- সেলিম রেজা নিউটন
চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানবীয় সামগ্রিক স্বাধীনতার পূর্বশর্ত। কর্তৃত্ববাদী শাসন এই স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে শুধু সমাজকে নিশ্চলই করে না, তার বিমানবিকীকরণ ঘটায়। বাংলাদেশে জন্মলগ্ন থেকে প্রবহমান শাসনপ্রণালীর গঠন কাঠামো ও চর্চা তাকে পরিণত করেছে সর্বস্বৈরতন্ত্রে। এই সর্বস্বৈরতন্ত্রের সাম্প্রতিক সংযোজন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। অরাজ এই আইনকে সর্বস্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রবাদের অন্যতম নিয়ন্ত্রণমূলক শুঁড় মনে করে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ একগুচ্ছ আইন রাষ্ট্রকে দিয়েছে নাগরিকের প্রাইভেসিতে হানা দেয়ার ক্ষমতা। সার্বক্ষণিক নজরদারিকে দেয়া হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি। সেলিম রেজা নিউটন বিশ্বব্যাপী চলতে থাকা গণনজরদারির রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করেছেন বর্তমান প্রবন্ধে। একই সঙ্গে হাজির করেছেন প্রাইভেসি রক্ষায় বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা নানা তৎপরতা ও আন্দোলনের পর্যালোচনা। লেখাটি প্রথমে অচেনা দাগ গ্রন্থে সংকলিত হয়।
প্রাইভেসি, সিক্রেসি, ট্রান্সপারেন্সি, ট্রাস্ট
নিজেকে আমরা কার সামনে কতটুকু উন্মুক্ত করব, কতটুকু উলঙ্গ করব, সেটা আমাদের যার যার নিজস্ব ব্যাপার। এই নিজস্বতাটুকুর নাম প্রাইভেসি। উলঙ্গ হতে কি কেউ চায়? সদর রাস্তায়? প্রাইভেসি মানে তাই আব্রু। ব্যক্তিগত আব্রু। ব্যক্তির আব্রু। প্রাইভেসিকে সাধারণত ‘গোপনীয়তা’র সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়। ‘গোপন’ শব্দটার সাথে প্রাইভেসির ধারণা মেলে না। ‘গোপন’ কথাটার মধ্যে কেমন জানি লুকানো লুকানো একটা ব্যাপার আছে। যেন কিছু একটা অকাজ-অপরাধ করে লুকাতে চাওয়া হচ্ছে। কেমন এক ধরনের চোর চোর ভাব। প্রাইভেসি জিনিসটা মোটেও তা নয়। একদমই না।
প্রাইভেসির প্রকৃত অর্থ আসলে ‘আব্রু’। প্রাইভেসি হলো এমন একটা অবস্থা যেখানে একটা মানুষকে অন্যরা পর্যবেক্ষণ করে না, বিরক্ত করে না (অক্সফোর্ড ডিকশনারিজ ডট কম)। এটা একটা মানুষের একা থাকার অবস্থা (কেম্ব্রিজ ডিকশনারিজ অনলাইন: ডিকশনারি ডট কেম্ব্রিজ ডট অর্গ)। এটা এমন একটা অবস্থা যেখানে একটা মানুষ একা থাকতে সক্ষম হয়। অন্যে তাকে দেখে না। তার কথা শোনে না। গণমনোযোগের হাত থেকে মুক্ত এরকম একটা অবস্থার নাম প্রাইভেসি (লংম্যান ডিকশনারি অফ কনটেম্পোরারি ইংলিশ: এলডিওসিই অনলাইন ডট কম।) প্রাইভেসি হলো স্বাধীনতা। অন্য লোকের নজরদারির বাইরে, জানার বাইরে, কাজকর্ম করার স্বাধীনতা। (ম্যাকমিলান ডিকশনারি ডট কম)
কথা প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি বা স্বচ্ছতার কথাও আসতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে যাবতীয় কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা আবশ্যক। প্রতিষ্ঠান বলতে এখানে এমনসব রাষ্ট্রীয়-আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে বুঝতে হবে যাদের সিদ্ধান্তে-কর্মকাণ্ডে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ তথা জনসাধারণ লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কর্তৃত্বতান্ত্রিক এসব প্রতিষ্ঠান অন্যদের ওপর, অন্তত নিজেদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর, শাস্তি-পুরষ্কার ইত্যাদি চাপানোর ক্ষমতাও রাখে। যেমন রাষ্ট্র, নানান রাষ্ট্রীয় সংস্থা-সংগঠন-প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, বৃহৎ ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া ইত্যাদি। এইসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা জরুরি।
পরিবারও একটা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু পরিবারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অর্থ আলাদা। এখানে স্বচ্ছতা মানে সবার সামনে উদোম হওয়া না। বেআব্রু হওয়া না। ব্যক্তির বেলায়ও তাই। ব্যক্তির স্বচ্ছতা বলতে সদর সড়কে উলঙ্গ হয়ে হাঁটা বোঝায় না। তবে হ্যাঁ, প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানগত কর্মকাণ্ডসমূহের স্বচ্ছতা আবশ্যক তো বটেই বটে। সেটা আদতে প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতারই প্রশ্ন।
তার মানে, স্বচ্ছতা দরকার প্রতিষ্ঠানের। আর ব্যক্তির দরকার ট্রান্সপারেন্সি নয়, ট্রাস্ট। বিশ্বস্ততা। নিজের প্রতি বিশ্বস্ততা। অন্যের প্রতি বিশ্বস্ততা। বিশ্বস্ততা হলো পারস্পরিক বোঝাপড়া। পারস্পরিক স্বাধীনতা। পারস্পরিক স্বরাজ। প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রাইভেসির প্রশ্ন নাই। প্রতিষ্ঠানের দরকার জবাবদিহিতা। ব্যক্তি-মানুষের কোনো ট্রান্সপারেন্সির প্রশ্ন নাই। ব্যক্তি-মানুষের দরকার প্রাইভেসি। ব্যক্তিগত আব্রু।
ইন্টারনেটের স্বাধীনতা রক্ষায় তৎপর মানুষজনকে ধন্যবাদ দিতে হয়। কেননা তাঁরা ‘সিক্রেসি’র সাথে ‘প্রাইভেসি’র পার্থক্য বিবেচনায় নিয়েছেন। প্রাইভেসি হলো আব্রু। প্রাইভেসি তাঁদেরই দরকার, যাঁরা বেআব্রু হতে চান না। আর গোপনীয়তা দরকার ক্রিমিন্যাল কর্মকাণ্ডের জন্য। গোপনীয়তা দরকার অপরাধীচক্রের। ক্রিমিন্যাল লোকজনের। যারা অন্যের ক্ষতি করে করতে চায়। সবাই জেনে গেলে তাদের কর্মকাণ্ড চালানো অসম্ভব। এই গোপনীয়তাই হলো ‘সিক্রেসি’। প্রাইভেসিকে যাঁরা গোপনীয়তা বলেন তাঁরা আসলে সিক্রেসির সাথে প্রাইভেসির পার্থক্য খেয়াল করেন না। কিংবা করতে চান না। না করলে তাঁদের সুবিধা হয়।
গোপনীয়তার সাথে নিতান্ত যদি মেলাতেই হয়, প্রাইভেসিকে তাহলে বড়জোর ‘ব্যক্তিগত গোপনীয়তা’ বলা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সিক্রেসি হলো প্রাতিষ্ঠানিক গোপনীয়তা। গোপনীয়তা ছাড়া প্রতিষ্ঠান বাঁচে না। কোকাকোলার ফর্মুলা মাত্রেই গোপন। প্রতিটা প্রতিষ্ঠান গোপনীয় সিদ্ধান্ত, আচরণ, তথ্যের আস্ত একেকটা স্তূপ।
সুতরাং সর্বপ্রথম, গোপনীয়তা দরকার রাষ্ট্রের। সরকারের। রাষ্ট্র-প্রধান, সরকার-প্রধান আর মন্ত্রী-বাহাদুরদের তাই ‘গোপনীয়তার শপথ’ই নিতে হয়। সাংবিধানিকভাবে। সরকারের কর্মকর্তাদেরকেও নিতে হয় গোপনীয়তার এই শপথ। অনেক সময় গোপন চুক্তিও করতে হয় সরকারকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে। সরকার এমন আরো অনেক কাজ করে, যা সবাই জানলে ঐসব কাজ করা মুশকিল হয়ে যাবে। অসম্ভব হয়ে যাবে। জানাজানি হয়ে গেলে মানুষ বাধা দেবে। করতে দেবে না ঐসব কাজ। বিক্ষোভ হবে। প্রতিবাদ হবে। নানা কিছু হবে। সরকার অচল হয়ে যাবে। তাই তাদেরকে কাজ করতে হয় গোপনে। গোপনীয়তা দরকার তাই সরকারের।
একই কারণে গোপনীয়তা দরকার রাজনৈতিক দলগুলোর। সেনাবাহিনীর। বিশ্ববিদ্যালয়-সিন্ডিকেটের। রাষ্ট্রের মতোই, যেকোনো আমলাতন্ত্রের মতোই, তারা তাদের সিদ্ধান্তগ্রহণপ্রক্রিয়া ও বিশেষ বিশেষ সিদ্ধান্ত গোপন রাখে। হ্যাঁ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েরও একটা ‘গোপনীয় শাখা’ আছে। এবং এভাবে গোপনীয়তা দরকার কর্পোরেট বাণিজ্যগোষ্ঠীগুলোর। বড় বড় বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠানগুলোর। এসবের মধ্যে মিডিয়াও পড়ে। গোপনীয়তা দরকার মিডিয়ারও। রাষ্ট্র-পার্টি-কর্পোরেট ও মিডিয়া কী প্রকাশ করে তার চেয়ে জরুরি হলো এরা কী গোপন রাখে। কী এরা প্রকাশ করে না। অন্যের কিছু না কিছু ক্ষতি না করে এরা নিজেদের মঙ্গল সাধন করতে পারে না।
গোপনীয়তা আমাদের দরকার নাই। আমরা যারা সাধারণ মানুষ। নাগরিক মাত্র। আমরা অপরাধী নই। ক্রিমিন্যাল নই। অন্যের ক্ষতি করার কাজে আমরা নিয়োজিত নই। আমাদের গোপন করার কিছুই নাই। আমাদের লুকানোর কিছু নাই। কিন্তু আমাদের আড়ালের দরকার আছে। কখনও কখনও। কম অথবা বেশি। যার যার বিবেচনা মতো। সবার সামনে আমরা আমাদের জামাকাপড় ছাড়ি না। সবার সামনে আমরা মলত্যাগ করে আরাম পাই না। সবার সামনে আমরা সঙ্গম করি না। এসব কাজ ষড়যন্ত্রমূলক নয়। অপরাধমূলক নয়। বৈধ। স্বাভাবিক। প্রাকৃতিক। তবু এগুলোর জন্য আমাদের একটু আড়াল দরকার হয়। ব্যক্তির এই আড়ালটুকুর নাম আব্রু। আমরা একটু আড়াল চাই। আব্রু চাই। প্রাইভেসি চাই। সবাই।
আব্রু একটা পুরাতন ব্যাপার। স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক, চিরন্তন ঘটনা। প্রাইভেসি বা আব্রু বলতে বোঝায় মর্যাদা, মানসম্ভ্রম, সম্মান, ইজ্জত, আবরণ, পর্দা, অন্তরাল, এবং আড়াল[১]। আব্রুই প্রাইভেসি। প্রাইভেসি হচ্ছে একটা মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত আড়াল। ইন্টারনেট-পরিসরের জন্য প্রাইভেসি যা, অন্যান্য পরিসরের জন্যও তাই।
দোকান থেকে আলু-পটল-ডিম-কনডম-অন্তর্বাস কিনে আমরা বাসায় নিয়ে আসি ব্যাগে করে। প্যাকেটে করে। ব্যাগে আমরা বোমা-অস্ত্র-মাদ্রকদ্রব্য বহন করছি, তা কিন্তু নয়। তবু ব্যাগটা ব্যবহার করি কেন? কারণ আমরা আব্রু চাই। স্বভাবত। আমরা প্রাইভেসি চাই। নিজ নিজ বিবেচনা মতো। কেন আমরা আমাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ব্যাগে করে বহন করি, এই অভিযোগে কি রাষ্ট্র আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারে? আমাদেরকে আটক করতে পারে? অপরাধী বানাতে পারে? পারে না। কারণ প্রাইভেসি চিরবৈধ একটা ঘটনা। ব্যাগটা আর প্যাকেটটা আমাদের আড়ালের নিশ্চয়তা দেয়। প্রাইভেসির নিশ্চয়তা দেয়। এই নিশ্চয়তাটুকু আমাদের স্বাভাবিক অধিকার।
অনলাইন প্রাইভেসি এবং ক্রিপ্টোগ্রাফি
সনাতন ডাকযোগাযোগের বেলায় ব্যক্তিগত আব্রুর এই নিশ্চয়তাটুকু অক্ষুণ্ণ ছিল। এখনও আছে। ডাকঘরের মাধ্যমে যোগাযোগ করার সময় এতকাল ধরে আমরা খাম ব্যবহার করেছি কেন? শুধুমাত্র পোস্টকার্ড ব্যবহার করি নি কেন? সব সময় করি না কেন? কারণ আমরা চাই না আমাদের চিঠি সবাই পড়ুক। আমরা চাই না আমাদের কথা যেকেউ তাদের খেয়ালখুশি মতো জানুক। আমরা নিজেদের আব্রু চাই। প্রাইভেসি চাই। আমরা তাই আমাদের চিঠিটাকে একটা খামের মধ্যে ভরে পাঠাই। তার মানে এই না যে আমাদের ঐ সব চিঠির মধ্যে মারাত্মক সব অপরাধের পরিকল্পনা লেখা ছিল। ইন্টারনেট-পরিসরে তাহলে কেন আমি আমার ইমেইল ন্যাংটা করে পাঠাতে বাধ্য হবো?
প্রশ্ন হলো: ইন্টারনেট-পরিসরে আমার ইমেইলটাকে আমি একটা খামে বা এনভেলপে ঢোকাবো কীভাবে? আমার চিঠির এবং যাবতীয় যোগাযোগের প্রাইভেসির ব্যবস্থা করব কীভাবে? উত্তর হলো: ক্রিপ্টোগ্রাফির মাধ্যমে। ক্রিপ্টোগ্রাফি কথা এসেছে গ্রীক থেকে। গ্রীক ভাষায় ‘ক্রিপ্টো’ মানে লুকানো, গুপ্ত। আর ‘গ্রাফি’ অর্থ লিখন। তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতিতে দুজন ব্যক্তির মধ্যে নিরাপদ যোগাযোগের কলাকৌশল নিশ্চিত করার বিদ্যার নাম ক্রিপ্টোগ্রাফি।
কম্পিউটার-প্রযুক্তির যুগে ক্রিপ্টোগ্রাফি আবির্ভূত হয়েছে সফটওয়ার হিসেবে। পিজিপি, টর, পিজিন, ওটিআর অরবট, গিবারবট, বিটকয়েন ইত্যাদি প্রভৃতি সফট-ওয়ারের সামনে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলো রীতিমতো অসহায় বোধ করছে। এইসব সফটওয়ার নিজেরা কিন্তু কোনো গুপ্তলিপি নয়। এগুলো সব ওপেনসোর্স সফটওয়ার। এদের নিজেদের পূর্ণাঙ্গ সফটওয়ার কোড বা সংকেতলিপি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে।
এইসব সফটওয়ার রচনা করেছে সাইফারপাঙ্কস-আন্দোলনের সফটওয়ার-রচনাকারীরা। এবং তাঁরা এগুলো বিতরণ করেছে বিনামূল্যে। ইন্টারনেট-পরিসরে। সাইফারপাঙ্কস-আন্দোলনের জন্ম খোদ ইন্টারনেটের জন্মের যুগে। ১৯৮০-র দশকের শুরুতে। ইন্টারনেটের তখন সূচনা ঘটছে মাত্র। ইন্টারনেট তখন সামরিকবাহিনীর এবং তাঁদের সাথে সংশ্লিষ্ট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একচেটিয়া প্রযুক্তি। ঠিক তখনই জন্ম নেয় সাইফারপাঙ্কস। নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলতে শুরু করে ইন্টারনেট-যোগাযোগ। শুরুতে নিজস্ব ইমেইল-লিস্টের মাধ্যমে। সেই ইমেইল-যোগাযোগ শুরু থেকেই ছিল ক্রিপ্টোগ্রাফিক সফটওয়ারকে ভিত্তি করে আত্মসংগঠনে গড়ে ওঠা।
সাইফারপাঙ্কসদের আন্দোলন আদতে ক্যালিফোর্নিয়া কেন্দ্রিক লিবার্টারিয়ান অ্যানার্কির একটা ধারা। মধ্য আশিতে প্রকাশিত হয় এঁদের ‘ক্রিপ্টোঅ্যানার্কিস্ট ম্যানিফেস্টো’ (টিমোথি মে, ‘ক্রিপ্টোঅ্যানার্কিস্ট ম্যানিফেস্টো’– পিটার লাডলো, ২০০১)। সাইফারপাঙ্কস-আন্দোলন মনে করে, অপ্রতিরোধ্য ক্রিপ্টোগ্রাফিক সফটওয়ার রচনা এবং ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের আগ্রাসনকে প্রতিহত করা সম্ভব। সম্ভব ব্যক্তির প্রাইভেসি ও স্বাধীনতার সীমাকে বাড়িয়ে দেওয়া। সম্ভব ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্পর্ককে মৌলিকভাবে বদলে দেওয়া।
ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্পর্ককে মৌলিকভাবে বদলে দেওয়ার কথাটাই অনেক বেশি গুরুত্বের সাথে তুলেছিলেন জার্মান নৈরাজ্যপথিক গুস্তাভ ল্যানডাওয়া[২]। গুস্তাভ দেখিয়েছিলেন, রাষ্ট্র কোনো চেয়ারটেবিল-স্থাপনা নয় যে একে ভেঙে ফেলা যাবে। রাষ্ট্র হচ্ছে একটা সম্পর্ক। বিশেষ ধরনের সম্পর্ক। রাষ্ট্রকে আমরা বদলাতে পারি, যদি আমরা রাষ্ট্র-সম্পর্কের বাইরে অন্য ধরনের (আন্তঃব্যক্তিক-সামাজিক) সম্পর্ক-প্রণালীতে পরস্পরের সাথে লিপ্ত হতে পারি। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ যখন ২০০৬ সালে তার আইকিউ ডট অর্গ নামের ব্লগ লিখছিলেন, তখন তাঁর ব্লগে সবার ওপরে, নিজের ছবিটার নিচে, ছিল গুস্তাভের এ বিষয়ক উদ্ধৃতি:
The State is a condition, a certain relationship between human beings, a mode of behavior; we destroy it by contracting other relationships, by behaving differently toward one another. … We are the state, and we shall continue to be the state until we have created the institutions that form a real community and society of men.
আমি যতটা দেখতে পাই, আজকের সাইফারপাঙ্কস-আন্দোলনের মূলমন্ত্র এই দৃষ্টিভঙ্গিটাই। এবং তাঁরা হাতেকলমে দেখাচ্ছেন। কেমন করে বদলে দিতে হয় রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যকার সম্পর্ক, পুরো আর্থসামাজিক সম্পর্কপ্রণালী।
রাষ্ট্র-কর্পোরেট নজরদারি বনাম ব্যক্তি-মানুষের প্রতিরোধ
ক্রিপ্টোগ্রাফিক সফটওয়ার আপনি-আমি ব্যবহার করব কেন? আমাদের সবার ভালো করে জানাও নেই, এনভেলপের চিঠির সাথে তুলনীয় সামান্য কোনো নিশ্চয়তাও ইন্টারনেটে নাই। স্মার্টফোনে নাই। ইয়াহু জিমেইল হটমেইল ওয়াই মেইল গুগল মেইল – এগুলো সবই একেবারে ন্যাংটা। একদম উলঙ্গ ইমেইল সার্ভিস এগুলো। স্কাইপ ফেসবুক টুইটার গুগল প্লাস – এসব সার্ভিসে আমাদের ইমেইল চ্যাট মেসেজ ছবি তথ্য – যাবতীয় কিছু ঠিক যেন খোলা পোস্টকার্ডের মতো। যেকেউ চাইলে আমাদের সমস্ত ইমেইল ইত্যাদি পড়ে ফেলতে পারেন। ব্যক্তিগত সব কিছু জেনে ফেলতে পারেন। তাঁর শুধু সামান্য একটু কারিগরি জ্ঞান থাকলেই হলো। গুগল এবং গ্রামীণ ফোন এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের এবং অন্যসব কর্পোরেট-প্রতিষ্ঠানের আইন-অনুগত ও বাণিজ্য-অনুগত পার্টনার মাত্র। আমাদের যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য যাচ্ছে রাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের হাতে। বিজ্ঞাপনী-বিপণনী প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে। শুধু ইমেইল চ্যাট এবং এসএমএস-ই নয়, আমাদের সমস্ত ধরনের অনলাইন-কর্মকাণ্ড এবং স্মার্টফোন-তৎপরতা তৃতীয় পক্ষের কাছে উদোম হয়ে থাকছে সার্বক্ষণিকভাবে। এবং সেগুলো নির্বিশেষে রেকর্ড করে রাখা হচ্ছে। পাইকারি হারে। গণহারে।
এখন আমাকে-আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনি কি আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে সর্বপ্রকার হস্তক্ষেপমুক্ত এবং স্বাধীন (স্ব+অধীন) ইন্টারনেট চান? নাকি সিকিউরিটি-নজরদারি-নিষেধাজ্ঞার ইলেকট্রনিক দাসপ্রথা চান? সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সময় নাই। ভয়ংকর প্রত্যক্ষ হামলা শুরু হয়ে গেছে। আপনার যাবতীয় ইলেকট্রনিক যোগাযোগের চ্যানেলগুলোতে গোপন চোখ বসানো হচ্ছে। দৃশ্যমান সিসি-ক্যামেরা অথবা অদৃশ্যমান সফটওয়ার-চোখ। স্মার্টফোন ইমেইল চ্যাটিং নেট-ব্রাউজিং রাস্তাঘাট স্টেডিয়াম – কোনো জায়গায় আপনার-আমার কোনো প্রাইভেসি নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ইউরোপে। সর্বত্র। মাইক্রোসফট ইয়াহু গুগল ফেসবুক ইউটিউব অ্যামেরিকান অনলাইন (এ.ও.ল.) অ্যাপল – কোথাও আপনার কোনো আব্রু নাই।
গুগল আমাদের প্রত্যেকটা ক্লিক রেকর্ড করে। চাহিবা-মাত্র সরকারকে, সরকারি এজেন্সিকে দিয়ে দেয়। সিএআইএ-প্রধানের জিমেইল অ্যাকাউন্টও এফবিআইয়ের কাছে উলঙ্গ করে দেওয়ার ব্যবস্থা গুগলে আছে। (এ ঘটনাও ঘটেছে সাম্প্রতিক কালে।) বাকিদেরও একই অবস্থা। প্রচলিত ব্রাউজারগুলো সবই ন্যাংটা। সেখানে কোন তথ্য কোন পিসি থেকে, কোন ল্যাপটপ থেকে, কোন স্মার্টফোন থেকে, কোন সাইবার-ক্যাফে থেকে কোন আইপি-ঠিকানা হয়ে কোন দিক দিয়ে কোন পথ হয়ে কোথায় গেল সবই ফকফকা পরিষ্কার পদ্ধতিতে নথিভুক্ত থাকে। এমনকি ছদ্মনামেও যদি আপনি কোনো মতপ্রকাশ করেন, যোগাযোগ করেন— নিস্তার নাই। আপনি কোমলমতি প্রেমিক হতে পারেন, সৎ ও আন্তরিক সমাজকর্মী হতে পারেন, কঠিন মনের রাজনৈতিক পরিবর্তনকামী যোদ্ধা হতে পারেন, ব্লগার হতে পারেন, অনলাইন-অ্যাকটিভিস্ট হতে পারেন, বুয়েটের বা জাহাঙ্গীরনগরের কোনো আবেগপ্রবণ শিক্ষক হতে পারেন, সেনাবাহিনীর সদস্য হতে পারেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের বিচারক হতে পারেন — রেহাই নাই আপনার। উপযুক্ত ধরনের কোনো ক্ষমতাশালী মহলের একটুখানি নেকনজর আপনার প্রতি পড়লেই হলো। আপনার ঘাড়ের ওপর পড়তে থাকবে পুলিশী নিঃশ্বাস। গ্রেপ্তার। রিম্যান্ড। কারাগার।
এটুকুই সব নয়। বিপদ আসলে অকল্পনীয় মাত্রায় ভয়াবহ। উদোম পোস্টকার্ডের সাথে উদোম ইন্টারনেটের পার্থক্য বিপুল। পার্থক্য মারাত্মক। পোস্টকার্ড অ্যানালগ। পোস্টকার্ডের আমলে বিশালতম কোনো গোয়েন্দা-প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও প্রত্যেকটা পোস্টকার্ডের বক্তব্য পড়া সম্ভব ছিল না। দরকারও ছিল না। সনাতন গোয়েন্দাগিরি ছিল নির্দিষ্ট নজরদারির কাল। ছিপ ফেলে মাছ ধরার মতো। নির্দিষ্ট কোনো ‘সন্দেহভাজন’ ব্যক্তিকে, বা তার সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্যকে, বড়শিতে আটকাতে পারলেই কাজ হাসিল হতো। এখন চলছে পাইকারি নজরদারির যুগ।
এখন পাইকারি হারে, যেন ‘কারেন্ট জাল’ দিয়ে, সমস্ত মাছ আটক করার প্রচলন ঘটেছে কম্পিউটার-প্রযুক্তির কল্যাণে। এখন আর বিশেষ কোনো সন্দেহ-ভাজনকেই যে খুঁজতে হবে তা নয়। এখন সবাই সম্ভাব্য সন্দেহভাজন। সবাই এখন সম্ভাব্য আলকায়দা। সবাই এখন মনে মনে মাওবাদী। আইনের চোখে এখন সকলেই হতে-পারে-অপরাধী। সুতরাং সবার সম্পর্কে তথ্য চাই। সম্ভব-অসম্ভব সব কিছু হাতে থাকা চাই। কখন কাকে লাগে ঠিক নাই। কখন কোনটা লাগে ঠিক নাই। কাজেই পাইকারিভাবে তথ্যসংরক্ষণ করা চাই। চাই গণনজরদারি। আজ থেকে ১৫ বছর পরে কাউকে বিশেষ সন্দেভাজন মনে হলে তার বিগত ১৫ বছরের অনলাইন-স্মার্টফোন-কর্মকাণ্ডের সুবিস্তারিত রেকর্ড চেক করা চাই। চেক করে দেবে সফটওয়ার। চোখের পলকে। এই হলো গণনজরদারির আদত কথা। (দ্রষ্টব্য: জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, ২০১২)
ইঙ্গমার্কিন রাষ্ট্র এবং তাদের তাঁবেদার সরকারগুলো নানারকম আইন-কানুন-ফন্দিফিকির করে ইন্টারনেটকে উলঙ্গ করে ফেলার পথে নিয়ে এসেছে বলতে গেলে। ইন্টারনেটের সেবাদানকারী কর্পোরেট সংস্থাগুলো পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা-প্রতিষ্ঠানে। সর্বগ্রাসী নজরদারির রাষ্ট্রীয় প্রকল্প তো আছেই। সাথে আছে সরকার-নিয়োজিত প্রাইভেট গোয়েন্দা কর্পোরেট-সংস্থাসমূহ। অরওয়েলের সেই কিংবদন্তীর সতর্কবাণী এখন ইন্টারনেটের জন্য ডালভাত। বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ। এভরিহোয়ার। এভরি মোমেন্ট।
কিন্তু বিগ ব্রাদারের ভয়ে দাসের জীবন যাপন করতে পারে না মানুষ। শেকল-বাঁধা ক্রীতদাসও নিজেকে মুক্ত করার জন্য ঝুঁকি নেয়। আজকের যুগে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, চাকরি-পরিবার-প্রেম হারানোর ঝুঁকি নিয়ে, পাইকারি নেট-নজরদারির আশঙ্কা ও দাবির সত্যতার সাক্ষাৎ প্রমাণ দিয়েছেন তরুণ মার্কিন কম্পিউটার-বিশ্লেষক এডওয়ার্ড স্নোডেন। সেটা তিনি করেছেন ক্রিপ্টোগ্রাফিক-যোগাযোগের মাধ্যমেই বটে। সিআইএর সাথে চুক্তির ভিত্তিতে কর্মরত এই ৩০ বছরের তরুণ যা জানিয়েছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে: এক ডজনের বেশি দেশের এক বিলিয়ন মতো গ্রাহকের তথ্য সংগ্রহে লিপ্ত আছে মার্কিন সংস্থাগুলো। কোন কোন আইনের অধীনে, কী কী প্রকল্পের অধীনে, কোন কোন সফটওয়ারের মাধ্যমে এই পাইকারি গোয়েন্দা নজরদারি চলছে তার বিস্তারিত বিবরণ স্নোডেনের দেওয়া তথ্য মোতাবেক মাস খানেক ধরে ছেপেছে বৃটেনের গাডির্য়ান পত্রিকা। (দ্রষ্টব্য উইকিপিডিয়া: এডওয়ার্ড স্নোডেন।) অ্যাসাঞ্জ স্বয়ং জানিয়েছেন, স্নোডেনের কাছে আছে অনেক মহাজরুরি তথ্য, যার প্রকাশ অচিরেই ঘটবে। আটকাতে পারবে না কেউ।
এভাবে এক দিকে চলছে সর্বগ্রাসী নজরদারি। রাষ্ট্র-কর্পোরেট-সেনাবাহিনীর দিক থেকে। গোটা ইন্টারনেট স্বাধীনতা ও ভবিষ্যত হয়ে পড়ছে বিপন্ন। অন্য দিকে চলছে, প্রাইভেসি রক্ষার লক্ষ্যে অজস্রমুখী সামাজিক নড়াচড়া। নানামুখি আন্দোলন। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের গণডিজিটাল দস্তখতের চাপে এ পর্যন্ত থমকে গেছে বেশ কয়টা মারাত্মক মার্কিন আইন। প্রাইভেসিবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী আইন। পাশাপাশি চলছে সাইফারপাঙ্কস-আন্দোলনের ক্রিপ্টোগ্রাফিক সফটওয়ার লেখার অপ্রতিরোধ্য বাস্তব তৎপরতা। এমন সব সফটওয়ার, যা ইন্টারনেট- প্রাইভেসিকে রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য করে তুলছে দিনকে দিন।
কেন আমি খামে ভরে চিঠি পাঠাচ্ছি, এই অভিযোগ রাষ্ট্র কখনও আমার বিরুদ্ধে তোলে নি। তুলতে পারে নি। তোলাটা নিতান্তই অবান্তর বটে। এ নিয়ে যুক্তিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু আমার ইমেইলকে ক্রিপ্টোগ্রাফিক সফটওয়ার দিয়ে খামের মতো করে আড়াল করার প্রাইভেসি-প্রচেষ্টার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রাষ্ট্র। প্রাইভেসি রক্ষার জন্য নিবেদিত এসব ওপেনসোর্স-সফটওয়ারকে অবৈধ, অপরাধমূলক বলে প্রতিপন্ন করার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তারা। সফল হচ্ছে কখনো, কখনো-বা ব্যর্থও হয়েছে। সেসবের বিস্তারিত কাহিনী এখন নয়।
আজ শুধু এটুকুই বলার যে: ক্রিপ্টোগ্রাফিক সফটওয়ারের ব্যবহারই পারে ইন্টারনেট-পরিসরে আমাদের প্রাইভেসিকে রক্ষা করতে। এইসব সফটওয়ার ব্যবহারের বিপুল বিস্তৃতি ঘটানোর মধ্য দিয়ে আমরাই পারি ইন্টারনেটের স্বাধীনতা এবং আমাদের প্রাইভেসি নিশ্চিত করতে। ভয়ংকর নিপীড়নমূলক এবং গণনজরদারিমূলক রাষ্ট্র-কর্পোরেট-গোষ্ঠীকে মোকাবেলা করতে। ব্যক্তির ও সমাজের স্বাধীনতার সীমাকে অপ্রতিরোধ্যভাবে বিস্তৃত করতে।
লাভাবিট এবং সাইলেন্ট মেইল বন্ধের ঘটনা
সবর্গ্রাসী রাষ্ট্রকর্পোরেট-নজরদারি তো আছেই। এবার, আস্ত একটা ইমেইল সার্ভিস ‘লাভাবিট’ বন্ধ করে দিতে বাধ্য করেছে মার্কিন সরকার। অভিযোগ: মস্কোর শেরেমেতেভো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকে-পড়া অবস্থায় এডওয়ার্ড স্নোডেন একটি লাভাবিট-অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ইমেইল করেছিলেন মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা আইনজীবী ও কর্মীদের কাছে। ইমেইল করেছিলেন তাঁর সংবাদ-সম্মেলনে আসার জন্য। এই ইএমইলের অভিযোগে দশ বছরের পুরানো, চার লক্ষাধিক গ্রাহকের একটা বৈধ, মার্কিন কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেল ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় চাপে।
লাভাবিট গড়ে ওঠে ২০০৪ সালে। ১০ বছর ধরে লাভাবিট ছিল একটা জনপ্রিয় ইমেইল সার্ভিস। ২০১৩ সালে এর গ্রাহক ছিল ৪,১০,০০০। এঁরা ফ্রি সার্ভিস দিতেন। ১২৮ মেগাবাইট পর্যন্ত। আবার পেইড সার্ভিসও দিতেন। ৮ গিগাবাইট পর্যন্ত। টেক্সাসের সফটওয়ার-প্রোগামাররা এটা গড়ে তুলেছিলেন। জিমেইল গুগল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের তথ্য গোপনে ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন এবং মার্কেটিং ডাটা প্রস্তুত করে থাকে। গ্রাহকদের কোনো প্রাইভেসি থাকে না। প্রাইভেসির ব্যাপারটা নিয়ে এই উদ্বেগের কারণে লাভাবিট বানান তাঁরা। এতে তাঁরা গ্রাহকদের প্রাইভেসির পূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে পেরেছিলেন ‘অ্যাসিমেট্রিক এনক্রিপশন’ তথা ‘পাবলিক কী ক্রিপ্টোগ্রাফি’র দুর্ভেদ্যতা দিয়ে। কোনো নিরাপত্তা এজেন্সির পক্ষেই লাভাবিটের প্রাইভেসি-প্রতিরক্ষা ভাঙা সম্ভব ছিল না। দশটা বছর ধরে তিল তিল করে নিজের হাতে গড়া এই লাভাবিটের মালিক ল্যাডার লেভিসন গত ৮ই আগস্ট লাভাবিটের হোমপেজে লিখেছেন:
আমাকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা হয়েছে। হয় আমাকে মার্কিন জনসাধারণের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে হবে, না হয় আমাকে প্রায় ১০ বছরের কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তোলা লাভাবিট বন্ধ করে চলে যেতে হবে। বিপুল পরিমাণে আত্ম-অনুসন্ধানের পরে আমি এটা আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তই নিয়েছি।
যা আমাকে এই সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দিল আইনসম্মতভাবে তা যদি আমি আপনাদের জানাতে পারতাম! আমি পারছি না। কী ঘটে চলেছে তা আপনাদের জানা দরকার বলে আমার মনে হয়। [মার্কিন সংবিধানের] প্রথম সংশোধনীর দিক থেকে এই ধরনের পরিস্থিতিতে মুখ খোলার স্বাধীনতার গ্যারান্টি মনে হয় আমার পাওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কংগ্রেস এমন সব আইন পাশ করেছে যা অন্য কথা বলে।
এখন অবস্থা যা, আমার গত ছয় সপ্তাহের অভিজ্ঞতা আমি জানাতে পারছি না, যদিও আমি দুই-দুইবার যথাযথভাবে অনুরোধ জানিয়েছি মুখ-
খোলার অনুমতি পাওয়ার জন্য।এখন কী ঘটতে যাচ্ছে? ফোর্থ সার্কিট আপিল আদালতে সংবিধানের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো কাগজপত্র আমরা তৈরি করতে শুরু করেছি। মার্কিন কোম্পানি হিসেবে লাভাবিটকে পুনরুজ্জীবিত করতে আমাকে অনুমোদন দিতে পারে এই আদালতের অনুকুল একটা সিদ্ধান্ত।
এই অভিজ্ঞতা আমাকে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রদান করেছে। … আমি খুব শক্তভাবে বলে রাখতে চাই। বিশ্বস্ততার গ্যারান্টিসহকারে ব্যক্তিগত তথ্য গচ্ছিত রাখার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত কোনো কোম্পানিকে কেউ যেন বিশ্বাস না করে।
লাভাবিট একটা ছোট-কিন্তু-স্বনামধন্য কোম্পানি। এর মালিক লেভিসন একা হাতে এই প্রতিষ্ঠানটা চালান। একজন মাত্র পূর্ণকালীন কর্মচারি আছেন তাঁর, যিনি ইউরোপের একজন গ্রাজুয়েট-ছাত্র। বার্ষিক কমবেশি এক লক্ষ ডলারের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল একটা মানুষের। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। মার্কিন মিডিয়া হাফিংটন পোস্টের সাথে একটা ভিডিও-সাক্ষাৎকারে লেভিসন বলেছেন: ‘তোমার সমস্ত টাকাপয়সা এবং স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা [মার্কিন] সরকারের আছে।’ মনের দুঃখে লাডার লেভিসন নিজের ইমেইল-অ্যাকাউন্টটা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়ে বলেছেন: ‘আমি আর ইমেইল ব্যবহার করছি না। ইমেইল সম্পর্কে আমি যা জানি, তা যদি আপনিও জানতেন তাহলে আপনিও ইমেইল ব্যবহার করতেন না।’
যে পদ্ধতিতে লাভাবিট বন্ধ করে দিল মার্কিন সরকার তা অকল্পনীয় ধরনের বিপজ্জনক। সরকার নিজে ঘোষণা দিয়ে এটা বন্ধ করে দেয় নি। মালিককে বাধ্য করেছে বন্ধ করে দিতে। এবং মালিক লেভিসন যেন এ ব্যাপারে প্রকৃত ঘটনা কাউকে না জানান সে ব্যাপারে তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে মহান আদালত। কী সেই নিষেধাজ্ঞা, তার শর্তাবলী কী, সেগুলো বলার অনুমোদনটুকুও লেভিসনের নাই। গণতান্ত্রিক দেশ বটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
তবে ‘গাডির্য়ান’ পত্রিকার রিপোর্টার স্পেন্সার অ্যাকারম্যান তাঁর ৯ই আগস্টের (২০১৩) রিপোর্টে একটা ধারণা দিয়েছেন। সেটা হলো: গোপন মার্কিন আদালত লাভাবিটকে হুকুম দিয়েছিল যেন তাঁরা তাঁদের গ্রাহকদেরকে রাষ্ট্রীয় নজরদারির আওতায় আনার ব্যাপারে মার্কিন সরকারের সাথে সহযোগিতা করে। কিন্তু সরকারি নজরদারিতে অংশ নিতে রাজি হয় নি লাভাবিট। গ্রাহকদের প্রাইভেসির ব্যাপারে তাঁরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংবিধানবিরোধী হুকুম তামিল করে ব্যবসা করতে চান না তাঁরা। রাষ্ট্রীয় নজরদারির প্রকল্পে দালালি করার হাত থেকে নিজেদের বাঁচানোর কৌশল হিসেবে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের লাভাবিট বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
লাভাবিটের পর আরো একটা নিরাপদ ইমেইল কোম্পানি ‘সাইলেন্ট সার্কেল’ও মার্কিন নজরদারি প্রতিষ্ঠান এনএসএ-এর ভয়ে বন্ধ করে দিয়েছে নিজেদের ইমেইল সার্ভিস ‘সাইলেন্ট মেইল’। সাইলেন্ট সার্কেলের অন্যতম মালিক ‘ইন্টারনেট সিকিউরিটি গুরু’ ফিল জিমারম্যান। ‘পিজিপি’ (প্রেটি গুড প্রাইভেসি) নামের দুর্দান্ত সিকিউরিটি-প্রাইভেসি সফটওয়ারের উদ্ভাবক তিনি। ওপেনসোর্স এই সফটওয়ার উদ্ভাবন এবং সেটা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রায় জেলে যেতে বসেছিলেন তিনি। জিমআরম্যানরা বলেছেন, তাঁরা কোনো সরকারি আদেশ পান নি বটে, কিন্তু ‘দেওয়ালেই তো সব লেখা আছে’। গোপন আদালতের গোপন আদেশ আসার আগেই, লাভাবিট বন্ধের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, তাড়াহুড়া করে তাঁরা তাই তাঁদের সাইলেন্ট মেইল সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়। তাঁরা তাঁদের সার্ভার থেকে গ্রাহকদের যাবতীয় তথ্য মুছে ফেলেছেন। জিমারম্যান বলেছেন, লাভাবিটের লেভিসনের মতো তিনিও এখন ইমেইল কম ব্যবহার করছেন। এর আব্রু-নিরাপত্তা কম। তিনি বরং এনক্রিপ্টেড মোবাইল মেসেজিঙের ওপর নির্ভর করেন বেশি। সাইলেন্ট সার্কেলের মোবাইল সার্ভিস ‘সাইলেন্ট ফোন’ এবং ‘সাইলেন্ট টেক্সট’ অবশ্য পূর্ণ নিরাপত্তা সহকারে চালু আছে। এই সার্ভিস দুটো বন্ধ না করার কারণ আছে। এগুলোর গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টে ঢোকার পাসওয়ার্ড গ্রাহকদের কাছেই থাকে। সাইলেন্ট সার্কেলের কাছে থাকে না। কাজেই আদালত হুকুম করলেও তারা গ্রাহকদের কোনো তথ্য আদালত বা সরকারকে দিতে সক্ষম নন। ইমেইলের বেলায় ব্যাপারটা এরকম করা সম্ভব হয় না। সেখানে বিশাল বিশাল পাসফ্রেজ গ্রাহকরা সার্ভারেই গচ্ছিত রাখেন। সেই পাসফ্রেজটা জানার জন্য তারা নিজেদের কাছে রক্ষিত অন্য একটা পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করেন। ফলে সার্ভারের মালিককে চাপ দিয়ে গোট সার্ভার-সফটওয়ারটাকে কমবেশি বদলে ফেলার সুযোগ বা গ্রাহকদের সম্পর্কে তথ্য জানার সুযোগ আদালতের বা রাষ্ট্রের থাকে।
ফিসা-আদালত, এনএসএ এবং এডওয়ার্ড স্নোডেন
সংগুপ্ত ‘ফিসা’-আদালতের আদেশ একবার এসে গেলে আপনি তা তামিল করতে বাধ্য। কী আদেশ এসেছে তা নিয়ে আপনি কাউকে কিছু বলতেও পারবেন না। এই হচ্ছে ফিসা-আইন বা ফরেন ইন্টেলিজেন্স সারভেইল্যান্স আক্টের মাহাত্ম্য। এই আদালতের গোপন হুকুমে এনএসএ-এফবিআই এখন প্রায় যাবতীয় ইলেকট্রনিক যোগাযোগ কোম্পানির সার্ভারে সরাসরি ঢুকতে পারে। পাইকারি হারে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। কোম্পানি গররাজি হতে তো করতে পারবেই না, কাউকে কিছু জানাতেও পারবে না। এই মুহূর্তে, এনএসএ-এফবিআই প্রতিদিন ২০ টেরাবাইট করে গ্রাহক-ডাটা সংগ্রহ করে। গোপনে।
‘গোপন কথা সব গোপনই ছিল’। কিন্তু এনএসএ এবং সিআইএর এক স্বাধীনতাপিপাসু কম্পিউটার-বিশ্লেষক এডওয়ার্ড স্নোডেন লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছেন সাম্রাজ্যের সাধ। কাছাখোলা, পাইকারি, রাষ্ট্রীয় নজরদারির বেশ কয়েকটা ভয়ংকর নথি তিনি তুলে দিয়েছেন বৃটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক গ্লেন গ্রিনওয়াল্ডের হাতে। এসব নথি খোদ এনএসএর ‘টপ সিক্রেট’ নথি।
গার্ডিয়ান তা পরীক্ষানিরীক্ষা করে একের পর এক ধারাক্রমিক রিপোর্ট ছেপেছে গত জুন মাসে। সেসব রিপোর্ট যদি আপনি পড়ে থাকেন তাহলে এরই মধ্যে নিশ্চয়ই আপনার ‘দ্য হেড মুভস রাউন্ড দ্য সান’ অবস্থা। ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে হৈচৈ লেগে গেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাখ্যা চেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। একাধিক জার্মান মন্ত্রী বলেছেন, ব্যক্তিগত আব্রু যাঁরা চান, তাঁরা যেন কেউ কোনো মার্কিন সার্ভারের সার্ভিস গ্রহন না করেন। সাইলেন্ট সার্কেলও তাঁদের সার্ভার সুইজারল্যান্ডে স্থানান্তর করার পরিকল্পনা করছে। এবং এরই মধ্যে গ্রাহকদের সচেতনতার কারণে মার্কিন ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় মারাত্মক ধ্বস নামতে শুরু করেছে। মার্কিন সার্ভারগুলোকে কেউ বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, এইসব মার্কিন সার্ভারের মূল সফটওয়ারের ভেতরে এনএসএ-এফবিআই এখন বসিয়ে দিচ্ছে চোরা সফটওয়ার। ফিসা-আইনের বদৌলতে। সিকিউরিটি-ভাষ্যকাররা বলছেন, লাভাবিটকেও এই একই আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা সেটা তামিল করার বদলে খোদ কোম্পানিটাই বন্ধ করে দিয়েছেন, যেন তাঁদেরকে গ্রাহকদের সাথে বেঈমানি করতে না হয়। স্বভাবতই লাভাবিটকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। স্নোডেন বলেছেন, অন্যসব বড় বড় কোম্পানিও লাভাবিটের পথ অনুসরণ করছে না কেন?
গোপন আদালতের গণতন্ত্র
লাভাবিট বন্ধ হয়ে যাওয়া বিষয়ক একটা রিপোর্টে বিশেষ জরুরি একটা কথা মনে করিয়ে দিয়েছে গার্ডিয়ান পত্রিকা। লাভাবিটই প্রথম কোম্পানি যাঁরা সরকারি নজরদারির অংশীদার না হয়ে নিজেদের কোম্পানি নিজেরা বন্ধ করে দিলেন। তাহলে এরকম কোম্পানি নিশ্চয়ই আরো আছে, যারা কোম্পানির ব্যবসা বাঁচানোর স্বার্থে গ্রাহকদের প্রাইভেসি উদোম করে দিয়েছে ‘এনএসএ’র কাছে? গ্রাহকদের আব্রু যায় যাক, কোম্পানির ডলার বাঁচুক।
হ্যাঁ, এরকম কোম্পানি আছে। এক গাদা আছে। আপনার-আমার প্রিয় এবং বিশ্বস্ত সব খ্যাতিমান কোম্পানি। এঁরা হলেন: ফেসবুক ইয়াহু জিমেইল হটমেইল লাইভ আউটলুক ইউটিউব স্কাইপ মাইক্রোসফট অ্যাপল এবং গুগল এবং ইত্যাদি এবং প্রভৃতি। পাইকারি নজরদারি প্রকল্পের তাঁরা আইনসঙ্গত রাষ্ট্রীয় পার্টনার। নোম চমস্কির ‘দ্য স্টেট-কর্পোরেট কমপ্লেক্স’-এরই এ আরেক রূপ বটে।
এইসব নামজাদা কোম্পানি আপনার-আমার যাবতীয় একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য দৈনিক-ভিত্তিতে কাছা খুলে তুলে দেয় ‘মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সি’ বা এনএসএ-র কাছে। সুতরাং ল্যাডার লেভিসনের কথা সিরিয়াসলি আমলে না নেওয়া অসম্ভব। কেউ যেন ফেসবুক ইয়াহু জিমেইল হটমেইল লাইভ আউটলুক ইউটিউব স্কাইপ মাইক্রোসফট অ্যাপল এবং গুগলকে সামান্য বিশ্বাসও না করেন।
এই হলো মার্কিনী ‘গোপন আদালতের গণতন্ত্র’। ফিল জিমারম্যান ঠিকই বলেছেন, এই আদালতের আদেশ আর খামে করে পাঠাতে হয় না। দেওয়ালে দেওয়ালে মুদ্রিত থাকে তা। নিতান্ত অন্ধ না হলে পড়তে সমস্যা হয় না। এগুলো সব ‘আইনী প্রক্রিয়া’! আইনের শাসন। যুক্তরাষ্ট্রের ‘গোপন আদালতের গণতন্ত্র’ এই হাল করেছে বিশ্ববন্দিত আইনের শাসনের। এ যেন সত্যিকারের হরর সিনেমা। জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ উপন্যাসের বিগ ব্রাদারের সর্বগ্রাসী নজরদারি-সাম্রাজ্যের কল্পনাকেও হার মানাতে যাচ্ছে আজকের ওয়াশিংটনের সাইন্স ফিকশন হরর মুভি।
সেনা রাষ্ট্র-কর্পোরেট নজরদারি ঠেকানোর পথ কী?
এখানে উপস্থাপিত সার্বিক আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তি-মানুষ হিসেবে এবং সমাজ-সচেতন প্রাণী হিসেবে আমাদের নিজেদের কর্তব্যের প্রশ্নটাও এসে যায়। প্রথম কর্তব্য হচ্ছে, আলোচ্য প্রসঙ্গ সম্পর্কে যথাসম্ভব পড়াশোনা করা, জানা-বোঝার চেষ্টা করা, এগুলো নিয়ে বন্ধু-বান্ধব-সহকর্মী-সাথী-পরিবারের সাথে শেয়ার করা। এইসব কথাবার্তা আপনি নামজাদা-খ্যাতিবাহাদুর অধিপতি মিডিয়ায় পাবেন না। যদিও বা পান, পাবেন টুকরা-টাকরা-বিক্ষিপ্ত-এলোমেলো সংবাদ-কণিকা, যা থেকে সার্বিক কোনো ধারণা পাওয়ার সামান্য উপায়ও নেই। সুতরাং আমাদের নিজেদের দিক থেকে জ্ঞান-কর্ম-সক্রিয়তার কোনো বিকল্প নেই। অন্যরা কী করছেন না করছেন সেদিকে তাকিয়ে বসে থাকার অবকাশও নেই। হাতে সময় নেই একেবারেই।
যে বিপদের কথা এখানে আলোচিত হচ্ছে তা কিন্তু স্রেফ ইউরোমার্কিন বিপদ নয়। এ বিপদ রওনা দিয়েছে আমাদের ধনলুণ্ঠিত তৃতীয় বিশ্বের দিকেও। বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম আশু টার্গেট। ইঙ্গমার্কিন সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের কাছে বাংলাদেশ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা আমাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে। তথাকথিত মৌলবাদ-সন্ত্রাসবাদ এবং আফগানিস্তান-ইরাক-পাকিস্তান-সিরিয়ার কথা মনে রাখলে এই বিপদের গন্ধ সুনিশ্চিভাবে আপনার সুনিদ্রা ব্যাহত করবে। উইকিলিকসের উন্মোচনসমূহের মধ্যে যদি আপনি ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের গোপন দলিলপত্র নাড়াচাড়া করে দেখেন তাহলে শিউরে উঠবেন। বাংলাদেশের যাবতীয় সামরিক সংস্থা এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান-প্রণালীর ওপরে মার্কিন প্রভাবের যে ইশারা সেগুলোতে আছে তা নিয়ে আমাদের রাষ্ট্র-সরকার-সংসদ ও সামরিক বাহিনী-সমূহের সম্যক আন্দাজ আছে কিনা আমি জানি না। আমার সংশয় আছে।
সম্প্রতি, বিডিআর-বিদ্রোহ নিয়ে আমার বইটার (‘বিদ্রোহের সপ্তস্ব: বিডিআর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়) বিস্তারিত-পরিমার্জিত-পরিলিখিত দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ করতে গিয়ে ঐসব দলিলপত্র আমাকে নাড়াচাড়া করতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই কথাগুলো তোলা। এখানে আপাত বড়ো পরিসরের আলাপে ঢোকার অবকাশ নাই। শুধু মনে রাখলেই চলে যে মূলত ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ’ দমনের নামে বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানারকম গোপন চুক্তি চলছে যা আমরা জানি না। এসব চুক্তির বিষয়বস্তু কী তাও আমরা জানি না। উপরোক্ত মার্কিন দলিলগুলোতে দেখেছি বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন আগ্রহের প্রধান জায়গা হচ্ছে নিরাপত্তা আর কর্পোরেট ব্যবসা।
সুতরাং নিরাপত্তা চুক্তির নামে যে বাংলাদেশকে মার্কিন এনএসএ-নজরদারি-প্রকল্পের অন্তর্ভূক্ত করার চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র করবে তা ধারণা করাটা অমূলক নয়। জানি না এতদিনে এ কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে কিনা। সুতরাং এ ইন্টারনেটের স্বাধীনতা এবং নজরদারিমুক্ত নাগরিক-স্বাধীনতার প্রসঙ্গগুলো জানা এবং প্রচার করার কর্তব্য আমাদের থাকে। আমাদের দ্বিতীয় কর্তব্য, আমার ধারণা, মার্কিন নজরদারির পার্টনার-কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে নীতিগত কারণে যথাসম্ভব পরিত্যাগ করা এবং বিকল্প-স্বাধীনতার পথে ইন্টারনেট ব্যবহার করার অভ্যাস করা। দ্বিতীয় এই দিকটা নিয়ে এখানে অতি সামান্য দুই-একটা উপায়ের কথা বলে রাখার অবকাশ আছে। নিজের ক্ষেত্রে আমি বহুল ব্যবহৃত সার্চইঞ্জিন ‘গুগল’ বিদায় দিয়েছি। গ্রহণ করেছি নতুন, দুর্দান্ত একটা সার্চইঞ্জিন ‘ডাকডাকগো’। এটা অতি অ-সাধারণ একটা সার্চ ইঞ্জিন। অধিকন্তু, এটা একটা প্রাইভেসি- সার্চইঞ্জিন। এই ইঞ্জিন আপনার ব্যক্তিগত তথ্য-পরিচয়-স্থান ইত্যাদি অনুসরণ করে না। রেকর্ড করে রাখে না। বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বেচে না। রাষ্ট্রীয় এজেন্সিকে দেয় না। এদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য চাইলে কয়েকটা লিংকে ঢুকে দেখা যাতে পারে। গুগল কীভাবে আপনার বারোটা বাজায়, ‘ডাকডাকগো’ কীভাবে বাজায় না সে সম্পর্কে জানার জন্য দ্রষ্টব্য: http://donttrack.us/। বাবল প্রযুক্তি কীভাবে টিকটিকিগিরি করে আমাদের ব্রাউজারে, সে সম্পর্কে জানার জন্য দ্রষ্টব্য: http://dontbubble.us/। আপনার ব্রাউজারের প্রাইভেসির জন্য দারুণ কিছু টিপস পাওয়া যাবে এখানে: http://fixtracking.com/। ‘ডাকডাকগো’ নিয়ে একটা ছোট অ্যানিমেশন দেখা যাবে এখানে: https://duckduckgo.com/about।
এখানে যে লিংকগুলো দিয়েছি সেগুলোতে কয়েকটা প্রাইভেসি- অ্যাডঅন আছে। সেগুলো ইন্সটল করলে হাতেনাতে ফল পাবেন। হাতেনাতে দেখতে পাবেন। নিজের চোখে। দেখবেন কারা আপনাকে ট্র্যাক/ফলো করছে। এবং তাদের কীভাবে থামানো হচ্ছে। রাষ্ট্র- কর্পোরেট নজরদারি তো মানি না মানব না দিয়ে থামানো যাবে না। আপনাকে আপনার নিজের ব্যবস্থা করে নিতে হবে। আপনার-আমার অভ্যাস বদলাতে হবে। সফটওয়ার বদলাতে হবে। গুগল ছাড়তে হবে। ফেসবুক ছাড়তে হবে। তবেই এই রাষ্ট্র-কর্পোরেট সিস্টেমের আক্কেল হবে। সুতরাং নিজেকে তৈরি করুন। প্রস্তুত হোন। রাষ্ট্র-কর্পোরেট সফটওয়ার ব্যবহারের চিরঅভ্যাসের চিন্তাদাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করুন।
তথ্যচোর, প্রাইভেসি-চোর গুগল তো ছেড়ে দিয়েছি। এবার ফেসবুকের বন্ধুদেরকে ফেসবুকের বিপদআপদগুলো বলা দরকার। এবং ফেসবুকের তাদেরকে ডায়াস্পোরে আসার দাওয়াত দেওয়াও দরকার। এটা নিতান্ত আমার-আপনার নিতান্ত ব্যক্তিগত কোনো ব্যাপার না। এমন কোনো আকামকুকাম আমি-আমরা করি না যে, আমাকে-আমাদেরকে মুখোশ পরে লুকিয়ে ঘুরতে হবে। আসলে এটা একটা নীতিগত সিদ্ধান্ত। কী ধরনের রাষ্ট্র আমি চাই? যে রাষ্ট্র ৩৬৫ দিন ২৪ ঘণ্টা আমাকে অপরাধী জ্ঞান করে নজরদারি করতে থাকবে? কেমন ইন্টারনেট চাই আমি? যে ইন্টারনেট হাজারটা গোয়েন্দা নজরদারিতে আমার প্রত্যেকটা ক্লিক রেকর্ড করবে? গোটা ইন্টারনেটের সমস্ত মানুষ সন্দেহভাজন মারাত্মক অপরাধী, আর রাষ্ট্র-কর্পোরেট-আমলা-গোয়েন্দারা সব ফেরেশতা? তামাশার সত্যি সীমা আছে।
ফেসবুকে আপনি সম্পূর্ণ বেআব্রু। এখানে প্রাইভেসি বলতে কিছু নাই। ফেসবুক আপনার যাবতীয় তথ্য বিক্রি করে। চাওয়া মাত্র সরকারকে দিয়ে দেয়। সারা দুনিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আপনাকে নজরদারি করে। প্রত্যেকটা ক্লিক এখানে রেকর্ডেড থাকে চিরদিনের জন্য। ফেসবুক রাষ্ট্র-বাণিজ্য-কর্পোরেটের কাছে আমার ‘প্রাইভেট পার্টস’ চুরি কোরে বেচে দেয়, আমাকে নাঙ্গা করে দেয়।
এছাড়া, ফেসবুক-কর্তৃপক্ষের বানানো স্বৈরতন্ত্রী কিছু নিয়ম মেনে চলতে ফেসবুকে আপনাকে বাধ্য করা হয়। আপনি অন্যের বানানো নিয়মের দাস মাত্র। পুতুল মাত্র। শুধু তা-ই নয়, ফেসবুক বিজ্ঞাপনে ভরা। বিরাট এক বাজার। এখানে সামাজিক সম্পর্ক বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করা হয়। ফেসবুক তাহলে কীভাবে ‘সামাজিক’ নেটওয়ার্ক হলো? এটা আসলে বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক। আপনাকে বিক্রি করে ফেসবুক।
একটা প্রশ্ন ওঠার সুযোগ থাকে। এই আমি ফেসবুকে বসেই ফেসবুকের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছি, নীতিগত দিক থেকে সেটা কতটা গ্রহণযোগ্য? আমার বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য না হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। পরিবারের মধ্যে থেকেই কি আমরা পরিবারের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর বিরুদ্ধে কথা বলি না? নতুন ধারার পরিবার গঠনের কথা বলি না? এ ছাড়া উপায় কী? পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে কি তাহলে আমাকে পরিবারের বাইরে জন্মগ্রহণ করতে হবে? তা তো সম্ভব না? তাহলে কি পরিবার যা তা-ই আমাকে বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নিতে হবে? তাজ্জব কিসিমের যুক্তি বটে। আমি তো একটা রাষ্ট্রের মধ্যে জন্মেছি। বসবাসও করি রাষ্ট্রেরই মধ্যে। আমার জীবন-মরণের মালিক আইনত রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের সংবিধান-আইনকানুন মানতে আমি আইনত বাধ্য। তাই বলে কি আমি আমার রাষ্ট্র-সংবিধান-আইনকানুনের ভালোমন্দ নিয়ে কথা বলতে পারব না? রাষ্ট্রের অন্যায় আচরণের বিরোধিতা করতে পারব না? তার জন্য কি আমাকে রাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে অবস্থান করতে হবে। রাষ্ট্রের বাইরে তো পৃথিবীতে কোনো জায়গায় নাই। তার মানে কি সমালোচনা পর্যালোনা বিরোধিতা-প্রতিবাদ-রূপান্তর অসম্ভব? এ হলো বিদ্যমান অচলায়তনকে প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নেওয়ার যুক্তি। রাষ্ট্রের-পরিবারের-বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাডিক্যাল রূপান্তরের কথা আমরা বলতে পারি। আইনে বাধে না। নীতিতে বাধে না।
কিন্তু ফেসবুক তো আর আমার কথায় রূপান্তরিত হবে না। উল্টো ফেসবুকই আমার বিরুদ্ধে বহিষ্কারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার রাখে। এটাই ফেসবুকের আইন। তাদের ইন্সট্রাকশানের বাইরে যাওয়ার উপায় আমাদের নাই। আমরা তো আর ফেসবুকের মালিক না। ফেসবুকের মালিক একচ্ছত্র জাকারবার্গ। এখানে মালিকের সাথে ফেস-টু-ফেস হওয়ার কোনো উপায়ই নাই বলা চলে। তাঁর এবং তাঁর পছন্দের লোকজনের তৈরি করা যেকোনো ‘আইন’ আমাকে মেনে চলতে হবে। বাধ্যতামূলকভাবে। এর বিরুদ্ধে কিছুই করার থাকবে না কারো। আমরা ফেসবুকের গোলাম। একেই সম্ভবত একনায়কতন্ত্র বলে।
ফেসবুক একটা একনায়কতন্ত্রী সামাজিক নেটওয়ার্ক। যা ‘একনায়কতান্ত্রিক’ তা আবার ‘সামাজিক’ হয় কীভাবে? সোনার পাথর-বাটির মতো অবস্থা। যে ফেসবুক আমাকে এবং আমার মতো কোটি গ্রাহকের প্রাইভেসি বিক্রি করে বিলিয়ন ডলার কামাচ্ছে, তার নীতিবোধই বা কোথায় থাকে। সুতরাং ফেসবুক ব্যবহার করে ডায়াস্পোরার প্রচার করার মধ্যে আমি কোনো সমস্যা দেখি না। এই ধরনের সমস্যায় যারা ভোগেন বা ভুগতে আগ্রহী, একনায়কপ্রীতি, কর্তৃত্ববান্ধব দাসমনোবৃত্তি, অতিরিক্ত ফেসবুক-আসক্তি এবং পরিবর্তন-বিমুখতার চিরপুরাতন ব্যাধিই তাদের আদি অসুখ কিনা তা ভেবে দেখতে প্রলোভন জাগে। যেকোনো প্রলোভনই অবশ্য পরিত্যাজ্য বটে।
ডায়াস্পোরা ট্রাই করে দেখা যেতে পারে। একটা সত্যিকারের সামাজিক নেটওয়ার্ক। এটা বিজ্ঞাপনমুক্ত। অবাণিজ্যিক। ব্যবহারকারীরাই ডায়াস্পোরা নেটওয়ার্কের আইনানুগ মালিক। ভাবতে পারেন? এটা করা হয়েছে এইজন্য যেন কর্পোরেট পুঁজি একে কোনোদিন কিনে ফেলতে না পারেন। অসাধারণ। ‘ডায়াস্পোরা’য় আপনার প্রাইভেসি সম্পূর্ণ গ্যারান্টিড। ডায়াস্পোরা আপনার কোনো ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করতে চায় না। জানতেই চায় না। নিজের সম্পর্কে কতটুকু তথ্য আপনি দেবেন, না দেবেন সেটা পুরোপুরি আপনার ব্যাপার। ডায়াস্পোরা থেকে আপনার একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য চাইলেও গোয়েন্দারা পাবেন না। ডায়াস্পোরার সফটওয়ার আপনার কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জমাই রাখে না। গোয়েন্দারা পাবে কীভাবে? এই সফটওয়ারটা ওপেনসোর্স। কারিগরি জ্ঞান থাকা সাপেক্ষে চাইলে আপনি নিজেই পরীক্ষা দেখতে পারেন এইসব দাবি সত্য কিনা, এবং এটা কীভাবে কাজ করে।
ডায়াস্পোরা আপনার প্রকৃত নাম-জন্ম-দেশ-লিঙ্গ-পরিচয় কিছুই জানতে চায় না। স্রেফ আপনার ইমেইল ঠিকানা, ছদ্মনাম আর পাসওয়ার্ড দিলেই আপনার অ্যাকাউন্ট খুলে যাবে। আপনার ইমেইল ঠিকানাটা সঠিক কিনা এবং আপনি নিজেই সেটা স্বেচ্ছায় ডায়াস্পোরায় দিয়েছেন কিনা সেটাও পরীক্ষা করে দেখে না ডায়াস্পোরা। অথচ ফেসবুকে আইনত আপনার যাবতীয় প্রকৃত তথ্য দিতে আপনি বাধ্য। যারা সেখানে নিক নেম দিয়ে আছেন, আইনত তারা অপরাধী। শুধু এই কারণেই আপনার শাস্তি হতে পারে। ডায়াস্পোরা নিক নামকেই উৎসাহিত করে।
আপনি নিজে একজন ব্যবহারকারী হিসেবে কী পদ্ধতিতে নিজেকে চালনা করবেন তা ডায়াস্পোরার মাথাব্যথার বিষয়ই না। তার মানে, কীভাবে আপনি ডায়াস্পোরা ব্যবহার করবেন সেটা আপনার নিজের ব্যাপার। এ ব্যাপারে ডায়াস্পোরা আপনার ওপর ফেসবুকের মতো করে কোনো প্রকার আইনকানুন-নিয়মনীতি চাপিয়ে দেয় না। আপনার বিবেকবুদ্ধি-চিন্তাভাবনা যুক্তিবোধের ওপরই তার আস্থা। ডায়াস্পোরার প্রণয়ন করা একটা ‘কমিউনিট গাইডলাইন’ আছে বটে। কিন্তু মেনে চলা বা না চলাটা আপনার ইচ্ছা। এটা বাধ্যতামূলক কিছু না। নীতিমালা ভাঙার দায়ে আপনাকে ডায়াস্পোরা থেকে বের করে দেওয়ার মতো কোনো ‘কর্তৃপক্ষ’ ডায়াস্পোরায় নেই। এটা কর্তৃত্বতন্ত্রমুক্ত একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান।
ডায়াস্পোরায় ফেসবুকের মতো ‘স্ট্যাটাস’ বলা হয় না, ‘কনভার্সেশন’ বা ‘আলাপ’ বলা হয়। সুন্দর আইডিয়া। স্ট্যাটাস শব্দটা অনেক বেশি অন্তর্মুখীন, নিষ্ক্রিয়, আত্মকেন্দ্রিক। আলাপ তা নয়। আলাপ সক্রিয়, নিজের গুরুত্বের হানি না ঘটিয়েও অপরের সাথে যোগাযোগে আগ্রহী। উপরন্তু, ডায়াস্পোরা’র ‘স্ট্রিম’ পাতায় ফেসবুকের হোমপেজের মতো আবর্জনা জঙ্গল হয়ে থাকে না। এখানে আপনি যা দেখতে চান শুধু সেই বিষয়ের জিনিসপত্রই আপনার ‘স্ট্রিম’ পাতায় দেখায়। সেটা আপনিই নির্ধারণ করবেন। করবেন নতুন নতুন হ্যাশট্যাগ যোগ করে করে। যেমন #art বা #assange ইত্যাদি। এই সব ট্যাগওয়ালা পোস্টই আপনার ‘স্ট্রিম’ পাতায় দেখায় ডায়াস্পোরা। ফলে ডায়াস্পোরার সামাজিক আলাপ অনেক বেশি ফোকাসড্ বা নির্দিষ্ট আগ্রহকেন্দ্রিক। আর অ্যানোনিমিটিই যেহেতু ডায়াস্পোরার মূল ধারা, তাই ফেসবুকের মতো এটা ‘আমাকে দেখো’ টাইপের মঞ্চ মঞ্চ খেলার মাঠ প্রস্তত করে না। নির্দিষ্ট ব্যক্তির কারিশমার চেয়ে এখানে বিষয়বস্তুকেন্দ্রিক সামাজিক আলাপ-আলোচনা ডিসকোর্সই মূল ঘটনা হয়ে ওঠে। আবার, ডায়াস্পোরায় সামাজিকতা বজায় থাকে পূর্ণ প্রাইভেসি-আব্রু-ইজ্জত সহকারেই। সুতরাং ডায়াস্পোরায় আসুন। সেখানে আমরা ‘মুক্তধারা’ নামে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করি। এটা একটা খোলা নেটওয়ার্ক। মুক্তধারা নেটওয়ার্ক। আপনিও আসুন। আমাদের যোগাযোগ হোক। তখন আরো শেয়ার করা যাবে। পরস্পরের থেকে শেখা যাবে।
ডায়াস্পোরা প্রকৃতপক্ষে ফেসবুকের মুনাফাগন্ধী বাণিজ্যিক নেটওয়ার্কের কোনো বিকল্প না। ডায়াস্পোরা আমূল পৃথক ধারার সামাজিক নেটওয়ার্ক। ‘সামাজিক’ শব্দটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এটা রাষ্ট্রের পার্টনার না। এটা কর্পোরেট হাউস না। ডায়াস্পোরা স্বতন্ত্র একটা ধারা, বা পরিপ্রেক্ষিত, বা দৃষ্টিকোণ বা প্যারাডাইম বটে। ফেসবুকের ধরণ-ধারণ থেকে এ এক বিরাট বাঁকবদল। নেট-সমাজকে দেখার-বোঝায়-মিথষ্ক্রিয়ার একেবারে আলাদা একটা মনোভঙ্গি বা অ্যাপ্রোচ। সমাজবিজ্ঞানে এই ধরনের ঘটনাকে প্যারাডাইম শিফট বলা হয়ে থাকে।
ডাকডাকগো কিংবা ডায়াস্পোরা ছাড়াও ইতোপূর্বে উল্লিখিত পিজিপি, টর, পিজিন, ওটিআর অরবট, গিবারবট, বিটকয়েন প্রভৃতি সফটওয়ারগুলো আমাদের আয়ত্ত করা দরকার। এই সফটওয়ারগুলো প্রাইভেসি বা স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। একই সাথে এগুলো ব্যবহারকারীর অনলাইন অ্যানোনিমিটির দিকটাও নিশ্চিত করে। প্রাইভেসি, স্বাধীনতা আর অ্যানোনিমিটির বিষয়গুলো ঘনিষ্টভাবে পরস্পর বিজড়িত প্রসঙ্গ যে সে কথা বলা বাহুল্য বটে।
অনলাইন অ্যানোনিমিটি অথবা পরিচয়ের রাজনীতি
আমাদের আজকের নিওলিবারাল পৃথিবীতে ব্যক্তি-মানুষ এবং তার পরিবার-বন্ধুবান্ধব-গোষ্ঠী-পাড়া-গ্রাম-সমাজের ওপরে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রশক্তির দাপট এমনই বেড়েছে যে রাষ্ট্রীয় আইনের অভ্যাসের বাইরে আমরা নিজেদের মতো করে চিন্তা করতেই ভুলে গেছি। আমরা যেন রাষ্ট্র এবং তার পার্টনার-প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনের অবৈতনিক দালাল। হুকুমের গোলাম। সবাই আমরা এখন ইউরো-আমেরিকান পোষা কুকুর। গলায় পরিচয়ের বেল্ট ঝুলিয়ে নিজের অস্তিত্বের প্রামাণিকতা জাহির করতে হবে।
আমি বেঁচে আছি অথবা মরে গেছি – এর যেকোনোটা প্রমাণ করতে চাইলে আমাকে আদালতে যেতে হবে। উকিল ধরতে হবে। কাগজ লাগবে। টাকা লাগবে। মানুষের চেয়ে কাগজ বড়। মানুষের চেয়ে আইন বড়। দারোগা বড়। রাষ্ট্র বড়। রাষ্ট্র মাত্রেই এখন ‘হীরক রাজার দেশ’: ‘যার নাম নেই, তার কথার কোনো দাম নেই’। অথচ পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ চিরকালই, নমস্য হাসান আজিজুল হকের ভাষায়, ‘নামহীন গোত্রহীন’ ছিল।
আজ পরিবার-স্কুল-মিডিয়া-রাষ্ট্র সবাই মিলে আমাদেরকে এবং তাদের নিজে-দেরকেও তোতা পাখির বিদ্যা মুখস্ত করিয়ে শেষ করেছে। যা খবরের কাগজে লেখে না, তা চিন্তা করাও কঠিন। যা টিভিতে দেখায় না, এ জগতে তার অস্তিত্বই নাই। নাম-পরিচয়ের রাষ্ট্রচিন্তাই আজ আমাদের ব্যক্তি-চিন্তা। এখন আমরা অ্যানোনিমিটির কথা শুনলে আঁতকে উঠি। অনেকে জিজ্ঞেস করেন, আমি তো অপরাধী নই, আমার তো লুকানোর কিছু নেই, তাহলে আমি মিথ্যা-মিথ্যা ‘দুই-নম্বরি’ একটা নিক নাম গ্রহণ করতে যাব কেন? অপরাধচিন্তাই একমাত্র চিন্তা আমাদের। হয় তুমি অপরাধী, নয় তুমি পুলিশ। আমারা আমাদের সমাজকে অপরাধীদের সমাজে পর্যবসিত করেছি। এখানে সকলেই অপরাধী বা সম্ভাব্য অপরাধী।
অ্যানোনিমিটি জিনিসটা প্রাইেভসিরই বিশেষ একটা রূপ। ‘অ্যানোনিমিটি’ কথাটার গোড়ায় আছে গ্রীক শব্দ ‘অ্যানোনিমিয়া’, যার অর্থ ‘নামহীন’, তথা ‘নামহীনতা’। যেকোনো যোগাযোগ-পরিস্থিতিতে অ্যানোনিমিটি বা ‘নামহীনতা’ বলতে বোঝায় যোগাযোগকারীর নাম অপ্রদর্শিত থাকা। সফটওয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে নামহীনতার প্রয়োগ এমনভাবেও করা হতে পারে যাতে করে বার্তার উৎস ব্যক্তিকে শনাক্ত অত্যন্ত কষ্টসাধ্য বা অসম্ভব হয়ে ওঠে। নামহীনতার বিশেষ একটা রূপ হচ্ছে ছদ্মনাম গ্রহণ। এক বা একাধিক ছদ্মনাম গ্রহণ করার রেওয়াজ কবি-সাহিত্যিক আর বিপ্লবী লেখকদের মধ্যে বহু পুরোনো। অনেকের একাধিক ছদ্মনাম থাকতে পারে। একেক ধরনের যোগাযোগের জন্য একেকটা ছদ্মনাম ব্যবহৃত হতে পারে। সম্প্রতি মাইক্রোসফটের ইমেইল সার্ভিস আউটলুক বা হটমেইল গ্রাহকদেরকে অনেকগুলো করে ছদ্মনাম গ্রহণের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। একই ইমেইল অ্যাকাউন্ট আমি ব্যবহার করছি। কিন্তু একক জনের কাছে আমার ইমেইল ঠিকানাটা একেক নামে প্রদর্শিত হচ্ছে। এখনই আমি ‘মিনাজেল-উসিটেরন অ্যাট হটমেইল ডট কম’। আবার এখনই আমি ‘সেলিমরেজানিউটন অ্যাট হটমেইল ডট কম’। আবার এখনই ‘ইটইজফরবিডেনটুফরবিড অ্যাট হটমেইল ডট কম’।
এভাবে অনলাইন অ্যানোনিমিটির ক্রমবর্ধমান সামাজিক দাবি নীতিগতভাবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে মাইক্রোসফট। মাইক্রোসফটের এই অ্যানোনিমিটি অবশ্য লোকদেখানো-লোকঠকানো টাইপের দুধভাত-অ্যানোনিমিটি। কারণ, কম্পিউটার-কারিগরির দিক থেকে এই ধরনের ছদ্মনাম মোটেও কোনো নামহীনতার নিশ্চয়তা দেয় না। আপনার প্রকৃত পরিচয় এক্ষেত্রে কারিগরিভাবে শনাক্ত করাটা ডালভাত মাত্র। সত্যিকারের নামহীনতার জন্য দরকার টর, পিজিন, ওটিআর জ্যাবার, কে-মেইল, এপিজি প্রভৃতি সফটওয়ার। তাহলেও তারপরও মাইক্রোসফটের এই সেবা বলে দিচ্ছে, নামহীনতার দাবিকে অগ্রাহ্য করাটা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।
নীতিবোধগত-শ্রেয়োবোধগত বিচারে অ্যানোনিমিটি আদৌ কোনো অপরাধকর্ম নয়। নামহীনতার ধারণা ইন্টারনেটের আবিষ্কৃত কোনো ধারণা নয়। এ বস্তু বহু পুরাতন বস্তু। যেমন মহাভারত-রামায়ন-বেদ-পুরাণ-উপনিষদ কোন ব্যক্তির বা ব্যক্তিবর্গের লেখা তা তাঁরা জানিয়ে যান নি। সাহিত্যিক ‘উইলিয়াম শেক্সপিয়ার’ও সম্ভবত কোনো ছদ্মনাম। এ ব্যক্তির আসল নাম কী তা আজ আর জানার উপায় নেই (people.dsv.su.se/~jpalme/society/anonymity.html)। সমাজে-রাষ্ট্রে বহুকাল ধরে পরিচয়ের-অপরিচয়ের অনুশীলন স্বীকৃত। মানে নিজের পরিচয় নিজের বিবেচনাবোধ ও সিদ্ধান্ত মোতাবেক জানানোর বা না জানানোর অধিকার। এই অধিকার-অনুশীলন-দাবির বিরাট রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে।
নামহীনতার ব্যবহার ঘটতে পারে অনেক ধরনের প্রয়োজন পূরণের জন্য। সুপরিজ্ঞাত কোনো ব্যক্তি ছদ্মনামে বার্তা পাঠানোর প্রয়োজন বোধ করতে পারেন। তিনি হয়ত চান না যে ঐ বার্তা আগে থাকতেই তার নাম নিয়ে চাউর হোক। তাতে করে জনমনে নানা রকম ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে পারে। আমি যদি শিবিরকর্মী হই তাহলে ছাত্রলীগের ডেরায় গিয়ে বলি না যে আমি শিবিরের একনিষ্ঠ কর্মী। আমার পরিচয় এখানে জীবনের নিরাপত্তার সাথে জড়িত। রাবি’র নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক, বন্ধু বখতিয়ার আহমদ, পাহাড়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছে অনেক পাহাড়ী সম্প্রদায় বাংলাদেশ, বার্মা, ভারত রাষ্ট্রসমূহের নানান সংস্থা ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীসমূহের হয়রানির হাত থেকে বাঁচতে এবং নিজেদের জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে একাধারে বাংলাদেশী, ভারতীয় ও বর্মী পরিচয় বহন করে। যেখানে যেটা প্রয়োজন সেখানে সেটা ব্যবহার করে। সমাজবিজ্ঞানীরা বা ব্যবসায়িক-বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানসমূহ বা সরকার বা এনজিওরা যখন সামাজিক জরিপ পরিচালনা করেন তখন তাঁরা উত্তরদাতাদের নাম-পরিচয় অজ্ঞাত রাখার সুযোগ দেন অবারিতভাবে। এই নামহীনতা বা অ্যানোনিমিটি ছাড়া তাদের জরিপের উদ্দেশ্য বৃথা যাওয়ার সম্ভাবনা। এ ছাড়া সাংবাদিকদেরকে বা পুলিশকে স্বেচ্ছায় গোপন তথ্য-সূত্র-ইশারা প্রদানকারী অনেক মানুষ নিজেরা নামহীন বা অ্যানোনিমাস থাকতে চান। পুলিশ এবং সাংবাদিকদেরকে সেটা মেনে নিতে হয় তো বটেই, সেই নামহীনতাকে রক্ষা করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হয়।
ডাক্তার-উকিল-বিচারক-ধর্মযাজকদেরকে অনেক মানুষের অনেক ব্যক্তিগত তথ্য ও নাম-পরিচয় গোপন রাখতে হয় পেশাগত সততার স্বার্থেই। অনেক দেশেই এইসব তথ্য-পরিচয় গোপন রাখাটা আইনের চোখে আবশ্যক শর্ত। অনেক চার্চে যাজকের সামনে ব্যক্তির ‘পাপের স্বীকারোক্তি’ বা কনফেশনের জন্য আলাদা বুথ বা কাউন্টার থাকে। সেখানে যাজক ব্যক্তিটিকে সরাসরি দেখতে পান না। এও তো নামহীনতাই বটে। আর সংবাদপত্রে বক্তিগত বিজ্ঞাপনের কলামে বা এমনকি চিঠিপত্রে বা এমনকি সম্পাদকীয় নিবন্ধে বা এমনকি খোদ সম্পাদকীয়তে নামহীনতার চর্চা অথবা ছদ্মনামের চর্চা তো রীতিমতো পুরোনো প্রথা।
আবার আমাদের সুমহান সংসদীয় গণতন্ত্রেও ভোটাররা ভোট দেন নিজেদেরকে নামহীন রেখেই। এই নামহীনতা তাদের মতের নির্ভিক ও নিরাপদ প্রকাশের নিশ্চয়তা দেয়। অন্য দিকে, সুপ্রাচীন কাল থেকে যারা দানখয়রাত-পরোপকার করে আসছেন, সেইসব হিতৈষী ব্যক্তিরা প্রায়শই নামহীনতার নিশ্চয়তা চান। পবিত্র ধর্মগ্রন্থেও আছে: ‘ডান হাত দান করলে যেন বাম হাত জানতে না পারে’। অ্যানোনিমিটি এসব ক্ষেত্রে অনিবার্য শর্ত প্রায়। বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের বা মাফিয়াদের বা রাষ্ট্রের বা সামরিক বাহিনীর বা কোনো কর্পোরেট-গোষ্ঠীর গুরুতর দুর্নীতির কথা উন্মোচন করে দিতে হলে ব্যক্তিকে অবশ্যই নামহীনতার আশ্রয় নিতে হয়। হুইসল ব্লোয়ারদের জন্য অ্যানোনিমিটি তাই অপরিহার্য। এজন্যই উইকিলিকস তাদের সংবাদ-সূত্রদের অ্যানোনিমিটির পূর্ণাঙ্গ নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করেছে এনক্রিপ্টেড সফটওয়ারের সাহায্যে। কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কেই কোনো ক্ষমতাহীন ব্যক্তির পক্ষে সবসময় স্বনামে সমালোচনা করা সম্ভব হয় না। এসব ক্ষেত্রে নামহীনতার প্রযুক্তির কোনো বিকল্পই নেই।
অনেক দেশ আছে যেখানে বাকস্বাধীনতা নেই। মতপ্রকাশের নিরাপত্তা নেই। সত্য প্রকাশের অধিকার নেই। সেই সব দেশের বিবেকবান মানুষদেরকে মতপ্রকাশ, সত্যপ্রকাশ, বাকপ্রকাশের কারণে নিগৃহীত হতে হয়। কারাগারে যেতে হয়। চাকরি হারাতে হয়। নির্বাসিত হতে হয়। এমনকি মৃত্যুবরণও করতে হয়। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইরান, ইসরায়েল, বাংলাদেশ প্রভৃতি রাষ্ট্র। এসব রাষ্ট্রে আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে নামহীনতার গুরুত্ব অপরিসীম।
নামহীনতা বা প্রাইভেসির ব্যাপারগুলো এসব ক্ষেত্রে লজ্জাজনক গোপনীয়তা লুকানোর আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটায় না। নামহীনতার ধারণা এখানে সবসময়ই মতামতের মুক্তপ্রকাশ এবং অধিকতর গণতন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাপার হিসেবে বিবেচিত হয়। একইভাবে অনেক দেশের মানবাধিকার কর্মীদেরকে, বার্মার ভিন্নমতাবলম্বী গেরিলাদেরকে, অথবা ভারতের আদিবাসী মাওবাদী গেরিলাদেরকে, কিংবা মেক্সিকোর জাপাতিস্তা-আন্দোলনের কর্মীদেরকে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয় পুরোপুরি নামহীন প্রযুক্তিসমূহের সাহায্যে। এ ছাড়া অত্যাচার-বিভীষিকার হাত থেকে বাঁচার উপায় নেই।
নামহীনতার নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত, ডায়াস্পোরার মতো, অনলাইন সামাজিক ফোরামে মানুষ অনেক বেশি মন খুলে নিজের মত প্রকাশ করতে পারে। এইসব ক্ষেত্রে আলোচনাকারী সহজেই এক ধরনের পারস্পরিক সমতা অনুভব করতে পারে। নামহীন বার্তার মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মূল্যায়নকারীকে অনেক স্বচ্ছন্দে থাকতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের ব্যাপারটিও এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে। পরীক্ষার খাতায় শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রকৃত নাম লিখতে পারেন না। খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পক্ষপাতহীনতা বজায় রাখার জন্য এখানে অ্যানোনিমিটি বা নামহীনতার ব্যবহার।
কাউকে উপদেশ দেওয়া আমার খাসলতের মধ্যে পড়ে না। সকলেই নিজের নিজের কাজ বোঝেন। কিন্তু আমি নিজে নিজে ভাবি। আমার মনে হয়, টর ব্রাউজারের সাহায্যে ডায়াস্পোরা জাতীয় সামাজিক নেটওয়ার্কে সত্যিকারের অ্যানোনিমিটির সাহায্যে মতপ্রকাশ করলে রাজীব হায়দার, আসিফ মহিউদ্দিন, মশিউর রহমান বিপ্লব, রাসেল পারভেজ, সুব্রত অধিকারী শুভ এবং শফিউর রহমান ফারাবীদের মতো তরুণ ব্লগারদেরকে হয়ত রাষ্ট্রীয়-বিরাষ্ট্রীয় হত্যা-জেল-জুলুম- নিপীড়নের স্বীকার হতে হতো না।
এঁরা কে কোন পক্ষের মতাদর্শ অনুসরণ করেন, না করেন। তা এখানে আমার বিবেচ্য না। আমার কাছে মতাদর্শের চেয়ে মানুষ বড়। এঁরা ব্লগে ভালো কথা লিখেছেন, না খারাপ কথা লিখেছেন, সেগুলোর সাথে আমি একমত, নাকি একমত নই, তা অবশ্য এখানে আলোচ্য নয়। তা নিয়ে আমি অন্যত্র[3] লিখেছি। আমার কাছে প্রধান প্রশ্নটা হলো, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অবাধ ও নিরাপদ করার ক্ষেত্রে অ্যানোনিমিটির কোনো শক্তিশালী ভূমিকা আছে কিনা তা বিবেচনা করা।
এই ধরনের ক্ষেত্রে নামহীনতার অনলাইন প্রযুক্তি ব্যবহারের বিকল্প নেই। ইতোমধ্যে যে নিপীড়নধর্মী, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিরোধী তথ্য-প্রযুক্তি-আইন সরকার পাশ করতে যাচ্ছে তা পার পেয়ে গেলে আমাদের অনেককেই নামহীনতার আশ্রয় নিতে হবে যে তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
নামহীনতা ব্যক্তিমানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত তো করেই। এ ছাড়াও তা সার্বক্ষণিক রাষ্ট্রীয়-প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারির হাত থেকে নাগরিকদেরকে রক্ষা করতে পারে। আবার ইন্টারনেটে ব্যবহারীকারীদের আচার ব্যবহার প্রয়োজন অপ্রয়োজন ইত্যাদি প্রভৃতিকে মনিটর করতে থাকে বাণিজ্যিক ও বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানগুলো। এদের হাত থেকে সুরক্ষা পাওয়ারও একটা অ্যানোনিমিটি বৈকি।
মোট কথা হলো: গুলি-বন্দুক-ছুরি-ফরসেপ-বটি-কাঁচি-ক্ষুরের মতো, কিংবা রাসায়নিক দ্রব্যাদির মতো, এবং এমনকি ওষুধপত্রের মতো অ্যানোনিমিটি বা নামহীনতারও সুপ্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগ থাকতে পারে। সেটা যার যার বিবেচনার ব্যাপার। তার জন্য তো খোদ ডাক্তারিবিদ্যা-ছুরি-ফরসেপ-বটি, রাসায়নিক দ্রব্যাদি, ওষুধপত্র, অথবা খোদ নামহীনতার ধারণাকে দোষারোপ করার বা অবৈধ প্রতিপন্ন করার বা অপরাধকর্মে পর্যবসিত করার কোনো সুযোগ নেই।
প্রাইভেসি এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একেবারে প্রাথমিক বা মৌলিক মানবাধিকারের মধ্যে পড়ে। যাবতীয় প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চুক্তি ও মুসাবিদায় এইসব অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা’র আর্টিকেল ১২ এবং আর্টিকেল ১৯ এর কথা। বলা যায় ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস’ এর ১৭ এবং ১৯ নম্বর আর্টিকেলের কথা। এ ছাড়া, ‘ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস’ এর ৮ম ও ১০ম অনুচ্ছেদের কথাও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। (দ্রষ্টব্য: ইয়ামান অ্যাকডেনিজ, ‘অ্যানোনিমিটি, ডেমোক্রেসি অ্যান্ড সাইবারস্পেস’, সোশ্যাল রিসার্চ, খণ্ড ৬৯, সংখ্যা ১, বসন্ত ২০০২।)
এক দিক থেকে দেখলে, নামহীনতা সবসময়ই যোগাযোগের ক্ষেত্রে অধিকতর সুযোগ তৈরি করে। আবার নামহীনতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে যোগাযোগ-বার্তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আইনের দ্বারা অনলাইন নামহীনতাকে নিষিদ্ধ করে দেওয়াটা এই মুশকিলের ভালো সমাধান হতে পারে না। এই সমস্যার সমাধানে এরই মধ্যে ‘অনলাইন রেপুটেশন’ নামে একটি ধারণা গড়ে উঠেছে। অনলাইন রেপুটেশন কোনো একটি ছদ্মনামের বিশ্বস্ততা পরিমাপের একটি পদ্ধতি। এর জন্য নানারকম সফটওয়ার-প্রযুক্তির অবতারণাও ঘটছে। (নামহীনতার প্রয়োজনের ও বিপদের দিক নিয়ে, এবং প্রাইভেসি ও নামহীনতা সংক্রান্ত মৌলিক মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনকানুন নিয়ে, বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: ইয়ামান অ্যাকডেনিজ, ‘অ্যানোনিমিটি, ডেমোক্রেসি অ্যান্ড সাইবারস্পেস’, সোশ্যাল রিসার্চ, খণ্ড ৬৯, সংখ্যা ১, বসন্ত ২০০২।)
নামহীনতা ব্যাপারটা আসলে আর কিছু না। বাধ্যতামূলক পরিচয় প্রকাশের রাষ্ট্রীয়-কর্তৃত্বতান্ত্রিক বন্দোবস্তকে মোক্ষমভাবে চ্যালেঞ্জ করে বসে এই ধারণাটা। এটাই আসলে কর্তৃত্বতন্ত্রের চোখে ‘নামহীনতা’ নামক ধারণাটিকে বিপজ্জনক করে তুলেছে। মহাকেন্দ্রীভূত, অতি-শক্তিশালী রাষ্ট্র-কর্পোরেট ক্ষমতাকাঠামোর মুখে ব্যক্তিমানুষকে নিতান্তই বিপন্ন করে তুলতে পারে বাধ্যতামূলক পরিচয় প্রকাশের এই রাষ্ট্র-কর্পোরেট বন্দোবস্ত ।
প্রসঙ্গত, প্রাইভেসি বা অ্যানোনিমিটি মানে কিন্তু শুধু অপ্রকাশের স্বাধীনতাই নয়। প্রকাশের স্বাধীনতাও বটে। প্রাইভেসি বা অ্যানোনিমিটি মানে আমার সম্পর্কে আমি নিজে কতটা প্রকাশ করতে চাই, এবং কতটা প্রকাশ না করতে চাই, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা। খোদ স্বাধীনতা মানে কিছু করার স্বাধীনতা তো বটেই, চাইলে কিছু না করারও স্বাধীনতা। সুতরাং কোথায় কতটা আমি আমার পরিচয় প্রকাশ করব অথবা করব না, তাকে নিতান্তই আমার নিজের এখতিয়ারভূক্ত ব্যাপার বলে ভাবার গুরুত্ব আছে।
মার্কিন সাম্রাজের পতনের শব্দ
ফিসা-আদালতের আদেশের কপি ছাড়াই যেমন তা দেওয়ালে পড়তে পারা যাচ্ছে বলে জিমারম্যান জানালেন, তেমনি আরও একটা ভবিষ্যতলিপি স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। সে লিপি ফুটে উঠছে ইতিহাসের দেওয়ালে। সেখানে লেখা আছে: যুক্তরাষ্ট্রকে বন্দি করছে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই। বলশেভিক রাশিয়ার মতো আত্ম-অবরুদ্ধ দেশ হয়ে পড়ছে আজকের যুক্তরাষ্ট্র। এটা আরেকটা উত্তর কোরিয়া, আরেকটা চীনে পরিণত হচ্ছে। নিজের নাগরিকদেরকেই নজরবন্দি করতে হচ্ছে তাকে। নাগরিকদের জামাকাপড়-অন্তর্বাস-মোজা খুলে তল্লাশি করতে হচ্ছে তাদেরকে। নিজের দেশের প্রতিটা নাগরিকই সাম্রাজ্যের সম্ভাব্য শত্রু আজ। নিজ দেশের হুইসলব্লোয়ারদের ভয়ে প্রকারান্তরে সংকুচিত হয়ে পড়ছে মার্কিন এস্টাবলিশমেন্টের অভ্যন্তরিন যোগাযোগ-পরিধি, কর্তৃত্ব প্রয়োগের সক্ষমতা।
মনে পড়ছে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ২০০৬ সালে লেখা ‘কন্সপিরেসি অ্যাজ গভর্ন্যান্স’ নামের ছয় পাতার প্রফেটিক থিসিস। সেখানে তিনি নেটওয়ার্ক-বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন, হুইসল ব্লোয়ারদের সম্ভাব্য ‘উন্মোচন’গুলো কীভাবে আতঙ্কিত করে ফেলবে সাম্রাজ্যের শাসকদেরকে। ‘লিক’ বা উন্মোচনের ভয়ে কমে যাবে তাদের যোগাযোগের পরিসীমা, সেই সাথে কর্মপরিধি। ক্রমাগত অক্ষম হয়ে পড়তে থাকবে সাম্রাজ্য। মাত্র সাত বছরের মধ্যেই বাস্তবায়িত হতে চলেছে অ্যাসাঞ্জের সেই প্রফেটিক থিসিস। ফুরিয়ে আসছে সাম্রাজ্যের অবাধ, অসীম সক্ষমতা। ফুরিয়ে আসছে সাম্রাজ্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের দিন। এসব তারই লক্ষণ।
আরো মনে পড়ছে, তাঁর নিজের ব্লগে (‘আইকিউ ডট অর্গ’) সম্ভবত ঐ বছরই জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ লিখেছিলেন ছোট্ট একটা নোট: ‘ইউনাইটেড স্টেটস অফ হোয়াট?’ মার্কিন বাণিজ্য-কর্পোরেটগুলোর সাথে বলশেভিক রাশিয়ার বেশ কিছু তাক লাগানোর মতো সাদৃশ্য নির্দেশ করে সেখানে তিনি বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-কর্পোরেটগুলো আসলে একেকটা ছোট ছোট বলশেভিক সোভিয়েত। ‘ইউএসএ’ নামটার অর্থ তাই ‘ইউনাইটেড সোভিয়েটস অফ আমেরিকা’। এখন এই ২০১৩ সালে এসে বোঝা যাচ্ছে, জার- বলশেভিক রাশিয়ার পরিণতিই বরণ করতে চলেছে ইউএসএ।
সাম্রাজ্য নয়, স্বাধীনতা
সার্বিক পরিস্থিতি আতঙ্কজনক। লাভাবিট, সাইলেন্ট সার্কেল এনএসএ, এবং এডওয়ার্ডের স্নোডেনের ঘটনাক্রম এক মারাত্মক হুঁশিয়ারি-সংকেত। ইন্টারনেটের ওপর নেমে আসছে ভয়ংকর প্রত্যক্ষ আঘাত। কেউ রেহাই পাবেন না। কোনো প্রকার ভিন্নমত সহ্য করবে রাষ্ট্রকর্পোরেট সাম্রাজ্য। কেননা ইন্টারনেট বাঁচলে এবং স্বাধীন থাকলে রাষ্ট্র, কর্পোরেশন, আইন- আদালত, আমলাতন্ত্র, আর্মি— তথা খোদ ‘এম্পায়ার’ বর্তমান কাঠামোকে মৌলিকভাবে সংস্কার না করে কিছুতেই টিকে থাকতে পারবে না। স্বাধীন ইন্টারনেট থাকলে সাম্রাজ্য থাকবে না। টিকবে না বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো। সুতরাং ইন্টারনেটকে তারা নজরবন্দি করবে। খোঁয়াড়ে ঢোকাবে। যেভাবে সম্ভব।
সাম্রাজ্যিক শাসকরা আতঙ্কিত। অন্যের রক্ত চুষে আরামে বসে ভোগবিলাসের দিন তাদের বিগতপ্রায়। এটা তারা টের পাচ্ছেন হাড়ে হাড়ে। তাই তারা ইন্টারনেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইনের দোহাই দিয়ে কোটি কোটি মানুষের জ্ঞান-প্রাইভেসি-প্রকাশ- সৃজন-যোগাযোগের সহজাত স্বাধীন স্পৃহাকে ধ্বংস করে দেওয়া যায় না। এটা জ্ঞান-বিজ্ঞান-অভিজ্ঞতা-অভিজ্ঞান-উপলব্ধি-প্রকাশ ও শেয়ারিং থেকে বঞ্চিত করবে গোটা মানবজাতিকে। এ হবে আত্মিক-সাংস্কৃতিক-আধ্যাত্মিক গণআত্মহত্যার শামিল। সেক্ষেত্রে ইন্টারনেট হবে ডিজিটাল দাসদের জন্য আইনসঙ্গতভাবে নির্ধারিত একটা সংকীর্ণ খোঁয়ার। কর্পোরেট-বাজারের খোঁয়ার। রাষ্ট্রীয় আমলাদের কাছে বাধ্যতামূলক বশ্যতার খোঁয়ার। থাকবে না আপনার যোগাযোগের স্বাধীনতা। থাকবে না পছন্দের স্বাধীনতা। থাকবে না নিজের মতো করে নিজেকে প্রকাশের বা অপ্রকাশের স্বাধীনতা।
তাই ইন্টারনেটের স্বাধীনতাকে, যোগাযোগের স্বাধীনতাকে বাঁচাতে না পারলে দমে যাবে কোটি মানুষের আত্মকর্তৃত্বের জায়মান চাকা। আমরা একটা নিখুঁত টাইপের ডিজিটাল দাসপ্রথায় প্রবেশ করতে শুরু করব। ধীরে ধীরে। অবধারিত-ভাবে। আমরা অনেকে আমাদের স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিয়ে নিরাপদ এবং অনিশ্চয়তাহীন সামাজিক দাসত্বকে ভালোবেসে মেনে নিতে পারি বৈকি। তবে, সবাই তাতে রাজি হবে না। ফেসবুক ইয়াহু জিমেইল হটমেইল লাইভ আউটলুক ইউটিউব স্কাইপ মাইক্রোসফট অ্যাপল এবং গুগল মেনে নিয়েছে গোপন আদালতের আদেশ। কিন্তু লাভাবিট মানে নি। সাইলেন্ট সার্কেল মানে নি। আরো অনেকেই মানবে না।
ইতোমধ্যে ফুটে উঠছে খোদ মার্কিন জনসাধারণের গণপ্রতিরোধের সুনির্দিষ্ট সব লক্ষণ। ফিসা-আদালতের বিরুদ্ধে লাভাবিট লড়তে যাচ্ছে ফোর্থ সার্কিট আপিল আদালতে। অত্যন্ত শক্তিশালী এই ফেডালের কোর্ট ১৩টা মার্কিন আপিল আদালতের মধ্যে অন্যতম। আদালতে লড়াইয়ের জন্য লাভাবিটের আইনী তহবিলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মার্কিন জনসাধারণ জমা দিয়েছেন ৯০,০০০ মার্কিন ডলার। লাভাবিট জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। লাভাবিট জয়ী হলে সেটা হবে যোগাযোগের স্বাধীনতার জয়।
একের পর এক নিরাপদ ইমেইল সার্ভিস বন্ধ করে দিয়ে শেষ রক্ষা করতে পারবে না সাম্রাজ্য। রাষ্ট্র-ডেভিলের রক্তচক্ষুকে কলা দেখিয়ে নিরাপদ যোগাযোগের পথ আছে আরো। আছে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, ফিল জিমারম্যানদের টিমোথি মে, এডওয়ার্ড পি. বার্লোদের গড়ে তোলা ‘সাইফারপাঙ্কস’দের পথ – ক্রিপ্টো অ্যানার্কির পথ (ক্রিপ্টো অ্যানার্কি সম্পর্কে দ্রষ্টব্য: পিটার লাডলো, ২০০১)। সাইলেন্ট মেইলবন্ধ করে দেওয়ার পর সিকিউরিটি-গুরু ফিল জিমারম্যান বলেছেন, ভবিষ্যতের তাঁরা গ্রাহকদের জন্য আরো সফিস্টিকেটেড সার্ভিস নিয়ে আসবেন। নতুন নতুন পথ বেরুবে। বোঝা যাচ্ছে।
ইন্টারনেটের কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ নাই। এটা কোনো রাষ্ট্রের সম্পত্তি না। এটা কোনো বাদশাহর সাম্রাজ্য না। এটা চলে স্বাধীনতা, স্বনিয়ন্ত্রণ এবং পরস্পর সহযোগিতার নীতিতে। সাম্রাজ্যিক আমলাদের মুসাবিদা করা আইনের হুকুমে ইন্টারনেট চলতে পারে না। ইন্টারনেট মানবজাতির সম্পদ। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বারের মতো এটা মানবজ্ঞানের অসীম ভাণ্ডারকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। দেশ-রাষ্ট্র-জাতি-ধর্ম-ভাষা ও কালের ক্ষুদ্র গণ্ডীকে ছাড়িয়ে এই প্রথম স্বাধীন বিশ্বমানব হয়ে উঠছে হোমো স্যাপিয়েন্স। তার আর কোনো মোল্লা-মোড়ল-মুরুব্বি দরকার নাই। ভবিষ্যত সাম্রাজ্যের নয়, মনুষ্য-স্বাধীনতার।
অন্তটীকা
[১] দ্রষ্টব্য: বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, সুবলচন্দ্র মিত্রের ‘সরল বাঙ্গালা অভিধান; হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়, ১৯৯৬-খ: ১৯০৭।
[২] গুস্তাভ ল্যানডাওয়া’র বই রেভোল্যুশন অ্যান্ড আদার রাইটংস (গুস্তাভ ল্যান্ডাওয়া, ২০১০)-এর অন্যতম প্রবন্ধ ‘উইক স্টেটসমেন, উইকার পিপল’-এ এই সংক্রান্ত আলোচনার অতিশয় তাৎপর্যপূর্ণ ঈঙ্গিত আছে।
[৩] এই বইয়ের ‘স্বাধীনতা সহিষ্ণুতা সংগঠন’ নামের ২৬-সংখ্যক রচনার কথা বলা হচ্ছে।