অরাজ
আর্টওয়ার্ক: মার্সিডিজ বেনজ শিল্পী: আথিয়ার মৌসুয়ি সূত্র: আর্ট এজেন্ডা
প্রচ্ছদ » জন ডব্লিউ হোয়াইটহেড।। নিপীড়ক নজরদারির যুগ

জন ডব্লিউ হোয়াইটহেড।। নিপীড়ক নজরদারির যুগ

অনুবাদ: মৌলি ইসলাম

আমরা জানি এইমুহূর্তে আপনি কোথায়; বাড়ির ঠিকানাও অজানা নয়। এমনকি, চিন্তাভাবনার বিষয়গুলোও আন্দাজ করা সম্ভব। কারণ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনার পরিচয় সবসময় জীবন্ত… যা মুছে ফেলার বোতামও নেই। —গুগলের সাবেক সিইও এরিক স্মিথ

আঙ্কেল স্যাম তোমাকে খুঁজছে।
সংশোধন: বিগ ব্রাদার তোমাকে খুঁজছে।

যদি কৌশলগতভাবে দেখা যায়, তাহলে পুঁজিবাদের রাঘব বোয়ালরা আমাকে বা আপনাকে নয়; বরং আমাদের তথ্য জানতে চায়। ‘তথ্য’ আমেরিকার বাজার বা মার্কিন সরকারের কাছে আমাদের মূল পরিচয়। সেখানে, প্রত্যেক তথ্য বিনিময় হয়; সর্বোচ্চ মূল্য হাঁকানো ক্রেতার সাথে হয় বিকিকিনি।

আর্টওয়ার্ক: ইন্টারসেকশন
মিল্পী: ওলেস্কে কুস্তভস্কি
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

এসব নিলামির বেশিরভাগই মার্কিন রাজনীতির জনপ্রিয় মুখ। নির্বাচনে জয় পেতে বা পুনরায় ক্ষমতায় বসতেই তাদের এ অপকৌশল। লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস বলছে, “একজন ব্যক্তি কখনো কোন রাজনৈতিক সমাবেশ বা প্রচারণায় যোগ দিলেই, ধড়িবাজ তথ্য পাচারকারীর নজরে চলে আসেন। অনুসরণ করা হয় তার প্রতি পদক্ষেপ।”

ভোটপ্রার্থী রাজনীতিকের কাছে বিক্রি হয় আমাদের ফোন, টেলিভিশন আর নিয়মিত ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির তথ্য।

কখনো কি মার্কিন বহুজাতিক চেইনশপ ‘হোল ফুডস’ থেকে অনলাইনে খাবার কিনেছেন? বা, কোন শ্যুটিং ক্লাবে অস্ত্রচালনা পরীক্ষা দিয়েছেন? মনে করে দেখুন তো, স্টারবাকসে বসে কফির মগে আয়েশ করে চুমুক দিচ্ছেন আর ঘুরে বেড়াচ্ছেন ইন্টারনেটের দুনিয়ায়। হয়তো, নিতান্ত প্রয়োজনে গেছেন কোন গর্ভপাত করানোর চিকিৎসা কেন্দ্রে। কিংবা, ঘরে বসেই দেখছেন ফক্স নিউজ বা MSNBC। অবসর সময়ে হয়তো মোবাইলে খেলছেন ক্যান্ডি ক্র্যাশ বা ঘুরে বেড়াচ্ছেন শপিং মলে। তাহলে, নিশ্চিতভাবে আপনাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। আর, এসব কাজের মাধ্যমেই শুষে নেয়া হচ্ছে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য। যা, অর্থের বিনিময়ে হবে হাতবদল। এটাই, পুঁজিবাদী নজরদারির যুগ।

অবিশ্বাস্য হলেও, একবার কোন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হলে, দালালরা তার পিছু নিবেই। প্রযুক্তির সহায়তায় যোগাযোগ করবে। কোথায় যাচ্ছেন, কি করছেন, কার সাথে বন্ধুত্ব-শত্রুতা, পড়ালেখা-মতাদর্শ সবকিছুই থাকবে তথ্য পাচারকারীদের নখদর্পনে।

ভয়াবহ বিষয় একবার এই ঘেরাটোপে পড়লে, আজীবন আপনাকে অনুসরণ করা হবে।

প্রযুক্তিনির্ভর প্রচারণার যুগে স্বাগতম। শিথিল নীতিমালার এই সময়ে আবহাওয়া বা খেলার অ্যাপ ডাউনলোড করলে বা কফিশপের ওয়াইফাইয়ে যুক্ত হলেই… তথ্য পাচারকারী চক্র পিছু নিবে। ঘরের রাউটার দিয়েও তারা ব্যক্তিকে রাখতে পারে নজরদারিতে। এরপর- সব তথ্যের তালিকা বানিয়ে আপনার এলাকারই রাজনীতিকের হাতে পাচার করবে। বিনিময়ে নিবে মোটা অংকের অর্থ। এই বাণিজ্যে কেউ পাবে না ছাড়।— সাংবাদিক ইভান হাল্পার।

সেই বিবেচনায়, আমরা সবাই প্রায় সমান। গোপনীয়তা লঙ্ঘনের কারণে কমবেশি ভুক্তভোগী। বাজারু আর মুনাফাখোরদের সামনে ব্যাক্তির অন্তরঙ্গ মুহুর্তও হয়ে পড়ে গবাদি পশুর খাবারের আঁটি (ঘাস-বিচালি)। সরকার বা পুঁজিবাদী গুপ্তচরবৃত্তির এই ক্ষ্যাপাটে যুগে আমাদের শুধু চোখে-চোখেই রাখা হয় না; রীতিমতো অনুসরণ-অনুকরণ করা হয়, টার্গেটে পরিণত করে হয় বেচাকেনার। এর কাছে, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা দফতর NSA’র নজরদারিও সেকেলে।

সবচেয়ে বাজে বিষয়টি হলো, আমাদের স্বেচ্ছা অংশগ্রহণের কারণেই সম্ভব হচ্ছে এই নজরদারি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোন সফটওয়্যার বা অ্যাপ ডাউনলোডের সময়, তাড়াহুড়ায় সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ বার্তা না পড়েই চলে যাই ‘শেষ বোতামে’। তা, মোবাইল বা কম্পিউটারের পর্দায় হয়তো নতুন লোগো জুড়ে দিচ্ছে। একইসাথে, সেটা আপনার গতিবিধি, কার্যক্রম সবই নিয়ে আসে নজরদারির আওতায়। তাই, দু’দণ্ড ভাবুন।

ব্যক্তির প্রত্যক পদক্ষেপ খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়, সাজানো হয় তথ্য, ভেঙ্গে গড়ে বসানো হয় ছকে। ব্যক্তিকে প্রভাবনের জন্য সামনে ধরা হয় অদৃশ্য এক আয়না। যাতে, আধুনিক-পরিবর্তিত নিজেকে দেখতে পান তিনি।

স্বাভাবিক যেকোন দিনে একজন মার্কিনিকে তার সরকার এবং পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তত ২০ উপায়ে নজরবন্দি রাখে। আধুনিকতার এই যুগে কোথায় হেঁটে বেড়াচ্ছেন, গাড়ি চালাচ্ছেন, ইমেইল চেক থেকে শুরু করে পরিবার-বন্ধুদের সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলা— সবকিছুতে আড়ি পাতছে সরকার। স্মার্টফোন কেনা, জিপিএস ডিভাইস ডাউনলোড, টুইটার-ফেসবুক-গুগল অ্যাকাউন্ট খোলা, মুদি সদাই থেকে বিমানের টিকেট কাটার জন্য ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে আসলে পুঁজিবাদী আমেরিকাকে সহায়তা করা হচ্ছে। তারা কৌশলে সরকারের হাতে আমাদের সময় ও টাকা ব্যয়ের দলিল তুলে দিচ্ছে।

আর্টওয়ার্ক: সার্ভিল্যান্স
শিল্পী: হামফ্রে কিং
সূত্র: রকফেলার

প্রযুক্তি এতোটাই এগিয়েছে যে, পুঁজিপতিরা অদৃশ্য বেড়া দিয়ে আমাদের বাসা-কর্মক্ষেত্র-বন্ধু ও পরিবারের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। যেকোন সময় মনভুলানো বার্তারূপী বোমা মারতে তারা প্রস্তুত। এরমাধ্যমে, খুব সহজেই তাদের কার্যোদ্ধার হচ্ছে আর, ব্যবহারকারীও টের পাচ্ছে না। একবার ভাবুন তো- দৃশ্যত কেউ যদি সবসময় আমাদের পিছু নেয়, টেলিফোনে আঁড়ি পাতে, গোপন কাগজপত্র পড়ে, লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে তাহলে, নিঃসন্দেহে আমরা পুলিশ ডাকতাম। দুঃখজনক হলেও সত্য, নিরাপত্তা বাহিনীও এ ঘৃণ্য কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত।

এটা শুধু নজরদারি বা তথ্য কেনাবেচার বিষয় না, চরম বিরক্তির কারণও। সরকারি পদক্ষেপ- আজ্ঞে যেকোন সরকারের- ক্রমাগত লাগামছাড়া ও জবাবদিহিহীন হয়ে উঠছে, নাগরিককে লক্ষ- অনুসরণ-বৃত্তাবদ্ধ এমনকি তাদের হাজতে পুরতেও পিছপা হচ্ছে না। চিন্তা করুন তো, নাৎসী জার্মানির মতো সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের হাতে এধরনের কৌশলী অস্ত্র পড়লে, কি ঘটতো? অথবা, পুলিশী রাষ্ট্রগুলো যদি পরে হিটলারের পদাঙ্ক অনুসরণ করতো… কি ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি দেখতো বিশ্ব!! অথচ, সব জেনেশুনেও সরকারের নজরদারির বিষয়টি আমরা কতো সহজ করে দিয়েছি।

সরকারি চোখগুলোর সামনে ব্যক্তি বরাবর নজরবন্দি। কোথায় যাচ্ছি, কাদের সাথে যোগাযোগ, অর্থব্যয়ের পরিমাণ, কি লিখছি-কি পড়ছি, কখন ঘুমাতে যাচ্ছি বিছানায়-কখন উঠছি, টিভি দেখা বা ইন্টারনেট ব্রাউজিং সবই রাষ্ট্রের ঝান্ডাধারীদের নখদর্পণে। ব্যক্তির প্রত্যক গতিবিধি নতুনভাবে তথ্য হালনাগাদে সহায়তা করে। এর মাধ্যমেই, কারো চরিত্র বা গোটা ছবিটা স্পষ্ট হয়। দেয়া হয় নামের পাশে টিকচিহ্ন। যাতে, প্রয়োজনে আপনাকে সঠিক পথে আনতে বেগ পেতে না হয়।

যদি মানবাধিকারকর্মী হন আর সে বিষয়ক লেখা তথ্য ফেসবুক বা টুইটারে শেয়ার করেন; তাহলে দলত্যাগী, বিপ্লবী, সরকার বিরোধী কট্টরপন্থী বা তথাকথিত সন্ত্রাসী হিসেবে নিজের গায়েই লাগালেন তকমা। লাইক বা শেয়ার না করেও; সরকারের নিপীড়ন, অন্যায় আচরণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পড়তে থাকলে, অন্তর্ভুক্ত হবেন পুলিশের তালিকায়। ফেলা হবে বিশেষ কোন গোষ্ঠীর কাতারে। ব্যক্তি লাইনচ্যুত হলেই, পুঁজিপতিরা করবেন সঠিক পথে ফেরানোর মহান কাজটি।

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুসারে, ঝুঁকির মাত্রা অনুসারে সবুজ-হলুদ-লাল রংয়ের কোডের আওতায় রয়েছি সবাই। যার মাধ্যমে, সম্ভাব্য সংকট তেরীর আগেই আন্দাজ করা সম্ভব। নগণ্য কোন ফেসবুক পোস্টের কারণে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে সেনাবাহিনীর মতো সম্মানজনক ক্যারিয়ার। চিকিৎসা সেবা নেয়ার সময় পড়তে পারেন অসুবিধায়। আপনার ঘনিষ্ঠ বা স্বল্পপরিচিত কেউ অপরাধের সাথে জড়িত থাকলেও, সেটা ফেলবে বিপত্তিতে। একশব্দে বললে, ব্যক্তি কোন না কোনভাবে রয়েছেন পুলিশের তালিকায়। শুধু, সরকার বিরোধী কোন কর্মকাণ্ডে জড়ালেই, সোজা ১৪ শিকের ভেতরে। সরকারই ভালো জানে, কিভাবে সাজানো হবে গোটা পরিকল্পনা, ফাঁসানো যাবে ব্যক্তিকে।

ইন্টারসেপ্টের প্রতিবেদন অনুসারে, FBI-CIA-NSA এবং অন্যান্য সরকারি এজেন্সিগুলো অনেকাংশেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যের ওপর নির্ভরশীল। যার শীর্ষে গুগল-ফেসবুক-টুইটার-ইনস্টাগ্রাম। এরইমাঝে, ধারণাটিকে কার্যকারী উপায়ে ব্যবহার করছে চীন।

চীনের লাখো নাগরিক এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ছাঁটাই-বাছাইয়ের কল্যাণে ‘অযোগ্য’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সুনাগরিক কিনা-সেটাও নির্ণয় করছে সোশ্যাল মিডিয়া। এর ফলে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ, সহায়-সম্পত্তি ক্রয় থেকে বিমান-ট্রেনের টিকেট কাটার সময়ও কালো তালিকাভুক্ত চৈনিকরা ভুগছেন।

ভীতিকর ভবিষ্যৎ থেকে আমরা খুব বেশি দূরে নই; যেখানে চীন সবার পথপ্রদর্শক। দেশটির নিরাপত্তা কাঠামো বা সরকারি আলামতও দেয় সেই ইঙ্গিত। যখন সরকার সবকিছুই দেখছে-জানছে এবং আপাতদৃষ্টিতে স্পষ্টবাদী বা আইনভঙ্গকারী নাগরিকের জন্য রেখেছে কড়া আইন, সেসময় পুরানো প্রবাদই খাটে “লুকানোর কিছুই না থাকলে… চিন্তারও কারণ নেই”

নাগরিকদের ওপর গোয়েন্দাগিরি বা প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের জীবনে আড়িপাতার মতো সরকারের প্রকাশ্য ঝুঁকিতে রয়েছেই। সাথে কৌশলগুলোর প্রায়োগিক ব্যবহারে আচরণ বা মতাদর্শিক পরিবর্তন ঘটানোও সম্ভব।

এমনকি, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও আমলাতন্ত্র এবং সরকারি প্রকল্পগুলোর প্রতি জনগণের প্রতিক্রিয়া হ্রাসের জন্য সরকারি সংস্থাগুলোকে ‘আচরণগত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি’ ব্যবহারের নির্বাহী আদেশ দিয়েছিলেন। সরকারি কাজগুলোর ব্যাপারে জনমত জানতে এটা আসলে একটি সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি। যারমাধ্যমে, আনুষাঙ্গিক বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন আনা সম্ভব।

সরকার বা পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণদের (!) মাকড়সার জালে আটকাতে প্রাক-অপরাধের মতো নাটক সাজায়। স্বয়ংক্রিয় চোখ-কান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যক্তির গায়ে সেঁটে দেয়া হয় ‘সন্দেহভাজন’ বা ‘চরমপন্থি’র মতো শব্দগুলো। যা, নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে নিঁখুত ডিস্টোপিয়ান দুঃস্বপ্নের দিকে ঠেলে দেয়।

আর্টওয়ার্ক: মাইন্ড কন্ট্রোল
শিল্পী: সিমন নস্কা
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

জর্জ অরওয়েল, আলদোস হাক্সলে এবং ফিলিপ কে ডিকে’র মতো সাহিত্যকদের লেখায় অনেক আগেই এসেছিলো ‘পীড়াদায়ক প্রাক-অপরাধে’র মতো চিন্তাভাবনা। ভুলে যাবেন না, যতো ভালো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সরকারি আইন বা কর্মসূচিই থাকুক না কেনো, এর পেছনে রয়েছে বিকৃত-দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অবৈধ মতলব। যেখানে, ক্ষমতা আর মুনাফার সমীকরণটা মিলে যায়। সন্ত্রাসবাদ-মাদক-অনুপ্রবেশ বিরোধী যুদ্ধ, সম্পদ জব্দকরণ-সড়ক ও বিদ্যালয়ের নিরাপত্তা পরিকল্পনার মতো ইস্যুগুলো জনকল্যাণে শুরু হলেও, সেটা তথাকথিত পুলিশী রাষ্ট্রেরই হাতিয়ার।

ভুল বা সঠিক হাতে পরে, হিতৈষী পরিকল্পনাও অমঙ্গলে পাল্টে যেতে পারে। মার্কিনীদের ওপর নজরদারি, ডিজিটাল উঁকিঝুঁকি বা তথ্য তালিকাভুক্তির পুরোটাই সরকারের হাতে। বিশেষভাবে, যখন সরকার কোন ব্যক্তির ফোনালাপ শোনে, গাড়ির গতিবিধি অনুসরণ করে, সেটা মোটাদাগে ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ।

এদিক থেকে, আমেরিকার মতো পুলিশী রাষ্ট্র ক্ষ্যাপাটে-হিসাবী আর নারকীয় প্রতিভার অধিকারী। সাদা চোখে যে প্রযুক্তিগুলোকে আমরা সামাজিকভাবে বৈপ্লবিক এবং মুক্তিদানকারী হিসেবে চিহ্নিত করছি, তা আদতে ভ্রাম্যমান হাজত, জেলার আর নজরদারি সংস্থাগুলো।

এরমাধ্যমে, একটা সময়ে ‘সোয়লেন্ট গ্রিন’ বা ঘনবসতিপূর্ণ বুভুক্ষু জাতিতে পরিণত হবো। (মার্কিন কল্পবিজ্ঞান লেখক হ্যারি ম্যাক্সওয়েল হ্যারিসনের বই) ১৯৭৩ সালে একইনামের চলচ্চিত্রে মূখ্য ভূমিকায় ছিলেন শার্লটন হেস্টন এবং এডওয়ার্ড জি. রবিনসন। সিনেমাটিতে, ২০২২ সালের ভবিষ্যৎ পৃথিবী চিত্রিত হয়েছে। যেখানে জনাকীর্ণ, দূষিত, অনাহারে ভুগতে থাকা নিউইয়র্কবাসী ‘সোয়লেন্ট গ্রিন কর্পোরেশন’ নামের কারখানায় বানানো সিনথেটিক খাবারের ওপর নির্ভরশীল। একটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ঘিরে শুরু দৃশ্যপট। একপর্যায়ে, পুলিশ হেস্টন বের করে আনেন বিস্কুট তৈরীর উপাদান সম্পর্কে ভয়াবহ তথ্য। যা, ক্ষুধার্ত জাতির মূল পুষ্টি উপাদান ছিলো। জানান “বিশ্বকে মনুষ্যহীন করাই সোয়লেন্ট গ্রিনের উদ্দেশ্য। মানবজাতিকে নিশ্চিহ্নের জন্যই এ খাবার। এমনকি, ভবিষ্যতের খাদ্যর জন্য মানুষকেও গবাদিপশুর মতো প্রজনন-প্রতিপালন করা হচ্ছে।”

আক্ষরিক অর্থেই, ঔপন্যাসিকের সেই চিন্তা সত্য ছিলো। কিন্তু, বর্তমানে সোয়লেন্ট গ্রিন হলো ব্যক্তিগত তথ্য। যা, সরকার আর পুঁজিপতিদের জন্য ঘষেমেজে সামনে সাজিয়ে দেয়া হয়। আমরাও গবাদি পশুর মতোই প্রতিপালিত। পার্থক্যটা শুধু খাবারের জন্য নয়— এটাই রক্ষে!

আমার বই ‘ব্যাটেলফিল্ড আমেরিকা: দি ওয়ার অন দ্যা আমেরিকান পিপল’-এও লিখেছি- শুধু তথ্যর জন্যই আমাদের হৃষ্টপুষ্ট-লেবেল সেঁটে-বেচাকেনা করা হয়। মার্কিন সরকার আর পুঁজিপতিদের মধ্যে যতো প্রতারণামূলক সম্পর্ক বাড়ছে; ততোই আমরা ডিজিটাল লাঞ্ছনার ঘেরাটোপে আটকা পড়ছি। সেই জাল ছিড়ে বেরুনোর মানে হলো গোটা বিশ্ব থেকে জনবিচ্ছিন্ন হওয়া।

১৯৮৪ সালে, জর্জ অরওয়েল পক্ষান্তরেই বর্তমান পরিস্থিতির সঠিক বণর্না দিয়েছিলেন। “আপনাকে এটা মেনেই জীবনযাপন করতে হবে— অভ্যাসগুলো পরিবর্তিত হবে প্রয়োজনীয়তায়, আড়িপাতা হবে প্রত্যেক আলাপনে, খুঁটিয়ে দেখা হবে গতিবিধি”

জরুরি ভিত্তিতে নিজেদের যন্ত্র নয় বরং মানুষ প্রমাণের জন্য ‘ইলেকট্রনিকস বিল অব রাইটস’ প্রয়োজন। সাংবিধানিক সুরক্ষা ছাড়া যন্ত্ররাজত্বে অনধিকার প্রবেশ ঠেকানো আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য। আর, সেটা করা না গেলে…খুব শিগগিরই স্টলেন গ্রিনের চরিত্রে পরিণত হবে আজকের মানুষ। কারামুক্ত হতে মানুষকে ফিরতে হবে অতীতে। যেখানে, নিজের ইচ্ছামাফিক কথা বলা, খাওয়া, কেনাকাটার স্বাধীনতা মিলবে। গুগল দেখাবে না রোয়াব, গোপন তথ্য বেঁচবে না CIA বা NSA’র কাছে। সর্বোপরি, সেনাবাহিনী বা আধুনিক প্রযুক্তির বিরুদ্ধে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হবো না আমরা।

মৌলি ইসলাম

মৌলি ইসলাম সাংবাদিক ও অনুবাদক। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায়। বর্তমানে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতি তাঁর আগ্রহের বিষয়।