- অনুবাদ: ইমরান কামাল
[ইজারায়েলি জায়নবাদের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আগামবেন বেশ চমকপ্রদ একটা ধারণা হাজির করছেন। জায়নবাদের আবির্ভাবের পেছনে তিনি নেতির ধারণা নিয়ে আসছেন আমাদের সামনে। লেখাটি প্রকাশিত হয় গত বছরের (২০২৪) এর ৩০ সেপ্টেম্বরে, Quodlibet নামক অনলাইন পত্রিকায়। এখানে আগামবেন দাবি করছেন একদিকে খ্রিস্টীয় জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোতে ইজরায়েলে ইহুদিদের আত্তীকরণ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে যেমন ইহুদি পরিচয় মুছে ফেলা হচ্ছে আবার আরেকদিকে ইহুদি পরিচয়ের অন্তঃসার যেই নির্বাসনের ধারণা তাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। এই দুই নেতির মাধ্যমেই ইহুদি পরিচয়ের ইতি ঘটছে, আবির্ভাব হচ্ছে জায়নবাদ নামক এক নতুন বস্তুর। আগামবেনের মতে জায়নবাদ মূলত ইহুদি পরিচয়ের মৌলিক ধারণার সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করে, এবং সেই পরিচয়কে অস্বীকার করে, ফলে আজকের জায়নবাদকে বুঝতে হলে এই নেতির ধারণা থেকেই বুঝতে হবে বলে দাবি করছেন আগামবেন। লেখাটির বাংলায় তর্জমা করা হয়েছে মূল ইতালিয়ান প্রবন্ধটির ইংরেজি সংস্করণ থেকে—সম্পাদক]
হালের হকিকত
জায়নবাদ ইহুদিবাদের ঐতিহাসিক বাস্তবতার দ্বৈতনেতি, এ কথা না বুঝলে হালের ইসরায়েলে যা ঘটছে তা বোঝাও অসম্ভব। প্রথমত, ইহুদিদের খৃষ্টীয় জাতি-রাষ্ট্রে চালান করার মধ্যদিয়ে এক নেতিকরণ হয়েছে, তাদের পরিচয়কে করা হয়েছে অস্বীকার। এই নেতিকরণের চূড়ান্ত পরিণতিই জায়নবাদ, যা আঠারো শতকের শেষ থেকে ধীরে ধীরে ইহুদি রূপকেই বিলুপ্ত করে দিয়েছে।
অ্যামনন রাজ-ক্রাকোৎসকিন (Amnon Raz-Krakotzkin) তাঁর একটি গবেষণায় চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন—জায়নীয় চৈতন্যের গভীরে আছে আরেক নেতি—গালুতের (Galut) নেতি, অর্থাৎ নির্বাসন, যা কিনা দুনিয়াব্যাপী যতরকম ইহুদিবাদ আছে তার সরল বৈশিষ্ট্য। এই নির্বাসন-ধারণার ভিত্তি দ্বিতীয় মন্দির ধ্বংসের আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বাইবেলীয় সাহিত্যেও এর উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়।
ইহুদি ঐতিহ্যে নির্বাসন–ধারণা
দুনিয়াতে ইহুদি অস্তিত্বের অপর নাম নির্বাসন। গোটা ইহুদি ঐতিহ্য—মিশনা (Mishnah) থেকে তালমুদ (Talmud), সিনাগগ-স্থাপত্য থেকে বাইবেলীয় নানান ঘটনার স্মৃতি—সবই গড়ে উঠেছে এবং এখনো দাঁড়িয়ে আছে নির্বাসনের দৃষ্টিকোণ থেকে। একজন অর্থডক্স ইহুদির কাছে, যে ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্রে বাস করছে—তারাও নির্বাসিতই। আর তোরাহে যে রাষ্ট্রের কথা আছে, একজন মসিহা আসবেন এবং সেই রাষ্ট্র গঠন করবেন বলে যে খোয়াব তারা দেখে—তা আর যাই হোক, আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র না। সেই রাষ্ট্রকল্পের মূলবাণী—মন্দির পুনর্প্রতিষ্ঠা আর যা কিছু কোরবানি হয়েছে তার পুনর্স্থাপন। কিন্তু ইসরায়েল রাষ্ট্র এসব কথা শুনতেই চায় না। এও মনে রাখা উচিত যে, ইহুদিবাদে, নির্বাসন কেবল ইহুদিদের বিষয় না, এ দিয়ে বোঝানো হয়—গোটা দুনিয়াই একটা আস্ত ব্যর্থগল্প। ইসহাক লুরিয়ার (Isaac Luria) মতো কাব্বালাবাদীদের মতে, নির্বাসন দিয়েই আরাধ্যের প্রকটদশা ব্যাখ্যা করা যায়। তারা মনে করতেন খোদা দুনিয়া পয়দাই করেছেন আত্মনির্বাসনের মধ্যদিয়ে। আর তার সেই নির্বাসন চলবে টিপ্পুন (Tiqqun) পর্যন্ত। ইহুদি কল্পনায়, টিপ্পুন হলো—অদ্যশৃঙ্খলার পুনর্প্রতিষ্ঠা।
উচ্চমনা অবস্থানের ভিত্তি
নির্বাসনের প্রতি এই নিঃশর্ত সম্মতি, যার জোরে ইহুদিরা হালের সকল প্রকার রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই অস্বীকার করতে পারে। একেই তারা উচ্চমনস্কতা বলে বোঝে, আর এ কারণে, যারা, যেসব ধর্ম ও জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছে, আপস করেছে, তাদের চাইতে নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। জিপসিদের মতো জনগোষ্ঠী হিসেবে ইহুদিরাও রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যান করেছে, কখনো যুদ্ধ করেনি এবং অন্য জনগোষ্ঠীকে বধযোগ্য বানিয়ে নিজেদের কলঙ্কিত করেনি।
জায়নবাদের প্রতারণা
জাতি-রাষ্ট্রের নামে নির্বাসন আর দেশহীনতার আকর ধারণাকে অস্বীকার করে জায়নবাদ খোদ ইহুদিবাদের মৌলিক বিশ্বাসের সঙ্গেই প্রতারণা করেছে। যার ফলে, রাষ্ট্র ইসরায়েল আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের চরম নিষ্ঠুর রূপে পরিণত হয়েছে। ফলত, এই অস্বীকার যে—ফিলিস্তিন—নামে আরেক নির্বাসনের স্রষ্টা হয়েছে, আর ইসরায়েল রাষ্ট্রকে বানিয়েছে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের নিকৃষ্টতম উদাহরণ, তা দেখে আমরা আর আচম্বিত না হই। জায়নবাদীদের মতে, দেশান্তর আর দেশহীনতা পৃথিবী থেকে ইহুদিদের মুছেই ফেলতে পারতো। ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস! যারা এককালে এই মত প্রচার করেছিলো, তারাই আজ দুনিয়া থেকে অপর কারো নাম মুছে ফেলতে উদ্ধত। এ কথাকে আমরা অবশ্য অন্যভাবেও পাঠ করতে পারি, আমরা বলতেই পারি, যে ইহুদিবাদকে আইশভিৎসও খুন করতে পারেনি, সেই ইহুদিবাদ সম্ভবত আজ জানে—কীভাবে তাকে খতম করা হবে।
সংযুক্তি
১. অ্যামনন রাজ-ক্রাকোৎসকিন: একজন ইসরায়েলি অধ্যাপক, বেন গুরিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইহুদি ইতিহাস পড়ান।
২. আইজাক লুরিয়া: ষোড়শ শতাব্দীর একজন কাব্বালবাদী রাব্বি।
৩. টিক্কুন ওলাম: একটি ইহুদি ধারণা, যা পৃথিবীকে মেরামত ও উন্নত করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মসূচিকে নির্দেশ করে।