[আহমেদ কামালের এ প্রবন্ধটি তার কালের কল্লোল : ইতিহাস, উন্নয়ন ও রাজনীতি গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে লেখাটি অরাজের পাঠকদের জন্য অনলাইন মাধ্যমে উন্মুক্ত করে দেয়া হলো। – সম্পাদক]
দুটো বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করে এ বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে দ্যা প্র্যাকটিস অব হিস্ট্রি গ্রন্থে ঐতিহাসিক জি. আর. এলটনের একটি উক্তি, যার বাংলা করলে অনেকটা এরকম অর্থ দাঁড়ায়—‘মানুষ এ যাবৎকাল যা করেছে, বলেছে, ভেবেছে এবং সর্বোপরি যত দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছে তার সবটাই ইতিহাস চর্চার অন্তর্গত।’ তারপরও কথা থাকে। পুরা অতীতটা কিন্তু কোনভাবে পুনরুদ্ধার হয় না। কারণ যেটুকু সাক্ষ্যপ্রমাণ টিকে আছে অথবা যুক্তি খাটিয়ে যতটুকু সাক্ষ্যপ্রমাণ জড়ো করা যায়, তার ভিত্তিতে ঐটুকু অতীতই কেবল উদ্ধার করা সম্ভব। আসলে ইতিহাস–চর্চা হচ্ছে বর্তমানের গায়ে অতীতের যে ছাপ তাকে বোধগম্য করা। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে প্রেজেন্ট এভিডেন্স। অর্থাৎ আজ এই মুহূর্তে যেই এভিডেন্সগুলি হাতের কাছে আছে তাই দিয়ে অতীতের পুনর্গঠন চলছে। মনে রাখতে হবে এভিডেন্স শনাক্তকরণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পাশে রাজনীতিও নিরন্তর কাজ করে চলছে। দ্বিতীয়ত, মানুষের সামাজিক সম্পর্ক নির্ধারিত হয় ক্ষমতার সম্পর্ক দ্বারা। হেরোডোটাস থেকে শুরু করে দ্যা এন্ড অব হিস্ট্রি এন্ড দ্যা লাস্ট ম্যান–এর লেখক ফুকুয়ামার সময় পর্যন্ত, অর্থাৎ এখন পর্যন্ত, মানব সমাজ প্রভুত্ব এবং অধীনতার সম্পর্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । যদিও এর চেহারা এবং বৈশিষ্ট্য নানারকম হতে পারে। ফোকাসটা আরো কাছে নিয়ে আসলে দেখা যাবে যে, ফরাসী বিপ্লবের পর থেকেই ইতিহাস জাতিরাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী তৈরী হচ্ছে। ইতিহাস চর্চা অনেকখানি আটকে পড়েছে জাতিরাষ্ট্রের স্রষ্টা শ্রেণীটির জীবনী রচনার মধ্যে। এই শ্রেণীটি উপনিবেশগুলার ভাগ্য নিয়ন্তাও বটে। এই ইতিহাসের রাজনীতি তো খুবই স্পষ্ট। জন–ইতিহাসকে এই দুই বেড়া ভেঙে বের হবার আশ্বাস দিতে হয়। কাজটি মূলত রাজনৈতিক।
এবার জন–ইতিহাসের ইতিহাসটা একটু খোঁজ করা যাক। ঐতিহাসিক কারণেই এই ইতিহাস চর্চার আদিভূমি ইউরোপ।
পিটার বার্ক জন–ইতিহাস চর্চার সূচনাকে আখ্যায়িত করেছেন ‘ডিসকভারি অব দ্যা পিপল’ নামে। সুইডেনের ঐতিহাসিক এরিক গিজারের (১৭৮৩–১৮৪৭) হিস্ট্রি অব দ্যা সুইডিশ পিপল, চেক ঐতিহাসিক ফ্র্যানটিসেক পালাকির (১৭৮৩–১৮৭৬) হিস্ট্রি অব চেক পিপল , ম্যাকলির ১৮৪৮ সালের হিস্ট্রি অব ইংল্যান্ড এসবই ইতিহাসে জনগণ আবিষ্কারের পথিকৃৎ। জনগণ আবিষ্কারের এই কাজটিতে পর্যটকরা অনেকখানি সাহায্য করেছে। ১৭৭০ সালে ইতালির পাদ্রী আলবার্তো ফরতিস ডালমাশিয়া ভ্রমণে যেয়ে মোরলাচিদের জীবনপদ্ধতি,সংস্কৃতি, ধর্ম আচার ইত্যাদি দর্শন করেন।
প্রথম পর্যায়ে জন–ইতিহাসের একটি প্রধান* উপাদান কিন্তু লোকসঙ্গীত। জার্মান কবি ও ফোকলরিস্ট আসিম ভন অরনিমের (১৭৮১–১৮৩১) মতে, লোকসঙ্গীত ইউরোপের অনেক দেশের বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিল। জাতির কল্পনাটা যদিও বুদ্ধিজীবীদের কাছে থেকেই এসেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইতিহাস চর্চা এক নতুন বাঁক নেয়। ইতিহাস এবার ‘পলিটিক্স এন্ড প্রোডাকশন অব আইডেন্টিটি’তে জড়িয়ে পড়ে। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে উঠতি দেশীয় ক্ষমতাধরদের নির্ভরযোগ্য মিত্র হয় ইতিহাস। জাতিয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে সৃষ্টি হয় জাতিরাষ্ট্রের। ৬০ এর দশকে এসে পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশেই জাতীয় ইতিহাস যেসব গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে লেখা হচ্ছিল সেইসব অবহেলিত গোষ্ঠীগুলাকে অন্তর্ভুক্ত করা শুরু হয়। ১৯৬০– এর দশকের দশকের এই তালিকায় প্রাক্তন ক্রীতদাস, শ্রমিক শ্রেণী, দাগী আসামী , নারী, শিশু, বৃদ্ধ এরা স্থান পেতে থাকে। ‘৭০ এর দশকে এই ইতিহাসকেই বলা হতো হিস্ট্রি ফ্রম বিলো।
‘৭০ ও ‘৮০ এর দশকে সদ্য উল্লিখিত তালিকাটি আরো একটু বড় হয়। এবার ছোটখাটো জাতিসত্ত্বা, নারী ও পুরুষ সমকামী এরাও স্থান পেতে শুরু করে। এদের ইতিহাস ‘মাইনরিটি হিস্ট্রি’ নামে পরিচিত হয়। অর্থাৎ গণতন্ত্রমনা ঐতিহাসিকেরা জাতির ইতিহাসের মূলধারা থেকে বাদ যাওয়া এইসব জনগোষ্ঠীকে ইতিহাসের ধারায় ফিরিয়ে আনতে শুরু করেন। যে মাইনরিটির কথা উল্লেখ করা হলো, তালিকাটি লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে তারা শুধু সংখ্যায় না, গুরুত্বেও মাইনরিটি। গত দশকের শুরু থেকে মাইনরিটি হিস্ট্রির কাছ থেকে সরকারি অথবা সরকার সমর্থনপুষ্ট জাতীয় ইতিহাস দেশে দেশে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। দীনেশ চক্রবর্তীর মতে, উত্তর আধুনিকদের ‘মহা আখ্যান’ বা ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’ এর সমালোচনা ব্যবহার করে জাতির একটি মাত্র সত্যায়িত ইতিহাসের ধারণাকে পরিত্যাগ করছে। প্রমাণ করা হচ্ছে জাতি আসলেই অনেকগুলি প্রতিযোগী আখ্যানের সৃষ্টি। মাইনরিটি হিস্ট্রির লড়াই আসলে এই এই জাতির কাহিনীতে জায়গা করে নেবার লক্ষ্যে পরিচালিত । আমরা যে জন–ইতিহাসে কথা বলছি তা আসলে ঐ মাইনরিটি হিস্ট্রি। প্রথমে তা প্রতিবাদী ইতিহাস হিসেবে মাথা তোলে, তারপর তা ধীরে ধীরে মহা–আখ্যানের মিছিলে শরিক হয়। প্রতিবাদী চরিত্রটা তখন বাড়তি একটা খোলসে রূপান্তরিত হয়।
ইতিহাস যেহেতু একটি সাক্ষ্য–প্রমাণভিত্তিক যুক্তিনির্ভর আখ্যান তৈরীর কৌশল, সেহেতু জন–ইতিহাসের চর্চা একটু আয়াসসাধ্যও বটে। আমি প্রথমে স্মরণ করেছি সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া ইতিহাস তৈরী হয় না। সমাজে আমরা যাদের জনগণ, ছোটলোক বা নিম্নবর্গ বলি তারা কিন্তু কর্মকান্ডের দলিলের রেখে যায় না, তাদের কীর্তির বেশিরভাগ ধরা থাকে স্মৃতিতে। এই স্মৃতিকে ইতিহাস করার প্রক্রিয়াকে সম্প্রতি ‘মুখের কথার ইতিহাস’ আখ্যা দেয়া হয়েছে। এখানেই জন–ইতিহাসের উপাদান নিয়ে দু’ একটা কথা সেরে নেয়া ভালো। জন–ইতিহাসের উপাদান কী? লিখিত সূত্রের অভাবে মৌখিক সূত্র নিঃসন্দেহে একটি মূল্যবান উপাদান। তাছাড়া গুজব, গান, কৌতুক, লৌকিক উৎসব, অল্পশিক্ষিত গ্রাম্য কবিদের রচিত পথুয়া সাহিত্য যাতে ৮ থেকে ১৬ পাতার কবিতা, তবে এর কোনটাই নির্ভেজাল লৌকিক সূত্র নয়। একে দক্ষতার সাথে ও সঠিক তাত্ত্বিক শক্তিতে বলীয়ান হতে হয় ধীরে ধীরে–ইংরেজিতে যাকে বলা হয় আনপ্যাক করা, সেই কাজটিই করতে হয়। জনস্মৃতির সমস্যা নিয়ে বর্তমানকালের ফরাসি দার্শনিক ফুকো কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। তার মতে জনস্মৃতি মিশেলহীন নয়। জনস্মৃতি ‘unified, fully achieved and therefore capable of sustaining a memory wholly apart from the dominant construction of the past’ এ কথাটি ফুকো স্বীকার করেননি। আসলে প্রায়শই জনস্মৃতিতে প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে আবদ্ধ মানুষের মানসিকতার প্রতিফলন দেখা যায়। এই বিষয়ে সচেতন না হলে জন–ইতিহাসের সত্যিকার অবস্থানটা শনাক্ত করা সম্ভব হবে না। জন–ইতিহাসের পক্ষের রাজনীতি ও গভীর সৃজনশীলতা দ্বারাই জন–ইতিহাস তৈরি সম্ভব।
আমি এরকম তিনটি রচনার উদাহরণ দিতে চাই।
বার্কলের অধ্যাপক দিলীপ বসু ও তার সহযোগীর লেখা মল্লবীর। এ বইয়ের পাণ্ডুলিপি পড়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। মল্লবীর কলকাতার অপরাধ জগতের এক উড়িয়া গুন্ডা। দেশ বিভাগের সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষে সে অংশগ্রহণ করেছিল। দাঙ্গার রাজনীতিতে উচ্চবর্ণের সঙ্গে এই সাধারণ গুন্ডার সম্পর্ক, তার চৈতন্যে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অবয়ব এই সকল জটিল দিকগুলি তার জবানীতেই বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। মল্লবীরের স্মৃতিকে ইতিহাস করার এই পদ্ধতি আয়ত্তের মধ্যেই জন–ইতিহাস তৈরীর ক্ষেত্রটি বড় হতে পারে।
দ্বিতীয় নিবন্ধটি ইউরোপের ইতিহাস থেকে পাওয়া। নিবন্ধটির শিরোনাম ‘ওয়ার্কার্স রিভোল্ট: দ্যা গ্রেট ক্যাট ম্যাসাকার অব দ্যা রু সেইন্ট–সেভেরিন’ ১৭৩০– এর দশকের শেষ দিকে প্যারিসের একটি ছাপখানার শ্রমিকেরা মালিকের অনেকগুলি বেড়াল নির্মমভাবে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের বিশ বছর পর এই ঘটনার একটি বিবরণ হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণকারী একজন শ্রমিকের জবানীতে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত সেই বিবরণকে ভিত্তি করে রবার্ট ডার্নটন বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সের প্যারি নগরীর এক অসাধারণ সামাজিক আখ্যান তৈরী করেন। প্যারির অন্ধকার ছোট ছাপাখানার জগতটাকে তিনি উদ্ভাসিত করেন তাঁর সৃষ্টিশীল ইতিহাস চর্চার আলোকচ্ছটায়। আমাদের সামনে তুলে ধরেন তৎকালীন প্যারির শ্রমিক–মালিক সম্পর্ক, ছাপখানার শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবন, তাদের সংস্কার ও চেতনার জগৎ—সর্বোপরি শ্রমিক–মালিক দ্বন্দ্বের এক অসাধারণ কাহিনী। এই ইতিহাসের নায়ক বিপ্লবপূর্ব প্যারি নগরীর ছাপখানার শ্রমিকেরা। এখানেও ইতিহাস তৈরির প্রাথমিক উপাদান ঐ একটি ছোট্ট বিবরণ।
তৃতীয় নিবন্ধটির রচয়িতা ভারতবর্ষের আধুনিক ইতিহাস চর্চায় নিম্নবর্গের অবস্থানকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার স্থপতি রণজিৎ গুহ। নিবন্ধটির নাম ‘চন্দ্রা’স ডেথ’। রণজিৎ গুহ চন্দ্রার মৃত্যু সম্পর্কিত মামলার একটি ছেঁড়া অসম্পূর্ণ বিবরণকে অপূর্ব দক্ষতায় এক অসাধারণ ইতিহাস তৈরী করেন। ১৯ শতকের ভারতবর্ষের ভারতবর্ষের অন্তজ সমাজের লাঞ্চিত নারীদের এক অসাধারণ উপাখ্যান এই নিবন্ধটি। নারীবাদী ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রেও এই নিবন্ধটি একটি অমূল্য দলিল। অথচ অন্তজ সমাজের নারীদের এই ইতিহাস দাঁড়িয়ে আছে একটি অসম্পূর্ন ছেঁড়া দলিলের ওপর। রণজিৎ গুহ জন–ইতিহাসকে, যে ইতিহাসের নামকরণ তিনি নিম্নবর্গের ইতিহাস করেছেন, উদ্ধার করার আরো সৃজনশীল পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। আপনারা যাঁরা তাঁর আপ্রোজ অব কাউন্টার ইন্টার্জেন্সি পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন উচ্চবর্গের দলিলের ভিতরেই কীভাবে নিম্নবর্গের ইতিহাস লুকিয়ে থাকে। অর্থাৎ যারা তাদের কীর্তির দলিল তৈরী করছে—অর্থাৎ উচ্চবর্গের সদস্যরা—তারা ক্ষমতার বিস্তার আর রক্ষার স্বার্থেই নিম্নবর্গকে তাদের দলিলে জায়গা করে দিচ্ছে। উচ্চবর্গের দলিল পাঠের এই পদ্ধতি শুধু অভিনবই নয়, জন–ইতিহাস উদ্ধারের এক সৃজনশীল পথও বটে। উপরে শুধুমাত্র তিনটি নিবন্ধের উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধরনের নিবন্ধ আরো অনেক লেখা হচ্ছে। জন–ইতিহাসের উৎসাহী ছাত্ররা সেগুলার সাথে পরিচিত হলে জন–ইতিহাসের চর্চা বিকশিত হবে।
রণজিৎ গুহর একটা বক্তব্য জন–ইতিহাস চর্চার লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে। নিম্নবর্গের অন্তর্ভুক্ত সকল শ্রেণীগোষ্ঠি, ব্যক্তি ও সমষ্টিকে ঐতিহাসিক গবেষণা ও বক্তব্যের বিষয় বলে স্বীকার করতে হবে সচেতনভাবে। এই সচেতনতার জন্য জনগণের পক্ষের রাজনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশ–উত্তর সমাজের প্রভু ও অধীনের সম্পর্কটা যাদের জীবনে খুবই প্রকট, অথচ যারা আমাদের ইতিহাস চর্চায় এখনো প্রায় অনুপস্থিত সেই আদিবাসী, নিম্নবর্ণ, গ্রাম–শহরের গরীব জনতা ও স্ত্রীলোকের ভূমিকা নিয়ে বিশেষভাবে ভাবতে ও লিখতে হবে। এইদিকে এগুতে গেলেই বোঝা যাবে উচ্চবর্গের দৃষ্টিভঙ্গি তার বাহন প্রচলিত ইতিহাস বিদ্যা আমাদের জুড়ে আছে। ১৯১৮ সালে আমেদাবাদের সূতাকল ধর্মঘটের ইতিহাস যখন লিখতে হবে, তখন যেন মনে রাখা হয় যে সেই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা গান্ধী, শংকরলাল ব্যাংকার ও অনুসূয়া সারাভাইইয়ের জীবনীর অধ্যায় মাত্র নয়। তার মধ্যে ধর্মঘটীদের চৈতন্যের শ্রেণী চেতনা যার অন্যতম উপাদান , একটি মূল্যবান ইতিহাস আছে। যে ইতিহাস মহাদেব দেশাই ও তেন্ডুলকারের পক্ষে লেখা সম্ভব হয়নি, তা আমাদেরই লিখতে হবে। যখন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে হবে তখন যেন মনে রাখা হয় যে এ আন্দোলন ছাত্র–বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলনই শুধু নয়; যখন ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের ইতিহাস লিখতে হবে তখন যেন মনে রাখা হয়, এ আন্দোলন শুধুমাত্র জাতীয় নেতাদের আর ছাত্র সংগ্রাম কমিটির আন্দোলনই নয়। এই ইতিহাস লিখতে হবে একদম একেবারে আরেক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। আমরা এমন ইতিহাস চাই যার মধ্যে মেয়েরা বা সাধারণ লোকেরা অতীত সমাজের তথ্যকণিকা মাত্র নয়, যার মধ্যে তারা ঐতিহাসিক সত্য বলে স্বীকৃত।
রণজিৎ গুহ আরো বলেন, ‘উচ্চবর্গের পক্ষপাতি ইতিহাসবিদ্যাকে সমালোচনা দিয়েই শুরু করতে হবে। সমালোচনাই নতুন পথ খোঁজার উপায়, তিনি খোঁজার কথা বলেছেন, পৌছানোর কথা নয়। কারণ পৌছানো যাবে তখনই যখন একেবারে নতুন কোন আদিকল্পকে বসানো যাবে পুরনোটির জায়গায়। এ ধরনের পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ শুধু নয়; অনেক এগানো–পেছানো, হারিয়ে যাওয়া, হোঁচট খাওয়া তার স্বভাবসিদ্ধ। ইতিহাসবিদ্যাকে ঢেলে সাজাতে হলে সাধারণ মানুষের দিকে চোখ ফিরাতে হবে। ঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশিকোত্তর বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং সবকিছুর ওপর রাজনীতিতে তাদের বিশিষ্ট ভূমিকা কী ছিল তা নির্ণয় করতে হবে।’ সেই উদ্দ্যেশ্যেই নতুন তথ্য খুঁজতে পুরনো তথ্যকে নতুনভাবে পড়তে হবে, দরকার হলে বিশ্লেষণের পুরনো কায়দা ছেড়ে নতুন কায়দা তৈরী করে নিতে হবে। আর এই সবকিছুকে সম্ভব করার জন্যই তথ্যাশ্রিত অভ্যাসের সঙ্গে মেলাতে হবে তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির। এই ইচ্ছার প্রকাশ যতটা সহজ, কাজতা ততখানি সহজ নয়।
এখানে জন–ইতিহাস চর্চার কিছু তাত্ত্বিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে, যদিও এ পর্যায়ে আলোচনা কিছুটা জটিল হয়ে উঠতে পারে। সেটা এড়াবার কোন উপায় নেই। তবে ক্রমাগত মতবিনিময়ের মধ্যে দিয়েই ভাবনার জটিলতা অনেকখানি সহজ হয়ে আসবে।
জন–ইতিহাস কি উচ্চবর্গের আখ্যানে ধস নামাতে পারে? এক সাম্প্রতিক লেখায় দীপেশ চক্রবর্তী এই প্রশ্নটি তুলেছেন। ইতিহাস চর্চায় যে মৌলিক শর্ত অর্থাৎ মানুষের কোন বিশেষ কর্মকান্ডে একটা আখ্যানের সম্ভাবনা এবং সেই আখ্যানটি যদি জনজীবনের যুক্তিগ্রাহ্যতার অবস্থান থেকে তৈরি হয় , তখনই তা ইতিহাস হয়ে ওঠে। এই যুক্তি গ্রাহ্যতা আদর্শিক, নৈতিক , রাজনৈতিক, দর্শনভিত্তিক হতে পারে। সেই কারণেই কোন উন্মাদের কাহিনী ইতিহাস হয় না, অথবা নেহাত ব্যক্তিগত কোন বিবরণ ইতিহাস হয় না; ওগুলি ইতিহাসের উপাদান হতে পারে যদিও। উপযুক্ত দুটি শর্ত মেনে যে ইতিহাস লেখা হয় তা একসময় ইতিহাসের মূলধারায় মিশে যায় অথবা নিজে একসময় প্রান্তিক অবস্থান থেকে কেন্দ্রীয় অবস্থানে চলে আসতে পারে। গত দুই দশকে রণজিৎ গুহর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা নিম্নবর্গের ইতিহাস তেমনই ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের ইতিহাস চর্চার কেন্দ্রে হাজির হয়েছে। ইতিহাস চর্চা এ ধরনের সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে পথ কেটে এগিয়ে চলে। জন–ইতিহাসের এই গ্রাহ্যতা জনজীবনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দ্বারা সৃষ্ট। জন–ইতিহাসের প্রয়োজন ঐতিহাসিকদের গণতান্ত্রিক চেতনাপুষ্ট প্রশ্ন থেকে উদ্ভূত। সামাজিক ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক চেতনা, যা কিনা ইউরোপের উদার রাজনীতি ও মার্ক্সবাদ থেকে আমরা শিক্ষ পেয়েছি, আমাদের প্রেরণা যোগায় সমাজের অবহেলিত মানুষের কাহিনীকে মূলধারার পাশে স্থান দিতে। জন–ইতিহাস চর্চা আসলে সামাজিক স্মৃতি গণতন্ত্রায়নের লক্ষ্যে একটি নিরন্তর সংগ্রাম। এটাই জন–ইতিহাস চর্চার রাজনীতি। জন ইতিহাস চর্চার কি কোন লক্ষ্য আছে? বিষয়টা নিয়ে ভাবা দরকার । তবে ঐতিহাসিক জে.এইচ.প্লাম্বের ক্রাইসিস ইন হিউম্যানিটিজ –এর একটি উক্তি ইতিহাস চর্চায় মানবিক লক্ষ্য নির্ধারণের ইঙ্গিত দেয়। তিনি বলেছেন, ‘Historian’s explanations of the past should lead to an explanation of it for their time and generation, so that by explaining man’s control over his future may be increased.
এই উদ্বেগ অনেক বড় মাপের। মানবজাতির ভবিষ্যৎ ঘিরে জন–ইতিহাস চর্চাও এই উদ্বেগের অংশীদার।