অরাজ
প্রচ্ছদ » জাতির কী রূপ?

জাতির কী রূপ?

  • সারোয়ার তুষার

শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ‘জাতির পিতা’ কিনা, তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত সম্প্রতি জমে উঠেছে। এ বিতর্ক করার জন্য উপযুক্ত সময় এখন কিনা– সে প্রশ্নও কেউ কেউ তুলেছেন। তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলা যায়, এ বিতর্ক উঠতই। বিমূর্ত স্তরে ‘জাতির পিতা’ ধারণার পিতৃতান্ত্রিকতা উপেক্ষা করার উপায় নাই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্রের অবদান অস্বীকার করে বিশেষ একজন ব্যক্তিকে ‘জাতির পিতা’ বানানোর ভাবাদর্শিক তাৎপর্যও উপেক্ষা করা যায় না।

পূর্ব বাংলা থেকে ক্রমে বাংলাদেশ নামে আবির্ভূত এ ভূখণ্ডের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চরিত্র। তাঁর ঐতিহাসিক অবদান অস্বীকার বা খাটো করার সুযোগ নাই। স্বাধীন বাংলাদেশে মুজিব শাসনামল সম্পর্কে ঐতিহাসিক মূল্যায়নেরও বিকল্প নাই।

আসলে কোনো ‘জাতি’র একক ‘পিতা’ থাকতে পারে কি? সাম্প্রতিক বিতর্কে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ ধারণার নজির টেনেছেন। ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের অবদান আনুষ্ঠানিকভাবে যদি স্বীকার করতেই হয়, ফাউন্ডার্স তথা স্থপতি ধারণার শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে একজন নয়, কয়েকজন স্থপতির কথা ভাবতে হবে।

‘জাতির পিতা’ ধারণার সমস্যা উপলব্ধির আগে খোদ ‘জাতি’ ধারণার সংকট উপলব্ধি করা প্রয়োজন। ইংরেজি ‘নেশন’ শব্দের বাংলা হিসেবে আমরা ‘জাতি’ শব্দটি গ্রহণ করেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করেন ‘নেশন’ শব্দের বাংলা হওয়া উচিত নয়; কারণ আমাদের সামষ্টিক জীবন নেশনকেন্দ্রিক নয়, সমাজভিত্তিক। বাংলায় ভাষায় ‘জাতি’ বা ‘জাত’ শব্দের অর্থও অনেক রকম– ঠিক রাষ্ট্রবাদী নয়; বাঙালি জাতি, নারী জাতি, পশু জাতি ইত্যাদি। তবু নেশন-স্টেটের বাংলা জাতিরাষ্ট্র, আর নেশনের বাংলা হিসেবে জাতি টিকে গেছে। রবীন্দ্রনাথের নোক্তা পাত্তা পায় নাই। পেলে ভালো হতো। তাঁর অবস্থানটাই সঠিক ছিল।

নেশন-স্টেট ইউরোপের বিশেষ ইতিহাসের ফসল। নিজেদের মধ্যে অনেক মারামারি-কাটাকাটি করে পাশ্চাত্য উপলব্ধি করে, এবার ‘সভ্য’ হওয়া দরকার। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, প্রতিটি নেশনের একটা স্টেট থাকতে থাকবে। খ্রিষ্টানদের অন্তঃধর্মীয় বিবাদে ১৭ শতকের ইউরোপ টালমাটাল ছিল। ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্টরা পরস্পরের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ৩০ বছরের (১৬১৮-৪৮) ধর্মযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সাব্যস্ত হয়– ‘রাজার ধর্মই হবে প্রজার ধর্ম’। ক্যাথলিক রাজত্বে প্রজার ধর্ম ক্যাথলিক; আর প্রটেস্টান্ট রাজত্বে প্রজার ধর্মমত প্রটেস্টান্ট। এই দফারফা ইতিহাসে ‘ওয়েস্টফালিয়ার সন্ধি’ হিসেবে পরিচিত। এর ফলে ধর্মের দিক থেকে রাজত্বগুলো একবাদী হয়ে উঠেছিল। ধর্মযুদ্ধে বিধর্মীনাশের মাধ্যমে ইউরোপে এক অদ্ভুত সাম্প্রদায়িক ‘শুদ্ধতা’ অর্জিত হয়েছিল। আশ্চর্য নয়; পরবর্তীকালের ইউরোপে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বাধিকার চেতনা যত বেড়েছে, এই একবাদী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বহুত্ববাদী ধ্যান-ধারণার সংঘাত তীব্রতর হয়েছে।

এক অর্থে, আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ‘এক জাতি এক ধর্ম এক ভাষা এক রক্ত’ কিসিমের বর্ণবাদী ধারণার সঙ্গে বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক চেতনার সংগ্রামেরই ইতিহাস। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সুদীপ্ত কবিরাজ মন্তব্য করেছেন: ‘দেখানো হয় যে ইয়োরোপীয় মানব ক্রমশই একটা থেকে আরেকটা মুক্তির দিকে লম্ফ দিয়ে বাকি পৃথিবীকে পথ দেখাচ্ছে। একটু খতিয়ে দেখলেই দেখা যায় সেই ইতিহাস যে কেবল শ্রেণিবিদ্বেষের এবং শোষণের ওপরে প্রতিষ্ঠিত তাই নয়, নিজের অস্মিতা ছাড়া সে অন্য সব অস্মিতাকেই অবমাননা এবং হিংসা করে এসেছে। এবং তাই পাশ্চাত্যের আধুনিক ইতিহাস মানবিক ভ্রাতৃত্বের ইতিবৃত্ত নয়, প্রত্যেক জাতির অন্য জাতির বিরুদ্ধে হিংসার ও যুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস।’1সুদীপ্ত কবিরাজ, ‘অ-জাতীয়’, রাষ্ট্রচিন্তা জার্নাল, ত্রয়োদশ সংখ্যা, ২০২৪

প্রচলিত কাণ্ডজ্ঞান অনুযায়ী ‘জাতি’ ধারণা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ইউরোপ তার ধর্ম প্রশ্নের মীমাংসা করেছে বলে মনে করা হয়। আসলে ব্যাপার হচ্ছে, ইউরোপের ‘জাতি ধারণা’র সঙ্গে (খ্রিষ্ট) ধর্মের যোগাযোগ ও আঁতাত গভীর। কারা এক ও অভিন্ন ‘জাতি’– এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে গিয়ে আধুনিক ইউরোপ সাব্যস্ত করেছে যে, যারা ভাষা, ধর্ম ও রক্তের দিক থেকে ‘এক ও অভিন্ন’, তারাই একীভূত জাতি। অর্থাৎ ইউরোপের জাতি ধারণা ‘মধ্যযুগীয়’ ধর্মের প্রতিবিধান তো নয়ই; বরং ধর্ম, ভাষা ও তথাকথিত অমিশ্রিত রক্তই ইউরোপের আধুনিক জাতিবাদী ধ্যান-ধারণার গাঠনিক উপাদান হিসেবে রয়ে গেছে। একই রক্তের অধিকারী অভিন্ন ভাষিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠী নির্দিষ্ট ভূমিতে ‘জাতিরাষ্ট্র’ কায়েম করবে– এমন ধ্যান-ধারণা উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়েও স্বাভাবিক মডেল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এই কাণ্ডজ্ঞান অনুযায়ী রাষ্ট্র মানেই জাতিরাষ্ট্র। বলা বাহুল্য, সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী এই (জাতি) রাষ্ট্রতত্ত্ব আধুনিক জমানার সব সংকটের মূলে। আধুনিক জাতিবাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্কও অত্যন্ত গভীর।

‘জাতি’ ধারণার বলেই ইউরোপ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। অভিন্ন ধর্ম-ভাষা-রক্তের বলে বলীয়ান কোনো ‘জাতি’ তথা সংগঠিত ইউরোপীয় লোকশক্তি পরদেশ আক্রমণ ও দখল করেছে। উপনিবেশিত অঞ্চল আকারে ও জনসংখ্যায় অনেক ক্ষেত্রেই ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তুলনায় বড় হলেও, তারা শুরুর দিকে উপনিবেশের যৌক্তিক বিরোধিতা করতে পারে নাই জাতি বা জনগণ ধারণার অভাবে।

উপনিবেশিত অঞ্চলের বুদ্ধিজীবীরা শুরুর দিকে ঠিক এ কারণেই উপনিবেশের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। এমন নয় যে, তারা স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন। কিন্তু কেন স্বাধীনতা? কার জন্য স্বাধীনতা? আমরা কি স্বাধীনতার উপযুক্ত হয়ে উঠেছি?– এই ছিল প্রধান তর্ক। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, কেবল স্বাধীনতা চাইলেই হবে না। চাওয়ার আগে ‘জাতি/জনগণ’ হয়ে উঠতে হবে। আবার ইউরোপীয় জাতিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পদানত অঞ্চলে ক্রমশ জাতীয় মুক্তির চেতনা তৈরি হওয়াতে উপনিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সূচিত হয়েছে।

যে যুক্তিতে ইউরোপ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলকে দখলে নিয়েছে, সেই একই যুক্তিতে উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষ বিংশ শতাব্দীতে উপনিবেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে তথা নিজেদের জাতি/জনগণ ঘোষণা করেছে। একই রক্তের অধিকারী জনগোষ্ঠী একটি ‘নেশন’ এবং তারাই একটি রাষ্ট্র গঠনের অধিকারী– এটাই আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের গোড়ার অনুমান।

‘নেশন’ শব্দ এসেছে লাতিন ‘নেশিও’ শব্দ থেকে; অর্থ জন্মসূত্রে একই সম্প্রদায়। অর্থাৎ জাতিরাষ্ট্রের সদস্যরা জন্মের সূত্রে সম্বন্ধিত, এ-ই হচ্ছে অনুমান। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের সব বর্ণবাদ ও অপরায়নের শিকড় এর মধ্যে নিহিত।

ইউরোপের অতীত দেখে আমাদের ভবিষ্যৎ চিনতে হবে– এ কথা আজকাল পাঁড় প্রাচ্যবাদীরাও বলার স্পর্ধা দেখান না। পার্টিশনের কালে সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপের অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে ‘সর্বজনীন’ ভেবে বহু ধর্ম বহু জাতি বহু ভাষার ভারতবর্ষকে দুই জাতিতে বিভক্ত করেছি আমরা। ধরে নেওয়া হয়েছিল, রাষ্ট্র মানেই জাতিরাষ্ট্র।

আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বের ইতিহাসে বিঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রস্তাব প্রাচ্য থেকেই উঠতে থাকবে। অধুনা দার্শনিক ও রাষ্ট্রতাত্ত্বিকরা বলছেন– তন্মধ্যে ওয়াল্টার মিনালু, মাহমুদ মামদানি, সুদীপ্ত কবিরাজ, ফরহাদ মজহার উল্লেখযোগ্য– রাষ্ট্র মানেই জাতির রাষ্ট্র হতে হবে, এমন কোনো দিব্যি নাই। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে গঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে জাতি ও রাষ্ট্রের আবশ্যিক যোগসাজশ অপ্রয়োজনীয়। এ কারণেই ফরহাদ মজহারের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী, মাহমুদ মামদানির বিউপনিবেশিত রাজনৈতিক সম্প্রদায়, সুদীপ্ত কবিরাজের অ-জাতিবাদী রাষ্ট্র ধারণা ‘জাতিরাষ্ট্র’ ধারণার বিরুদ্ধে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রস্তাব হিসেবে হাজির আছে। কোনো রক্তবাদী ও জাতিবাদী রাষ্ট্রকল্পকে সমর্থন করার সুযোগ নাই।

গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী নিজেদের জন্য সুসংহত রাষ্ট্র গড়ে তুলবে, এটাই আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকল্প। এ ধরনের রাষ্ট্রে ‘মেজরিটি’ হবে অস্থায়ী ও রাজনৈতিক মেজরিটি তথা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ফলাফল; স্থায়ী, অনড় কোনো সূচনাবিন্দু নয়। জাতিরাষ্ট্রে মেজরিটি ও মাইনরিটি উভয়ই স্থায়ী, অনড় এবং ধর্ম বা ভাষার দিক থেকে ধাতবাদী। অ-জাতিবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মেজরিটি ও মাইনরিটি উভয়ই অস্থায়ী, পরিবর্তনশীল ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ফসল। কাজেই ‘জাতি’ ধারণার বিপরীতে ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী’ বর্গটির চর্চা ও প্রয়োগ অধিকতর গণতান্ত্রিক।

প্রথম প্রকাশ : সমকাল  ২৪ অক্টোবর ২০২৪ 

  • 1
    সুদীপ্ত কবিরাজ, ‘অ-জাতীয়’, রাষ্ট্রচিন্তা জার্নাল, ত্রয়োদশ সংখ্যা, ২০২৪

সারোয়ার তুষার