অরাজ
শিল্পী: সালওয়া রাওয়াদাত শোকার
প্রচ্ছদ » জামরাত মেসন।। আমি পুরুষ কিম্বা নারী নই, একজন রূপান্তরকামী

জামরাত মেসন।। আমি পুরুষ কিম্বা নারী নই, একজন রূপান্তরকামী

আমার নাম জামরাত মেসন এবং আমার একটি যোনি রয়েছে। আমি পূর্ব লন্ডন অ্যাক্টিভিজম কমিউনিটির একজন সক্রিয় সদস্য, কিন্তু আজ আমি কথা বলবো একজন ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামীর জায়গা থেকে। ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি দ্বারা আদতে একটি বিস্তৃত পরিসরের জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয় যারা কোনো না কোনোভাবে তাদের জন্মসনদে লিপিবদ্ধ লিঙ্গপরিচয় হতে ব্যতিক্রমরূপে আত্মপ্রকাশ করে। কাজেই আমি কোনোভাবেই ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের প্রতিনিধি নই। আমি কেবল বলতে পারি একজন ট্রান্সেক্সুয়াল বা রূপান্তরকামী হিসেবে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান জগতটাকে কীভাবে দেখি। আজ সেটাই বলবো আপনাদের।

আমি বেশ সৌভাগ্যবান একজন রূপা। প্রথমত, কারণ আমি এখনও বেঁচে আছি। এবং দ্বিতীয়ত, কারণ আমার একটি পরিবার আছে যারা আমাকে ভালোবাসে। এগুলো এমন আহামরি সৌভাগ্যের ব্যাপার হবার কথা নয়, কিন্তু এই মুহূর্তে এগুলোই অনেক বড় বিষয়। আমার নিজের অভিজ্ঞতাই বেশ চমকপ্রদ। সংক্ষেপে বলছি। ৩ বছর বয়সে আমার উচ্চারিত প্রথম বাক্য ছিলো, ‘আমি একজন ছেলে’। ৭ বছর বয়সেও যখন আমি আমার বিশ্বাসে অনড় রইলাম, তখন বাবা-মা আমাকে একজন মনোবিজ্ঞানীর কাছে নিয়ে গেলেন। সেই মনোবিজ্ঞানী রায় দিলেন, আমি খুব সম্ভবত ‘লিঙ্গ-অস্থিরতায়’ ভুগছি। বাবা-মা তখন আমার স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে আমাকে চুল ছোট রাখার এবং ছেলেদের ইউনিফর্ম পরার অনুমতি আদায় করে দেন। ৮ বছর বয়সে আমাকে লন্ডনের এনএইএসে একজন মনরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হয় এবং ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত আমি তার তত্ত্বাবধানেই চিকিৎসা নিই। ১২ বছর বয়সে আমি আমার দাদি/নানির আর্থিক সহযোগিতায় আইনতভাবে আমার নাম পরিবর্তন করে একজন ছেলের নাম রাখি। তো মোটামুটিভাবে বলা যায়, আমি ৭-৮ বছর বয়স থেকেই একজন ছেলে বা পুরুষ হিসেবে জীবনযাপন করে আসছি। তবে আমি দৈহিকভাবে পুরোপুরি একজন নারীর মতই কৈশোরে পদার্পণ এবং বয়ঃসন্ধি যাপন করি, এবং ২১ বছর বয়সে টেস্টোস্টেরন হরমোন দ্বারা প্রভাবিত হই। ২২ বছর বয়সে আমি একটি অস্ত্রোপচার করাই। আমার বয়স এখন ২৪,কাজেই আমি বিগত প্রায় ২ বছর ধরে আমার বর্তমান রূপে আছি। 

কিন্তু আমার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র রূপান্তরকামীদের জন্য নিরঙ্কুশ গ্রহণযোগ্যতা প্রার্থনা নয়, অথবা আমাদের প্রতি সাধারণ মানুষের বিদ্বেষ দূর করাও নয়। আজ আমি সরাসরি ট্রান্সফোবিয়া বা রূপান্তরকামভীতি নিয়ে কথা বলতে চাই, কারণ এটি আমাদের সবাইকেই নানাভাবে প্রভাবিত করছে, এবং আমরা সকলেই এটা দূর করতে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে পারি। একটি সংঘবদ্ধ সমাজ হিসেবে লিঙ্গ প্রশ্নে আমাদের আরও সংবেদনশীল হওয়া আবশ্যক।

গর্ভে আমরা সবাই নারীই থাকি। যারা পুরুষ হিসেবে জন্ম নেয় তারা গর্ভকালীন সময়ে টেস্টোস্টেরোনের প্রভাবে পুরুষে পরিণত হয়। আমাদের ভগাঙ্কুর তখন বিবর্ধিত হয়ে পুংদণ্ডে পরিণত হয়, এবং ভগোষ্ঠ তখন পরিণত হয় অণ্ডকোষে। ইংরেজিতে women শব্দটার উৎপত্তিও men with womb বা womb-man থেকে, যার অর্থাৎ গর্ভ সম্বলিত পুরুষ। সেভাবে দেখতে গেলে, পুরুষেরা হলো বৃহদাকৃতির ভগাঙ্কুর সম্বলিত নারী,কিংবা বৃহদাঙ্গুর। অধিকাংশই একটি যোনি কিংবা পুংদণ্ড নিয়ে মাতৃগর্ভ থেকে বের হয়, কিন্তু কেউ কেউ এই দুইয়ের মাঝে আটকে থাকে। তাদেরকে ‘আন্ত:লিঙ্গ’ বলা হয়। ছেলে কিংবা মেয়ে হিসেবে জন্ম নেয়ামাত্র আমাদের সাথে বেশ লক্ষণীয় রকমের আলাদা আচরণ করা হয়। যেমন ছেলেদেরকে খেলনা হিসেবে দেওয়া হয় লেগো, আর মেয়েদেরকে পুতুল। (এবং তারপর আবার সমাজে নারী প্রকৌশলীর অভাব নিয়ে হা-হুতাশও করা হয়!) মেয়েদেরকে কোমল হতে এবং নিজেদের অনুভূতির ব্যাপারে কথা বলতে উৎসাহিত করা হয়, অপরদিকে ছেলেদেরকে দেওয়া হয় কঠোরতার পাঠ। বড় হতে গিয়ে প্রতিটি ছেলেমেয়েকে তার নিজের পরিচয় কী, এবং আসল পুরুষ বা আসল নারী কাকে বলে তা নিয়ে অনেক বক্তৃতা শুনতে হয়। আমাদের প্রত্যেককেই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এই নারী-পুরুষের দ্বন্দ্ব নিয়ে অনেক ভুগতে হয় বা হয়েছে। আমি নিজেকে এই দ্বন্দ্বের একজন চরম পর্যায়ের ভুক্তভোগী মনে করি। আমি নিজেকে পুরুষ মনে করি না, কিন্তু সেইসাথে আমি এটাও জানি যে আমি কোনোভাবেই সম্পূর্ণরূপে একজন নারীও নই। আমার মনে হয় সকল রূপান্তরকামীই এই দ্বন্দ্বের শিকার। 

আমাদের সমাজটা নারী ও পুরুষ এই দুই ভাগে বিভক্ত এবং আমি এই দুই দলের কোনোটিতেই পড়ি না। এর ফলে আমি শুধু সভ্য সমাজে নয়, প্রতি পদে পদে, এমনকি কারাগারেও নানা সমস্যার সম্মুখীন হবো। আমাকে যদি কোনো কারণে জেলে পাঠানো হয়, তাহলে হয় আমাকে একজন পুরুষ হিসেবে নারী সেলে রাখা হবে, কিংবা একজন যোনি সম্বলিত পুরুষ হিসেবে পুরুষ সেলে রাখা হবে, যেখানে আড়ালের কোনো বালাই নেই। আমাকে যদি কোনো কারণে গ্রেপ্তার করে আমার শরীরে তল্লাশি চালানো হয়, তাহলে হয় একজন নারী অথবা একজন পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তা কাজটি সম্পন্ন করবেন। কিন্তু আমি তো নারী-পুরুষ কোনোটিই নই। আমি একজন রূপান্তরকামী। রাষ্ট্রীয় কোনো লিঙ্গ নির্ধারক সনদপত্র নেই যার দ্বারা আমাকে সরকারিভাবে একজন নারী বা পুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি জানানো হবে। কেননা আমি নারী কিংবা পুরুষ কোনোটিই নই, আমি একজন ট্রান্সসেক্সুয়াল। হ্যাঁ, আমাকে একজন পুরুষ হিসেবে পুরুষ সেলে পাঠানো যায়, পুরুষ কর্মকর্তা দ্বারা আমার শরীরে তল্লাশি চালানো যায়, একজন নারীর সাথে আমাকে বিয়েও দেওয়া যায়। কিন্তু আমি তো বিয়ে করতে চাই না। আমি এমন কোনো সমাজে বাস করতে চাই না যেখানে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের শরীরে তল্লাশি চালিয়ে একে অপরকে জেলে পুরে দেয়। আমি এমন কোনো লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে চাই না যেখানে আমরা সরকারের কাছে আর্জি জানাবো আমাদের আরও সাবলীলভাবে,আরও কার্যকরভাবে শোষণ করার জন্য। আমি একটা পঁচে যাওয়া সমাজব্যবস্থায় কিঞ্চিৎ সুবিধা পেতে চাই না। আমি পুরো ব্যাপারটাতেই আমূল পরিবর্তন চাই। আমি একটি উন্নততর পৃথিবী বিনির্মাণে সক্রিয় অবদান রাখতে চাই।

শিল্পী: কালকি সুব্রামানিয়াম

ট্রান্স পুরুষ কিংবা রূপান্তরকামী পুরুষদের (মানে আমাদের) বিরুদ্ধে চলমান অপপ্রচার, কুসংস্কার, কিংবা ভ্রান্ত ধারণার একটি হলো যে, আমরা নাকি নিজেদেরকে পুরুষদের মত শক্ত-সমর্থ প্রমাণ করে সমাজে পুরুষের সেসকল সুযোগ-সুবিধা পেতে চাই,যা ভোগ করার অধিকার আমাদের নেই। আমরা নাকি অপর্যাপ্ত, অসম্পূর্ণ। কারণ আমাদের কোনো লিঙ্গ নেই, কিংবা থাকলেও তা কুৎসিত,ক্ষুদ্রাকার কিংবা অকেজো। আমরা বিশাল নিতম্ব এবং অকেজো লিঙ্গ সম্বলিত অপরিপূর্ণ পুরুষ। 

অপরদিকে ট্রান্স নারীদের সম্পর্কে প্রচলিত অপবিশ্বাস হলো,তারা নিজেদের আত্মসম্মান হারাচ্ছে। তারা হাস্যকর,কৌতুকের খোরাক। যেচে পড়ে নারী হতে কে-ই বা চাইবে বলুন? শুধু শুধু তারা সমাজে নিজেদের সম্মান একধাপ নিচে নামিয়ে ফেলছে। 

মোদ্দাকথা, ট্রান্সফোবিয়া বা রূপান্তরকামভীতির মূলে রয়েছে লিঙ্গবৈষম্য। অনেকে মনে করেন ট্রান্স নারীরা এই পুরুষশাসিত সমাজে নারী হবার যন্ত্রণা জানেন না, কারণ তাদের কখনো লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হতে হয় না। কিন্তু তারা এটা বোঝেন না যে, ট্রান্সফোবিয়াও লিঙ্গবৈষম্যেরই একটা রূপ। আরও শতগুণ বিভৎস্য একটা রূপ!

অনেকে বলেন, আমরা ট্রান্স পুরুষেরা এই লিঙ্গবৈষম্য থেকে বাঁচতেই পুরুষে রূপান্তরিত হই। কিন্তু সত্যিটা হলো, যে ট্রান্সেক্সুয়াল সে লিঙ্গবৈষম্য থেকে বেঁচে যাওয়া তো দূরে থাক বরং লিঙ্গবৈষম্যের এক অতল কূপে নিক্ষিপ্ত হয়। মূদ্রার দুই পিঠ, এবং এর কিনারটাকেও ভালোমত দেখে ফেললে, লিঙ্গবৈষম্যের আসল রূপটা দেখা যায়। তখন এই ব্যাপারে আপনার দৃষ্টি এতটাই সজাগ হয়ে যাবে, যে আপনি সেখানেও লিঙ্গবৈষম্যকে খুঁজে পাবেন যেখানে আর কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। লিঙ্গ বিষয়ে আপনি যত জানবেন,ক্ষমতার প্রবাহকে আপনি তত পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবেন।

লিঙ্গবৈষম্য কিংবা আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, মানুষের ব্যতিক্রমী লৈঙ্গিক আচরণের ওপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা লিঙ্গবৈষম্য, অর্থাৎ আসল পুরুষ বা আসল নারী না হতে পারার-এই ব্যাপারটা আলোচনায় প্রায় আসেই না বলতে গেলে। কিন্তু এই ব্যাপারটা সমকামভীতির পেছনেও একটি বড় কার্যকারণের ভূমিকা পালন করে। একটি সমকামী ছেলে যার আচার-আচরণ আর দশটা ছেলের মতই পুরুষালি,সে কিন্তু স্কুলে অন্য ছেলেদের দ্বারা বুলিয়িংয়ের শিকার হয় না। কারণ স্কুলের বাচ্চারা তাদের সহপাঠী কার প্রতি আকৃষ্ট তা নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা নেই। বরং তারা তার আচরণ দেখে বিচার করে। অপরদিকে একটি বিষমকামী ছেলের আচরণ যদি কিছুটা মেয়েলি হয়, সে কিন্তু ঠিকই বন্ধুদের বিদ্রূপের বস্তুতে পরিণত হয়। এবং সেক্ষেত্রে তার সহপাঠীরা তাকে ক্ষ্যাপানোর জন্য ছক্কা, সমকামী, ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে থাকে। আদতে তারা কেবলমাত্র তাদের মেয়েলি আচরণের জন্যই বুলিংয়ের শিকার হয়,কারণ তারা ‘আসল পুরুষ’ এর মত নয়। এটাও কিন্তু লিঙ্গবৈষম্য, কিন্তু আমরা একে সমকামভীতি বা হোমোফোবিয়া বলে থাকি। কিন্তু এতে মুশকিলটা হয় কি, হোমোফোবিয়া হিসেবে ব্যাপারটার মোকাবেলা করতে গেলে এ বিষয় নিয়ে কাজ করে এমন ভুরি ভুরি সংগঠন পেয়ে যাবেন,যারা আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। কিন্তু সেই ‘মেয়েলি’ আচরণের বিষমকামী ছেলেটাকে সাহায্য করার মত কোনো সংস্থা আছে কি? নেই। তাকে হয়তো বলা হচ্ছে যে সমকামী হওয়াটা দোষের কিছু নয়, যেটা সত্যি কথা। কিন্তু কেউ তাকে এটা বলছে না যে সমকামী না হয়েও একটা ছেলে মেয়েলি হতে পারে, এবং সেটাও দোষের কিছু নয়। আমরা ট্রান্সেক্সুয়ালরা হরদম এধরনের বুলিয়িংয়ের শিকার হই,এবং সেটা হয় আরও বিশ্রী। কিন্তু আমরা একা নই। সেই মেয়েলি স্বভাবের ছেলেটি কিংবা কিঞ্চিৎ পুরুষালি স্বভাবের মেয়েরাও কিন্তু আমাদের মতই এর ভুক্তভোগী।

ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের এই অভিজ্ঞতাগুলো লিঙ্গবৈষম্যের সবচেয়ে মারাত্মক নিদর্শনগুলোর মাঝে অন্যতম। ‘মারাত্মক’ শব্দটা এক্ষেত্রে মোটেও অত্যূক্তি নয়, কারণ ট্রান্সজেন্ডার ডে অফ রিমেম্বারেন্স এর ওয়েবসাইটের সমীক্ষা অনুযায়ী ২০০৯ সালে ১৩০ জন ট্রান্সজেন্ডার মানুষকে কেবলমাত্র ট্রান্সজেন্ডার হবার কারণে হত্যা করা হয়েছে। এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা যা আমাদের সকলকেই প্রভাবিত করছে এবং আমরা সকলেই এটা মোকাবেলায় অংশ নিতে পারি। 

এই ‘আসল পুরুষ’ এবং ‘আসল নারী’র সমগ্র ধারণাটারই উৎপত্তি হয়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে। আরও সহজ করে বললে, একটা পরিবারের একজনকে সারা সপ্তাহ কাজ করে মাইনে পেতে হয়, আরেকজনকে সন্তানদের দেখাশোনা করতে হয়, যা করতে গিয়ে তাকে ঘরের কাজ করতে হয় এবং বিনা মাইনেতে বাচ্চাদেরকে মানুষ করতে হয়, এই সমগ্র ব্যবস্থাটার কারণে। বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ পরিবারে পুরুষটি সারাদিন অর্থোপার্জনের জন্য কাজ করে, অপরদিকে নারীটি বিনা মাইনেতে বাড়ির কাজ করে। অর্থাৎ, নারীটির এই বিনা মাইনের পরিশ্রমটাই কিন্তু এই পুরো ব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রেখেছে। এটা না থাকলে সমস্ত ব্যবস্থাটাই ভেঙ্গে পড়তো। কিন্তু এটাকে লিঙ্গ পরিবর্তন করে, কিংবা পুরুষ এবং নারীর কাজ অদলবদল করে, কিংবা পালা করে করলেও পাল্টানো সম্ভব না। এমনকি আরেকজন নারীকে সামান্য কিছু পয়সা দিয়ে এই কাজগুলো করিয়ে নিলেও এই ব্যবস্থাটায় কোনো পরিবর্তন আসবে না। কারণ এই ব্যবস্থাটা যতদিন চলমান থাকবে, কাউকে না কাউকে বিনা মাইনেতে কাজ করতে হবে। এবং এই অসমতাই আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। আমরা ট্রান্সজেন্ডাররা যতই নারী-পুরুষের কাজ ভাগ করে নেয়ার এই অসমতার নগ্ন স্বরূপটাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিই না কেন, কেবলমাত্র কাজের সমতার জন্য দাবী জানানোই এই সমস্যার সমাধান নয়।

শিল্পী: গিওর্গে ভারতুসু

এর সমাধান হিসেবে আমি আবারও আমার আগের কথাটারই পুনরাবৃত্তি করতে চাই। আমাদের একটি সমাজ হিসেবে, একটি সম্প্রদায় হিসেবে লিঙ্গ প্রশ্নে সংবেদনশীল হতে হবে। এক লিঙ্গপরিচয় থেকে আরেকটাতে রূপান্তর বিষয়টা কেবলমাত্র অস্ত্রোপচারেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এই পুরো প্রক্রিয়ায় খুব ক্ষুদ্র একটা ভূমিকা পালন করে অস্ত্রোপচার। রূপান্তর ব্যাপারটা মূলত ঘটে থাকে সামাজিকভাবে, কারণ লিঙ্গপরিচয়ের সমগ্র ধারণাটাই সামাজিক একটা ধারণা। আগেই বলেছি,আমি প্রায় ১২ বছর কোনোরকম অস্ত্রোপচার কিংবা হরমোন থেরাপি ছাড়াই একজন পুরুষ হিসেবে জীবনযাপন করেছি। আমি এখন একজন পুরুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারি কারণ লোকে আমাকে পুরুষ হিসেবে জানে এবং সম্বোধন করে। ‘রূপান্তর একটি সামাজিক বিষয়’- এই কথাটা বেশিরভাগ মানুষই বোঝে না। কেউ ট্রান্স হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে লোকে সেই ব্যক্তির জন্মসূত্রে পাওয়া লিঙ্গপরিচয় অনুযায়ী তার মত পরিবর্তনের চেষ্টা করে। অর্থাৎ, সে পুরুষের শরীরে জন্মে নারী হতে চাইলে তাকে জোর করে পুরুষ বানানোর চেষ্টা করা হয়, আবার সে নারীর শরীরে জন্মে পুরুষ হতে চাইলে তাকে জোর করে নারী বানানো হয়। এক্ষেত্রে তার আচরণ কতটা নারীসুলভ কিংবা পুরুষসুলভ- এই বিষয়টা অনেক বড় ভূমিকা পালন কর। এর ফলে একজন ট্রান্স ব্যক্তিকে ‘মেয়েলি’ কিংবা ‘পুরুষালি’ আচরণ করে তবেই সমাজে সম্মানের সাথে বাঁচার অধিকার অর্জন করতে হয়। এর মানে হলো আমাদের মত ট্রান্স পুরুষেরা কঠোর, পুরুষালি বেকুবের মত আচরণ করি বলেই সবার কাছে সম্মানিত হই। কিন্তু আসলে তো আমাদের সকলেরই উচিৎ প্রত্যেককে তার নিজ নিজ পরিচয়ের জন্য নির্বিশেষে সম্মান করা, যাতে সকলে তাদের নিজের পরিচয়েই স্বাছন্দ্য বোধ করে। 

আমরা আমাদের এই প্রাইড মার্চ এবং অ্যক্টিভিজমের মাধ্যমে কী অর্জন করতে চাই?

কেবলই কি ক্ল্যাপ্টন, স্ট্র্যাটফোর্ড, কিংবা ইস্টহ্যামের মত পূর্ব লন্ডনের অভিজাত এলাকাগুলোয় ‘যেমন খুশি তেমন’ সাজে হেঁটে যাওয়ার, যাকে খুশি তাকে চুমু খাওয়ার স্বাধীনতা? কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষদের মাঝে, যেখানে আমরা আসলে বাস করি, সেখানে আমাদের স্বাধীনতার কী হবে? কবে আমরা আমাদের পরিচয়, প্রেম, লিঙ্গ, এবং শরীর নিয়ে সকলের সামনে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারবো, একদল বখাটে কিশোরের হাতে গণপিটুনির শিকার হবার ভয় ছাড়াই? আর আমাদেরকে গণপিটুনি দিতে চাওয়া সেই ‘গণ’- দের কী হবে? তারাও তো আমাদেরই বন্ধু, পরিজন, প্রতিবেশী। সেই কিশোরদের মধ্যে কেউ কি চাইলেই তার প্রিয়তমকে চুমু খেতে পারবে? পারবে তার পছন্দমত ‘মেয়েলি’ পোশাকে সাজতে, সকলের কাছ থেকে বিতাড়িত হবার কিংবা নিজের স্বকীয়তা হারানোর ভয় ছাড়াই?

এগুলো শুনতে সেসকল মধ্যবিত্ত সমকামীদের কাছে লোভনীয় মনে হতেই পারে, যারা ইতমধ্যেই তাদের স্বাধীনতা অর্জন করে ফেলেছে। হ্যাম্পস্টেডের অভিজাত এলাকায় প্রেমিকের হাত ধরে হেঁটে বেড়ানো সেসকল সমকামীদের মনে হতেই পারে, “আমরা তো দিব্যি আছি। কী দরকার ওসব ঝামেলায় জড়ানোর?” তারা চাইতেই পারে হ্যাকনি’র মত হোমফোবিয়া, ট্রান্সফোবিয়া, লিঙ্গবৈষম্যে জর্জরিত স্বল্পশিক্ষিত, নিম্নবিত্ত এলাকায় থাকা আমাদের মত রূপান্তরকামীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সহযোদ্ধা না হতে। বর্তমানে লন্ডনের প্রাইড আন্দোলনের চেহারা দেখে মনে হয় আমাদের সতীর্থদের মাঝে এই না চাওয়াদের সংখ্যাই বেশি। আর সেকারণেই, ঠিক এই কারণেই, এরকম তৃণমূল পর্যায়ে আন্দোলনটাকে জিইয়ে রাখতে এধরণের কর্মসূচীর আরও বেশি বেশি প্রয়োজন। এবং সর্বক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলনটাকে সচল রাখা প্রয়োজন।

  • মূল লেখার লিংক: https://theanarchistlibrary.org/library/jamrat-mason-i-am-not-a-man-or-a-woman-i-am-a-transexual

মাঈশা মারিয়াম

অনলাইনে লেখালিখি, অনুবাদ, ও সম্পাদনা করেন। পড়াশোনা করেছেন ইংরেজি সাহিত্যে। আগ্রহের বিষয়সমূহের মধ্যে রয়েছে সংগীত, চিত্রকলা, এবং ভ্রমণ। স্বরব্যাঞ্জো ব্যান্ডের সাবেক এবং লুব্ধক ব্যান্ডের বর্তমান সদস্য। বারোভাজা নামক একটি সমাজকল্যাণ সংগঠনের সদস্য।
ইমেল: maesha.marium@gmail.com