- বখতিয়ার আহমেদ
আকস্মিকই তাঁর চলে যাওয়া। মৃত্যুর আগের দিনও টুইটারে ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি। নৈরাজ্যের নৃতত্ত্ববিদ ডেভিড গ্রেইবার আর নেই। গ্রেইবার ছিলেন সেইসব চিন্তকদের একজন যাঁরা ক্ষমতার প্রতিবয়ানে মানুষ, সমাজ, সম্পর্ক ও স্বাধীন-আনুভূমিক সংগঠনপ্রণালীর ইতিহাস ও ন্যায্যতা তুলে ধরেছেন। নৃতত্ত্ব এবং অর্থনীতি দুই ক্ষেত্রেই তাঁর কাজকে বৈপ্লবিকই বলা চলে৷
গত বছর পাঁচেক ধরে আমি একটা অস্ট্রেলিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ পরিবর্তন বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের গবেষক-শিক্ষার্থী। ‘মাল্টিডিসিপ্লিনারী ও মাল্টিকালচারাল’ এই গবেষণা কেন্দ্রের করিডোরে আমার পরিচয় আমি বাংলাদেশি নৃবিজ্ঞানী। তো, এখানে ২০০৭ সালের দিকে সমসাময়িক সামাজিক আন্দোলন বিষয়ে লেখালেখি ঘাঁটতে গিয়ে ভীষণ বদ-মেজাজী এক লেখার মুখোমুখি পড়ে যাই, এক মার্কিন নৃবিজ্ঞানী, ডেভিড গ্রেয়বার তার নাম। The Globalization Movement: Some Points of Clarification শিরোনামের লেখার প্রথম বাক্য, “A great deal of nonsense has been written about the so-called antiglobalisation movement”, লেখাটায় তার ক্ষুরধার বিশ্লেষণের বিষয় ‘বিশ্বায়ন আন্দোলন’, যাকে কর্পোরেট মিডিয়া “বিশ্বায়ন-বিরোধী আন্দোলন” নামে প্রচার করে, সেখানে মিডিয়া ও একাডেমি তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা। পিয়েরে বরদিউ’র মত, তিনিও মনে করেন সেই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমাজবিদ্যার পন্ডিতদের ভূমিকা, তার সোজা কথায় ‘ন্যাক্কারজনক’। সেই সব এন,জি,ও পুষ্ট অধ্যাপক, যারা বছরের পর বছর অস্তিত্বহীন সব সামাজিক আন্দোলন বিষয়ে বস্তা বস্তা কাগজ পয়দা করেছেন তারা সবাই সিয়াটলের মত বিদ্রোহ নিয়ে কবরের নীরবতা পালন করছেন। তিনি শুধু অভিযোগ তুলে ক্ষ্যান্ত দেন নাই। একজন খাঁটি নৃবিজ্ঞানীর মত এই আন্দোলনগুলোতে নিজের সক্রিয় অংশীদারি অভিজ্ঞতা দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন কর্পোরেটের বিরুদ্ধে মানুষের স্বতস্ফূর্ত শান্তিপূর্ণ বিদ্রোহের বয়ান। লেখাটা পড়তে পড়তে ২০০৩ সালে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারির প্রথম বছরে লেখা এক অসহায় জবানবন্দীর স্মৃতি জেগে উঠেছিল। কিন্তু নৃবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমি ২০০৭-এ আরেকটু উপরের ক্লাসে পড়ি, ফলে এই মিল আমাকে অবাক করেনি। নৈরাজপন্থী অধ্যাপক ব্রায়ান মার্টিনের ক্লাস করতে গিয়ে আমি তখন ‘হুইসেল ব্লোয়িং’ কথাটার মানে বুঝে গেছি, মানুষের ইতিহাসের ভাঁজে ভাঁজে স্বরাজের সুন্দরকে চিহ্নিত করা একটু একটু করে শিখছি। যা হোক, আমি গ্রেয়বারের পিছু ছাড়লাম না। লাইব্রেরী হাতড়াতে গিয়ে পেয়ে গেলাম আরেকটা চটি বই, “Fragments of an Anarchist Anthropology”, পড়তে গিয়ে দেখি এখানে তিনি বোঝার চেষ্টা করছেন রাষ্ট্রবিহীন সমাজ যে খুবই সম্ভব এবং এটাই যে মানব-প্রকৃতির সাথে একমাত্র সংগতিপূর্ণ ক্ষমতা বিন্যাস, বার বার এই অমূল্য-অপরুপ সত্যের মুখোমুখি হয়েও কেন নৃবিজ্ঞানীরা মুখে কুলুপ এঁটে থেকেছেন। মনে পড়ছে সবচেয়ে মজার উদাহারণ ছিল র্যাডক্লিফ ব্রাউন। নৈরাজপন্থার প্রতি ঝোঁকের কারণে বন্ধুরা তাকে ডাকতেন ‘এনার্কো ব্রাউন’ নামে। কিন্তু যেই তিনি কেম্ব্রিজের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হলেন, ‘স্যার’ হলেন, মুখ দিয়ে নৈরাজ শব্দটি আর কেউ কোনদিন শুনতে পায়নি। যদিও তার আজীবন গবেষণার বিষয় থেকেছে আন্দামান দ্বীপের নৈরাজ্যিক সমাজগুলোর রাজনৈতিক বিন্যাস, The Andaman Islanders, এক অসাধারণ এথনোগ্রাফি।
যাই হোক, আমার নিজের পি এইচ ডি গবেষণার বিষয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রান্তসীমা পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিচয় ও উন্নয়নের রাজনীতি। পিয়েরে ক্লস্ত্রে আর পিয়েরে বরদিউ নামের দুই ফরাসি নৃবিজ্ঞানীকে পড়ার চাপেই আমি তখন জেরবার, তার উপর এসে জুটলেন দুই আমেরিকান, জেমস স্কট আর এই ডেভিড গ্রেয়বার, আমার নিজের থিসিস লেখা প্রায় লাটে উঠল। কিন্তু একই সাথে বদলে যেতে থাকল নৃবিজ্ঞান নিয়ে আমার নিজের চিন্তা। একের পর এক ডেড লাইন মিস করতে থাকলাম, সুপারভাইজারের হাসি শুকনা থেকে শুকনাতর হতে থাকল, আর আমি নৃবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আগের দেড় যুগের বহু শিক্ষা অশিক্ষা করার কাজে লেগে গেলাম। এখনও লেগে আছি, কিন্তু বাস্তব জ্ঞান খানিকটা ফিরেছে, পি এইচ ডি শেষ করতে চাই।
এই সেপ্টেম্বরে যখন ওয়াল স্ট্রিট বিদ্রোহ শুরু হল, অনেকেই হয়তো খেয়াল করেছেন, মিডিয়া প্রথমে পরিস্কার চেপে যাওয়ার চেষ্টা করল। পরে যখন দেখা গেল এটা আসলে চেপে রাখবার মত জিনিসের চেয়ে বহুগুণ বড়, তখন শুরু হল এ নিয়ে আবোল-তাবোল সংবাদ পরিবেশন। সেই বিস্তারে যাওয়ার সুযোগ আমার নেই কিন্তু একটা জিনিস মনে হচ্ছিল যে আন্তরিকতা থাকা স্বত্ত্বেও মিডিয়ার অনেকের কাছে, এবং সাধারণ্যের কাছে আন্দোলনটা ভীষণ অস্পষ্ট এবং ব্যাখ্যাতীত ব্যাপার, অবাক হওয়ার মত ব্যাপার। মাসের পর মাস আন্দোলন চলছে কিন্তু এখনও কোন হিরোর নাম জানা গেল না, কোন নির্দিষ্ট দাবি নাই, কোন নেতা নাই, এ কেমন আন্দোলন? মিডিয়াও এ নিয়ে গলদঘর্ম হতে থাকল কিন্তু খুব একটা সুবিধা করা গেল না। কিন্তু সামাজিক আন্দোলনের পেশাদার গবেষক হিসাবে আমার অবাক হওয়ার অনুমতি নাই। কাজেই আমি গুগলে সোজা ডেভিড গ্রেয়বার নামে খোঁজ লাগালাম, দেখলাম মামা ঠিকই আছেন ব্রিটিশ পত্রিকা দি গার্ডিয়ানে, নিজের মত নিজের কাজটা ঠিকই করে যাচ্ছেন। এর মধ্য হঠাৎ দেখি বিজনেস উইক ম্যাগাজিন অক্টোবরের ৩১ তারিখের সংখ্যায় অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট নিয়ে তাদের বিশেষ সংখ্যার শিরোনাম দিয়েছে Who is Behind the Mask? খানিকটা চমকে, মনে সন্দেহ নিয়ে সেই মুখোশ উল্টালাম, দেখি ডেভিড গ্রেয়বারের নাম। শংকা আরো বেড়ে গেল কারণ আমি জানি এই বিদ্রোহে তো কারো হিরো হওয়ার কথা নয়। লেখাটা পড়ে ভুল ভাঙল। আমার ধারণা গ্রেয়বারকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় আপনি এখানে কি করছেন, উত্তর হবে নৃবিজ্ঞানী হিসেবে নিজের সামাজিক ভূমিকা পালন করছি। আর লেখাটা হচ্ছে এক নৃবিজ্ঞানীকে নিয়ে লেখা, এথনোগ্রাফিক ধারায় অনুপ্রাণিত একটি রচনা। শিবের গীত লম্বা হয়ে যাচ্ছে, কাজেই কিছু জরুরী আলাপ দিয়ে শেষ করি।
এনার্কি’র বাংলা কি হবে এ বিষয়ে আমার এখনো কোন চূড়ান্ত ফয়সালা নাই। আমি নৈরাজ/নৈরাজ্য/নৈরাষ্ট্র/স্বরাজ/অরাজ ইত্যাদি শব্দমূলের নানা ধর্মী প্রয়োগ নিয়ে ভাবি, কোন একটাতে থিতু হওয়ার তাড়া যেমন নাই, তেমনি উপায়ও নাই আপাতত। কিন্তু এই শব্দগুলোর, বিশেষত ‘নৈরাজ্যে’র সরকারি মানেটাই এখনও পর্যন্ত মতাদর্শ নির্বিশেষে বাংলা ভাষার সমসাময়িক সব লেখক নির্বিচারে মেনে নিয়েছেন। প্রায়ই অবাক হই এই লেখকদের তালিকায় কষ্ট-কল্পনীয় সব নাম দেখে। নৈরাজপন্থী ধ্যান-ধারণার ঐতিহাসিক সূতিকাগারগুলোর একটি হয়েও বাংলাভাষী অঞ্চলের সমসাময়িক রাজনৈতিক চিন্তাধারায় নৈরাজপন্থা বুদ্ধিবৃত্তির সরকারি পরিভাষার তাবেদারিতে আটকে আছে। কাজেই এই লেখাটি পড়ার গুরুত্বপূর্ণ একটা মানসিক প্রস্তুতি হওয়া উচিত “নৈরাজ” শব্দটার সরকারি মানের চক্কর থেকে বেরুনো।
নৈরাজপন্থা আসলে কি? নৈরাজপন্থা আসলে কোন রাজনৈতিক মতবাদ নয়। অন্য এক লেখায় গ্রেয়বার বলেছিলেন, “মার্ক্সবাদ হচ্ছে বিপ্লবের কৌশল বিষয়ক তাত্ত্বিক ও বিশ্লেষণ ধর্মী ডিসকোর্স আর নৈরাজপন্থা হচ্ছে বিপ্লবী চর্চার নৈতিকতা বিষয়ক ডিসকোর্স”। নৈরাজ্যের চুড়ান্ত লক্ষ্য নৈরাজ্যই, এনার্কি ইজ অর্ডার। আর সব রাজনৈতিক দর্শন মানুষকে প্রাকৃতিকভাবে হিংস্র, স্বার্থপর মনে করে (হবসের কল্পনা) এবং হানাহানিকেই আদি শাশ্বত সামাজিক দশা মনে করে। ফলে রাষ্ট্রকে বল-প্রয়োগের সার্ব্বভৌম ক্ষমতা দেয়া হয় একজন আরেকজনকে দেখিবামাত্র খুন করবার একটা সম্ভবনাকে সমাজের প্রকৃতি অনুমান করে। খুনোখুনিকেই আদি মানব-দশা বা অর্ডার বোঝানো হয়। মনে করা হয় আইনের শাসন, কারাগার, এবং শাস্তির সার্বক্ষণিক একটা আতংক না থাকলে মানুষ মানুষ থাকবে না। অন্যদিকে নৈরাজপন্থীরা মনে করেন একে অন্যকে সহযোগিতাই হচ্ছে মানব প্রকৃতি। এবং মানুষ এটা রাষ্ট্রের খবরদারি, আইনি ব্যবস্থা এবং কোন ধরনের হুজুরদের উপস্থিতি ছাড়াই করতে সক্ষম। রাষ্ট্রের দাপুটে ইতিহাস আমাদের এই সত্যটা ভুলিয়ে দেয় যে মানবেতিহাসের ৯৯% ভাগ সময় জুড়ে সব মানব সমাজ, এবং গত শতাব্দীর আগ পর্যন্ত পৃথিবীর বেশির ভাগ জায়গার মানুষেরা সেটা করেছে। নৈরাজপন্থীরা আস্থা রাখেন মানুষের অনাদি মমত্ববোধের উপর, সমাজের মধ্যে অরাজনৈতিক (কর্তৃত্বহীন) ক্ষমতা চর্চার উপর। তারা মনে করেন কর্তৃত্ব ছাড়াও নেতৃত্ব সম্ভব। রাষ্ট্রীয় আয়োজনে সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্রকে তারা সামরিকতন্ত্রেরই নামান্তর মনে করেন কারণ এখানেও একটি ছোট্ট ‘নির্বাচিত’ দলকে বৃহদাংশের উপরে বল প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়। নৈরাজপন্থীরা মনে করেন একটি সমাজের প্রয়োজনীয় সব সিদ্ধান্ত প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের মাধ্যমে, সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণে নেয়া সম্ভব। নৈরাজপন্থীদের লক্ষ্য ক্ষমতা দখল নয়, ক্ষমতাতন্ত্রের অবসান।
এই অনুবাদ, বা মূল লেখার লক্ষ্য ডেভিড গ্রেয়বারকে হিরো হিসেবে উপস্থাপন নয়। বছর পাঁচেক ধরে তার দুরবর্তী কিন্তু মনযোগী ছাত্র হিসেবে জানি যে আইডিয়াটা উনিও পছন্দ করবেন না। বরং লেখাটি রাজনৈতিক আন্দোলন বা এর নেতৃত্ব যে কর্তৃত্ববিহীনও হতে পারে তার একটা কেস স্টাডি হিসেবে পড়া যেতে পারে। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র যে একটি বাস্তব, এবং প্রয়োগযোগ্য, এবং অর্জনযোগ্য ব্যাপার, ওয়াল স্ট্রিট বিদ্রোহ যে তার জলজ্যান্ত উদাহারণ, এটা অনুধাবন করা যেতে পারে এই লেখা থেকে। কিন্তু ওয়াল স্ট্রিট বিদ্রোহকে নৈরাজপন্থী বিদ্রোহ বলার উদ্দেশ্য এটার গায়ে কোন রাজনৈতিক মতবাদের ব্র্যান্ড লাগানো নয়, কারণ আগেই বলেছি, নৈরাজপন্থা কোন রাজনৈতিক মতবাদ নয়, খোদ রাজনীতি প্রশ্নে একটি নৈতিক অবস্থানের নাম।
অন্যদিকে নৃবিজ্ঞানকে একতরফাভাবে একটি বিপ্লবী/বেপরোয়া বিজ্ঞান হিসেবে হাজির করাও এর উদ্দেশ্য নয়। রাষ্ট্র-ব্যবস্থা বিবর্জিত সমাজ সম্পর্কে মানববিদ্যাগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে নৃবিজ্ঞানই সবচেয়ে বেশি ভেবেছে কিন্তু সেই ভাবনার বড় অংশই কানার হস্তীদর্শন… যেখানে রাষ্ট্র নেই সেখানে তারা কাল্পনিক আদিম বর্বরতা দেখেছে, আবার যেখানে উপনিবেশিক রাষ্ট্র পুরাদমে হাজির থেকে রাষ্ট্রবিহীন রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলোকে ধ্বংস করেছে সেখানে আধুনিক রাষ্ট্রের জলজ্যান্ত উপস্থিতিকেও তারা উপেক্ষা করে গেছেন। উদাহারণ হতে পারে ইভান্স প্রিচার্ডের ‘দি নুয়ের’। নুয়েরদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞানের এই ধ্রুপদী এথনোগ্রাফিটিতে তিনি সব বলছেন শুধু নুয়েরদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে আসলে রাষ্ট্রের বিপরীতে একটি বাস্তব, যৌক্তিক এবং নৈরাজ্যিক ব্যবস্থা এটা বাদে। আবার একই সাথে এই গোত্রগুলোর চারপাশ থেকে চেপে আসা আধুনিক রাষ্ট্রের ভৌতিক উপস্থিতিকেও তিনি নিজের লেখায় অনুপস্থিত রেখে দিচ্ছেন। আর সবচেয়ে বড় যে ঝামেলাটা উপনিবেশিক (উপনিবেশ কিন্তু কোন মৃত অতীত নয়) যুগের নৃবিজ্ঞানীরা বাধিয়েছেন তা হচ্ছে রাষ্ট্রবিহীন সমাজকে আদি, আদিম, এথনিক, ট্রাইবাল, উপজাতি ইত্যাকার নামে ডেকে মানুষের ইতিহাসকে বিবর্তনের অমোঘ সরল রেখায় সাজিয়ে দেখিয়েছেন যে রাষ্ট্র মানুষের ইতিহাসের অবিকল্প/অনিবার্য নিয়তি, এটাই একমাত্র কাম্য, এটাই স্বাভাবিক, এটাই সভ্যতার তথা মানূষের রাজনৈতিক ইতিহাসের শেষ গন্তব্য। ফলে নৃবিজ্ঞানও জান্তে বা অজান্তে বৃহদাংশে সেই কান্ডজ্ঞানের অংশ হয়ে গেছে যা মানুষকে ডান্ডা ও দন্ড ছাড়া সভ্য ভাবতে পারেনা।
অহিংস নাগরিক বিদ্রোহ, ওয়াল স্ট্রিট বিদ্রোহের যেটা মূল রাজনৈতিক কৌশল, সেটাকেও অদ্বিতীয়, অবিকল্প এবং সার্বজনীন নৈরাজ্যিক রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ভাবাটাও ঠিক নয়। আসলে নৈরাজের ধারণা মানুষের অচেতনের এমন গভীরে প্রোথিত যে সেটাকে শুধু তার রাজনৈতিক কৌশলের নিরীক্ষে বুঝতে যাওয়াটাও বোকামি। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, বা ঢাকা শহরে অনশন একটি কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে কারণ সেখানে মিডিয়া আছে, জনতা আছে, রাষ্ট্রের আইনি বাধ্য-বাধকতা আছে। কিন্তু ঝাড়খন্ডের জঙ্গলে রাষ্ট্রের হাতে নিষ্পেষিত আদিবাসীরা অনশন করে কোন রাজনৈতিক অর্জনে পৌছাতে পারবে না, কারণ তারা যে না খেয়ে আছেন সেটা দেখবার মতন কেউ নেই, কখনও ছিলও না। আদিবাসীদের মুক্তি আকাঙ্ক্ষা, স্বরাজের আকাঙ্ক্ষা সেখানে তাই মাও সে তুং এর বন্দুক হয়ে গর্জে উঠে।
ডেভিড গ্রেয়বারকে নিয়ে আমার প্রধানতম প্রেমানুভূতি হচ্ছে তিনি অতি সাধারণ, স্বাভাবিক, ক্ষুদে একজন মানুষ যিনি নিজের ছোট্ট কোণটিতে নিজের ছোট্ট কাজটা ঠিক-ঠাক মত করবার চেষ্টা করেন। ওয়াল স্ট্রিট বিদ্রোহের মত কান্ড ঘটানোর চতুর্থ দিনে বিরহ কাতর প্রেমিক হয়ে ছুটে যান নিউ ইয়র্ক থেকে অস্টিনে, বদ-মেজাজের জন্য চাকরি হারান, পঞ্চাশ বছর বয়সে এসে ফেল মারেন ড্রাইভিং টেস্টে। ওয়াল স্ট্রিট বিদ্রোহ থেকে সামাজিক আন্দোলনের ছাত্র হিসেবে আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল কিভাবে অরাজপন্থা অতি সাধারণ সব মানুষকেও ইতিহাসে তার ভূমিকা পালনের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়, কিভাবে ব্যক্তির আপাত সাধারণ গুণাবলিকেও ইতিহাস নির্মাণের কাজে লাগায়, কিভাবে ইতিহাসকে হিরোদের হাত থেকে উদ্ধার করে ছোট্ট ছোট্ট সাধারণ মানুষদের হাতে তুলে দেয়। অরাজপন্থা এ কারণেই আজকের সময়ের সবচেয়ে সম্ভবনাময় রাজনৈতিক অবস্থান কারণ তা রাজনীতির নামে ব্যক্তিকে সমাজের বোঝা না বানিয়েও তার সমস্ত সম্ভবনাকে কাজে লাগাতে পারে মুক্তির লড়াইয়ে। ব্যক্তি মানুষও মুক্তি পায় কর্তৃত্বের/নেতৃত্বের অভিশাপ থেকে। গ্রেয়বারের একটা ছবি খুঁজে টানিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল নোটে, পরে ভুল বোঝাবুঝির ঝুঁকি বিবেচনায় বাদ দিলাম। থাক না ছোট্ট মানুষেরা অনিন্দ্য সুন্দর সব মুখোশের আড়ালেই।
কিছু টেকনিক্যাল টার্ম আছে, আমি ফুটনোট দেয়াসহ নোটটার ঘষামাজা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করব। আর বানানের বিষয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আপাতত গত্যান্তর নাই।
ডেভিড গ্রেয়বার: ওয়াল স্ট্রিট দখল আন্দোলনের অ্যান্টি-লিডার
পরিচিত হউন এক নৃবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক কর্মী, ও নৈরাজ্যবাদীর সাথে যিনি এক অভাগা মিছিলকে একটি বৈশ্বিক প্রতিরোধ আন্দোলনে রুপান্তরিত হতে সহায়তা করেছেন।
ড্রেক বেনেত্তে
ডেভিড গ্রেয়বার বলতে পছন্দ করেন যে এ বছর আসলে তার লক্ষ্য ছিল তিনটাঃ নিজের বইয়ের বিক্রি-বাট্টা বাড়ানো, গাড়ি চালানো শেখা, এবং, বিশ্বব্যাপী একটা বিপ্লব শুরু করা। প্রথম কাজটা ভালই চলছে, দ্বিতীয়টা কঠিন লাগছে, এবং তৃতীয়টার ক্ষেত্রে, অগ্রগতি ভাল।
গ্রেয়বার একজন পঞ্চাশ বছর বয়সি নৃবিজ্ঞানী- কেউ কেউ মনে করেন নিজের প্রজন্মের উজ্জ্বলতমদের একজন- খ্যাত হয়েছেন বিনিময় ও মূল্য ব্যবস্থা নিয়ে উদ্ভাবনী তত্ত্বের জন্য, ‘ইরোকুইজ ওয়ামপুম’ বা ‘কোয়াকিটল পোটলাচ’র মতন নৃবৈজ্ঞানিক প্রপঞ্চ ঘেঁটে। মার্কিন নাগরিক, এখন শিক্ষকতা করেন ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের গোল্ডস্মিথ কলেজে। নৃবিজ্ঞানী ছাড়াও তিনি একজন নৈরাজ্যবাদী এবং আমূলপন্থী সংগঠক, গত কয়েক দশকের অনেকগুলো বড় বামপন্থী প্রতিরোধ আন্দোলনের লড়িয়ে; কুইবেক সিটি এবং জেনোয়া, নিউ ইয়র্ক এবং ফিলাডেলফিয়াতে রিপাবলিকান জাতীয় কনভেনশনে বিক্ষোভ, ২০০২ সালে নিউ ইয়র্কে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সভায় বিক্ষোভ এবং সর্বশেষ এ বছরের গোড়ায় লন্ডনের বর্ধিত ছাত্রবেতন বিরোধী বিক্ষোভে সক্রিয় ছিলেন। এই গ্রীষ্মে গ্রেয়বার ছিলেন ছোট্ট একদল রাজনৈতিক কর্মীদের একজন যারা প্রথমে নিঃশব্দে পরিকল্পনা করেছে, তারপর ঢোল পিটিয়ে দখল করেছে লোয়ার ম্যানহাটনের জুকত্তি পার্ক, তারপর অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট নামে এক আদলহীন বৈশ্বিক আন্দোলনের পাদ-প্রদীপ হয়ে উঠেছে।
গ্রেয়বারকে এই আন্দোলানের একজন নেতা বলা ভুল হবে, কারণ তাদের মধ্যে সার্বক্ষণিক চর্চিত কর্তৃত্বহীনতার দর্শন নেতৃত্বের ধারনাটাকেই বিদ্ঘুটে মনে করে। তিনি আন্দোলনের কোন মুখপাত্রও নন, কারণ এই আন্দোলন এখন পর্যন্ত কোন সুনির্দিষ্ট দাবি-দাওয়া পেশ করতে অস্বীকার করেছে। এমনকি, জুকত্তি পার্কেও তার নাম খুব বেশি লোকে জানে না। কিন্তু তিনি এই দলটির সবচেয়ে সুসংহত কণ্ঠস্বর গুলোর একজন যিনি আন্দোলনের আশা-নিরাশাকে ফ্রেমে তুলে ধরতে পারেন এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটির গভীরতর বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে। “আমরা যা দেখছি তা হচ্ছে এক নতুন আমেরিকান প্রজন্মের বিদ্রোহী আত্ম-সত্ত্বার সুচনা, এমন এক প্রজন্ম যারা দেখতে পাচ্ছে পড়াশুনা শেষ করে তাদের সামনে কোন চাকরি নেই, কোন ভবিষ্যত নেই, আছে শুধু বিশাল অংকের ক্ষমাহীন ঋণের বোঝা”। সেপ্টেম্বরের ২৫ তারিখে গার্ডিয়ানে লেখা এক উপসম্পাদকীয়তে তিনি লিখেছিলেন “এটা কি আসলে অবাক হওয়ার মত ব্যাপার যে তারা তাদের ভবিষ্যত চুরি করা অর্থকড়ির রাঘব-বোয়ালদের সাথে একটা ফয়সালা করতে চাইছে?”
গ্রেয়বারের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারনা কাঠামো পেয়েছে বৈশ্বিক ন্যায়বিচার আন্দোলনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, কিন্তু একই সাথে তা ঋদ্ধ হয়েছে তার জীবনের আরেক অংশ, নৃবিজ্ঞানী হিসেবে তার কাজের মধ্য দিয়ে। গ্রেয়বারের সর্বশেষ বই, ঋণঃ প্রথম ৫,০০০ বছর প্রকাশিত হয়েছে ওয়াল স্ট্রিট বিদ্রোহের দুই মাস আগে। বইটা টাকা ও বাজারব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশের একটি বিকল্প ইতিহাস; বিশাল বিস্তৃতি, গভীর বোঝা-পড়া, এবং চিন্তা নাড়া দেয়ার মত এক কাজ। পশ্চিম আফ্রিকার টিভ জনগোষ্ঠি থেকে শুরু করে প্রাচীন সুমেরীয় থেকে মধ্যযুগের আয়ারল্যান্ড থেকে আধুনিক আমেরিকা পর্যন্ত অজস্র সমাজের বরাত দিয়ে তিনি দেখাচ্ছেন কিভাবে ঋণের প্রতি মানুষের একটা অনিশ্চিত আচরণ কাজ করে, কিভাবে ঋণ একই সাথে বাধ্য-বাধকতা ও পাপ হিসেবে বিরাজ করে, কিভাবে একই সাথে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং শোষণ-নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। এই ইতিহাসের পথ পাড়ি দিতে দিতেই তিনি এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন কেন ইতিহাসজুড়ে বেশির ভাগ মানুষই ঋণ শোধ করা একটি নৈতিক দায়িত্ব মনে করে কিন্তু আবার একই সাথে মনে করে যে টাকা ধার দেয়া যাদের পেশা তারা শয়তান।
গ্রেয়বারের যুক্তিতর্কের ধারা তাকে সরাসরি অর্থশাস্ত্রের মূলসূত্রগুলোর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, এবং শাস্ত্রটি তাকে, মোটা দাগে, অবজ্ঞা করেছে। কিন্তু বইটা সাধারণ পাঠকদের মাঝে জনপ্রিয় হওয়ার জন্য এর চেয়ে মাহেন্দ্রক্ষণ আর কিছু হতে পারেনা। তার লেখালেখি তিনি যে আন্দোলনটার সূচনার সাথে জড়িত সেটাকে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো দিয়েছে, একে একটা ঐতিহাসিক গতিধারার সাথে যুক্ত করেছে। ওয়াল স্ট্রিট বিদ্রোহীদের অস্পষ্ট দাবি-দাওয়া দুইটা বিষয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে, এক. রাজনীতিতে টাকার প্রভাব; দুই. ঋণঃ বন্ধক, ক্রেডিট কার্ড, শিক্ষা ঋণ এবং তার সাথে বৃহৎ ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বড় ব্যক্তি ঋণ গ্রহীতাদের ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক ধ্বসের সময় যেভাবে আপ্যায়ন করা হয়েছে তার তুলনা।
“ও অনেক গভীর করে ভাবতে পারে, ও বরাবরই আন্দোলন আর বিপ্লবের ছাত্র”, বলছিলেন কালে লাসন, ভ্যাঙ্কুভারের কর্পোরেট বিরোধী ম্যাগাজিন অ্যাডবাস্টার্সে’র প্রতিষ্ঠাতা। সে হচ্ছে ওই টাইপের লোক যে বলবে, “আমরা যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি সেটা কি ১৯৬৮ সালের মত নাকি ফরাসি বিপ্লবের মত?”
গ্রেয়বার এটা ব্যাখ্যা করেন আরো বড় এক গল্পের অংশ হিসেবেঃ পুরা ইতিহাস জুড়েই ঋণ আসলে নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের সম্পদ হরণের রাষ্ট্রীয় হাতিয়ার (সাধারণত যুদ্ধে খরচ করবার জন্য) এবং ইতিহাসে যখনি যথেষ্ট পরিমান মানুষ যথেষ্ট পরিমান ঋণে নিমজ্জিত হয়েছে, তখনি সাধারণতঃ কোন না কোন ধরনের বিদ্রোহ হয়েছে।
গ্রেয়বার ছোট্ট-খাট্ট অস্থির ধরনের মানুষ, নীল চোখ, কিশোরসুলভ ফ্যাকাসে মুখ। স্নাতক শিক্ষার্থীদের মতন পোষাক-আশাক পড়েন, হড়বড় করে কথা বলেন, লম্বা যুক্তিমালার ফাঁকে ফাঁকে রাগে ফেটে পড়েন, ছেড়া-খোঁড়া হাসি দেন, দম নেওয়ার জন্য আবার একটু থামেন। কারো চোখে খুব একটা চোখ রাখেন না। একটা চিন্তা শেষ করার পর হাঁসের মত মাথা ঝাঁকান, ভুরু দিয়ে ধনুক বানান, যেন তিনি এইমাত্র একটা হালকা কিন্তু আশংকাজনক শব্দ শুনতে পেয়েছেন।
ওয়াল স্ট্রিট বিদ্রোহ শুরু হওয়ার চারদিন পর থেকে কয়েক সপ্তাহ গ্রেয়বার ছিলেন টেক্সাসের অস্টিনে, দীর্ঘ মাঠ-গবেষণা শেষে মেক্সিকো থেকে ফেরা সহ-নৃবিজ্ঞানী বান্ধবীর সাথে সময় দিতে। সেখানেও খানিকটা জড়িয়ে ছিলেন অকুপাই বিদ্রোহের দুনিয়ার বহু জায়গার মত স্থানীয় সংস্করণ ‘অকুপাই অস্টিনে’।
এই গ্রীষ্মটা গ্রেয়বার শুরু করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাবাটিকেল ছুটি নিয়ে লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্কে এসে, যেখানে প্রায়শই আড্ডা দিতে যেতেন ১৬বিভার নামের একটা ‘আঁতেল’দের আখড়ায়। এটা ছিল ওয়াল স্ট্রিটের পাশেই বুদ্ধিবৃত্তিক অ্যাক্টিভিস্টদের একটা আখড়া যেখানে লোকজন শব্দার্থবিজ্ঞান, ইন্টারনেট হ্যাকিং বা আদিবাসী সংগ্রাম নিয়ে কথা বলে। আরো অনেক আমেরিকান অ্যাক্টিভিস্টদের মতই গ্রেয়বারও গভীর নাড়া খেয়েছিলেন মিশরীয় জনতার তাহরির চত্বর দখল, এবং মাদ্রিদের কেন্দ্র দখল করা ‘ইন্ডিগনাদোস’দের দেখে। মধ্য জুলাইয়ের দিকে তিনি অ্যাডবাস্টার্সে একটা ছোট নিবন্ধ লেখেন এরকম একটা উত্থান পশ্চিমে ঘটানোর জন্য কি কি করা যায় সে নিয়ে। গরমের বেশিরভাগ সময়টা জুড়ে ১৬বিভারের আলোচনা ঠিক এই প্রশ্নকে ঘিরেই ঘুরপাক খায়। যখন ‘অপারেশন এম্পায়ার স্টেট রেবিলিওন’ নামের স্থানীয় একটি সংগঠন জুনের ১৪ তারিখে জুকত্তি পার্কে প্রথম দখল কর্মসূচীর ডাক দেয়, মাত্র চার জন লোক হাজির হয়েছিল সেখানে।
জুলাই ১৩ তারিখে অ্যাডবাস্টার্স তাদের আহবান জানায় ওয়াল স্ট্রিট দখলের, দিন ঠিক করা হয় দুই মাস পরের, সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখ। দিন ঠিক করা আর প্রচার চালানোই ছিল আন্দোলনে ম্যাগাজিনটির মূল সম্পৃক্তি। ‘নিউ ইয়র্কারস এগেইন্সট বাজেট কাট’ নামের একটি দল, কিছু ছাত্রকর্মী, এবং নগরীর গরিব পাড়া-মহল্লার কিছু নেতা এগিয়ে এলেন বাকি কাজকর্ম সামলানোর জন্য। জুন ও জুলাইয়ের তিন সপ্তাহজুড়ে শহরের বাজেট কাট এবং ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে তারা ক্যাম্প গেঁড়ে বসে থাকলেন সিটি হলের সামনের রাস্তার ওপারে, একটা ছোট্ট তাঁবুর শহর বানিয়ে যার নাম দিয়েছিলেন তারা ব্লুম্বার্গভিল। তারপর তাদের মনে হল এই একই কাজ করা যায় ওয়াল স্ট্রিটেও। অ্যাডবাস্টার্সে’র সাথে কথা বলে তারা একটি ‘সাধারণ্যের সমাবেশ’ বা ‘পিপল’স জেনারেল এসেম্বলির ডাক দিলেন “যে কোন ধরণের কাট-ছাঁট ও কৃচ্ছতা সাধনের” বিরদ্ধে, এবং পরিকল্পনা আঁটতে লাগলেন সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখের ‘দখল’ কর্মসূচী নিয়ে।
সমাবেশটা হওয়ার কথা ছিল শহরতলীর ম্যানহাটন পার্কের বোউলিং মাঠে যেখানে এই আন্দোলনের কারণে ইতিমধ্যে খ্যাতি পাওয়া নুড়ি পাথরে খুড় দাবড়িয়ে তেড়ে আসা ষাঁড়ের ভাস্কর্যটি দাঁড়িয়ে আছে। গ্রেয়বার এই সমাবেশটার খবর পেয়েছিলেন এবং আগস্টের ২ তারিখ বিকেলে তিনি বোউলিং মাঠে যান দুই বন্ধুকে নিয়ে, জিওর্জিয়া সাগ্রি নামের এক গ্রিক নৈরাজ্যপন্থী শিল্পী এবং সাবু কোহসো নামের এক জাপানি এক্টিভিস্ট (যিনি গ্রেয়বারের বইয়ের জাপানি অনুবাদকও)।
‘সাধারণ্যের সমাবেশ’ বা ‘পিপল’স জেনারেল এসেম্বলি’ কথাটি একজন নৈরাজপন্থীর কাছে বিশেষ অর্থ ও তাৎপর্য বহন করে। একভাবে ধরতে গেলে এটা সমসাময়িক নৈরাজপন্থার একটি কেন্দ্রীয় বিষয় যেটি দাঁড়িয়ে আছে এই ধারণার উপর যে বল-প্রয়োগ নির্ভর যে কোন বিপ্লবী আন্দোলনই নিপীড়নমূলক সমাজেরই জন্ম দেয়। ‘সাধারণ্যের সমাবেশ’ হচ্ছে খুবই সুচিন্তিত সতর্কতায় পরিচালিত একটি যৌথ আলোচনা পদ্ধতি যার মাধ্যমে সব সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় কোন গুটি কতক নেতার মাধ্যমে নয়, সংখ্যাগুরুত্বের জোরে নয়, যৌথ-মিমাংসা বা কনসেন্সাসের মাধ্যমে। অমিমাংশিত বিষয়গুলো তুলে দেয়া হয় জমায়েতের মধ্যেই ছোট ছোট ওয়ার্ক গ্রুপের হাতে, কিন্তু শেষতক সিদ্ধান্ত হতে হবে সর্বসম্মতিক্রমে, এমনকি জমায়েতের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে গেলেও। আপাত দৃষ্টিতে এটা খুব কঠিন সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া মনে হতে পারে, কিন্তু ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন যে অভিনব ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে সাধারণ্যের সমাবেশকে বিশালকায় জনস্রোতের মধ্যেও কার্যকর একটি পদ্ধতি হিসেবে প্রমাণ করা, এবং বিদ্রোহের স্বতন্ত্র সব চিহ্ন-ভাষা উদ্ভাবন করা যা ব্যবহার করে যে কোন অংশগ্রহণকারীই সরাসরি প্রশ্ন তুলতে, সমর্থন দিতে বা অসম্মতি জানাতে, এমনকি নির্জলা বিরোধিতা করতে পারেন।
কিন্তু গ্রেয়বার ও তার বন্ধুরা যখন আগস্টের দুই তারিখের সমাবেশে হাজির হলেন, তারা আবিস্কার করলেন যে আয়োজনটা যত না ‘সাধারণ্যের সমাবেশ’ তার চেয়ে বেশি একটা প্রথাগত মিছিল যা সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে কিছু পূর্ব-নির্ধারিত দাবি-দাওয়া নিয়ে ওয়াল স্ট্রিট অভিমুখে যাত্রা করবে (যার একটি ছিল “প্রাইভেট ও পাবলিক খাতে গণ-কর্মসংস্থান কর্মসূচী”, এবং অন্যটি ছিল “নিপীড়ন ও যুদ্ধের অবসান”)। নৈরাজপন্থার পরিভাষায়, আয়োজনটা পরিচালিত হচ্ছিল ‘উলম্বিক’ ভাবে, ‘আনুপূর্বিক’ সংগঠনের মত, গ্রেয়বার ও তার বন্ধুরা যেমন আশা করেছিলেন সে রকম ‘আনুভূমিক’ ভাবে নয়, এবং এটা দেখে গ্রেয়বার আর সাগ্রি ভীষণ ক্ষেপে গেলেন।
এরপর যা ঘটল তা যেন নৈরাজপন্থার একটি শিক্ষনীয় গল্প। কোহসোকে সাথে নিয়ে এই দুইজন আরো কিছু লোকজন জুটিয়ে ভিন্নমত আর অসন্তুষ্টি জানিয়ে চলে এলেন পার্কের আরেক কোনে এবং নিজেদের মত করে ‘সাধারণ্যের সমাবেশ’ শুরু করলেন, ১৭ সেপ্টেম্বরের কর্মসূচীর পরিকল্পনা শুরু করলেন। শুরুতে ডজন খানেক লোক থাকলেও আস্তে আস্তে এপাশে লোক বাড়তে থাকল, তাদের র্যালিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আয়োজকদের অনেক চেষ্টা স্বত্ত্বেও। এই দড়ি টানাটানি চলল সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত, কিন্তু শেষতক বোউলিং মাঠের অবশিষ্ট ৫০ জনের মত জমায়েতের সবাই যোগ দিলেন বিদ্রোহের ভিতরের বিদ্রোহীদের ‘সাধারণ্যের সমাবেশে’।
“ঐ মিছিলের আয়োজকরাও শেষ পর্যন্ত যোগ দিয়েছিলেন আমাদের সাথে”, স্মৃতি-চারণ করছিলেন কোহসো। “তারপর সবাই মিলে অনেক অনেক রাত পর্যন্ত আমরা পরিকল্পনা করেছি আমাদের কি কি কমিটি দরকার সে নিয়ে”।
যদিও পরের কয়েক সপ্তাহের প্রস্তুতি বাকি ছিল, কিন্তু সেদিন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জিত হয়েছিল। ঘটনাটা আনুভূমিকভাবে পরিচালনা, এবং সে অনুযায়ী যা যা করা প্রয়োজন তা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া। তার মধ্যে অন্যতম একটা সিদ্ধান্ত ছিল কোন নেতা, এমনকি পুলিশের সাথে দেন-দরবারকারী পর্যন্ত না রাখা, প্রাত্যহিক ‘সাধারণ্যের সমাবেশ’ ও তৎসংশ্লিষ্ট অগুনতি ওয়ার্ক গ্রুপের সভা করা যা এখনও জুকত্তি পার্কের প্রতিরোধ আন্দোলনের হৃৎপিন্ড হিসেবে কাজ করছে, এর থেকে দুনিয়া জুড়ে স্রোতস্বিনী হওয়া অন্য সব আন্দোলনেরও।
গ্রেয়বারের জন্য পরের দেড় মাস ছিল চরকির মত মিটিং করে বেড়ানোর সময়। তখন সাপ্তাহিক সমাবেশ হতো, প্রথমটি হয়েছিল ব্যাটারি পার্ক সিটির আইরিশ হাঙ্গার মেমোরিয়ালের কাছে, পরেরগুলো ইস্ট ভিলেজের টম্পকিনস স্কয়ার পার্কে। তিনি এর কয়েকটি সমন্বয় করেন নিজে, এবং বাকি সময়ের পুরোটাই দেন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে হওয়া বিভিন্ন কর্ম-দলের সভায়। (আগস্টের ১৪ তারিখে টুইটারে লিখেছিলেন, “আজ আমি ক্লান্তিতে নিঃশেষ। জীবনের প্রথম ড্রাইভিং ক্লাস, তারপর টম্পকিনস স্কয়ার পার্কে সভা পরিচালনা তিন ঘন্টা ধরে”)। তিনি আইনী ও স্বাস্থ্যগত প্রশিক্ষণ সংগঠিত করছিলেন, অহিংস প্রতিরোধ আন্দোলন বিষয়ে ক্লাস নিচ্ছিলেন বিরামহীন। কি কি দাবি-দাওয়া থাকবে বা আদৌ থাকবে কিনা এ নিয়ে সীমাহীন আলোচনা চলল, এমন এক প্রশ্ন যা এই কয়েক মাস পরেও অমিমাংসিতই থেকে গেছে।
সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখের ‘সাধারণ্যের সমাবেশে’ সিদ্ধান্ত হল দখলের লক্ষ্যবস্তু নিয়েঃ প্রথম পছন্দ চেজ ম্যানহাটন প্লাজা। বেশ কয়েকটি হাতের পাঁচও রাখা হল বিবেচনায়। ফলে দখল শুরু হওয়ার আগের রাত থেকেই পুলিশ যখন ম্যানহাটন প্লাজা ঘিরে রাখল, দখল-আন্দোলনকারীদের বিকল্প প্রস্তুতির কোন ঘাটতি দেখা দিল না। সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখে, নির্ধারিত সময় বিকেল তিনটার ঘন্টাখানেক আগেই প্লাজার পরিবর্তে জুকত্তি পার্কে যাওয়ার সিদ্ধান্ত মুখে মুখে ছড়িয়ে দেয়া হল, প্রায় ২০০০ লোক জড়ো হয়ে গেল এখন বিখ্যাত হয়ে যাওয়া জুকত্তি পার্কের পাথুরে চত্বর, নীচু বেঞ্চ আর গাছপালার ছায়ায় ছায়ায়। স্থান নির্বাচনটি আসলেই ভাগ্যের আশীর্বাদপুষ্ট কারণ জুকত্তি একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন পার্ক, ফলে শহর কর্তৃপক্ষের বিক্ষোভকারীদের উচ্ছেদ করবার কোন আইনী অধিকার নেই। সে রাতের সাধারণ সমাবেশটি সমন্বয় করেন গ্রেয়বার যেখানে সিদ্ধান্ত হয় এখুনি ওয়াল স্ট্রিট অভিমুখে যাত্রা না করে পার্কেই ক্যাম্প করে থাকবার। তিন দিন পরে, গ্রেয়বার যখন অস্টিনের উদ্দেশ্যে উড়াল দেন, বিক্ষোভটি ইতিমধ্যেই নিউ ইয়র্কের স্থানীয় একটি খবরের চেয়ে একটু বেশি কিছুই হয়ে উঠেছে।
গ্রেয়বার ১৬ বছর বয়স থেকেই নৈরাজপন্থী। তিনি বড় হয়েছেন নিউ ইয়র্কেই, আমূলপন্থী রাজনীতিতে ঠাসা চেলসিয়ার ট্রেড ইউনিয়ন অর্থায়িত একটি অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে। এক ইঁচড়ে পাকা শিশুর মতই, এগারো বছর বয়সেই তার গভীর আগ্রহ জন্মায় মায়ান হায়রোগ্লিফিক্সের নিয়ে। (এই প্রাচীন লিখন পদ্ধতিটির তখনও কেবল আংশিক পাঠোদ্ধার হয়েছে)। তিনি তার নিজের মৌলিক কিছু অনুবাদ পাঠালেন এ বিষয়ে সে সময়কার এক শীর্ষ স্থানীয় বোদ্ধার কাছে যিনি এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে গ্রেয়বারের জন্য একটি বৃত্তি যোগাড় করে দেন আনডোভারের মাস’র ফিলিপস একাডেমিতে।
গ্রেয়বারের জন্মের সময় তার বাবা-মার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, যার একটা বড় সময় তারা পার করেছেন ১৯৩০ দশকের বাম রাজনীতির স্বশিক্ষিত শ্রমিক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবি হিসেবে। গ্রেয়বারের মা ছিলেন একজন গার্মেন্টস কর্মী, এবং, খানিকটা তারকাও, যেহেতু আন্তর্জাতিক নারী পোশাক কর্মী ইউনিয়নের পৃষ্ঠপোষতার একটি মিউজিকেল কমেডির মুখ্য চরিত্রে রুপায়ন করতেন যা একই সাথে ব্রডওয়ে থিয়েটারেও জনপ্রিয় হয়েছিল। বাবা কাজ করতেন একটি অফসেট ছাপাখানার প্লেট কারিগর হিসেবে। তার বাবার আদি নিবাস ছিল কানসাস, স্পেনের গৃহযুদ্ধে তিনি রিপাবলিকানদের হয়ে লড়েছিলেন। নৈরাজপন্থীরা এই রিপাবলিকান মোর্চার অংশীদার ছিলেন এবং অল্প সময়ের জন্য হলেও তারা বার্সেলোনার নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছিলেন।
“বেশিরভাগ মানুষই নৈরাজপন্থাকে খারাপ ব্যাপার ভাবেনা, ভাবে যে এটা অবাস্তব পাগলামি”, গ্রেয়বার বলেন। “হ্যাঁ, এটা নিশ্চয়ই দারুণ চিন্তা যে কোন কারাগার, পুলিশ, কর্তৃপক্ষীয় ক্রম-নেতৃত্ব কাঠামো থাকবেনা, কিন্তু সবাই তো তখন খুনোখুনি শুরু করে দেবে। কাজেই এটা সম্ভব না তাই না?” কিন্তু গ্রেয়বারের বাবা স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় নিজে দেখেছিলেন যে এটা সম্ভব। “কাজেই এটা কোন পাগলামি ছিলনা। আমি এটাকে কখনও পাগলামি ভেবে বড় হইনি”।
অনেক বছর পরে, গ্রেয়বার যখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানের স্নাতক ছাত্র, তার মাঠ-গবেষণা তাকে খুব অন্য এক ধরনের নৈরাজ্যিক জনগোষ্ঠির সংস্পর্শে নিয়ে আসে। তার অভিসন্দর্ভ ছিল মাদাগাস্কারের বেটাফো নামের এক গ্রামীণ সমাজ নিয়ে যা ছিল অভিজাত বংশ আর তাদের দাসদের সমষ্টি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আই এম এফ) আরোপিত বাধ্যবাধকতার অংশ হিসেবে সরকারি ব্যয় সংকোচনের কারণে কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য হয় ঐ এলাকা থেকে সরে আসতে তার বাসিন্দাদের নিজ ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে। পরে যদিও এই ধরনের কাঠামোগত সংস্কার নীতির কঠোর প্রতিবাদ করেছেন তিনি, কিন্তু এটাও লক্ষ্য করতে ভোলেননি যে রাষ্ট্র তাদের পরিত্যাগ করে যাওয়ার পরে এই জনগোষ্ঠি একটি সাম্যবাদী সমাজ গড়ে তুলেছে যেখানে প্রায় ১০,০০০ লোক এক সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে প্রায় সর্বসম্মত বোঝাপড়ার মাধ্যমে। যখন দরকার পড়ে, অপরাধের বিচারের দায়িত্ব নেয় জনতারই একটি তাৎক্ষণিকভাবে সংগঠিত অংশ, কিন্তু তারপরও একটি সর্বসম্মত মিমাংশার দরকার পড়ে এখানেও, এমনকি অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝুলাতে হলে তার পিতা-মাতারও অনুমোদন লাগে।
১৯৯৯ সালে সিয়াটলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বিরোধী বিক্ষোভের আগ পর্যন্ত গ্রেয়বার সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হয়ে উঠেননি। সে সময় ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে তিনি অনুধাবন করতে থাকেন সারা জীবন যে ধরনের আন্দোলনে যুক্ত হতে চেয়েছেন তা এমন এক সময় শুরু হয়েছে যখন তিনি নিজের একাডেমিক ক্যারিয়ারের দিকে মনযোগ দেয়া শুরু করেছেন। “আপনি যদি এইসব বিষয়ে খুব নিবেদিত হন, তাহলে ঘটনা খুব দ্রুত ঘটতে থাকে”, গ্রেয়বার বলেন। “প্রথম কর্মসূচীতে এসে দেখবেন আপনি পুরা একজন বহিরাগত। আপনি বুঝতেই পারবেন না কি হচ্ছে। দ্বিতীয়বারেই কিন্তু আপনি সবকিছুই বুঝে ফেলবেন। তৃতীয়বারে, আপনি চাইলেই হয়ে উঠতে পারেন নেতৃত্বের কার্যকর অংশ। যে কেউ এখানে নেতৃত্ব দিতে পারেন তার যদি সময় ও শক্তি খরচের ইচ্ছা থাকে”।
সময়টা গ্রেয়বারের জন্য ছিল বিশেষ সুখের। নিউ হ্যাভেনে তিনি ছিলেন একজন বিদ্বান, এবং নিউ ইয়র্কে, যেখানে তিনি বেশিরভাগ সময়ই কাটাতেন, তিনি ছিলেন একজন নৈরাজপন্থী যেখানে তিনি নানান ধারার রাজনৈতিক কর্মী, শিল্পী-সাহিত্যিক, এবং বাউন্ডুলের দল, যারা নিজেদের ডাইরেক্ট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক নামে পরিচয় দেয়, তাদের মাঝে নতুন এক সমাজ খুঁজে পেয়েছিলেন। সেখানে বিক্ষোভ যেমন হতো তেমনি হতো বিশদ ব্যঞ্জণাময় উৎসবাদিও- ‘রিক্লেইম দা স্ট্রিট’ পার্টি অথবা সেই রাতগুলো, যখন সবাই এক সাবওয়ে ট্রেনে উঠে গোটা শহর জুড়ে হৈ হুল্লোড় করে বেড়ানোটাই কাজ।
যাই হোক, ২০০৫ সালে এই সুখের দিন শেষ হয়ে যায় যখন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় তার চাকরি পাকা হওয়ার আগেই তার নিয়োগ চুক্তি বাতিল করে দেয়। গ্রেয়বার এর বিরুদ্ধে আপিল করেন এবং তার মামলাটি ইয়েলসহ অন্যান্য জায়গার পেশাদার নৃবিজ্ঞানীদের দাবি হয়ে দাঁড়ায়। তিনি দাবি করেন যে তার চুক্তি বাতিল করবার পেছনে অন্ততঃ আংশিক কারণ হিসেবে কাজ করেছে তার রাজনৈতিক সক্রিয়তা। যদিও অনেকে মনে করেন আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে ঠিক সে ধরনের একটি কর্তৃত্বপরায়ণ প্রতিষ্ঠান দার্শনিকভাবে গ্রেয়বার যার ঘোর বিরোধী এবং মেজাজ-মর্জির দিক থেকে একদমই অনুপযুক্ত।
“তার ব্যক্তিগত স্টাইল নিয়ে কিছু ঝামেলা ছিল, প্রশ্ন ছিল সে ডিপার্টমেন্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের জৈষ্ঠ সহকর্মীদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল কিনা তা নিয়ে। মচকানোর মত মোলায়েম লোক হিসেবে তার খুব একটা সুনাম ছিলনা”, স্মৃতি চারণ করছিলেন থমাস ব্লম হানসেন, স্টানফোর্ডের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ইয়েলে গ্রেয়বারের সেই সময়ের সহকর্মী। “আমি মনে করিনা সে যে তার নিজের ক্ষেত্রে প্রধানতম একজন নৃবিজ্ঞানী সে বিষয়ে কারো কোন সন্দেহ আছে”, তিনি আরো যোগ করেন। “কিন্তু সে আসলেই আমাদের একাডেমিক জীবনের ক্রমবর্ধিষ্ণু অংশ হয়ে উঠা একঘেঁয়ে প্রশাসনিকতায় কোন আগ্রহ খুঁজে পেত না”।
অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনটি সূচনার সাথে যুক্ত সবাই, গ্রেয়বার থেকে শুরু করে অ্যাডবাস্টার্সের সম্পাদকরা বা ‘বাজেট হ্রাস বিরোধী নিউ ইয়র্কবাসী’ পর্যন্ত সবাই হতবাক হয়েছেন এর সাফল্যে। আমেরিকার বামপন্থী সক্রিয়তার জগৎ সাধারণত প্রগতিবাদী ও শান্তিবাদী, নাগরিক মুক্তিবাদী ও মার্ক্সবাদী, আদর্শবাদী বা বাস্তববাদীদের মিলিত জগা-খিচুড়ি এবং প্রায়শই পারস্পরিক দ্বন্ধ্ব আর ভুল-বোঝাবুঝিতে পরিপূর্ণ থাকে। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের অভিনব দিক হচ্ছে এই আন্দোলন এই প্রবণতা স্বত্ত্বেও গড়ে উঠা কোন আন্দোলন নয়, বরং এই প্রবণতার কারণে গড়ে উঠা একটি আন্দোলন। নিজের বিবেচনায় গ্রেয়বার এই সাফল্যের কৃতিত্ব পরিকল্পনাকারীদের নয়, বরং দেন খানিকটা ভাগ্যকে, যথোচিত সময় নির্বাচনকে, এবং সর্বোপরি দেশটিতে ফুঁসে উঠা ক্ষোভ আর হতাশাকেঃ “খুব হাতে গোনা কিছু চাকরি আছে বাজারে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিশ্চল হয়ে আছে মাটিতে, আর ব্যক্তি হিসেবে, জাতি হিসেবে আমরা নিমজ্জিত হচ্ছি ঋণে”।
ঋণ নিয়ে গ্রেয়বারের সমস্যা বা আপত্তি শুধু এই নয় যে মাত্রারিক্ত ঋণ খারাপ। ঋণের আরো মৌলিক সমস্যা হচ্ছে, নিজের বইয়ে তিনি লিখেছেন, একে অপরকে সাহায্য করবার যে সহজাত মানবিক প্রবৃত্তি, ঋণের বিস্তার সেটাকে বিকৃত করে ফেলে। অর্থশাস্ত্রের বইগুলো আমাদের বোঝায় যে টাকা ও বাজারের উদ্ভব হয়েছে মানুষের “পরিবহন ও বিনিময়ের” প্রবণতার কারণে, যেমনটা বলে গেছেন অ্যাডাম স্মিথ। টাকা আসবার আগে, স্মিথ যুক্তি দেন, মানুষেরা সাতটা মুরগির সাথে একটা ছাগল বিনিময় করতো, বা এক জোড়া সেন্ডেলের বিনিময়ে এক বস্তা শস্যদানা। তারপর কিছু কারবারি আর ব্যবসায়ী ভাবলেন যে বিনিময়ের জন্য যদি সাধারণ কোন মাধ্যম থাকে তাহলে সব কিছু খুব সহজ হয়ে যায়, সেটা রুপাই হোক বা ওয়ামপুমই হোক। এই গল্পের ঝামেলা হচ্ছে, যা কয়েক যুগ ধরে নৃবিজ্ঞানীরা বলার চেষ্টা করছেন, এরকম কোন কিছু আদৌ কখনো ঘটেছে বলে বৈজ্ঞানিক কোন প্রমাণ নেই। “বিনিময় অর্থনীতির কোন নিখাদ ও সরল কোন উদাহারণ আজ পর্যন্ত নৃবিজ্ঞানে বর্ণিত হয়নি, সেখান থেকে টাকার উৎপত্তি তো দুরের ব্যাপার”, গ্রেয়বারের দেয়া এক উদ্ধৃতিতে বলছেন নৃবিজ্ঞানী ক্যারোলিন হামফ্রে।
টাকা বিহীন সমাজের লোকেরা বিনিময় করে না, যদি না তারা একদম অপরিচিত বা শত্রু কারো সাথে কারবার করছে। তার বদলে তারা একজন আরেকজনকে জিনিসপত্র এমনি দিয়ে দেয়, কখনো কখনো অর্ঘ্য হিসেবে, কখনো ভবিষ্যতে কোন কিছু পাওয়ার আশায়, আবার কখনো কখনো একদম সাদামাটা উপহার হিসেবে। সেই অর্থে, বিনিময়কে সহজ করবার জন্য টাকার উদ্ভব ঘটেনি, বরং এর প্রচলন ঘটে প্রাচীন মিশরের মতন রাষ্ট্র বা সুমেরুর মন্দির কেন্দ্রিক আমলাতন্ত্রের হাতে যাতে করে মানুষের কর পরিশোধের বিষয়টি নির্ঝঞ্জাট হয়, অথবা মালিকানাধীন সম্পদের পরিমান নিরুপণ সহজ হয়। এই প্রক্রিয়াতেই তারা প্রচলন ঘটায় মূল্য ধারণার, ব্যক্তি নিরপেক্ষ বাজার-ব্যবস্থার, যা ক্রমশঃ পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার জৈব-জালটিকে গ্রাস করে ফেলে।
এই হচ্ছে আক্ষরিক অর্থে প্রাচীন ইতিহাস। তো, এতে কি যায় আসে? অনেক কিছুই যায় আসে, কারণ, টাকা, গ্রেয়বার যুক্তি দিচ্ছেন, পারস্পরিক বন্ধন আর কর্তব্যবোধকে, যা কিনা নিখাদ সামাজিক বিষয়, তাকে ঋণে পরিণত করে, যা কিনা পুরাপুরি অর্থনৈতিক বিষয়। ঋণ পরিশোধের গুরুত্ব বিষয়ক যে ধারণা আমাদের মাথার ভেতর কাজ করে তা আমাদের পরস্পরের প্রতি যে মমত্ববোধ তাকে বিনষ্ট করে। ঋণ পবিত্র কোন ব্যাপার নয়, কিন্তু মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক পবিত্র।
আমারা যদি ঋণের সামাজিক উৎস বুঝতে পারি, গ্রেয়বার বলেন, আমাদের চিন্তার শর্তাবলি বদলে যাওয়ার সাথে সাথে আমরাও আরো বেশি বেশি আগ্রহী হয়ে উঠব নিজেদের ঋণ, বন্ধক, ক্রেডিট কার্ড, শিক্ষা ঋণ, বা গোটা জাতির ঋণকেই পুনর্বিবেচনা করবার জন্য। চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় নেওয়া মরিয়া পদক্ষেপগুলো যদি কিছু দেখিয়ে থাকে তা হচ্ছে, গ্রেয়বারের মতে, আমরা স্বেচ্ছায় কোন প্রতিষ্ঠানের ঋণ মওকুফ করে দিতে রাজি যদি প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ হয়।
শেষ বিচারে, অন্ততঃ তাত্ত্বিকভাবে, সার্বভৌমত্বের মালিক হচ্ছে জনগণ। সে বিচারে আমরাই ব্যাংককে টাকা বানানোর অধিকার দেই আমাদেরই সেই টাকা ঋণ দেয়ার জন্য, গ্রেয়বার বলেন। “আমরা এ জিনিস বানিয়েছি একসাথে, কাজেই আমরা চাইলেই সবকিছু ভিন্ন ভাবেও করতে পারি”।
গ্রেয়বারের বই তার সহ-নৃবিজ্ঞানীদের মাঝে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে, এবং এটা সেই বিদ্যাজগতের বাইরেও যথেষ্ট মনযোগ পেয়েছে। (যদিও মান্ডি হ্যাঙ্কের মতে, ইন্ডিয়ানার এক লাইব্রেরিয়ান যিনি জুকত্তি পার্কে রাতারাতি গড়ে উঠা লাইব্রেরিটি দেখাশুনা করছেন, গ্রেয়বারের বইয়ের কপিগুলো সেখানে খুব একটা ব্যবহৃত হচ্ছে না)। মূলধারার কয়েকজন অর্থনীতিবিদও তার ধারণাগুলোর সাথে পরিচিত। জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টাইলার কোয়েন, যিনি ঘটনাক্রমে একই সাথে একজন বহুল পঠিত ব্লগারও, তাদেরই একজন।“সে মানুষজনের মধ্যে খানিকটা জ্ঞান সেঁধিয়ে দিতে পারে, এবং আমি মনে করি সেই ঠিক আছে, অ্যাডাম স্মিথ ভুল করেছিলেন”, তিনি বলেন। তারপরও কোয়েন, যিনি নিজে একজন মুক্তিপন্থী, গ্রেয়বারের রাজনীতি তাঁকে কমই আকৃষ্ট করেছে। তিনি আধুনিক রাষ্ট্রের কোন বিকল্প কিছু দেখতে পান না। “সোমালিয়ার দিকে তাকান, যদি কোন শুন্যতা থাকে, কিছু না কিছু সেটাকে পূরণ করবেই”।
তিনি হয়তো জুকত্তি পার্কের ঢোল বাজানো লোকদের প্রতিও আঙ্গুল তুলতে পারেন। ঢোলের বিরামহীন বাড়ি, যা ছিল অকুপাই আন্দোলনের আবহ সংগীত, তাই আবার একগাদা শব্দ দূষণের অভিযোগ নিয়ে এসেছে যা অন্যথায় সমর্থন দেয়া কমিউনিটি বোর্ড এবং এর নির্বাচিত কর্মকর্তাদের ধৈর্য্য পরীক্ষা নিয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে সাধারণ্যের সমাবেশে নানা যুক্তি-তর্ক করেও কিছু ঢোল বাজিয়েকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে বাজানোর বিষয়ে রাজি করানো যায়নি, কিন্তু সংগঠকরা আশা করছেন অক্টোবরের ২৫ তারিখের একটি মতভেদ নিরসন সভায় এটির ফয়সালা হয়ে যাবে।
বইয়ের শেষ দিকে, গ্রেয়বার একটি নীতিগত পরামর্শ দেনঃ একটা বাইবেল-স্টাইলের “জুবিলি”, সকল আন্তর্জাতিক ও ভোক্তা ঋণ মওকুফ। এধরনের জুবিলি আজকের আধুনিক যুগে অচল হলেও প্রাচীন ব্যাবিলন, এসিরিয়া, এবং টলেমিজের অধীনের মিশরে এটা ছিল একটা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। শাসকেরা জানতেন অজন্মার বছরগুলোতে ঋণগ্রস্থ কৃষকদের “জুবিলি” না দেয়ার অর্থ হচ্ছে দাঙ্গা-হাঙ্গামা। “স্বাধীনতা শব্দটা সবচেয়ে প্রাচীন যে রাজনৈতিক দলিলে পাওয়া যায় তা হচ্ছে একজন সুমেরীয়ান রাজার ঋণ মওকুফের ঘোষণা দেয়ার কাগজ”। “এটা অভিবাদনযোগ্য একটা ব্যাপার হবে”, গ্রেয়বার লিখছেন, “শুধু এই কারণে নয় যে এটা মানুষের অনেক অনেক দুঃখ-দুর্দশা কমাবে, এজন্যও যে এটা আমাদের নিজেদেরকে নিজেরাই মনে করিয়ে দেয়ার উপায় যে টাকা বর্ণনাতীত কোন ব্যাপার না, কারো ঋণ শোধ করার মূলে নীতি-নৈতিকতার ব্যাপার নাই, বরং এই সব কিছুই মানবিক আয়োজনের অংশ এবং গণতন্ত্রের যদি কোন মানে থাকে তাহলে তা হচ্ছে এই পুরো আয়োজনকে ভিন্নভাবে সাজানোর জন্য আমাদের সকলের একমত হওয়ার সামর্থ্য। (কারেন ওইয়েজ’র রিপোর্টিংসহ)