১৯৩৬ সালে, গৃহযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে, স্পেনের শ্রমজীবী জনতা যে বিপ্লবটি সংগঠিত করেছিলেন, তাকে যদি বিগত ১০০ বছরের শ্রম-মুক্তি আন্দোলনের সবচে প্রানবন্ত ফসল বলা হয়; তাহলে মোটেও বাড়িয়ে বলা হয় না। স্পেনের, বিশেষ করে কাতালোনিয়া ও অ্যারাগন অঞ্চলের কৃষক-শ্রমিকরা নৈরাজ্যবাদী মতাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে এমন সব সামাজিক প্রকল্প পরিচালনা করেছিল; যা সে আমলের সবচে আশাবাদী বিপ্লবীও কল্পনা করতে পারেনি। এই বিপ্লবী সময়টাতে অ্যানার্কো সিন্ডিকালিস্ট ও শ্রমিকরা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রর মাধ্যমে কয়েকশ কালেক্টিভ গড়ে তোলেন এবং স্ব-ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেগুলো পরিচালনা করেন। শ্রমিকদের অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র ও কালেক্টিভগুলো স্প্যানিশ বিপ্লবকে এমনভাবে চিহ্নিত করে যা তাকে পূর্বের সকল সামাজিক নীরীক্ষা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা স্থান দেয়। অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র ও কালেক্টিভগুলো গড়ে তোলার পেছনে প্রধান ভূমিকা রাখে স্পেনের তখনকার সর্ববৃহৎ শ্রমিক ইউনিয়ন, সি.এন.টি এবং স্পেন-পর্তুগালের অ্যানার্কিস্ট সংগঠন, এফ.এ.আই-এর অ্যাক্টিভিস্টরা। কয়েক হাজার বছরের রাজতন্ত্রী, সামন্তবাদী ও পরবর্তী পুঁজিবাদী অত্যাচার, শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্পেনের প্রলেতারীয় জনতার ন্যায়, সম্মান, মুক্তি ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে সি.এন.টি তার কর্মনীতি হিসেবে ধারণ করে।
এই আকাঙ্ক্ষা ও কর্মনীতি বাস্তব রূপ পায় তাদের অ্যানার্কো সিন্ডিক্যালিস্ট ও মুক্তিকামী কমিউনিস্ট প্রোগ্রামে। কয়েক দশক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর তাদের সে প্রোগ্রাম বাস্তব রূপ পায় ১৯৩৬ সালের বিপ্লবে। সে সময়ের কালেক্টিভগুলোর মধ্য দিয়ে। এসব কর্মকাণ্ডের মূল চিন্তাধারা অ্যানার্কিস্টদের মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা পেলেও, বাস্তবে এগুলো পুরোপুরি স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে তুলেছিল শ্রমজীবী মানুষেরা। তাঁরাই নিজেদের মধ্যে গণতান্ত্রিক উপায়ে চর্চা করেছেন স্ব-ব্যবস্থাপনার নানা উপায়-কৌশল। শুধু তাই নয়, তত্ত্ব থেকে বাস্তব চর্চায় যাওয়ার সময় যেসব নানাবিধ সমস্যায় পড়তে হয়েছে; সেগুলোর অবাক করা সৃজনশীল সমাধানও এসেছে এই শ্রমজীবী মানুষদের থেকেই। সেখানে আলাদা করে কোনো তাত্ত্বিক বা বুদ্ধিজীবীর প্রয়োজন হয় নি।
শ্রমের জাতীয় কনফেডারেশন1স্প্যানিশ ভাষায়ঃ Cofederecion Nacional del Trabajo – CNT। ইংরেজিতেঃ National Confederation of Labour. – সি.এন.টি-র বিপ্লব পূর্ববর্তী সদস্য সংখ্যা ছিল ১০ লাখের মতো। স্পেনের সর্ববৃহৎ ইউনিয়ন তো বটেই, এটি তখনকার দুনিয়ার সবচে বড় ইউনিয়নগুলোরও একটি ছিল। সি.এন.টি-র গঠনতন্ত্রে তাদের মূল লক্ষ্য স্পষ্ট অক্ষরে লেখাঃ “সামাজিক বিপ্লব ও মুক্তিকামী কমিউনিজম।”2CNT – The Founding Congress of The Spanish Confederation of Labor. তাদের পন্থা ছিল: অ্যানার্কো সিন্ডিক্যালিজম অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেনীর ইউনিয়ন দ্বারা বিপ্লবী কর্মকান্ডের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণীকে সামাজিক বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করা এবং শ্রমিক শ্রেণীর নিজ তত্ত্বাবধানে বিপ্লব সম্পন্ন করা।
সি.এন.টি-র এক্টিভিস্টরা নিজেদের এই শক্ত অবস্থান তৈরি করেছিলেন বিগত বেশ কয়েক বছরের বিরামহীন আন্দোলন-সংগ্রাম ও প্রচার-প্রচারণার মধ্য দিয়ে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল: ১৯১৯ সালের ৮ ঘন্টা শ্রমের আন্দোলন। এ আন্দোলনের সফলতা হিসেবে বিশ্বের প্রথম ৮ ঘন্টার কর্মদিবস আইন পাশ করা হয়। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহের ঘটনা ছিল ১৯৩৪ সালের আস্তুরিয়ার খনি শ্রমিকদের বিদ্রোহ। সেখানে শ্রমিকরা নিজেদের ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বাধীন বলে। পরে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সেই বিদ্রোহ দমন করা হয়। সি.এন.টি-র ইতিহাসে রক্তক্ষয়ী এই অধ্যায়ে প্রাণ দিতে হয়েছিল হাজার হাজার নৈরাজ্যবাদীকে।
তবে এসব আন্দোলন ও আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। ১৯৩৬ সালের জুলাইয়ে এসে যায় সেই পরমক্ষণ, যার জন্য এই মুক্তিকামী জনতা অপেক্ষা করেছেন এবং রক্ত ঝরিয়েছেন শত শত বছর ধরে।
১৯৩৬ সালের জুলাইয়ে, স্পেনের নির্বাচিত রিপাবলিকান সরকারের বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থান শুরু হলে প্রথম প্রতিরোধটি এসেছিল সিএনটি-র এই বিপ্লবী জনতার কাছ থেকে। তাৎক্ষণিকভাবে সেনা অভ্যুত্থান রুখে দিয়ে তারা নিজেদের স্বপ্নের সমাজ গঠন ও পরিচালনার উদ্যোগ নেন। ১৯৩৬ সালের এই বিপ্লবের পর, বার্সেলোনা-সহ স্পেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শত শত ফ্যাক্টরি, গ্রাম, আবাদ-জমির নিয়ন্ত্রন নেয় শ্রমিক নিজেরাই।
বিপ্লবী পরিস্থিতি এসে যাওয়া মাত্রই অ্যানার্কিস্ট সংগঠনগুলো কলকারখানা ও ক্ষেত-খামারের দখল নিয়ে নিয়েছিলেন। এবং সেগুলো পরিচালনা করতে শুরু করেছিলেন স্ব-ব্যবস্থাপনার নীতিতে। ওপর তলার কারো আদেশের অপেক্ষায় না থেকে তাঁরা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের মাধ্যমে কারখানা পরিচালনা ও উৎপাদন শুরু করেন। বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েল সেসময়ের বার্সেলোনার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন: “আমার জীবনে দেখা প্রথম এই এক শহর, যেখানে শ্রমিকেরাই তার কর্তা। প্রত্যেক বিল্ডিং ছিল শ্রমিকদের দখলে এবং তার বাইরে ঝোলানো এনার্কিস্টদের লাল-কালো পতাকা।”3George Orwell – Homage to Catalonia (p.2)
অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র
স্প্যানিশ বিপ্লবের সেই সময়টিতে বার্সেলোনাসহ কাতালোনিয়ার অনেক জায়গায় চলেছে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের চর্চা। যেটি এখনকার প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের থেকে একেবারেই আলাদা। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র এমন এক ব্যবস্থা যেখানে ভোটাররা নির্দিষ্ট সময় পর পর কোন ক্ষমতাশালী ব্যক্তিকে ভোটের মাধ্যমে তাদেরকে শাসন করার অনুমতি দেন। পরবর্তী ভোটের আগ পর্যন্ত সে ব্যক্তি নিজ ইচ্ছা মত শাসনকার্য চালাতে পারে। এর মধ্যে তিনি দুর্নীতি, অবিচার, অন্যায় ইত্যাদির মধ্যে জড়িয়ে পড়লেও ভোটারদের তাকিয়ে দেখা ছাড়া করার কিছুই থাকে না। তাত্ত্বিকভাবে পরবর্তী ইলেকশন চক্রে সে ব্যক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করার সুযোগ থাকলেও আমরা সবাই জানি তা কতটুকু বাস্তবসম্মত। ক্ষমতাসীন ব্যক্তি আইন পাশের মাধ্যমে, কারচুপি করে বা ক্ষেত্রবিশেষে শুধুমাত্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই নিজের ক্ষমতার মেয়াদ অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাড়িয়ে ফেলতে পারে। এতেও নাগরিকদের তাকিয়ে থাকা ছাড়া করার কিছু থাকে না কেননা তার ক্ষমতা সুরক্ষিত করার জন্য আছে পুলিশ ও সেনাদল।
অন্যদিকে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র এমন এক ব্যবস্থা, যা ক্ষমতাকে জনগণ থেকে এরকম আলাদা করে ফেলতে পারে না। ক্ষমতার চর্চা ও পরিচলনা জনগণের মাধ্যমেই হয়। অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রে গ্রাম-নগর, ও কর্মস্থানের নিয়ন্ত্রন জনগণের হাতে থাকে। নগর, গ্রাম, ও কর্মস্থল কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য জনগনই নানা এসেম্বলি নির্মান করে, যার সদস্য সে গ্রামের বা শহরের বাসিন্দা বা কর্মস্থলের সদস্যরাই হয়। তারা সে এসেম্বলিতেই তর্ক-বিতর্ক-আলোচনার মাধ্যমে নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ও পলিসি বানান। সে সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচিত নানা কমিটি বা কাউন্সিল থাকে। এ কাউন্সিল বা কমিটির সদস্য হয় নির্বাচিত ডেলিগেট।
ডেলিগেট ও প্রথাগত প্রতিনিধির পার্থক্য হল, প্রথাগত প্রতিনিধি অন্যের নামে নিজের ইচ্ছা মত শাসন-পরিচালনা করেন আর একজন ডেলিগেটের কাজ তাকে দেয়া নির্দিষ্ট দায়িত্ব পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এই কাজের বিবরণ আসে জনগণের দেয়া ম্যান্ডেট থেকে। এভাবে জনগণের তাদের পারিপার্শ্বিকের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আসে। দেশের সত্যিকারের মালিক জনগণ হয়। জনসংখ্যাবহুল শহরগুলো সাধারণত অনেক মহল্লা ও পাড়া পড়শির ভিত্তিতে অ্যাসেম্বলি তৈরি হয়। অনেকগুলো অ্যাসেম্বলি ফেডেরেটেড হয়ে শহরের একটি সেকশন গঠন করে ও অনেকগুলো সেকশন ফেডেরেটেড হয়ে শহর ফেডেরেশন গঠন করে।
শহর ও গ্রামের ফেডেরেশন মিলে গঠিত হয় জাতীয় ফেডেরেশন। এভাবে একটি দেশের মানুষ ঘনিষ্টভাবে যোগাযোগ রাখতে পারে ও যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে কোনো কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়াই। জনবিচ্ছিন্ন কোনো সরকারের কাছে স্বাধীনতা আত্নসমর্পণ এবং তাদের জীবন ও পারিপার্শিকের উপর নিয়ন্ত্রন হারানো ছাড়াই। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র হল ক্রমে স্বাধীনতা হরণ প্রক্রিয়া। অন্যদিকে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র হল ক্রমে স্বাধীনতা নির্মাণ প্রক্রিয়া।
স্প্যানিশ শ্রমিকদের স্ব-ব্যবস্থাপনা
১৯৩৬ সালের জুলাইয়ে, বিপ্লবের পর বার্সেলোনার মতো বড় শিল্পায়িত শহর সংগঠিত হয়েছিল এই অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র ও নৈরাজ্যের নীতিতে। যেখানে বিশাল সংখ্যক শ্রমিক জনতা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র ও স্ব-ব্যবস্থাপনার নীতিতে নিজেদের সংগঠিত করতে শুরু করেন।
স্পেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শ্রমিকেরা এমন অ্যানার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন কয়েক দশক ধরে। তারা এসব চিন্তা বাস্তবে প্রয়োগ ঘটানোর নানা কৌশলও নানা সময়ে ভেবেছেন, প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন। ফলে, ১৯৩৬ সালের বিপ্লব সংগঠনের সাথে সাথেই শহর ও গ্রামের কলকারখানা, যন্ত্রপাতি, পরিবহন-যাতায়তের, এমনকি রিটেইল ও হোলসেল এন্টপ্রাইজগুলোও সেলফ-ম্যানেজমেন্ট বা স্ব-ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিজেদের শ্রমিক কাউন্সিল, কমিটি বা ইউনিয়নের আওতায় নিয়ে আসে। এ বিপ্লবী পরিবর্তন শুধু স্পেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলেই সীমিত ছিল না। স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া থেকে শুরু করে আল্কয় পর্যন্ত সি.এন.টি নিয়ন্ত্রিত ফ্যাক্টরি ছিল। আর এ সব কিছুই চলছিল একটি ঘোরতর গৃহযুদ্ধের মধ্যে।
শহরের প্রলেতারিয়দের পাশাপাশি কৃষক ও ভূমি-শ্রমিকেরাও (যাদেরকে গ্রামাঞ্চলের প্রলেতারিয় বলা যায়) তাদের ভূমি ও বাসস্থানের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। শিল্প বিপ্লবের আগে, স্পেনের কৃষি সম্পূর্ণভাবে ছিল বড় বড় জমিদারদের হাতে। সেসব জমি ছিনিয়ে নিয়ে সিএনটির কৃষকরা গড়ে তোলেন বিশ্বের অন্যতম সফল যৌথ কৃষি প্রকল্প। গ্রামীন শ্রমিকদের এমন সব বিপ্লবী উদ্যোগ কখনো কখনো শহরের শ্রমিকদের থেকেও সুদূরপ্রসারী হয়েছে। কোনো কোনো গ্রামে মুদ্রার বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছিল সম্পূর্ণভাবে।4 Gaston Leval – Collectives in the Spanish Revolution (1975) (p.44) স্পেনের এই কৃষক-শ্রমিকরা প্রকৃত অর্থে বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিলেন সেই কমিউনিস্ট স্লোগানের: “প্রত্যেকের সামর্থ্য ও প্রত্যেকের চাহিদা অনুযায়ী”। যেখানে সবার শারিরীক ও মানসিক চাহিদা অনুযায়ী কাজ নেয়া হত ও সবাই ঐকতানে প্রয়োজনীয় উৎপাদন করে সবার শারিরীক ও মানসিক চাহিদা অনুসারে পণ্য সরবরাহ করা হতো। কোন কোন কালেক্টিভ, পয়েন্ট ভিত্তিক উৎপাদন ও বিপনন ব্যবস্থা চালু করে5 Gaston Leval – Collectives in the Spanish Revolution (1975) (p.58) যা এত সমৃদ্ধ ও চিন্তনশীল ছিল যার দৃশ্য গ্রামবাসীদের পশ্চাৎপদ মনে করা বুদ্ধিজীবীদের মুখ বন্ধ করে দেয়। কৃষি কালেক্টিভগুলো এত সুষ্ঠুভাবে শ্রমিকেরা পরিচালনা করেন যে কৃষি পণ্য উৎপাদন ৫ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায় যুদ্ধবিদ্ধস্ত অবস্থার মাঝেও6Anthony Beevor – The Battle For Spain – The Spanish Civil war 1936 – 1939 (p.525)। পরে তা এমন এক পর্যায়ে চলে আসে যে এই কালেক্টিভগুলোই পুরো রিপাবলিকান স্পেনের খাদ্যের জোগান এবং যুদ্ধের জন্য রশদের ব্যবস্থা করে দিচ্ছিল।
এসব কিছুর কোনটিই একদিনে হয় নি। শত শত বছর ধরে বিরাজমান বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থার প্রপাগান্ডা ও শিক্ষায় দীক্ষিত কোন দেশের জনগণ একদিনে অ্যানার্কিস্ট বা কমিউনিস্ট হতে পারে না। সি.এন.টি-র কয়েক দশকব্যাপি নিরলস সংগ্রাম ও এক্টিভিজম জনগণের মনে নৈরাজ্যবাদ ও সমাজবাদের প্রতি গভীর সহানুভূতি নিয়ে আসে। বিপ্লবের টান টান উত্তেজনার আগে মানুষ এটি জিজ্ঞেস করত না যে নৈরাজ্য বা সমাজবাদ সম্ভব কিনা, বরং জিজ্ঞেস করত “কবে?” সি.এন.টি এবং সম্পৃক্ত সকল নৈরাজ্যবাদীরা বিশ্বাস করত কাজ ছাড়া কথা মূল্যহীন ও কথা ছাড়া কাজ বিভ্রান্তিকর। তারা কাগজ-কলমের পাশাপাশি কাজের মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণায় গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। ধর্মঘটের মাধ্যমে শ্রমজীবী জনতার নিজেদের উৎপাদনী ক্ষমতার উপর জোর বিশ্বাস আনা, শ্রমিক কাউন্সিল ও ফেডেরালবাদের মাধ্যমে কোন সরকার বা কর্তৃত্ব ছাড়া নিজের জীবন ও ভাগ্য নিজের হাতে নিয়ন্ত্রনে আনার অভিজ্ঞতা ও অভ্যাস তৈরির মাধ্যমে সি.এন.টি জনগণের কাছে নৈরাজ্যবাদের প্রতি আস্থা যোগায়।
শাসকশ্রেণীর শোষণমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে শ্রমিকদের সচেতন করে তোলার কাজটি অনেক আগে থেকেই করছিল সিএনটি। শ্রমিকদের মধ্যেও গড়ে উঠেছিল নিজেদের শক্তির ওপর বিশ্বাস ও আস্থা। এগুলোর মাধ্যমে ১৯৩৬ সালের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের ভিত্তি তারা তৈরি করে রেখেছিল অনেক আগেই। সি.এন.টি ও এফ.এ.আই নিজেরা ১০৩টি পত্রিকা প্রকাশ ও বিতরণ করত। সেই সাথে ছিল অসংখ্য সাময়িকী ও পরিস্থিতি ভিত্তিক ইশতেহার-ঘোষণা।7 Juan Gomez Casas – Anarchist Organisation, The History of The F.A.I (p. 15) সি.এন.টি অন্যসব নৈরাজ্যবাদীদের মতই শ্রমজীবী জনগণের নিজেদের বিপ্লবের উপর বিশ্বাস করত। তারা প্রথম আন্তর্জাতিকের “শ্রমজীবী জনতার মুক্তির সংগ্রাম শ্রমজীবী জনতার দ্বারাই করতে হবে” স্লোগানের বিশ্বাসী ছিলেন। যে বিপ্লব জনগণের হবে না সে বিপ্লবে আগের বুর্জোয়া শাসনের সব অন্যায়, অবিচার, শাসন ও শোষণ পুনরায় ফিরে আসবে – এ নীতিতে বিশ্বাস করত।
বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধ
স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময়ে ফ্যাসিস্ট ও ন্যাশনালিস্ট শত্রুর বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধও গড়ে তুলেছিল সি.এন.টি, এফ.এ.আই ও লিবারটেরিয়ান ইয়ুথের মিলিশিয়া বাহিনী। ফ্যাসিস্ট বাহিনী ও ফ্যাসিস্টদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী থাকলেও ফ্যাসিস্ট প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ ভাবে শহরের বুর্জোয়া, গ্রামের লুপ্তপ্রায় সামন্ত সর্দার ও স্পেনের তখনকার বিশাল ভূমি-মালিক চার্চের স্বার্থ রক্ষার প্রচেষ্টা ছিল। স্পেনের জনগণকে কয়েক হাজার বছর ধরে গুড়িয়ে-মুচড়িয়ে খাবার যাঁতাকল ভেঙে যাবার শেষ মুহূর্তেই শাসক-শোষক শ্রেণী তাকে বাঁচাবার জন্য এক শেষ প্রচেষ্টা স্বরূপ ফ্যাসিস্ট হায়নাদের স্পেনের জনগণের উপর লেলিয়ে দেয়। ‘স্পেনের বীর’ খেতাব প্রাপ্ত এনার্কিস্ট বুয়েনাভেন্তুরা দুররুতি এর মতেঃ “বুর্জোয়া শ্রেনী যখন দেখে তার হাত থেকে ক্ষমতা ছুটে যাচ্ছে তখন সে তার বিশেষাধিকার ধরে রাখার জন্য ফ্যাসিবাদকে টেনে আনে।”8 Felix Morrow – Revolution and Counter-Revolution in Spain (1963) শহরের ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, গ্রামের সামন্ত সর্দারগণ ও চার্চের নেতারা ছিল এই ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার ভিত। তারাই ছিল এই ফ্যাসিস্ট বাহিনীর তহবিলের প্রথম উৎস। তিন দশকের বুর্জোয়া অব্যবস্থাপনা, চার্চ কেন্দ্রিক দুর্নীতি, গ্রামীন জনতাকে লুট করার নীতির ঘোর প্রতিরোধ করে যায় সংগঠিত শ্রমজীবী জনতা। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল সি.এন.টি। এসব প্রতিবাদ-প্রতিরোধের রূপ দেখা পর্যায়ক্রমিক বিদ্রোহ ও গণঅভ্যুত্থানে। শাসক-শোষক শ্রেণী ক্রমেই বুঝে উঠছিল যে তাদের ক্ষমতার আয়ু আর বেশি দিন নেই। এই জন্য তারাও সেটি আঁকড়ে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছিল।
স্পেনের উদারবাদী রাজনীতীবিদরা মনে করেছিল জার্মানি-ইতালির মত ফ্যাসিস্ট উত্থান প্রতিহত করা সম্ভব সংশোধনবাদী রাজনীতির মাধ্যমে। তারা তখনও জার্মানি ও ইতালির উদারবাদী রাজনীতির পতনের কারণ বুঝে উঠতে পারেনি। কিন্তু সেটা এনার্কিস্টরা ঠিকই জানত এবং অনেক আগের থেকেই জানত। ফ্যাসিজমের উত্থান সম্পূর্ণভাবে উৎপাদন যন্ত্র ও এর সাথের সামাজিক সম্পর্কের সাথে জড়িত। আদতে বাইরে ফ্যাসিবাদ জাতি, বর্ণ, শ্রেনী বিভাজন রক্ষার নাম দিয়ে রাজনীতি করলেও তার মূল কার্যক্রম শাসক শ্রেণীর বিশেষাধিকার ও তাদের উৎপাদন যন্ত্রর মালিকানার অধিকার রক্ষা। এই বিশেষাধিকার ও মালিকানার অধিকারের প্রশ্নই স্পেনের শ্রমজীবী মানুষ তুলেছিল।
১৯৩৬ এর ফ্যাসিস্ট উত্থানের আগেই স্প্যানিশ অ্যানার্কিস্টরা বুঝে গিয়েছিল যে গৃহযুদ্ধ আসন্ন। “হয় ডানপন্থি পার্টিগুলো ইলেকশনে জিতবে ও শ্রমজীবী জনতা বিপ্লব ডাকবে, না হয় বাম-রিপাবলিকানরা জিতবে ও গৃহযুদ্ধ শুরু হবে।”9Juan Gomez Casas – Anarchist Organisation, The History of The F.A.I (p. 154) – এ ছিল এফ.এ.আই এর ভবিষ্যদ্বাণী। যুদ্ধ একটা হবেই, হয় সেটা গৃহযুদ্ধ না হয় বিপ্লবী যুদ্ধ। তাদের দাবী ছিল: ফ্যাসিবাদকে রুখতে হলে উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা পালটানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। হয় দেশের কল-করখানা, খনি, বাঁধ, আবাদী জমি স্পেনের জনতা নিয়ন্ত্রনে নিবে তাদের নিজেদের কাউন্সিল ও ইউনিউনের মাধ্যমে সরকারের কোন রকম হস্তক্ষেপ ছাড়া ও এর দ্বারা ফ্যাসিজম এর পতন ঘনিয়ে আসবে; নয়তো বুর্জোয়া শ্রেণীর নিয়ন্ত্রন বহাল থাকবে এবং সেটি ফ্যাসিস্ট আগাছাকে পানি দিয়ে বড় করবে। কার্যত স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় এটিই ঘটেছিল।
যেসব অঞ্চলে শ্রমজীবী জনতা শহর নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিল সেখানে ফ্যাসিবাদ ফ্র্যাঙ্কোর আক্রমণের শুরুতে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগই পায় নি। তবে বাস্তবতা হল বাম-রিপাবলিকান সরকারই শ্রমিকদের আত্নরক্ষা ও শহর নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় বাধা দিয়েছিল। ফ্র্যাঙ্কোর আক্রমণের খবর যখন ছড়াতে শুরু করে তখন বিভিন্ন শহরের শ্রমিকেরা সরকারের কাছে আত্নরক্ষার জন্য অস্ত্রের জন্য অনুরোধ করে। বিপ্লবের ভয়ে সরকার তাদের অস্ত্র দেয়নি ও সাথে ফ্যাসিস্ট অভ্যুত্থানের সবচেয়ে সংবেদনশীল মুহূর্তে দুর্বলতার পরিচয় দেয়। এছাড়াও অনেক অঞ্চলের গভর্নররা নিজেরাই ফ্যাসিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ায় সাথে সাথেই তাদের অঞ্চল ফ্যাসিস্টদের হাতে তুলে দেয়। এভাবে স্পেনের দক্ষিণ ও পশ্চিমের অনেক শহর ফ্যাসিস্ট হানাদারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। কিন্তু সি.এন.টি ও এফ.এ.আই যুদ্ধের আসন্নতা জেনে গোপনভাবে স্পেনের উত্তরে ও পূর্বের অঞ্চলগুলোতে অস্ত্র ভান্ডার লুকিয়ে রাখে। ফ্যাসিস্ট আক্রমণের খবর পাওয়ার পর পরই শ্রমিকদের নিকট তারা অস্ত্র বণ্টন করে স্পেনের সামরিক ও অর্থনৈতিক অর্থে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলো রক্ষা করে সেসব অঞ্চলে ফ্যাসিস্ট অভ্যুত্থান প্রতিহত করে।
স্পেনের সর্ববৃহৎ ইন্ডাস্ট্রিয়াল শহর বার্সেলোনা অ্যানার্কিস্ট শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে আসে। এতে ফ্যাসিস্টদের দ্রুত অভ্যুত্থানের স্বপ্ন সম্পূর্ণরূপে বানচাল হয়ে যায় ও একইসাথে স্প্যানিশ বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধের প্রারম্ভ হয়। স্পেনের লিবারেল-বাম-রিপাবলিকান সরকারের ইতিহাস আমাদের দেখিয়ে দেয় যে ফ্যাসিস্ট বিপদ মোকাবেলা কখনোই ক্ষমতায় থাকা লোকদের পাল্টানোর দ্বারা সমাধান হবে না। আদতে ফ্যাসিবাদের প্রশ্ন মৌলিকভাবে উৎপাদনের যন্ত্রের মালিকানা ও এর সাথের সামাজিক সম্পর্কের প্রশ্ন।
স্পেনের গৃহযুদ্ধে ডান ক্যাম্পে ছিল সেনাবাহিনী, কার্লিস্ট10 কাউন্ট ডন কার্লোসের বংশ স্পেনের রাজ ক্ষমতার অধিকারী – এ মতবাদে বিশ্বাস করা দল। , ফ্যালাঞ্জিস্ট11 JONS ফ্যাসিস্ট পার্টির সদস্য। , রাজতন্ত্রী12 আলফোন্সিন বংশ স্পেনের রাজ ক্ষমতার অধিকারী – এ মতবাদে বিশ্বাস করা দল। , সামন্ত সর্দার, বুর্জোয়াজি, ক্যাথলিক চার্চের পাদ্রী ও নেতাগণ। তাদের সম্মিলিতভাবে ন্যাশনালিস্ট বলা হলেও ফ্র্যাঙ্কো হিটলার ও মুসোলিনির সামনে নিজেকে ফ্যাসিস্ট বলত ,আবার ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সামনে নিজেকে বলত কন্সার্ভেটিভ। ফ্যাসিস্টবিরোধী ক্যাম্পে ছিল রিপাবলিকান, অ্যানার্কিস্ট, অ্যানার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট, বলশেভিক পি.সি.ই, মার্ক্সিস্ট পি.ও.ইউ.এম সমাজতান্ত্রিক পি.এস.ও.ই, বাস্কের জাতীয়তাবাদী ইত্যাদি। অনেকে এ যুদ্ধকে “বাম বনাম ডান” যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করলেও ইতিহাসবিদগণ ব্যাপারটিকে আরো গভীরভাবে পর্যালোচনা করেন। ইতিহাসবিদ অ্যান্টনি বিভরের মতেঃ “স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধকে আজপর্যন্ত বাম-ডানের কোন্দল হিসেবে অভিহিত করার মধ্য দিয়ে খুবই ভুলভাবে সরলীকরণ করা হয়েছে। আরো দুইটি খুব গুরুত্বপূর্ণ অক্ষের সংঘর্ষের উৎপত্তি ঘটেঃ রাষ্ট্রীয় কেন্দ্রীকরণ বনাম আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন এবং কর্তৃত্ববাদ বনাম ব্যক্তির স্বাধীনতা।”13 Anthony Beevor – The Battle For Spain – The Spanish Civil war 1936 – 1939 (p.48)
বলশেভিক কমিউনিস্টদের বিশ্বাসঘাতকতা
বিভর জাতীয়বাদী পক্ষের শ্রেণী স্বার্থে একত্রিত হওয়া ও সেই ক্যাম্পের সব দলেরই কেন্দ্রীয়-রাষ্ট্রবাদী, কর্তৃত্ত্ববাদী ও ডানপন্থী হওয়া লক্ষ করেন ও বলেন যে “জাতীয়বাদী পক্ষ এ জন্য তার প্রতিপক্ষের থেকে বেশি সুসঙ্গত ছিল।” রিপাবলিকান পক্ষের দিকে লক্ষ করে তিনি বলেন যে তারা ছিল “অসঙ্গতির মহামিশ্রণ” ও তারা “একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখত।” ফ্যাসিস্টরা যেখানে সবাই কর্তৃত্ববাদী ও কেন্দ্রবাদী ছিল সেখানে বামের মধ্যে “কমিউনিস্টরাও” (পি.সি.ও.ই; এনার্কিস্টরাও কিন্তু লিবার্টেরিয়ান কমিউনিস্ট ছিল তাই পি.সি.ও.ইকে এজন্য তারা কমিউনিস্ট না ডেকে বলশেভিক ডাকত।) ছিল ফ্যাসিস্টদের মত “কর্তৃত্ববাদী ও কেন্দ্রবাদী, যাদের বিরোধিতা করত আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের অধিকারবাদী ও লিবার্টেরিয়ানরা (মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্রী) ।”14Anthony Beevor – The Battle For Spain – The Spanish Civil war 1936 – 1939 (p.49)
এই অসঙ্গতি দেখা যায় গৃহযুদ্ধের একদম প্রথম থেকে। স্পেনে বলশেভিকরা কোন মজবুত ভিত্তি কখনো গড়ে তুলতে পারেনি। স্পেনের বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক মুভমেন্টের নেতৃত্ব প্রায় সম্পূর্ণরূপে অ্যানার্কিস্টরাই দিয়েছিল। তবে যুদ্ধের সময় রিপাব্লিকানদের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হয়ে দাঁড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন, যেহেতু রিপাবলিকানদের কাছে অস্ত্র ও রসদের সবচেয়ে বড় বিক্রিকর্তা ছিল তারা। তবে স্তালিন আন্তর্যাতিক সংহতি স্বরূপ এরূপ কিছু করেনি। ফ্যাসিস্টদের সরবরাহ দিচ্ছিল নাৎসি জার্মানি ও ফ্যাসিস্ট ইতালি। স্পেনে জার্মানি যাতে ঘাটি না গড়ে পারে ও স্ট্রেট অব জিব্রালটার যাতে হিটলারের নিয়ন্ত্রণে না এসে ইউরোপীয় জল-যাতায়তের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে এটাই ছিল স্তালিনের সবচেয়ে বড় চিন্তা। সমাজতন্ত্রী ভাতৃত্ববোধের জন্য না করেও নিজের স্বার্থের জন্যও যদি স্তালিন স্পেনে ফ্যাসিস্ট বাহিনী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের জন্য কাজ করে যেত তাহলে তাকে সাধুবাদ জানান হত। কিন্তু স্তালিন একইসাথে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সাথে মিত্রচুক্তির জন্য কুটনীতি করছিল। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স নন-ইন্টারভেনশন নামের নীতি রেখে ফ্যাসিস্ট বাহিনীকে পরোক্ষভাবে সহোযোগিতা করছিল কারণ সেসময় হিটলার ও মুসোলিনি ফ্র্যাংকোর পক্ষে প্রত্যক্ষ অবস্থান নিয়েছে। ফ্রান্সের শাসক শ্রেণীর ভয় ছিল স্পেনে সমাজবাদীদের বিজয় হলে তার দেশেও বিপ্লবের আগুন জ্বলবে। স্তালিন তাই তাদের কথায় সায় দিয়ে অস্ত্র বিক্রি খুবই সীমীত আকারে রেখেছিল। তবে এ পলিসির ভয়াবহ ফলাফল দেখা যায় স্পেনের অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট ক্যাম্পে। স্পেনের বিপ্লবের প্রথম মূহুর্তেই সি.এন.টি এর কয়লা খনি শ্রমিকেরা ইংরেজ পূঁজিবাদীদের মালিকানাধীন কয়লা খনি নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয়। এ নিয়ে ইংরেজ পূঁজিবাদীগণ খুবই বিচলিত ছিল ও সাথে বিচলিত ছিল তাদের প্রতিনিধি ব্রিটিশ সরকার। স্পেনের বিপ্লবী শ্রমিকেরা ভূমি ও কল-কারখানা নিয়ন্ত্রনে নেয়ার ফলে বহির্বিশ্বে শাসক শ্রেণী যে উদ্বেগে পড়েছিল তা স্তালিন শান্ত্ব করাতে চেয়েছিল। স্পেনে বিপ্লব নেই ও স্পেনের শ্রমিকদের দ্বারা দখলকৃত সব সম্পত্তি বিদেশি মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে এরূপ আশা পি.সি.ই বিদেশি বুর্জোয়াদের দিচ্ছিল। এর জন্য শুরুর থেকে স্তালিনবাদীরা লিবারেল-বুর্জোয়া রিপাবলিকানদের বাদে অন্য সব দলের সাথে কোন্দল শুরু করেছিল।
বিভর বলেনঃ “আশ্চর্যজনকভাবে ব্যক্তিগত মালিকানার সবচেয়ে স্পষ্টভাষী রক্ষাকর্তা লিবারেল রিপাবলিকানরা ছিল না – ছিল কমিউনিস্ট পার্টি ও তার কাতালান সহায়ক পি.এস.ইউ.সি। দুই দলই কমিন্টার্নের লাইন বরাবর বিপ্লবকে ঢাকার চেষ্টা করছিল।”15 Anthony Beevor – The Battle For Spain – The Spanish Civil war 1936 – 1939 বিপ্লব হবে কিন্তু যুদ্ধের পর! তারা এরূপ স্লোগান দিয়ে বেড়াচ্ছিল যা বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলগুলোর জন্য খুবই অসম্মানজনক ছিল। দুররুতি এ সম্পর্কে বলেনঃ “আমরা একই সাথে যুদ্ধ ও বিপ্লব করছি। মিলিশিয়ারা ভূমি, ফ্যাক্টরি, রুটি ও সংস্কৃতির জন্য লড়ছে। কোদাল ও রাইফেল দুইটাই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।”16 Abel Paz – Durruti In the Spanish Revolution (1996) তিনি অন্য এক জায়গায় বলেনঃ “হিটলার ও মুসোলিনি রাশিয়ার লাল সেনার থেকে আমাদের বিপ্লব নিয়ে বেশি চিন্তিত। আমরা জার্মানি ও ইতালির শ্রমিকগণকে আমাদের ফ্যাসিবিরোধী প্রতিরোধ দিয়ে উজ্জীবিত করছি।”17 The Toronto Daily Star এর Pierre van Passen এর কাছে দেয়া ইন্টারভিউ থেকে। (5 August 1936)
সুতরাং স্তালিনবাদীদের সাথে অন্য সব বাম দলের সংঘর্ষের সূত্রপাত এখান থেকেই। অ্যানার্কিস্ট ও পি.ও.ইউ.এম ছিল বিপ্লবের জন্য ও বলশেভিকরা ছিল স্তালিনের জন্য। স্তালিনের স্বার্থ যখন স্পেনের জনতার স্বার্থের বিপরীতে যাচ্ছিল তখনও তারা স্তালিনের স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিল। যুদ্ধ শেষ দিকে তারা অসংখ্য এনার্কিস্ট, মার্কিস্ট ও সোশালিস্ট এক্টিভিস্টদের হত্যা করে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা শহীদ ছিলেন আন্দ্রে নিন – পি.ও.ইউ.এমের নেতা। তাঁকে স্তালিনীয় পুলিশ তাদের বানানো গোপন টর্চার চেম্বারে টর্চার করে মেরে ফেলে। তিনি এককালে ট্রটস্কির সেক্রেটারি ছিলেন বলে ও নানা মিথ্যা অজুহাতে তাঁকে ও পুরো পি.ও.ইউ.এমকে ট্রটস্কিবাদী অ্যাখা দেয়া হয়। কিন্তু আসলে পি.ও.ইউ.এমকে ট্রটস্কি নিজে সমালোচনা করে।18 Pierre Broué – Trotsky and The Spanish Revolution (1967) এছাড়াও তাদের ট্রটস্কিবাদী হবার কোন প্রমাণ আজ পর্যন্ত মিলেনি। “১৯৩৩ এর আগেই ট্রটস্কির সাথে আন্দ্রে নিনের রাজনৈতিক সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়”19 Keith Hassel – Trotsky and The POUM। লেখাটি ব্রিটিশ মার্ক্সিস্ট জার্নাল Revolutionary History এর Summer 1988 এডিশনে প্রকাশিত হয়। – লিখেন কিথ হ্যাসেল। বিভর এ সম্পর্কে বলেনঃ “স্তালিনিস্টরা দাবী করত যে পার্টিটি ‘ট্রটস্কিবাদী’ ছিল। কিন্তু আসলে তা সত্য নয়। সোভিয়েত ইউনিওনের লেফট-অপোজিশনের সাথে তাদের বেশি মিল ছিল।”20 Anthony Beevor – The Battle For Spain – The Spanish Civil war 1936 – 1939 (p.70) তবে স্তালিনিস্টদের কাছ থেকে সবচেয়ে ভয়ংকর ও যুদ্ধকালীন-একতা বিধ্বংসী অভিযোগ আসে যখন ওরা পি.ও.ইউ.এম-কে ফ্যাসিস্টদের সাহায্যকারী ডাকা শুরু করে। জোর্জেস সোরিয়া ছিলেন একজন ব্রিটিশ স্তালিনিস্ট প্রতিনিধি যিনি পি.ও.ইউ.এম-কে ট্রটস্কিবাদী ও ফ্যাসিস্টদের সাহায্যকারী হিসেবে দেখানোর জন্য “ফ্র্যাঙ্কোর সেবায় ট্রটস্কিবাদীরা” নামে একটি মনগড়া রিপোর্ট বানান। ১৯৩৮ সালে বার্সেলোনাতে পি.ও.ইউ.এম-কে ট্রাইবুলনালে তদন্ত করার পর যখন প্রমাণ মেলে যে তাদের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ বানোয়াট, সোরিয়া নিজের ভুল স্বীকার করে বলেনঃ “পি.ও.ইউ.এম নেতৃবৃন্দের গেসটাপো ও ফ্র্যাঙ্কোর প্রতিনিধি হবার যে অভিযোগ ছিল তা মনগড়া বললেও কম বলা হবে। এ অভিযোগের পক্ষে বিন্দুমাত্র প্রমাণ বের করা সম্ভব হয়নি।”21 Lawrence and Wishart সংকলনকৃত Georges Soria এর Trotskyism in The Service of Franco. (p.1)
পি.ও.ইউ.এম স্পেনের সবচেয়ে বড় মার্ক্সবাদী দলগুলোর মধ্যে একটি ছিল। তারা শেষ অবধি শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবকে রক্ষার জন্য লড়ে যান। কিন্তু স্তালিনিস্টদের এত খুন, হত্যা, গুম, টর্চার ও বিপ্লব-বিরোধীতা কোন কাজেই আসল না কেননা শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রিত ইন্ডাস্ট্রি সরকার জোরপূর্বক ছিনিয়ে যাওয়ার পর শ্রমিকেরা সম্পূর্ণ মনোবলহীন হয়ে যায় ও যুদ্ধের ন্যাযতাকেই প্রশ্ন করা শুরু করে। তবুও অ্যানার্কিস্টরা ফ্যাসিস্ট গণহত্যা আশু জেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার আহবান জানায় ও স্তালিনীয় কমান্ডের আওতায়ই যুদ্ধ চালিয়ে যায়। কিন্তু মনোবলহীনতা, রিপাব্লিকান সরকারের বাজে রণ-স্ট্র্যাটেজি,সামরিক নেতৃবৃন্দ অজ্ঞতা ও অক্ষমতা, সরকারের দ্বারা অর্থনীতির অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ফ্যাসিস্টদের বিজয় ত্বরান্বিত করে। যেই শ্রমিক নিয়ন্ত্রিত ক্যাটালোনিয়া দেখে জর্জ অরওয়েল আবেগে আপ্লুত হয়েছিল, সে ক্যাটালোনিয়া স্তালিনবাদীদের বুটের নিচে চলে গিয়েছিল। সে ক্যাটালোনিয়ায় ফ্র্যাঙ্কো বাহিনী ঢুকে ১৯৩৯ সালের জানুয়ারিতে। সরকারের স্পেনের জনগণের প্রতি শেষ অপমান স্বরূপ ফ্র্যাঙ্কোর কাছে গোপনে আত্নসম্পর্ণের জন্য যায়। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কোও তাদের অপমান করে তা নাকোচ করে। মাদ্রিদের শেষ রক্ষায় নামে স্পেনের শ্রমিকরা। “নো পাসারান!” – তারা প্রবেশ করতে পারবে না! “ভিভা মাদ্রিদ সিন গোবিরেনো!” – সরকারহীন মাদ্রিদ জিন্দাবাদ! স্লোগান মুখে নিয়ে মাদ্রিদের জনতা মাদ্রিদের শেষ রক্ষার জন্য শেষ ব্যারিকেড গড়ে। কিন্তু তাদের না ছিল অস্ত্র-গোলাবারুদ, না ছিল রসদ। সরকার অ্যানার্কিস্টদের খাদ্য কমিটি ভেঙ্গে দেয়ার পর ও খাদ্য বিপনন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রনে নেয়ার পর দুর্নীতির জন্য প্রথমবারের মত মাদ্রিদ ভুখা যায়।22 Anthony Beevor – The Battle For Spain – The Spanish Civil war 1936 – 1939 অবশেষে ২৮ মার্চ ১৯৩৯ ফ্যাসিস্ট বাহিনী মাদ্রিদে প্রবেশ করলে স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ ও স্প্যানিশ বিপ্লবের ইতি ঘটে।
স্প্যানিশ বিপ্লব একইসাথে যেমন আজকের প্রজন্মের বিপ্লবী ও অ্যাক্টিভিস্টদের জন্য এক দৃষ্টান্ত- ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা, সামাজিক মালিকানা ও শ্রমিক শ্রেণীর আত্ন-নিয়ন্ত্রন স্থাপনার এক উজ্জ্বল ও দুর্দান্ত উদাহরণ, তেমনি তা এক সতর্কবার্তা – আমরা মিত্র হিসেবে কাদের নিব? বিপ্লব আগে, না গৃহযুদ্ধ আগে? স্প্যানিশ বিপ্লবের ইতিহাস এসব প্রশ্নের উত্তর চিন্তা করতে আমাদের গভীরভাবে প্রণোদনা দেয়। স্প্যানিশ বিপ্লব প্রমান করে যে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধ যুদ্ধ ও উৎপাদনের মালিকানার প্রশ্ন একই সূত্রে গাঁথা, প্রমাণ করে যে রাষ্ট্র সবসময় জনগণের বিপ্লবের বিরূদ্ধে থাকবে ও সরকারের ক্ষমতা বদলানোর মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ মোকাবেলা সম্ভব না। আশা করছি আজকের মুক্তিকামী যোদ্ধাগণ স্প্যানিশ বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধ থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের ব্যক্তিগত জীবন ও অ্যাক্টিভিস্ট জীবনে তার প্রতিফলন ঘটাবে।