ে সিঙ্কে গিয়ে পড়ে। আমরা যখন খুব জটিল ও অতীব জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর দিকে আগ্রহী হই তখন বোঝাপড়াগুলোও খুব সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে এবং সেখানে নিরীক্ষা ও দ্বিমতের অনেক জায়গা তৈরি হয়। বৌদ্ধিক ও বাস্তব জীবনে আরও বেশি সম্ভাবনার অনুসন্ধান আমাদের আরও বেশি জানতে সাহায্য করে।

প্রশ্ন: সম্ভবত অন্যান্য আরও অনেক চিন্তার চেয়ে অরাজপন্থাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ভুল বা অযথার্থ উপস্থাপনার। বহু মানুষের কাছে অরাজপন্থার অর্থ নানান রকমের হতে পারে। আপনার কি কখনও সুযোগ হয়েছে আপনি অরাজপন্থা বলতে কি বোঝেন সেটা ব্যাখ্যা করার? অরাজপন্থার এই অযথার্থ উপস্থাপনা কি আপনাকে বিরক্ত করে?

চমস্কি: অযথার্থ বা ভুল উপস্থাপনা আসলে এক ধরনের উপদ্রব। এর কারণগুলোর বেশিরভাগই খুঁজে পাওয়া যাবে ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যেই, খুব নিশ্চিত ভাবেই, জনগণের বোঝাপড়া গড়ে উঠতে বাধা দেয়ার মাঝে এদের একটা বিশেষ আগ্রহ আছে। এ প্রসঙ্গে ডেভিড হিউমের সরকারের মূলনীতি বইটির কথা স্মরণ করা যাক। জনগণ তাদের শাসকের কাছে কখনো নতি স্বীকার করে নিয়েছে, এ ব্যাপারটি নিয়ে হিউম বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তার শেষকথা ছিল, যখন “সবসময় শাসিতের হাতেই ন্যাস্ত থাকে ক্ষমতা, তখন নিজের সমর্থনে শাসকের হাতে অভিমত ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকে না। যে কারণে শুধুমাত্র অভিমতের উপর ভিত্তি করেই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রবাদ সর্বাধিক স্বৈরতান্ত্রিক ও সামরিক সরকারের ক্ষেত্রে যেমন খাটে, তেমনি সর্বাধিক মুক্ত ও জনপ্রিয় সরকারের ক্ষেত্রেও খাটে।’’ [Hume: 1994:16]  হিউম খুবই বিচক্ষণ লোক ছিলেন, ঘটনাচক্রে আজকালকার মানদণ্ডে তাকে ঠিক মুক্তিপরায়ণও বলা চলে না। কোনো সন্দেহ নেই যে হিউম শক্তিমত্তার কার্যকারিতাকে অবমূল্যায়ন করেছেন, কিন্তু তার পর্যবেক্ষণ আসলে আমার কাছে ঠিকই মনে হয়েছে, মনে হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে অধিকতর স্বাধীন সমাজগুলোতে, যেখানে অভিমত নিয়ন্ত্রণের কৌশল আরও বেশি পরিশীলিত। বিকৃত উপস্থাপনা ও বিভ্রান্তির অপরাপর রূপগুলো স্বাভাবিকভাবেই একে অপরের সহচর হয়ে থাকে।

ডেভিড হিউম

তো, এই ভুল উপস্থাপনা আমাকে বিরক্ত করে কিনা? নিশ্চয়ই করে, ঠিক যেমনটা বাজে আবহাওয়াও আমাকে বিরক্ত করে। এটা টিকে থাকে ততক্ষণ যতক্ষণ ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ একে জায়েজ করার জন্য একটি আজ্ঞাবহ রাজনৈতিক অধিকারী গোষ্ঠী তৈরি করতে পারে। যেহেতু এরা খুব একটা মেধাবী হয় না অথবা ঠিক ততটাই মেধাবী হয় যে এরা জানে, যুক্তি ও তথ্যের ধারে কাছে দিয়ে যাওয়া যাবে না। ফলে এদের ভরসা হলো ভুল উপস্থাপনা, গালাগালি  আর এমন কতক হাতিয়ার যা তাদের হাতে আছে এবং দিন শেষে শক্তিমানদের নানা বর্মে এরা সুরক্ষিত। আমাদের বোঝা দরকার কেনো এমন হয় এবং আমাদের উচিত যতটা সম্ভব তার মুখোশ উন্মোচন করে ফেলা। এটাই আমাদের এবং অন্যান্যদের মুক্তির প্রকল্পের অংশ অথবা আরও সঙ্গত ভাবে বলা যায় যে, মানুষ ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করছে এই মুক্তি অর্জনের জন্যেই।

খুব সহজ সরল মনে হচ্ছে,তাই না? এটা আসলেই তাই-ই। তবে মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে আমার এখনও অনেককিছু জানার বাকি আছে যা খুব সহজ সরল নয়, বিশেষত যখন এর থেকে বিমূর্ততা আর ব্যক্তিগত স্বার্থপরতার জায়গাগুলোকে সরিয়ে নেয়া হয়।

প্রশ্ন: ধরুন, প্রতিষ্ঠিত বামপন্থী মহলের অবস্থান কেমন, অন্তত অরাজপন্থা বলতে এই অংশের মানুষের বোঝাপড়াটা যখন অনেকটাই নৈকট্যপূর্ণ? আপনি কি অরাজপন্থার বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি ও সমর্থন নিয়ে খুব অবাক হওয়ার মত কিছু পেয়েছেন এই মহলের কাছে?

চমস্কি: আমি যদি সঠিক ভাবে বুঝে থাকি আপনি আসলে ‘প্রতিষ্ঠিত বামপন্থী মহল’ বলতে কি বোঝাচ্ছেন, তাহলে বলবো, না এই মহলে অরাজপন্থা প্রসঙ্গে আমার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে খুব একটা বিস্ময় নেই।  কারণ আসলে যেকোনো বিষয়েই আমার দৃষ্টিভঙ্গি খুব কমই তারা জনেন। আমি এই মহলটির সাথে খুব বেশি ওঠাবসা করি না। আমার লেখায় বা বক্তৃতায় খুব কদাচিৎ এদের সম্পর্কে কোনো  রেফারেন্স পাবেন। অবশ্য এটা একেবারে একশোভাগ সত্যি তা নয়। ফলে আমেরিকায় (ইংল্যান্ডে বা অন্যান্য জায়গাগুলোতে এর চেয়ে অনেক কম) আপনি যাদেরকে বলছেন ‘প্রগতিশীল মহল’ তাদের কোনো কোনো অংশে বিশেষ করে এদের স্বাধীন ও পর্যালোচনামূলক চিন্তাশীল অংশে হয়তো আমার কিছু কিছু কাজ সম্পর্কে খানিকটা বোঝাপড়া আপনি পেতে পারেন। আর আমার কিছু ব্যক্তিগত বন্ধু আছেন এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তারাও খানিকটা জানেন। কিন্তু আপনি বিভিন্ন বইপত্র ও সাময়িকীগুলোর দিকে দেখুন, মানে আমি বলতে চাচ্ছি, আমি যা বলি বা লিখি সেসবকে প্রথাগত বিদ্যায়তনিক অনুষদগুলো বা সম্পাদকীয় দপ্তরগুলোর চেয়ে এরা বেশি স্বাগত জানাবেন,এটা আমি আশা করি না। অবশ্য কিছু ব্যতিক্রম তো নিশ্চয়ই আছে।

আসলে প্রশ্নটা খুব কদাচিৎ উত্থাপিত হয়,তাই এর কোনো সহজ উত্তর নেই।

প্রশ্ন: অনেকেই খেয়াল করেছেন যে আপনি ঠিক যে অর্থে অরাজপন্থা শব্দটি ব্যবহার করেন একই অর্থে আপনি আরেকটি শব্দবন্ধ মুক্তিমুখিন সমাজতন্ত্রী ব্যবহার করেন। আপনি কি মনে করেন এই দুটি শব্দ আসলে আবশ্যিক ভাবে একই রকমের? আপনার কাছে কি অরাজপন্থা এক ধরনের সমাজতন্ত্র? এর আগে যে বর্ণনা টুকু ব্যবহার করা হয়েছে সেটা এরকমের যে অরাজপন্থা হচ্ছে সমাজতন্ত্র ও স্বাধীনতাআপনি এই ধরনের সমীকরণের সাথে একমত?

চমস্কি:  গেঁর‌্যার বইয়ের ভূমিকাটি,যার কথা আপনি বলছেন এখানে,সেটা শুরু হয়েছিলো  প্রায় শতাব্দী আগের একজন অরাজপন্থার প্রতি সংবেদনশীল মানুষের একটা উদ্ধৃতি দিয়ে। তিনি বলেছেন,‘অরাজপন্থার বিস্তৃত পাঠ রয়েছে’ এবং এটা ‘বহু কিছুকেই অন্তর্ভুক্ত করে’[Mirbeau : 1894]। এরই একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক,  প্রথাগত ভাবে যাকে বলা হচ্ছে ‘মুক্তিমুখিন সমাজতন্ত্র’। আমি ওই ভূমিকাতে এবং আরও বেশ কিছু জায়গায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি এই শব্দবন্ধটি দিয়ে আমি আসলে কি বোঝাতে চাই। একই সাথে উল্লেখ করেছি যে, এটা আসলে মৌলিক ভাবেই আমার ধারণা,এমনটা নয়। আমি আসলে অরাজপন্থি আন্দোলনের প্রধান মানুষদের ধারণাগুলোকেই নিয়েছি,তাদেরকে উদ্ধৃত করে।  এবং তারা আসলে প্রতিনিয়তই নিজেদেরকে সমাজতন্ত্রী বলেই পরিচয় দিয়েছেন  এবং একই সাথে খুব তীব্র ভাবেই সমালোচনা করেছেন ‘নতুন শ্রেণীর’ রেডিকেল  বুদ্ধিজীবীদের যারা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে চায় গাজোয়ারি রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত পর্যবসিত হয় এক ধরনের ‘লাল আমলাতন্ত্রে’ যাদের ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন বাকুনিন।  একেও আবার ‘সমাজতন্ত্র’ বলেই দাবি করা হয়। আমি বরং রুডলফ রকারের অভিমতের সাথে একমত পোষণ করি, এই প্রবণতাগুলো (খুব কেন্দ্রীয় প্রবণতা) নেয়া হয়েছে এনলাইটেনমেন্ট বা জ্যোতির্ময়কাল আর উদারনৈতিক চিন্তার সবচাইতে সেরা ধারণাগুলো থেকে।  বাস্তবত, আমি যেমনটা দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম যে, এই ধারনাগুলো আসলে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতবাদ ও  অনুশীলনের সাথে খুব তীক্ষ্ণ ভাবে বিরোধিতামূলক।  যে সকল ‘মুক্তিমুখিন’ মতবাদ খুব বাজার চলতি, ফ্যাশনদুরস্ত, বিশেষত  যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে এবং অন্যান্য সমকালীন মতবাদগুলোর প্রায় সবকটিই আমার কাছে মনে হয় এক ধরনের সীমাবদ্ধকরণ, একই বা ভিন্নরকমের অবৈধ কর্তৃত্ববাদকে, কখনও কখনও একেবারে বাস্তব স্বৈরতন্ত্রকে সমর্থন করে।

স্পেনীয় বিপ্লব

প্রশ্ন: অতীতে আপনি যখনই অরাজপন্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন, প্রায়শই আপনি উদাহরণ হিসাবে খুব গুরুত্ব দিয়ে স্পেনের বিপ্লবের কথা উল্লেখ করেছেন। আপনার মতে এই উদাহরণটির দুইটি দিক রয়েছে, যেমন একদিকে স্পেনের বিপ্লবকে আপনি অরাজপন্থী সক্রিয়তার বাস্তব উদাহরণ বলে মনে করেন। অন্যদিকে আপনি এটাও খুব গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেন যে, শ্রমিক  শ্রেণী তাদের নিজেদের প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্যে দিয়ে কতটা অর্জন করতে পারে, স্পেনের বিপ্লব তার খুব ভালো একটা উদাহরণ। এই দুইটি দিক অর্থাৎ অরাজপন্থার বাস্তব প্রয়োগ আর অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র, এই দুটি ধারণা কি আপনার কাছে সমার্থক? অরাজপন্থা কি তাহলে গণক্ষমতার দর্শন?

চমস্কি: আসলে আমার কাছে যেটা খুব সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের ব্যাপার তাকে ব্যাখ্যা করার জন্যে আমি খামোখাই ‘দর্শন’ এর মতো একটা শৌখিন শব্দ ব্যবহার করতে চাই না। আর  বলে রাখা ভালো যে আমি শ্লোগানের বিষয়ে খুব স্বস্তি বোধ করি না। স্পেনের বিপ্লব ব্যর্থ হবার আগে সেখানকার শ্রমিক ও কৃষকদের অর্জনগুলো ছিলো অনেক অর্থেই বিরাট ও মহান অর্জন। ‘অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র’ এই ধারণাটি গড়ে উঠেছে খুব সাম্প্রতিক সময়ে, কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই এই ধারণাটির সাথে স্পেনের বিপ্লবের অর্জনের অনেক মিল রয়েছে। আমি দুঃখিত, আমার যুক্তিটা হয়তো একটু ছেঁদো মনে হবে। কিন্তু আমি মনে করি,অরাজপন্থা আর অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র সমর্থক কিনা সেটা বলার জন্যে আমাদের কাছে অরাজপন্থা বা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র এই দুইটি ধারণাই যথেষ্ট পরিষ্কার নয়।

প্রশ্ন: স্পেনের বিপ্লবের একটা প্রধান অর্জন ছিলো তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারা। শুধু মানুষের হিসাব করলে হয়তো বলা যাবে প্রায় তিরিশ লক্ষ মানুষ এর সাথে যুক্ত ছিলো। শহর এবং গ্রামের উৎপাদন প্রক্রিয়ার ব্যবস্থাপনার দিকটি দেখভাল করেছিলো শ্রমিকেরাই । এটা কি আপনার কাছে কাকতালীয় মনে হয় যে ব্যক্তি স্বাধীনতার সমর্থক অরাজপন্থীরা এখানে এক ধরনের সমষ্টিগত প্রশাসন তৈরি করতে সফল হয়ে উঠেছিলেন

চমস্কি: না, একেবারেই কাকতালীয় নয়। বরং অরাজপন্থার প্রবণতা হিসাবে আমি সবসময়ই যা দেখেছি তা হচ্ছে, এরা সবসময়ই খুব সুচারুভাবে গোছানো একটা সমাজ চায়, যেখানে বিভিন্ন ধরনের কাঠামোকে ( যেমন কর্মক্ষেত্র, সমাজ এবং আরও নানান ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত সংগঠনসমূহ)  অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রণটা থাকে যারা এর সদস্য তাদের হাতেই,যারা উচ্চপদে বসে ক্ষমতার  জোরে আদেশ দিতে পারেন তাদের হাতে নয় (আবারো বলছি, ব্যতিক্রম শুধুমাত্র যেখানে কর্তৃত্ব ন্যায্য হিসেবে প্রমাণিত হয়,যেমন কোনো কোনো বিশেষ দৈব ঘটনার সময়।)

নো পাসারান
পোস্টার

গণতন্ত্র প্রসঙ্গে

প্রশ্ন: অরাজপন্থীরা প্রায়শই তাদের শক্তির একটা বিরাট অংশ ব্যয় করেন তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের কথা বলে। বাস্তবত কখনও কখনও গণতন্ত্রের আলাপকে একেবারে শেষ সীমায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে এদেরকে অভিযুক্তও করা হয়। এর পরেও বহু অরাজপন্থী আছেন যারা এটা বুঝতে ব্যর্থ হন যে, গণতন্ত্র হচ্ছে অরাজপন্থার একটা কেন্দ্রীয় অঙ্গ। অরাজপন্থীরা প্রায়শই তাদের আন্দোলন সম্পর্কে বলে থাকেন যে, এটা হচ্ছে ‘সমাজতন্ত্র’ সম্পর্কিত কিম্বা ‘ব্যক্তি’ স্বাধীনতা সংক্রান্ত। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা বলেন না যে, অরাজপন্থা আসলে গণতন্ত্রেরও প্রশ্ন। আপনি কি একমত যে, গণতান্ত্রিক ধারণাগুলোও আসলে অরাজপন্থার কেন্দ্রীয় প্রশ্নগুলোর অন্যতম?

চমস্কি: ‘গণতন্ত্রে’র যে সকল সমালোচনা রয়েছে অরাজপন্থীদের মাঝে তা মূলত সংসদীয় গণতন্ত্র’র সমালোচনা। কেননা আমাদের সমাজে সংসদীয় গণতন্ত্র আবির্ভূত হয়েছে গভীর শোষণতান্ত্রিক স্বরূপ নিয়ে। ধরুন যুক্তরাষ্ট্রর কথা, শুরু থেকেই অন্য দেশের মতোই দারুণভাবে স্বাধীন ছিলো দেশটি। আমেরিকার গণতন্ত্রের ভিত্তি ছিলো, ১৭৮৭ সালের সংবিধান সংক্রান্ত কনভেনশন।  যেখানে জেমস ম্যাডিসন বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন যে,সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব হল,‘সংখ্যাগরিষ্ঠের হাত থেকে সংখ্যালঘু ঐশ্বর্যশালী অভিজাত মানুষদের রক্ষা করা’। সেজন্যেই তিনি ইংল্যান্ডের ‘আপাত গণতন্ত্র’ কে সাবধান করে দিয়েছিলেন, যদি সাধারণ জনগণকে নানান ধরনের পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বা গণবিষয়াবলীতে মতামত দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে তারা হয়তো এক সময় আমাদের কৃষি ব্যবস্থার সংস্কার চাইবে কিংবা আরও অনেক ধ্বংসাত্মক সংস্কার চাইবে। আর  সেজন্যেই আমেরিকার ব্যবস্থা এমনভাবে সাজাতে হবে যেনো ‘সম্পদের অধিকারের’  বিরুদ্ধে এই ধরনের অপরাধ গুলোকে এড়ানো যায় এবং সম্পদের উপরে এই অধিকারকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে (বাস্তবত,এটাই আছে)। সত্যিকারের মুক্তিপরায়ণ মানুষ এই কাঠামোর সংসদীয় গণতন্ত্র’র তীব্র সমালোচনা করেছেন। এছাড়া আমি এ রকরকম আরও অনেক বিষয় বলিইনি।  যেমন ধরুন দাসত্বের কথা, কেবল একটির কথাই যদি বলি, শ্রমজীবী মানুষ শ্রম-দাসত্বের তীব্র নিন্দা করেছে। অথচ তারা এই উনিশ শতক জুড়ে বা তার পরেও কখনই অরাজপন্থা বা কমিউনিজমের কথা শোনেইনি।

লেনিনবাদ প্রসঙ্গে

প্রশ্ন: আমাদের সমাজের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের  প্রশ্নে তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের গুরুত্ব প্রমাণিত।  কিন্তু এরপরও, বামপন্থিরা অতীতে এই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন। আমি খুব সাধারণ ভাবেই বলছি সোস্যাল ডেমোক্রাসি১০ এমন কি বামপন্থিদের বলশেভিক ধারার১১ মাঝে গণতান্ত্রিক অনুশীলনের বদলে অভিজাত চিন্তা ভাবনার দিক থেকে অনেক মিলের জায়গা ছিলো। লেনিন, এক্ষত্রে একটা যুতসই এবং খুব পরিচিত উদাহরণ। তিনি সন্দিহান ছিলেন যে, শ্রমিকেরা ট্রেড ইউনিয়ন সচেতনতার চেয়ে বেশি কিছু অর্জন করতে পারতো।  আমার ধারণা এই মতামত দিয়ে তিনি বোঝাতে চাইতেন যে, শ্রমিকরা আসলে নিজেদের নিকট ভবিতব্যের চেয়ে দূরের কিছু দেখতে পেতেন না। একই ভাবে ব্রিটেনের লেবার পার্টির প্রভাবশালী নেতা ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রী১২ বিয়েট্রিস ওয়েব মনে করতেন যে, শ্রমিকরা জানে কেবল রেসের ঘোড়ায় টাকা খাটাতে! এই ধরনের আভিজাত্যবোধের উৎস কোথায় এবং এই ধরনের চিন্তা বামপন্থীদের মাঝে কি করছে?

চমস্কি: আমি দুঃখিত আমার পক্ষে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন। যদি বলশেভিকবাদকেও বামপন্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে আমি নিশ্চিত ভাবেই বামপন্থিদের খাতা থেকে নিজেকে আলাদা করে নেবো। আমার মতে, সমাজতন্ত্রের সবচেয়ে বড়শত্রু ছিলেন লেনিন।  আমি এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। কেউ যদি খুব সাদামাটা ভাবেও শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসের দিকে একটু তাকান, কিম্বা সাম্প্রতিক সময়ের শ্রমিক আন্দোলনের নানান পত্র পত্রিকার দিকে একটু চোখ বোলান, তাহলে শ্রমিকরা কেবল রেইসের বাজির প্রতিই আগ্রহী, এমন একটা অদ্ভুত দাবি একবারেই ধোপে টেকে না।  এমনকি আমার এখান থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরের শিল্প শহর নিউ ইংল্যান্ডের লাঞ্ছিত নিপীড়িত শ্রমিকদের সেই সব দুর্দান্ত সাহসী সংগ্রামের কথা এখন পর্যন্ত সেটাই বলছে আমাদের। এই গোলার্ধের সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত দেশটির কথাই ধরুন, হাইতি,  একসময় ইউরোপের ঔপনিবেশিক শাসকেরা যাকে স্বর্গ হিসেবে বিবেচনা করতো এবং যাকে ইউরোপের এক কোনা অংশেরও ধন সম্পদের উৎস বলে মনে করতো না, তা এখন সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং সম্ভবত এই ধ্বংস থেকে উদ্ধারের কোনো সম্ভাবনাই নেই আর। বিগত কয়েক বছরে, এই দেশটির অবস্থা এতোটাই দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছে যে, উন্নত ও ধনী বিশ্বের খুব কম মানুষই ভাবতে পারবে যে, তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠনগুলোর দ্বারা কৃষক এবং বস্তিবাসীরা এমন একটা জনপ্রিয় আন্দোলন গড়ে তুলেছে যা অন্যান্য অনেক জায়গার উদাহরণকেও ছাড়িয়ে গেছে বলে আমি জানি। আর আমেরিকান বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতারা যখন গর্বের সাথে ঘোষণা করেন যে, হাইতিবাসীকে গণতন্ত্র শেখাতে গিয়ে কি পরিশ্রমটাই না করতে হয়েছে তাদের তখন কেবল খুব কট্টর সরকারি আমলা টাইপের কেউ হলেই এই ধরনের কথা শুনে উপহাসে ভেঙ্গে না পড়ে থাকতে পারে। শ্রমজীবী মানুষের এই আন্দোলনের সাফল্য এতোটাই বিরাট ও শক্তিমানদের জন্যে ভীতিকর ছিলো যে,এর পরিণতিতে তাদের উপরে নেমে আসে আরও ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসবাদী নিপীড়ন।এই হামলার পুরোটাই ছিলো আমেরিকার সমর্থনে,সাধারণ জনগণ যার পুরোটা জানে না এবং এই সকল প্রতিবাদকারীরা এখনও আত্মসমর্পণ করেনি। এটাকে কি কেউ শুধু ‘রেইসের বাজি’ খেলার মতো বলবেন?

আমি প্রায়শই রুশো’র একটা কথা উল্লেখ করি, এখানেও করতে পারি,… ‘আমি যখন দেখি সম্পূর্ণ নগ্ন বর্বর মানুষেরা দলে দলে ইউরোপীয়  আয়েশিপনাকে ঘেন্না করছে আর শুধুমাত্র নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য বরদাশত করে চলেছে ক্ষুধা, দাবানল ও মৃত্যুকে তখন আমার মনে হয়, স্বাধীনতা রক্ষার প্রশ্নে কোন যুক্তিতর্ক আসলে মোসাহেব-গোলামদের মুখে মানায় না’।  [Rousseau: 1964: 165]

প্রশ্ন: আবারো খুব সাধারণ ভাবেই বলছি, আপনার নিজের কাজ যেমন ধরুন  Deterring Democracy13, Necessary Illusions14 এই বইগুলোতে ধারাবাহিক ভাবেই আপনি ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে আমাদের সমাজে অভিজাত চিন্তাগুলো অবস্থান করে। আপনি বিতর্ক তুলেছেন কিভাবে পশ্চিমা (অথবা সংসদীয়) গণতন্ত্রর সাথে জনগণের সত্যিকারের  ভূমিকা বা জনগণের অংশগ্রহণের গভীর বিরোধ রয়েছে, পাছে জনগণের অংশগ্রহণ যদি সম্পদের অসম বণ্টনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়, যা আদতে কেবল ধনীদেরকেই সুবিধা দেয়। আপনার এই ধরনের কাজগুলো বেশ প্রত্যয়দীপ্ত, কিন্তু ভিন্ন আরও কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে  অনেকেই বেশ হতাশ। যেমন ধরুন, আপনি জন এফ কেনেডির রাজনীতির সাথে লেনিনের তুলনা করেছেন, বাস্তবত অনেকটা দুজনকে এক করে দেখিয়েছেন। এই বিষয়টি উভয় শিবিরকেই বেশ হতাশ করেছে, আপনি কি এই ব্যাপারে খানিকটা ব্যাখ্যা করতে পারেন আবারো?

চমস্কি: আমি জন এফ কেনেডি প্রশাসনের উদারবাদী বুদ্ধিবৃত্তির সাথে লেনিনীয় চিন্তাকে এক করে ফেলিনি, কিন্তু আমি এদের দুজনের চিন্তার মাঝে এক বিস্ময়কর মিল দেখেছি। প্রায় এক শতক আগে বাকুনিন যেভাবে ইঙ্গিত করেছিলেন তাঁর লেখা দারুণ উপলব্ধিমূলক  প্রবন্ধ ‘নয়া শ্রেণী’১৫ তে। যেমন ধরুন,আমি ম্যাকনামারা থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি দিয়েছি যেখানে বলা হচ্ছে যে,আমাদের আরও বেশি করে ম্যানেজারিয়াল নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো দরকার যদি আমরা সত্যিকার অর্থেই ‘মুক্ত’ হতে চাই, তিনি ব্যাখ্যা করছেন কিভাবে ‘ব্যবস্থাপনার অভাব’ ‘সত্যিকারের গণতন্ত্রের জন্যে হুমকি’ হয়ে ওঠে এবং এটা নিজের জন্যেই কিভাবে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। এই বক্তব্যের শুধু কয়েকটি শব্দ পাল্টে দিলেই আপনি এর মাঝে লেনিনীয় মতবাদের  স্বরূপটি দেখতে পাবেন। আমি বরং প্রশ্ন তুলেছি এই দুই ধরনের চিন্তারই শেকড়টা খুব গভীর। এখন এই বক্তব্যে মানুষ ঠিক কেনো ‘হতাশ’ সেটা খুব বিস্তারিত না জেনে আমি এর চাইতে বেশি বলতে পারছি না। তুলনাটি খুবই নির্দিষ্ট এবং আমি মনে করি উভয়েই নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথার্থ ও উপযুক্ত। যদি তা না হয় তাহলে এটা একটা ত্রুটি এবং আমি এ বিষয়ে নিজে আরও বেশি আলোকিত হতে চাই।

আর্টওয়ার্ক: লেনিন অন রোস্টাম
শিল্পী: আলেকজান্ডার গেরাসিমভ
সূত্র: ইউএসএসআর পেইন্টিংস

মার্কসবাদ প্রসঙ্গে

প্রশ্ন: খুব সুনির্দিষ্ট ভাবে বললে বলা যায়, লেনিনবাদ তো আসলে মার্কসবাদেরই একটি ধারা যা লেনিনের হাতে গড়ে ওঠে। আপনি যখন   লেনিনবাদ শব্দটি ব্যবহার করেন এবং সুনির্দিষ্ট ভাবে লেনিনের সমালোচনা করেন, তখন কি আপনি পরোক্ষভাবে মার্কসের কাজ থেকে লেনিনবাদকে পার্থক্য করেন? আপনি কি লেনিনের পরবর্তী অনুশীলনকে মার্কসের কাজের ধারাবাহিকতা হিসাবে দেখেন?

চমস্কি: বাকুনিন সতর্ক করে দিয়েছিলেন ‘লাল আমলাতন্ত্র’ বিষয়ে যা আসলে ‘সকল স্বৈরাচারী সরকারের চাইতেও বাজে’ সরকার গড়ে তুলতে পারে,বাকুনিনের এই সতর্কতাবাণী ছিলো লেনিনের অনেক আগে এবং মূলত এই অভিযোগ করেছিলেন মার্কসের অনুসারীদের দিকেই। বাস্তবত সেই সময় মার্কসের অনুসারীদের মাঝেও নানান ধরন ছিলো। পানেকোয়েক, রোজা লুক্সেমবার্গ, ম্যাটিক এবং অন্যান্যরা ছিলেন লেনিন থেকে বেশ ভিন্ন এবং এদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায়শই ‘অ্যানার্কো-সিন্ডিক্যালিজম’র১৬ নানান ভাবনার সাথে মিলে যায়।

স্পেনের বিপ্লব নিয়ে বেশ সংবেদনশীল ভাবেই লিখেছিলেন [কার্ল] কোর্স এবং অন্যান্য কয়েকজন। মার্কস থেকে লেনিনবাদের মাঝে ধারাবাহিকতা ছিলো। আবার এটাও ঠিক যে অন্যান্য মার্কসবাদী যারা লেনিনের ও বলশেভিকবাদের কট্টর সমালোচনা করেছেন তাদের মাঝেও মার্কসের ধারাবাহিকতা ছিলো। কৃষক বিদ্রোহ প্রসঙ্গে মার্কসের পরের দিকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে  থিওডর শ্যানিনের লেখালেখি এখানে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। আমি মার্কস-বিশারদ নই, তাই আমি এটা বলবো না যে, ঠিক কোন উত্তরাধিকারটি  ‘সত্যিকারের মার্কস’ কে প্রতিনিধিত্ব করে। অবশ্য আদৌ এই প্রশ্নটির যদি কোনো উত্তর থেকে থাকে।

প্রশ্ন: সাম্প্রতিক সময়ে আমরা আপনার লেখা Notes On Anarchism  (গতবছর পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে আমেরিকার Discussion Bulletin১৭ থেকে)। এই বইয়ে আপনি উল্লেখ করেছেন প্রথম দিককার মার্কস এর চিন্তাগুলোকে, বিশেষত মার্কসের পুঁজিবাদের অধীনে এলিয়েনিয়েশন ধারণা গড়ে ওঠার তত্ত্ব প্রসঙ্গে। আপনি কি সাধারণত মার্কসের জীবন ও কাজকে এই ভাবে বিভিন্ন পর্বে ভাগ করার পক্ষে? যেমন ধরুন তরুণ মার্কস অনেকটাই মুক্তিমুখিন সমাজতন্ত্রী কিন্তু পরিণত মার্কস ক্রমশই হয়ে উঠেছেন একজন শক্ত কর্তৃত্ববাদী?

চমস্কি: তরুণ মার্কসকে তাঁর সময় ও পরিপার্শ্ব প্রভাবিত করেছে ব্যাপকভাবে,যে সময়ে তিনি বেঁচে ছিলেন, যে সমাজে তিনি বড় হয়েছেন। সেজন্যেই তাঁর চিন্তায় অনেকেই মিল খুঁজে পাবেন ধ্রুপদী উদারবাদ, ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট বা জ্যোতির্ময়কালের মতো প্রসঙ্গগুলোর সাথে এবং একই সঙ্গে পাবেন ফরাসি ও জার্মান রোমান্টিকতাবাদের ছোঁয়া। আবারো বলে নেয়া ভালো, আমি মার্কস বিষষে পণ্ডিত  নই, তাই এ বিষয়ে কোনো বেত্তার বিচার করতে পারবো না। এ বিষয়ে আমার বোঝাপড়াটা হচ্ছে, তরুণ মার্কস অনেকটাই এনলাইটেনমেন্ট বা জ্যোতির্ময়কালের শেষ দিকের প্রতিভূ। আর পরিণত মার্কস ক্রমশই হয়ে উঠেছেন দারুণ কর্তৃত্বপরায়ণ সক্রিয়তাবাদী এবং পুঁজিবাদের দারুণ সমালোচক, যিনি পুঁজিবাদের চুলচেরা সমালোচনা করেছেন কিন্তু বিকল্প হিসাবে সমাজতন্ত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন খুব সামান্যই। তবে এগুলো কেবলই আমার মতামত।

প্রশ্ন: আমি যতটুকু বুঝি,আপনার সামগ্রিক বোঝাপড়ার মূল অংশটি গড়ে উঠেছে মানবপ্রকৃতি১৮  বিষয়ে আপনার ধারণার উপর ভিত্তি করে। অতীতে যেমন মানব প্রকৃতিকে  ভাবা হতো অনেকটাই প্রতিক্রিয়াশীল,এমনকি  সীমাবদ্ধ হিসাবে। ধরুন, অরাজপন্থার দিকে যেকোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তনের অসম্ভব বিবেচনার কারণ হিসেবে মানব প্রকৃতির  এই অপরিবর্তনীয়তাকে  যুক্তি হিসাবে ধরে নেয়া হয়েছিলো। আপনি কি ভিন্নমত পোষণ করেন? করলে কেনো?

চমস্কি: আসলে যেকোনো মানুষেরই চিন্তার মর্মস্থল গড়ে ওঠে মানব প্রকৃতি সম্পর্কে তার ধারণার উপরে, অনেকেই হয়তো এ বিষয়ে খুব সচেতন নন কিম্বা হয়তো তাদের ধারণাগুলো সুগ্রন্থিত নয়। তবে এটা তাদের বেলায় সত্য যারা অন্তত নিজেদেরকে নৈতিক মনে করেন,দানব নন।  দানবদের কথা বাদ দিয়ে যদি বলি, তাহলে যেকোনো মানুষই তা সে সংস্কার বা বিপ্লবের সমর্থক হোন কিম্বা বর্তমান অবস্থার স্থায়িত্ব বা পূর্বতন অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সমর্থক হোন অথবা কেবলই নিজের কাজ ঠিকঠাক মতো করার মানুষ হোন সকলেই মানুষের জন্যে ভালো, এমন কিছুরই পক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকেন। কিন্তু এই যে বিচারবোধ সেটাতো কোনো না কোনো ভাবে গড়ে ওঠে ‘মানব প্রকৃতি’ প্রসঙ্গে আমাদের ধারণা বা বোঝাপড়ার উপরেই। একজন যুক্তিবান মানুষ চেষ্টা করেন এই বোঝাপড়াটা যতটা সম্ভব স্বচ্ছ করতে যায় এবং তাহলেই কেবল এই মূল্যায়নটি করা যায়। সুতরাং এভাবে দেখলে আমি অন্যদের চেয়ে খুব একটা আলাদা নই।

হ্যাঁ, আপনি সঠিক, মানব প্রকৃতিকে একরকমের প্রতিক্রিয়াশীল বলেই দেখা হয়েছে। কিন্তু এই প্রতিক্রিয়াশীলতা  নিশ্চিত ভাবেই বিপুল বিভ্রান্তির ফলাফল। আমার নাতনি কি একখণ্ড পাথর? কোনো সরীসৃপ উভচর প্রাণী, একটা মুরগি কিম্বা একটা বানর থেকে আলাদা কিছু নয়? এই অর্থহীনতাকে যিনি অর্থহীন হিসাবে নাকোচ করে দিতে পারেন, তিনি নিশ্চয়ই বোঝেন মানবপ্রকৃতি বলতে আলাদা কিছু আছে। এখন শুধু আমাদের জানা বাকি যে, এই স্বতন্ত্র প্রকৃতিটি আসলে কি? বৈজ্ঞানিক ভাবে অসামান্য গুরুত্ব ও মানবিক তাৎপর্যের কারণেই এটা একটা বিপুল আগ্রহ উদ্দীপক প্রশ্ন হিসেবে হাজির হয়েছে আমাদের সামনে। আমরা এর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ইতিমধ্যেই জানি, যদিও প্রধান মানবিক অর্থ এখনও অজানা। এর বাইরে, আমাদের জন্যে বাকি থাকে প্রত্যাশা, সংকল্প, অন্তর্দৃষ্টি আর অনুমান।

আসলে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে তেমন কিছু নেই এ প্রসঙ্গে। কেননা মানুষের ভ্রুণ নানান ভাবেই এতোটাই সীমাবদ্ধ যে, সে পারে না পাখির মতো পাখা নিয়ে বড় হতে, তার দৃষ্টিশক্তি আর তার পদ্ধতি পতঙ্গের মতো নয় কিম্বা তার নেই কবুতরের মতো তীব্র ঘ্রানশক্তি।  যে শর্তগুলো জীবের বিকাশকে সীমাবদ্ধ করে ঠিক একই শর্তই তাকে একটা সমৃদ্ধ, জটিল ও ভীষণ গোছানো কাঠামো অর্জন করতে সাহায্য করে।  অন্যান্য সমপ্রজাতির বেলাতেও ঠিক একই মৌলিক নিয়মে খুব সমৃদ্ধ ও অসাধারণ সক্ষমতার বিকাশ ঘটে। যেকোনো জীবের এই রকমের নির্ধারক অভ্যন্তরীণ কাঠামোর অভাব নিশ্চিত ভাবেই তার বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে দেয়। এই ধরনের জীব হয়তো বেঁচে থাকে অনেকটা অ্যামিবার মত করে, জগতের করুণা নিয়ে (এমন এরাও বেঁচে থাকে কোনও না কোনো ভাবে)। বিকাশের সুযোগ আর সীমাবদ্ধতা খুব যৌক্তিক ভাবেই সম্পর্কিত।

ধরুণ ভাষা, খুব সামান্য কয়েকটি মনুষ্য ক্ষমতার একটি যার সম্পর্কে এখন অনেক কিছুই জানা। আমাদের বিশ্বাস করার খুব শক্ত যুক্তি আছে যে, আসলে সব মনুষ্য ভাষাই অনেকটাই একই রকমের।  মানুষকে পর্যবেক্ষণ করছেন এমন একজন মঙ্গলগ্রহের বিজ্ঞানী হয়তো উপসংহারে পৌঁছাবেন যে, আদতে মহাবিশ্বে কেবল একটাই ভাষা আছে, কিছু রকমফের ছাড়া। এর কারণ হচ্ছে মানব প্রকৃতির বিশেষ  বৈশিষ্ট্য যা মানুষের ভাষার ভিত্তি তৈরি করে এবং খুবই নগণ্য সংখ্যক বিকল্পকেই অনুমোদন করে।  এটা কি সীমাবদ্ধ করে ফেলা? নিশ্চয়ই। এটা কি স্বাধীনতা দেয়া? সেটাও ঠিক। এই অত্যন্ত সীমাবদ্ধতার ফলেই খুবই প্রাথমিক, বিক্ষিপ্ত ও বিচিত্র সব অভিজ্ঞতই ভাব প্রকাশের এক সমৃদ্ধ ও জটিল পদ্ধতির বিকাশকে সম্ভব করে তোলে, সম্ভাবনাকে বাস্তব করে তোলে।

ধরুন, মানুষের মাঝে জৈবিক ভাবে নির্ধারিত তফাৎগুলোর বিষয়ে কি বলবেন? মানুষের মাঝে এই তফাৎগুলো নিশ্চিত ভাবেই বিদ্যমান ও সত্য, কিন্তু তা কখনই ভয় বা অনুশোচনার কারণ নয় বরং তা আনন্দের কারণ। ক্লোন প্রাণীদের জীবন আসলে যাপনযোগ্য হয়ে ওঠে না এবং যেকোনো বিবেচনাবোধ সম্পন্ন মানুষ তার জীবনকে তখনই উপভোগ করতে পারেন  যখন তিনি দেখেতে পান অন্যদের এমন কিছু আছে যা তার সাথে মেলে না। এটাই মানুষের প্রাথমিক বিবেচনা হওয়া উচিৎ। এই বিষয়গুলো নিয়ে খুব সাধারণ ভাবে যে বিশ্বাসগুলো প্রচলিত, আমার মতে তা খুবই অদ্ভুত।

এই মানব প্রকৃতি, তা সে যেমনই হোক না কেনো, অরাজপন্থী জীবনবোধ গড়ে তোলার জন্যে সহায়ক নাকি বাধা? এক ভাবে বা অন্য ভাবে, এই প্রশ্নের যথার্থ উত্তর আমাদের জানা নেই। এসব নিরীক্ষা ও আবিস্কারের বিষয়, ফাঁপা বুলিবাগিশি’র বিষয় নয়।

আগামির ভবিষ্যৎ

প্রশ্ন: শেষ করার আগে আমি বর্তমান সময়ের বামপন্থী রাজনীতির কিছু বিষয় নিয়ে জিজ্ঞাসা করতে চাই। আমি জানি না আমেরিকাতেও ঠিক একই রকমের ঘটেছে কিনা, কিন্তু এখানে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বামপন্থী মহলে একধরনের নৈতিক ভাঙ্গনের শুরু হয়েছে। এটা এমন নয় যে এখানকার মানুষজন সোভিয়েত ইউনিয়নে যা হচ্ছিল তার খুব গুণগ্রাহী সমর্থক ছিলো।  বরং এটা একটা সাধারণ অনুভূতি তৈরি হয়েছে যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন মানে মতবাদ হিসাবে সমাজতন্ত্রেরও পতন ঘটেছে। আপনি কি এই ধরনের নীতিভ্রষ্ট্রতা খেয়াল করেছেন? এ প্রসঙ্গে আপনার উত্তর কি হবে?

চমস্কি: সোভিয়েত একনায়কতন্ত্রের পতনের প্রসঙ্গে আমার প্রতিক্রিয়া হিটলার এবং মুসলিনির পতনের প্রতিক্রিয়ার মতোই। সব দিক থেকেই এটা মানব চেতনার একটা বিরাট বিজয়। এই ঘটনাটিকে সমাজতন্ত্রীদের স্বাগত জানানোর কথা ছিলো, অন্তত সমাজতন্ত্রের একটা প্রধান শত্রুর পতন হয়েছিলো এর মাধ্যমে। আপনার মতো আমিও দেখার জন্যে আগ্রহী হয়েছিলাম, যারা নিজেকে স্টালিনবাদ বিরোধী এবং লেনিনবাদ বিরোধী বলে গণ্য করেছিলেন,  এই স্বৈরাচারের পতনের ফলে তারাও কিভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়েছিলো। আসলে, এই ঘটনা প্রমাণ করেছে যে, এরা যত না  লেনিনবাদে বিশ্বাস করতেন, লেনিনবাদের প্রতি এদের অনুরাগ তার চেয়েও অনেক গভীর ছিলো।

তবে এই নৃশংস ও স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার আরও কারণ রয়েছে, কেননা এই ব্যবস্থাটি যতটা না ‘গণতান্ত্রিক’ ছিলো তার চেয়ে বেশি ‘সমাজতান্ত্রিক’ ছিলো ( খেয়াল করে দেখুন,  এরা নিজেদের সমাজতন্ত্রী ও গণতন্ত্রী-এই দুটিই দাবি করতো এবং পরের দাবিটি নিয়ে পশ্চিমে অনেক হাস্যরস তামাশা থাকলেও  প্রথম দাবিটি কিন্তু গভীর আগ্রহসহই মেনে নিয়েছিলো।  সমাজতন্ত্র’র বিরুদ্ধেই একটা অস্ত্র হিসাবে তাকে কাজে লাগিয়েছিলো। এটা ছিলো পশ্চিমের বুদ্ধিজীবীদের ক্ষমতাসীন শক্তির সেবাদাসত্বের একটা নমুনা)। স্নায়ু যুদ্ধের১৯ চরিত্রের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে।

আমার মতে,এটা ছিলো ইউরোপের বিশ্বদখলের লালসাকে খানিকটা ভদ্রস্থ করে দেখানোর জন্য ‘উত্তর ও দক্ষিণ সংঘাত’-এর বিশেষ রূপায়ন। পূর্ব ইউরোপ ছিলো প্রকৃত তৃতীয় বিশ্ব এবং ১৯১৭ থেকে শুরু হওয়া স্নায়ু যুদ্ধের সাথে পৃথিবীর অন্যান্য অংশের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর স্বাধীন পথ নেয়ার প্রতিক্রিয়ার কোনো সম্পর্ক ছিলো না, যদিও এক্ষেত্রে মাত্রাগত তফাৎ নানান সংঘর্ষে আগুনে ঘি ঢেলেছে। শুধু একারণেই,এটা খুব যৌক্তিক ভাবেই প্রত্যাশিত ছিলো যে, এই অঞ্চলটি আবার ঠিক আগের অবস্থাতেই ফিরে আসবে: পশ্চিমের কিছু অংশ,যেমন চেক রিপাবলিক এবং পশ্চিম পোল্যান্ড হয়তো আবার একসাথে হতে পারে যখন অন্যান্যরা খুব প্রথাগত সেবাদাসের ভূমিকায় থাকবে, এই ‘এক্স-নোমেনক্লাতুরা’ই২০ হয়তো হয়ে উঠবে এই তৃতীয় বিশ্বের অভিজাত শ্রেণী (এটা হবে পশ্চিমা কর্পোরেট শক্তির অনুমোদনক্রমেই যারা এদেরকেই বিকল্প হিসাবে পছন্দ করে)। এটা কোনো সুন্দর ভবিষ্যৎ ছিলো না এবং অনেককে তা দুর্ভোগের দিকেই চালিত করেছিলো।

উদ্বেগের আরেকটা কারণ হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা ও জোট নিরপেক্ষতা২১ প্রশ্ন। সোভিয়েত সাম্রাজ্য যত কিম্ভূতই হোক না কেন, এর অস্তিত্বই জোট নিরপেক্ষতার জন্য এক ধরনের জায়গা তৈরি করেছিলো এবং পশ্চিমের প্রতি বিদ্বেষ প্রবণতার কারণেই এরা কখনও কখনও পশ্চিমের দ্বারা আক্রান্ত দেশগুলোকে সাহায্য করতো। এখন এসব আর নেই,আর দক্ষিণ এর পরিণতি ভোগ করছে।

আর তৃতীয় কারণটি হচ্ছে,যাকে পশ্চিমা বেনিয়া মিডিয়া বলে ‘পশ্চিমা আদুরে শ্রমিক শ্রেণী’ আর তাদের ‘বিলাসবহুল জীবনযাত্রা’। পূর্ব ইউরোপের একটা বিরাট অংশ আবারো দখলে আসার পরে, বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকপক্ষ আর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যেনো হাতে  পেলো মোক্ষম অস্ত্র, নিজেদের দেশের শ্রমিকদের হুমকি-ধামকি দেয়ার জন্য।  জেনারেল মোটরস কিংবা ভক্সওয়াগন তখন হুমকি দিতে শুরু করলো যে তারা কেবল মেক্সিকো বা ব্রাজিলেই নয়, চাইলে পোল্যান্ডে কিম্বা হাঙ্গেরিতেও কারখানা সরিয়ে নিতে পারে। বোঝাই যায় যে, এই পরিস্থিতিতে তারা একরকমের আত্মতুষ্টিতে ভুগছে এই বিষয়ে।

স্নায়ু যুদ্ধ থেকে বা এই ধরনের যেকোনো সংঘাতময় সময়ের শেষে কে উদযাপন করছে আর কে গোমড়া হচ্ছে তা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। এই হিসাবে, স্নায়ু যুদ্ধের আসল বিজয়ী হচ্ছে পশ্চিমা অভিজাত শ্রেণী আর সেই  ‘এক্স-নোমেনক্লাতুরা’, যারা এখন তাদের কল্পনারও অতীত ধনী। আর বিজিতদের মাঝে রয়েছে পশ্চিমের শ্রমিক শ্রেণী এবং দক্ষিণের সেই সকল দেশ যারা স্বাধীনতার পথে হেঁটেছিলো।

যদিও বিরল, তবুও এই ধারণাগুলো যখন পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীরা বুঝতে পারেন, তখন তাদের মাঝে এক ধরনের উন্মত্ত বিকারগ্রস্ততা  তৈরি হয়। এটা দেখানো খুব সহজ। এটা বোঝাও যায়। এই পর্যবেক্ষণগুলো সঠিক এবং ক্ষমতা ও সুবিধা বঞ্চনার কারণেই এই উন্মত্ত বিকার।

মোটের উপরে স্নায়ু যুদ্ধের সমাপ্তিতে একজন সৎ মানুষের প্রতিক্রিয়া কেবল একটা নৃশংস কর্তৃত্ববাদের ধ্বংসে উচ্ছাস প্রকাশ করার চেয়েও বেশ জটিল হবে এবং আমার মতে এই বিষয়ে প্রচলিত মতামতগুলো প্রবল ভন্ডামিতেই বন্দি হয়ে আছে।

আর্টওয়ার্ক: রোড টু কমিউনিজম
শিল্পী: ভ্লাদেমির কাজানেভস্কি
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

পুঁজিবাদ প্রসঙ্গে

প্রশ্ন: অনেক অর্থেই বামপন্থীরা আবারো ফিরে গিয়েছেন গত শতকের মতো তাদের মূল শুরুর বিন্দুতে। তখনকার মতোই এরা একটি বিকাশমান পুঁজিবাদকে প্রত্যক্ষ করছেন। যদিও সম্পদের বৈষম্য ও অসমতা পাহাড়সম হয়েছে, তা সত্ত্বেও পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি ঐকমত্য আছে যে,পুঁজিবাদই সম্ভবত ইতিহাসের একমাত্র সম্ভাব্য সচল অর্থনৈতিক সংগঠন।  যেকেউ বলতে পারেন যে, এই প্রেক্ষাপটের বিপরীতে কিভাবে অগ্রসর হতে হবে সে বিষয়ে বামপন্থীরা অনেকটাই অনিশ্চিত। আপনি এই সময়টিকে কিভাবে দেখছেন? এটা কি এক ধরনের মূলে ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন? সমাজতন্ত্রের মুক্তিমুখিন ধারাকে সামনে নিয়ে আসা এবং গণতন্ত্রের উপরে জোর দেয়াই কি এখনকার করণীয় হতে পারে?

চমস্কি: আমার মতে,এটা আসলে অনেকটাই  প্রোপাগান্ডা। আমরা এখন পুঁজিবাদ বলতে যা বলছি তা আসলে এক ধরনের কর্পোরেট মারকেন্টাইলিজম বা বাণিজ্যতন্ত্র,যেখানে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে ও আন্তর্জাতিক সমাজে বিপুল প্রভাব খাটানো শক্তিমান রাষ্ট্রগুলোর সহায়তায়  মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে ব্যক্তি খাতের বিশাল সব স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো। নানান ধরনের বিভ্রমের বিপরীতে আমেরিকায় এটা নাটকীয় ভাবে সত্য। ধনিক ও অভিজাত  শ্রেণী এখন আর আগের মতো বাজারের শৃঙ্খলাগুলো মানতে রাজি নয়, যদিও এরা সাধারণ আম জনতার জন্যে এই শৃঙ্খলাগুলোকে এখনো সঠিক মনে করে। কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, ধরুন রিগ্যান প্রশাসনের২৩ কথা, যাঁদের আবির্ভাব ঘটেছিলো মুক্ত বাজারের বুলিবাগীশি দিয়ে, যারা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে চাঙ্গা করতে চেয়েছিলো এটা বলে যে তারাই যুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বাণিজ্য সুরক্ষাবাদী প্রশাসন।  বাস্তবত এরা সম্মিলিত ভাবে আগের সকল প্রশাসনের চেয়ে  বেশি সংরংক্ষণবাদী ছিলো।  বর্তমান বাজার ভিত্তিক ক্রুসেডের একজন নেতা নিউট গিংরিচ  যিনি বিপুল ধনী একটা এলাকার প্রতিনিধিত্ব করেন, যদিও এটা কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তার বাইরে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তার এলাকা আমেরিকার যেকোনো নিম্ন-মধ্যবিত্ত মফস্বল এলাকার চেয়ে অনেক  বেশি কেন্দ্রীয় সরকারের ভর্তুকি পেয়ে থাকে। আমেরিকার ‘রক্ষণশীলরা’ যারা ক্ষুধার্ত শিশুদের জন্য স্কুলগুলোতে দুপুরের খাবার বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে তারাই আবার পেন্টাগনের জন্য বাজেট বৃদ্ধিরও দাবি জানিয়েছে, যা ১৯৪০ এর দশকের শেষের দিকে তার বর্তমান আকারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কারণ বাণিজ্যিক মিডিয়াগুলো দয়া করে আমাদেরকে জানিয়েছে  যে, এই ‘বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতামূলক, ভর্তুকিবিহীন, মুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি’ এভাবে চলতে পারবে না, সরকারকে অবশ্যই এর ‘ত্রাণকর্তা’ হিসাবে ভূমিকা পালন করতে হবে। এই ‘ত্রাণকর্তা’ ছাড়া নিউট গিংরিচের নির্বাচনি এলাকা হতো একটা হতদরিদ্র শ্রমজীবী এলাকা (অবশ্য সেই সৌভাগ্য তাদের থাকলে)। সেখানে থাকতো না কোনো কম্পিউটার, ইলেক্ট্রনিক্স, হতো না কোনো বিমান শিল্প বা খনিজ বিষয়ক শিল্প ইত্যাদি ইত্যাদি। জনগণের মাঝে অরাজপন্থিদেরকে এই ধরনের প্রতারকদের সাথে মিলিয়ে ফেলা উচিৎ নয়।

আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে মুক্তিমুখিন সমাজতান্ত্রিক চিন্তাগুলো এখন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক এবং জনগণের মাঝে তাদের বেশ গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে। বিপুল কর্পোরেট প্রোপাগান্ডা সত্ত্বেও, উচ্চ শিক্ষিত বলয়ের বাইরে  বেশির ভাগ মানুষ এখনও তাদের প্রথাগত মনোভাবই বজায় রাখে। যেমন ধরুন, যদি আমেরিকার উদাহরণ দেই, এখানে জনগণের শতকরা আশি ভাগেরও  বেশি মানুষ মনে করেন আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি ‘মজ্জাগত ভাবেই অন্যায্য’ এবং আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি আসলে প্রতারণামূলক, যা কেবল ‘বিশেষ স্বার্থেরই’ সেবা করে ‘জনগণের’ নয়। আমেরিকার জনগণের একটা বিস্ময়কর বড়সড়ো অংশ মনে করে পাবলিক এফেয়ার্স বা গণবিষয়াবলীতে শ্রমজীবী মানুষের মতামত প্রকাশের সুযোগ খুবই সীমিত (একই অবস্থা ইংল্যান্ডেও), ফলে অভাবী মানুষকে সহায়তার জন্যে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ সংকোচন কিম্বা কর মওকুফের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিৎ। অথচ বর্তমান রিপাবলিকান প্রস্তাবনা গুলো যা কংগ্রেসের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে তা শুধু ধনীদেরকেই লাভবান করে আর  আম জনতার জন্য অনিষ্টকর ভূমিকায় আবির্ভূত হয় এবং এই রকমের আরও অনেক অনেক উদাহরণ রয়েছে। বুদ্ধিজীবীরা হয়তো অন্য গল্প শোনাবে আপনাকে কিন্তু আসল তথ্যটা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন কিছু নয়।

প্রশ্ন: সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে অরাজপন্থি চিন্তাগুলোর সঠিকতাই প্রমাণিত হয়েছে, বাকুনিনের ভবিষ্যৎবাণীই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। আপনার কি মনে হয় এই সাধারণ বিকাশ থেকে এবং বাকুনিনের দারুণ বোধগম্য বিশ্লেষণ থেকে অরাজপন্থীদের প্রেরণা নেয়া উচিৎ? অরাজপন্থী মানুষদের কি তাদের চিন্তা এবং ইতিহাসের উপর আরও বেশি আস্থা রেখে আগত সময়ের দিকে নজর দেয়া উচিৎ?

চমস্কি: আমি অন্তত আশা করি উপরের আলোচনায় এর উত্তর আছে। আমি মনে করি বর্তমান যুগে অশুভ দৃষ্টান্ত যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে দুর্দান্ত সব আশার চিহ্ন, এর ফলাফল কি হবে তা নির্ভর করছে আমাদের সামনে থাকা সুযোগগুলোকে আমরা ঠিক কতটা ব্যবহার করতে পারছি তার উপরে।

প্রশ্ন: সবশেষে, নোম, একটা ভিন্ন প্রশ্ন করছি। আমরা আপনার জন্যে এক পাইন্ট গিনেস বিয়ার অর্ডার করে রেখেছি এখানে। আপনি কবে আসবেন এবং পান করবেন সেটা?

চমস্কি: গিনেস’টা প্রস্তুত থাক, আমি আশা করি খুব লম্বা সময় লাগবে না আমার আসতে। আমরা যদি পারতাম তাহলে হয়তো কালকেই চলে আসতাম। আয়ারল্যান্ডে আমরা (মানে আমার স্ত্রীও এসেছেন আমার সাথে, যদিও এই ধরনের ধারাবাহিক ভ্রমন তার জন্যে অস্বাভাবিক) দারুণ সময় কাটিয়েছি, আমরা আবার আসতে চাই। আর কেনই বা নয়? কঠিন কঠিন সব আলাপ করে আপনাদেরকে বিরক্ত করবো না, তবে অসাধারণ সব প্রত্যাশা রয়েছে, যে পরিস্থিতিগুলোর কথা আমি বলার চেষ্টা করছি সেসব বিষয়ে।

পাদ টিকা

১.ফরাসি নৈরাজ্য চিন্তাপথিক দানিয়েল গেঁর‌্যা লিখিত বই Anarchism : From Theory To Practise. বইটি মান্থলি রিভিউ প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে। এতে নোম চমস্কি ভূমিকা লেখেন। ভূমিকাটি পরে বিভিন্নস্থানে Notes On Anarchism শিরোনামে প্রকাশিত হয়।

২. নোম চমস্কি ও এস হ্যারম্যান ১৯৮৮ সালে লেখেন তাদের সাড়া জাগানো বই Manufacturing Consent. পরে ১৯৯২ সালে দুই কানাডিয়ান প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা মার্ক আকবার ও পিটার উইনটনিক বিষয়বস্তুকে ধরে চমস্কির ভাবনা বিস্তৃত করতে নির্মাণ করেন ১৬৭ মিনিটের প্রামাণ্যচিত্র Manufacturing Consent: Noam Chomsky and the Media.

৩. স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম লিখিত বই Of Priceple OF government .

৪. Liberatarian Socialism  এর পরিভাষা মুক্তিমুখিন সমাজতন্ত্র। ১৮৫৮ সাল  থেকে ১৮৬১ সালের ভেতরে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত নৈরাজ্যবাদী জার্নাল খব Le Libertaire এ প্রথম প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হয়। ফরাসি নৈরাজ্যবাদী চিন্তাপথিক ও কবি Joseph Déjacque  প্রথম ব্যবহার করেন। উনিশ শতকের আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মানুষের সমিতিতে  সমাজতন্ত্র প্রশ্নে মার্কস-বাকুনিন বিভাজন হয়। মার্র্কস সমাজতন্ত্র বলতে মনে করতেন সাম্যবাদে উত্তরণের আগে উৎক্রমনমূলক পর্যায় যাতে শিল্প-প্রলেতারিত রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে। অন্যদিকে বাকুনিনের  মতে সমাজতন্ত্র মানেই বিপ্লবকালে  এই রাষ্ট্র তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থার উচ্ছেদ। নৈরাজ্যবাদীরা রাষ্ট্রহীন সমাজতন্ত্রকেই মুক্তিমুখিন সমাজতন্ত্র  এবং রাষ্ট্রবিহিত সমাজতন্ত্রকে কর্তৃত্বপরায়ণ সমাজতন্ত্র বলে থাকেন।

৫. নৈরাজ্যবাদের আদি চিন্তাপথিক মিখাইল বাকুনিন তাঁর Stateless socialism: Anarchism  রচনায় সমাজতন্ত্র ও স্বাধীনতার সম্পর্ক ব্যাখা করেন। বাকুনিনের মতে ‘সমাজতন্ত্র ছাড়া স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচার আর স্বাধীনতা ছাড়া সমাজতন্ত্র নির্মমতা’।  দেখুন: বাকুনিন (২০১৯: পৃ) পরে যুক্তরাষ্ট্রের বামপন্থী আন্দোলনে anarchism is equivalent to socialism with freedom কথাটি জনপ্রিয় হয়।

৬. Red Beurocracy এর পরিভাষা লাল আমলাতন্ত্র। রুশ নৈরাজবাদী চিন্তক মিখাইল বাকুনিন এই প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। বাকুনিন মনে করতেন শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির পথ হল সমাজতন্ত্র। বাকুনিন সমাজতন্ত্র বলতে শুধু উৎপাদনের সামাজিক মালিকানাই বুঝতেন না,  একই সঙ্গে রাষ্ট্র উচ্ছেদকে অপরিহার্য শর্ত হিসেবে সামনে রাখেন। বাকুনিন Statism and Anarchy  তাঁর ধারণা বিস্তৃত করেন এবং মাকর্সীয় রাষ্ট্রবিহিত সমাজতন্ত্রর তীব্র সমালোচনা করেন। রাষ্ট্র ও তার তাবৎ রাজনৈতিক ব্যবস্থাটা শাসক-শাসিত সম্পর্ক নির্মাণ করে এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে স্বাধীনতা হরণ করে। রাষ্ট্রকে  ‍চূর্ণ না করে তার ক্ষমতা  দখল কেবল নতুন রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণীই নির্মাণ করে। বাকুনিন এই নতুন রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণীর ক্ষমতাকেই Red Beurocracy নামে অভিহিত করেন।

৭. ১৯৩৬  সালের স্পেনীয় বিপ্লব ছিল শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক বিপ্লব। কাতালোনিয়া, আন্দালুসিয়া, আরাগোন এবং ভ্যালেন্সিয়ার অংশবিশেষ  জুড়ে সংগঠিত হয় এই বিপ্লব। স্পেনের অর্থনীতির দুই-তৃতীয়ংশরই নিয়ন্ত্রণ নেয় শ্রমজীবী শ্রেণী। শ্রমজীবী মানুষের নৈরাজ্যবাদী সংগঠন সিএনটি ছিল এই বিপ্লবের সংঘটক। কারখানার দখল নিয়ে শ্রমজীবীদের স্ব-স্বপরিচালনা ব্যবস্থা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে  প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র, সমন্বয়ের জন্য ফেডারেটিভ পদ্ধতির পরিচালনা ব্যবস্থা এবং প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৩৬-১৯৩৯  পর্যন্ত বিপ্লব স্থায়ী ছিল।

৮. অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র: Participatory Democracy’ পরিভাষা াংশগ্রহনমূল গণতন্ত্র। এটি সংসদীয় প্রতিনিধিত্বমূল গণতন্ত্ররে ধরণ থেকে একবারেই আলাদা। উৎপাদনকাঠামো ও সমাজ- সমিতি ও সম্প্রদায়গুলোতে ব্যক্তি স্বয়ং প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয় এবং প্রত্যেকে ও সকলে মিলে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে।

৯. ১৭৮৭ সালের সংবিধান সংক্রান্ত কনভেনশন: যুক্তরাষ্ট্রর সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাসে  খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সংবিধান সংক্রান্ত কনভেনশন পেনসিলভেনিয়ার  ফিলাডেলফিয়ায়  ১৭৮৭ সালের ১৪ মে থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে শাসন হবে, তা নির্ধারণই ছিল এই কনভেনশনের মুখ্য উদ্দেশ্য। কনভেনশনে  সভাপতিত্ব করেন জর্জ ওয়াশিংটন।  ৭০ জন ডেলিগেট এতে অংশ নেয়ার কথা থাকলেও ৫৫ জন অংশ নিতে সক্ষম হন। স্টেটগুলোকে বিবেচনার জন্য ৩৯ জনের সাক্ষর সম্বলিত প্রস্তাবনা পাটানো হয়। জেমস মেডিসন, আলেকজান্ডার হ্যামিলটন নতুন ধরনের শাসনপদ্ধতির কথা বলেন। কনভেনশনে জনসংখ্যা অনুপাতে প্রতিনিধিত্বও প্রস্তাব হাজির করেন জেমস মেডিসন।

১০. সোস্যাল ডেমোক্রাসি: সোসাল ডেমোক্রাসি ১৮৬০’এর দশকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক আন্দোলন। এর সুদূরপ্রসারীর লক্ষ হচ্ছে ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অভীষ্ট সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।

১১. ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রী : ব্রিটেনের একটি সমাজতন্ত্রী ধারা যারা বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের বদলে ধারাবাহিক সংস্কারের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের তাত্ত্বিক ধারণায় বিশ্বাসী। এদের মূল সংগঠনের নাম ‘ফ্যাবিয়ান সোসাইটি’।

১২. বলশেভিক : রুশ সোসাল ডেমোক্রাটিক লোবার পার্টির লেনিনপন্থী অংশ। বলশেভিক অর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ। ১৯০৩ সালে পার্টিরি দ্বিতীয় কংগ্রেসে অপর অংশ মেনশিভিক থেকে আদালা হয়ে যায়। পরবর্তীতে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টিতে রূপান্তরিত হয়।

১৩. Deterring Democracy  চমস্কির আলোচিত বই। ১৯৯১ সালে ভার্সো বুকস থেকে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই বইটি আলোচনার ঝড় তোলে। বইটিতে চমস্কি মার্কিন সাম্রাজ্যের ক্ষমতাকাঠামোকে উন্মোচন করেন এবং দেখান কিভাবে নিজ দেশে এবং দেশের বাইওে এই ক্ষমতা গণতন্ত্রর জন্য হুমকি। একদিকে আকাশচুম্বি সামরিক ক্ষমতা অন্যদিকে পড়ন্ত অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রর জন্য একটি নতুন ধরনের অসামঞ্জস্য তৈরি করে এবং এই কারণে যুক্তরাষ্ট্রর ‘জাতীয় স্বার্থর’ নামে ভয়ানক শোষণ জারি করে।  নিকারাগুয়া থেকে ফিলিপাইন, পানামা থেকে মধ্যপ্রাচ্য- দুনিয়াব্যাপি শোষণের নতুন এক বিন্যাস তৈরি হয়। যাকে ‘নয়া বিশ্বব্যবস্থার আবির্ভাব বলেছেন চমস্কি।

১৪. Necessary Illusions: Thought Control in Democratic Societies ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত চমস্কির বই। সাউথ ইন্ড প্রেস ও প্লুটো প্রেস বইটি প্রকাশ করে। এতে চমস্কি দেখান ক্ষমতা কিভাবে প্রপাগান্ডার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোকে বিলীন করে এবং ধোঁয়াশার মাধ্যমে বিভ্রান্তি তৈরি করে।  প্রকৃত গণতন্ত্রকে রুদ্ধ করে ফেলা বা অকার্যকর করতে কর্পোরেট মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের  ভ’মিকার সমালোচনা করেন চমস্কি।

১৫. ‘নয়া শ্রেণী’: Newclass শিরোনামে বাকুনিনের একটি প্রবন্ধ জি পি ম্যাক্সিমফ সম্পাদিত বাকুনিন রচনামালায়  পত্রস্থ হয়েছে। বাকুনিন নয়া শ্রেনী বলতে মূলত লাল আমলাতন্ত্রে গজিয়ে ওঠা নতুন রাজনৈতিক শ্রেণীটিকে বুঝিয়েছেন। ৬ নম্বর পাদটিকা দ্রষ্টব্য।

১৬. অ্যানার্কো সিন্ডিক্যালিজম: নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রধানধারা। চমস্কির মতে,  অ্যানার্কো-সিন্ডিক্যালিস্টরা নৈরাজ্যবাদকে অত্যন্ত সংগঠিত ও জটিল  শিল্পায়িত সমাজের জন্য সঠিক ধরনের সংগঠনপ্রণালী হিসেবে দেখে। আর এই প্রবণতার সম্পর্ক রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বামপন্থী-মার্ক্সবাদের সঙ্গে, যেমন কাউন্সিল-কমিউনিজম যা লুক্সেমবার্গবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত।

১৭. Discussion Bulletin : ১৯৮৩ সাল থেকে ২০০৩ পর্যন্ত ত্রৈমাসিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। এর সম্পাদক ছিলেন ফ্রাঙ্ক জিরাল্ড।

১৮. মানবপ্রকৃতি: চমস্কির ভাষাতত্ত্বেরও অন্যতম প্রস্তাবনা মানবপ্রকৃতি।  চমস্কি তাঁর ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণায় যে লক্ষ্যণীয় সিদ্ধান্তে উপনীত হন তা হলো: মানুষ সহজাত ভাবসম্পন্ন। চমস্কি যুক্তি দেখান যে, ভাষার ব্যাকরণ কাঠামোর অন্তর্নিবিষ্ট রূপগত বিধান বুঝতে পারার ক্ষমতা মানুষের সহজাত। চমস্কি যুক্তি দেখান যে, ভাষার ব্যাকরণ কাঠামোর অন্তর্নিবিষ্ট রূপগত বিধান বুঝতে পারার ক্ষমতা মানুষের সহজাত। খুব অল্প বয়সেই শিশুরা বড়দের কথাবার্তা শুনে ব্যকরণের জটিল বিধানগুলো আয়ত্ত করে ফেলে। একজন শিশু পরবর্তীতে এই বিধানগুলোকে এমনভাবে ব্যবহার করে যাতে খুব নির্দিষ্ট সংখ্যক শব্দ দিয়েই অসংখ্য বাক্য সে প্রণয়ন করতে থাকে। এই বাক্যগুলো অশ্রুত অর্থাৎ নতুন। তাই ব্যকরণের অন্তর্নিহিত বিধান চিনতে পারার সক্ষমতা এবং অসংখ্য বাক্য উৎপাদনের এই সহজাত ক্ষমতাকে সৃজনশীলতা বলে আখ্যায়িত করা যায়।

১৯. স্নায়ুযুদ্ধ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রসমূহ এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্রসমূহের মধ্যকার টানাপোড়েনের নাম। ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৮০’র দশকের শেষ পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ছিল। প্রায় পাঁচ দশকব্যাপী সময়কালে এই দুই শক্তিশালী দেশের মধ্যকার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও রাজনৈতিক মতানৈক্য আন্তর্জাতিক রাজনীতির চেহারা নিয়ন্ত্রণ করত।

২০. ‘এক্স-নোমেনক্লাতুরা’: এক্স-নোমেনক্লাতুরা : মূলত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট পার্টির অভিজাত নেতাদের এই নামে ডাকা হতো, যারা পার্টির খুব শীর্ষ পদে, নানান গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন। এরা কমিউনিস্ট সংগঠনের মধ্যেও ‘এলিট’ অংশ। যদিও এই সাক্ষাৎকারে ‘এক্স-নোমেনক্লাতুরা’  বলতে পূর্ব ইউরোপের অভিজাত দেশগুলোর কথা বলা হয়েছে যাঁদের সাথে পশ্চিমের সখ্য গড়ে উঠেছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে। -অনুবাদক

২১. জোট নিরপেক্ষতা: ১৯৬১ সালের সাবেক যুগাস্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে জন্ম হয় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের।

তথ্যপঞ্জি

1. Hume, David (1994) Of the First Principles of Government, Political Essay; Ed. Knud Haakonssen; Cambridge University Press; Edinburgh, Uk

2. Mirbeau, Octave (1894) Le Journal, February 19, 1894; Ed. Fernand Arthur Pierre Xau; Paris

3. Rousseau, Jean-Jacques (1964); First And Second Discources; Ed. R. D. Masters; St. Martin Press, New York.

 

মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার