দিল্লির প্রথিতযশা বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর দ্যা স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজ (CSDS)-এর ফেলো এবং ভারতীয় বাঙালি চিন্তক আদিত্য নিগামের কাজ সম্পর্কে জানতে পারি গত বছর, বোধিচিত্তের সুবাদে। নিগামের লেখাপত্র বোধিচিত্তের নজরে আনেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ স্বাধীন সেন। বোধিচিত্ত এবং শ্রদ্ধেয় স্বাধীন সেনের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।
গত বছর করোনা মহামারির প্রথম ঢেউ আঘাত হানার একেবারে শুরুর দিকেই Kaflia.online–এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে নিগামের চার–পর্বের প্রবন্ধের কিস্তি। এই চার–পর্বের ধারাবাহিক প্রবন্ধের প্রথম দুই কিস্তি, আমার অনুবাদে প্রকাশিত হয় বোধিচিত্তে (নিগাম ২০২০ক) এবং পরবর্তীতে অরাজে (নিগাম ২০২০খ)। শেষ দুই পর্ব আর গত বছর অনুবাদ করা হয়ে ওঠেনি। ইন্ডিয়াসহ উপমহাদেশের অন্যান্য দেশে নিগামের কাজ বহুল সমাদৃত এবং পর্যালোচিত হলেও, আমার বা আমাদের জন্য গত বছরও তিনি ছিলেন অপেক্ষাকৃত অপরিচিত তাত্ত্বিক। তা সত্ত্বেও, তার প্রবন্ধ অনুবাদ করতে গিয়ে তার কাজ সম্পর্কে আমি আগ্রহী হয়ে ওঠি। বিশেষত পুঁজি ও পুঁজিবাদ, তত্ত্ব, সেক্যুলারিজম, মডার্নিটি, সাবলটার্নিটি, উন্নয়ন নিয়ে নিগামের কাজের গভীরতায় বেশ চমৎকৃত হই। গতবছরই প্রকাশিত হয় তার সর্বশেষ বই Declonizing Theory: Thinking across the Traditions; এই বইটি পড়ে এবং প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে যৌথভাবে নিগামের প্রকল্প “Doing Theory” সম্পর্কে অবগত হয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিই আদিত্য নিগামের একটি সাক্ষাৎকার নেব। আদিত্য নিগামের কাছে সেই প্রস্তাব রাখতেই তিনি সানন্দে রাজি হন। এ বছরের এপ্রিলে এই সাক্ষাতকারের জন্য তাকে যখন প্রশ্নগুলো পাঠিয়েছিলাম, দিল্লিতে তখন করোনা মহামারির কারণে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। এর মধ্যেও নিগাম এই সাক্ষাৎকারের জন্য প্রেরিত আমার প্রশ্নগুলোর সাথে লিপ্ত হয়েছেন। এজন্য তার প্রতি আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।
সামাজিক ও রাজনৈতিক তত্ত্বের বিউপনিবেশায়ন নিয়ে নিগাম বর্তমানে কাজ করছেন। কেবলমাত্র পশ্চিমা তত্ত্বের চর্চা কিংবা ‘অ–পশ্চিমা’ সমাজে পশ্চিমের দার্শনিক ও তাত্ত্বিক ক্যাটাগরিসমূহকে সর্বজনীন ধরে নিয়ে তার নানাবিধ পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা কিংবা পশ্চিমের ‘ক্রিটিক’ করাকেই নিগাম ও তার সহ–তাত্ত্বিকরা নিজেদের কাজ মনে করেন না। তারা মনে করেন বিভিন্ন চিন্তা ঐতিহ্যের মধ্যে গতায়াতের মাধ্যমে ‘অ–পশ্চিমা‘ সমাজই হতে পারে doing theory তথা “তত্ত্ব করা”র ক্ষেত্র।
তত্ত্ব নাকি অনুশীলন, আগে তত্ত্ব পরে অনুশীলন, অনেক তত্ত্ব হয়েছে এবার অনুশীলনের পালা; এমন নানাবিধ যান্ত্রিকতাকে ছাপিয়ে তারা বলছেন: The point is to change the way we do theory (Nigam 2020e)। “তত্ত্ব করা” প্রকল্পে তারা তত্ত্বকে সমাজে এমনভাবে গ্রোথিত করতে চান যেন তত্ত্বকে অনুশীলন থেকে কিংবা অনুশীলনকে তত্ত্ব থেকে আলাদা করে ভাবা অসম্ভব হয়ে ওঠে। তত্ত্ব নির্মাণের ভিন্ন পদ্ধতিই তারা প্রতিষ্ঠা করতে চান। (Banerjee, Nigam & Pandey 2016)
এছাড়াও নিগাম পুঁজির সর্বজনীনতা , গ্লোবায়নের সিলসিলা, ‘অ–পশ্চিমা’ অভিজ্ঞতায় পুঁজির দার্শনিকতার স্বরূপ উদঘাটন প্রকল্পেও লিপ্ত।
শ্রিলংকা, ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন তাত্ত্বিকদের সাথে ‘post-national condition’ সংক্রান্ত কাজেও নিগামের সক্রিয়তা লক্ষণীয়। আদিত্য নিগামের কাজের সাথে বাংলাদেশের ক্রিটিক্যাল চিন্তাজগতকে পরিচয় করিয়ের দেয়ার সূত্রপাত হতে পারে এই সাক্ষাৎকার।
আরিফ রেজা মাহমুদ, তানভীর আকন্দ, সহুল আহমদের সাথে বিচিত্র রকমের চিন্তার আদান–প্রদান ও ধারাবাহিক কথোপকথনের প্রভাব আমার পক্ষে অস্বীকার করা অসম্ভব। বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই ইন্ডিয়ান ফাউন্ডেশন ফর দ্যা আর্টস–এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর কবি অরুন্ধতী ঘোষের প্রতি। বেশ কিছু দিনের জন্য আদিত্য নিগামের সাথে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, এই সময়ে নিগামের সাথে যোগাযোগ পুনরুদ্ধারে অরুন্ধতী ঘোষ সহায়তা করেছেন অকাতরে। এছাড়াও হাসিবউদ্দিন হুসাইন, শ্রবণা শফিক দীপ্তি, শাহীন খান, কাজী তাফসিন, ডালিয়া চাকমা, ফরিদুল হক, নাঈমুল ইসলাম নয়ন, ইমরান ইমন, লোপা ভৌমিক, ইফতেখার রুমি, রিবাতুল ইসলাম, মোস্তাকিম বিল্লাহ মাসুমসহ যারা আমার দৈনন্দিনতার অংশ হয়ে আছেন, তাদের সবার প্রতি আমার ঋণ ক্রম–বর্ধমান:
“আমি অকৃতি অধম ব’লেও তো কিছু
কম করে মোরে দাওনি…”
ধন্যবাদান্তে,
সারোয়ার তুষার
মূল সাক্ষাৎকার
সারোয়ার তুষার: গত বছর মহামারি শুরু হওয়ার পর Kaflia.online–এ মহামারি, জৈব–রাজনীতি এবং ‘পুঁজিবাদের পরের জীবন’ (Life after capitalism) সংক্রান্ত চার কিস্তির ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখেছেন আপনি (Nigam 2020a,b,cd)। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ‘পুঁজিবাদের পরের জীবন’কে আমরা কী করে আমাদের বর্তমানতার মধ্যে ধরতে পারি? আপনি যেহেতু মনে করেন না যে, ‘ইতিহাসের অনিবার্য যুক্তি’ (inevitable logic of history) অনুযায়ী পুঁজিবাদের পতন ঘটবে এবং সমাজতন্ত্র অবধারিতভাবে ধরা দেবেই। সেক্ষেত্রে ‘পুঁজিবাদের পরের জীবন’ কথাটার মাধ্যমে সেই ইতিহাসের ক্রম–বিবর্তনের নিয়তিবাদী যুক্তি বা বিশ্বাসের ফাঁদেই আমরা পড়ছি কিনা?
আদিত্য নিগাম: এই প্রশ্নটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারণ ‘পুঁজিবাদের পরের জীবন’ বলতেই আমাদের মাথায় সমাজতন্ত্রের কথা চলে আসে। আর আমাদের কল্পনায় সমাজতন্ত্র কতকগুলো চলতি মার্ক্সবাদী ধারণার সঙ্গে যুক্ত, কারণ এই আদর্শের একমাত্র মূর্ত রূপ আমরা তারই রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে দেখতে পেরেছি। মার্ক্সবাদী তত্ত্ব আমাদের শিখিয়েছে যে সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদের পরের অবস্থা, এবং পুঁজিবাদকে অতিক্রম করেই মানব–সমাজ সমাজতন্ত্রের দিকে এগোতে পারে। মার্ক্সবাদের এই বক্তব্য ইতিহাস সম্বন্ধে তার দর্শনের সাথে গভীরভাবে জড়িত। এই ইতিহাস–দর্শনে সমাজের ক্রম–বিকাশের একটা নির্দিষ্ট পথ আছে যেটা তাকে সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদ ও পুঁজিবাদের পর সমাজতন্ত্রের দিকে নিয়ে যায়।
মার্ক্স ও এঙ্গেলসের সময়ে, ইউরোপের মাটিতে দাঁড়িয়ে, উনিশ শতকের নানান শ্রমিক অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা থেকে বোধ হয় এই ধারণাটি পুষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। ১৮৪৫ থেকে শুরু করে, বিশেষ করে ১৮৫০ ও ১৮৬০–এর দশকে লেখা মার্ক্সের রচনাগুলোর মধ্যে এই অভিজ্ঞতাকেই একটা তত্ত্বগত ভিত্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। উৎপাদন–পদ্ধতি ও অর্থনীতিকে সমাজের ভিত হিসেবে ধরে নেওয়া হয় এবং এই তত্ত্বের মধ্যে উৎপাদনের শক্তির ক্রম–বিকাশের ভূমিকা এক অর্থে প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। সে কারণেই মার্ক্স ও এঙ্গেলস আশা করেছিলেন যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ইউরোপের বিকশিত দেশগুলোতেই আগে ঘটবে। অথচ বিপ্লবটা ঘটে গেল রাশিয়াতে ও তার পরবর্তীকালে অন্যান্য ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে, যেখানে উৎপাদন শক্তির ও অর্থ–ব্যবস্থার তেমন বিকাশ ঘটেনি। লেনিন এর ব্যাখ্যা করলেন অন্যভাবে— যেখানে বিপ্লবের কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক বিকাশ বা পুঁজিবাদের বিকাশের আর তত গুরুত্ব রইল না। তার বক্ত্যব্য ছিল যে সাম্রাজ্যবাদের উদয়ের পর গোটা পৃথিবী একই সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলে বাঁধা এবং এই chain টি ভাঙবে সেখানে যেখানে সেটা সবচেয়ে দুর্বল— অর্থাৎ যেখানে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বগুলো সব চেয়ে বেশি তীব্র। এটা লক্ষণীয় যে এই ব্যাখ্যাটি অর্থনৈতিক প্রশ্ন, বা পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক বিকাশের প্রশ্নটার পরিবর্তে এক অন্য তত্ত্ব উত্থাপন করল যেটা সরাসরি রাজনৈতিক। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রয়োজন এখন আর উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের কারণে দেখা না দিয়ে সরাসরি রাজনৈতিক কারণে সামনে উঠে আসছে। ফলে আধুনিক শ্রমিকশ্রেণি আর তার চালিকা শক্তি থাকল না, কারণ যে সমাজগুলোতে বিপ্লব হলো সেখানে শ্রমিকশ্রেণি নগণ্যই ছিল। তখন উঠে এলো শ্রমিক–কৃষক মৈত্রী বা ঐক্যের প্রশ্ন, যার সম্বন্ধে আমি পরে আরও বলব।
মার্ক্সবাদ ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তা–ভাবনাতে এই হস্তক্ষেপ এক বিশাল বড় পরিবর্তনের সূত্রপাত করতে পারত, কিন্তু সেটা হলো না। লেনিনসহ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শুরু করে চীন ও অন্যান্য সব দেশের চিন্তাবিদরা সবাই ধরে নিয়েছিলেন যে বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের বিপ্লব করতে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সমাজ বিকাশের স্তর ডিঙিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়— অতএব তাদেরকেও পুঁজিবাদের মতনই দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটাতে হবে। কৃষির জায়গা ক্রমশঃ শিল্পকে নিতে হবে, এটা যেন অবধারিত এবং পুঁজিবাদের মধ্য দিয়ে যদি সেটা বাস্তবায়িত না হয়ে থাকে, তাহলে ক্ষমতায় আসার পর কমিউনিস্টদেরই সেই কাজটা করতে হবে। এই ধারণার ফল কী হয়েছে তা তো আমরা সর্বত্র দেখেছি এবং দেখছি।
এসব কারণে আমি ‘পুঁজিবাদের পরের জীবন’ এর কথা বলেছি— সমাজতন্ত্রের নয়। বিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্রের ও মার্ক্সবাদের এই ইতিহাস থেকে অনেক কিছু শেখার ও বোঝার আছে ঠিকই কিন্তু আজ আমাদের ‘উত্তর–পুঁজিবাদী জীবনের’ কথা যে পরিস্থিতির মধ্যে ভাবতে হচ্ছে এবং যে কারণে ভাবতে হচ্ছে তা একদম আলাদা। এখানে প্রয়োজন নতুন তত্ত্বের, নতুন চিন্তা–ভাবনার ও নতুন ইতিহাস–দর্শনের। ইতিহাসের ক্রম–বিবর্তনের নিয়তিবাদী যুক্তি বর্জন করতে গেলে মার্ক্সবাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা অবশ্যই নিতে হবে কিন্তু তার মধ্যে আবদ্ধ থাকলে চলবে না।
এবার প্রশ্ন হলো ‘পুঁজিবাদের পরের জীবন’ এর অর্থ কী এবং সেটা আমরা কীভাবে ভাবব? আমার মতে আজকের দিনে, বিশেষ করে আমাদের মতো এশিয়া বা আফ্রিকার সমাজগুলোর অবস্থান থেকে পুঁজিবাদের পরের জীবনের কথা ভাবতে গেলে সর্বপ্রথম এটা বুঝতে হবে যে আজকে পুঁজি গোটা পৃথিবীর জন্য— মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা, প্রকৃতি, এমনকি জড়বস্তুর ক্ষেত্রেও একটা বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে দুটি কথা স্পষ্ট করতে চাই। প্রথমত, আমি যখন ‘পুঁজিবাদের পর’ কথাটা ব্যবহার করছি তার মানে এই নয় যে গোটা পৃথিবীতে, সমস্ত দেশের সমস্ত ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আমার যে লেখাগুলির উল্লেখ আপনি করেছেন তাতে এই বিষয়টা নিয়ে আরও বিস্তৃত আলোচনা করেছি যে এখনো পৃথিবীর বৃহৎ অংশে অ–পুঁজিবাদী সম্পর্কই বর্তমান। কিন্তু এটা আসলে উৎপাদন পদ্ধতির প্রশ্নই নয়, কারণ আজ প্রত্যেকটা জীবন (ও উৎপাদন) পদ্ধতিই পুঁজির কবলে পড়েছে। কোনোটাই বাদ পড়ে না। দ্বিতীয়ত, এই কারণেই পুঁজির দ্বন্দ্ব আজ শুধু ‘আধুনিক শ্রমিকশ্রেণির’ সঙ্গে নয়, বরঞ্চ ‘খোদ জীবন’ (life itself)-এর সঙ্গে। আদিবাসী বা indigenous people সহ মানব সমাজের সমস্ত অংশের সঙ্গে তো বটেই; তার সংঘাত আজ পশুপাখি, জন্তু জানোয়ার, গাছপালা, প্রকৃতি— সবার সাথে। এইভাবে দেখতে গেলে ‘পুঁজিবাদের পর’–এর অবস্থা কোনো বিশেষ সামাজিক স্তরের সাথে যুক্ত নয়, হতে পারেও না। এখানে পুঁজিবাদের পরের জীবনের সঙ্গে ইতিহাসের কোনো ‘অনিবার্য যুক্তি’র সম্পর্ক নেই। বড়জোর এটাকে আমাদের বর্তমানের রাজনৈতিক তাগিদ বা দাবি বলা যেতে পারে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, এভাবে দেখলে ‘জৈব–রাজনীতির’ বা biopolitics-এর অর্থও আজ অনেক বেশি ব্যাপক। ফুকো জৈব–রাজনীতি বলতে যা বোঝাতে চেয়েছিলেন তার সম্পর্ক মূলত ‘সরকার’–এর কার্যকলাপের সঙ্গে ছিল। আজকে কিন্তু পুঁজির কার্যকলাপের প্রসঙ্গে ‘biopolitics’কে অন্যভাবে বুঝতে হবে।
সারোয়ার তুষার: আপনি আপনার চার–পর্বের ধারাবাহিক প্রবন্ধ সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে ‘নয়া–বিপ্লব’–এর রূপরেখা আলোচনা করেছেন (নিগাম ২০২০খ)। একে আপনি বলছেন, ‘নয়া শাতিরীয়–কোপার্নিকাসীয় বিপ্লব’। সিরিয়ান জ্যোতির্বিদ ইবনে আল শাতিরের মডেল ধরে পরবর্তীতে পোলিশ জ্যোতির্বিদ কোপার্নিকাস পৃথিবী যে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে এবং সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে এই ধারণাকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং নতুন প্যারাডাইম তথা আদিকল্প প্রস্তাব করেছিলেন। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটা ছিল এক যুগান্তকারী বিপ্লব। একইভাবে, এই মডেলের মর্মবাণীকে সামাজিকবিদ্যা এবং দার্শনিক ক্ষেত্রে অনুসরণ করে আমরা বলতে পারি, মানুষ পৃথিবীর কেন্দ্রে নয়। এই বিবৃতি প্রকৃতির উপর মানুষের ‘সার্বভৌমত্ব’, আধুনিক পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্ব এবং সাংস্কৃতির উত্থান ও আধিপত্য, অর্থনীতি সংক্রান্ত প্রচলিত বোধ–বুদ্ধিকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আমাদের এই সাক্ষাতকারের পাঠকদের জন্য বিষয়টা আরেকটু বিস্তারিত করতে চাই। এই গ্রহের সার্বিক জীব ও জড় সত্তাকে মানুষের যজ্ঞ ও প্রয়োজন মেটানোর উপকরণ ভাবা, প্রকৃতিকে মানুষের উপনিবেশে পরিণত করা কিংবা পোষ মানানোর জ্ঞানকাণ্ড আঠারো শতক থেকে মানুষের চিন্তা ও বিশ্বাসের জগতের প্রাণ–ভোমরায় পরিণত হয়ে আছে। এই প্রবল মনুষ্যকেন্দ্রীক চিন্তাবিশ্বে অর্থনীতি হচ্ছে বৃহত্তর সেট এবং প্রকৃতি যেন তার উপসেট। ফলে মানুষের ‘সমাজ’কে প্রকৃতি থেকে এবং মানুষকে আলাদা ভাবা হলো ‘না–মানুষ’ (non-human) সত্তা থেকে। বলা যায়, ব্রুনো লাতুর কথিত এই ‘মহা–বিভাজন’ (great divide)-ই মানুষকে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে এবং অর্থনীতিকে মানব অস্তিত্বের প্রধান উদ্দেশ্যে পরিণত করল। বিপুল এবং সীমাহীন সম্পদ পুঞ্জিভবনের দর্শন ‘প্রগতি’র চিহ্ন হয়ে ওঠল।
এখন অতিমারি বা সার্বিকভাবে পরিবেশগত সংকটের ফলে মানুষী–যজ্ঞ সংকোচনের কথা উঠছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে ধরনের ইতিহাস ও তত্ত্ব চর্চা পৃথিবীর উপর মানুষের সার্বভৌমত্ব/উপনিবেশ নাকচ করে দিয়ে মানুষকে আর দশটা প্রজাতির মতো এক প্রজাতি; অর্থাৎ মানুষের ‘ভূ–তাত্ত্বিক কর্তাসত্তা’ (geological agency)-কে ‘জীবতাত্ত্বিক কর্তাসত্তা’ (biological agency)-তে সংকুচিত করবে; ইতিহাসের ‘নায়ক’ হিসেবে মানুষকে বিবৃত না করে সার্বিক জীবনের ইতিহাসে মানুষকে অবস্থিত করবে (চক্রবর্তী ২০১৬); তেমন ইতিহাস–চর্চার গুরুত্ব কতখানি? তত্ত্বের বিউপনিবেশায়নকে সেই পর্যন্ত বিস্তৃত করা প্রয়োজন মনে করেন কিনা?
আদিত্য নিগাম: শেষ থেকে শুরু করে বলি যে অবশ্যই তত্ত্বের বিউপনিবেশায়নের (ডিকোলনাইজেশান) প্রয়োজন আজ মূলত এই কারণেই দেখা দিয়েছে এবং মানুষের জায়গা যে সামগ্রিক জীবনের মাঝখানে, এই কথাটা আজ জোর গলায় বলা দরকার। মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু তো মানুষ নয়ই, ‘ইতিহাসের নায়ক’ও সে নয়— এই স্বীকৃতি আজ এক জ্বলন্ত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর সবকিছু যে তার ভোগের উপকরণ নয়, এটা স্পষ্টভাবে বোঝা ও বলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ এই ধারণার ফলে মানুষ নিজের সাথে সাথে পৃথিবীর অন্য সমস্ত জীবদের সর্বনাশও ডেকে এনেছে।
বিউপনিবেশায়নের দ্বিতীয় প্রয়োজন এই প্রশ্নটার সাথে যুক্ত আরেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে কেন্দ্র করে। সে বিষয়টা হলো প্রতিটি সমাজের তার নিজের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত করার অধিকার। আমরা এশিয়া কিংবা আফ্রিকার বর্তমানে দাঁড়িয়ে কি নতুন করে আমাদের ভবিষ্যতের সম্বন্ধে ভাবতে পারি? তার অধিকার বা ক্ষমতা কি আমাদের আছে? নাকি যেটা আমরা এতদিন জেনে ও মেনে এসেছি— যা মূলত আমাদের জন্য আগেই পশ্চিমের তাত্ত্বিক ও দার্শনিকেরা ভেবে রেখেছেন— সেটাকেই পরম সত্য মনে করে আঁকড়ে ধরে থাকব? আমাদের কাজ কি কেবল তাদের চিন্তার অবলম্বন করে এগিয়ে যাওয়া? কার্যত এই দুটি প্রশ্ন আজ এক জায়গায় এসে গেঁথে গেছে, কারণ ওই পথ ধরে যাওয়া মানে হচ্ছে তাদের ভুল ও ভ্রান্ত ধারণাগুলোর পুনরাবৃত্তি করা। একথা ঠিক যে আজকে পশ্চিমের চিন্তাবিদরাও এসব প্রশ্ন নিয়ে নতুন করে ভাবছেন কিন্তু তাতে আমাদের ভাববার দায়িত্বটা শেষ হয়ে যায় না। যে কথাটি ভালো করে উপলব্ধি করা প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে এই যে গোটা সমাজ–বিজ্ঞান যা আমরা পড়ে এসেছি এবং যা এখনো আমাদের স্কুলে–কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়ানো হয়— সবই কিন্তু মানব সমাজের এক পঞ্চমাংশেরও কম লোকের অভিজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে। তাদের অভিজ্ঞতা ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে আছে এক বিশেষ ইতিহাস ও এক বিশেষ সময়— যেটাকে আমরা আধুনিকতার ঊষাকাল বলতে পারি— আবির্ভূত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি। চার্চের আধিপত্য থেকে মুক্ত হওয়ার পর রাজনীতি, রাষ্ট্রচিন্তা ও সমাজ নিয়ে অনেক কিছু নতুন করে, বিজ্ঞান–সম্মতভাবে ভাবা হলো। তারই পাশে ভগবানের অবর্তমানে (Nietzsche’র কথায় ‘Death of God’), মানুষের স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে যে দার্শনিক চিন্তা–ভাবনা আমরা দেখতে পাই তার অনেকটাই এই পটভূমিকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। যাই হোক, এই বিষয়ের বিশদ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়।
এক অর্থে দুটি প্রয়োজনের কেন্দ্রে আছে একই প্রশ্ন— যেটাকে আমরা বলতে পারি ‘ইউরোপীয় এপিস্টেমের’ (European episteme) প্রশ্ন। এই এপিস্টেমের মূলে যে ধারণাটি কাজ করছে সেটা—আপনি ঠিকই বলেছেন—মানুষের নায়কত্বের ধারণা। কেবল ইতিহাসের নায়কই সে নয়, সে মহাবিশ্বের নায়ক, সৃষ্টির নায়ক। এবং তার উন্নতি–প্রগতির জন্যই সবকিছু বর্তমান। এবং এই প্রগতির ধারণা সর্বপ্রথম অর্থনৈতিক— মানুষের উন্নত হওয়া বা সভ্য হওয়ার মাপকাঠি নিছক এটাই। এবং এটা যে শুধু মার্ক্সবাদের ভ্রান্ত ধারণা, এমনটা ভাবা ভুল হবে। অর্থনৈতিক বিকাশই যে সভ্য সমাজের চিহ্ন এ বিষয়ে মোটামুটি আধুনিক ইউরোপের বেশিরভাগ দার্শনিক বা চিন্তাবিদ একমত। শুধু তাই নয়, এটাও মাথায় রাখতে হবে যে সমাজ বিকাশের যে ইতিহাস–দর্শন আমরা ইউরোপ থেকে পেয়েছি তাতে সমাজের ক্রমবর্ধমান বিকাশের মূলই হচ্ছে অর্থনৈতিক বিকাশ। গোটা মানব সমাজের বিকাশকে এক ধরনের ছকে ফেলা হয়ে থাকে যেটা আমরা এই সমাজ–বিজ্ঞানের দৌলতে ‘সার্বভৌম/ সর্বজনীন’ (universal) বলে মেনে নিয়েছি। অর্থাৎ আমরা আমাদের একদম পৃথক ইতিহাসগুলোকেও ওই একই ছকে রেখে তার ব্যাখ্যা করতে শিখেছি।
বিগত কয়েক দশকে ইতিহাস–ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যায় ঠিকই। বিভিন্ন সমাজের আলাদা ইতিহাসকে এখন আমরা কিছুটা স্বতন্ত্রভাবে দেখতে শুরু করেছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা মনে করি যে পুঁজিবাদের আবির্ভাবের পরে গোটা পৃথিবী, তার নানান পৃথক সমাজ, এখন একই জায়গায় এসে পৌঁছেছে কারণ তারা এখন একই ব্যবস্থার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এর পর থেকে গোটা পৃথিবীর ভবিষ্যত একই হবে।
আধুনিকতা ও পুঁজিবাদ যেহেতু ইউরোপে জন্মেছে এবং ওখানে যেহেতু এর সঙ্গে জড়িত প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা ভাবনা আগে হয়েছে, সে কারণে আমরা তাদের অনুকরণ করতে অভ্যস্থ হয়ে গেছি। সমস্যাটি এখানেই। তারা এই পথে আগে অগ্রসর হয়েছে বলেই তারা ও তাদের পথ আমাদের আদর্শ হতে হবে এমন ভাববার কোনো কারণ নেই। কিন্তু বিগত আড়াই–তিন শত বছরের ইউরোপের ও পশ্চিমের আশ্চর্য প্রগতিই বলতে গেলে ওদের পক্ষে একটা তর্ক হয়ে দাঁড়াল, যেটা সবাই মেনে নিতে বাধ্য হয়ে গেল। এর ফলে আমরা আসলে এই বিবেচনার মধ্যে যাই–ইনি যে ওদের এই প্রগতিই কি আমাদের কাম্য? কীসের উপর, কোন ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে সে প্রগতি? আজকে তো এই কথাটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে উপনিবেশবাদের ফলেই, অর্থাৎ গোটা পৃথিবীকে গোলাম বানিয়েই পশ্চিমের এই আশ্চর্যজনক বিকাশ ঘটেছে। আফ্রিকা থেকে আনা লক্ষ লক্ষ গোলামদের ছাড়া, এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাসহ পৃথিবীর অন্যত্র স্থানীয় অধিবাসীদের গণসংহার, ওই মহাদ্বীপগুলোকে বসবাসকারী উপনিবেশে (settler colony) পরিণত করা ছাড়া এই আশ্চর্য বিকাশ সম্ভব ছিল না। পৃথিবীজুড়ে অ–শ্বেত মানুষের দাসত্ব যেমন এই উন্নতি–প্রগতির মূলে ছিল, তেমনি ছিল বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানার মাধ্যমে শোষণ–দোহন। আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে এটা ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম— মানব সমাজের প্রগতির এটাই একমাত্র পথ। তাই আমাদের মতো দেশের রাষ্ট্রনেতারা আজও ওই বিকাশের স্বপ্ন দেখে চলেছেন।
দর্শনের দিক থেকে দেখতে গেলে, পরিবেশগত সংকট ও ‘মানুষ বনাম না–মানুষ’ এর যে ‘মহা বিভাজন’, যার কথা ব্রুনো লাতুর বলেন, সেটি হচ্ছে এই বিপর্যয়ের মূলে। মানুষের এক অংশকে পশু বলে গণ্য করা অথবা তাদের কে কোনো অতীতের ‘অবশিষ্ট’ হিসেবে দেখা, (যার ফলে তাদের বিলোপ ঘটানোর যুক্তি যোগান হয়ে থাকে), এবং উন্নতি–প্রগতির সেই ধারণা এই মহা–বিভাজনের মধ্যে থেকেই জন্মাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত, আপনি সঠিকভাবেই যেটাকে ‘এই গ্রহের জীব ও জড় সত্তাকে মানুষের যজ্ঞ ও প্রয়োজন মেটানোর উপকরণ’ ভাবার মানসিকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সেই মানসিকতা মানুষের এক অংশকেও তার উপকরণে পরিণত করে ফেলে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে গেলে অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই যে কয়েকশ বছর আগে আল–শাতির ও কোপার্নিকাস বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী বিপ্লবের সূত্রপাত করেছিলেন, আজ সমাজ–চিন্তার ক্ষেত্রে সে–জাতীয় একটা বিপ্লব ঘটছে। এখনো বহু দেশে রাষ্ট্র–নেতাদের ও নীতি নির্ধারকদের চিন্তা–ভাবনায় তার কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না ঠিকই, কিন্তু একথাও ঠিক যে এক অসম্ভব পরিবেশগত সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে নানা মহলে, নানাভাবে পশ্চিম প্রদত্ত অর্থনৈতিক বিকাশ–কেন্দ্রিক মডেল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বরং বলা উচিত যে প্রশ্ন তো অনেক দিন ধরেই উঠছিল— আজ আমরা তার উত্তর খোঁজার দিকে অনেকটা এগিয়ে যাচ্ছি এই আল–শাতির–কোপার্নিকাস বিপ্লবের ফলে। অন্তত আজ আর এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে সূর্য পৃথিবীকে (অর্থাৎ মহাবিশ্ব মানুষকে) প্রদক্ষিণ করে না বরং মানুষই একটা বৃহত্তর মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র অংশ যে তার ধৃষ্টতার দরুন নিজেরই সর্বনাশ ডেকে আনছে। এই চিন্তা–ভাবনা আজ পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করছে।
সারোয়ার তুষার: সর্বজনীন নূন্যতম আয় (Universal Basic Income-UBI) বিশ্বজুড়েই এক প্রগতিশীল দাবি হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু আপনি আপনার চার–পর্বের প্রবন্ধ সিরিজের প্রথম দুই পর্বে UBI-কে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। আপনার মতে UBI নির্মম ধারণা, কারণ এর ফলে ভারতসহ দক্ষিণ গোলার্ধে (Global South) পুঁজি ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের বাইরে যেসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মালিকানা আছে, UBI তাদেরকে রাষ্ট্রের জৈব–রাজনৈতিক (biopolitical) কলকব্জায় পরিণত করবে; নিজেদের জীবনের উপর তাদের যে নূন্যতম স্বায়ত্ত্বশাসন ও নিয়ন্ত্রণ আছে, সেটাকে ধবংস করবে। বরং আপনি পুঁজি–বহির্ভূত (non-capital) স্পেস তৈরির স্বার্থে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিকে (informal economy) বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন। বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টেনে ‘সংহতি অর্থনীতি’ (solidarity economy), ‘প্রয়োজনের অর্থনীতি’–এর (need economy)পক্ষে বেশ জোরালো যুক্তি তুলে ধরেছেন।
অন্যদিকে, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায় আপনাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে (Nigam 2014) কল্যাণ স্যানালের এই need economy’র ধারণাকে ‘unpersuasive’ বলেছেন। তিনি ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার রাষ্ট্রে–যেখানে শত কোটি মানুষের জন্য উৎপাদন ও বিতরণের প্রশ্ন হাজির হয় সেখানে–এই need economy’র ধারণা টেকসই (viable) হবে বলে মনে করেন না। UBI-কে জৈবরাজনীতির লেন্সে দেখাসহ পুঁজি ও রাষ্ট্রের বাইরে বিকল্প স্পেস তৈরির বিষয়ে আমাদের পাঠকদের কি বলবেন?
আদিত্য নিগাম: সর্বজনীন ন্যূনতম আয় বা Universal Basic Income নিয়ে সমস্যা, আমার মতে, দুটি স্তরে। আমি এটা কে ‘নির্মম’ মনে করি না। বরং অতিমারির পরিপ্রেক্ষিতে, যেখানে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ লোকেরা তাদের রোজগার হারিয়েছেন সেখানে এ–জাতীয় একটা ন্যূনতম আয় সত্যিই তাদের বেঁচে থাকার জন্য বেশ জরুরি একটা পদক্ষেপ বলেই মনে হয়। আমার সমালোচনা অন্য জায়গায়। এক অর্থে এটাও আমাদের পশ্চিমের মুখাপেক্ষী হওয়ার লক্ষণ। আমরা যদি পশ্চিমের, বিশেষত— ইউরোপের পরিস্থিতির দিকে তাকাই তাহলে বুঝতে অসুবিধে হবে না যে ১৯৮০’র দশক থেকে এ জাতীয় একটা দাবি কেন উঠতে শুরু করে— বিশেষ করে ইউরোপের বামপন্থী বুদ্ধিজীবী মহল থেকে। ধরুন ১৯৮০’র কাছাকাছি সময়ে আন্দ্রে গর্জ (Andre Gorz) তার বই Farewell to the Working Class-এ সোশ্যাল ইনকাম বা সোশ্যাল ওয়েজের কথা তোলেন। এই বইটার উনি ‘An Essay in Post-Industrial Socialism’ বলে পরিচয় দেন এবং ইউরোপের পুঁজিবাদের মধ্যে আসা নতুন পরিবর্তনগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে বলেন যে চাকরি আর কাজের দাবির আর এখন কোনো মানে হয় না, কারণ ইউরোপের পুঁজিবাদ যেদিকে এগোচ্ছে সেখানে কাজের অবসানই হবে আগামীকালে। পশ্চিম ইউরোপের তিনটি প্রধান শিল্পায়িত দেশের সম্বন্ধে যা অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎবাণী তখন পাওয়া যাচ্ছিল তার ভিত্তিতে তিনি বলেন যে আগামী দশ বছরে এ দেশগুলো অটোমেশনের ফলে ৪০ থেকে ৫০ লক্ষ চাকরি হারাতে বসেছে। একমাত্র যদি কাজের ঘণ্টা বেশ কিছুটা কমানো যায় তাহলেই এই চাকরিগুলো বাঁচানো যেতে পারে। সুতরাং শ্রমিকশ্রেণির উচিত কাজের দাবি না তুলে একটা ন্যূনতম আয়ের দাবি তোলা। কাজ থেকে মুক্তির কথাও তিনি বলেন (Gorz 2001)।
এবার তার ৩৫ বছর পরে জেমস ফার্গুসন তার Give a Man a Fish ছাপান। তিনি এমন এক অবস্থায় এই বইটি লেখেন যেখানে আনুষ্ঠানিক অর্থব্যবস্থার মধ্যে চাকরি প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে— মনে রাখতে হবে তার পটভূমিকায় আছে জবলেস গ্রোথের অনেক বছর। তিনি এটাও বুঝতে পারছিলেন যে বর্তমান যুগে পুঁজিবাদ আসলে এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেছে যেখানে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের তার কোনো প্রয়োজনই নেই। আমাদের যুগের পুঁজিবাদের জন্য পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ সারপ্লাস, এবং অপ্রয়োজনীয় অর্থাৎ redundant; ফলে তিনি বুঝলেন যে উৎপাদনের গণ্ডির মধ্যে আর লড়াইটা আবদ্ধ রাখার কোনো মানে হয় না। এবার লড়াইটা ‘বিতরণের’ (distribution) স্তরে লড়তে হবে (Ferguson 2015)। কে কতটা পাবে তার একটা ন্যূনতম সংজ্ঞা স্বতন্ত্রভাবে ঠিক করতে হবে— সে কাজ পাক আর নাই পাক। এই অবস্থাটি তৈরি হলো কী করে? প্রধানত এর মূলে হচ্ছে পুঁজিবাদের তৈরি করা সেই জায়গা যেখানে পুঁজি তার আধিপত্য কায়েম করে সমস্ত কৃষি/কৃষক, ছোট কারিগর–শিল্পী, ছোট কারখানাদার ও দোকানদারদের বিলোপ সাধন করতে পেরেছে। পুঁজির রাজত্বে সবাই সর্বহারা। এমতবস্থায় UBI-এর মতো দাবি ওঠাটা স্বাভাবিক।
এবার আমরা যদি আমাদের দেশগুলোর— এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর অবস্থা দেখি তাহলে সহজে বোঝা যাবে যে এখানে পুঁজির রাজত্ব সেই অর্থে কায়েম হয়নি। সেই কারণে আমাদের সমাজে কৃষক, কারিগর–শিল্পী, ছোট দোকানদার বা কারখানাদার— এক কথায় অনানুষ্ঠানিক অর্থব্যবস্থার একটা ব্যাপক জায়গা আজও আছে। ভারতে সরকারি তথ্য অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক রোজগার প্রতিশতে ১০–এর চেয়েও কম। ৯০ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকদের মধ্যে একটা ভালো রকম অংশ আছে যারা অত্যন্ত গরিব। তাদের সংখ্যার অনুপাত হবে ১৮–২০ শতাংশ যাদের জন্য অবশ্যই বিশেষ সরকারি হস্তক্ষেপ দরকার হয়। ভারতে আগের United Progressive Alliance-এর সরকার (২০০৪–২০১৪) National Rural Employment Guarantee Act (NREGA)-এর মাধ্যমে এদের জন্য কাজের এবং আয়ের ব্যবস্থা করেছিল, যার ফলে অনেকে অত্যন্ত গরিব অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। এদের জন্য প্রথম দিকে নিশ্চয়ই UBI গোছের একটা ব্যবস্থা হলে সুবিধে হয়। এদের অধিকাংশের অবশ্য কোনো ব্যাংকে খাতা ছিল না— ফলে বিশেষ চেষ্টা করে তাদের একাউন্ট খোলানো হলো, যাতে তাদেরকে direct benefit transfer (DBT)-এর মাধ্যমে পাওনা টাকাটি সোজা ব্যাংকে পৌঁছে দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও আজও ধরুন ১৯ কোটির মতো লোকের ব্যাংকের খাতা নেই। মাঝে মাঝেই ‘আর্থিক অন্তর্ভুক্তির’ (financial inclusion) কথা তোলা হয়— যার অর্থ হলো এদের সবাইকে আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং–এর মধ্যে টেনে আনা। এটা তো স্পষ্টই যে UBIও ততদিন সফল হতে পারে না যতদিন না সবাই ব্যাংকিং–এর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে — সরকারের তরফ থেকে তাদের খাতে প্রতি মাসে আয় নয় তো জমা পড়বে কী করে?
এবার প্রশ্ন উঠতে পারে আমি কেন বলছি যে শুধু সাময়িকভাবে, প্রথম দিকে এদের UBI’র আবর্তে আনা যেতে পারে— কেন আমি এটার পুরোপুরি সমর্থন করি না? দুটো কারণে। প্রথমত, আজ আমরা যদি বিশ্বজুড়ে মধ্যবিত্ত লোকেদের অভিজ্ঞতা দেখি— সেটা এশিয়ার ১৯৯৭’র সংকট হোক বা আমেরিকা ও ইউরোপের ২০০৮–এর সংকটই হোক (আর এর মধ্যে আর্জেন্টিনা ও গ্রিসের মতো দেশের কথা ভুলে যাবেন না), সেই জায়গাগুলোতে সাধারণ মানুষের সারা জীবনের সঞ্চয় মিনিটে উধাও হয়ে যেতে দেখা গেছে। অসংখ্য লোক রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে গেছে। ব্যাংকগুলি হচ্ছে পুঁজিবাদের সেই হাতিয়ার যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আজীবন সঞ্চয়ের টাকা বাজারি বড় খেলোয়াড়দের হস্তগত হয়ে থাকে। ভারতে জাতীয়কৃত ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা লুট করে এমন অনেকে এখন বিদেশে বাস করছেন যাদের সরকারই মদদ জুগিয়েছে। আসলে হের্নান্দো ডি সোটো (Hernando de Soto) যেটা অনেক গবেষণা করে বুঝলেন সেটা হলো এই যে আমাদের মতো দেশগুলিতে স্টক এক্সচেঞ্জে বা পুঁজির বাজারে যত পুঁজি আছে তার চেয়ে অনেক বেশি পুঁজি এই আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থার বাইরে থেকে যায়। এটাকে উনি ‘মৃত পুঁজি’ (Hernando 2000) আখ্যা দিয়েছেন, কারণ সেটা স্টক মার্কেটে টেনে এনে বিনিয়োগ করা যায় না। সাধারণ মানুষ যা সেভিং করেন তা ‘মৃত’ কারণ তার থেকে পুঁজিপতিরা মুনাফা অর্জন করতে পারছে না। এই কারণে আমি মনে করি গরিব মানুষের নিজেদের জীবনের উপর যতটুকু এক্তিয়ার আছে সেটুকুও তাদের থাকবে না যদি তারা এইভাবে পুঁজির কবলে পড়ে যায়।
UBI-এর কল্পনা— এবং এটা হলো আমার দ্বিতীয় আপত্তি— পুরোপুরি রাষ্ট্র–কেন্দ্রিক। কে নূন্যতম আয়টা দেবে? অবশ্যই রাষ্ট্র— রাষ্ট্র ছাড়া আর কারই বা এই অধিকার থাকতে পারে? পৃথিবীজুড়ে আমাদের যে অভিজ্ঞতা তাতে পুঁজিকে যতটা ঘৃণা করার আমাদের কারণ আছে, ঠিক ততটা নাহলেও রাষ্ট্রের উপরে ভরসা করার কি কারণ আছে? বিশেষ করে গরিব মানুষের বা ক্ষুদ্র সম্পত্তির মালিক যারা, তাদের অভিজ্ঞতা কী? শেষ পর্যন্ত এই কল্পনার মূলে যে বিশাল আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে আছে সেটা কি অস্বীকার করা যায়? মজার ব্যাপার এই যে আসলে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র জিনিসটা কী তার কোনো ধারণা আমাদের, এশিয়া–আফ্রিকার বাসিন্দাদের নেই। সেটা দেখতে ও বুঝতে হলে দেখতে হয় ইউরোপ ও আমেরিকার দিকে যেখানে মানুষের জীবনের কোনো দিক, কোনো লেনদেন— কিছুই সরকারের নজরের বাহিরে থাকে না। ফুকোর চিন্তার কেন্দ্রে যে আধুনিক রাষ্ট্র ছিল, যাকে নিয়ে তার ‘জৈব–রাজনীতি’ ও ‘গভর্মেন্টালিটি’ ধারণার সূত্রপাত, সেই রাষ্ট্র আজকের আধুনিক ইউরোপ ও আমেরিকার রাষ্ট্র। এখানে তাই এটা বলে রাখা দরকার যে পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেভাবে গভর্মেন্টালিটিকে শুধুমাত্র কল্যাণ বা welfare-এর অর্থে বোঝেন আমি তা মনে করি না। ফুকোর এই জৈব–রাজনৈতিক রাষ্ট্রটি আসলে বেশ ভয়াবহ একটা জিনিসও বটে। আর আমাদের যুগে তো সেটা আরও ভয়ঙ্কর একটা চেহারা গ্রহণ করেছে।
সেই কারণে আমি মনে করি ‘উত্তর–পুঁজিবাদী জীবন’–এর সন্ধান আসলে সাধারণ মানুষের তার জীবনের উপর এক্তিয়ারের প্রশ্নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে তার সমাধান পুঁজি বা রাষ্ট্র কোনোটাই দিতে পারে না। এবং এই কারণেই আমি ‘পুঁজি–বহিৰ্ভূত’ জায়গাগুলো খুঁজি এবং সেগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিই। সুতরাং ‘সংহতি অর্থনীতি’, ‘সমবায় অর্থনীতি’ ও ‘প্রয়োজনের অর্থনীতি’র কল্যাণ সান্যালের (Sanyal 2007) ধারণা আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ব রাখে। পার্থ–দা যেটাকে ‘unpersuasive’ মনে করেন, আমি কিন্তু তার মধ্যে সম্ভাবনা দেখতে পাই। আসলে কল্যাণ সান্যাল প্রয়োজনের অর্থনীতির কথা বলতে কোনো মুক্তির পথ দেখাচ্ছিলেন না। তিনি কেবল মাত্র আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন যে এ জাতীয় এক বিশাল এলাকা আমাদের মতো দেশগুলিতে আছে যেখানে লোকে সঞ্চয়ের (accumulation) জন্য উৎপাদন করেন না, বরং তাদের প্রয়োজন মেটাবার জন্য করেন। আমার নিজের ট্রেড ইউনিয়নে কাজের অভিজ্ঞতা এবং পরে অধ্যয়ন থেকে বলতে পারি যে যারা সাধারণ গরিব মানুষ, যারা বিশেষভাবে ‘বুর্জোয়া এথিক’ এ দীক্ষা নেননি, তাতে শিক্ষিত হননি, তারা ‘সঞ্চয়’ (accumulation)-এর কথা সচরাচর ভাবেন না।
পার্থ–দা’র সঙ্গে আমার দ্বিতীয় বড় মত–পার্থক্য আসলে অন্য জায়গাতে। উনি একজন ভালো সমাজ–বিজ্ঞানীর মতো যা ঘটে যায় তার ব্যাখ্যা করেন এবং আমাদের সেটা বুঝতে সাহায্য করেন কিন্তু আমার কাছে সমাজ পরিবর্তনের প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ। এটা একদিকে আমার অতীতের রাজনৈতিক কর্মী মনোভাব থেকে আসে হয়তো, কিন্তু পরবর্তীকালে আমি এটাও বুঝেছি যে দর্শন ব্যাখ্যা করে ভবিষ্যৎটা মাথায় রেখে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দর্শনের একটা দিক অবশ্যই ভবিষ্যৎমুখী। সুতরাং পার্থ–দা’র কথাটার সঙ্গে কিছুটা একমত হয়েও, বর্তমান অবস্থায় পুঁজির রাজত্বে প্রয়োজনের অর্থনীতি টেকসই নয়, এটাতে আমি সন্তুষ্ট হতে পারছি না। এই অর্থব্যবস্থা শুধু যে টিকে আছে তাই নয়, বরং বেড়েই চলেছে। ১৯৭১–এ আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের এক মিশন আফ্রিকাতে এই অনানুষ্ঠানিক অর্থব্যবস্থার অধ্যয়ন করতে গিয়ে পেয়েছিলেন, শুধু যে সেটা টিকে ছিল তাই নয়, বিগত দশকগুলিতে আরও বিস্তার লাভ করেছে। এটা অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে নানান সরকারি নীতি–নির্ধারকদের আশার অনুরূপ ছিল না। তারা আশা করে ছিলেন এই ‘অতীতের অবশেষ’গুলো আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং তাদের সমস্ত চেষ্টা সেই দিকেই থাকত। তাদের সকল চেষ্টা সত্ত্বেও এই সেক্টরটা বেড়ে চলেছিল এবং বেশ কিছু ধন সৃষ্টিও করছিল। তারও তিন দশক পরে হের্নান্দো ডি সোটোর কাজে এটা আরও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এই অনানুষ্ঠানিক অর্থব্যবস্থা আমাদের মতো দেশগুলিতে বেশ ভালো পরিমাণে ধন সৃষ্টি করে। মনে রাখা দরকার যে ডি সোটো কিন্তু এই অনানুষ্ঠানিক অর্থব্যবস্থার ঘোরতর বিরোধী— সমর্থক একেবারেই নন।
বুঝতেই পারছেন পার্থ–দা’র সঙ্গে আমার দ্বিমত ‘যা আছে’ তার ব্যাখ্যা নিয়ে তো আছেই, কিন্তু মত–পার্থক্যটা এর চেয়ে আরও বেশি এই কারণে যে, আমি ভাবছি পুঁজিবাদের পরের কথা— সেখানে পৌঁছতে হলে আমাদের ভবিষ্যৎ–এর অর্থব্যবস্থার কল্পনাটি কী রকম হওয়া উচিত? পার্থ–দা এখনো পুঁজিবাদ সম্বন্ধে অনেকটা মার্ক্সবাদের গণ্ডির মধ্যে থেকে ভাবেন বলে স্বাভাবিকভাবেই ওনার সাথে আমার মতের একটা অমিল থেকে যায়। আমি যে ভাবে পুঁজিবাদ এবং বিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্রের সম্বন্ধে ভাবি তাতে আমার মনে হয় ওই ভবিষ্যৎটা কোনো এক ধরনের সম্পত্তির মালিকানার (যথা রাষ্ট্রের মালিকানা) উপরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সে রকম একটা নতুন সমাজে অনেকভাবে এই প্রয়োজনের অর্থনীতিকে সমর্থন দিয়ে আরও মজবুত করা যেতে পারে।
সারোয়ার তুষার: আপনার চার–পর্বের প্রবন্ধ সিরিজ সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রশ্ন। এরপর আমরা আপনার অন্যান্য কাজের প্রসঙ্গে ঢুকব। Fascism, the Revolt of the ‘Little Man’ and Life After Capitalism (Nigam 2020c) প্রবন্ধে আপনি বৈশ্বিক ডানপন্থার উত্থানের (global rise of the right) কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। এই ডানপন্থার উত্থানকে আপনি দেখছেন বিরাজমান বামপন্থা, বাম–মধ্যপন্থা ও উদারপন্থার ক্ষয়, সংকট এবং ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে। বহু জায়গাতেই দেখা গেছে, পুঁজিবাদের সংকট ও বিপর্যয়ের উল্টো ফল হয়েছে। পুঁজিবাদের বিপর্যয়ে অবধারিতভাবে সমাজতন্ত্র হাজির না হয়ে [যেমনটা ভাবা হয়েছিল] ট্রাম্প, মোদী, বলসোনারোদের উত্থান ঘটেছে। এই ডানপন্থী বাতাবরণে বিশ্বজুড়ে ফ্যাসিবাদের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে ‘ক্ষুদে মানব’ (little man)-এর উত্থানও লক্ষ করা যাচ্ছে। এই ‘ক্ষুদে মানব’ freedom–কে বন্দিত্ব হিশেবে বিবেচনা করে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শকেই ‘মুক্তি’ ভাবে। প্রচলিত প্রগতিশীল রাজনীতিতে ‘সর্বহারা’ কিংবা ‘নিম্নবর্গ’–কে ঘিরে যে আশা ও বৈপ্লবিক রূপকল্প (revolutionary vision) বিরাজ করে, ‘ক্ষুদে মানব’ সেই ছক সম্পূর্ণ ওলটপালট করে দেয়। আবার অধিকতর ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের যে–কোনো ঘরানার রাজনীতি তো গণ–মানুষ ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। সবমিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির বিবেচনায় ডানপন্থার মোকাবেলায় গণমুখী রাজনীতির কী কী কৌশল ও নীতির প্রশ্ন ভাবা উচিত?
আদিত্য নিগাম: আসলে আমি বলব এই ‘ক্ষুদে মানব’ মুক্তি বা স্বাতন্ত্র্যকেই ভয় পায়। এমন নয় যে সে ফ্যাসিবাদ কিংবা ফ্যাসিবাদী মতাদর্শকে মুক্তি ভাবে। বরং মুক্তি তার কাম্যই নয়— তাতে তার নিজেকে অসহায় ও দিশেহারা মনে হয়। যেমনটি হয় অল্পবয়সে বাবার ছত্রছায়া হারিয়ে ফেলা বাচ্চার— হঠাৎ মনে হয় আমার দেখাশোনা করার, খেয়াল রাখার এবং আমার জন্য ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কেউ নেই। সাধারণত ছোট শহরের বাসিন্দা, এই ক্ষুদে মানব এই বিশাল জগতে নিজেকে একা ও শক্তিহীন মনে করে— যেন সে অথৈ জলে পড়েছে। নতুন দুনিয়ার সাম্যের ও স্বাতন্ত্র্যের ভাষা সে বোঝে না— বিশেষ করে নারী সমতাকেও ভয় পায়, কারণ তাতে সে চিরাচরিত পারিবারিক ও সম্প্রদায়গত কাঠামোর বিপদ দেখতে পায়। আমরা যে আধুনিক মূল্যবোধগুলোতে মুক্তির পথ দেখতে পাই— সেই একই ধারণাগুলোতে সে দেখে এমন এক বিপদ যে তার পরম্পরাগত জীবনকেই তছনছ করে দিচ্ছে। ফলে সে খোঁজে এক পিতৃসুলভ অধিনায়ক বা নেতা যে তার ভাষায় কথা বলে, ‘political correctness’-এর ধার ধারে না, নারী মুক্তি ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য’র খোলাখুলি বিরোধিতা করে এবং পারম্পরিক জীবন পদ্ধতিকে রক্ষার ভরসা দেয়। নরেন্দ্র মোদী, ডোনাল্ড ট্রাম্প বা বলসোনারোর মতো নেতাদের মধ্যে সে তার অধিনায়ক খুঁজে পায়ে। এই কথা বলার মানে এই নয় যে ফ্যাসিবাদ নিছকই কোনো অতীতমুখী বা অতীতগামী প্রকল্প। ফ্যাসিবাদ বহু অর্থে আধুনিক যুগের প্রজেক্ট এবং জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র উভয়ের খোরাক নিয়েই তার জন্ম। অথচ এ কথা ভুললে চলবে না যে আধুনিকতা ও শিল্পায়ন যেভাবে দ্রুত সমস্ত পুরোনো কাঠামো ও সম্পর্কগুলোকে তছনছ করে দিয়ে যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে, তাতে অনেকের মধ্যে নতুন যুগের ‘মুক্তির’ প্রতি ভয় ও সংশয় দেখা দেয়— সেটাও কিন্তু ফ্যাসিবাদের মতো আন্দোলনের রসদ যোগায়।
এইবার মূল প্রশ্নে আসা যাক। সাধারণভাবে বিপ্লবের প্রচলিত রূপকল্পে ‘সর্বহারা’ কিংবা ‘নিম্নবর্গ’কে ঘিরে পরিবর্তনের যে চিন্তা–ভাবনা তার দুটি দিক নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই। প্রথমত, মার্ক্সবাদের প্রভাবে সর্বহারাকে কেন্দ্র করে যে ধারণা তৈরি হয়েছে, এবং পরে গ্রামশি যেটাকে ‘নিম্নবর্গীয় সামাজিক সমূহ’ বলেছেন— এই দুটোর মধ্যে তফাৎ আছে। মার্কস যে সর্বহারার কথা উনিশ শতকের ইউরোপের অভিজ্ঞতায়, তার পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বলেছিলেন, সেটা মূলত একটি অর্থনৈতিক শ্রেণি। রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হস্তক্ষেপ করলেও তার চেহারা অর্থনৈতিকই ছিল এবং মার্কস বিপ্লবে তার যে ভূমিকা নির্ধারণ করেছিলেন তার কিন্তু তথ্যে কোনো ভিত্তি নেই। কোনো তথ্য থেকেই এটা প্রমাণ হয় না এবং করা যায় না যে সর্বহারার ঐতিহাসিক দায়িত্ব হচ্ছে সাম্যবাদের মাধ্যমে গোটা মানব–সমাজের মুক্তি সাধন করা। সে যাই হোক, মার্কস এই সর্বহারার ‘চেতনা’কে সরাসরি তার অর্থনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে যুক্ত করেন। অন্য দিকে, গ্রামশি কিন্তু লিখছিলেন ফ্যাসিজমের যুগে, অনেকটাই কারাগারের মধ্যে বসে। তার লেখায় যখন আমরা সাবলটার্ন বা নিম্নবর্গীয় সমূহের কথা পড়ি তখন কিন্তু আমরা একেবারে অন্য একটা জিনিস লক্ষ করি। গ্রামশি চেতনার প্রশ্নকে কোনো অর্থনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না করে এবার দুটি কথা বলেন— এক, নিম্নবর্গের ইতিহাস সর্বদা শক্তিশালী শ্রেণিগুলোর কার্যকলাপের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং সে কারণে সহজে ঐক্যবদ্ধ হয় না। দুই, এই সমূহগুলোর চেতনার প্রশ্ন সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের সঙ্গে জড়িত। গ্রামশির শ্রমিকশ্রেণির ও নিম্নবর্গের পরিভাষার মধ্যেই কিন্তু সংস্কৃতির বিষয় উপস্থিত আছে যার ফলে তাদের চেতনা সমাজে আধিপত্যের সুদীর্ঘ সংগ্রামের সাথে গাঁথা বলে তিনি মনে করেন। যদিও গ্রামশি সরাসরি ওই সব প্রশ্নের সম্মুখীন হননি যেগুলো ‘ক্ষুদে মানব’ ও তার বিদ্রোহ সম্বন্ধে তোলা হয়েছে, তাহলেও এটা পরিষ্কার যে তার ফ্রেমেওয়ার্কের মধ্যে আমরা এগুলোকে একটু আলাদাভাবে ভাববার সম্ভাবনা পাই। আমরা দেখতে পাই যে শ্রেণি চেতনার কী রূপ হবে সেটা আগাম বলা যায় না— সবই সংগ্রামের মধ্যে, বিশেষ করে cultural hegemony’র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ঠিক হয়। সাধারণ মানুষের ‘ক্ষুদে মানবের’ দিকটা প্রধান হয়ে উঠবে নাকি শেষ পর্যন্ত বৈপ্লবিক হেজেমনির লড়াই এর মধ্য দিয়ে তার পরিবর্তনকামী দিকটা এগিয়ে আসবে— সবটাই নির্ভর করছে রাজনীতির উপর।
সারোয়ার তুষার: উপনিবেশোত্তর সমাজ (Postcolonial Society) কি আবশ্যিকভাবে ‘non-normative’ সমাজ? প্রাচ্যবাদী (orientalist) এবং ইউরোপ–কেন্দ্রীক (Eurocentric) চিন্তায় ধরেই নেয়া হয় পশ্চিম ‘তত্ত্ব’ উৎপাদন করবে এবং অ–পশ্চিম (non-west) হবে সেই তত্ত্ব প্রয়োগ ও চর্চার ক্ষেত্র (field)। একজন উত্তর–ঔপনিবেশিক চিন্তক হিশেবে আপনার ক্ষেত্রে ‘doing theory’ কথাটার তাৎপর্য কী?
আদিত্য নিগাম: ‘Non-normative’ কথাটার অর্থ যদি এই হয় যে উপনিবেশোত্তর সমাজগুলো সমাজ বিজ্ঞান বা থিওরি দ্বারা তৈরি কোনো ছকের মধ্যে পড়ে না তাহলে নিশ্চয়ই আমার উত্তর হবে ‘হ্যাঁ, তারা আবশ্যিকভাবে নন–নর্মেটিভ’। মিশেল ফুকো যে অর্থে ‘নর্ম’–এর কথা বলেন— অর্থাৎ আদর্শ ঠিক নয় বরং যেটা থেকে normal কথার আভাস পাওয়া যায়— সে অর্থে নর্মেটিভ হতে গেলে আমাদের হয় male হতে হয়, নয় female হতে হয়। এই অর্থে আমাদের ‘অদ্ভুত’ মনে হতেই পারে কারণ আমাদের কোনো কিছুই তো মেলে না তাদের তত্ত্বের দিক থেকে দেখতে গেলে। পুঁজি ও শ্রমের বাহিরে যে আমাদের সমাজগুলোতে এক বিশাল জগৎ আছে সেটাও তারই একটা উদাহরণ। আমি যেটা অনেক সময় ছাত্রদের বলে থাকি, ওই তত্ত্বের কাছে উত্তর খুঁজতে গেলে ভাবতে হবে আমরা নাকি কিছুই জানি না, কিছুই বুঝি না, আর কিছুই ঠিক মতো করি না। মনে হবে এই পৃথিবীর পাঁচ ভাগের চার ভাগ লোক, যারা এই সমাজগুলোতে বাস করেন, তারা না পেরেছেন আধুনিক হতে, না বোঝেন সেক্যুলারিজম, আর না পেরেছেন গণতন্ত্র গড়ে তুলতে। এমনকি তাদের পুঁজিবাদ ও বিকাশও ‘অবরুদ্ধ’ ও প্রতিবন্ধিত। এর কারণ কিছুটা আগের একটা প্রশ্নের উত্তরে আলোচনা করেছি — ইউরোপের ইতিহাস যে পথে অগ্রসর হয়েছে এবং সেটাকে ইউরোপের চিন্তাবিদ ও দার্শনিকরা যেভাবে বিধিবদ্ধ করেছেন, সেভাবে যদি আমরা না এগোই তাহলেই আমাদের ‘উদ্ভট’ মনে হবে। আর আমরা যেভাবে ওই জ্ঞান বা তত্ত্বকে রপ্ত করেছি তাতে আমাদের তত্ত্ব নিয়ে ‘গল্প করা’ ছাড়া কিছু করার থাকে না।
ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী ভূদেব মুখোপাধ্যায় একদা বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার সম্বন্ধে বলেছিলেন যে আমাদের এখানে বিজ্ঞান করা হয় না, কেবল বিজ্ঞানের গল্প করা হয়। সমাজ বিজ্ঞান ও দর্শনের ক্ষেত্রে আজ সেই একই কথা বলা যায়। আমরা ওদের তাত্ত্বিকরা কী বললেন তার গল্প করতে বেশি ভালোবাসি। ‘থিওরি করা’টা (‘doing theory’) কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। থিওরি করা মানে হলো নিজের সময়ের, নিজের বর্তমানের সঙ্গে কুস্তি করা, তার চ্যালেঞ্জটা বোঝা এবং তার মধ্যে থেকে পথ বার করা। পশ্চিমে তৈরি জ্ঞান ও তত্ত্ব আওড়াতে থাকলে এই কাজটা করা সম্ভব নয়। আমাদের জ্ঞান উৎপাদনের পদ্ধতি এমনই হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আমরা ভাবি তত্ত্বের কারবারটা পশ্চিমের— আর আমাদের কাজ হচ্ছে শুধু সেটাকে আমাদের সমাজগুলোতে প্রয়োগ করা। বড়জোর ‘আমাদের তথ্য’ দিয়ে ওদের তত্ত্বকে ‘টেস্ট’ করা। এমন না যে টেস্ট এ ফেল করলে থিওরিটা বর্জন করা হবে, বরং ফেল করে যায় আমাদের সমাজগুলো। এখানে তাদের তত্ত্ব কার্যকরী না হওয়ার কারণ আমরা আমাদের নানান ‘অভাব’ এর মধ্যে খুঁজি। কেন সেকুলার হতে পারছি না, কেন গণতন্ত্র গড়তে পারলাম না ইত্যাদি সব মনোভাব সেই অভাববোধ থেকেই আসে। আসলে আদৌ কি সেক্যুলার হওয়া আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বা হতে পারে, এই প্রশ্ন উঠতেই দেওয়া হয় না।
আমি এটা অন্য জায়গায় উল্লেখ করেছি যে চার্চ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার যে ধরনের একীকরণ ইউরোপে ছিল সেটা পৃথিবীর অন্যত্রে খুব কমই দেখা যায়। ইসলামে তো চার্চের মতো কোনো সংস্থা ছিলই না, আর হিন্দুদের তো সে অর্থে কোনো কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রও ছিল না। চীন বা জাপানে ‘রিলিজন’ বলতে (ইংরিজিতে) যা বোঝায় সে রকম কোনো ব্যাপার ছিল না। এই সমস্ত দেশে ও সমাজে রাষ্ট্র মূলত ধর্মীয় রাষ্ট্র ছিল না। ভারতবর্ষে প্রাচীন কাল থেকে কোনো ধর্মীয় রাষ্ট্রের নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র কোনো ধর্মীয় রাষ্ট্রের বই নয়। গোটা ইউরোপ যখন চার্চের পায়ে লুটোচ্ছে, যাকে পরে ‘dark middle ages’ বলা হলো, সেই সময়ে ভারতে সালতানাত বা মুঘল সাম্রাজ্য শরিয়ার ভিত্তিতে দেশ শাসন করছিল না। বরং আকবার–এর সময় হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয় এবং ‘দিন–এ–ইলাহী’র মতো একটা নতুন ধর্ম প্রবর্তনের চেষ্টা করা হয়। আরব দুনিয়ায় বিজ্ঞান ও দর্শনের বিশাল অগ্রগতি ৮ম এবং ৯ম শতাব্দী থেকে দেখা যায়। এই বৃহৎ ইতিহাসের কোনো চর্চাই হবে না, তার থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করে হবে না, এবং তত্ত্বের দিক থেকে এটা অবহেলিত থাকবে— এরকম অবস্থায় আমাদের কাছে সেকুলারিজম–এর মন্ত্র উচ্চারণ করা ছাড়া আর উপায় কী থাকে? আমার মতে আমাদের থিওরি করার মানে সর্বপ্রথম আমাদের নিজেদের ইতিহাসকে তত্ত্বের দিক থেকে বোঝা।
সারোয়ার তুষার: গণমুখী রাজনীতিতে প্রায়ই “সাধারণ মানুষ”–এর একটা সুনির্দিষ্ট ইমেজ কল্পনা করে নেয়া হয় যা অনেকসময়ই বিভ্রান্তি তৈরি করে। অথচ আজকাল অনেক চিন্তকই বলছেন যে বিশেষত আমাদের মতো একদা উপনিবেশিত (colonized) অঞ্চলে আদতে একক ও অবিভক্ত (singular and unitary) কোনো “জনতা” নেই।
এই যে “জনতা”র একটা সুনির্দিষ্ট ইমেজ কল্পনা করে নেয়া, তাদেরকে বিপ্লবের/পরিবর্তনের উপাদান ভাবা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদিকে লিনিয়ার একটা টাইম ফ্রেমের ভবিষ্যত কোনো বিন্দুতে কল্পনা করে নেয়া অনেকসময় ফ্যাটিশ তৈরি করে বলে আমার ধারণা। ফলে রাজনীতিটা হয়ে দাঁড়ায় ইউটোপিয়ান। ইউটোপিয়া খারাপ তা বলছি না। যারা অ্যান্টি–ইউটোপিয়ান আমি তাদের বিরুদ্ধে। মানুষের ইউটোপিয়া থাকতেই হয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ইউটোপিয়ান রাজনীতি “যা কিছু ভালো” তাকে ভবিষ্যতে স্থাপন বা কল্পনা করে নেয়। “ভালো সবকিছু” ভবিষ্যতে ঘটবে, সেই ভবিষ্যতের পানে অপার হয়ে তাকিয়ে থাকার তাড়না সৃষ্টি করে। ফলে বর্তমানকে দেখা হয় একটা কন্সপিরেসির চোখ দিয়ে। কারও কাঁধে দোষ চাপানো বা আহাজারি তখন রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসে। পরিবর্তন–প্রত্যাশীরা আর বর্তমানের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না অনেক সময়। ছিটকে পড়ে।
“জনতা”র একটা সুনির্দিষ্ট ইমেজ ধরে নেয়া এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন বা রূপান্তরকে ভবিষ্যতের কোনো বিন্দুতে কল্পনা করার এই লিনিয়ার টাইম ফ্রেমকে আপনি কীভাবে দেখেন?
আদিত্য নিগাম: আপনার প্রশ্নটা ঠিকই কিন্তু এটার উত্তর হিসেবে খুব বেশি বলতে চাই না। কারণ এখনো এই বিষয় নিয়ে আমি অনেক কিছু নতুন করে ভাবছি। তবে আমার মনে হয় যে ইউরোপের ইতিহাসে Death of God, অর্থাৎ Christianity’র একেশ্বরবাদী ভগবানের বিদায় নেওয়ার পরে এবং রাষ্ট্রের একটা স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার মুহূর্তে অনেক প্রশ্ন এই বিশেষ প্রসঙ্গে ওঠে। এর আগে তো রাজা ভগবানের প্রতিনিধি ছিল। এবার প্রশ্ন দেখা দিলো রাজনৈতিক ক্ষমতাকে অন্য একটা জমিতে দাঁড় করাবার— এই ক্ষমতার উৎস কোথায় হবে? জনগণ বা ‘জনতা’ ছাড়া আর কার থেকে সেই ক্ষমতা তার বৈধতা পেতে পারে? আর কিছুটা ভগবানের মতো জনতারও একক ও অবিভক্ত will বা ‘ইচ্ছাশক্তি’ কল্পনা করার প্রয়োজন দেখা দিলো। আসলে শুধু একদা উপনিবেশিত দেশগুলোতেই নয় এই জাতীয় একক ও অবিভক্ত will কোথাওই দেখা যায়নি। ফ্যাসিজম তার চেষ্টা করেছে ঠিকই কিন্তু এটা কল্পনার বেশি কোনো কালেই কিছু ছিল না।
সময়ের ব্যাপারটা আমার মনে হয় একটু আলাদা— যদিও তার সম্পর্কও খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে আছে। মার্ক্সবাদে এবং সাধারণভাবে ইউরোপীয় ইউটোপিয়ান চিন্তা–ভাবনা যে মুক্তি ও ‘ভালো সব কিছু’ সুদূর ভবিষ্যতে দেখে তার শিকড় ওখানেই খুঁজে পাওয়া যাবে। জান্নাত থেকে নির্বাসিত হওয়ার পরে মানুষ ‘ঐতিহাসিক সময়’–এর মধ্যে এসে পড়ে যেখান থেকে মুক্তি পেয়ে সে আবার সেই অবস্থায় ফেরত যাবে যেখানে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। শ্রেণিবিহীন সমাজের কল্পনা অনেকটা এই তত্ত্বকেই অবলম্বন করে।
সারোয়ার তুষার: আপনার Democracy, State and Capital: The ‘Unthouht’ of 20th Century Marxism (Nigam 2009) প্রবন্ধটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। আমার ধারণা মার্ক্সবাদী–মাওবাদী এবং সংসদীয় উদারনৈতিক গণতন্ত্রী; এই দুই শিবিরই এই প্রবন্ধের প্রচণ্ড বিরোধিতা করবে (হয়তো করেছেও)। একদিকে আপনি ‘mass democracy’-কে liberal parliamentarianism/ constitutionalism থেকে পৃথক করছেন এবং বলছেন যে, mass democracy আসলে উদারনৈতিক সাংবিধানিক রাজনীতির ‘anti-thesis’; আবার অন্যদিকে আপনি বলছেন, প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র (dictatorship of the proletariat), গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা (democratic centralism) ইত্যাদি রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘entry of masses’-এর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। এখানে আমার কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তর্ক মনে হয়েছে, আপনি কথিত ‘আইনের শাসন’–এর রূপকথা, তথাকথিত বৈপ্লবিক ভ্যানগার্ড তত্ত্ব এবং ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ; এই প্রত্যেকটির চূড়ান্ত অভিমুখ হিসেবে সার্বভৌম ক্ষমতাকে (sovereign power) উন্মোচন করেছেন এবং গণতন্ত্রকে এর বিপরীতে তুলে ধরেছেন। এজন্যই জনগণের প্রকৃত উত্থানকে ম্যানেজ করতে হয় কোনো না কোনো বর্ণের রাখাল–বালক তত্ত্ব (vanguardism) টিকিয়ে রাখার স্বার্থে।
কিন্তু বিশ শতকের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, যে–কোনো বৈপ্লবিক/রূপান্তরকামী/পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক প্রকল্প যদি রাষ্ট্র–ক্ষমতা দখলে মনোযোগী হয়, তাহলে চূড়ান্ত বিচারে তা পুঁজির পুঞ্জিভবনে (accumulation of capital) গিয়ে থামে। তথাকথিত অনেক ‘সমাজতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুঁজিবাদকে আরও নির্মম চেহারায় দেখা গেছে [চীনের ক্ষেত্রে তো অনেকসময় কৌতুক করে বলাই হয়, socialism is the quickest way to capitalism]। আপনি দেখাচ্ছেন যে, [সমাজতন্ত্রের সাইনবোর্ড সম্বলিত রাষ্ট্রসমূহের] এই পুঁজিবাদের দিকে অগ্রসর হওয়াটা কোনো ‘সংশোধনবাদ’ (revisionism)-এর ফল নয়; বরং খোদ রাষ্ট্র, আধুনিকতা এবং পুঁজির আন্তঃসম্পর্কের অনিবার্য পরিণতি (আপনার ভাষায়, the logic of the modern state itself is bourgeois..)।
উপরের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আপনার কাছে আমার জিজ্ঞাসা দুটি। প্রথমত, আপনি যাকে বলছেন mass democracy, সেই mass democracy’র পথ ধরে কী করে পুঁজি ও রাষ্ট্র–কর্তৃত্বকে ছাপিয়ে যাওয়া (beyond state and capital) সমাজ–সম্পর্ক ভাবা সম্ভব? দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রবাদী (statist) রাজনৈতিক চিন্তার আধিপত্যের বিপরীতে যারা অবস্থান করেন, তাদের নীতি–কৌশল কেমন হতে পারে?
আদিত্য নিগাম: ‘Socialism is the quickest way to capitalism’ কথাটা বেশ মজার— আমি এটা আগে শুনিনি। বিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে যে আলোচনা এই লেখাটিতে আমি করেছি তার প্রস্থান বিন্দুও এটাই— কেন বারে বারে কমিউনিস্টরা বিপ্লব করেও শুধু পুঁজিবাদই গড়েন। আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তরে এই বিষয়টা নিয়ে কিছু বলেছি কিন্তু এই বিষয়টির বিশদ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। আপনার যে বিশেষ প্রশ্ন দুটি, সেগুলোর উত্তর দেওয়ার আগে এটা বলে দিই যে ওই লেখাটার মধ্যে অনেক কিছু নিয়ে আমি এখনো ভাবছি। যখন লিখেছিলাম, প্রায় ১২ বছর আগে, তখন একটা বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে ওই প্রশ্নগুলো উঠছিল। ভারতীয় মাওবাদ নিয়ে নতুন করে একটা বিতর্ক তো উঠছিলই, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা নিও–লিবারেলিজম নিয়েও প্রশ্ন উঠছিল। ২০০৮–এর বিশ্ব পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক সংকটের অনেক আগেই কৃষকদের জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলনগুলি তুঙ্গে উঠে গিয়েছিল। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে যেখানে একটি বাম ফ্রন্ট সরকার তিন দশক ধরে রাজত্ব করছিল, সেখানে ওরাও শেষ পর্যন্ত কৃষিকে উৎখাত করে তার জায়গায় পুঁজিবাদ গড়তে চেয়েছিল। ‘চীনের পথ’ অবলম্বনে ‘Special Economic Zone’ই গড়তে চেয়েছিল, কিন্তু চীনের মতো সুবিধে এখানে হয়নি। যেহেতু আমরা একটা গণতন্ত্র, সেই গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামে কৃষকরা আন্দোলনে নামলেন। এর ফলে শেষে পশ্চিমবঙ্গে মার্ক্সবাদীদের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটল।
যাই হোক, এর পর ১২ বছরে এই সমস্ত প্রশ্ন নিয়ে আরও অনেক ভাববার সুযোগ হয়েছে, নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে। পরবর্তীকালে সারা বিশ্বে যেভাবে দক্ষিণপন্থার অভ্যুদয় হয়েছে তার আলোকে এই বিষয়গুলির আরও গভীর বিশ্লেষণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এটাও বলে রাখা দরকার যে ‘mass democracy’ কথাটা আমার নয় বরং ওটা নাজি সমর্থক আইনবিদ কার্ল স্মিট ব্যবহার করেন। তার মতে উদারতাবাদ ও সংসদীয় প্রতিনিধি ব্যবস্থা আসলে গণতন্ত্র নয়। মনে রাখা দরকার যে এই মতামত স্মিটের একার নয়। তখনো ছিল না এবং আজও জাক রান্সিয়েরের (Jacques Ranciere) মতো বামপন্থী দার্শনিকেরা এই ব্যাপারে অন্তত স্মিটের সাথে একমত। স্মিটের উদ্দেশ্য অবশ্য নাজি রাজনীতির পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো ছিল, যেটা অন্যরা সমর্থন করতে পারেন না। যাই হোক, একথা অস্বীকার করা যায় না যে উনিশ শতকজুড়ে সারা ইউরোপে ভোটের অধিকারের যে লড়াই চলে তার সঙ্গে তখনকার প্রতিনিধি ব্যবস্থার একটা দ্বন্দ্বও দেখা দেয়। রান্সিয়ের মনে করিয়ে দেন যে লিবারেল প্রতিনিধি ব্যবস্থার সূত্রপাত গণতন্ত্রের বিস্তারের জন্য নয়, তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য হয়েছিল। পরবর্তীকালে অবশ্য দেখা গেল যে কার্ল স্মিটের অর্থে মাস ডেমোক্রেসির বহিঃপ্রকাশ ফ্যাসিজমের মাধ্যমে হলো।
যে প্রশ্ন স্মিটের পরেও থেকে গেছে সেটা হলো এই যে: ‘জনতার একক ও অবিভক্ত ইচ্ছা’কেই যদি আমরা গণতন্ত্রের সমার্থক মনে করে নিই, তাহলে এটাও বুঝতে হবে যে এই ‘ইচ্ছা’ আগে আসে না, বরং অধিনায়ক শাসক প্রয়োজন মতো সেটা গড়ে নেয়। বিস্তর আলোচনার সম্ভাবনা এখানে নেই কিন্তু এটুকু তো বলা যেতে পারে আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তরে যে mass demcracy’র ভিত্তিতে নতুন কিছু— পুঁজি ও রাষ্ট্রকে ছাপিয়ে যাওয়া কিছু— ভাবা সম্ভব নয়। আজ পৃথিবীজুড়ে গণতন্ত্রের থিওরি ও ব্যবহার এক অভূতপূর্ব সংকটের সম্মুখীন। নতুন ভাবনা চিন্তার জরুরি প্রয়োজন আছে।
আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন— যারা রাষ্ট্রবাদী রাজনৈতিক চিন্তার বাহিরে গিয়ে ভাবেন তাদের নীতি ও কৌশলের প্রশ্ন কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখানে অনেক কিছুই বলা যেতে পারে কিন্তু আমার মনে হয় আসল যে বিষয়টি আমাদের বুঝতে হবে সেটি হলো এই যে আজকে বসে বিংশ শতাব্দীর সেই ‘ব্যক্তিগত’ বনাম ‘রাষ্ট্রীয়’ সম্পত্তির মালিকানা এই বাইনারির মধ্যে ভাবলে আর চলবে না। আমি আগেই বলেছি যে আমাদের সামনে প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে পুঁজি ও রাষ্ট্র এই দুই–এর হাত থেকেই সাধারণ মানুষের স্বাতন্ত্র্যকে রক্ষা করা। এবার এখানে আরও যোগ করতে চাই যে ব্যক্তিগত মালিকানা বা উদ্যোগ মানেই পুঁজিবাদ নয়। কল্যাণ সান্যালের ‘প্রয়োজনের অর্থব্যবস্থার’ আলোচনা থেকে যেটা স্পষ্ট বোঝা যায় সেটা হলো এই যে ব্যক্তি–মালিকানা সত্ত্বেও একটা বিশাল ক্ষেত্রজুড়ে লোকে পুঞ্জীভবনের/পুঁজিকরণের তর্কের বাহিরে থাকতেই পছন্দ করেন। আমার লেখাগুলোতে আমি ল্যাটিন আমেরিকায় ‘সংহতি অর্থনীতি’ নামে যে প্রয়োগগুলো চলছে, তার উল্লেখও করেছি। এদের মালিকানার স্বরূপ ব্যক্তিগত ও সম্প্রদায়গত — দুইয়ের সমন্বয়ের ভিত্তিতে কাজ করে। এখানে ভাগ করে নেওয়ার অর্থাৎ sharing-এর ব্যাপারটা প্রধান। ইউরোপে বিভিন্ন জায়গায় এনার্কিস্টরা সমবায় নিয়েও কাজ করেছেন।
এই সকল উদাহরণ থেকে আমরা দেখতে পাই যে অন্য এক উত্তর–পুঁজিবাদী অর্থনীতির উপাদান আমাদের এসব অভিজ্ঞতার মধ্যেই আছে। এবার প্রশ্ন উঠতে পারে যে এইগুলোর ভিত্তিতে কি কোনো রাজনীতি দাঁড় করানো যায়? আমি মনে করি এটা সম্ভব, কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মতে প্রশ্নটা এর চেয়ে অনেক বড়: আমার দিন দিন এই ধারণা দৃঢ় হচ্ছে যে রাজনীতি কোনো সমস্যার সমাধান নয় বরং সকল সমস্যার উৎস। ‘রাজনীতি’ বলতে এখানে আমি বোঝাতে চাইছি পার্টিগত, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক রাজনীতি— যার মাধ্যমে গোটা সমাজ এক বিশাল মেশিনে পরিণত হয়ে যায়, মানুষ তার কলকব্জা মাত্র হয়ে থেকে যায়। গণতন্ত্রের বর্তমান সংকটের সঙ্গে এটার একটা গভীর সম্পর্ক আছে। আপাতত, এটাকে প্রশ্ন হিসাবেই ছেড়ে দিতে চাই। এর মানে অবশ্য এই নয় যে এর মধ্যে আমাদের হাতের উপর হাত রেখে বসে থাকতে হবে— বরং আমাদের এক নতুন ধরনের বামপন্থা গড়ে তোলার দিকে সচেষ্ট হতে হবে।
সারোয়ার তুষার: ভারত ও বাংলাদেশসহ প্রায় সমস্ত উত্তর–ঔপনিবেশিক সমাজে একটা খুব শক্তিশালী মতামত চালু আছে: ইউরোপের উপনিবেশ হওয়াটা ছিল প্রাচ্যের ‘অনিবার্য’ নিয়তি (fate)। এরকম অনড় সমাজব্যবস্থাকে গতিশীল করা এবং বিকশিত করা ছিল উপনিবেশবাদের ‘ঐতিহাসিক কর্তব্য’ (historical responsibility)। ভারতীয় সমাজব্যবস্থার নিজস্ব কোনো গতি নেই–ইউরোপীয় এই দাবির বিরোধিতা যে হয়নি তা না, বিরোধিতা হয়েছে। কিন্তু সেই ইউরোপীয় ছকেই রেনেসাঁস, রিফর্মেশন, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদের ইতিহাস আমরা খুঁজেছি। খুঁজতে গিয়ে যে প্রক্রিয়ার যা প্রত্যাশা করেছি তা তো হয়নি। সব উল্টে গিয়েছে। (চট্টোপাধ্যায় ২০১৫)
এর ফলাফল অন্তত দুই–দিক থেকে ভয়াবহ হয়েছে বলে আমার ধারণা। একদিকে, ‘যা কিছু পশ্চিমের’ তাকে ‘বহিরাগত’ তকমা দিয়ে একদল ‘অতীত–ঐতিহ্য’ অনুসন্ধান এবং এক ধরনের অতীতবাদী (pastist) ও গোষ্ঠী–জাতীয়তবাদী (ethno-nationalist) হয়ে ওঠেছে। অন্যদিকে, আরেকদল ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্ব ও অনিবার্যতায় এতটাই মজেছে যে, ‘যা কিছু পশ্চিমের’ তাকে প্রায় ‘অলঙ্ঘনীয়’ জ্ঞান করতে শুরু করেছে এবং নিজেদের সমাজকে ইউরোপের ‘বিকৃতি’ ভেবেছে। পার্থ চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছেন, দোষটা কি আমাদের সমাজ–ব্যবস্থার? নাকি আমাদের বিশ্লেষণের উপকরণের? যে তত্ত্বের ভেতর দিয়ে দেখছি, সেটাই হয়তো উপযুক্ত নয়। (চট্টোপাধ্যায় ২০১৫)
সোহিনী চট্টোপাধ্যায়কে (Nigam 2018) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আপনিও বলেছেন, পুঁজিবাদ কেন ‘যেভাবে বিকশিত হওয়ার কথা’ সেভাবে বিকশিত হচ্ছে না এই নিয়ে অ–পশ্চিমা (non-west) অঞ্চলগুলোতে বিস্তর তর্ক–বিতর্ক হয়ে গেলেও, পুঁজির সর্বজনীনতার দাবির (claim of universality) ব্যাপারে মোটাদাগে নিঃসংশয় অবস্থান দেখা গেছে। (আপনার ভাষায়: We could look at the Marxist debate in much of the non-West from the 1960s onwards— dependency, unequal exchange and accumulation in peripheral capitalism— as an instance. For decades, we debated why capitalism was not developing in the non-West as it ‘should have’— but instead of asking if something was wrong with the theory (the universal history of capital, for instance), we debated what was wrong with these societies!)
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রশ্নটাই একটু ভিন্নভাবে করতে চাই— কেন আমরা আমাদের বিশ্লেষণের উপকরণগুলোকে ‘অবধারিত’ ধরে নিয়েছি? দ্বিতীয়ত, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ‘সর্বজনীনতা’কে প্রশ্ন করার পাশাপাশি সংকীর্ণ অতীতমুখিতা কিংবা উগ্র স্বদেশিয়ানার (ultra-nativism) বিরুদ্ধে আমরা কী করে অর্থবহ কায়দায় আলাপ তুলতে পারি?
আদিত্য নিগাম: আসলে যারা এটা ভাবেন যে প্রাচ্যের সমাজগুলির সম্বন্ধে মার্কস ১৮৫০’র দশকে যা লিখে গেছেন সেটাই তাদের আওড়ে যেতে হবে তাদেরকে আমার কিছু বলার নেই। মার্ক্স তার ভারত সম্বন্ধে সেই সময়ে যা লিখেছেন তার থেকে ওনার নিজেরও দৃষ্টিভঙ্গি অনেক পাল্টে গেছিল ১৮৬০’র পরে এবং বিশেষ করে ১৮৭০’র পরে যখন তিনি রাশিয়া এবং ভারতসহ প্রাচ্যের দেশগুলো নিয়ে গভীর অধ্যয়ন শুরু করেন। আগের লেখাগুলোতে তিনি যে মনে করতেন উপনিবেশবাদ ‘ইতিহাসের অচেতন হাতিয়ার’ হয়ে এই দেশগুলোতে এসেছে সেই ধারণা পরে অনেক পাল্টে গিয়েছিল। তাছাড়া ভারতে অনেক বছর পর ইরফান হাবিব, ডি ডি কোসাম্বি, রামশরণ শর্মা ও রোমিলা থাপারের মতো মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদরা তাদের গবেষণার মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছিলেন যে ‘ভারতীয় সমাজ ‘অনড়’ ও পরিবর্তনহীন’— এ ধারণা একদম ভুল। আপনার এই কথা ঠিক যে অনেক সময় যখন এই ধারণাগুলোর সমালোচনা হয়েছে তখনো সেই ইউরোপীয় ছকের মধ্যে ফেলে দেখার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু ওই সব কথা বাদ দিলেও আজকের দিনে গোটা পৃথিবী থেকে এত নতুন গবেষণা সামনে আসার পরে উপনিবেশবাদ সম্বন্ধে মার্ক্সের ১৮৫০’র দশকের উক্তিগুলোকে ধরে বসে থাকার কোনো মানে হয় না।
দ্বিতীয়ত, আমি মনে করি না যে কেবল মাত্র পশ্চিমের গুণকীর্তনে মগ্ন থাকলে উগ্র–জাতীয়তাবাদ বা উগ্র–স্বদেশিয়ানার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। বরঞ্চ, যত বেশি আমরা তা করব তত বেশি আমরা ওই শক্তিগুলোর রসদ জোগাব। আজ এই বিষয়ে কি কোনো সন্দেহ আছে যে আমাদের মতো দেশগুলোতে যারা নিজেদের আধুনিক ও সেক্যুলার বলেন তারা যেভাবে তাদের নিজেদের অতীতকে খারিজ করে পশ্চিম–ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন তাতে তারা সাধারণ মানুষ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন? আজ তার ফলে উগ্র–জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোর সুবিধা হয়েছে এবং তারা তাদের উদ্ভট ‘ইতিহাস ব্যাখ্যা’ লোকেদের মধ্যে প্রচার করতে পেরেছে। এই ব্যাপারে আমি পার্থ–দা’র সঙ্গে একেবারে একমত যে দোষটা আমাদের সমাজগুলোর নয়, বরং আমাদের বিশ্লেষণ–উপকরণের। তার ফলে আমরা আমাদের সমাজে যা আছে বা যা ছিল তার কোনো মূল্য দেখতে পাই না আর কেবল কখনো feudalism, কখনো secularism, কখনো renaissance খুঁজে বেড়াই। আর না পেলে হতাশ হই।
সর্বজনীনতার প্রশ্নটা বেশ জটিল। কিন্তু আমার মনে হয় সেটা অন্য দিক থেকে ধরলে ভালো হয়। আপনার প্রশ্নে মোটামুটি ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে তার সঙ্গে ‘সংকীর্ণ অতীতমুখিতা বা উগ্র–স্বদেশিয়ানার বিরুদ্ধে অর্থবহ আলাপ’ তুলতে পারার সোজা সম্পর্ক আছে। আমার প্রশ্ন হলো, বিগত দুয়েক শতকের অভিজ্ঞতা, সর্বজনীনতার একচেটিয়া আধিপত্যের অভিজ্ঞতা, এ বিষয়ে কি আমাদের আশ্বস্ত করে যে তার ভিত্তিতে কোনো ‘অর্থবহ আলাপ’ সম্ভব হয়েছে? আজকে বিশ্বজুড়ে সর্বজনীনতা প্রশ্নবিদ্ধ কেন? এবং প্রশ্ন তুলছে কারা? দুনিয়ার আদিবাসী (indigenous population) যাদের গণ–সংহার তো হয়েইছে; আবার তাদের অতীতের বস্তায় ফেলে আমরা–আধুনিকরা–সর্বজনীনতার বুলি কপচাই। আর প্রশ্ন ওঠে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা একদা উপনিবেশিত, নানান সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর দিক থেকে। তার কারণ হচ্ছে সর্বজনীনের বিষয়বস্তু (content) তো আগের থেকে ঠিক করা আছে। এটা তার প্রকৃতি— কতগুলো principle ধরেই তো আমরা দাবি করতে পারি যে এগুলোর ভিত্তিতে ‘অর্থবহ আলাপ’ করতে হবে। সে কারণে আজ দর্শনের ও দার্শনিকদের কাছে এটা এক বিশাল বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার মনে হয় সর্বজনীনের কোনো বিষয়বস্তু আগের থেকে নির্ধারিত করলে চলবে না— তার মানে এই যে, সর্বজনীন ওই ‘অর্থবহ আলাপের’ শেষে হয়তো আবির্ভূত হতে পারে। ততদিন এই আলাপ আধুনিক অর্থে আলাপ হবে না— যেখানে আমরা পরস্পরকে যুক্তির ভিত্তিতে নিজের মতের দিকে টানবার, convince করার চেষ্টা করি। ততদিন এই আলাপের ধরন আলাদা হতে বাধ্য— আমরা একে অপরকে গল্প শোনাতে পারি, তাদের গল্প শুনতে পারি, কিন্তু কেউ কাউকে দলে টানবার চেষ্টা করবে না। চেষ্টা করব সাক্ষাৎটা শেষ হওয়ার পরেও বুঝবার। এর জন্য সম্পূর্ণ একটা আলাদা মনোভাব দরকার।
সারোয়ার তুষার: আপনার কাজে মার্ক্স ও মার্ক্সবাদ ফিরে–ফিরে আসে। আবার আপনি উত্তর–ঔপনিবেশিক (Post-colonial) চিন্তক হিসেবেও সমাদৃত। তথাকথিত ‘তৃতীয় বিশ্বের’ বাস্তবতায় এটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। কারণ আপনার লেখালেখিত মার্ক্সবাদ ও উত্তর–উপনিবেশিকতাবাদ দুই–ই প্রবলভাবে উপস্থিত। কিন্তু আমাদের অঞ্চলের মার্ক্সবাদের অনুসারিরা (পার্টিজান এবং নন–পার্টিজান উভয় ঘরাণাই) উত্তর–উপনিবেশিকতাবাদ, নিম্নবর্গের অধ্যয়ন (subaltern studies), উত্তর–কাঠামোবাদের (post-structuralism) ঘোরতর বিরোধী। এর কারণ কী? অনেকের প্রতিক্রিয়ায় এমনও মনে হয় যে, মার্ক্সবাদী ছকে বিপ্লবটা যেন প্রায় হয়েই যাচ্ছিল; উত্তর–ঔপনিবেশিকতাবাদ, নিম্নবর্গের অধ্যয়ন কিংবা উত্তর–আধুনিক তত্ত্ব চর্চাই যত গণ্ডগোল পাকিয়েছে। পোস্ট–কলোনিয়াল চিন্তক হিসেবে একদিকে মার্ক্সবাদিদের গোঁড়ামি (Orthodoxy) মোকাবেলা, অন্যদিকে মার্ক্সকে নিজের কাজে বিপুলভাবে প্রাসঙ্গিক রাখা দুই–ই আপনাকে করতে হয়। এ বিষয়ে কিছু বলুন….
আদিত্য নিগাম: আসলে নিজেদের ব্যর্থতার দায়িত্ব অন্য কারও ঘাড়ে চাপাতে পারলে এই ধরনের মার্ক্সবাদিরা বেঁচে যান। তাদের মনে হয় তাদের আর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এমন মার্ক্সবাদিদের (যে দুই ঘরাণার কথা আপনি বলেছেন, উভয়েরই) আসল সমস্যা হলো এই যে তারা মার্ক্সবাদকেও একটা ধর্মের মতো করে বুঝেছেন। ঠিক যেমন ধর্মের কাছে সব কিছুর উত্তর আগাম থাকে, কোনো প্রশ্নই তাদের বিচলিত করে না আর প্রশ্ন উঠলেই সেটা শত্রু শিবিরের কাজ হতে হয়— ঠিক তেমনই হচ্ছে এদের মার্ক্সবাদে আস্থা। তারা বিজ্ঞানের কথা বলেন। কিন্তু বিজ্ঞানের কারবারই হচ্ছে অজানার সন্ধান করা। বৈজ্ঞানিক যদি এই ভেবে বসে যায় যে তার কাছে সব কিছুর উত্তর আগের থেকেই আছে তাহলে বিজ্ঞানের কোনোদিন এক বিন্দু উন্নতি হতো না। এ–জাতীয় মার্ক্সবাদিরা আর সব কিছুতে ইতিহাসের দোহাই দেন কিন্তু নিজেদের ইতিহাসকে ভয় পান। এ এক অদ্ভুত সম্প্রদায়। আমরা নিম্ন–বর্গ অধ্যয়নের কথা নিশ্চয়ই আলোচনা করব, উত্তর–ঔপনিবেশিকতাবাদ ও উত্তর–কাঠামোবাদেরও আলোচনা করব অথচ তাদের মার্ক্সবাদ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতন তো ব্যাপক গণ আন্দোলনের মাধ্যমে হলো— ওখানে কোন দেরিদা বা ফুকো গিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন? সোভিয়েত জনগণ কি নামও শুনেছিলেন এদের কিংবা এদের তত্ত্ব বা দর্শনের? সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের নামে তাদের যা গেলানো হচ্ছিল তাতে তাদের আপত্তি ছিল, গণতন্ত্রের অভাব নিয়ে তাদের ঘোরতর রাগও ছিল। তাছাড়াও আরও অনেক সমস্যা ছিল যার উত্তর–আধুনিকতা বা উত্তর–কাঠামোবাদের সঙ্গে আদৌ কোনো সম্পর্ক ছিল না।
দ্বিতীয় যে বিষয়টা উঠে আসে, সোভিয়েত পতনের পর, সেটা হচ্ছে ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’ বা পরিচয়বাদী রাজনীতি। এখানেও আইডেন্টিটি পলিটিক্স নিয়ে বিগত তিন–চার দশকের যে কাজ হয়েছে তাতে কোনে সন্দেহের অবকাশ নেই যে গায়ের জোরে ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির বিলোপ সাধনের চেষ্টার প্রতিকার হিসেবেই এই ধরনের রাজনীতির আবির্ভাব। এখানে বোধ হয় এটাও বলে রাখা দরকার: অনেকে ভাবেন উত্তর–কাঠামোবাদের পরিচয়ের রাজনীতির সঙ্গে কোনো তত্ত্বগত সম্পর্ক আছে যেটা আদৌ ঠিক নয়। উত্তর–কাঠামোবাদের পুরো কারবারই এর বিপরীত— এটা বোঝানো যে আইডেন্টিটি মাত্রই হচ্ছে অস্থায়ী ও অ–স্থির একটা ব্যাপার।
এবার আমার কথা বলি। আমার মনে হয় মার্ক্স ও মার্ক্সবাদকে যারা মার্ক্সের জীবনের একটা পর্যায়ের কার্যকলাপ ও চিন্তার মধ্যে আবদ্ধ করে রাখেন তারা মার্ক্সের সঙ্গে তো অন্যায় করছেনই, সমাজের প্রতিও তাদের দায়িত্ব বর্জন করে ফেলছেন। মার্ক্স থেকে যে ধারা শুরু হয় সে বিগত দেড়শ বছরের যাত্রায় অনেক আঁকা–বাঁকা পথ হয়ে এগিয়েছে। বহু এমন অভিজ্ঞতা মার্ক্সবাদিদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হয়েছে যার কল্পনাও মার্ক্সের সময় করা যেত না। নানান উপধারাও এই সফরে বেরিয়েছে। এগুলোর অনেককেই আন্দোলন থেকে বার করে দেওয়া হয়েছে, শত্রু শিবিরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আজ যদি আমরা বিগত শতাব্দীর গোটা অভিজ্ঞতার হিসাব–নিকাশ করতে চাই এবং সমাজতন্ত্রকে নতুনভাবে কল্পনা করতে চাই তাহলে আমাদের মার্ক্সবাদের ‘মূল পাঠ’–এর বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে ও খুঁজতে হবে। উত্তর–ঔপনিবেশিক দুনিয়াতেই মার্ক্সবাদের অধিকাংশ জীবন কাটল— অথচ সেটার কিন্তু আজ অবধি কোনো তাত্ত্বিক বিবেচনা হয়নি। হয়নি কারণ সে ইতিহাসই আমরা বর্জন করেছি। আমি যেহেতু এই কাজটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি তাই আমার জন্য মার্ক্সবাদের ইতিহাসের এক অন্য উত্তর–উপনিবেশিক পাঠও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়।
সারোয়ার তুষার: আপনার প্রথম বই The Insurrection of Little Selves: The Crisis of Secular Nationalism in India বের হয় ২০০৬ সালে। এই বইতে আপনি নেহরুভিয়ান/মার্ক্সবাদী সেক্যুলার–জাতীয়তাবাদের সংকটকে উন্মোচন করেছেন। সাম্প্রদায়িকতার (Communalism) মোকাবেলায় সেক্যুলারবাদের (secularism) ব্যর্থতার প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন। সেক্যুলার–জাতীয়তাবাদকে আপনি সাম্প্রদায়িকতার একমাত্র প্রতিষেধক (antidote) হিসেবে মনে করেন না, বরং সেক্যুলার–জাতীয়তাবাদ যে অনড় (rigid) পরিচয়বাদী রাজনীতি (identity politics) গড়ে তোলে তার বিপদের দিকটাও আপনি আমলে নিতে চান। এরপর নিবেদিতা মেননের সাথে যৌথভাবে লিখলেন Power and Contestation: India Since 1989, যেটা ২০০৭–এ বের হলো। ২০১০–এ লিখলেন After Utopia: Modernity, Socialism and the Postcolony নামক বই। Desire Named Development বইটি বের হয় ২০১১ সালে। এই বইয়ে আপনি পুঁজিবাদের অমোঘ অনিবার্যতাকে (inevitability) চ্যালেঞ্জ করছেন এবং উন্নয়নের নামে কৃষক ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদ ও বাস্তুহীনতাকে চিহ্নিত করছেন। আপনার সাম্প্রতিকতম বই বেরিয়েছে গত বছর— Decolonizing Theory: Thinking across Traditions। এই বইয়ে এসে আপনার রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের প্রথম পর্যায় শেষ হলো বলে কি ধরে নেয়া যায়? আপনার এই জার্নি সম্পর্কে আমাদের পাঠকদের কিছু বলুন। আপনার অনুসন্ধান কোথা থেকে শুরু হয়েছিল? এখন এসে নিজেকে কোথায় আবিষ্কার করছেন?
আদিত্য নিগাম: আপনি একদম ঠিক ধরেছেন। আসলে ১৯৯০–৯২–এ সক্রিয় রাজনীতি ছাড়ার পর থেকে মার্ক্সবাদের সম্বন্ধে যে প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলাম তার একটা পর্যায়ের অবসান ঘটল Decolonizing Theory: Thinking Across Traditions (2020e) এর সাথে। আঠারো বছর সিপিআই(এম)-এ কাজ করার পর যখন ১৯৯২তে পার্টি ছাড়লাম তখন যে প্রশ্নগুলো উদ্বেলিত করছিল তাতে এক দিকে ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন করে উঠে আসা জাতির প্রশ্ন প্রধান ছিল— যার সম্বন্ধে মার্ক্সবাদিদের কোনো ধারণাই ছিল না বললে চলে। আর ঠিক সেই সময়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাটিও আমাদের অনেককেই ঝাঁকিয়ে দিয়েছিল। অন্য দিকে সেই বছরগুলোই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের সময়। সব মিলিয়ে ব্যর্থতার এমন এক অবস্থা যার ব্যাখ্যা নির্দিষ্ট কোনো ‘ভুল’ সিদ্ধান্তের কথা বলে করা যায় না। ভারতে আমরা এটাও তখন দেখতে পাচ্ছিলাম যে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনগুলো ঠান্ডা হয়ে গেলেও বিভিন্ন প্রদেশে আদিবাসী ও কৃষকদের জমি থেকে বেদখল করার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল। মার্ক্সবাদী ধ্যান–ধারণার মধ্যে এটা বোঝা মুশকিল ছিল। কৃষক ও আদিবাসীদের তো মার্ক্সবাদিরা ভাবতেন অতীতের ‘অবশেষ’ যাদের নিয়তিই হচ্ছে শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া। তারাই তো নিঃস্ব হয়ে আধুনিক সর্বহারা হয়ে পুনর্জন্ম লাভ করবে! অন্যদিকে, শ্রমিকশ্রেণি বা সর্বহারা হলো পুঁজিবাদের সবচেয়ে মজবুত ও দৃঢ় বিরোধী। কিছুই ঠিক মিলছিল না আমার পুঁথি পড়া জ্ঞানের সঙ্গে।
এখানে আরেকটা কথা বলা দরকার। ব্যবহারের দিক থেকে প্রথমে রাশিয়ার বিপ্লবের সময়ে এবং পরে আরও জোরালোভাবে চীন বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে, শ্রমিক–কৃষক ঐক্যর কথা উঠেছিল ঠিকই কিন্তু তার তাৎপর্য আমরা বুঝতাম না। এটা যে একটা সাময়িক, কৌশলগত ব্যাপার ছিল এবং ক্ষমতায় এলে কমিউনিস্টরাও ঠিক সেইভাবেই শিল্পায়নের মাধ্যমে কৃষকের বিলোপ সাধনের চেষ্টা করবে— এই বিষয়টি বুঝতে অনেক সময় লাগল। সমাজতন্ত্রের পতন না হলে হয়তো তার তাৎপর্য বুঝতাম না।
সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর শুনতে লাগলাম যে তার পরাজয়ের আসল কারণ হলো কৃষি ও কৃষক–প্রধান সমাজগুলোতে বিপ্লব হওয়া যেখানে পুঁজিবাদের যথেষ্ট বিকাশ ঘটেনি। চীনের প্রসঙ্গে মাও বিষয়টাকে একটু অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করেছিলেন ঠিকই কিন্তু মার্ক্সবাদের ইতিহাস দর্শন ও তত্ত্বের মধ্যে কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেননি।
বলতে গেলে, যে দিক থেকেই দেখি, একই প্রশ্ন উঠে আসে। যেমন জাতির প্রশ্ন পুনরায় উঠে আসে, তেমনই আদিবাসী–কৃষকদের সংগ্রামের ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠে আসে— যাকে আমরা ‘অতীত’ ভেবে নিয়েছিলাম তার প্রত্যাগমন হয়! এখান থেকে জন্ম নিতে শুরু করল পুঁজিবাদের সঙ্গে আধুনিকতার সম্বন্ধের প্রশ্ন। সব মিলিয়ে যেটাকে ইতিহাস দর্শন বলা যায়, সেটা নিয়ে অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে থাকে যেগুলি এই সমস্ত বইয়ে নানানভাবে বিবেচনা করা হয়েছে
Decolonizing Theoryতে এই চিন্তাগুলো একটা জায়গায় এসেছে। আমার মনে হয় এই সব ব্যাপার নিয়ে ভাবতে গেলে বারবার যে ‘লিনিয়ার টাইম’ এর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তার থেকে বেরোবার কিছুটা পথ এখানে খুঁজে পেয়েছি। বিভিন্ন দেশের স্কলাররা যে কাজ করেছেন এবং করছেন তার সঙ্গে একটা কথোপকথনের মাধ্যমেই এটা কিছুটা করা গেছে। কিন্তু এখনো তত্ত্বের দিক থেকে, philosophy’র দিক থেকে একটা তর্ক দাঁড় করানোর কাজ বাকি আছে। যতদিন না সেটা হচ্ছে ততদিন ইউরোপীয় জ্ঞানতত্ত্বের আধিপত্যকে ঠিক মতো চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।
রেফারেন্স:
চক্রবর্তী, দীপেশ (২০১৬): ‘আরেক টোয়েন্টি টোয়েন্টি: পৃথিবীর উষ্ণতা–বৃদ্ধি ও মানুষের ইতিহাস’, ইতিহাসের জনজীবন ও অন্যান্য প্রবন্ধ, তৃতীয় মুদ্রণ, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা
চট্টোপাধ্যায়, পার্থ (২০১৫): ‘জাত–জাতি–জাতীয়তা’, ইতিহাসের উত্তরাধিকার, পঞ্চম মুদ্রণ, প্রথম সংস্করণ, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা
নিগাম, আদিত্য,
-(২০২০ক): “করোনা জৈব–রাজনীতি ও পুঁজিবাদের পরের জীবন: আশার ইশতেহার”, অনু. সারোয়ার তুষার, বোধিচিত্ত, ৫ই এপ্রিল, ২০২০, https://sites.google.com/view/bodhichitta/%E0%A6%85%E0%A6%A4%E0%A6%AE%E0%A6%B0/%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%A8-%E0%A6%AC%E0%A6%AF%E0%A6%AA%E0%A6%B2%E0%A6%9F%E0%A6%95%E0%A6%B8-%E0%A6%93-%E0%A6%AA%E0%A6%9C%E0%A6%AC%E0%A6%A6%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A6%AC%E0%A6%A8-%E0%A6%86%E0%A6%A6%E0%A6%A4%E0%A6%AF-%E0%A6%A8%E0%A6%97%E0%A6%AE?authuser=0
–২০২০খ, “পুঁজিবাদের পরের জীবন এবং নয়া শাতিরীয়–কোপার্নিসীয় বিপ্লব: আশার ইশতেহার–২”, অনু. সারোয়ার তুষার, অরাজ, ২রা মে, ২০২০, https://www.auraj.net/%e0%a6%86%e0%a6%a6%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%af-%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%97%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a5%a4%e0%a5%a4-%e0%a6%aa%e0%a7%81%e0%a6%81%e0%a6%9c%e0%a6%bf%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87/3976/
Banerjee, Prathama; Nigam, Aditya and Pandey, Rakesh (2016): The Work of Theory: Thinking across Traditions, Economic & Political Weekly, Vol LI, NO 37, pp 42-50
Ferguson, James (2015): Give a man a fish: Reflections on the New Politics of Distribution, Duke University Press, North Carolina
Gorz, Andre (2001): Farewell to the Working Class: An Essay on Post-Industrial Socialism, Pluto Press, London
De Soto, Hernando (2000): The Mystery of Capital: Why Capitalism Triumphs in the West and Fails Everywhere Else, Basic Books, New York
Nigam, Aditya (2009): Democracy, State and Capital: The ‘Unthought’ of 20th Century Marxism, Economic & Political Weekly, Vol XLIV, NO 51, pp 35-39
-(2014): Partha Chatterjee Interviewed by Aditya Nigam, Development and Change, Volume 45, Issue 5 p. 1059-1073
– (2018): Theories from the South II: Interview with Aditya Nigam, Interviewed by Sohini Chattopadhyay, 10 November, Borderlines CSSAAME
-(2020 a) : CORONA BIOPOLITICS AND LIFE AFTER CAPITALISM – A MANIFESTO OF HOPE I, 26 March, Kaflia.online
-(2020b): LIFE AFTER CAPITALISM AND THE NEW ‘AL SHATIR-COPERNICUS’ REVOLUTION – MANIFESTO OF HOPE II, 09 April, Kaflia.online
-(2020c): FASCISM, THE REVOLT OF THE ‘LITTLE MAN’ AND LIFE AFTER CAPITALISM – MANIFESTO OF HOPE III, 23 April, Kaflia.online
-(2020d): BEYOND THE ‘EMPLOYMENT’ PARADIGM AND LIFE AFTER CAPITALISM – MANIFESTO OF HOPE IV, 07 May, Kaflia.online
-(2020e): Decolonizing Theory: Thinking Across Traditions, Bloomsbury India, New Delhi
Sanyal, Kalyan (2007): Rethinking Capitalist Development: Primitive Accumulation, Governmentality and Post-Colonial Capitalism, Routledge, New Delhi