- সেলিম রেজা নিউটন
এ তো রীতিমতো অরাজকতা। খোদ রাজধানী থেকে রাজনীতি-রাজতন্ত্র উঠে গেল নাকি? রাজার অনুমতি ছাড়াই সমাবেশ হচ্ছে দিব্যি। তাও আবার রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ। মানুষের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করা। সর্বনাশের কথা। উপরন্তু শাহবাগের সমাবেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজনীতিকেরা সেখানে বক্তৃতা করতে পারবেন না। সাহারা খাতুন, মাহবুব-উল-আলম হানিফরা বক্তৃতা করতে গিয়ে অপদস্ত হয়েছেন এরই মধ্যে। এই সমাবেশ তার মানে রাজনীতিবিরোধী। অরাজকতা ছাড়া কী?
‘অরাজকতা’ মানে ‘রাজা’বিহীন বন্দোবস্ত। রাজা-রাজনীতি-হুজুর-হোমরা চোমরা ছাড়াই নিজেরা নিজেদেরকে পরিচালনা করার স্বকৃত বিন্যাস। এরই তো নাম অরাজকতা। এই সমাবেশের রাজনীতিবিরোধিতার ভেতরে সুপ্তভাবে হলেও আছে ‘অরাজ’-এর ধারণা: অরাজনীতি, অরাজতন্ত্র। অন্য ভাষায় একেই বলে নৈরাজ্য। নৈরাজ্য মানে স্বাধীনতা। নৈরাজ্য মানে স্বনিয়ন্ত্রণ, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মকর্তৃত্ব। নৈরাজ্য মানে ‘আমরা সবাই রাজা’। সুপ্ত এই উপাদানগুলো ক্রমশ স্পষ্ট ভাষায় যতো বেশি প্রকাশিত হয়ে উঠবে, শাহবাগ-সমাবেশ ততো বেশি এগিয়ে যাবে তাহরির স্কয়ারের দিকে। আরবিতে ‘তাহরির’ মানে কিন্তু ‘স্বাধীনতা’ই বটে। শাহবাগ-চত্বর ঠিকই এগিয়ে চলেছে স্বাধীনতা-চত্বরের দিকে।
নব্বুইয়ের শুরুতে আরম্ভ হওয়া আইনের শাসনের অগোছালো বোলচাল ১/১১-তে আইনের সুসংগঠিত বিভীষিকাপন্থার দাঁত-নখ-পেশী দেখিয়েছিল। তারই অনুরাগে (কিছু পরে কিছু আগে) কর্তৃপক্ষীয়, চাপিয়ে-দেয়া, শাসন প্রতিষ্ঠার প্রচারণা মাধ্যমে এতদিন শুনে আসলাম: ‘আইন তার নিজের গতিতে চলবে’! এখন দেখছি খোদ ‘আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল’-এর আদেশ লোকে মানছে না। আদালতের জন্য লজ্জার কথা। এ তো রীতিমতো আদালত অবমাননা। এই ক’দিন আগেও যে হাইকোর্টের হাইথট-ওয়ালা সব রুলজারির কথা শুনছিলাম, রেডিওতে কীভাবে বাংলা বলা হবে, হুমায়ূন আহমেদ কীভাবে উপন্যাস লিখবেন ইত্যাদি প্রভৃতি কিছুই বাদ যাচ্ছিল না আইনের সুদীর্ঘ হাতের নাগাল থেকে, সেই হাইকোর্ট এখন চুপচাপ। তাজ্জব বটে।
রাস্তায় সমাবেশ নাকি অবৈধ! রাস্তায় সমাবেশ করলে গাড়ি চলতে অসুবিধা হয়, পণ্য-পরিবহনে বিঘ্ন ঘটে। সেই রাস্তা অধিকার করে সমাবেশ চলছে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা, লাগাতার। আশ্চর্য ব্যাপার। অধিক আশ্চর্যের ব্যাপার: বেয়াদব জনসাধারণ এই রাস্তা-অধিকার-করা আন্দোলন নিয়ে বিরক্ত হচ্ছেন না, মিডিয়ার কাছে নালিশ করছেন না, উল্টো বাড়ি থেকে ভাত এনে ছেলেমেয়েদের খেতে দিচ্ছেন। বাবা এগিয়ে দিচ্ছেন তার মেয়েকে। মা দোয়া করছেন ছেলের জন্য। বান্ধবী বন্ধুকে ফেসবুকে মেসেজ পাঠাচ্ছে: ‘বাড়ি ছেড়ে পালালাম; শাহবাগে যাচ্ছি।’
আইনের শাসন আপাতত উধাও তাহলে! যেকোনো সমাবেশ করার জন্য, মাইক ব্যবহার করার জন্য, মেট্রেপালিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন পেশ করতে হবে। তারপর তারা দয়া করে অনুমতি দেবেন (আদৌ যদি দেন)। কোথায় গেল সেইসব কর্তৃপক্ষীয়, চাপানো আইন-কানুন? আওয়ামী লীগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী না হয় এই আন্দোলনে লাভবান হবেন ভেবে সৌজন্যবশত এর ওপরে মরিচের গুঁড়া ছিটাচ্ছেন না। কিন্তু ‘জনদুর্ভোগ’! কোথায় ‘প্রথম আলো’? কোথায় গেল তাদের এতোদিনকার প্রিয় এজেন্ডা? মানুষ এতো নির্লজ্জ হয়! না, হয় না। আসলে মানুষ এতো নির্লজ্জ হয় না: কিন্তু পুঁজি হয়, ক্ষমতা হয়, সার্কুলেশন হয়। ওগুলো আসলে মানুষ না, মনুষ্যোচিত না, মনুষ্যবান্ধব না। শাহবাগের সমাবেশ যতোদিন এসবের দিকে মন না দেবে ততোদিন আমাদেরকে কর্মময় অপেক্ষার উপাসনা করে যেতে হবে বৈকি। আপাতত পুলিশ-র্যাবের পাহারা আর মিডিয়ার অতি-তেলে তৈলাক্ত হওয়ার বিপদ সম্পর্কে আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে কিন্তু।
আইনত এখনও মাঘ মাস, শীতের রাজত্ব। তবু বেআইনত যে ফাল্গুনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে! বোঝা যাচ্ছে, মানুষ রাস্তায় নামলে সব কিছু বদলে যায়। বিচারবিভাগ দুশ্চিন্তায় পড়ে। পুলিশবিভাগ রুটিন দায়িত্বের বাইরে বেরুনোর আগে ভাবে। মিডিয়া একটা অরাজক আন্দোলনকে কাভার করার জন্য রাত জাগে। আর রাজনীতিবিদেরা ভাবতে থাকেন: আমাদের দিন কি ফুরিয়ে যাবে? এইসব বাচ্চা কাচ্চারা সময়মতো দুধভাত খেতে ঘরে ফিরবে তো?
আসলে দশচক্রে ভগবান ভূত। দশ যেখানে, ভগবানও সেখানে। বহুমত আর বৈচিত্র্যই এই আন্দোলনের শক্তি। সেজন্যেই এর মধ্যে রাজনীতিকরা ঢোকার চেষ্টা করছেন। একটু-আধটু ঢুকেও পড়ছেন রাষ্ট্রক্ষমতার জোরে। তারা নিজেরা যদি এরকম সমাবেশ ডাকতেন, দলীয় কর্মীরা ছাড়া কেউই আসতেন না, সে কথা সবারই জানা। সেজন্যই তরুণদের প্রাণবন্ত সমাবেশে সরীসৃপের মতো ঢুকছে রাজনীতি। ঢুকছে ষড়যন্ত্রও। ষড়যন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে হলে শাহবাগ-সমাবেশকে ইতোমধ্যে বিদ্যমান বহুমত-বৈচিত্র্য-রাজনীতিবিরোধিতা ধরে রাখার পাশাপাশি আনুভূমিক ও গণতান্ত্রিক নতুন সাংগঠনিক কাঠামো এবং নতুন ভাষা সৃজন করতে পারতে হবে। এটাই তাদের জন্য আসল চ্যালেঞ্জ।
রাস্তায় এতদিন শুধু জামায়াত ছিল। তাদের পেট্রো-ডলারের দাপট ছিল। কালো টাকায় কেনা, কালো টাকায় ভাড়া করা অস্ত্র এবং অস্ত্রধারী ছিল। কাঁচের শিশির পেট্রোলবোমা ছিল। এখন নিরস্ত্র-কিন্তু-স্বপ্নসশস্ত্র মানুষও রাস্তায় নেমেছেন। আনন্দ সংবাদ।
রিক্লেইম দ্য স্ট্রিট!‘: ইঙ্গ-মার্কিন-ইউরোপীয় মুলুকে আমাদের লড়াকু তরুণদের বহুদিনের আদরের শ্লোগান। ষাট-সত্তর দশকের ইউরোপ-জোড়া প্যারিস-বসন্ত থেকে শুরু করে শ্রমচোষা-রক্তচোষা মালিকদের হাত থেকে শিক্ষার্থী-শ্রমিকদের কলকারখানা পুনর্দখল-আন্দোলন আর প্রশাসক-প্রফেসরদের হাত থেকে ক্যাম্পাস কব্জা করার আন্দোলন; বর্ণবাদ-পুরুষতন্ত্র-শ্রেণিবৈষম্য-বিরোধী আন্দোলন, প্রকৃতি পুনরুদ্ধারের আন্দোলন; আশির দশকের যুদ্ধবিরোধী-আগ্রাসনবিরোধী-পরমাণু অস্ত্রবিরোধী আন্দোলন; নব্বুইয়ে এবং তার পরের দশকে পুঁজির বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে সিয়াটল-জেনোয়া-কানকুনের আন্দোলন আর আফগানিস্তান-ইরাক-যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন; এবং তারপর এই একুশ শতকে এসে লন্ডনে ছাত্রবেতনবিরোধী শিক্ষার্থী-আন্দোলন ও ইঙ্গ-মার্কিন-ইউরোপ-জোড়া পুঁজিবাদবিরোধী অকুপাই-আন্দোলন: এই সমস্ত আন্দোলনের প্রধানতম আইডিয়া এবং শ্লোগান ছিল ‘রিকেইম দ্য স্ট্রিট!’
না, রাজপথ দখল নয়: রাস্তার জনমালিকানা নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা। রাজপথ তো রাজার। রাজা যায়, রানি যায়, বাঁশি বাজে, পথিক আটকে থাকে, পাজেরো ছোটে প্রাসাদের দিকে। আর রাস্তা মুসাফিরের। রাস্তা পথিকের। রাস্তা অনুসন্ধানের। সেই রাস্তার পুনঃমালিকানা দাবি করেছে শাহবাগের সমাবেশ।
বিগত কুড়ি বছর ধরে আমাদেরকে শেখানো হচ্ছে, মিডিয়া-মুখস্ত করানো হচ্ছে:পার্লামেন্টই সকল সমস্যার সমাধানের উৎস। পার্লামেন্টে যে নাই, আইনত সে নাই। সে অস্তিত্বহীন: নন-এগজিস্টেন্ট। পার্লামেন্টারি-রাজনীতির ঘেরাটোপে গড়া এই আইনের শাসনের যুগে শাহবাগ-মহাসমাবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠ করা শপথ অনুযায়ী রাস্তায় আন্দোলন হবে ‘গণমানুষের নেতৃত্বে’। হায়, হায়। পার্লামেন্টের কী হবে? বাংলাদেশের নিওলিবারাল পুঁজির উচ্ছিষ্টভোজীদের কী হবে? ‘প্রথম আলো’র সুশীল সমাজের কী হবে?
হ্যাঁ, তারা চাইবেন এই সমাবেশ শুধু আওয়ামী-ক্যাম্পের সংকীর্ণ রাজনৈতিক এজেন্ডা পূরণ করে সুশীল বালক-বালিকার মতো ঘরে ফিরে যাক। তারা চাইবেন: এই সমাবেশ শুধু ফাঁসি ফাঁসি করেই চিল্লাক। তারা চাইবেন: এই সমাবেশ ১৯৭১-এর চেতনায় ‘জনগণের, জনগণের-জন্য, জনগণের-দ্বারা’ পরিচালিতব্য বাংলাদেশের রূপরেখা নিয়ে মনোনিবেশ না করুক। কিন্তু সেটুকু করতে না পারলে স্রেফ গুটিকয় রাজাকারের ফাঁসি দিতে পারলেই কি একাত্তরের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ পাবো আমরা, একাত্তরেরই ঘোষণা মোতাবেক যে বাংলাদেশের মালিক এদেশের জনসাধারণ?
সুতরাং শাহবাগ-সমাবেশকে ভাবতে হবে নতুন ধারার, সত্যিকারের গণমুখি সংগঠন-সংস্থা-সংঘ-সমিতি-প্রতিষ্ঠান-সমাজ-বিন্যাস-কাঠামো নিয়ে। আজ শুধু এটুকু উচ্চারণ করে রাখি: মুখস্ত শ্লোগান, গতানুগতিক আইডিয়া আর সংকীর্ণ কথাবার্তার মধ্যে নিজেদেরকে পরিসীমিত করে রাখলে আমরা সরকার-স্পন্সরড, মিডিয়া-তেলে-তৈলাক্ত একটা অসার ফাঁসি-আন্দোলনে পর্যবসিত হবো মাত্র। তারপর ফাঁসি টাসি শেষ হয়ে গেলে ঘরে ফিরে দেখব আমাদেরই গলায় সেই চিরপুরাতন রাজনীতির ফাঁসটা লেগে আছে: নেতারা পার্লামেন্টের খোঁয়াড়ে চেঁচাচ্ছেন, পরস্পরকে খুন করছেন, সাগর-রুনির আত্মা হাহাকার করে চলেছে, ক্রসফায়ার-গুম-রিমান্ডের বিধান আরো বিকশিত হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশের গত ৪০ বছরের যে রাজনৈতিক অচলায়তন, সেটিকে ভেঙে দেশকে সত্যিকারের নতুন পথে এগিয়ে নিতে হলে, তরুণদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। কোনো পার্টি, কোনো মতাদর্শ-শাস্ত্র, কোনো সংসদ, কোনো আদালত, কোনো সশস্ত্রবাহিনী, কোনো রাজ-বুদ্ধিজীবীই এই সংকটের সমাধান ঘটাতে পারবে না। কেননা এঁরা সবাই মিলেই তো তিল তিল করে এই মহাসংকট, মহা-অচলাবস্থা তৈরি করেছেন।
পার্টিগুলো নিজেদের পেট-পকেট-প্রভুর দালালি করেছেন। মতাদর্শ-শাস্ত্র-গুলো মানুষকে অন্ধ করেছে, বিভক্ত করেছে, মুক্ত ভাব বিনিময়ের অযোগ্য করে তুলেছে। সংসদ-সদস্যরা কোনোদিন নীতির পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে, বিবেকের পক্ষে দাঁড়াতে পারেননি; নমিনেশন কিনেছেন আর সরকারি তহবিল ও আপামর মানুষের কাছ থেকে মেরে-ধরে খাজনা আদায় করে নমিনেশনের টাকা পূরণ করার লুটপাট করেছেন। সংবিধান সমুন্নত রাখার শপথ গ্রহণ করা আদালত বারবার আমাদের মহাসংকটে ঠুঁটো জগন্নাথের মতো পাথর হয়ে থেকেছেন। বৈধতা দিয়েছেন একের পর এক স্বৈরতন্ত্রকে বন্দুকের ভয়ে। বিবেকের ভয় তাদের ছিল না। এই সেদিনের ১/১১-তেও তারা একই কাজ করেছেন নির্লজ্জের মতো। আর সশস্ত্রবাহিনী একের পর এক অভ্যুত্থান, রক্তপাত, মারামারি, হানাহানি, মিথ্যাবিচার, গণফায়ারিং স্কোয়াড, উপর্যুপরি সামরিক শাসন জারি করে গণতন্ত্রের সর্বনাশ করেছেন, মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছেন স্রেফ ভয় দেখিয়ে, বন্দুকের জোরে। তো, আজকে বিপুলতম আকার ধারণ করা এই সর্পিল, পিচ্ছিল, প্যাঁচানো, কর্দমাক্ত মহাসংকটটা যারা নিজেদের হাতের বানিয়েছেন, আর যাই হোক সেই সব লোক-মত-ধারা এই সর্বগ্রাসী সংকটের সমাধান করতে পারবে না। এটা কমনসেন্স।
সংকট সমাধান করবেন কে তাহলে? করবেন তারাই যাঁরা এই সংকটের শিকার হয়ে খাঁচাবন্দি হয়ে আছেন যুগ যুগ ধরে। এই খাঁচাবন্দি মানুষ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম এবার, ছোট ছোট জানালা খুলে ফেলেছেন প্রযুক্তির কল্যাণে। ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ, নানান ওয়েবসাইট, গান, কবিতা, ছোটকাগজ, হাজারটা মিডিয়া এবং সর্বোপরি প্রেম-ভালোবাসা-ভাববিনিময়ের ভেতর দিয়ে তারা পরস্পরকে চিনছেন-জানছেন কোনো শাস্ত্র-মতাদর্শ ছাড়াই, অন্ধবিশ্বাস ছাড়াই, খোলামনে। তারা তর্ক করছেন, বিতর্ক করছেন, একমত হচ্ছেন, লাখো ধারায় কাজে নেমে পড়ছেন: কিছু না কিছু কাজ। আত্মপ্রকাশের আনন্দে তারা বিভোর হয়ে আছেন। আত্মপ্রকাশের এই আনন্দই স্বাধীনতা। সরকারি আইন-কানুনের বাইরে, সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের বাইরে তারা ক্রমাগতভাবে আত্মকর্তৃত্বের-আত্মমর্যাদার রূপকাঠামো-বিন্যাসের কল্পনা করতে শুরু করেছেন ইতোমধ্যেই।
জেগে উঠতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার স্বাদ পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। এই জাগরণেরই প্রথম, বৃহত্ ঝাপ্টা এসেছে আজ শাহবাগে ফাল্গুনের ঈষদুষ্ণ বাতাসের রঙ মনে মেখে। ফাল্গুন আমাদের চিরকালের দ্রোহ আর প্রেমের পয়গাম। নতুন এই বাংলাদেশের প্রায় সক্কলেই রাজনীতিবিরোধী। রাজনৈতিক দলকে তারা আর বিশ্বাস করেন না। পার্লামেন্টকে তারা বিশ্বাস করেন না। আদালতের স্বচ্ছতা নিয়ে তারা সদাসন্দিহান। পুলিশ-র্যাব-সেনাবাহিনীকে দেখলেই তারা ভয় পান: এই বুঝি কোনো অঘটন ঘটে। মিডিয়াকে তারা সংকীর্ণ স্বার্থের ভাণ্ডারি মনে করেন। মুখস্ত বুলি আওড়ানো বুদ্ধিজীবীদেরকে মনে করেন বাঁচাল, দালাল। পুরানো বাংলাদেশের দিন শেষ। একাত্তরের রক্তসূর্য যে নতুন বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি নিয়ে উদিত হয়েছিল, সেই বাংলাদেশকে আগাগোড়া ঢেলে সাজিয়ে নতুন বাংলাদেশের বিন্যাসের ছবি আঁকার এটাই সময়।
বছরের পর বছর ধরে কবি সাহিত্যিক লেখক শিল্পী চলচ্চিত্রকর্মী ছোটকাগজকর্মী প্রকাশনাকর্মী ব্লগার ইন্টারনেট-অ্যাকটিভিস্ট ওয়েবসাইট-ডিজাইনার স্থপতি ভাস্কর ফটোগ্রাফার সাংবাদিক কম্পিউটার-বিজ্ঞানী সফটওয়ার-প্রোগ্রামার নাট্যকর্মী মুক্ত-সফটওয়ার-অ্যাকটিভিস্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থী ব্যবসা-উদ্যোক্তা ইত্যাদি প্রভৃতি শত ধরনের তরুণ-যুবারা ছবিরহাট চারুকলা জাদুঘর শাহবাগ সোহরাওয়ার্দী-উদ্যান চত্বরকে ঘিরে আড্ডা মেরে চলেছেন। অথচ ভদ্রলোক বুদ্ধিজীবীরা এই পুরো এলাকাটাকে গাঁজাখোরদের নোংরা একটা জায়গা বলে এতোকাল নাক সিঁট-কিয়েছেন। ছেলেমেয়েদের ‘বেলেল্লাপনা’র জায়গা বলে বাঁকা চোখে তাকিয়েছেন এর দিকে। আজ সব সমালোচনা উপেক্ষা-উন্নাসিকতাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে শাহবাগ জ্বেলেছে আমাদের আশার প্রদীপ । (উল্লেখ্য: ঢাকার বাইরের সমাবেশগুলোর পেছনে এই কমিউনিটি হয়ে ওঠার চর্চা এখনও ভালো করে দাঁড়ায়নি বলেই পরিবর্তনের এই মুহূর্তেও সেগুলো নেতাদের গতানুগতিক বক্তৃতাবাজিতে সরগরম হয়ে আছে।) পৃথিবীর সমস্ত বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক-বাহাস-পড়াশোনা-হাসি-তামাশা-আনন্দ-মেলামেশা-প্রেম-ভালোবাসায় ভরপুর শাহবাগের দুর্দান্ত প্রাণবন্ত আড্ডা গত দুই দশকের বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মে শ্রেষ্ঠতম গণবিশ্ব-বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। এটা হয়ে উঠেছে সৃজনবৈচিত্র্যে গমগম করা শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিক্ষেত্র। ফান্ড দিয়ে, আমলা দিয়ে, প্রজেক্ট দিয়ে, এনজিও দিয়ে এরকম অবাধ স্বাধীনতাপূর্ণ একটা শিল্প-সৃজন-বিকাশ-অভয়ারণ্য বানানো যায় না। স্বাধীনতাই তো সৃজনশীলতার ধাত্রী। এই ধাত্রীই শত সহস্র তরুণ-যুবককে মানসিকভাবে সাবালক করে তুলেছে, আন্তরিক একটা বিরাট নিবিড় কমিউনিটি গড়ে তুলেছে শাহবাগে।
রাষ্ট্র মাস্তান মন্ত্রী ঠিকাদার এমপি দারোগা র্যাব প্রফেসর ক্যাডার জঙ্গি হুজুর গুরু পুরুৎঠাকুর হোমরা চোমরা এলিট-মহাজনদের সার্বক্ষণিক অত্যাচারে তো খোদ আমাদের সমাজটাই আজ কারাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কোথায় আমাদের সেই ছোটবেলার পাড়া-মহল্লা? সেখানে সবাই সবার বন্ধু ছিল, আত্মীয় ছিল। মারামারি-ঝগড়াঝাটি-কান্নাকাটি শেষে আবার সবাই একসাথে হাসতে হাসতে খেলতে শুরু করার সমাজ-সম্প্রদায়-গ্রাম আজ কোথায়? রাষ্ট্র এবং নির্বাচিত-অনির্বাচিত আমলাতন্ত্র আজ একেবারে তলার পরিবার পর্যন্ত বিস্তৃত তার শূঁড় দিয়ে সব কিছু শুষে নিচ্ছে। এখন সব ‘ওয়ার্ড’, ‘ইউনিয়ন’, ‘উপজেলা’, ‘নির্বাচনী এলাকা’। এখন সবাই গলায় কুকুরের বেল্টের মতো পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে নাগরিক হয়ে উঠতে বাধ্য হচ্ছেন। এখন সবাই ভোটার মাত্র। এখন সবাই ক্রেতা মাত্র। এখন সবাই যেন ‘কোকাকোলা-দল’ না হয় ‘পেপসি-দল’ হতে বাধ্য। সবাই এখন বিএনপি-আওয়ামী লীগ, কংগ্রেস-বিজেপি, ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান। আর যেন পথ নাই, সমাজ নাই, সম্প্রদায় নাই, মা নাই, বাবা নাই, বয়োজ্যেষ্ঠর সম্মান নাই, ছোটদের আদরযত্ন নাই, বন্ধু-বান্ধব নাই। শুধু মারমার-কাটকাট প্রতিযোগিতার ছ্যাবলামি। আজকের শাহবাগ-সমাবেশ বিগত দুই-আড়াই দশক ধরে গড়ে ওঠা সমাজ-সম্প্রদায়-পাড়া-কমিউনিটি-বন্ধুত্ব-বোধেরই ফল। জ্ঞাতসারে হোক বা অজ্ঞাতেই হোক: আজকের শাহবাগ-স্বাধীনতা রাষ্ট্রের খপ্পর থেকে খোদ সমাজকে উদ্ধার করার, মুক্ত করার, সমাজের আত্মকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার অজস্রমুখি প্রচেষ্টার ফল। তাই তো আজ ফিরে আসছে একাত্তরের নয় মাসের মতো সর্বব্যাপী, বহুবৈচিত্র্যপূর্ণ, প্রাণবন্ত সমাজ-সম্প্রদায়-আত্মীয়তা-বন্ধুত্ব।
শাহবাগ এখনকার মতো যদি ফুরিয়েও যায় আরো অনেক শাহবাগ আসবে। অকুপাই-আন্দোলনের শ্লোগান উচ্চারণ করে বলি: ‘দ্য বিগিনিং ইজ নিয়ার’ (সন্নিকটেই শুরু)। এই গণজাগরণ কোনো না কোনো ভাবে আবার আত্মপ্রকাশ করবে। শাহবাগের স্মৃতি কখনো হারিয়ে যাবে না। খুন-গুম-ক্রসফায়ার, রাষ্ট্রীয় মাস্তানি, দলীয়করণ, দালালি, চামচামির বাইরে তরুণ-জনসাধারণ এবার সুনির্দিষ্ট-ভাবে ভাবতে শুরু করুক কেমন বাংলাদেশ তারা চান। কেমন পুলিশ চান, কেমন আদালত চান, কেমন জনপ্রতিনিধিত্ব চান। এগুলো নিয়ে সত্যিকার অর্থেই সর্বাত্মক-রূপান্তরধর্মী চিন্তা গড়ে তুলতে পারাই আজকের শাহবাগ-সমাবেশের প্রধান কাজ। কথাটা অল্পবয়েসী তরুণ এবং বৃদ্ধ-বয়স্ক তরুণেরা যদি মনে রাখেন আর নিজেদের মাথা ও আত্মকর্তৃত্বের ওপর আস্থা রাখতে শুরু করেন, বদলে যেতে শুরু করবে বাংলাদেশ। আগামীর সেই বৃহত্তর বাংলা-বসন্ত আমাদের দরজায় টোকা দিচ্ছে।
এই ফাল্গুনেও পূর্ণাঙ্গ বসন্ত এখনও আসে নি বটে। এখনও প্রস্তুতি পর্ব চলছে শাহবাগে আর সারাদেশে। প্রস্তুতি এখনও সম্পন্ন হয়নি। কিন্তু হবে। অচিরেই হবে। যখন-তখনই হবে। হয়ত সামনের কোনো শীতকালেই হবে। বসন্ত তো শীতেই আসে, তাই না? ঠিক যে: আর্থ-রাজনৈতিক দল-শক্তিগুলো এবং তাদের মিডিয়া সংকীর্ণ একটা মেডিয়েটেড বসন্ত বানানোর চেষ্টা করছে নানা কারণে। তবু সেটা ঠিক তাদের মতো ইচ্ছানুযায়ী দাঁড়াচ্ছে না কিন্তু। আরব বসন্ত তো আর মিডিয়া দিয়ে বানানো যায় না: বাংলা-বসন্তও না। হ্যাঁ, যেকোনো প্রকৃত গণআন্দোলনকে ঘিরেই সব ধরনের ক্ষমতাশীলমহল প্যাঁচ কষতে থাকেন। তবু যে বালিকারা বালকদের সাথে ক্রোধের আনন্দে নাচছেন তাতে আমি আনন্দিতই বটে। এই সাক্ষাত্, নারীর সাথে পুরুষের, বড়দের সাথে ছোটদের, শিক্ষিতদের সাথে রিকশাওয়ালাদের, এ আমাদের সমাজের যাবতীয় অসামাজিক ব্যাধি-বালা-মুসিবত কমাবে, বাড়াবে সমাজের স্বাধীনতার সীমা: রাষ্ট্র-রাজনীতির একচ্ছত্র রাক্ষস-ক্ষমতার বিপরীতে। সুসমাচার বৈকি। বসন্ত যে এই বঙ্গে আসার জন্য মুখিয়ে আছে সেটা দিব্যি বোঝা যাচ্ছে: শাহবাগে, সারা বাংলাদেশে। আজকের শাহবাগ-সমাবেশ সেই বাংলা-বসন্তের আগাম ফাল্গুনী ইশতেহার।
নোট: রচনাটি ছাপা হয়েছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম-এ ৯ই ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে এবং দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে। পরে রচনাটি লেখকের অচেনা দাগ গ্রন্থতে সংকলিত হয়।