অরাজ
আর্টওয়ার্ক: প্রিজনার শিল্পী: পল হাসনার সূত্র: সাৎসি আর্ট
প্রচ্ছদ » পিতর ক্রপোৎকিন।। আইনকানুন ও কর্তৃপক্ষ

পিতর ক্রপোৎকিন।। আইনকানুন ও কর্তৃপক্ষ

অনুবাদ: ইস্ক্রা

পিতর ক্রপোতকিন
(১৮৪২-১৯২১)
সূত্র: রবার্ট গ্রাহামের এনার্কিজম ওয়েবলগ

প্রথম অধ্যায়

অজ্ঞতা যখন সমাজে রাজত্ব কায়েম করে এবং মানুষের চিন্তাশক্তিকে বিকল করে ফেলে, তখনই নানান ধরনের আইনের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে। আশা করা হয় আইন প্রণয়ন করলেই সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু, প্রতিটি নয়া আইনই মানুষের মনে একেকটি মিথ্যা আশ্বাস সৃষ্টি করে। এরপর সেগুলো নয়া বিধান প্রয়োগ করে এমনসব দাবী-দাওয়া উত্থাপনের জন্য অবিরত চেষ্টা চালিয়ে যায় যেগুলো হয়তো মানুষ তাদের নিজস্ব জ্ঞান ও নৈতিকতার মাধ্যমেই আদায় করতে পারত। কথাগুলো কোন বিপ্লবী বা সংস্কারকের নয়। কথাগুলো বলেছেন Repertoire de la Legislation নামক ফরাসি আইন সংগ্রহপুস্তকের রচয়িতা, আইনবিদ ড্যালয় (Dalloy)। এই কথাগুলো স্বয়ং একজন আইনস্রষ্টা এবং আইন অনুরাগীর লেখা হলেও, এগুলো  আমাদের সমাজের অস্বাভাবিক অবস্থাকেই সঠিকভাবে প্রকাশ করে।

বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা নয়া আইন প্রণয়নকে সকল অবগতির প্রতিষেধক হিসেবে বিবেচনা করে। খারাপকে সরাসরি পরিবর্তন আবশ্যক। কিন্তু, তার বদলে মানুষ যেন আইনের মাধ্যমেই তার পরিবর্তন করতে চায়। সরু রাস্তা প্রশস্ত করার বদলে লোকে আগে “রাস্তা প্রশস্তকরণ আইন” প্রয়োগ করার কথা ভাবে। কোনো পার্করক্ষীর সঙ্গে ক্রীতদাসের মতো আচরণ করেও যে কেউ ভাবেন “পার্করক্ষীদের আরও বিনয়ী করার জন্য আইন প্রণয়ন জরুরী।” কৃষি বা ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিলেও চাষী বা ব্যবসায়ীদের বলতে শোনা যায় “আমাদের রক্ষা করার জন্য আইন প্রণয়ন করা দরকার।” পুরানো কাপড় বিক্রেতা থেকে শুরু করে এমন কেউ নাই যে তার ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার জন্য আইন প্রণয়নের দাবী করেন না।

কারখানার মালিক মজুরি কমিয়ে কর্মদৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করলো। ব্যস, তৃণমূল পর্যায়ের রাজনীতিকেরা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সিঁধা ও কাযর্কর কোন পন্থা বাতলে দেওয়ার বদলে বলে ওঠেম, “সকল অধিকার রক্ষার জন্য চাই আইন।” সংক্ষেপে, সবকিছুর জন্য সবখানেই আছে আইন! আদব-কেতার জন্য আছে আইন, পাগলা কুকুরের জন্যে আছে আইন, মূল্যবোধ ও নীতির জন্য আছে আইন, সকল প্রকার অনৈতিকতা,কর্ম-অনীহাসহ যাবতীয় অশুভের বিরুদ্ধেও আছে আইন। আমাদের এমনভাবে শিক্ষা দেওয়া হয় যেন বাল্যকাল থেকেই আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করার স্পৃহা মরে যায়। এই শিক্ষা আমাদের কতৃর্পক্ষের প্রতি নমনীয় করে। আইনের এই ছড়ি ঘুরানো চক্র আমাদের বিপথগামী করে। আমাদের জন্ম, শিক্ষা, বিকাশ, ভালবাসা, বন্ধুত্ব সবকিছুই তারা নিয়ন্ত্রণ করে। যদি এই অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে আমরা আমাদের স্বকীয়তা ও স্বপ্রণোদনার অভ্যাসটি হারিয়ে ফেলব। আইনের শাসন মূলত সরকারি প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রণীত এবং একদল শাসকের মাধ্যমে চালিত। এটি সেটি ছাড়াও টিকে থাকা সম্ভব, আমাদের সমাজ বোধহয় এই বিষয়টি বুঝতে অপারগ। এমনকি আমাদের সমাজ যখন এই প্রভাব-বলয় থেকে মুক্তির পথে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিল, সবকিছু নতুন করে গড়ার সম্ভাবনা যখন দেখা দিয়েছিলো, “স্বাধীনতার সেই প্রথম বছরটি” একদিনের বেশী টেকানো যায়নি। স্বাধীনতার ঘোষণার পরদিন সকালেই জনগণ তাদেরকে আইন ও কতৃর্পক্ষের হাতে সঁপে দিয়েছিল।

বস্তুত, হাজার বছর ধরে যারা আমাদের শাসন করে এসেছে তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও শাসকের প্রতি আনুগত্য তৈরির চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই করেনি। এইরকম নৈতিক পরিবেশেই অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের লালন-পালন করেন এবং বিদ্যালয়গুলো শুধুমাত্র উক্ত আনুগত্যপূর্ণ মনোভাব গড়ে তোলাই নিশ্চিত করে। আইনের অবিচ্ছেদ্যতা নিশ্চিত করতে ছলচাতুরীর মাধ্যমে অত্যন্ত সুকৌশলে বিজ্ঞানের সঙ্গে আনুগত্যের অভ্যাসটি মিশিয়ে বাচ্চাদের শেখানো হয়। ফলে, আইনের প্রতি আনুগত্যই তাদের ধর্মে পরিণত হয়। এভাবেই নৈতিক মূল্যবোধের সাথে শাসকদের আইন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ফলে আইন অমরত্ব লাভ করে। স্কুলঘরে ইতিহাসের নায়ক বলে তারাই বিবেচিত হয় যারা আইন মেনে চলে এবং আইনের মাধ্যমে বিদ্রোহীদের দমন করে।

এরপর, আমরা আমাদের ব্যক্তি জীবনে প্রবেশ করি। এখানেও চলে অপপ্রচার। জলকণা যেমন করে লোহাকেও ফুটো করে ফেলে, তেমনিভাবে সমাজ ও সাহিত্য আমাদের দিনের পর দিন, ঘন্টার পর ঘন্টা নানাভাবে প্রভাবিত করতে করতে আনুগত্যের কুসংস্কার রপ্ত করিয়ে ফেলে। ইতিহাস, কূটনীতি, সামাজিক অর্থনীতির বইগুলো আইনের বাধ্যতামুলক আগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গিতে ঠাসা। এমনকি পদার্থবিদ্যা, যা কিনা সম্পূর্ণরূপে পযবের্ক্ষণমূলক জ্ঞান, সেখানেও ধর্মতত্ত্ব ও স্বেচ্ছাচারী দর্শন থেকে ধার করে আনা কৃত্রিম ধারণাগুলোর সাহায্যে আইনের প্রতি বাধ্যতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি সন্নিবেশ করা হয়েছে। এভাবেই নিজ বুদ্ধিমত্তার উপর আস্থা রাখার শক্তিকে সফলভাবে দ্বিধান্বিত করা গেছে।  সবর্দা আইনের আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করা গেছে। সংবাদপত্রগুলো দ্বারাও একই কাজ করানো হয়েছে। যেখানে প্রতিটি খবরের মূল বক্তব্য আইনের অসারতা প্রমাণ করে এবং চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়, কেমন করে এটি শাসকদের সকল প্রকার পঙ্কিলতা ও দূষণ দ্বারা বিকৃত, সেখানেও জোর করেই আইনের স্তুতি প্রচার করা হয়। আইনের দাসত্ব সবসময় ভালো গুণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এমন কোন বিপ্লবী পাওয়া দুষ্কর যিনি তাঁর যৌবনকাল হতেই আইনের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন নাই। অবশ্য, অপব্যবহারই আইনের অনিবার্য পরিণতি।

শিল্পকলাও এই মেকি-বিজ্ঞানের সঙ্গে হাত মেলায়। বিখ্যাত ভাস্কর, পটুয়া, সংগীতজ্ঞগণ আইনকে ঢালরূপে ব্যবহার করেন এবং যারা এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তাদের চোখ-রাঙ্গানি ও উন্নাসিকতা দ্বারা প্রতিহত করেন। আইন বাঁচাতে প্রার্থনালয়গুলো সদা সোচ্চার। বিপ্লবীরাও উচ্চপযার্য়ের যাজকদের গায়ে হাত দিতে সাহস করেন না। এবং, প্রতিটি  বিপ্লবই যখন এইরকম প্রাচীন কিছু প্রতিষ্ঠানকে মুছে ফেলতে উদ্যত হয় তখন আইনই তাদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে এবং তাদের সমস্ত কাজকমর্কে স্বীকৃতি দেয়।

জনগণ যেটিকে আচরণবিধি বা আইন বলে থাকে সেগুলো আসলে দাসত্ব, ভূমিদাসত্ব, সামন্তবাদ এবং রাজতন্ত্রেরই শোষণ। এই শোষণ আমাদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। অসহায় মানুষেরা চিরদিন যাদের বলির শিকার হয়েছে, যাদের অদৃশ্য শক্তির শাস্তির ভয়ে স্পর্শ করতেও ভয় পেয়েছে, যারা সারা জীবন অন্যদের ক্রীতদাসতুল্য মনে করেছে, আইন মূলত তাদেরই প্রতিভূ।

আর্টওয়ার্ক: লিবার্টি লিডিং দ্য পিপিল
শিল্পী: ইউজিন ডেলাক্রইক্স
সূত্র: উইকিআর্ট

ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে, মধ্যবিত্তের হাতে সবোর্চ্চ ক্ষমতা আসা অবধি, আইনের দাসত্ব সফল্যের সহিত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রাচীন শাসনব্যবস্থায় জনগণ আইন সম্পর্কে খুব কমই মতামত ব্যক্ত করতে পারত। যদ্যাবধি মন্টেস্কু, রুশো এবং ভলতেয়ার রাজা-রাজড়াদের খামখেয়ালির বিরোধীতা করেছেন, ততদিন রাজা ও তার চাটুকারদের আবদারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করলে ফাঁসি অথবা কারাদণ্ড একপ্রকার নিশ্চিত ছিল শাস্তি। কিন্তু, বিপ্লবের মধ্যবর্তী ও পরবর্তী সময়ে আইনজীবীগণ ক্ষমতা অর্জন করেন। এবং, তারা পূর্ববর্তী নীতিগুলোকেই আবার শক্ত-পোক্ত করে প্রতিষ্ঠা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। মধ্যবিত্তশ্রেণী শুরুতে এটাকে প্রবল উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। যাজকদের শ্রেণীও বিদ্রোহীদের হাতে ক্ষমতা দখল হওয়ার ভয়ে এটাকে দ্রুত অনুমোদন দিয়েছিল। অতীতের খামখেয়ালি শাসন ও উৎপীড়নের বিপরীতে জনগণ সংস্কার হিসেবেই একে গ্রহণ করেছিল।

এটা বোঝার জন্য অবশ্যই আঠারো শতকের কথা আমাদের কল্পনায় থাকতে হবে। আমরা সেই সময়ের নারী-পুরষদের উপর ক্ষমতাবান উচ্চবংশীয়দের পাশবিকতার কাহিনী শুনে ব্যথিত হই। কিন্তু, সেসব জানার আগে, “আইনের চোখে সবাই সমান, জন্ম বা ভাগ্য নির্বিশেষে সকলেই আইনের প্রতি আস্থাশীল হতে হবে।”- এই কথাগুলো তৎকালীন জনগণের উপর কেমন প্রভাব ফেলেছিল তা জানা প্রয়োজন। যে ব্যক্তি পূর্বে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলে বিবেচিত হত, যার কোনদিন কোন অধিকার ছিল না, যে কোনদিন অভিজাতদের চরম অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার পেত না, বরং, প্রতিহিংসায় পড়ে তাকেই মেরে ফেলা হত বা ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হত – সেও এই আইনব্যবস্থায় নিজ অধিকারের স্বীকৃতি আবিষ্কার করল, অন্ততপক্ষে তত্ত্বীয়ভাবে আবিষ্কার করল – অন্তত প্রভুর সমান ব্যক্তিস্বাধীনতা তারও আছে। এই আইন আর যাই হোক না কেন, অন্তত প্রভু ও ভৃত্যকে সমানচোখে দেখার ওয়াদা করেছিল। এই আইন বিচারপ্রক্রিয়ায় গরিব-ধনীর সমতার কথা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু, সেই প্রতিশ্রুতি ছিলো মিথ্যা; এবং, আজ তা আমাদের কাছে স্পষ্ট। যেহেতু, স্বীকৃতিই ভণ্ডামির নিদারুণ স্বরূপ, তাই সেই সময়ে এটা ছিল অত্যন্ত অগ্রসরমান, ন্যায়বিচারের প্রতি স্বীকৃতির সনদ স্বরূপ। এই কারণে হুমকির মুখে পড়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রক্ষাকর্তারা (The Robespierres and the Dantons) রুশো এবং ভলতেয়ারদের অনুসরণে কলম ধরেন এবং ঘোষণা করেন, “সকলকেই আইনের প্রতি সমান শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে।” চালিকাশক্তি ইতিমধ্যেই ক্রমবর্ধমান অপর একদল শত্রুর সাথে মোকাবেলা করতে বাধ্য হওয়ায় উপরোক্ত বক্তব্যের সঙ্গে তারা আপস করেছিল। পুনরায় প্রভুদের খামখেয়ালি শাসনের হাত থেকে বাঁচতেই আইনের প্রতি তারা মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল।

মধ্যবিত্ত শ্রেণীও একই পথে হাঁটতে শুরু করে যা ঊনিশ শতকে বুর্জোয়া দর্শন নামের দর্শনের উন্মেষ ঘটায়। তারা তাদের মতবাদকে স্কুলে প্রচার করেছে, তাদের লেখনীতে উপজীব্য করে। এই উদ্দেশ্যে তারা নিজস্ব শিল্পকলা ও বিজ্ঞান সৃষ্টি করে যাতে করে তাদের দর্শনটি বিকশিত হয়ে ওঠে। এই সবকিছুই তারা অত্যন্ত সফলভাবে করতে পেরেছিল বলেই ঘৃণ্য এই বাস্তবতা আজ আমাদের সামনে। প্রভুদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও সমালোচনার বদলে আমরা দেখতে পাই, পূর্বের স্বাধীনতাকামী জনগণও প্রভুদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে। তারা দয়া কামনা করছে এবং প্রভুদের আইনকেই বিকশিত করে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করিয়ে নিচ্ছে!

কিন্তু, একশ বছরে সময় এবং পরিস্থিতি বদলে গেছে। কোন আইনের উৎপত্তি, প্রয়োগ, ব্যাপ্তি সম্পর্কে না জেনেই সেটি মানতে নারাজ এমন বিদ্রোহীরা এখন সর্বত্রই আছেন। আমাদের যুগের বিদ্রোহীরা সমাজের অত্যন্ত মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে সমালোচনা করছেন, যেগুলো এযাবৎকাল ধরে অলঙ্ঘনীয় বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে। এই সমালোচনায় আইন নামক সেই প্রতীমাটিও আছে। এই কারণে চলমান এই পরিবর্তনগুলোকে আর বিদ্রোহ বলা যায় না, এগুলো হলো বিপ্লব।

সমালোচকেরা আইনকে বিশ্লেষণ করেছেন। এবং সেখানে স্রষ্টা, সন্ত্রাস, নির্বোধ যাজকদের অলৌকিক সত্তার প্রতি নির্লজ্জ্ব সমর্থন, রক্তপাত, জবরদখল ছাড়া আর কিছুই পাননি। তারা আইনের বৈশিষ্ট্যাবলী বিশ্লেষণ করেছেন। সেখানেও তারা মানবজাতির চিরস্থায়ী অগ্রগতির বদলে তাদের স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য বিকাশে বাধা এবং সময়ের সাথে সাথে কোন বিশেষ বস্তুটির উন্নয়ন হবে তা নির্ধারণ করার এক গূঢ় ষড়যন্ত্র খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা প্রশ্ন করেছেন, আইনকে তখন কিভাবে প্রয়োগ করা হতো? এর উত্তরে তারা দেখেছেন বাইজেনটাইনিজমের বর্বরতা, তদন্তের নামে নিষ্ঠুরতা, মধ্যযুগীয় অত্যাচার, জল্লাদদের কষাঘাতে শরীরের মাংস খসে যাওয়া, শেকল, চাবুক, কুঠার, জেলখানার অন্ধকূপ, নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা, অভিশাপ এবং অশ্রু। এখনও আমরা আগের মতোই কুঠার, ধাতব তার, রাইফেল, জেলখানা; অপরদিকে, নির্যাতিত কয়েদী, পশুর মতো খাঁচায় বন্দীর সমস্ত আশা নিংড়ে বের করে আনা জীর্ণ দেহ, মানবপ্রকৃতির সকল বৈশিষ্ট্য বর্জিত বিচারক, আইন নামক গল্পের অবাস্তব জগত, মৃত্যু এবং নির্যাতনের বিকট উল্লাস, বিচারবহিভূর্ত ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞের পাগলামী, সর্বোপরি মানবজাতির অতলস্পর্শী অবনতিই দেখতে পাই। এবং, এইসব দোষে আইনপ্রণেতারা পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন।

সমালোচকেরা এমন আইন-প্রণেতাদের হদিশ পান যারা নিজেরাও জানেন না তাদের আইনটির বক্তব্য কী। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কিত বিন্দুমাত্র ধারণা হয়তো তাদের নেই। অথচ, তারাই শহরের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে আইন প্রণয়ন করেছে। অস্ত্র সম্পর্কে না জেনেই তারা অস্ত্র আইন তৈরি করেছে। শিক্ষাদান সম্পর্কে না জেনেই তৈরি করেছে শিক্ষা-বিষয়ক আইন। উল্টাপাল্টা আইন তারা প্রণয়ন করেছে ঠিকই, কিন্তু, মজলুম, কয়েদী বা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের শাস্তি বিধানের বেলায় কখনো কম যায়নি। অথচ, যাদের তারা শাস্তি দিয়েছে তারাও মানব সমাজেরই অংশ এবং আইন প্রণেতাদের চেয়ে সবসময়েই হাজারগুণে বেশী নীতিবোধসম্পন্ন।

সবশেষে, সমালোচকেরা দেখতে পান, সেকালের কারারক্ষীরা সকল মানবিক অনুভূতি বিবর্জিত। গুপ্তচরকে রক্তপাতের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এমন নজিরও মেলে হয়তো পুলিশের গুপ্তচরই তার কৃতকর্মের জন্য ঘৃণাবোধ করেছে। নৈতিকতার অধঃপতন, দুর্নীতি, যান্ত্রিকতা, মানবজাতির সকল অসৎ গুণাবলী আইনের বিজয় নিশ্চিত করতে নৈতিক সমর্থন দিয়েছে।

এসবই আমরা খুঁজে পেয়েছি। পুরানো সূত্র “আইনকে সম্মান করুন” এর পুনরাবৃত্তি আমরা আর করব না। বরং, আমরা বলব “আইন এবং তার সকল বৈশিষ্ট্যকে ঘৃণা করুন।” দাসত্বের বাক্য “আইনকে মান্য করো” না বলে আমরা বলব, “সকল আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করুন!”

আইনের নামে যত অপকর্ম ও হিতকর্ম হয়েছে সেসব শুধুমাত্র তুলনা করুন। ভালো ও মন্দকে সাবধানে ওজন করুন, দেখবেন আমরাই সঠিক।

দ্বিতীয় অধ্যায়

কালের হিসাবে, আইন নয়া জামানার একটি পণ্য। যুগ যুগ ধরে মানবজাতি কোন প্রকার লিখিত আইন ছাড়াই জীবনযাপন করেছে। এখনও প্রাচীন মন্দিরের প্রবেশদ্বারে, মন্দিগাত্রের পাথরের গায়েও তার সঙ্কেত রয়ে গেছে। সেই সময়ে মানুষের মধ্যকার সম্পর্কগুলো প্রথা, অভ্যাস এবং প্রচলিত রীতির (Usage) উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হতো। ক্রমাগত চর্চার মাধ্যমে সেগুলো ক্রমে বিশুদ্ধ হয়ে উঠত। শিকার করা, পশুপালন করা অথবা কৃষিকাজের মতো বিষয়গুলো শেখার মতো করেই মানুষ শৈশবেই সেইসব রীতিনীতি শিখে ফেলত।

প্রতিটি সমাজই এই প্রাচীন দশার মধ্য দিয়েই গিয়েছে এবং এখনও মানবজাতির একটা বড় অংশের কোনো লিখিত আইন নাই। রাশিয়া, ইতালি, স্পেন এমনকি ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের বৃহদাংশের বাসিন্দাদের মধ্যে লিখিত আইনের কোনো ধারণাই নাই। আইনবিদেরা বলে থাকেন, প্রতিটি গোষ্ঠীরই তাদের নিজস্ব রীতিনীতি ও প্রথা আছে এবং প্রথালব্ধ আইনও আছে। এসব গোষ্ঠীর নিজস্ব সামাজিক আচার-আচরণ আছে, যেগুলোর মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী গ্রাম এবং সম্প্রদায়ের লোকজনের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে। এমনকি আমাদের “সভ্য” রাষ্ট্রগুলোতেও, বড় বড় শহরে ছেড়ে পল্লী অঞ্চলে গেলে দেখতে পাই যে, সেখানকার বাসিন্দাদের পারস্পরিক সম্পর্কগুলো কর্তৃপক্ষের লিখিত আইন দ্বারা নয়, বরং প্রাচীন ও সর্বজন স্বীকৃত প্রথাসমূহের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। বিধিবদ্ধ আইনগুলো কেবলমাত্র তাদের এবং রাষ্ট্রের মাঝে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কাজ করছে। তাদের পারস্পরিক সম্পর্কগুলো কখনো কখনো খুব জটিল হলেও সেগুলো কেবলমাত্র প্রাচীন প্রথা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।

প্রাচীন মানুষদের আচার-ব্যবহার বিশ্লেষণ করে প্রথার দুটি স্বতন্ত্র ধারার কথা জানতে পারা যায়।

যেহেতু মানুষ একাকী বাস করে না, তাই অভ্যাস এবং অনুভূতির যে বিকাশ তার ভিতরে ঘটে সেগুলো সমাজ সংরক্ষণ এবং স্বজাতির টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সমাজ সম্পর্কিত এইসব অনুভূতি এবং প্রথা না থাকলে জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে যেত। এইসব প্রথা আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এগুলো আইনের চেয়েও পুরোনো। এমনকি ধর্মও এইসব নির্ধারণ করেনি, এগুলো যেকোনো ধর্মের চেয়েও পুরোনো। সমাজে বসবাসরত প্রায় সকল জীবিত প্রাণীদের মাঝেই এগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায়। এগুলো বস্তুর প্রকৃতি হতে স্বতঃস্ফুর্তভাবে উৎসারিত হয়ে থাকে, যেমন, বিভিন্ন প্রাণীর স্বভাব, যেগুলোকে আমরা সহজাত প্রবৃত্তি বলি। এরপর  বিবর্তনের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়। এগুলো শুধু তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণই নয় বরং, নানান প্রতিকূলতার মাঝে সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেও অপরিহার্য।

বর্বর মানুষ তখনই একে অপরকে ভক্ষণ করা ছেড়েছিলো যখন তারা বুঝলো যে, বছরে একবার নিজ বয়সী স্বজাতির মাংস খেয়ে উৎসব করার চেয়ে কৃষিকাজে নিয়োজিত হওয়াটা অধিকতর লাভজনক। বহু পর্যটক এমন অনেক স্বাধীন গোষ্ঠীর আচার-ব্যবহারের কথা বর্ণনা করেছেন যেখানে আইনকানুন ও কর্তৃপক্ষের ধারণা অজ্ঞাত হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে কোনো হানাহানির ইতিহাস নাই। কারণ, সেইসব সমাজে বসবাসের অভ্যাসটি ভ্রাতৃত্ব ও স্বার্থের অখণ্ডতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল এবং তারা বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য তৃতীয় ব্যক্তির স্মরণাপন্ন হতেন। আতিথেয়তা, মানবজীবনের মূল্য, পারস্পরিক দায়িত্ববোধ, দুর্বলের প্রতি সহানুভূতি, সাহস, এমনকি আত্মোৎসর্গের ধারণা – প্রাচীন সামাজিক মানুষদের মাঝে বিকশিত হয়েছিল। এই গুণগুলো মূলত তাদের সন্তানাদি এবং বন্ধুদের স্বার্থেই উদ্ভূত হয়েছিলো এবং এগুলো যেকোনো লিখিত আইনকানুন এবং ধর্মের চেয়েও অনেক পুরোনো। এইসব অনুভূতি এবং আচার-ব্যবহার চর্চার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হলো সামাজিক জীবন। যাজক বা দার্শনিক না হয়েও বলা যায় এইসব গুণাবলী মানুষের সহজাত এবং এগুলো আসলে যূথবদ্ধ জীবনেরই ফল।

কিন্তু এইসব প্রথার পাশাপাশি সমাজ ও স্বজাতির সংরক্ষণের জন্য অপরিহার্য অন্যান্য প্রবৃত্তিরও বিকাশ ঘটেছিল। সেইসাথে আবেগের বিকাশের মাধ্যমে বিবিধ অভ্যাস ও প্রথার বিকাশও মানব সম্প্রদায়ে ঘটেছিল। অন্যের উপর কর্তৃত্ব এবং স্বেচ্ছাচারিতার ইচ্ছা, প্রতিবেশী গোষ্ঠীর শ্রমার্জিত পণ্য হাতিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা, বিনাশ্রমে ভোগবিলাসিতার ইচ্ছা, দাসদাসীদের দিয়ে সকল প্রকার বাসনা ও বিলাসিতা পূরণের ইচ্ছা – এ ধরণের আত্মকেন্দ্রীক, ব্যক্তিগত ইচ্ছা অপর এক ধারার প্রথার জন্ম দেয়। যাজক এবং যোদ্ধারা ছিলো  বুজরুকের দল। এরা অন্ধবিশ্বাস ছড়িয়ে স্বার্থসিদ্ধি করত এবং অপরের ক্ষতির কথা বিবেচনা না করেই সবার মধ্যে অন্ধবিশ্বাস ছড়াত। যুদ্ধবাজ, লুটেরা শাসকদের সঙ্গে এই দুই শ্রেণী হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করত। এরা এদের অনুকূলের প্রথাসমূহ প্রাচীন সমাজের উপর চাপিয়ে দিয়ে জনগণের উপর আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। বিনাশ্রমে লভ্যাংশ অর্জন, ভীতিপ্রদর্শন, মানুষের মূঢ়তার কল্যাণে তারা তাদের প্রথাসমূহকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিল। ফলে, তাদের কর্তৃত্বের শক্ত ভিত্তি তৈরি হয়েছিল।

এই স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রথমত তারা মানবজাতির মূঢ়তাকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করত। শিশু এবং বন্যদের মাঝে এই লক্ষণ অধিক অনুপাতে আছে এবং এই প্রবণতা পশুদের মাঝেও দেখা যায়। মানুষ যখন অন্ধবিশ্বাসে নিমজ্জিত থাকে তখন সে তার বিদ্যমান পরিস্থি্তির সামান্যতম পরিবর্তনেও ভয় পায় এবং সাধারণত প্রাচীনের পূজারী হয়। নবীনেরা কোনোকিছুর পরিবর্তন ঘটাতে চাইলেই প্রবীণেরা বলেন, “আমাদের পূর্বপুরুষেরাও এটাই করেছেন; তারা বেশ ভালোভাবেই জীবন অতিবাহিত করেছেন; তারা আমাদের প্রতিপালন করেছেন; তারা অসুখী ছিলেন না; সুতরাং তুমিও একই কাজ করো!” অচেনা যেকোনো কিছুকেই তারা ভয় পায়, এমনকি অতীত যদি দারিদ্রপূর্ণ, উৎপীড়নমূলক এবং দাসত্বপূর্ণও হয়ে থাকে তবুও তারা অতীতের নজিরকেই আঁকড়ে ধরতে চায়। একথা-ও বলা যেতে পারে যে, মানুষ যতোই দুর্দশাগ্রস্ত হয় ততোই সে সব ধরনের পরিবর্তনকে ভয় পায়, পাছে তা তাকে আরো দুর্গত করে তোলে। নতুন কিছু শুরু করার আগে, জীবনযাপনের পুরানো পদ্ধতির সমালোচনা করার আগে সে জীবনে কিছু আরাম-আয়েশ করে নিতে চায়। পরিবর্তনের বিপদজনক পথে পা বাড়াবার আগে সে কিছুটা আশা সঞ্চয় করতে চায়। যতদিন না সে আশায় উজ্জীবিত হতে পারে, নিয়ত অন্ধবিশ্বাস আর জুজুর ভয় দেখানো প্রতিপালকদের হাত থেকে যতদিন না সে মুক্ত হতে পারে,  ততদিন সে তার পুরোনো অবস্থানে থাকাটাই শ্রেয় মনে করে। যদি নবীনেরা কোনো পরিবর্তন করতে চায়, প্রবীনেরা তাদের বিরুদ্ধে মরাকান্না জুড়ে দেন। কিছু গোঁড়া লোকজন নিজ দেশের প্রথাকে ধরে রাখার জন্য জীবন পর্যন্ত দিয়ে দেন, কারণ তাদেরকে ছোটকাল থেকেই শেখানো হয়েছে যে প্রথার সামান্য ব্যত্যয় ঘটলেই পুরো সম্প্রদায় ধ্বংস হয়ে যাবে। এমনকি আজকের দিনেও বেশীরভাগ রাজনীতিক, অর্থনীতিক এবং নয়া-বিপ্লবীরাও একইরকম মনে করেন। তারাও বিলীয়মান অতীত আঁকড়ে বসে থাকেন। তাদের বেশীরভাগই  কেবল অতীত নজির নিয়ে চিন্তা করেন। বেশীরভাগ তেজস্বী উদ্ভাবকই স্রেফ অতীতের বিপ্লবের অনুসরণকারী।

কুসংস্কার, শ্রমবিমুখতা এবং ভীরুতা থেকে উৎসারিত হয় নিয়মানুবর্তীতা। আর এটিই নিপীড়নের প্রধান অবলম্বন। প্রাচীন সমাজে যাজক এবং সেনাপ্রধানেরা অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে এগুলো নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করত। তারা প্রথাগুলোকে তাদের সুবিধা অনুযায়ী পুরো সম্প্রদায়ের উপর চিরস্থায়ীভাবে চাপিয়ে দিতো। কারণ, যতদিন পর্যন্ত এই ধরনের রক্ষণশীল মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে শোষণ করা যাবে ততদিন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর অনধিকারচর্চা চালাতে পারবে। যতদিন পর্যন্ত কেবলমাত্র প্রাকৃতিক কারণে মানুষের মধ্যে বৈষম্য ছিলো এবং ক্ষমতা ও সম্পদের কেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে বৈষম্যবৃদ্ধি করা যায়নি ততদিন পর্যন্ত কোনো আইনকানুন অথবা ভয়ংকর রূপধারী বিচারালয় এবং বিতর্কিত দণ্ডবিধি প্রয়োগের কোনো প্রয়োজনই ছিলো না।

আর্টওয়ার্ক: দ্য ট্রায়াল অব স্ট্রাফোর্ড
শিল্পী: থমাস আলফ্রেড উলনথ
সূত্র: ইউকে পার্লামেন্ট

আইনকে যদি কেবলমাত্র শাসকদের কার্যোপযোগী করেই উপস্থাপন করা হতো তাহলে তার গ্রহণযোগ্যতা আর আনুগত্য অর্জনে অসুবিধা হতো। তাই আইন প্রণয়নকারীরা একই আইনে প্রথার দুই ধরনের ধারাই রেখেছিলো। এদের মধ্যে একটি ধারা হলো নৈতিকতা, সামাজিক ঐক্য ইত্যাদি। এগুলো সকলের মধ্যেই সহজাত। আর অপর ধারাটি হলো হুকুম। এগুলো মূলত বৈষম্যকে চিরস্থায়ী রূপ দিতে প্রণীত হয়। প্রথা অবশ্যই সমাজের টিকে থাকার জন্য জরুরী। কিন্তু শাসকশ্রেণীর মর্জিমতো আইনের ভিতরে সেগুলোকে চাতুর্যের সাথে মেশানো হয়েছে। এরপর নীতি ও হুকুম উভয়ের জন্যই মানুষের কাছ থেকে সমান আনুগত্য দাবী করা হয়েছে। আইন বলে “হত্যা কোরো না” এবং সাথে সাথে জুড়ে দেয় “এবং যাজককে খাজনার অংশ দাও”, আইন বলে “চুরি কোরো না” এবং এরপরেই জুড়ে দেয় “যারা খাজনা দিতে অস্বীকার করবে তাদের হাত কেটে নেওয়া হবে।”

প্রতিটি আইনের বৈশিষ্ট্যই এমন। এবং, আজও এর দুমুখী চরিত্রকে রক্ষা করা হচ্ছে। স্রেফ শাসকশ্রেণীর স্বার্থোদ্ধারের জন্য সৃষ্ট প্রথাসমূহ প্রয়োগের ইচ্ছা থেকেই এর উৎপত্তি। এর বৈশিষ্ট্যই হলো, বিভিন্ন সামাজিক প্রথা পালনের জন্য অপ্রয়োজনীয় নিয়মের সঙ্গে মানুষের জন্য ক্ষতিকর প্রথাকে মেশানো। শাসকশ্রেণীর স্বার্থোদ্ধারের উপযোগী যেসব প্রথা রয়েছে সেগুলোকে সামাজিক প্রথার সঙ্গে সংমিশ্রণ করাই এর কাজ। কর্তৃত্ব খাটিয়ে, জবরদস্তি করে, জালিয়াতি করে অর্জন করতে হয় পুঁজি। এইরকম পুঁজি যেমন মানুষকে বিন্দুমাত্র দাম দেয় না তেমনি, এইরকম আইনও মানুষকে মূল্যায়ন করতে পারে না। জবরদস্তি আর কুসংস্কার ছড়িয়েই যার জন্ম এবং ভোক্তা, যাজক আর ধনী শোষকশ্রেণীর স্বার্থোদ্ধারই যার ভিত্তি, তাকে আক্ষরিক অর্থেই শৃঙ্খলা ভঙ্গের মাধ্যমেই ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এ সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হওয়া যাবে যখন আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে ধর্ম, কর্তৃপক্ষ এবং বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থায় আইনের প্রছন্ন মদদ সম্পর্কে জানব।

তৃতীয় অধ্যায়
আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি প্রতিষ্ঠিত আচার ও প্রথার মাধ্যমে কেমন করে আইনের উৎপত্তি ঘটেছিল। আমরা আরও দেখেছি, শুরু থেকেই শাসকেরা ছলে-বলে, কৌশলে অপরিহার্য সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে ক্ষতিকর ও স্বার্থান্বেষী প্রথাগুলোকে কেমন করে অন্যান্য প্রথার সঙ্গে সংমিশ্রণ করেছিল। পরবর্তীতে রাজনৈতিক সংগঠনের বিকাশের সাথে সাথে আইনের এই দ্বিমুখী চরিত্র আরও প্রকট হয়ে ওঠে। যতদিন পর্যন্ত না সামাজিক প্রথার একেবারে কেন্দ্রে আইন অনুপ্রবেশ করতে পেরেছে, ততদিন নিপীড়িত শ্রেণীর ক্ষতি করে সময়ের সাথে সাথে পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের মাধ্যমে বারবার আইন প্রণীত হয়েছে। প্রভাবশালী শ্রেণীর নির্দেশনায় এসব আইন প্রণীত হয়েছে। বঞ্চিতদের যে যৎসামান্য অধিকার সমাজে নিশ্চিত ছিলো সেগুলোও প্রভাবশালী শ্রেণী সময়ে সময়ে নতুন আইনের মাধ্যমে টেনে টেনে বের করে ফেলে দিয়েছে। এরপর শাসকশ্রেণীর সুবিধার জন্য তৈরি আইনের দ্বারা পুরোনো আইনকে রদ করেছে।বাক্‌লের (Buckle) মতে, “সেগুলোই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ আইন, যেগুলো পূর্ববর্তী আইনকে রদ করেছে।” মানুষকে আইনের এই শেকলে বাঁধতে গিয়ে প্রতিবার কত দুর্দান্ত প্রচেষ্টাই না করতে হয়েছে, এজন্য কত নদী রক্তই না বয়েছে! পৃথিবী থেকে ভূমিদাসত্ব আর সামন্ততন্ত্র নিশ্চিহ্ন করতে, রাজকীয় বিচারালয়ের ক্ষমতা গুঁড়িয়ে দিতে ফ্রান্সকে চার বছর ধরে বিপ্লব এবং বিশ বছর ধরে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। অতীতে চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় আইনের সামান্য অংশ রদ করতেও আমাদের কয়েক দশক লেগে গিয়েছিল, এমনকি বিপ্লবের মাধ্যমেও সেগুলোকে রদ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

পুঁজির উদ্ভবের ইতিহাস সমাজতান্ত্রিকেরা ইতোমধ্যেই বহুবার বলেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন কেমন করে যুদ্ধ, লুণ্ঠন, দাসত্ব, ভূমিদাসত্ব, জালিয়াতি এবং শোষণের মাধ্যমে এর উদ্ভব হয়েছে। তাঁরা আরও দেখিয়েছেন কিভাবে শ্রমিকের রক্তের বিনিময়ে এটি পরিপুষ্ট হয়েছে এবং কেমন করে তিলেতিলে এটা পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। আইনের উদ্ভবের ইতিহাসের একই ধরনের গল্প আছে। এই গল্পটিই বলা এখনো বাকি আছে। যথারীতি, মানুষের মস্তিষ্কেও আইনকে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। এই ইতিহাস ইতিমধ্যেই তার দর্শনকে একত্র করেছে ফেলেছে এবং একের পর এক মাইলফলক পুঁতে চলেছে।

পুঁজির মতো আইনও লুণ্ঠন, দাসত্ব ও শোষণের ক্ষেত্রে একই ধরনের বুলি আওড়িয়েছে; যমজ ভাই-বোনের মত তারা হাতে হাত মিলিয়ে মানবজাতির উপর প্রভাব বিস্তার করেছে।  ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশেরই ইতিহাস একইরকম। খুব গভীরে পর্যালোচনা করলে হয়তো কিছু অমিল পাওয়া যাবে কিন্তু মূল কারণগুলো একই। এবং ফ্রান্স এবং জার্মানিতে আইনের বিকাশের বিভিন্ন পর্যায় জানার মাধ্যমেই ইউরোপের অন্যান্য দেশের আইনের বিকাশ সম্পর্কে জানা সম্ভব।

প্রথমত, আইন ছিলো একজাতীয় চুক্তি। যদিও পরবর্তীতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হস্তক্ষেপে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনের মাধ্যমে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছিল। তৎসত্ত্বেও এগুলো ছিলো বস্তুত সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে Champs de Mars এর লোকেদের চুক্তি। সুইডেনের বিভিন্ন প্রদেশের ফিল্ড অফ মে’তে (Field of May) সেই সময়ের ধ্বংসাবশেষ আজও সংরক্ষিত আছে। এটা সত্য যে, এই চুক্তিগুলো সবসময়ই অবাধে গৃহীত হতো না। এমনকি সেই প্রাচীন সময়েও ধনী এবং শক্তিশালী শ্রেণী তাদের ইচ্ছাকে বাদবাদিকেদের উপর চাপিয়ে দিত। কিন্তু প্রতিবারই আক্রমণ করতে গিয়ে তারা জনগণের বাধার সম্মুখীন হতো এবং জনগণ তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে বুঝিয় দিতো।

কিন্তু, একদিক থেকে চার্চ এবং অপরদিক থেকে উচ্চপদস্থরা মিলে তাদেরকে কব্জা করতে সমর্থ হয়েছিল। ফলে, আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেশবাসীর কাছ থেকে হাতছাড়া হয়ে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত লোকজনের কাছে চলে গিয়েছিল। লুকিয়ে রাখা ধনসম্পদকে কাজে লাগিয়ে চার্চ তার কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করেছিল, মানুষের ব্যক্তিজীবনে আরও বেশী অনুপ্রবেশ করেছিল, এবং স্বর্গে রক্ষা করার প্ররোচনা দিয়ে চার্চ তার ভৃত্যদের দিয়ে খাটিয়ে নিতো। চার্চ প্রতিটা শ্রেণীর কাছ থেকেই কর আদায় করতো। এরা নিজেদের বিচারিক এখতিয়ার বৃদ্ধি করেছিল, দণ্ডকে দ্বিগুণ করেছিল এবং নিজেকে এমনভাবে সমৃদ্ধ করেছিল যাতে প্রতিটা অপরাধের জন্যই তার কাছে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। এতে করে আইনের সাথে মানুষের আর কোনো সংযোগ রইলো না। ফরাসি আইনের একজন ইতিহাসবিদ মন্তব্য করেছেন “(তখন) আইন, আইনপ্রণেতাদের দ্বারা প্রণীত না হয়ে বরং ধর্মান্ধ কাউন্সিলের দ্বারা প্রণীত হত।”

সেই সময় একইভাবে, ব্যারনদেরও (Baron) মাঠের শ্রমিক এবং শহরের আর্টিজেনদের (Artisan) উপর কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল। তারাও আইনপ্রণেতা এবং বিচারক বনে গিয়েছিল। দশ শতকের রাষ্ট্রীয় আইনগুলো নিছকই সেবা, শ্রম এবং রাজস্ব সংক্রান্ত আইনের ধ্বংসাবশেষ। সেই সময়ের আইনপ্রণেতারা ছিলেন ডাকাতের মতো। এদের কাজই ছিল কৃষিজীবীদের কাঠ থেকে লুঠতরাজ চালানো। এই ডাকাতেরা সহজাত ন্যায়বিচারের ধারনাটিকে নিজেদের কাজে লাগিয়েছিল। তারা নিজেদের সেই ন্যায়বিচারক হিসেবে জাহির করত। ন্যায়বিচারের মূলমন্ত্রটাকে এরা নিজেদের কামাইয়ের রাস্তায় পরিণত করেছিল এবং মিথ্যা আইন সাজিয়ে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল।

পরবর্তীতে এই আইনগুলোকেই আইনজ্ঞরা সংগ্রহ এবং বিন্যস্ত করে আধুনিক বিধানের গোড়াপত্তন করেছিল। ব্যারন এবং যাজকদের থেকে আগত এইসব বিধানকে কি আমরা মান্য করব?

প্রথম বিপ্লব, নগররাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমে এইসব আইনের একাংশ রদ করতে সমর্থ হয়েছিল। মুক্ত শহরের সনদগুলোর বেশীরভাগ অংশই ছিলো নিছক ব্যারন শাসিত এবং বিশপ শাসিত আইনের মধ্যকার আপোষ। যদিও এর ফলে মুক্ত শহরগুলোর মধ্যে নতুন সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। তবুও এই আইনগুলোর সাথে আমাদের বর্তমান আইনগুলোর কী এমন পার্থক্য আছে! ওইসব শহরে তখনও রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষার জন্য কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড তুলে নেওয়া হয়নি। যে ব্যক্তিই শত্রু শহরের সঙ্গে যোগাযোগ করতো তাকেই বিতাড়িত করা হত এবং ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হত। তথাকথিত “অপরাধ এবং অপকর্মের” জন্য জরিমানা আদায়ই ছিলো মুখ্য বিষয়। দ্বাদশ শতকের নগররাষ্ট্রগুলোর বিচারব্যবস্থা হয়তো এখন বিস্মৃত। কিন্তু এগুলো এমন বিচারের নীতিতে চলত, যেখানে যোকোনো সদস্যের ভুলের জন্য পুরো সম্প্রদায়কে দায়ী করা হতো। তৎকালীন সমাজ অপরাধকে দুর্ঘটনা বা দুর্ভাগ্য বলে বিবেচনা করত। এই ধারণাটি বর্তমানে রুশ শ্রমজীবিদের মধ্যেও বিদ্যমান। কাজেই, বাইবেলে যেমনটা বলা হয়েছে তেমনিভাবেই তারা ব্যক্তিগত সহিংসতার ধারণাটিকে স্বীকার করতো না। বরং, তারা ভাবতো যে, প্রতিটা ভুলের দায় পুরো সমাজের উপরেই বর্তায়। গল (Gauls) এবং জার্মানদের (German)  মৃত্যুদণ্ড ও নির্যাতনের বিভিন্ন উপায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পশ্চিমে প্রাচ্যের স্বেচ্ছাচারীতার আমদানীকারক বাইজেন্টাইন চার্চের (Byzantine Church) সকল উপাদান সন্নিবেশিত করা হয়েছিল। একইভাবে সামাজিক প্রথাগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে জমির উপর চিরস্থায়ী মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে এতে রোমান সাম্রাজ্যের সৃষ্ট রোমান আইনগুলোও (Roman Code) সন্নিবেশিত করা হয়েছিল।

আমরা জানি, স্বাধীন নগররাষ্ট্রগুলো তাদের স্বাধীনতা ধরে রাখতে পারেনি। ধনী ও গরীবের, জনগণ ও ভূমিদাসের চিরায়ত বৈষম্যের কারণে তারা রাজপক্ষের সহজ শিকারে পরিণত হয়েছিল। যেহেতু রাজপক্ষের দরকার নতুন শক্তি, তাই আইনপ্রণয়ের ক্ষমতা তারা অনুগ্রহপুষ্ট সভাসদ গোষ্ঠীর  উপরে ন্যস্ত করেছিলেন। শুধুমাত্র রাজার দাবীকৃত খাজনার বিরুদ্ধেই আপীল করার সুযোগ ছিলো। কোর্ট মর্জি আর খেয়ালখুশীমতো সংসদকে যেন দুই শতাব্দীতে একবার তলব করতো। প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত মন্ত্রীসভা “কাউন্সিলস এক্সট্রাঅর্ডিনারি (Coucils Extraodinary)” কদাচিৎ রাজার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রতি মনোযোগ দিত। এমনই ছিলো ফ্রান্সের আইনপ্রণেতাদের অবস্থা। পরবর্তীতে যখন সকল ক্ষমতা একজন ব্যক্তির উপরে ন্যস্ত হল, তখন তিনিই নিজেকে “রাষ্ট্র” দাবী করে বসলেন। তিনিই তার মন্ত্রীদের মাধ্যমে বা তার হুজুগে “সিক্রেট কাউন্সিল অফ দ্য প্রিন্স” এর নামে মিছেমিছি উদ্ভট ফরমান জারি করতেন। এগুলো অমান্য করার শাস্তি ছিলো যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। জনগণের জন্য সবধরনের বিচার বিভাগীয় নিশ্চয়তা রহিত হয়েছিল। পুরো জাতি রাজা ও তার পারিষদদের ভূমিদাসে পরিণত হয়েছিল। এইসময়ের ভয়ংকরতম দণ্ডবিধিগুলো – দ্য হুইল (The Wheel), দ্য স্টেক (The Stake), জীবন্তাবস্থায় চামড়া উৎপাটন ইত্যাদি আজ চমকে দেওয়ার মতো ভয়ংকর। পাগলা যাজক এবং রাজাদের আবিষ্কৃত নির্যাতনের সকল উপায় প্রয়োগ করে অপরাধীদের নির্মম কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে রাজারা আনন্দ উপভোগ করত।

মহান বিপ্লব (ফরাসি বিপ্লব) সামন্তবাদ ও রাজা-রাজড়াদের চাপিয়ে দেওয়া আইনের এই কাঠামোকে ভাঙতে শুরু করে। কিন্তু কিছুদূর ভাঙার পরেই বিপ্লব আইনপ্রণয়ের ক্ষমতা বুর্জোয়াদের হাতে হস্তান্তর করে। এরা তখন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কর্তৃত্ব সুংসহত করার জন্য নতুন আইন কাঠামো প্রস্তুত করে। তাদের সংসদ অতি দ্রুততার সঙ্গে আইনের এক পাহাড় গড়ে তোলে। কিন্তু এইসব আইনের মূলভিত্তি কী ছিল?

এর বৃহদাংশের একটিইমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো, আর তা হলো ব্যক্তিগত সম্পতি অর্জন। যেমন: শোষণের মাধ্যমে অর্জিত সম্পত্তি রক্ষা করা। তাদের উদ্দেশ্যই ছিলো শোষণের এক নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করা এবং পুঁজিবাদের মাধ্যমে মানবকল্যাণমূলক বিভিন্ন কাজ যেমন, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ, বিদ্যুতিক বাতি, রাসায়নিক শিল্প, সাহিত্যচর্চা এবং বিজ্ঞান ইত্যাদির লোক দেখানো উন্নয়ন ঘটিয়ে শোষণকে সুসংহত করা। এই আইনগুলোর মৌলিক উদ্দেশ্য মোটামুটি একইরকম ছিলো। সেগুলো রাষ্ট্রযন্ত্রকে, যা মূলত পুঁজির শোষণ এবং সম্পদের একচেটিয়া অধিকারকে নিশ্চিত করে, টিকিয়ে রাখার জন্যই প্রণীত হয়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, সেনাবাহিনী, প্রশাসন, অর্থনীতি সকলেই এক ঈশ্বরকে পূজা করত, আর তা হলো পুঁজি। সবকিছুর একটাই উদ্দেশ্য ছিলো – পুঁজিপতিদেরকে শ্রমিকদের অধিকার হরণ করার সুযোগ করে দেওয়া। বিগত আশি বছরের আইনগুলোকে বিশ্লেষণ করলে এইসব ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না। অদৃশ্য সত্তারূপে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া মূলত আইনের সত্যিকার লক্ষ্য, যাতে সমাজ থেকে ঘৃণা ও বর্বরতার অবসান হয়। বর্তমানে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার তুলনায় রাষ্ট্রীয় অপহরণের স্বীকার হয়ে খুনই বেশী হয়। কিন্তু যদি এই ধরণের অপরাধ ও অপকর্ম ক্রমশ কমে যেতে থাকে আমাদের আইনকানুনকে অবশ্যই আর পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়বে না। আইনের নির্দেশনায় অপরাধ কমে যাচ্ছে না বরং, আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেই এমন হচ্ছে। ভবিষ্যতে আক্রমণ বা অন্যান্য কোনো প্রতিহিংসা সংক্রান্ত প্রতিটি আইন উঠিয়ে দিলেও অপরাধ বৃদ্ধির নজির সৃষ্টি হবে না।

আর্টওয়ার্ক: ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলিউশন ১৭৯৫
শিল্পী: আগস্ত ভিসোঁ
সূত্র: পিন্টারেস্ট

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, গত পঞ্চাশ বছরে বেশকিছু উদারনৈতিক আইন প্রণীত হয়েছে। এই আইনগুলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, এগুলো আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া বর্বর আইনগুলোকে রদ করেই প্রণীত হয়েছে। প্রতিটি উদার আইন, প্রতিটি মৌলিক কর্মসূচীই বলা যায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোগের জন্য প্রণীত আইনকে রদ করে এসেছে। মৃত্যুদণ্ড রদকরণ, জুরি পদ্ধতিতে সকল অপরাধের বিচার (দ্বাদশ শতকের জুরিরা অপেক্ষাকৃত উদার ছিল), ম্যাজিস্ট্রেট নির্বাচন, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনার অধিকার, স্থায়ী সেনাবাহিনী, বিনামূল্য পরামর্শ ইত্যাদি এগুলো সবই আধুনিক উদারনীতিবাদের আবিষ্কার এবং এ হলো চার্চ এবং রাজা-রাজড়াদের হস্তক্ষেপের পূর্বাপর স্বাধীনতার প্রত্যাবর্তন।

তাই, প্রত্যক্ষভাবে সম্পদের শোষণ এবং পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের শোষণ হতে মুক্তি – এই দুটিই আধুনিক ও ব্যয়বহুল বিধানযন্ত্রের মূলনীতি। কিন্তু এখনই সময় নিছক বুলিতে সন্তুষ্ট না হয়ে এর আসল অর্থ বোঝার। যেসব আইন প্রাথমিকভাবে নিজেদেরকে সমাজের জন্য দরকারি প্রথাসমূহের সমষ্টি হিসেবে প্রমাণ করতে আবির্ভূত হয়েছিল সেগুলোই বর্তমানে ধনীর হাতে গরীবের শোষণের হাতিয়ার ছাড়া আর অন্যকিছু প্রতীয়মান হয় না। এখন সভ্য হওয়ার হার শূন্য, এর একটাই লক্ষ্য – শোষণ বৃদ্ধি।

আইনের বিকাশের ইতিহাস আমাদের এটাই বলে। এই ইতিহাসের কী এমন কোনো গুণ আছে যার জন্য আমরা মান্য করতে বাধ্য? অবশ্যই এমন কোনো গুণ নাই। সকল লুটতরাজের ফল পুঁজি ছাড়া এতে মান্য করার আর কিছুই নাই। তাই, সকল আইন জ্বালিয়ে দেওয়াই ঊনবিংশ শতকের বিপ্লবীদের প্রথম কর্তব্য, কারণ এগুলোই হলো ব্যক্তিমালিকানার মূলস্তম্ভ।

চতুর্থ অধ্যায়
মানুষকে নিয়ন্ত্রণের জন্য লাখে-লাখে যত আইন রয়েছে, সেগুলোকে খতিয়ে দেখার পর সেগুলোকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় – সম্পদের সুরক্ষাদান, ব্যক্তিকে সুরক্ষাদান, সরকারকে সুরক্ষাদান। এবং এই তিন শ্রেণীর আইনকে বিশ্লেষণের পর আমরা এসবের অপ্রয়োজনীয়তা এবং ক্ষতিকারক গুণাবলী সম্পর্কিত যৌক্তিক উপসংহারে আসতে পারি।

সমাজতন্ত্রী মাত্রই জানেন সম্পদের সুরক্ষা বলতে কি বুঝায়। সম্পত্তি-আইন ব্যক্তি বা সমাজের পরিশ্রমের উৎপাদন ভোগ করার নিশ্চয়তা দিতে তৈরি করা হয়নি। বরং, উৎপাদিত বস্তুর একাংশ চুরি করার জন্য এবং সেইসাথে যারা সমাজ বা ব্যক্তির সম্পত্তি চুরি করে তাদের সুরক্ষা প্রদানের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।  উদারণস্বরূপ, যখন আইন জনাব ‘ক’ এর বাড়ির উপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তখন এটি তার নিজের বা বন্ধুদের সাহায্যে তৈরি বাড়ির অধিকার প্রতিষ্ঠা করে না। এমন হলে কেউ তার অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করতো না। অপরদিকে, আইন আসলে সেই বাড়ির উপরে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে যা সে আদৌ নিজ শ্রমে তৈরি করেনি।  এর কারণ, প্রথমত, সেটি অন্য কেউ তাকে বানিয়ে দিয়েছে যাদের হয়তো সে শ্রমের সঠিক মূল্যও পরিশোধ করেনি এবং অপর কারণ হলো বাড়িটির একটি সামাজিক মূল্য আছে যা সেই ব্যক্তি নিজে প্রস্তুত করতে পারে না। আইন আসলে সেই বস্তুর প্রতি ব্যক্তিগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করে যাতে মূলত সবারই সমান অধিকার আছে,  একইসাথে নির্দিষ্ট কারোই অধিকার নাই। একই বাড়ি সাইবেরিয়াতে তৈরি করা হলে অন্যকোনো বড় শহরের মত তার মূল্য থাকবে না। যেহেতু, আমরা জানি, মূল্য তখনই সৃষ্টি হয় যখন বহুদিন ধরে মানুষ কোন শহরকে গড়ে তোলে, তাকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে, গ্যাস এবং পানির ব্যবস্থা করে, বিনোদনের স্থান সৃষ্টি করে, কলেজ, থিয়েটার, দোকানপাট, রেলওয়ে, রাস্তাঘাট নির্মাণ করে। তাই, প্যারিস, লন্ডন বা রৌয়েনে (Rouen) কোনো ব্যক্তির বাড়ির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে আইন অসৎ উপায়ে তাকে সাধারণ মানুষের শ্রমে সৃষ্ট কোনো স্থান অধিকার করতে স্বীকৃতি দেয়। এই অধিকার এবং একই ধরনের অন্যান্য অধিকাগুলো এমনই চরম অবিচার যে সকল শুভ ও ন্যায়বোধের বিরুদ্ধে আইনের এক বিশাল অস্ত্রাগার, একপাল সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং বিচারকদের প্রয়োজন হয়।

আসলে, দুনিয়ার অর্ধেক আইনই, বিশেষত, প্রতিটি দেশের দেওয়ানি আইনই এই ধরণের স্বীকৃতি প্রদানের কাজটি ছাড়া আর কিছুই করে না। পুরো মানবজাতির বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কতিপয় ব্যক্তির স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষ্যেই এই মনোপলি চলে। বিচারালয়গুলোর তিন-চতুর্থাংশ মামলাই আসলে মনোপলিস্টদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ছাড়া আর কিছুই নয় – যেন চুরির মাল নিয়ে দুজন চোর ঝগড়া করছে। এবং বহু ফৌজদারী আইনেরও উদ্দেশ্য একই রকম – শ্রমিকদের মালিকদের অধঃস্তন করে রাখার পাঁয়তারা যেন বৈষম্যের সুযোগ নিশ্চিত হয়।

এমন কোনো আইন নাই যা শ্রমিককে তার শ্রমলব্ধ উৎপাদন ভোগের অধিকার নিশ্চিত করে। এটা এতোই সহজ এবং প্রাকৃতিক, এটা মানবজাতির প্রথা ও রীতিনীতির এমনই অবিচ্ছেদ্য অংশ যে, আইন একে কোনো ভাবনার বিষয় বলে গণ্যই করেনি। অস্ত্র হাতে প্রকাশ্য রাহাজানি আমাদের বৈশিষ্ট্য নয়। একজনের উৎপাদিত দ্রব্যের উপর ভাগ বসিয়ে কলহ বাঁধানোও আমাদের বৈশিষ্ট্য নয়। যদি তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হত, তখন কোনো ধরনের আইনি আশ্রয় না নিয়ে তারা তৃতীয় একজনের মাধ্যমে সমস্যা মিটমাট করতো। একমাত্র মালিকানা ব্যবস্থাই অন্যের উৎপাদিত দ্রব্যের সিংহভাগ দাবী করে। মনুষ্যত্ব সাধারণভাবে, কোনো ধরনের বিশেষ আইনি হস্তক্ষেপ ছাড়াই কারোও উৎপাদিত দ্রব্যে তার অধিকারকে মেনে নেয়।

আর্টওয়ার্ক: ওয়ার্কার্স আপরােইজিং
শিল্পী: জ্যাকোব স্টেইনহাট
সূত্র: ওয়েমিয়ার

পরমানন্দের বস্তু, মোটা মোটা খন্ডের সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনের বই। মানবশ্রমের উপর একচেটিয়াদের অন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ব্যতীত এগুলোর অন্য কোনো উদ্দেশ্য নাই। তাই সেগুলো থাকারও কোনো কারণ নাই। এজন্য বিপ্লবের সময় বিপ্লবীরা সেগুলো বাতিল করতে বদ্ধ পরিকর ছিলেন। বস্তুত, তথাকথিত “সম্পত্তির অধিকার” সংক্রান্ত সকল আইন, সকল স্বত্ব-দলিল (Title deed), নিবন্ধনপত্র, এককথায়, যা কিছু মনুষ্যত্বের ইতিহাসে কালিমা বলে চিহ্নিত, যা কিছু দাসত্ব ও ভূমিদাসত্বের মতো অপমানকর, সবকিছু পুড়িয়ে অগ্নুৎসব করলেই ভালো হতো।

সম্পত্তি আইন সম্পর্কিত মন্তব্যগুলো দ্বিতীয় প্রকার আইন, শাসন সংক্রান্ত আইন, যেমন: সাংবিধানিক আইনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এগুলোও আইন, আদেশ, অধ্যাদেশ, ফরমানের এক অস্ত্রাগার যেগুলো মূলত দখলদার কিংবা প্রতিনিধিত্বমূলক শাসকদের রক্ষা করে। এবং এদের হাতেই মানবতা লাঞ্চিত হয়। আমরা ভালোমতোই জানি – এনার্কিস্টরা বহুবার অবিরাম সরকার ব্যবস্থার সমালোচনা করে বলেছেন – রাজতন্ত্রিক, সাংবিধানিক অথবা প্রজাতান্ত্রিক – সকল সরকারেরই লক্ষ্য হলো বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের, অভিজাতদের, যাজকদের এবং বণিকদের স্বার্থ রক্ষা করা। প্রতিটা দেশেই আয়করের মৌলিক আইন, আবগারি শুল্ক, সেনাবাহিনী, পুলিশ বা চার্চ ইত্যাদির কার্যনির্বাহী পরিষদ ও তাদের পদসমূহের জন্য  তৃতীয় একপ্রকার আইন আছে যেগুলোর কাজই হলো প্রশাসনকে সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও অভ্যন্তরীণ গণ্ডগোল মেটানো। এবং এই ব্যবস্থা সবসময়ই দখলদার শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে। এইসব আইন বিশ্লেষণের পর, এদের কার্যকলাপ প্রতিদিন দেখার পর আপনি আবিষ্কার করবেন যে এরা কোনোটাই সংরক্ষণের যোগ্য নয়। এই ধরনের আইন সম্পর্কে আর দ্বিতীয় কোনো মত দেওয়ার সুযোগ নাই। শুধুমাত্র এনার্কিস্টরাই নয়, কমবেশী সকল মৌলিক বিপ্লবীরাই মানবেন, সরকারব্যবস্থা সম্পর্কিত সকল আইনকেই স্রেফ আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াই প্রয়োজন।

তৃতীয় প্রকারের আইন অর্থাৎ, ব্যক্তির নিরাপত্তা এবং “অপরাধ” চিহ্নিতকরণ ও নিবারণ বিষয়ক আইনগুলো সম্পর্কে বলা এখন বাকি রইলো। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, এগুলো নিয়েই সর্বাধিক অন্ধবিশ্বাস জড়িয়ে আছে। এই আইনগুলোকে এমনভাবে বিবেচনা করতে বাধ্য করা হয় যার ফলশ্রুতিতে এই বিশ্বাস জন্মে যেন, এগুলো সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য একদম অপরিহার্য। এই আইনগুলো মানব সম্প্রদায়গুলোতে ব্যবহার্য বিভিন্ন প্রথার মূল (Nucleus) থেকে বিকশিত হয়েছে। পরবর্তীতে এগুলোকে কাজে লাগিয়ে শাসকেরা তাদের কর্তৃত্বকে পাকাপোক্ত করেছে। গোত্র প্রধানদের, শহরের ধনী পরিবারগুলোর এবং রাজাদের কর্তৃত্ব নির্ভর করতো তাদের বিচারিক কার্যক্রমের উপর। বর্তমানেও যখনই সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা আলোচনা করা হয়, সর্বপ্রথমে এর সর্বোচ্চ বিচারক হিসেবে ভূমিকার কথাই সর্বপ্রথম বলা হয়। যুক্তি দেখানো হয়, “সরকার না থাকলে মানুষ একে অপরকে কচুকাটা করতো।” বার্ক বলেছিলেন, “সরকারের একমাত্র কাজ হলো প্রতিজন অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য বারো জন করে সৎ জুরি নিয়োগ করা।”

এ ব্যাপারে বিবিধ অন্ধবিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও এনার্কিস্টদের এখনই বলা উচিত এই ধরনের আইনগুলো পূর্ববর্তী আইনের মতোই অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর।

প্রথমত, তথাকথিত “অপরাধ” বা অন্যের উপরে আক্রমণ দুই-তৃতীয়াংশ বা কখনো তিন-চতুর্থাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ব্যক্তিগত সম্পদে ভাগ বসাতেই সংঘটিত হয়েছে। যেদিন ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা উঠে যাবে সেদিন এই তথাকথিত “অপরাধী” শ্রেণীরও বিলুপ্তি ঘটবে। “কিন্তু”, তখনও বলা হবে, “তবুও যদি কোনো আইনকানুন না থাকে, তাহলে নরপশুরা থেকেই যাবে। তারা কথায় কথায় অস্ত্র হাতে সতীর্থদের জীবননাশ করতে উদ্যত হবে।” যখনই সমাজের দণ্ড প্রদানের অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় তখনই এমন ধুয়া বারবার তোলা হয়।

এই তত্ত্বের চেয়েও সমসাময়িক সময়ে প্রতিষ্ঠিত বড় সত্য হলো, দণ্ডের প্রখরতা অপরাধ কমায় না। ফাঁসির কথাই যদি ধরি, তাহলে একটি ফাঁসির জন্য সিকিভাগ হত্যাও কমবে না। অপরদিকে, মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করা হলে আরেকটি খুনও বেড়ে যাবে না কিন্তু হত্যাও কমে আসবে। পরিসংখ্যান এই প্রমাণ দেয়। কিন্তু যদি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয় এবং খাদ্য সুলভ হয়, আবহাওয়া ভালো থাকে, তাহলে হত্যাকাণ্ড দ্রুত কমে আসে। এটাও পরিসংখ্যানের মাধ্যমে প্রমাণিত। অপরাধের মাত্রা হ্রাস বা বৃদ্ধি দ্রব্যমূল্য ও আবহাওয়ার উপরে নির্ভর করে। এমন নয় যে সকল খুনীরাই ক্ষুধার জ্বালায় খুন করে। এটা বিবেচ্য বিষয় নয়। কিন্তু যখন ফসল ভালো হয়, দ্রব্যমূল্য নাগালের মধ্যেই থাকে এবং  আবহাওয়া থাকে চাঙ্গা, মানুষের মন উৎফুল্ল এবং দুর্দশা যখন নিত্যদিনের তুলনায় কম থাকে, মানুষ তখন হতাশাজনক চর্চা থেকে বিরত থাকে, মামুলি ব্যাপার নিয়ে সতীর্থের উপর ছুরি চালানোর কথা চিন্তা করে না।

উপরন্তু, আরও একটা অতি পরিচিত সত্য হলো, শাস্তির ভয় কোনোদিন একটিমাত্রও হত্যাকাণ্ডকেও থামাতে পারেনি। যে তার প্রতিবেশীকেই প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে খুন করে সে এর পরিণতি সম্পর্কে খুব একটা ভাবে না। এবং, এমন কতিপয় খুনী পাওয়া যাবে যারা বিচার ফাঁকি দেওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলো না।

এমন সমাজের কথা ভাবতে হবে যেখানে মানুষ ভালো শিক্ষার মাধ্যমে তার সকল দক্ষতার বিকাশ করে সেগুলোকে কাজে লাগাতে শেখে এবং এগুলোকে উপভোগ করতে শেখে যাতে করে তার অন্যের ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করতে না হয়। এমন ভবিষ্যত সমাজের কথা না ভাবতে গিয়ে, এতো দুঃখ-কষ্ট থাকা সত্ত্বেও আমাদের সমাজে কোনোদিন দণ্ডবিধির বিলোপ হলেও খুনের সংখ্যা আর একটিও বৃদ্ধি পাবে না; এমনকি বর্তমানে যাদের স্বভাবসিদ্ধ খুনী বলে বিবেচনা করে জেলে পুরে নির্যাতন করা হয়, তাদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধবৃত্তি হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনাও অত্যন্ত প্রবল হবে।

আইন ও দণ্ডবিধির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও সুবিধা আমাদের অবিরাম বলা হয়। কিন্তু, কখনো কি আইন ও দণ্ডবিধির মানবজাতির উপর প্রযুক্ত সুফল ও কুফলের তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে? নাকি শুধুমাত্র মানবজাতির ভিতরে জাগ্রত মন্দ প্রবৃত্তিগুলোকে বিবেচনা করেই ভয়াবহ দণ্ডবিধি আরোপ করা হয়েছে! মানুষ হলো পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম জীব; এমনকি পশুদের মধ্যেও, যারা তার নিষ্ঠুর প্রবৃত্তিকে নীরবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়! যদি তা নাই হতো, তাহলে কেমন করে রাজা, বিচারক বা যাজকেরা স্রেফ কর্তৃত্ব ধরে রাখতে আইন নামক অস্ত্রটি ব্যবহার করে শরীর থেকে মাংস খুলে নেওয়া, ক্ষতস্থানে গরম পিচ ঢেলে দেওয়া, অঙ্গচ্ছেদন করা, হাড্ডি গুঁড়িয়ে দেওয়া, শরীরকে দুইভাগে কেটে ফেলার মতো কাজ করতে পারতো? মানব সমাজ মাত্রই কেবলমাত্র ভ্রষ্টাচারের ধারা অবলম্বী – এই অজুহাতে বিচারকদের মোটা অংকের বেতনে পুষে রাষ্ট্র তথাকথিত “অপরাধকে” সংজ্ঞায়িত করে।

কারাগারগুলোকে পর্যবেক্ষণ করলেই জানা যায়, কলঙ্ক ও দুর্নীতি যে দেয়ালে থেকে ঝরে ঝরে পড়ে স্বাধীনতাহীনতায় মানুষের কেমন দশা হয়। শুধু মনে রাখতে হবে যে, এই ধরনের কারাগারগুলোকে যতই সংস্কার করা হয় সেগুলো ততোই ঘৃণ্য হয়ে ওঠে। মধ্যযুগীয় অন্ধকূপের (Dungeons) চেয়ে আমাদের আধুনিক জেলখানা (Penitentiaries) শতগুণে জঘন্য। সবশেষে ভাবা দরকার, আনুগত্যের নামে কেমন দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচারের শিক্ষা মানুষের মাঝে ছড়ানো হয়েছে। আইনকানুন ও কর্তৃপক্ষের সারমর্মই হলো ঘাতক, কারারক্ষক ও গুপ্তচরদের মাধ্যমে বিবেক, বন্ধুত্বের মূল্যায়ণ না করেই সকলকে শাস্তিদানের অধিকার রাখা। এককথায়, আইন প্রয়োগ করে অথবা স্রেফ কর্তৃত্বের জোরে শাস্তিপ্রদান করা।

এইসব কিছু বিবেচনা করলে, আপনি এই মর্মে অবশ্যই আমাদের সাথে একমত হবেন যে, যেসব আইন জঘন্য শাস্তির মাধ্যমে পীড়ন করে সেগুলোকে বিলোপ করা উচিত।

আর্টওয়ার্ক: দ্য ট্রায়াম্ফ অব ডেথ
শিল্পী: পিটার ব্রুজেলস
সূত্র: উইকিমিডিয়া

রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে অসম্পৃক্ত জনগণ স্পষ্টই বুঝতে পেরেছেন যে, যাদের আমরা “অপরাধী” বলে থাকি তারা নিতান্তই অভাগা। কারণ, প্রতিবিধান তাকে বেঁধে রেখে মেরেছে অথবা তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে অথবা বন্দীদশায় হত্যা করেছে, কিন্তু তাকে ভ্রাতৃসুলভ সেবা দিয়ে, সাম্যের ভিত্তিতে সদাচার করে সৎ মানুষদের মাঝে থাকার সুযোগ দেয়নি। আগামী বিপ্লবে আমরা আশা করি আর এই কান্না অব্যাহত থাকবে না।

“সব গিলোটিন জ্বালিয়ে দাও, সব কারাগার গুঁড়িয়ে দাও, বিচারক, পুলিশ, গুপ্তচরদের মতো অসাধু শ্রেণীকে বিতাড়িত করো, যে লোকটি কুপ্রবৃত্তি থেকে অন্যের ক্ষতি করেছে তাকেও ভ্রাতৃস্নেহ দাও, মোটকথা, মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে অলস করে রাখা বিভিন্ন অসাধু তৈজসপত্র কেড়ে নাও এবং সজাগ থাকো কোনো অপরাধ যেন সমাজের ক্ষতি করতে না পারে।”

অপরাধের প্রধান শর্তই হলো আলস্য, আইন এবং কর্তৃপক্ষ। সম্পত্তি আইন, সরকার সম্পর্কিত আইন, দণ্ডবিধি এবং কর্তৃপক্ষ, যারা নিজেরাই আইন প্রণেতার ভূমিকা পালন করে এবং প্রয়োগ করে। আর কোনো আইন নয়! আর কোনো বিচারক নয়! স্বাধীনতা, সাম্য এবং মানবতার বাস্তব প্রয়োগ – এগুলোই হলো সমাজবিরোধী শক্তিগুলোকে প্রতিহত করার মোক্ষম উপায়।

টিকা
১. ফ্রাঙ্কদের (Franks) বার্ষিক সম্মেলন, যা মূলত মার্চে অনুষ্ঠিত হতো। তখন মার্চ মাসই ছিলো বছরের প্রথম মাস।

ইস্ক্রা