অনুবাদ: ফারজানা লিয়া
আব্দুল্লাহ্ ওজালান একজন চিন্তক, দার্শনিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী । তিনি কুর্দিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সসস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (PKK) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮৪ সালে কুর্দি–তুর্কি সংঘাতের সময় এই সংগঠনটির নেতৃত্ব দেন তিনি। যার ফলে ১৯৯৯ সালে তুরস্কের সরকার তাকে বন্দি করে ও মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। পরবর্তীতে তুরস্কে মৃত্যুদণ্ডের প্রথা বাতিল হলে ওজালানকে মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। এখন পর্যন্ত তিনি তুরস্ক সরকারের হাতে বন্দি আছেন। বন্দি অবস্থায়ই তিনি একাধিক গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করেন। ওজালানের রাজনৈতিক চিন্তা মারে বুকচিন, মিশেল ফুকো, হানাহ্ আরেন্ডট্, কার্ল মার্ক্সের মতো দার্শনিকদের পাশাপাশি নারীবাদী রাজনৈতিক চিন্তা ও মেসোপটেমিয়ার পূরাণ দ্বারাও প্রভাবিত। মূলত মারে বুকচিনের প্রভাবেই তিনি মার্ক্সিস্ট, লেনিনিস্ট ও স্তালিনীয় মতাদর্শ থেকে বের হয়ে এসে মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মারে বুকচিনের চিন্তাধারার প্রভাবেই তিনি কুর্দি প্রশ্নে হাজির করেছেন গণতান্ত্রিক কনফেডারেশনের সূত্র। ওজালানের চিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এমন একটি নারীবাদী রাজনীতি যেখানে তিনি নারীদের দেখেন গণতান্ত্রিক স্বাধীন সমাজ গড়ে তোলার কেন্দ্রস্বরূপ। ওজালানের এই দর্শনকে যিনিওলজি (Jineology) বা নারীদের বিজ্ঞান বলা হয়। উত্তর এবং পূর্ব সিরিয়ার স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল রোজাভায় কুর্দিরা যে মুক্ত সমাজ গড়ে তোলার প্রয়াস সেখানে ওজালানের গণতান্ত্রিক ফেডারেলবাদ, নারীবাদ ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন ধারণার প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সমন্বয়ে কুর্দিস্তান কমিউনিটিজ ইউনিয়ন (KCK) ওজালানের রাজনৈতিক চিন্তাকে বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে।- সম্পাদক
নারী প্রসঙ্গ নিয়ে ভাবা বা লিখতে যাওয়ার মানে হচ্ছে সমগ্র ইতিহাস ও সমাজকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা। এর কারণ হচ্ছে নারীর উপর নিয়মতান্ত্রিক নিপীড়নের নজিরবিহীন এক ব্যাপ্তি।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, সভ্যতার ইতিহাসকে নারীর লোকসানের ইতিহাস হিসেবেই সংজ্ঞায়িত করা যায়। আর এই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়—যেই ইতিহাস ঈশ্বর ও তার বান্দাদের, প্রভু আর তাদের ভৃত্যদের, কারখানার, বিজ্ঞান ও শিল্পের— সবখানেই পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক ব্যক্তিত্ব নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে। সামগ্রিকভাবে এটি পুরো সমাজেরই ক্ষতি; যার ফলস্বরুপ আমরা লিঙ্গবৈষম্যে জর্জরিত একটি সমাজ পেয়েছি।
লিঙ্গবাদ যেমন ক্ষমতার হাতিয়ার, তেমনি এটি একটি অস্ত্রের মতোও, যা ইতিহাসজুড়ে সভ্যতার সমস্ত ব্যবস্থার মাঝেই পাকাপোক্তভাবে আসন গেড়ে বসে আছে। আদতে কোনো সামাজিক গোষ্ঠীই নারীদের মতো শারীরিক এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে এতটা শোষণের শিকার হয়নি। নারী নিপীড়নের বিভিন্ন রূপের ধরনগুলোও বেশ স্পষ্ট। একজন নারী উত্তরাধিকারীর জন্ম দেয়। নারী বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম বিলায়। সবার অপছন্দের কাজগুলো তারই ঘাড়ে বর্তায়। নারী হচ্ছে একজন বাধ্যগত দাস। যৌনাকাঙ্ক্ষার চিরস্থায়ী এক বস্তু নারী। নারী বিজ্ঞাপনের মাধ্যম। নারী মূল্যবান ভোগ্যপণ্য, আসলে নারীই হচ্ছে সকল পণ্যের রানি। নারীই সেই ভিত্তি তৈরি করে দেয় যার উপর সহিংসতার অবিচ্ছিন্ন হাতিয়ার হিসেবে পুরুষ তার ক্ষমতা উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করতে পারে। সভ্যতার ৫০০০ বছরের ইতিহাসকে আমরা প্রকৃত অর্থে ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’ হিসেবে বর্ণনা করতে পারি।
পুঁজিবাদের যুগে লিঙ্গবাদকে খুব নিখুঁতভাবে ভাবাদর্শিক হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছে। লিঙ্গবৈষম্যময় সমাজের উত্তরসূরি হিসেবে পুঁজিবাদ নারীকে কেবল ঘরের ভেতরেই বিনা পরিশ্রমে খাটিয়ে তৃপ্ত হয়নি, নারীকে সে পরিণত করেছে যৌন বস্তুতে, বাজারে বিকানোর উদ্দেশ্যে নারীকে পরিণত করেছে ভোগ্যপণ্যে। পুরুষ যেখানে শুধু তার শ্রমই বিক্র করতে পারে সেখানে একজন নারী শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোটাই বিক্রির বস্তু। এভাবেই দাসত্বের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপটি অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠে। নারীর ওপর আধিপত্য আরোপের জন্য এই ব্যবস্থা একটি কৌশলগত ভূমিকা আরোপ করে, যা শোষণ ও ক্ষমতার বিস্তারের সাথে জড়িত। নারীর উপর প্রথাগত দমনপীড়নের প্রসার ঘটার সাথে সাথে প্রতিটি পুরুষই কর্তৃত্বশীল সঙ্গী হয়ে উঠতে থাকে। এভাবেই একটি সমাজ সামগ্রিক ক্ষমতা বিস্তারের লক্ষণ দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান একই সাথে সীমাহীন আধিপত্যের বোধ ও ধারণা প্রদান করে।
নারীকে জৈবিকভাবে অসম্পূর্ণ লিঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করাটা নিখাঁদ ভাবাদর্শিক ও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের ফসল। আর এই অবস্থাকে স্বাভাবিক প্রতিপন্ন করতে এই মতবাদ তাবৎ বৈজ্ঞানিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রচেষ্টার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, নারী নিজেই এই অবস্থাকে স্বীকার করে নেয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এই অধস্তন অবস্থানের স্বাভাবিকতা ও পবিত্র অলঙ্ঘনীয়তা, যাকে নানাবিধ মানুষই শত শত বছর ধরে মেনে আসছে, নারীদের মধ্যেও তা সমানভাবে গ্রহণীয়, এবং তা নারীর চিন্তা ও আচরণকেও গড়ে তুলে। এটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, কোনো নৃগোষ্ঠী, শ্রেণি বা জাতিই নারীদের মতো এতটা কাঠামোগত দাসত্বের শিকার হয়নি। নারীর দাসত্বের ইতিহাস এখনো লেখা বাকি আর মানব–মুক্তির ইতিহাস এখনো নারীর হাতে রচিত হবার অপেক্ষায়।
নারী তার নিজের দাসত্বে অভ্যস্ত হয়ে পড়ার মাধ্যমে একটি কর্তৃত্বক্রমের (হায়ারার্কি) উদ্ভব হয়, এবং এর ফলে সমাজের অপরাপর অংশকগুলোকেও দাসত্বের অধীনে নিয়ে আসার পথ সুগম হয়। নারী দাসত্বের পরম্পরা হিসেবেই পুরুষের দাসত্ব এসেছে। জাতি বা শ্রেণিগত দাসত্ব আর লিঙ্গভিত্তিক দাসত্বের পার্থক্য হলো, একে তো তা অনেক সুদূরপ্রসারি এবং সূক্ষ্ম, তার উপর আবেগতাড়িত মিথ্যা বুলি আওড়ে এই নিপীড়ন নিশ্চিত করা হয়। সমাজের সর্বত্র নারীর দাসত্বই অন্য সকল প্রকার কর্তৃত্বক্রম (হায়ারার্কি) ও রাষ্ট্রকাঠামোর পথ সুগম করেছে। কর্তৃত্বক্রমিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ক্ষুদ্র একটি অংশের বাইরে, শুধু নারীর জন্যই নয় বরং সমগ্র সমাজের জন্যই তা সর্বনাশ ডেকে এনেছে।
এ কারণেই পুরুষতান্ত্রিক ভাবাদর্শ ও এর উপর নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর যেকোনো প্রকার গভীর সমালোচনার পথই উপেক্ষা করা হয়েছে। এই ব্যবস্থার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিপ্রস্তর হচ্ছে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠান। পরিবার হচ্ছে পুরুষের মানসজাত একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। সভ্যতার সামগ্রিক ইতিহাসজুড়েই পরিবারের অর্থ এই শক্তিবলেই বিস্তার লাভ করেছে যেই শক্তি শাসকগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রযন্ত্র একে প্রদান করেছে। পুরুষের আধিপত্যের দিকে পরিবার বিন্যাসের ধাবিত হওয়া, এবং এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রবাদী সমাজের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিবারের নিজেকে সফলভাবে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই নারীর সীমাহীন, মজুরিবিহীন কাজ চালিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করা হয়েছে। একই সাথে তারা সন্তান লালনপালন করে, পর্যাপ্ত জনগোষ্ঠী তৈরিতে রাষ্ট্রের চাহিদা পূরণ করে আবার সমগ্র সমাজজুড়ে দাসত্ব ছড়িয়ে দেয়ার রোল মডেল হিসেবেও কাজ করে।
রাষ্ট্রের একটি মাইক্রোমডেল হিসেবে যদি পরিবারকে আমরা স্বীকার না করি তবে মধ্যপ্রাচ্যীয় সমাজের উপযুক্ত বিশ্লেষণ করা অসম্ভব। আদিঅন্ত উপর্যুপরি মার খাওয়া মধ্যপ্রাচ্যীয় পুরুষ নারীর ওপরই তার প্রতিশোধ আরোপ করে। প্রকাশ্যে সে যত বেশি অপমানিত হয়, তত বেশি সে নারীর উপর তার আগ্রাসন আরোপ করে। আপন সমাজ থেকে নিজেকে রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে, অসহায় ও ক্ষুব্ধ পুরুষ পরিবারে একজন স্বৈরাচারের মতো আচরণ করে এবং স্ত্রী–সন্তানদের ওপর হিংস্র হয়ে উঠে। যে পুরুষ তার নিজের মূল্যবোধগুলোকে সমাজে পদদলিত হতে দেয়, তথাকথিত ‘অনার কিলিং‘-এর মাধ্যমে সে চেষ্টা করে তার সেই ক্রোধ নারীর উপর প্রয়োগ করতে।
মধ্যপ্রাচ্যের সমাজের ক্ষেত্রে এটা যোগ করা দরকার যে পুরুষতান্ত্রিক, রাষ্ট্রবাদী সমাজের প্রথাগত প্রভাবের সাথে কোনোভাবেই পশ্চিমা সভ্যতার অধিকতর আধুনিক রূপগুলোর প্রভাবের মেলবন্ধন ঘটেনি। বরং এগুলো এমন একটি সংঘবদ্ধতা তৈরি করে যার সাথে গর্ডিয়ান নটের তুলনা করা চলে।
দেখা যাচ্ছে, পুরুষের ক্ষেত্রে ক্ষমতা ও আধিপত্যের ধারণাকে বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত কঠিন। নারী যতটা নয় তার চেয়ে পুরুষই যেকোনো প্রকার পরিবর্তনকে অস্বীকার করে। আধিপত্যশীল ভূমিকা ছেড়ে দিলে পুরুষ নিজেকে রাজ্যহারা রাজার মতো অবস্থানে দেখতে পায়। ফলে তাকে চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিতে হবে যে, আধিপত্যের এই ফাঁপা রূপই তাকে স্বাধীনতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলে।
এ ধরনের বিশ্লেষণ নিছক তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ না, তার থেকেও বেশি কিছু। কারণ এগুলোর মধ্য দিয়ে কুর্দি জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের অস্তিত্বের তাৎপর্য প্রকাশ পায়। কুর্দি জনগণের স্বাধীনতাকে নারী স্বাধীনতা থেকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই, এ কারণেই আমরা নিজেদের সেভাবেই সংগঠিত করেছি। সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতা আর স্থানীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর আক্রমণ সত্ত্বরও যে আমাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা দমে যায়নি, তার সবচেয়ে বড় এবং অমূল্য অংশের কৃতিত্ব দিতে হয় নারীমুক্তির আন্দোলন আর এই আন্দোলন যে সচেতনতার সৃষ্টি করেছে তাকে। আমাদের মতে স্বাধীন নারী ব্যতীত কোনো স্বাধীন কুর্দিস্তান হতে পারে না।
এই দার্শনিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ কোনো অর্থেই নারীদের সংগ্রামে যুক্ত করার কৌশলগত রাজনৈতিক চাল নয়। আমাদের লক্ষ্য হলো একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পুরুষ একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে। আমি বিশ্বাস করি, আজ অবধি আমাদের সংগ্রামের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অধপতিত, আধিপত্যশীল, অত্যাচারী, শোষণকারী পুরুষকে বুঝতে সক্ষম হয়েছি। নারীর স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে আমি সবচেয়ে যথাযথ যে উত্তর খুঁজে পেয়েছি তা হলো, পুরুষতান্ত্রিক পুরুষকে বুঝো, বিশ্লেষণ করো ও তাকে ‘মেরে’ ফেলো। আমি আরো এক ধাপ এগিয়ে যেতে চাই। আমি পুরুষকে শান্তিকামী এক ব্যক্তিত্বে বিনির্মাণের আহ্বান করব। ধ্রপদী পুরুষকে বিশ্লেষণ ও ‘হত্যা’র মাধ্যমে ভালোবাসা আর শান্তির পথকে সুগম করতে হবে। এদিক থেকে আমি নিজেকে নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন কর্মী বলে মনে করি।
বিপরীত লিঙ্গসমূহের মধ্যকার বিরোধের দীর্ঘ ৫০০০ বছরের ইতিহাস রয়েছে, যা একবিংশ শতাব্দীর প্রধান সংগ্রাম হয়ে উঠেছে। নারীরা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। এই সমস্যাকে দৃশ্যমান করে তোলার জন্য এই সংগ্রামকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় কিছু অসাধারণ নারী তাদের পদচিহ্ন রেখে গেছে তাদের জীবন, তাদের চিন্তা আর কর্মের মাধ্যমে। নারীর এই বিরুদ্ধাচারণ আমাদের সামনে কিছু একটা তুলে ধরে— তা হলো পুরুষতান্ত্রিক ভাবাদর্শ ও মূল্যবোধ, সমাজে এই মূল্যবোধগুলোর প্রভাব এবং পুরুষতান্ত্রিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছাড়া আমরা না পারব আমাদের জীবনে স্বাধীনতা অর্জন করতে, না পারব একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে, সে কারণে সমাজতন্ত্রকেও কার্যকর করে তোলা যাবে না। জনগণ শুধুমাত্র গণতন্ত্রেরই কামনা করে না, তারা লিঙ্গবৈষম্যহীন একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রত্যাশা করে। লিঙ্গসমতা ছাড়া, স্বাধীনতা বা সাম্যের যে কোনো ডাক ভিত্তিহীন আর বিভ্রান্তিকর। জনগণের যেমন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে, তেমনি নারীরও উচিত তার নিজের ভাগ্য নিজেকেই নির্ধারণ করা। পাশ কাটিয়ে যাওয়া বা ফেলে রাখার মতো কোনো বিষয় এটি নয়। অন্যদিকে, নতুন একটি সভ্যতা নির্মাণের পথে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে নারীর স্বাধীনতা অপরিহার্য হয়ে উঠবে। আমি বিশ্বাস করি, স্বাধীনতার জন্য প্রকৃত সমাজতন্ত্র এবং জাতীয় সংগ্রামের বিপরীতে, শ্রেণি বা জাতির স্বাধীনতার থেকে নারীর স্বাধীনতা অধিক গুরুত্ব বহন করে।
নিজেদের সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, নারীর স্বাধীনতার জন্য যে লড়াই তা রাজনৈতিক বলয়ে প্রবেশ করার সাথে সাথেই তাকে চূড়ান্ত পর্যায়ের কঠোর বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হবে। তা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক রণক্ষেত্রে বিজয় ছাড়া কোনো দীর্ঘমেয়াদী অর্জন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক রণক্ষেত্রে বিজয় মানে এই নয় যে নারী ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবে। বরঞ্চ ঠিক উল্টোটা, রাষ্ট্রবাদী আর কর্তৃত্বক্রমিক কাঠামোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ মানে এমন একটি কাঠামোর সৃষ্টি করা যেটি রাষ্ট্রঅভিমুখী নয় বরং একটি গণতান্ত্রিক আর পরিবেশবাদী সমাজের দিকে অগ্রসর হওয়া যেখানে সকল ধরনের লিঙ্গই হবে স্বাধীন। আর এর ফলে শুধু নারীই নয় বরং সমগ্র মানবজাতিরই জয় হবে।