- স্বাধীন সেন
কোনো কিছুই লিখতে মন চাইতেছিল না। বিভিন্ন কারণেই। শারিরীক জরাগ্রস্ততার কারণে। আরও কয়েকটি কাজে মনোযোগ থাকার কারণে। বিষণ্ণতা আর উন্মুলতার কারণে। কোনো কিছু লেখালিখি বা বলাবলিকে ইদানিং বেহুদা মনে হওয়ার কারণে। কোনো কিছু ফেসবুকে লিখলেই নানাভাবে তকমা পাওয়া আর অ্যাবিউজড হওয়ার ভয়ে ও বেদনার্ত হওয়ার আগাম আতঙ্কে। বাচনিক নৃশংসতাকে আমি শরীরী ও মনস্তাত্ত্বিক নৃশংসতা ও সহিংসতার সঙ্গে সঙ্গে গুরুতর নৃশংসতা ও নির্মমতা বিবেচনা করতে শুরু করার কারণে। আদৌ বাক–স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার অনুভব বিভ্রম কীনা সেই বোধে ও জিজ্ঞাসার আক্রান্ত হওয়ার কারণে। আর নিরেট আলস্যজনিত কারণে। লিখতে গেলে সংহতিবোধ তৈরি করার দায়, রেফারেন্স ঘাঁটার খুঁতখুঁতানি, কাউকে আঘাত করলাম কীনা সেই আশংকার কারণেও।
তবুও নববর্ষের প্রাক্কালে কয়েকটি কথা লিখলাম। সকল কারণ উপেক্ষা করেই। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বছরের প্রাক্কালে। বিগত বছরে আমরা যেমন ফ্যাসিস্ট একটি সরকারের পতন ঘটিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখেছি, তেমনই বহু মানুষকে নৃশংসভাবে নিপীড়িত ও নিহত হতেও দেখেছি। রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে। সেই হত্যা, অত্যাচার, আর বৃহৎ পরিসরে ক্ষমতার নির্মমতা প্রথমবার ডিজিটাল দুনিয়ার মারফতে দেখেছি। এই দেখার ভয়াবহ মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব আমাকে শারীরিকভাবেও আক্রান্ত করেছে। যেহেতু আমার কয়েকটি ব্যাধি প্রবলভাবেই মনস্তাত্ত্বিক দশার সঙ্গে সম্পর্কিত বা সাইকোসোমাটিক।

ফ্যাসিজমকে যদি আমরা ক্ষমতার কর্তৃত্ব, দাপট, নৃশংসতা, আধিপত্যশীলতা, প্রাবল্য আর চরম নির্মমতার একটি রূপ হিসেবে বিবেচনা করি তাহলে ক্ষমতার বহুবিধ নড়াচড়া, সক্রিয়তা ও কুশীলবদের যুক্ততা নিয়ে ঐতিহ্য প্রসঙ্গে আলাপচারিতা করা যেতে পারে সম্ভবত। এই ছোট লেখায় আমি সেই চেষ্টাই করবো। ঐতিহ্য নিয়ে নানাবিধ আলাপ ও যুক্তিতক্কো এর আগেও বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছি। প্রত্নতত্ত্ব, হেরিটেজ আর ইতিহাস বিষয়ে আলাপ করতে গিয়ে। ঐতিহ্য হিসেবে কোন ভাষা, কোন বয়ান, কোন আচার, কোন অভিব্যক্তি, কোন অনুভব, কোন আবেগ, কোন সংবেদকে আমরা স্বীকৃতি দেবো (বা খারিজ করবো) তা প্রক্রিয়াগতভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখতে পারে। কোন কোন শব্দ বা চিহ্ন বা চর্চাকে আমরা ঐতিহ্য হিসেব স্বীকার করবো, কোন বয়ান ব্যবহার করে, আর খারিজ বা বর্জন করবো কোন বয়ান ব্যবহার করে সেই জিজ্ঞাসা জরুরি হতে পারে। তবে আমার আগ্রহ এই প্রশ্নগুলোরে সঙ্গে মোকাবিলায়: ঐতিহ্য আসলে কী? কীভাবে কোনটা ‘আমাদের ঐতিহ্য’ আর ‘ওদের ঐতিহ্য’ সেই নির্ধারণের প্রক্রিয়া চলমান থাকে? কোনটা বিশুদ্ধ, আসল, প্রকৃত ও সহী ঐতিহ্য আর কোনটা নয় সেই হিসাবনিকাশ কীভাবে ও কেন ঘটে? প্রথমেই ধরে নেয়া পূর্বানুমানগুলোর ভিত আমাদের নাড়িয়ে দিতে হবে। ঐতিহ্য/ট্রাডিশন হিসেবে কোনো বস্তুগত এবং অবস্তুগত বা অস্পর্শনীয়/ইনট্যানজিবল হিসেবে যে ভাগ করা হয় প্রতিষ্ঠিত শাস্ত্র ও বয়ানে সেই বিভাজন অসাড় হিসেবে বুঝতে হবে। সকল বস্তুগত ও অবস্তুগত ঐতিহ্যই পরস্পর সম্পর্কিত। একে অপরের সঙ্গে লিপ্ত, যুক্ত—মিথষ্ক্রিয়ারত থাকে। কোনো গান, স্মৃতি, ভাষ্য, পারফরমেন্স, গীতরঙ্গ, রীতি, আচার, অভ্যাস, ভাষা, অভিব্যক্তি আপাত দৃষ্টিতে অস্পর্শনীয় বলে অনুমিত হলেও সেগুলো বস্তুদুনিয়ার সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ারত। একই কথা বলা চলে বস্তুগত ঐতিহ্যের ক্ষেত্রেও। প্রতিটি বস্তুগত ঐতিহ্যই বয়ান, আখ্যান, স্মৃতি, কিংবদন্তী, কাহিনি, গল্প, লোকশ্রুতির মতন অস্পর্শনীয় অনুশীলন ও তৎপরতার সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে। পরের পূর্বানুমানটি ধরে নেয়, ঐতিহ্য আমরা যেভাবে দেখছি–শুনছি–উদযাপন করছি সেভাবেই ছিল, আছে। চিরায়ত ও চিরন্তনতা, হাজার হাজার বছরের ধারাবাহিকতা, আদি ও বিশুদ্ধ একটা গঠন কোনো এক কালে কোনো এক স্থানে ছিল বা তার উদ্ভব ঘটেছিল বলে আমরা ধরে নেই। পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সেই ঐতিহ্যের বদল বা পরিবর্তন ঘটেছে। কোনো বদলকে আমরা স্বাভাবিক বলে মনে করি। কোনো বদলকে আমরা অস্বাভাবিক বা বেমানান বলে ঠাহর করি। উদ্ভব, বিকাশ, বদল ঘটলেও কোনো অথেনটিক আর শুদ্ধ ঐতিহ্যের কতগুলো সারসত্তাগত বৈশিষ্ট্য থাকে এবং বিভিন্ন সময়ে বদলের পরেও ওই সারসত্তা ধারবাহিকভাবে অটুট ও অক্ষয় হিসেবে টিকে থাকে। ঐতিহ্য প্রসঙ্গে এই পূর্বানুমানগুলো শাস্ত্রীয় পরিসরে, বিদ্যায়তনিক পরিসরে আর বয়ানগত/বাঙ্ময় পরিসরে প্রবল ও আধিপত্যশীল হিসেবে বিরাজমান রয়েছে কিন্তু উপরের পূর্বানুমানগুলো কেবল ভ্রান্তই না। বরং এই পূর্বানুমানগুলো তৈরি হয়ে উঠেছে, বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধুনিকতার প্রকল্পের কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে। আধুনিকতা যেমন একদিকে ঐতিহ্যের বিপ্রতীপ হিসেবে বিবেচিত তেমনই আধুনিকতা ঐতিহ্যকে অব্যবহতভাবে বলবত রাখার সঙ্গেও জড়িত।
জাতীয় ঐতিহ্য, ধর্মীয় ঐতিহ্য, সম্পদায়গত ঐতিহ্য, আঞ্চলিক ঐতিহ্য, বিশ্ব ঐতিহ্য, লোক বা ফোক ঐতিহ্য, ভাষাগত ঐতিহ্য, রীতি–আচার–আচরণ–খাদ্যাভ্যাস–পোষাক–অভিব্যক্তি–অনুভূতি–আখ্যানভঙ্গিগত ঐতিহ্য প্রভৃতি নানা রূপে আর বর্গে ঐতিহ্যকে ভাগ করে বিদ্যায়তনে, শাস্ত্রীয় চর্চায়, জনপরিসরের বয়ানে তর্কবিতর্ক চলতে থাকে। এই বিবাদ সংঘাত ও সহিংসতায় পরিণত হওয়ার উদাহরণ ইতিহাসে বহু স্থানে ও কালে রয়েছে। আধুনিক ও ঔপনিবেশিক ক্ষমতা ও জ্ঞানের পরিসরে কোনো মানুষ বা জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় খোঁজার তৎপরতা যেভাবে অনিবার্য একটি মানবীয় আচার হিসেবে চিহ্নিত হওয়া শুরু করে তার প্রলম্বন আমরা জাতীয়তাবাদ, জাতিবর্ণবাদ, বর্ণবাদসমেত বিভিন্ন পরিচয়বাদী চিন্তা ও চর্চায় লক্ষ্য করি। জাতীয়তাবাদ ও জাতি–রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে জাতীয় ঐতিহ্য থাকা আবশ্যকীয় হয়ে ওঠে। কারণ অতীতের বিভিন্ন বয়ান ও উল্লেখের উপরে জাতীয়তাবাদী (এবং সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত অন্য যেকোনো পরিচয়বাদী বাসনা) কল্পনা ও বয়ানের, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপনিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের তৎপরতার বৈধতা ও প্রামাণ্যতা নির্ভর করতে থাকে। সেভাবে বিবেচনা করলে যে ভাবে যে ঐতিহ্যকে আমরা এখন চিরন্তন, হাজার বছরের পুরানো, বিশুদ্ধ, অনাদি, পবিত্র, আসল, সহী, প্রকৃত হিসেবে ঠাহর করতে থাকি সেই ঐতিহ্য আদতে আধুনিকতার প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন কুশীলব, সত্তা, পুঁজি আর ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়, গঠিত হয়, প্রদর্শিত হয়, আলাপিত হয়। বিবাদের বিষয়ে পরিণত হয়। যখন আমরা দাবি করি যে, এইটা আমাদের সহী ঐতিহ্য না, এই রীতি বা পোষাক বা খাবারদাবার, বা ভাষা, বা আবেগ নিতান্তই পরের, আরোপিত, চাপিয়ে দেয়া, দূষিত, ভেজাল, বেঠিত, অবৈধ, অনৈতিহাসিক তখন আসলে আমরা ঐতিহ্যকে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হই। বিভিন্ন শর্তাধীনে, বিভিন্ন কুশীলবের অসম ক্ষমতা ও পুঁজির সম্পর্কের, অথবা অনুভব–উপলব্ধির মনস্তাত্ত্বিক স্বাভাবিকীকরণের প্রণালিবদ্ধ প্রক্রিয়াগুলোকে আমরা অবজ্ঞা করি, আড়াল করি।

যে দল–মত–চিন্তারই হই–না– কেন, বিভিন্ন ঐতিহ্যের সহীত্ব নিয়ে সম্পূর্ণ প্রতিপক্ষতার পরেও সকল পক্ষের প্রবল ও জনপ্রিয় আলাপচারিতায় তাদের উল্লিখিত–পেশকৃত–আদর্শ হিসেবে জাহির করা ঐতিহ্যকেই সহী আর আসল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিভিন্ন আলাপ ও বাহাসে নিজের দাবি করা ঐতিহ্যকেই বা ঐতিহ্যের প্রণালি, রীতি ও চিহ্নগুলোকেই চিরন্তন, আসল, প্রকৃত, বিশুদ্ধ ও আদিতম হিসেবে ধরে–নেয়ার প্রবণতা ও ঝোঁক জারি থাকে। প্রবল জাতীয়তাবাদী, পরিচয়বাদী আর আধুনিকীকরণ প্রকল্পগুলোর চলমান স্বাভাবিকতার মধ্যে উদ্ভব খোঁজা, দূষণ ও ভেজাল দূর করে বিশুদ্ধ কোনো কিছুকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা আবশ্যকীয় এবং মহান, দেশাত্মবোধক, পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে পেশ করা হয়। সেখানে অথেনটিক ও প্রামাণ্য হিসেবে কোনো কিছু (ভাষা–অনুভূতি–অভিব্যক্তি–বৃত্তি–প্রবৃত্তি–আচার–সংবেদ–চিহ্ন ইত্যাদি ইত্যাদি) জাহির করে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে হাজির করার কার্যক্রম ও বাসনা বলবৎ থাকে। এরিক হবসবম এই প্রক্রিয়াকে ‘ইনভেনশন অব ট্রাডিশন’ বা ‘ঐতিহ্যের আবিষ্কার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। হবসবমীয় মতানুসারে আধুনিক বিভিন্ন দশা ও শর্তের মধ্যে বিভিন্ন সময়ই ঐতিহ্য আবিষ্কৃত, পুনরাবিষ্কৃত, নবায়িত, পরিগঠিত হতে থাকে। সেখানে পুঁজিবাদ, জাতিরাষ্ট্রের মতন প্রতিষ্ঠান যেমন ভূমিকা রাখে তেমনিই ভূমিকা রাখে জাতীয়তাবাদ ও নানাবিধ সম্মিলনমূলক ও সংঘাতমূলক দশা ও মত। তার পর্যালোচনার কালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অপরবাস্তব পরিসরের সক্রিয়তা, বাস্তবতা ও বহুবিধ যাপন ছিল না। ঐতিহ্যের আবিষ্কার–পুনরাবিষ্কারের বাহাসে ও আখ্যানে আর প্রক্রিয়ার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কার্যকলাপ, এবং পরিবর্তিত মানবীয় সত্তার গঠন ও বৈশিষ্ট্যাবলি নিয়ে তাই আলাপ করার অবকাশও উনার ছিল না।
আমি এক্ষেত্রে ‘ঐতিহ্যর আবিষ্কার’—এই হবসবমীয় ধারণার তুলনায় তালাল আসাদের ঐতিহ্য সম্পর্কিত বহুবিধ লিপ্ততা ও পর্যালোচনাগুলো দ্বারা বেশি প্রভাবিত। একদিকে আসাদ ঐতিহ্যের পুনর্গঠনের/রিকনফিগারেশন অব ট্রাডিশনের কথা বলেন। যেখানে তিনি আবিষ্কারের চাইতে বাছাইকরণ/সিলেকশনের উপরে গুরুত্ব দেন। অন্যদিকে তিনি ঐতিহ্যকে আখ্যানগত/ডিসকার্সিভ আর শরীরজ/দেহ বিজড়িত(এমবোডিড) হিসেবে আলাদা করেন। তার আলাপে ডিসকার্সিভ ও এমবোডিড ধারণাগতভাবে আলাদা হলেও পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। মিথষ্ক্রিয়ার মধ্যে জারি থাকে।
কোন আচার, অনুশীলন, ভাষা, অভিব্যক্তি, বয়ান ঐতিহ্য হিসেবে সহী ও বিশুদ্ধ হিসেবে, দরকারী, মুক্তিদায়ী হিসেবে পরিগণিত হবে, আর কোনগুলো–হবে–না সেটা ক্ষমতা ও পুঁজির, সত্তাশ্রয়ীতা/সাবজেকটিভিটি সমেত আধুনিকীকরণের প্রকল্পের বহুবিধ, বিচিত্র ও জটিল ক্রিয়াকলাপ ও শর্তর উপরে নির্ভর করে। আমাদের সংবেদ (ইন্দ্রিয়জ উপলব্ধি, অভ্যাস, ঝোঁক, শরীরের নানাবিধ আচার ও পারফরমেন্স, আবেগ, ভাবাবেগ, ভাবাবেশ) আখ্যানগত ও টেক্সচুয়াল ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই কর্তৃত্ব তৈরি করে, প্রবল ও স্বাভাবিক হিসেবে জনপ্রিয় ও অধিপতিশীল হয়ে ওঠে। কোনো আবেগ বা অভিব্যক্তি সঠিক, অথেনটিক ও সহী হিসেবে নির্মিত ও গঠিত হয়। কোনো ভাষা ও আচরণ–আচার, শোনা–বলা, গন্ধ নেয়া, স্বাদগ্রহণ, ছোঁয়ার ধরন বিশুদ্ধ, চিরায়ত, অনাদি কাল ধরে বিরাজমান হিসেবে পরিবেশিত হয়। বাদবাকি যেকোনো কিছু আরোপিত, আমদানীকৃত, দূষণ, ভিনদেশী, আধুনিক/পশ্চিমা, ঔপনিবেশিক, ভিন্ন ও প্রতিপক্ষীয় ঐতিহ্য হিসেবে দাগিয়ে দেয়া হয়। চাপিয়ে দেয়া অথবা বিশেষ কর্তৃত্বশীল প্রতিষ্ঠান–জনগোষ্ঠীর কর্তৃক কৃত্রিমভাবে আমদানীকৃত হিসেবে সাব্যস্ত হয়। হালের দুনিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রে ও অঞ্চলে বিস্ফোরিত হয়ে ওঠা, পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত সাংস্কৃতিক যুদ্ধ ও খারিজীকরণের তৎপরতার বিপজ্জনক আর সহিংস উত্থানে এমন বয়ান বহুল উৎপাদিত ও সঞ্চালিত হয়। বিশেষ করে অপরবাস্তব পরিসরের রাজনীতিতে ও চিন্তা–পছন্দ/অপছন্দ–পণ্যায়নের প্রবল প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে। ব্যক্তি মানুষের অভীষ্ঠ লক্ষ্য হিসেবে এবং মানবীয় অত্যাবশ্যক বৈশিষ্ট হিসেবে যখন প্রতিযোগিতা, মেধাস্তর ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ও জীবিকা আর সফলতার বাসনাকে স্বাভাবিক করে তোলা হয়েছে তখনকার এই দুনিয়ায় নিয়ত যুক্ততার মধ্যে মানুষ সহীত্ব আর না–সহীত্বের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের অধীনস্ত হয়ে পড়ে। ঐতিহ্য ও পরিচয় একদিকে প্রতিযোগিতা ও সফলতার মানদণ্ড হিসেবে খাড়ায়। যদিও দাবি করা হতে থাকে যে, এই প্রতিযোগিতা অবাধ ও মুক্ত। এই স্বাধীনতা ও বেছে নেয়ার অধিকার থাকার বোধ পরিশেষে বিভ্রমমাত্র। ঐতিহ্যের প্রবল বয়ান বহুবিদ মিথ্যা, অপতথ্য, বাছাই করা উদাহরণ বা টেক্সট বা উদ্ধৃতিকে দৃশ্যমান করে তুলতে থাকে একের পর এক। সার্বক্ষণিকভাবে যখন একটি ডিভাইস মানবায়িত সংবেদকে গঠন করতে থাকে, তখন খারিজকরণ আর সংঘাতে পক্ষাবলম্বন করতে উৎসাহিত করা সহজ হয়ে পড়ে। একইসঙ্গে বাছাই করার স্বাধীনতা, নিজের পরিচয়ের শুদ্ধতা ও শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা বা নিজেকে ঐতিহ্যগত ভাবে দূষণে বাধ্য হওয়া ভিকটিম হিসেবে মনে করতে থাকাও এই দৃশ্যমান অপরবাস্তব পরিসর স্বাভাবিক করে তোলে। অনিবার্যভাবেই এই প্রক্রিয়ায় অপরায়ন ঘটতেই থাকে। অপরের উপরে নিজের ব্যর্থতা, নিজের খুঁজে বের করা দূষণ, গ্লানিবোধ, বা শ্রেষ্ঠত্বর পুনরুদ্ধারের প্রকল্প পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে হতে থাকে। শত্রু গঠিত হয়। নিপীড়ক ও শাসক চিহ্নিত হতে থাকে। দাগানো চলতে থাকে। ঐতিহ্য গঠিত হওয়ার আর পুনর্গঠিত হওয়ার এই সর্বগ্রাসী, নৃশংস আর সহিংস তৎপরতায়।

যেহেতু ক্ষমতার সম্পর্ক পরিবর্তনশীল, অসমতা ও বৈষম্য দূর করা কঠিন, প্রবল ও প্রান্তিকের সম্পর্ক পাল্টাতে পারে। অবস্থান ও দশা বদলালেও অসমতা বলবত থাকে। যেহেতু আধুনিকতা, আধুনিক জাতি–রাষ্ট্র, ও তার প্রতিষ্ঠানগুলো, রাষ্ট্রান্তরী সংস্থাগুলো পরম্পরের সঙ্গে যুক্ত কুশীলব হিসেবে আমাদের নৈমিত্তিক ও তুচ্ছতর জীবনযাপনকেও বৃহত্তর জাতি–রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানসমূহের পাশাপাশি প্রভাবিত করেছে সেহেতু কর্তৃত্ব ও দাপটের বদলের সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যের বয়ানও বদলায়, পুনর্নবায়িত হয়, পরিগঠিত হতে থাকে। অর্থাৎ আজ যাকে আমরা সঠিক, বিশুদ্ধ ও চিরায়ত বলে দাবি করছি, প্রামাণ্য ও আদিতম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছি, গত কাল সেটা সেরকম নাও থাকতে পারে। আগামীকাল আবারও ভিন্ন রূপ নিতে পারে। ভিন্ন দাবি, ভিন্ন প্রতিপক্ষ, ভিন্ন শত্রু তৈরি হতে পারে। ঐতিহ্য গঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া তাই বিষচক্রের মতন।
আগে জারি থাকা বিভিন্ন বয়ান ও সংবেদন–শরীরী আচারগুলো থেকে কোনো কোনোটাকে প্রবল, কর্তৃত্ববাদী ও দাপুটে পরিচয়বাদী, বহুজাতিক সংস্থার মুনাফা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং জাতি–রাষ্ট্রের চলতি মতাদর্শের ও স্বীকৃত বয়ানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে বাছাই করা হয়। পরিমার্জন করা হয়, পুনর্গঠন করা হয়। আর ঐতিহ্য হিসেবে খাড়া করা হয়। বাদবাকি সকল কিছু, প্রান্তিক হিসেবে বিবেচিত সকল বয়ান ও সংবেদন–শরীরজ বৈশিষ্ট্য বর্জন করা হয়, অথবা প্রবল ঐতিহ্যের ধারণা ও বয়ানের আর চর্চার মধ্যে বাছাই করে আত্মসাৎ করা হয়। সেখানে দুর্বল ও প্রান্তিক ঐতিহ্যের চিহ্ন ও চিহ্নের ব্যাখ্যা প্রবল ঐতিহ্যের শর্ত দ্বারা নির্ধারিত হয়। ধরেন, আদিবাসীদের কোনো ঐতিহ্য বা পরিফরমেন্স বা রিচুয়ালকে যখন প্রবল জাতি–রাষ্ট্র বহুত্বের ও বৈচিত্র্যের প্রমাণ হিসেবে প্রদর্শন ও হাজির করে বেশিরভাবে ক্ষেত্রেই সেই হাজিরকরণ প্রবল জাতি–রাষ্ট্রের শর্তানাুসারেই ঘটে। সংখ্যাগড়িষ্ঠতাবাদী কোনো রাষ্ট্র ও ব্যবস্থা সংখ্যালঘিষ্ঠের অন্তর্ভুক্তি ও প্রদর্শনও জটিল বাছাইকরণ, পুনর্গঠন আর আত্মসাৎকরণে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটতে থাকতে পারে। উদাহরণ হিসেবে, হালে পশ্চিমবাংলায় হিন্দুত্ববাদীদের মাধ্যমে বঙ্গাব্দ হিসেবে পালিত বাংলা নববর্ষ (বছর গণনার ধরন ও জ্যোতিষশাস্ত্রগত রীতিকে) অশুদ্ধ ও নাজায়েজ হিসেবে চিহ্নিত করে ‘সনাতনী হিন্দু নববর্ষ’ প্রচলন করার প্রকল্প নজরে পড়বে। বেশ হইচই করে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যকে নানাধরনের তৎপরতার মাধ্যমে এই হিন্দু নববর্ষকে আসল ‘ভারতীয় নববর্ষ’ হিসেবে পালন করার প্রকল্প চালু করেছে। চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের প্রতিপদ তিথিতে এই নববর্ষ শুরু বলে দাবি করে বিজেপি–আরএসএস। ওইদিন শ্রীরামচন্দ্রের জন্মতিথি আর সম্রাট বিক্রমাদীত্য প্রচলিত বিক্রম সম্বতের শুরু বলেও তারা মনে করে। তাদের এই উদ্যোগ ও প্রকল্প নির্বাচনে তেমন প্রভাব ফেলতে না–পারায় এবছর তারা পহেলা বৈশাখকে এতদঅঞ্চলের শাসক শশাঙ্কের প্রবর্তিত কালপঞ্জী হিসেবে দাবি করে পহেলা বৈশাখকে পালন করেছে। এখানে ঐতিহাসিক তথ্য ও উপাত্ত, সত্যি বা মিথ্যা গৌণ। বরং কোনটা হিন্দুত্ববাদীদের মানদণ্ড অনুসারে আর নির্বাচনী রাজনীতির পরিসরে জরুরত, কার্যকর এবং প্রভাববিস্তারী সেটাই ঐতিহ্যর ধরন, সংজ্ঞা ও উদযাপনের রীতি নির্ধারণে বিবেচ্য। বাঙালির নববর্ষ পালনের হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প পশ্চিবঙ্গে হয়ে উঠেছে ক্ষমতা ও নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করার অন্যতম একটি পারফরমেটিভ তৎপরতা। প্রবল ও সংখ্যাগড়িষ্ঠতাবাদী হিন্দুত্ববাদী একরূপ ও সমসত্ত্ব ঐতিহ্য তৈরির ক্ষেত্রে নববর্ষ পালনের তৎপরতার পুনর্গঠন ঘটেছে। কিন্তু রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তী পালনের বিপুল তৎপরতা আর দিল্লিতে রামনবমী উপলক্ষ্যে মাছেরবাজার বন্ধ করে দেয়ার ঘটনাও একই সময়ে ঘটছে। সেক্ষেত্রে কোনো কোনো ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের সর্বভারতীয় ও চিরন্তন হিন্দুত্ব কায়েম করার প্রকল্প বিভিন্নভাবে চালু আছে। অন্যদিকে নির্বাচনী রাজনীতিকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই প্রকল্পে কৌশলগত ছাড় দেয়া হচ্ছে। উপরের উদাহরণটি চলমান ও বহুল আলোচিত ও দৃশ্যমান ঐতিহ্য নির্মাণ ও বাছাইকরণের একটি নমুনা হিসেবে আমি উল্লেখ করলাম।
একথাও উল্লেখ করা জরুরি যে, খোদ বাংলা নামক স্থানিক বর্গটি এবং বাঙালি ঐতিহ্য নামক বয়ান ও আচারগুলো বিভিন্ন সময়ে ও স্থানে বাছাইকরণ, স্বাভাবিকীকরণ ও প্রবলকরণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। যেকোনো ঐতিহ্য নির্মাণের ও পরিগঠনের প্রক্রিয়া অসম ক্ষমতা সম্পর্কের পরিসরে সারবাদী ও সমসত্ত্বকরণ করে। কিছু বিষয়, বৈশিষ্ট্য ও আচারকে গ্রহণ করে, বাদবাকিগুলোকে বাদ দিয়ে দেয়। সম্মিলন অথবা সমন্বয়ের যে প্রক্রিয়ার কথা আমরা পড়তে অভ্যস্ত তাতে ক্ষমতা সম্পর্কর এমন প্রভাবগুলো বিবেচনায় নেয়া খুব কমই হয়। রবার্ট রেডফিল্ড আর ম্যাকিম ম্যারিয়ট ‘বড় ঐতিহ্য’/’গ্রেট ট্রাডিশন’ আর ‘ছোট ঐতিহ্য’/’লিটল ট্রাডিশন’ নামের দুটো বর্গ বা ধারণা ব্যবহার করে জটিল ও শ্রেণিবিন্যস্ত সমাজে ঐতিহ্য কীভাবে বিকশিত হয় ও কাজ করে তা নিয়ে আলাপ করেছিলেন। তাদের এই আলাপ প্রাক–আধুনিক, প্রাক–ঔপনিবেশিক সমাজ ও ইতিহাস পর্যালোচনায় প্রভাবশালী হলেও এই আলাপেও প্রাক–আধুনিক সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ক্ষমতা, শাসন, কর্তৃত্ব ও শাসকের কর্তৃত্ব বা উচ্চ শ্রেণি/বর্ণ/বর্গ/জাতি/জাতিবর্ণ/সম্প্রদায়ের সঙ্গে অন্যান্যর মিথষ্ক্রিয়াকে বিবেচনায় নেয়া হয় নাই। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় বলেন, আজ যে ঐতিহ্যকে বড় হিসেবে সাব্যস্ত করা হচ্ছে তার বড় হয়ে ওঠার, আর ছোট ঐতিহ্যের ছোট হয়ে ওঠার ইতিহাস রয়েছে।

আমরা কোন ভাবে কোনো শব্দ বা পদের ব্যাখ্যা করবো, কোনো আচার বা আচরণকে সংজ্ঞায়িত করবো, কোনো চিহ্নকে কীভাবে তকমা দেবো, কোন আচার ও অভ্যাসকে আর ঝোঁক ও সংবেদনকে কোন পরিচয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত করবো সেটা বিরাজমান দাপুটে, কর্তৃত্ববাদী আর প্রবল বয়ানগত ও শরীরজ ঐতিহ্যের পারস্পরিক সম্পর্কের উপরে একদিকে নির্ভর করে। আবার অন্যদিকে প্রান্তিক ও এখন দুর্বল হয়ে পড়া বয়ানগত ও শরীরজ ঐতিহ্যের সম্পর্কের উপরে আর প্রবলের সঙ্গে এই দুর্বলের সম্পর্ক, মোকাবিলা, সংলাপ, সংঘাতের প্রক্রিয়া ও দশার উপরেও নির্ভর করে। প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের মাধ্যমে যে ঐতিহ্য গঠিত হয়েছিল, অথবা কর্তৃত্ব, নিপীড়স ও নৃশংসতার বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে যে বয়ানগত ও শরীরী সংবদনের ঐতিহ্য বাছাইকৃত হয়ে সাচ্চা, মুক্তিদায়ী, গণমানুষের হিসেবে গৃহিত হয়েছিল, প্রান্তিকতা সমেত লড়াইয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী হয়ে উঠেছিল সেই সবই পরিবর্তিত ক্ষমতাসম্পর্ক, প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্ব আর বয়ানের ও সেই বয়ান স্বীকৃত চিহ্নগুলোর ক্রিয়াকলাপে ভয়াবহভাবে প্রবল, নিপীড়ক আর আধিপত্যবাদী হয়ে উঠতে পারে। প্রবল ও প্রান্তিকের স্থান–চেহারা–সম্পর্ক কেবল বদলে যায়। গ্রামীণ সংস্কৃতি বা ফোক বলতে যেসব আচার ও অনুষ্ঠানকে আমরা বুঝি ও বাছাই করি তার মাধ্যমে অনেক আচারকে শহুরে বা মধ্যবিত্তের হিসেবে এমনভাবে পরিবেশন করতে থাকি যেন শহর ও মধ্যবিত্ত বা ভদ্রবিত্ত বয়ান ও যাপনের দুনিয়ার বাইরের কোনো পরিসর। কোনটা শহুরে আর কোনটা গ্রামীণ বা ফোক সেই হিসাবনিকাশই উপরের ঐতিহ্য বাছাইকরণ ও পুনর্গঠনের ইতিহাস ও প্রক্রিয়ার বাইরের না। বাংলা নববর্ষে ইতিহাসে তাই ‘আগেরটায় ফিরে যাওয়া’, এটা আরোপ করা, এটা আমাদের সংস্কৃতি না, এই আচার সহী বাঙালির না—এমন সকল দাবি বা বয়ার পরিশেষে ঐতিহ্য পুনর্গঠন, বাছাইকরণ, পুনর্নবায়নের বয়ানগত কর্তৃত্বকে হাজির করে। কে, কেন ও কীভাবে এইসব বয়ান তৈরি করছেন, কীভাবে উৎপাদিত এসব বয়ান বৈধতা ও অবৈধতা নির্ধারণ করছে, বিরাজমান ক্ষমতার কাঠামো ও সম্পর্কের সঙ্গে এই বয়ান প্রদানে সম্পর্ক কী ও কেমন তা বিশদভাবে পর্যালোচনা না করলে আমরা সহী ও গলদ নিয়া বিভ্রমের মধ্যেই যাপন করবো।
উপরের আলাপচারিতা পড়ে মনে হতে পারে যে, আমি যেহেতু ঐতিহ্য গঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া এবং সেই প্রক্রিয়া কীভাবে ও কেন আলাপিত হয় বা হয় না সেই প্রসঙ্গগুলো উল্লেখ করেছি তাই আমি একটি সাপেক্ষিকতাবাদী অবস্থান নিয়েছি। অর্থাৎ সকল ঐতিহ্যই সহী হতে পারে আবার সকল ঐতিহ্যই গলদ হতে পারে এমন কোনো যুক্তি আমি পেশ করছি। সেটা মনে হওয়াটা ভুল হবে। বরং সহীত্ব বা গলদত্বর জনপ্রিয় ও জনতুষ্ঠিবাদী বয়ান ও সংবেদনের ক্ষেত্রে আমি সতর্ক, সন্দেহ ও সংশয়সমেত অবস্থান জারি রাখতে চাই। এই আলাপের চাইতেও জরুরি হচ্ছে গঠিত ও পুনর্গঠিত হওয়ার প্রক্রিয়াগুলো নিষ্ঠা, মনোযোগ আর নিবিড়তার সঙ্গে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা। ঐতিহাসিকভাবে পর্যালোচনা করতে গেলে ধারাবাহিকতার পাশাপাশি ধারাবাহিকার ছেদ ও বদলকেও স্বাভাবিক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কনটিনজেনসি ও পরিপ্রেক্ষিতের পর্যালোচনা এখানে ভীষণ জরুরি। প্রতিপক্ষতা ও সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে এই প্রতিপক্ষতা কীভাবে ও কেন তৈরি হলো, এতে কোন প্রসঙ্গ ও বিষয় আড়াল করা হচ্ছে, কীভাবে প্রবলের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব জারি থাকছে, কীভাবে সমসাময়িক ও অতীতের সত্য আলামতগুলোকে আড়াল করে লুকানো হচ্ছে বা অবজ্ঞা করা হচ্ছে সেই দিকে মনোযোগ দিতে আমার আগ্রহ থাকবে। ঐতিহ্যের উদযাপন যদি প্রবলের ক্ষমতার প্রতি প্রতিস্পর্ধী হয়, ধারবাহিতা ও পরিবর্তনের প্রক্রিয়া, শর্ত ও পরিপ্রেক্ষিতের নিবিড়ি ও নিষ্ঠ পাঠসমেত বহুবিধ ও অনেকান্তবাদী ঐতিহ্যগুলোর সমধর্মী ও শরিকী তৎপরতা হিসেবে যাপনের অংশ হয় তাহলে মানবীয় আধিপত্য, লোভ, বাসনা আর আধিপত্যকামীতাকে চ্যালেঞ্জ করতে করতে, মিথ্যাকে চিহ্নিত করতে করতে, ভ্রান্ত ঐতিহ্য চেতনা ও পরিচয়বাদী নিপীড়ন আর সংখ্যাগড়িষ্ঠতাবাদকে জায়েজ করার ঐতিহ্যকে প্রশ্ন করতে করতে, বেসামাল করে দিতে দিতে ঐতিহ্যের উদযাপন তো আমরা করতেই চাই।
সূর্যোদয়ের এই ওয়াক্তে সকলকে আনন্দময় ও মঙ্গলময় নববর্ষের প্রীতি, শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই।
পহেলা বৈশাখ। ১৪৩২: : ১৪ এপ্রিল ২০২৫।
অরুনাপল্লি, সাভার, ঢাকা।