অরাজ
আর্টওয়ার্ক: কনস্ট্রাকশন ওয়াকার্স শিল্পী: ওয়াল্ট লান্ডারব্যাক সূত্র: পিন্টারেস্ট
প্রচ্ছদ » নোম চমস্কি।। অ্যানার্কো সিন্ডিক্যালিজমের প্রাসঙ্গিকতা

নোম চমস্কি।। অ্যানার্কো সিন্ডিক্যালিজমের প্রাসঙ্গিকতা

অনুবাদ: অনিক সন্ধি

 

নোম চমস্কি

প্রফেসর চমস্কি, প্রথমেই এনার্কিজম কী তা নিয়ে আলোচনা না করে এনার্কিজম কী নয়, তা দিয়ে শুরু করা যাক৷ এনার্কি শব্দটি গ্রিক ভাষা থেকে আহরিত, আক্ষরিক অর্থে যার মানে দাঁড়ায় “রাষ্ট্রহীনতা বা সরকারহীনতা”। এখন, যারা এনার্কি বা এনার্কিস্ট রাজনৈতিক দর্শনের কথা বলে, তারা তো অবশ্যই শুধু এটা বোঝায় না যে কাল থেকে সব পুলিশ, আইন-কানুন, কর-খাজনা, পোস্ট অফিস – এসব কিছুর বিলীন হয়ে যাক, নাকি? অবশ্যই ব্যাপারটা আরো জটিল কিছু।

চমস্কি: আচ্ছা। আসলে এখানকার কিছু প্রশ্নের উত্তরে “হ্যাঁ” বলতে হবে আর কিছু ক্ষেত্রে “না” বলতে হবে। পুলিশবাহিনীর অবসান – হ্যাঁ, কিন্তু রাস্তাঘাটে কোন ট্রাফিক নিয়ম-কানুন থাকবে না, মোটেই তা নয়। শুরুতেই বলে রাখা ভালো যে, বিপুল পরিসরের রাজনৈতিক ধারণা নৈরাজ্যবাদের (Anarchisim) আওতায় পড়ে। তবে আমি এনার্কিজমকে মুক্তিকামী বা লিবার্টারিয়ান-বামের অংশ বলেই ধরি, যাকে অন্যভাষায় স্বেচ্ছাধীন বা ভলান্টারি সমাজতন্ত্রও বলা যায়। আর তার মধ্যেই পড়ে মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্র, এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম, সাম্যবাদী নৈরাজ্যবাদের মতো আদর্শ যা ক্রপোৎকিন, বাকুনিন এবং অন্যান্যদের দ্বারা প্রকাশিত হয়। তাদের ধারণায় ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত একটি সমাজ কিন্তু সেই সমাজ গঠিত হতে হবে অনেক ধরনের জৈবিক একক কিংবা জৈবিক সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে। আর এই একক কিংবা সম্প্রদায় বলতে তারা বুঝিয়েছেন কর্মক্ষেত্র ও পাড়া-মহল্লাকে। এই এককগুলো সমাবেশিত হয়ে ফেডারেশনের মাধ্যমে অত্যন্ত কর্মক্ষম ও সংবদ্ধ সংগঠন গঠন করবে যার প্রসার হবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। সকল সিদ্ধান্ত গৃহিত হবে সারগর্ভ পর্যায়ে যার মর্ম ফেডারেশনগুলোতে বহন করবে প্রতিনিধিগণ (delegates), যারা  ওই সকল জৈবিক একক বা সম্প্রদায়েরই সদস্য এবং যারা সেখানেই ফিরে যাবে।

তো এর মানে এমন কোন সমাজ নয় যেখানে একেবারেই কোন সরকার থাকবে না৷ বরং এটি এমন এক সমাজ দাবী করে যার মূল কর্তৃত্ব সবসময় আসে নিচ থেকে উপরতলায়, উপর থেকে নিচতলায় নয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো প্রতিনিধিত্বমূলক গণতনন্ত্রে (representative democracy) কর্তৃত্ব আসে উপর থেকে নিচ তলায়, যদিও সেখানে নির্বাচক বা ভোটাররাই সিদ্ধান্ত নেয়।

চমস্কি: যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের অন্তত দুটি সমালোচনা নৈরাজ্যবাদী ঘরানা থেকে আসবে। প্রথমত,  উল্লেখিত দুই ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের হাতে একচেটিয়া ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, সেখানকার গণতন্ত্র শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়। নৈরাজ্যবাদীরা সবসময়ই বলে এসেছে যে একজন ব্যক্তির উৎপাদনশীল জীবনের গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ সার্বিক মানবিক মুক্তির একেবারে কেন্দ্রীয় বিষয়। অর্থাৎ, সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সমাজের গণতান্ত্রিক চর্চার অর্থ আসলে তাই। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত মানুষকে বাজারে নিজেকে ভাড়া করতে বাধ্য করানো হবে এমন কারো কাছে যে তাকে ভাড়া করতে চাইবে, যতদিন পর্যন্ত উৎপাদন ক্ষেত্রে তার ভূমিকা হবে সাধারণ হাতিয়ারের, ততদিন সেই বলপ্রয়োগমূলক ও অত্যাচারী ব্যবস্থায় অর্থপূর্ণ  গণতন্ত্র চর্চার কোন প্রশ্নই আসে না।

ঐতিহাসিকভাবে বলছি, এর আগে কি এমন কোন সমাজের নজির পাওয়া যায় যেটি ব্যাপকভাবে ও সূদুরপ্রসারীভাবে নৈরাজ্যবাদী নীতির কাছাকাছি?

চমস্কি: ছোট ও বড় দুই ধরনের নৈরাজ্যবাদী সমাজই আমি লক্ষ্য করেছি যা শুধু অতীতেই নয়, বর্তমানেও আছে। দীর্ঘ সময় ধরে বেঁচে থাকা ছোট সমাজগুলোর মধ্যে ইজরায়েলের কিবুৎজিমকে আমি চমৎপ্রদ উদাহরণ হিসেবে বেছে নিব। দীর্ঘ সময় ধরে এটা নৈরাজ্যবাদী নীতির ভিত্তিতেই চলছিল যেমন স্বপরিচালনা বা সেল্ফ-ম্যানেজমেন্ট, প্রত্যক্ষ শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ, কৃষি, শিল্প ও সেবার একীভূতকরণ এবং স্বপরিচালনায় ব্যক্তিগত অংশগ্রহণ। আর আমি মনে করি এগুলো প্রায় সব ক্ষেত্রেই সফল ছিল।

কিন্তু এগুলোতো রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অভ্যন্তরেই ছিল যা তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করত।

চমস্কি: সবসময় তা ছিল না। আসলে এগুলোর ইতিহাস খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। শুধুমাত্র ১৯৪৮ সাল থেকেই তারা রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত হয়। এর আগে তারা ঔপনিবেশিক ছিটমহলের অন্তর্ভুক্ত ছিল যা ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের বাইরেই ছিল। আর এই সমাজটা ছিল অন্তভৌমিক ও সমবায় পদ্ধতি অনুসরণকারী। আমার মতে যখন তারা রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত হয় তখনই তারা তাদের মুক্তিকামী সমাজবাদী চরিত্র হারিয়ে ফেলে। আরও কিছু ঘটনাবলিও এতে ভূমিকা রাখে যা ওই অঞ্চলের জন্য অনন্য, কিন্তু সেই দিকে আমাদের যাওয়ার দরকার নেই। একটা কার্যকর মুক্তিপরায়ণ সমাজতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এরা খুবই চমৎকার একটা মডেল যা উন্নত শিল্প সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

আর্টওয়ার্ক: জুলিও ১৯
শিল্পী: বারদাসানো
সূত্র: পিন্টারেস্ট

এখন বড় নৈরাজ্যবাদী সমাজের উদাহরণে আসি। আকারে অত্যন্ত বড় রকমের নৈরাজ্যবাদী বিপ্লবের কথা চিন্তা করলে ১৯৩৬ এর স্প্যানিশ বিপ্লবের কথা মাথায় প্রথমে আসে। এই বিপ্লবটি এতটাই সুদূরপ্রসারী  ছিল যা তখনকার রিপাব্লিকান অংশের অঞ্চলে বিশাল পরিমাণের জায়গা দখল করেছিল এবং সেখানকার কৃষি ও শিল্পকে এমনভাবে জড়িয়েছিল যে বাহিরে থেকে দেখলে মনে হবে বিপ্লবটি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু আসলে বিপ্লবটি তিন প্রজন্মের নৈরাজ্যবাদীদের নানাবিধ পরীক্ষা, চিন্তাধারা ও কর্মসূচির ফল যা সেখানকার মানুষদের মন গভীরভাবে জয় করতে পেরেছিল। আর অবশ্যই, মানবিক পাল্লায় ও যে-কোন ধরনের অর্থনৈতিক পাল্লায় এই বিপ্লব অত্যন্ত সফল হয়েছিল। ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা অত্যন্ত সফলভাবে উপরতলার কোন শাসন ও বলপ্রয়োগ ব্যতীতই উৎপাদন কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল, যা তখনকার উদারবাদী ও তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্টদের অবাক করে দিয়ে ছিল। এই নৈরাজ্যবাদী বিপ্লব ক্ষমতাবানদের দ্বারা শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছিল, কিন্তু যেটুকু সময় ধরেই তা বেঁচে ছিল, আমি মনে করি সকল ক্ষেত্রেই তা সফল হয়েছিল। আর এই বিপ্লবই প্রমাণ করে যে গরীব মেহনতি শ্রেণির মানুষেরা তাদের নিজেদের জীবন নিজেদের শর্তে কোন প্রকারের বলপ্রয়োগ ও শাসন ছাড়াই সংগঠিত ও পরিচালনা করাতে কতটা সক্ষম। স্প্যানিশ অভিজ্ঞতা অগ্রসর শিল্পায়িত সমাজের জন্য কতটা প্রাসঙ্গিক তা সত্যিই গভীরভাবে পরখ করে দেখা দরকার।

এটা পরিষ্কার যে নৈরাজ্যবাদের গোড়ার কথার একটি হলো ব্যক্তির অগ্রাধিকার- অবশ্য বিচ্ছিন্নতায় নয়, বরং অন্য ব্যক্তির সাথে যুক্ততা-  এবং তার স্বাধীনতার পরিপূর্ণতা। শুনে অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাবনার মতো মনে হয়। আমেরিকান অভিজ্ঞতা কী এমন ছাপ ফেলেছে যা স্বাধীনতার এই ধরণের ঐতিহ্যকে আপনি ও আপনার মত অন্যান্য নৈরাজ্যবাদী চিন্তাবিদরা সন্দেহ করেন?

চমস্কি: শুরু করার আগেই বলে নিতে চাই আমি নিজেকে একজন নৈরাজ্যবাদী চিন্তাবিদ হিসেবে মনে করি না। আমি নিজেকে মনে করি নৈরাজ্যিক পথের একজন পথিক হিসেবে। তবে আমি বলব অন্যান্য নৈরাজ্যবাদী চিন্তাবিদরা আমেরিকান অভিজ্ঞতা অর্থাৎ জেফারসোনিয়ান গণতন্ত্রকে অনকটাই প্রসন্নচিত্তেই দেখেছেন। ওই যে সেই জেফারসোনিয়ান চিন্তা, যেটা বলে সেই সরকারই মহান সরকার যা শাসন করে সবচেয়ে কম, আবার থোরিউ যাতে যোগ করেছিলেন এউ বলে যে সেই সরকারই মহান সরকার যা শাসনই করে না। এই কথাটাই আধুনিক কালের নৈরাজ্যবাদী চিন্তকগণ বারংবার বলেছেন।

কিন্তু জেফারসোনিয়ান গণতন্ত্রের আদর্শ বিকশিত হয়েছিল পুঁজিবাদের বিকাশের আগে, এমন এক সময়ে যেখানে নিয়ন্ত্রণের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল না এবং ছিল এখনকার মত ব্যক্তিগত ক্ষমতা। আসলে আগেকার পুরনো মুক্তিবাদী লেখাগুলো পড়লে চমকে যেতে হবে। ধরেন ১৭৯২ সালের ভিলহেলম ফন হামবোল্টের রাষ্ট্রের সমালোচনামূলক ধ্রুপদী লেখাগুলো ( The Limits of State Action) যা পরবর্তীতে [জন স্টুয়ার্ট] মিলকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, সেখানে একীভূত ব্যক্তিগত ক্ষমতাকে প্রতিহত করার কথা নেই বললেই চলে। তবে অবশ্যই একীভূত নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রতিহত করার প্রয়োজনীয়তা লেখা আছে। আর প্রায় একই জিনিস দেখবেন পুরনো আমেরিকান ঐতিহ্যতেও। কিন্তু এর কারণ হলো তখন এই একটা ক্ষমতাই ছিল। হামবোল্ট বুঝতে পারেননি যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বাদেও ব্যক্তিগত ক্ষমতা প্রতিহত করার প্রয়োজনীয়তাও দেখা দিবে ভবিষ্যতে। তিনি শুধু রাষ্ট্র ও চার্চের ক্ষমতার বিরুদ্ধেই লিখেছেন। তো তিনি যখন মানুষের নিজের সৃজনী বা উদ্ভাবনী জীবনের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণের কথা বললেন, যখন তিনি মানুষের নিজের শ্রম থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করাকে নিন্দা করলেন, তখন তিনি রাষ্ট্রবিরোধী ও পাদ্রীবর্গবিরোধী দিক থেকেই তা বললেন। কিন্তু এই একই নীতি পূঁজিবাদী সমাজেও প্রয়োগ করা যায়। আর আমি মনে করি হামবোল্ট যদি বর্তমানে বেঁচে থাকতেন তবে তিনি অবশ্যই মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্রী হতেন।

পিতর ক্রপোৎকিন

তাহলে কি বলা যায় না যে মুক্তিবাদ বা নৈরাজ্যবাদের প্রযোজ্যতায় সহজাতভাবেই প্রাক-শিল্পায়িত ধারণার বৈশিষ্ট্য রয়েছে? যে তার বাস্তবায়নের জন্য দরকার গ্রামীণ এক সমাজ যেখানে প্রযুক্তি ও হাতিয়ার সরল প্রকৃতির? আর যেখানকার অর্থনৈতিক সংগঠন স্থানীয় ও ছোট আকারের?

চমস্কি: আচ্ছা এই প্রশ্নটিকে আমি তাহলে দুই ভাগে ভাগ করি।  প্রথমত, অন্যান্য নৈরাজ্যবাদী এই সম্পর্কে কী বলেন এবং দ্বিতীয়ত, আমার মতামত। নৈরাজ্যবাদীরা এখানে দুইভাগে বিভক্ত। একটি নৈরাজ্যবাদী ঐতিহ্য-ক্রপোৎকিনকে যে ধারার প্রতিনিধি বিবেচনা করা যায়-যারা আপনার বর্ণিত সমাজই চায়। আবার আরেক ঐতিহ্যের নৈরাজ্যবাদীরা, যাদের বলা হয় এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট, তারা নৈরাজ্যবাদকে অত্যন্ত সংগঠিত ও জটিল এক শিল্পায়িত সমাজের জন্য সঠিক ধরনের সংগঠনপ্রণালী হিসেবে দেখে। আর এই প্রবণতার সম্পর্ক রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বামপন্থী-মার্ক্সবাদের সঙ্গে, যেমন কাউন্সিল-কমিউনিজম যা লুক্সেমবার্গবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। বলে রাখা ভাল যে, এ্যান্টন পানেকুকের মতো মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক এই বামপন্থী-মার্ক্সবাদের প্রতিনিধিত্ব করেন; যিনি একাধারে ছিলেন বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ, যিনি শিল্পে শ্রমিক কাউন্সিল সম্বন্ধে পূর্ণ এক তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন।

তাহলে এই দুইটি ধারণার ভিতর কোনটি সঠিক? মানে এটা কি সত্য যে নৈরাজ্যবাদী ধারণা শুধু গ্রামীণ সমাজের জন্য উপযুক্ত নাকি নৈরাজ্যবাদ অত্যন্ত উন্নত ও অগ্রসর একটি শিল্পায়িত সমাজের জন্য উপযুক্ত? আমি নিজে মনে করি পরের ধারণাটিই সঠিক। অর্থাৎ আমি মনে করি শিল্পায়ন ও উন্নত প্রযুক্তি বড় জায়গা জুড়ে স্বপরিচালনার সম্ভাব্যতা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যা আগের যুগে ভাবাই যেত না। আর ঠিক এই কারণেই এটি উন্নত শিল্প সমাজের জন্য যুক্তিসম্মত একটি ব্যবস্থা, যেখানে শ্রমিকেরা নিজেরা নিজের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার মালিক হতে পারবে, অর্থাৎ নিজের কর্মক্ষেত্রের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায়, আবার অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন-পরিচালনায়, সামাজিক প্রতিষ্ঠানে ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বা তারও বড় পরিসরে বড় রকমের সিদ্ধান্ত রাখতে পারবে। বর্তমান প্রতিষ্ঠানগুলো তাদেরকে উল্লেখিত ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ দেয় না এবং দিতে চায় না আর তার জন্য যে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা প্রয়োজন তাও দেয় না এবং দিতে চায় না। আর তাছাড়াও প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাজ প্রযুক্তির বদৌলতে স্বয়ংক্রিয় করা সম্ভব যার ফলে মানুষ কাজের বোঝা থেকে মুক্তি পাবে ও মনমতো সৃজনশীল কর্মে লিপ্ত হতে পারবে।

আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই নৈরাজ্যবাদী সমাজে অর্থনীতি সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করব। কিন্তু তার আগে আপনি যেহেতু একটি আধুনিক অবস্থায় নৈরাজ্যবাদী সমাজের কথা বলছেন, এমন সমাজের রাজনৈতিক গঠনতন্ত্রের একটা চিত্র তুলে ধরবেন কি? যেমন ধরুন সেখানে কি রাজনৈতিক দল থাকবে? আর সরকারের কোন কোন অংশ অবশিষ্ট থাকবে?

চমস্কি: এ সম্বন্ধে যাকে বলা যায় মোটের ওপর সর্বসম্মতি আমি তার একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করি। আমি একে আবশ্যিকভাবে সঠিক বিবেচনা করি। শুরু করা যাক প্রধান দুটি সংগঠন ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা দিয়ে; যা হল কর্মক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ ও সম্প্রদায়। ধরুন, শ্রমিক কাউন্সিল সমূহের একটি নেটওয়ার্ক যা উপরের পর্যায়ে সাধারণ সমাবেশ গঠন করে ফ্যাক্টরি সমূহের অথবা শিল্পের শাখা সমূহের প্রতিনিধিত্বের দ্বারা, যার চরিত্র জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের হতে পারে। ঠিক আরেকভাবে ভাবা যায় একটি প্রশাসন ব্যবস্থা যা স্থানীয় সমাবেশ বা এসেম্বলি সমূহকে জড়িত করে এবং আবারও যা আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফেডারেটেড হয়ে শিল্প ও ফ্যাক্টরিকে জড়ায়।

এখন ঠিক কীভাবে এ ধরনের সংগঠনপ্রণালী বিকশিত হবে এবং ঠিক কীভাবে পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত হবে; আপনার কি দুই ধরনের সংগঠনই লাগবে নাকি এক প্রকারেই চলবে এগুলো নিয়ে খোদ নৈরাজ্যবাদী তাত্ত্বিকদের মধ্যে বিতর্ক চলমান এবং নানামাত্রিক প্রস্তাবনা বিরাজ করে। আমি একটা পক্ষ নিয়ে নেয়ার মতো নিশ্চিত এখনো নই। এই প্রশ্নগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে।

তাহলে এখনকার মতো জাতীয় পর্যায়ে যে নির্বাচন হয় এবং যাতে রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে তা থাকবে না। কারণ যদি তেমন থাকত তাহলে এখনকার মতো কেন্দ্রীয়ভাবে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বিরাজ করত যা নৈরাজ্যবাদী ভাবনার বিরুদ্ধে।

চমস্কি: না, নৈরাজ্যবাদী ভাবনা অনুযায়ী প্রতিনিধিত্বমূলক কর্তৃত্ব একেবারে নূন্যতম মাত্রায় থাকবে এবং এই সকল প্রশাসনিক কাঠামোয় যারা অংশগ্রহণ করবে তারা একেবারে সরাসরি তাদের আঙ্গিক সম্প্রদায় সমূহের প্রতি সংবেদনশীল (responsive) থাকবে। আসলে এইসকল প্রশাসনে অংশগ্রহণের সময় অংশগ্রহণকারীর জন্য খুব সীমিত থাকবে আর তারা চাইলেও পেশাদার আমলা হতে পারবে না কারণ অংশগ্রহণ চলাকালীন  অবস্থাতেও তারা যে শ্রমিক অথবা মহল্লা কাউন্সিল প্রতিনিধিত্ব করছে সেখানকার কাজ একাধারে করে যাবে।

আর মনে হয় কোন নৈরাজ্যবাদী সমাজ রাজনৈতিক দল গঠনে বাধা দেবে না। আসলে নৈরাজ্যবাদ এই মতে বিশ্বাসী যে কোন ধরণের প্রোকাস্টিয়ান (অর্থাৎ বল প্রয়োগ দ্বারা সমতা সাধক) ব্যবস্থা ও সমাজ জীবনে আরোপ করা যেকোন আদর্শ ও নিয়ম অচিরেই সেই সমাজের জীবনীশক্তি ধ্বংস করে ফেলে। সেই সাথে সেখানকার পার্থিব ও মনোজাগতিক সংস্কৃতির প্রভাবে গড়ে ওঠা সব ঐচ্ছিক সংগঠনের সম্ভাবনাকেও ধ্বংস করে ফেলে। আর যা না বললেই নয়, যদি এমন হয় যে রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা থেকেই যাচ্ছে তাহলে বোঝা যাবে যে সেই নৈরাজ্যবাদী সমাজ ব্যর্থ হয়েছে। আসলে যা হওয়া উচিত তা হল, যেখানেই স্ব-ব্যবস্থাপনা বা সেল্ফ-ম্যানেজমেন্টে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে সেখানকার ফেডারেশন সমূহের সব পর্যায়ে সবার ভিন্নমত, দলাদলি, দ্বন্দ-সংঘর্ষ, স্বার্থের ভিন্নতা প্রকাশ করা হবে ও তার মিটমাট করা হবে। একটা স্বাধীন সমাজে এসব জিনিসতো থাকবেই আর তাই এসবকে স্বাগতমও জানানো হবে। তাই বলে কেন তা দুই একটি রাজনৈতিক দলের হাতে করায়ত্ব হতে হবে, তা আমি বুঝি না। আমি মনে করি না মানব জীবন ও স্বার্থের জটিলতা রাজনৈতিক দলভূক্ত একটা সমাজ বুঝতে পারে। রাজনৈতিক দলসমূহ প্রধানত শ্রেণি স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে, আর নৈরাজ্যবাদী সমাজে শ্রেণীর উৎখাত এবং শ্রেণীকে লঙ্ঘন করার বন্দোবস্ত থাকবে ফলে রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন ফুরাবে।

আর্টওয়ার্ক: গ্রিড
সূত্র: উইকিমিডিয়া

রাজনৈতিক সংগঠন সম্বন্ধে এটা শেষ প্রশ্ন। এই যে নির্বাচনহীন এসব প্রশাসনিক সংগঠন এবং এদের আধা-সরকারী কাঠামো, তাদের কর্তৃত্বক্রমতান্ত্রিক স্তরভুক্ত এসেম্বলিসমূহের মদদে যে পিরামিডের চূড়া গঠন করবে; এমন কি হতে পারে না যে এই চূড়া জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেই কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের মত আচরণ করবে? আর তাছাড়া এই চূড়ার কাছে তো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্বন্ধীয় ও সামরিক কিছু ক্ষমতা থাকবে। এমন কি হতে পারে না যে সে এই ক্ষমতার মদদে এখনকার রাষ্ট্রসমূহের মতই অগণতান্ত্রিক হয়ে পড়ে?

চমস্কি: যেকোন মুক্তিবাদী সমাজের জন্যই আপনার বলা দৃশ্যকল্পের দিকে অগ্রসর হওয়া থেকে নিজেকে রুখতে পারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব। আর তা যাতে প্রতিহত হয়, তার জন্য প্রতিষ্ঠানসমূহকে সেভাবেই বানাতে হবে। আমি নিজে একেবারেই মনে করি না যে প্রশাসনে অংশগ্রহণ একটা ফুল টাইম কাজ হবে। হ্যাঁ, তা একটা অযৌক্তিক সমাজের জন্য হতে পারে, আর সেখানকার  সমস্ত সংকট আসলে সেই অযৌক্তিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ফল। তবে একটা যৌক্তিক ও চলমান অগ্রসর শিল্পায়িত সমাজ, যা মুক্তিপরায়ণ ধারণার ভিত্তিতে সংগঠিত, সেখানকার প্রশাসনিক কাজ হবে পার্ট-টাইম আর আর সকলের দ্বারাই তা পালাবদলের মাধ্যমে সংগঠিত হবে। আর সকল সময়েই তারা তাদের নিজেদের সৃজনী কর্মের সাথেই যুক্ত থাকবে।

এমন হতে পারে যে ধরুন, প্রশাসন নিজেই ইস্পাত উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত। তাই যদি হয় তাহলে প্রশাসন ব্যবস্থাও ইস্পাত ইন্ডাস্ট্রির ভিত্তিতে হবে এবং তা পরিচালিত হবে সেই ইন্ডাস্ট্রির সকল শ্রমিক দ্বারা এবং তারা সংগঠিত হবে তাদের নিজদের শ্রমিক কাউন্সিলের ভিত্তিতে।

আর তাই কিন্তু হয়েছিল ১৯৫৬ এর হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লবের সময়, যেখানে শুধু শ্রমিকরাই নয়, সরকারি কর্মচারীরাও ক্ষমতার সমতাকরণের ভিত্তিতে কাউন্সিল উপায়ে সংগঠিত হয়েছিল ও সরকারী সেবাসমূহ দিয়ে যাচ্ছিল। এমনও হতে পারে এরূপ ব্যবস্থাই নৈরাজ্যবাদী সমাজকে বল প্রয়োগী সমাজে পরিণত হতে বাধা দেবে।

আপনি যদি মনেই করে থাকেন একটা জটিল পর্যায় পর্যন্ত প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থাদির প্রয়োজন ফুরাবে না, সেক্ষেত্রে আপনার বক্তব্য থেকে কিন্তু পরিস্কার হওয়া গেল না এই তল থেকে উপরের দিকে ধাবিত প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থায় কার্যকর নিয়ন্ত্রণ কীভাবে রাখা সম্ভব হবে যা বর্তমানের পেন্টাগনীয় জটিল সংগঠন ও প্রযুক্তি ব্যবস্থা থেকে আলাদা হবে?

চমস্কি: আচ্ছা। প্রথমেই আমাদের পরিভাষা সম্পর্কে পরিষ্কার থাকা উচিত। আপনি পেন্টাগনকে প্রতিরক্ষামূলক সংগঠন বলছেন অথছ ১৯৪৭ সাল পর্যন্তও এদের নাম ছিল যুদ্ধ মন্ত্রণালয়। আমি তখন ছাত্র ছিলাম, এবং অতটা জটিল চিন্তার মানুষ ছিলাম না। কিন্তু তখনই আমি এবং অন্য অনেকেই বুঝতে পারে যে অতীতে মার্কিন সেনাবাহিনী যে মাত্রায় প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল, সেই দিন শেষ। যেহেতু এর নতুন নাম হলো প্রতিরক্ষা বিভাগ, তার মানে এটা আদতে হয়ে উঠল আগ্রাসন বিভাগ। অন্য কিছুই না।

আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যাত না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বাস করে যান – এই মর্মের ভিত্তিতে।

চমস্কি: হ্যাঁ, অরওয়েল আধুনিক রাষ্ট্রের ঠিক যে প্রকৃতিটা তুলে ধরেছিলেন, অনেকটা তাই। ঘটনা ঠিক ঠিক তাই। আমি বলতে চাচ্ছি, পেন্টাগন কোন অর্থেই প্রতিরক্ষা বিভাগ হতে পারে না। এটা কখনোই কারো হাত থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে রক্ষা করেনি। এটি সবসময় হানাদারি কায়দায় অন্য দেশ আক্রমণ করেছে। এটি কোন প্রতিরক্ষামূলক নয়, বরং আক্রমণাত্মক সংগঠন। পেন্টাগন ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ খুব ভাল ভাবেই চলতে পারবে। পেন্টাগন তার হাতে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী করায়ত্ব করেছে মূলত দুইটি কারণে – উভয়ই ভয়ানক সমাজবিরোধী।

প্রথমত, এমন একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা রক্ষায় যাকে তারাই নাম দিয়েছে আমেরিকান স্বার্থ – অর্থাৎ মূলত তার ব্যবসায়ীদের স্বার্থ। দ্বিতীয়টি হল অভ্যন্তরীণ, যাকে শাসকরা কেইনসিয়ান মেকানিজম  বলে থাকে। নির্দিষ্ট সময় পর পর পেন্টাগন বিপুল পরিমাণ সামরিক খাতে সরকার ব্যয় করে, যাকে হাস্যকরভাবে “অর্থনীতির স্বাস্থ্য সুরক্ষা” বলা হয়ে থাকে। আসলে তা স্রেফ অপচয়।

এই দুটো অবশ্যই নির্দিষ্ট শ্রেণীর স্বার্থ হাসিলের জন্য করা হয়, অর্থাৎ আমেরিকার শাসক শ্রেণী। কিন্তু আর যাই হোক,  জনগণের স্বার্থ হাসিল তারা কখনই করে না। একটা মুক্তিপরায়ণ সমাজতান্ত্রিক বা নৈরাজ্যবাদী সমাজে কখনোই এই বিপুল পরিমাণ আবর্জনা উৎপাদন ও অপচয় করা হবে না। যদি এমন হয় যে কোন এক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে, তবে এমন কেউই নেই যে তাকে আক্রমণ করার ক্ষমতা রাখে। কিউবা ও মেক্সিকোর তো প্রশ্নই আসে না। তাই যুক্তরাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরক্ষা নিয়ে মাথা ঘামানোর তেমন দরকার নেই। তবে কোন সামাজিক বিপ্লব যদি পশ্চিম ইউরোপের কোথাও সংগঠিত হয়, তবে তাদের হয়তো প্রতিরক্ষা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে।

আমি বলতে যাচ্ছিলাম, নৈরাজ্যবাদী সমাজে প্রতিরক্ষার কোন প্রয়োজন হবে না এমন কোন সাধারণ নীতি নেই। কারণ এই ধরনের নৈরাজ্যবাদী পরীক্ষা-নিরীক্ষা ধবং হয়ে গেছে।

চমস্কি: আসলে এগুলোর কোন সাধারণ উত্তর নেই। এগুলোর উত্তর হতে হবে খুবই সুনির্দিষ্টভাবে, সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এবং বস্তুনিষ্ঠ শর্তের সাপেক্ষে।

এ ধরনের সংগঠনপ্রণালীর যে ধরনের গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের কথা আপনি বলছেন, তা বুঝতে আমার একটু বেগ পেতে হচ্ছে। কারণ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না জেনারেলরা কীভাবে নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে যেটাকে আপনি [গণতান্ত্রিক হিশেবে] অনুমোদন করবেন।

চমস্কি: এজন্যই আমি এর জটিলতাটার দিকে ইঙ্গিত করতে চাই। এটা পুরোপুরি নির্ভর করে আপনি যে সমাজ বা দেশের কথা বলছেন তার উপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ঘটনা একরকম। কিন্তু যদি ইউরোপে কখনো সামাজিক বিপ্লব সংগঠিত হয়, তাহলে আপনি যে প্রসঙ্গটি তুললেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কারণ সেক্ষেত্রে প্রতিরক্ষার বিষয়টা আমলে নিতেই হবে। পশ্চিম ইউরোপে যদি কোন না কোন পর্যায়ের মুক্তিপরায়ণ সমাজ-বিপ্লব সংগঠিত হয়ই, সেক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক অভিযানের হুমকি থেকেই যাবে। এবং তখন সমস্যাটা দেখা দিবে যে কীভাবে একে মোকাবেলা করা হবে। স্পেনিশ বিপ্লবে ঠিক এই সংকটই হাজির হয়েছিল। ফ্যাসিবাদী, কমিউনিস্ট এবং উদারনৈতিক গণতন্ত্রীদের [অন্তরাল] সামরিক অভিযানের মুখোমুখি হয়েছিল এই বিপ্লব। এবং এরকম ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার প্রশ্ন যে গুরুত্বপূর্ণ হয় উঠবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

যাই হোক, আমি মনে করি আমাদের যে প্রশ্নটা তুলতে হবে, কেন্দ্রীয় নির্দেশে পরিচালিত স্থায়ী সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষার জন্য উপযুক্ত কিনা। তবে আমি মনে করি না পশ্চিমে ইউরোপকে মুক্তিপরায়ণ সামাজিক বিপ্লব রক্ষার ক্ষেত্রে মার্কিন বা সোভিয়েতের আক্রমণের মুখোমুখি হতে হবে। এক্ষেত্রে আক্রমণটা হয়তো সামরিক না হয়ে অর্থনৈতিক হবে। সরাসরি সৈন্যবাহিনী স্থাপন করবে। তারা মূল আঘাত হানবে ইউরোপের অর্থনীতিতে।

স্প্যানিশ সিভিল ওয়ার পোস্টার

আপনি আপনার এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “একটা সভ্য সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তির তার প্রতিভা বিকাশের সুযোগ থাকবে, যেখানে প্রত্যেকের সৃজনী কর্মক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদনমুখী কাজ করার সুযোগ থাকবে।” তারপর আপনি প্রশ্ন করেন, “তাহলে অর্থ বা ক্ষমতা বা ঠিক কী দিয়ে সেই কাজের প্রতিদান দেয়া যায়? কিন্তু সত্যি কথা হল মননসিদ্ধির সকল কাজই নিজেই তার প্রতিদান।” এখন অনেকের কাছে এই ধরনের যুক্তি অনেক আকর্ষণীয় হতে পারে৷ কিন্তু মননসিদ্ধির সকল কাজই যে সমাজের জন্য মঙ্গলজনক কিংবা আমরা বর্তমানে যে জীবনধারায় অভ্যস্ত তার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করবে এর প্রতিশ্রুতি কী?

চমস্কি: হ্যাঁ, কিছু কিছু কাজ আছে যা আমাদের বর্তমান জীবনধারা ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয়, কিন্তু প্রশ্নটা হল তা কতটুকু কষ্টদায়ক হতে হবে? এটা তো জানা যে বর্তমানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জীবনে কাজের পরিশ্রম কমানোর জন্য মোটেও নিয়োজিত নয়। এর কারণ হল ধরেই নেয়া হয় যে এখন এক বিপুল পরিমাণের মজুর-দাস নিয়োজিত আছে যারা নিজেকে ক্ষুধা থেকে বাঁচানোর জন্য যেকোন ধরণের কাঁধ ভাঙ্গা কাজ করতে প্রস্তুত। কিন্তু যদি কখনও মানবিক বুদ্ধিমত্তাকে নিয়োজিত করা হয় এই প্রশ্নের উত্তর বের করার জন্য যে বর্তমানের কাজ-কর্মকে কীভাবে অর্থশীল বানানো যায়, তার উত্তর আমি জানি না। তবে এটা ভাবা উচিত না যে তার কষ্ট লাঘব সম্ভব নয়। যেমন আমি স্টেট কন্সারভেশন কমিশনের জন্য ৩৪টা চারা লাগাই যা অন্তত আমার জন্য খুবই কষ্টকর হওয়ার কথা। কিন্তু আমি এটাকে খুবই উপভোগ করি। তবে যদি এমন হত যে আমার উপর কোন ওভারসীয়ার আরোপ করা হত কিংবা আমাকে জোর করে এটা করার জন্য বাধ্য করা হত তবে আমি তা মোটেও উপোভোগ করতাম না। তাই বলছি বেশিরভাগ মানুষেরই ভারী কাজ করতে তেমন অসুবিধা হয় না, তাই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে সেইসব কাজেরই কষ্ট লাঘব কী করে সম্ভব।

কিন্তু বেশিরভাগই তো বেশ কিছু মাস অর্থহীন কাজ যেমন অটোমোবাইল এসেম্বলিতে, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারে…

চমস্কি: আমার মনে হয় না মানুষ এসব কাজকে একেবারেই অর্থহীন মনে করে। আমার জানামতে যারা অটোমোবাইল ফ্যাক্টরিতে টেকনিকাল কাজ কর্ম করে তারা তাদের কাজ নিয়ে খুবই গর্ব করে। আর এসবের জন্য তো অনেক বিশেষায়িত স্কীল দরকার যা অনেকের কাছেই অনেক আকর্ষণীয়। আর যদি সত্যিই এমন হয় যে এমন কিছু কাজ রয়েছে যা আসলেই কষ্টদায়ক ও অর্থহীন তবে সমতার খাতিরে কমিউনিটির সবার মাঝে সে কাজ সমান ভাবে ভাগ করে দেয়া যেতে পারে।

আচ্ছা, আপনি বলছেন কমিউনিটি আপস মীমাংসার অধিকার রাখে। কমিউনিস্ট তত্ত্বও তো তাই প্রদান করে যার ভিত্তি হল জাতীয় পরিকল্পনা, বিনিয়োগের জন্য আদেশ ও বিনিয়োগ পরিচালনা ইত্যাদি কিন্তু একটি নৈরাজ্যবাদী সমাজতো এসবের সুযোগ রাখে না যেহেতু তারা রাষ্ট্রকেই প্রত্যাখান করে।

চমস্কি: আমি বলব এই ধারণাটা ভুল। নৈরাজ্যবাদী সমাজ অবশ্যই তার শ্রমিক কাউন্সিল ও তাদের ফেডেরাটিভ কাঠামোয় জাতীয় পরিকল্পনার পূর্ণ সুযোগ রাখে। পার্থক্যটা হল এই পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণে কে অংশগ্রহণ করতে পারে। নৈরাজ্যবাদী এবং অবশ্যই মুক্তিকামী বা বাম-মার্কসবাদী ঐতিহ্য চায় সেই পরিকল্পনা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করুক অবগত শ্রমিক কাউন্সিলের এসেম্বলি সমূহ। যেখানে রাষ্ট্রবাদী কমিউনিস্টরা চায় তা করুক একটা জাতীয় আমলা গোষ্ঠী যারা যাবতীয় সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিজেদের মধ্যে রাখবে ও কয়েক বছর পর পর নির্বাচন প্রচারণায় বলবে, “যাকেই তোমরা নির্বাচিত কর না কেন, আমাকে বা আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে, দিন শেষে দূরবর্তী আমলা শ্রেণীর এক সদস্যই তোমাদের শাসন করবে।”

কিন্তু বিশেষজ্ঞ ও বিশেষায়নের তো ব্যাপার আছে একটা…

চমস্কি: হ্যাঁ, নৈরাজ্যবাদীরা তো বিশেষজ্ঞদের প্রত্যাখান করে না। অবশ্যই এরকম বিশেষজ্ঞ থাকবে যারা একটা পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা ও তার ফল শ্রমিক কাউন্সিলদের সামনে এনে দিবে ও বলবে যে দেখুন এটা এটা করলে উৎপাদন এটা এটা হবে। কিন্তু এই বিশেষজ্ঞরাও শ্রমিকদের মতনই তাদের নিজস্ব কাউন্সিলে সংগঠিত হবে ও তাদের সাথে থেকেই তাদেরই হয়ে কাজ করবে। ঠিক যেমনটা অটোমোবাইল তৈরিকর্তারা আমাদের গাড়ি বানিয়ে দেয় ও আমরা পরে নিজেরা নিজেরদের মত চালাই, ঠিক তেমনি পরিকল্পনাকারীরা পরিকল্পনার নকশা শ্রমিকদের হাতে তুলে দিবে ও শ্রমিকরাই তাদের ইচ্ছানুসারে তা অনুসরণ করবে।

মানুষের আমূল প্রকৃতি অর্থাৎ তার প্রেরণা, তার পরার্থপরতা, তার জ্ঞান ও তার জটিলতা – এসব কিছুর পরিবর্তনের উপর মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্র কতটুকু নির্ভরশীল?

চমস্কি: আমি মনে করি শুধু পরিবর্তনই না, বরং মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্র এসব ক্ষেত্রে অবদানও রাখবে বটে। এটা অবদান রাখবে মানুষের আত্মিক পরিবর্তনে – অর্থাৎ সে কীভাবে নিজেকে নিজে দেখে, তার কর্ম ক্ষমতায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে, উৎপাদনে ও অনুসন্ধানে। একদিকে এটা সেই পরিবর্তনে নির্ভরশীল আবার আরেকদিকে এটা এমন সব প্রতিষ্ঠান তৈরিতে সচেষ্ট যা মানুষের কর্মের প্রকৃতিতে, সৃজনী কর্ম সম্পাদনে, অন্য মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে পরিবর্তন রাখবে আর সেই সম্পর্কের ভিত্তিতে এমন সব নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করবে যা নতুন উপায়ে মানব প্রকৃতিকে বিকশিত করতে সাহায্য করবে। আরপর আরো মুক্তিপরায়ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে যেখানে এই মুক্ত মানুষগুলো অবদান রাখতে পারবেঃ আমার মতে এটিই সমাজতন্ত্রের সঠিক বিকাশ।

আর্টওয়ার্ক: শিরোনামহীন
শিল্পী: হিসাম সাত্তা
সূত্র: রুয়া

প্রশ্ন: আর শেষমেশ প্রফেসর চমস্কি, এরূপ আদর্শের সমাজ কী আগামী ২৫ বছর বা এর কাছাকাছি সময়ের মধ্যে এখনকার উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোতে অস্তিত্বশীল হওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে?

চমস্কি: আমি মনে করি না আমি এতটাই বুদ্ধিমান কিংবা [তথ্যের দ্বারা] এতটাই অবগত যে এরকম অত্যন্ত জটিল একটা প্রশ্নের উত্তরে আমি কোন আগাম ভবিষ্যতবাণী করতে পারব। তবে আমার ধারণা অন্তত এটুকু আমরা বলতেই পারি যে, শিল্পায়িত পুঁজিবাদের মধ্যে সংকীর্ণ অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের পাটাতনে দাঁড়িয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এবং সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সমস্ত প্রবণতা দৃশ্যমান। এই প্রবণতাসমূহ দীর্ঘকাল যাবৎ বিরাজ করছে এবং এগুলোকে থামানোর মতো কোন নীতি উপায় দেখা যাচ্ছে না।

কিন্তু আমার মতে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকতার এই বিকাশ – এবং অবশ্যই এরা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত- বিদ্রোহের দিকে এবং অবিরামভাবে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে সাংগঠনিক প্রচেষ্টার দিকে ঠেলে দিবে। এসব অনেক ধরনের রূপ নেবে। বর্তমানে ইউরোপে যে আন্দোলন চলছে তার নাম হল সহ-নিরূপণ বা কো-ডিটারমিনেশন। অন্য ভাষায় বলতে গেলে শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ। বেশিরভাগ প্রচেষ্টাই নগণ্য এবং আমার মতে ভ্রান্তও বটে যেহেতু এগুলো শ্রমিক শ্রেণির আসল মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত নয়। তবে আর যাই হোক এটি একটি সঠিক প্রতিক্রিয়া অন্তত এই উপলব্ধি ও অনুমানের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিকভাবেই হোক বা বেসরকারী অর্থনৈতিক ক্ষমতার জোরেই হোক, বল প্রয়োগ ও নিপীড়ন কোন ভাবেই মানবজীবনের অত্যাবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য নয়। যতদিন পর্যন্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের এই কেন্দ্রীকরণ চলবে, ততদিন পর্যন্ত তাদের উৎখাতের জন্য সংগ্রাম ও বিদ্রোহও চলবে। আর আমি আশা করি অচিরেই সেই সংগ্রাম সফল হবে।

নোট: এই ইন্টারভিউ  BBC London Weekend 7v এর জন্য ১৯৭৬ সালের ২৫শে জুলাই সংগঠিত হয়েছিল পিটার জেই এর দ্বারা এবং প্রকাশিত হয় Noam Chomsky, Radical Prioritie,  expanded cd., সম্পাদকঃ সি.পি ওটেরো; ওকল্যান্ড: AK Press, ২০০৩), pp. 211-24

 

অনিক সন্ধি

অনিক সন্ধি অরাজপন্থি অ্যক্টিভিস্ট। উনিশ শতক ও বিশ শতকের ধ্রুপদী নৈরাজ্যবাদের ইতিহাস ও তত্ত্ব তার মূল আগ্রহের জায়গা। লেখালেখির পাশাপাশি অনুবাদ করছেন। পড়াশোনা করছেন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ফার্মাসি বিভাগে। এছাড়া একটি মেটাল ব্যান্ডে ড্রামার হিসেবে কাজ করছেন।
যোগাযোগ: ‍anikshandhi1019@gmail.com